ময়ূরকণ্ঠি জেলি

ময়ূরকণ্ঠি জেলি

শশাঙ্ক টেবিলের উপর থেকে খাতাটা তুলে নিল।

নীল মলাটের ছোট সাইজের সাধারণ নোটবুক! দাম বোধহয় আজকের দিনে আনা আষ্টেক। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে শশাঙ্ক এরকম নোটবুক ব্যবহার করেছে, তখন দাম ছিল দুআনা। মনে আছে তখন হঠাৎ ডায়রি লেখার শখ হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ ডায়রির পাতায় কুলিয়ে উঠত না, কারণ শশাঙ্ক কেবল দৈনন্দিন কার্যকলাপের বর্ণনাই লিখত না। সে সম্পর্কে দার্শনিক মন্তব্য, আপন চিন্তাভাবনার বিশ্লেষণ, এমনকী মাঝে মাঝে রাত্রে দেখা স্বপ্নের বিবরণ পর্যন্ত লিখে অস্তিত্বের ব্যাপারটাকে একটা সাহিত্যিক মর্যাদা ও স্থায়িত্ব দেওয়ার প্রবৃত্তি তখন শশাঙ্কর মনে জেগেছিল।

কিন্তু অভ্যাসটা এক বছরের বেশি টেকেনি। একাগ্রতা জিনিসটা শশাঙ্ককে চিরকালই এড়িয়ে গেছে–যে কারণে মেধাবী ছাত্র হয়েও পরীক্ষায় চমকপ্রদ ফললাভের সৌভাগ্য থেকে সে চিরকালই বঞ্চিত হয়েছে। যাকে বলে গুড সেকেন্ড ক্লাস শশাঙ্কর স্থান আজীবন সেই পঙক্তিতেই রয়ে গেছে। তার ডায়রিটিও শশাঙ্ক হারিয়ে ফেলেছে কবে কীভাবে তা মনে নেই।

এ খাতাটা অবিশ্যি দিনপঞ্জি নয়। শশাঙ্ক প্রথম পাতাটার দিকে চাইল। সরু কলমে কালো কালিতে yang Pet C. 971–Some Notes on Longevity-P. Sarkar, 14 July, 1970.

প্রদোষের খাতা। প্রদোষের জিনিয়াসের সর্বশেষ নিদর্শন। খাতার অর্ধেক পাতায় কালির আঁচড় পড়েনি। আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে তার শেষ কথা প্রদোষ বলে যেতে পারেনি। ১৯৭১ সনের ১৭ই ডিসেম্বর বিয়াল্লিশ বছর তিন মাস বয়সে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে প্রদোষের মৃত্যু হয়। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বায়োকেমিস্ট হিসেবে প্রদোষ তার জীবনের শেষ দুটি বছর কোন বিশেষ গবেষণায় লিপ্ত ছিল, সে সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক মহলে অনেক জল্পনা কল্পনা হয়েছিল, কিন্তু তার কোনও সঠিক সন্ধান পাওয়া যায়নি।

আজ সে সন্ধান জানে কেবল একটিমাত্র ব্যক্তি–শশাঙ্কশেখর বোস।

আপনি বাবার বন্ধু ছিলেন, তাই মা-র ইচ্ছে আপনি বাবার কাগজপত্রগুলো দেখে, সেগুলোকে গুছিয়ে-টুছিয়ে যদি একটা…মানে…

প্রদোষের চৌদ্দ বছরের ছেলে মণীশ ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝাতে না পারলেও, শশাঙ্কর বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। প্রদোষের কাগজপত্রের অবিন্যস্ত সম্ভারে শৃঙ্খলা আনয়ন, তার অপ্রকাশিত রচনাবলীর একটি তালিকা প্রস্তুত করায় শশাঙ্কর কোনও আগ্রহের অভাব ছিল না। প্রদোষের জীবদ্দশায়, কলেজে সহপাঠের সময় থেকেই শশাঙ্ক প্রদোষের প্রতি আকৃষ্ট হয়েও তাকে ঈর্ষা না করে পারেনি। প্রথমে ঈর্ষা করেছে তার মেধাকে, পরে তার খ্যাতি ও লেখনীশক্তিকে।

ঈর্ষার আরেকটি কারণ–নিভা মিত্রকে প্রদোষের পত্নীরূপে লাভ। অধ্যাপক ভাস্কর মিত্রের কন্যা নিভার সঙ্গে দুই বন্ধুরই একসঙ্গে আলাপ হয় অধ্যাপকের বাড়িতেই। অপেক্ষাকৃত সুপুরুষ হয়েও একদিনের আলাপেই শশাঙ্ক প্রদোষের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় কারণ নিভার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ক্ষণিকের আলাপেই মানুষের বাইরের আবরণ ভেদ করে অন্তরের রূপটি ধরে ফেলার।

তিন মাস কোর্টশিপের পর নিভর সঙ্গে প্রদোষের বিবাহ হয়। প্রদোষ বলেছিল, খ্রিস্টান বিয়ে হলে তোকে বেস্টম্যান করতুম।শশাঙ্ক নিজে আর বিয়ে করেনি। না করার কারণ তার নিজের কাছে স্পষ্ট–নিভাকে সে ভুলতে পারেনি। এমন অন্য কোনও মেয়েও তার চোখে পড়েনি যে, স্মৃতি তার মন থেকে মুছে ফেলতে পারে।

কিন্তু আজ যখন প্রদোষ মৃত, তখন তো আর ঈর্ষার প্রশ্ন ওঠে না। তাই মণীশের অনুরোধ শশাঙ্ক ঠেলতে পারেনি। প্রদোষের বাড়ির তিনতলার পূর্ব দিকের স্বল্পায়তন ঘরটিতে বারোদিন অহোরাত্র পরিশ্রম করে শশাঙ্ক তার পরলোকগত বন্ধুর লেখা প্রবন্ধগুলি রচনাকাল অনুযায়ী ধারাবাহিক ভাবে সাজিয়ে দিয়েছিল।

নীল নোটবইটি চোখে পড়ে অষ্টম কিংবা নবম দিনে। একটি বুক শেলফের সবচেয়ে উপরের তাকে মেচনিকফের একটা বইয়ের পিছনে খাতাটি আত্মগোপন করে ছিল। মনে পড়ে, খাতাটি পেয়ে এবং তার বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত পেয়ে উত্তেজনায় শশাঙ্কর শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়েছিল। আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে প্রদোষের এ-গবেষণার কথা কেউ জানে না–এমনকী প্রোফেসর বাগচিও না। প্রদোষকে নিয়ে বাগচির সঙ্গে শশাঙ্কর আলোচনা হয় প্রদোষের মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই। বাগচি তখন বলেন, কিছুদিন থেকেই প্রদোষ যেন কী একটা ভাবছে। এটা তার অন্যমনস্কতা থেকেই বুঝেছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। তোমায় কিছু বলেছে কি?…

বাগচি তাঁর তেইশ বছরের অধ্যাপক জীবনে প্রদোষের মতো ছাত্র পাননি। প্রদোষ যে অনেক আগেই অনেক বিষয়েই তার শিক্ষককে অতিক্রম করে গিয়েছে, সেটা বাগচি নিজেও স্বীকার করতেন। বাগচির গভীর বিশ্বাস ছিল যে, বায়োকেমিস্ট্রির জগতে প্রদোষ কোনও একটা যুগান্তকারী অবদান রেখে যাবে। তাই তার ভাবনাচিন্তা গবেষণা ইত্যাদি সম্পর্কে বাগচির কৌতূহল ছিল অপরিসীম। কিন্তু বাগচি এই খাতাটি সম্পর্কে জানতেন না।

বাগচি ছাড়া আর যে দুজনের জানার সম্ভাবনা ছিল, সে হল শশাঙ্ক নিজে এবং প্রদোষ ও শশাঙ্কর বন্ধু অমিতাভ। অমিতাভ আজ পাঁচ বছর হল লন্ডনের ফ্রীডম্যান ল্যাবরেটরিজ-এর কাজ নিয়ে দেশছাড়া। তাই খাতার ব্যাপারটা তার কাছেও অজ্ঞাত বলে অনুমান করা যেতে পারে।

খাতাটি পাওয়ার পরেও শশাঙ্ককে সেটি পড়ার লোভ সংবরণ করতে হয়েছিল কয়েকদিন, কারণ প্রদোষের রচনা নির্বাচনের কাজ তখনও শেষ হয়নি। বারোদিনের দিন কাজ শেষ হবার পর খাতাটি আদ্যোপান্ত পড়ে নিয়ে শশাঙ্ক প্রফেসর বাগচিকে তাঁর অনুরোধ অনুযায়ী খবর দিল।

আপনি এবারে আসতে পারেন স্যার। আমার কাজ খতম।

সাকসেসফুল?

আসুন। এসে দেখুন!

আই উইল বি দেয়ার ইন অ্যান আওয়ার।

টেলিফোন রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিভা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। রোজই এই সাড়ে চারটের সময় নিভা তাকে চা এনে দিয়েছে, এবং রোজই এই মুহূর্তটিতে শশাঙ্ক একটা হৃৎস্পন্দন অনুভব করেছে। নিভা থান পরে না। তার পরনের সরু কালো পাড়ের মিলের শাড়ি তার অজ্ঞাতসারেই যেন তার রূপকে একটি স্নিগ্ধ আভিজাত্য দান করেছে।

কাজ শেষ?

হ্যাঁ।

কত পরিশ্রম করলেন আপনি!

সব সার্থক। আশ্চর্য সব লেখা আবিষ্কার করেছি।

কেন জানি শশাঙ্ক ঠিক এই মুহূর্তে নীল খাতাটির কথা আলাদা করে বলতে পারল না নিভাকে। কিন্তু সত্য গোপন করা তো আর মিথ্যাভাষণ নয়–আর সত্য উদঘাটনের সময় তো পড়েই আছে সামনে। বাগচি এলে তখন তো কথা হবেই।

নিভাকে দেখে একটি প্রশ্নই কেবল শশাঙ্কর মনে জাগে। সে কি বিয়ে করে সুখী হয়েছিল? এ কদিনে এতবার দেখেও শশাঙ্ক এ-প্রশ্নের উত্তর পায়নি। কিন্তু প্রদোষকে বিবাহ করে সে সুখী হয়নি, এমন সন্দেহ তার মনে উদয় হবে কেন? জিনিয়াসের স্ত্রীর জীবনে শূন্যতা থাকতে বাধ্য, এমন একটা প্রচলিত বিশ্বাসই কি এই সন্দেহের উৎস?

বাগচি এলেন প্রায় ছটা।

কীরকম বুঝেছ হে?

রিমার্কেবল। যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি। রচনার সংখ্যাও বেশি, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যও যা আন্দাজ করেছিলাম তার চেয়ে বেশি।

আমি একটা মেমোরিয়াল ভলমের কথা ভাবছি। সেটা হল ইমিডিয়েট কাজ। তোমার সাহায্য চাই–বলাই বাহুল্য।

শশাঙ্কর প্যান্টের ডান পকেটে সেই নীল খাতা। মানুষের আয়ুবৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে যুগান্তকারী গবেষণা।

পশ্চিমের আধুনিকতম গবেষণা ও প্রাচ্যের সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদিক জ্ঞানের সংমিশ্রণে লব্ধ এলিক্সির অফ লাইফ, অথবা আয়ুবৃদ্ধিকর ড্রাগ প্রস্তুত প্রণালীর বর্ণনা। প্রদোষের মতে এই ড্রাগ ইঞ্জেকশনের ফলে মানুষ বাঁচবে অন্তত দেড়শো বছর। ব্যক্তিবিশেষের মেটাবলিজম অনুযায়ী আয়ুর তারতম্য হবে অবশ্যই–তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দুশো-আড়াইশো বছর বাঁচাও অসম্ভব নয়। এই ড্রাগের অবশ্যম্ভাবী সাফল্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছে প্রদোষ।

শশাঙ্কর ডান হাতটা অন্যমনস্ক ভাবেই তার প্যান্টের ডান পকেটে প্রবেশ করল।

বাগচি এতক্ষণ প্রদোষের লেখাগুলি নেড়েচেড়ে দেখছিলেন।

১৯৭০ পর্যন্ত ওর কাজের ও চিন্তাধারার বেশ একটা ধারাবাহিক ছবি পাওয়া যাচ্ছে হে।

হ্যাঁ স্যার।

কিন্তু এই কি সব? আর কোনও খাতা নেই?

শশাঙ্কর হঠাৎ গরম লাগছে। সে হাতের কাছে পাখার রেগুলেটারটা তিন থেকে পাঁচের ঘরে ঠেলে দিল।

বাগচি আবার বললেন, তুমি সব জায়গায় খুঁজে দেখেছ?

নিভা আবার ঘরে এসেছে। এবার প্রফেসর বাগচির জন্য চা ও মিষ্টি।

শশাঙ্ক একটা গলা খাকরানি দিয়ে বলল, দেখেছি স্যার।

কিছু পাওনি? হয়তো আলগা ফুলস্ক্যাপ কাগজে কিছু থাকতে পারে। ওর মাথাটা যে পরিমাণে পরিষ্কার ছিল, কাজের পদ্ধতিটা তো সবসময়ে ঠিক সেরকম…

শশাঙ্ক ডান হাতের তর্জনী, মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে পকেটের খাতাটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।

আর কিছুই পাইনি স্যার।

পরিষ্কার গলায় অস্বীকারোক্তিটা ঘুপচি ঘরে অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর শোনালো।

হুঁ বলে বাগচি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। বাগচি কি তাকে সন্দেহ করছেন? কিন্তু এসন্দেহ যে দূর করতে হবে। শশাঙ্ক তার গলার স্বর আরও দৃঢ় করল।

এ ঘরে আর কোথাও কিছু নেই।

বাগচি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অবিশ্যি এই তেতাল্লিশ বছরের জীবনে প্রদোষ যা করে গেছে তার কোনও তুলনা নেই, কিন্তু তাও… বাগচি নিভার দিকে চাইলেন। বউমা কিছু হেল্প করতে পারো?

নিভা তার শান্ত আয়ত চোখ দুটি বাগচির দিকে তুলল।

বাগচি প্রশ্নটিকে আরেকটু বিশদভাবে ব্যক্ত করলেন, প্রদোষ তার জীবনের শেষ দুটো বছর কী নিয়ে ভেবেছে তার কোনও লিখিত ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। তোমায় সে মুখে কখনও কিছু বলেছে কি? বুঝতেই তো পারছ–তার চিন্তার সামান্য কণাটুকুরও আজ মূল্য অনেক।

নিভা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ধীর সংযত কণ্ঠে বলল, তাঁর কাজ সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি আমাকে।

বাগচি এবার বললেন, তাকে ইদানীং কিছু লিখতেও দেখোনি?

এ প্রশ্নের উত্তর শশাঙ্কই দিল।

আমি তো বলছি স্যার। কোনও জায়গা বাদ রাখিনি। তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।

শশাঙ্ক মন স্থির করে ফেলেছে। প্রদোষের শেষ রচনাটি আর প্রদোষের থাকবে না। এটা হবে তার নিজেরই লেখা, নিজেরই গবেষণা, নিজেরই জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসার ফল। দ্বন্দ্ব তো কেবল নিজের মনের সঙ্গে, বিবেকের সঙ্গে–আর তো কেউ জানবেও না, বুঝবেও না। আজ থেকে ছমাস হ্যাঁ, অন্তত ছমাস সে কাউকে কিছু জানাবে না। ছমাস সময়টার প্রয়োজন আছে। কারণ মিথ্যাটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। এই কটা মাস তাকে আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে পড়াশুনা করতে হবে। বাগচির মতো লোকের মনে যাতে কোনও সন্দেহ না স্থান পায়। মাঝে মাঝে তাকে বাগচির সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দেবে যে, আয়ুবৃদ্ধির প্রশ্নটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে, সে নিয়ে সে পড়াশুনা করছে, রিসার্চ করছে। তারপর সময় হলে সে খাতাটা বাগচিকে দেখাবে।

কার খাতা? প্রদোষের খাতা? অবশ্যই না। প্রদোষের খাতার প্রতিটি অক্ষর সে অন্য খাতায় কপি করে নেবে। সে খাতার প্রথম পাতায় সে লিখবে–Some Notes on Longevity by S. S. Bose. তারপর তার প্রথম কাজ হবে প্রদোষের ফরমুলা অনুযায়ী আয়ুবৃদ্ধির ড্রাগটি প্রস্তুত করা। একটা বাদে কোনও উপাদানই দুষ্প্রাপ্য নয়। যেটি দুষ্প্রাপ্য সেটিও অর্থ আর ব্যক্তিগত প্রভাবের বিনিময়ে লভ্য।

আজ তারিখ ৩রা অগস্ট ১৯৭২। আজ শশাঙ্ক তার ড্রাগ প্রস্তুতের কাজ শুরু করবে। কিন্তু তার আগে প্রদোষের খাতাটি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা দরকার। অন্য কাজ সমস্ত করা হয়ে গেছে। একটি বড় সাইজের কালো খাতায় শশাঙ্ক প্রদোষের লেখা কপি করে নিয়েছে। বাগচির মনে যাতে কোনও সন্দেহের উদ্রেক না হয় তার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। এই ছমাসে একাধিকবার শশাঙ্ক তাঁর সঙ্গে বসে আয়ুবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করেছে। বাগচি প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, পরে আনন্দিত হয়েছেন ও তাকে উৎসাহ দিয়েছেন, বুঝেছি, প্রদোষের ব্যক্তিত্বই এতদিন তোমার নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ হতে দেয়নি। বন্ধুবিচ্ছেদে উপকার হয়েছে তোমার। এটা অস্বাভাবিক নয়। মানুষের মন বড় বিচিত্র জিনিস।…করে যাও তোমার কাজ। সাহায্যের প্রয়োজন হলে চাইতে দ্বিধা কোরো না। ফরমুলাটির কথা বাগচিকে বলেনি সে। অনেক ভেবেই সে স্থির করেছে যে, একেবারে ড্রাগটি প্রস্তুত করে তবে সে সবকিছু প্রকাশ করবে।

এত করেও আজ প্রদোষের খাতাটি নষ্ট করার পূর্ব মুহূর্তে সে কেন দ্বিধা বোধ করছে?

শশাঙ্ক বুঝল যে, বিবেক বলে যে বস্তুটি মানুষের অন্তরের একটি নিভৃত কক্ষে বাস করে, সেই বিবেকই এই সংশয়ের কারণ। কিন্তু আজকের দিনে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে গেলে সত্যিই কি ওই বস্তুটির কোনও প্রয়োজন আছে? গত কয়েক দশকের পৃথিবীর ইতিহাসে কতগুলি প্রধান ঘটনা বিশ্লেষণ করলে কি এই সত্যটাই প্রমাণ হয় না যে, বিংশ শতাব্দীতে বিবেক জিনিসটার কোনও মূল্য নেই? হিটলারকে আজ যারা নিন্দা করে, সাময়িক হলেও হিটলারের মতো প্রতিপত্তি তাদের কজনের ভাগ্যে জুটেছে? হিরোশিমার উপর আণবিক বোমা বর্ষণ করেও আমেরিকার সম্মানে কোনও হানি হয়েছে কি? আসলে আজকের দিনে বিজ্ঞানের প্রসারই যখন মানুষের মন থেকে পরলোক পরজন্ম ইত্যাদির চিন্তা মুছে ফেলে দিয়েছে, তখন বিবেক জিনিসটার সত্যিই আর কোনও প্রয়োজন নেই।

শশাঙ্ক মনে জোর পেল।

পকেট থেকে দেশলাই বার করে প্রদোষের খাতার মলাটের একটি কোণে অগ্নিসংযোগ করে খাতাটা হাত থেকে মেঝেতে ফেলে দিল।

হাতের ঘড়িতে হিসাব করে শশাঙ্ক দেখলে খাতাটি পুড়তে সময় লাগল সাড়ে তিন মিনিটের কিছু বেশি।

.

ড্রাগ-প্রস্তুত পর্বের বিস্তারিত বিবরণ এ কাহিনীতে কেন নিষ্প্রয়োজন, সেটা যথাস্থানে প্রকাশ্য। আপাতত অন্য একটি ঘটনাকে প্রাধান্য দিতে হয়।

৩রা অগস্ট সকাল সাড়ে নটায় প্রদোষ শশাঙ্কর খাতাটি পুড়িয়ে ফেলে। দ্বিপ্রহরিক আহার সেরে সে তার বালিগঞ্জের সর্দার শশাঙ্ক রোডের ফ্ল্যাট থেকে যাবে বেলঘরিয়া। সেখানে তার এক মামার একটি প্রায়-পরিত্যক্ত বাগানবাড়ির একটি ঘরে, গত ছমাসের মধ্যে সে একটি ল্যাবরেটরি তৈরি করেছে। ড্রাগটি প্রস্তুত হবে এই ল্যাবরেটরিতেই–তবে দিনের বেলা নয়–মধ্যরাত্রে।

খেতে বসার মুখটিতে শশাঙ্ক একটি টেলিফোন পেল।

কে, শশাঙ্ক?…চিনতে পারছিস?

সে কী? কবে এলি?

অমিতাভ বিলেত থেকে ফিরে এসেছে–অপ্রত্যাশিত ভাবে।

কাল সকালে।

কী ব্যাপার?

বোনের বিয়ে। ভাবতে পারিস? যাবার সময় দেখে গেছি ফ্রক পরছে!

শশাঙ্ক হাসে। কেমন আছিস?

আমি তো ভালই। তুই কেমন?

সো-সো?…কিন্তু খবর জানিস তো?

প্রদোষের ব্যাপার তো? টেরিবল! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি।Whom the Gods love… জানা আছে তো?

খুব জানি। যে কারণে আমার বিশ্বাস আমাদের কপালে অনেক দুঃখভোগ আছে।

আশ্চর্য! মৃত্যুর মাসখানেক আগেও ওর একটা চিঠি পেয়েছি। আগে কোনওদিন লেখেনি। ওই প্রথম, আর ওই শেষ।

শশাঙ্কর গলাটা ধরে গেল।

তোকে চিঠি…তুই…?

কী হল?

না না। মানে–তোকে চিঠি লিখেছিল?

আর বলিস না। তখন কাজে বেরোচ্ছি–ভীষণ তাড়া। চিঠিটা এল, একবার কোনওরকমে চোখ বুলিয়ে হাতে একটা পেপারব্যাক ছিল, তার মধ্যে রেখে দিলুম, আর সেটা কোথায় যে হাত থেকে স্লিপ করে পড়ল। বোধহয় টিউবেই।

সে কী রে?

এত আফসোস হল! বেশ বড় চিঠি, জানিস! আর ফুঁ অফ ইন্টারেস্টিং থিংস। কী জানি কী একটা নিয়ে রিসার্চ করছিল। সামথিং টু ডু উইথ…উইথ…

শশাঙ্কর গলায় শ্লেষ্ম। একবার কেশে নিয়ে সে বলল, লন্ডনের হাওয়ায় তোর স্মৃতিশক্তিটা অ্যাফেক্টেড হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে?

ও ইয়েস ইয়েস! মনে পড়েছে। লঞ্জিভিটি, লঞ্জিভিটি! আসল ব্যাপারটা কী জানিস? আমার নিজের আবার আয়ুবৃদ্ধির ব্যাপারে খুব বেশি ইন্টারেস্ট নেই। ঠাকুরদাকে দেখেছি তো–আশি বছর বয়স অবধি কী জ্বালান জ্বালিয়েছেন। আরও পঞ্চাশটা বছর যদি ও জ্বালানি সইতে হত–উঃ।

সমস্ত ব্যাপারটা হালকা করার উদ্দেশ্যে শশাঙ্ক একটা হাসির চেষ্টা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হল। তারপর সে বলল, এমন একটা ব্যাপার নিয়ে সে ভাবছিল, আর তার একটা নোট পর্যন্ত নেই!

নোট নেই? কিন্তু ও যে–তুই ঠিক বলছিস তো?

আমিই তো ওর লেখাপত্তর সব ঘেঁটেঘুঁটে গুছিয়ে দিলুম।

কিছু পাসনি? অন লঞ্জিভিটি?

নাথিং। তুই বোধহয় গণ্ডগোল করছিস।

কিন্তু…ভেরি স্ট্রেঞ্জ! তা হলে কি লঞ্জিভিটি নয়? সামথিং এক্স? হবেও বা!…যাই হোক, এগারোই সন্ধ্যা সাতটা।

কী?

ডলির বিয়ে–বললাম না। আসা চাই। অবিশ্যি, তোর বাড়ি একবার যাবই। কাল তো রোববার। সকালের দিকে আছিস?

আছি। ইয়ে–তোর বাগচির সঙ্গে দেখা হয়েছে?

পাগল! ফোনও করিনি। সময় কোথায়? শুধু নিভাকে একটা ফোন করে সমবেদনা জানিয়েছি।

ওকে প্রদোষের চিঠির কথা–?

না। হারিয়ে ফেলেছি শুনলে কষ্ট পাবে। চলি ভাই। বাই বাই!

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে শশাঙ্ক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে রইল।

তা হলে কি তাকে সত্যটা প্রকাশ করে দিতে হবে? কিন্তু গত ছমাসের এত পরিশ্রম, এত অর্থব্যয়, রাত্রিজাগরণ, অর্থ ও খ্যাতির এত রঙিন স্বপ্ন সব কি ব্যর্থ হবে? এই স্বপ্নসৌধ যদি তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়, তা হলে সে বাকি জীবনটা কী নিয়ে থাকবে! এখন তো তার আর অন্য কোনও কাজে মন নেই। সত্যি বলতে কি, আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে পড়াশুনার ফলে তার ও বিষয়ে রীতিমতো জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসার সঞ্চার হয়েছে।

নাঃ, এ কাজ তাকে করতেই হবে। যেভাবে প্ল্যান করেছিল সেভাবেই। অমিতাভর মনে যেটুকু সন্দেহ আছে, দূর করতে হবে। আর ও তো এসেছে বোনের বিয়ের ব্যাপারে। মাসখানেকের বেশি থাকবে না নিশ্চয়ই। তারপর ও চলে গেলে ড্রাগের খবরটা প্রকাশ করলেই হবে।

বিকেলে বেলঘরিয়া যাবার মুখে মণীশ এল–তার হাতে একখানা চিঠি।

এটা মা দিলেন।

শশাঙ্ক হালকা সবুজ রঙ-এর খামটা খুলে চিঠিটা পড়ল।

মাননীয়েষু,

সেই যে কাজ করে দিয়ে গেলেন, তারপর তো কই আর এলেন না। আমার একান্ত ইচ্ছে আপনি একদিন এসে আমাদের এখানে খান। কোনদিন সুবিধে হবে সেটা হয় মনুকে, না হয় আমাকে টেলিফোনে জানিয়ে দেবেন। আশা করি ভাল আছেন।

ইতি
বিনীতা
নিভা সরকার।

চিঠিটা পড়া শেষ হলে শশাঙ্ক সেটাকে ভাঁজ করে মণীশের পিঠে ছোট্ট একটা চাপড় মেরে বলল, মাকে বোলো–যেদিন আসব তার দুদিন আগে টেলিফোন করে জানিয়ে দেব, কেমন?

মণীশ চলে গেলে পর শশাঙ্ক নিভার চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিল।

.

ড্রাগ-প্রস্তুত পর্বের বিবরণ এই কারণে নিষ্প্রয়োজন যে, প্রদোষের নির্দেশ অনুযায়ী উপাদান মিশিয়ে যে পদার্থটি তৈরি হল, প্রদোষের আনুমানিক বর্ণনার সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। রাত বারোটার সময় কাজ শুরু করে ভোর পাঁচটায় শশাঙ্কর কাঁচের পাত্রটিতে যে বস্তুটি আবির্ভূত হল তেমন বস্তু শশাঙ্ক এর আগে কখনও দেখেনি। প্রদোষ তার খাতায় লিখেছিল তরল পদার্থের কথা। যেটি পাওয়া গেল সেটি হল ভিস্কা–অর্থাৎ চিটচিটে থথকে।

পদার্থটির প্রথম অবস্থা অবিশ্যি তরলই ছিল, কিন্তু পাঁচ মিনিটের জন্য ঘরের বার হয়ে ফিরে এসে শশাঙ্ক দেখল সেটি জমতে শুরু করেছে।

যে অবস্থায় এসে জমা থামল, সেটা দেখে কেবল একটি জিনিসের কথাই মনে হয়–জেলি। রঙ যদি লাল হত, তবে সেটাকে পেয়ারার জেলি বলে ভুল করা অস্বাভাবিক হত না। কিন্তু এখন সে ভুলের প্রশ্নই ওঠে না। জেলি জাতীয় কোনও পদার্থের যে এমন রঙ হতে পারে তা শশাঙ্ক ভাবতেও পারেনি। বৈদ্যুতিক আলোতে রঙ-এর বাহার ঠিক ধরা পড়েনি৷ ভোরবেলা পূর্বদিকের খোলা জানলাটা দিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে জেলির গায়ে পড়াতে সমস্ত ঘর যেন আলোয় আলো হয়ে উঠল।

শশাঙ্ক উপরের দিকে চেয়ে দেখলে জেলি থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে সিলিং-এর উপর ছড়িয়ে পড়ে নয়নাভিরাম নীলাভ চাঁদোয়ার সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু শুধুই কি নীল?

শশাঙ্ক লক্ষ করল দৃষ্টিকোণের সামান্যতম পরিবর্তনেই জেলির রঙ বদলাচ্ছে। নীলই প্রধান। কিন্তু সবুজ ও লালের আভাসও পাওয়া যায়। এ রঙকে ময়ূরকণ্ঠি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

বিস্ময়ের মধ্যেও শশাঙ্কর হাসি পেল। ময়ূরকণ্ঠি জেলি! প্রদোষ এ কীসের ফরমুলা দিয়ে গেল? এ কি ড্রাগ, না অন্য কিছু? জীব রসায়নের ইতিহাসেই কি এর স্থান, না প্রাতরাশের মেনুতে?

যাই হোক না কেন–এমন চমকপ্রদ বর্ণচ্ছটা শশাঙ্কর অভিজ্ঞতায় এই প্রথম। নাই বা থাকুক এর কোনও আয়ুবৃদ্ধির শক্তি, এর অনির্বচনীয় সৌন্দর্যই ধৈর্য ও শ্রম সার্থক করছে।

শশাঙ্ক তন্ময় হয়ে পাত্রটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে লক্ষ করল জেলির মধ্যে যেন একটা মৃদু স্পন্দনের ভাব।

মুহূর্তকাল বিস্ময়ের পর শশাঙ্ক এই স্পন্দনের একটা কারণ অনুমান করল। জেলি এতই সেনসিটিভ যে, ভোরের সূর্যালোকের মৃদু উত্তাপই এতে উত্তেজনা সঞ্চার করতে সক্ষম। অর্থাৎ, জেলি গরমে ফুটছে।

শশাঙ্ক পূর্বদিকের জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে টেবিলের কাছে ফিরে এসে পাত্রটির গায়ে হাত দিয়েই তার অস্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভব করল।

তারপর অতি সন্তর্পণে পাত্রের মুখের কাছে হাতের তেলোটা আনামাত্র বিদ্যুদ্বেগে হাতটা সরিয়ে নিয়ে লক্ষ দিয়ে শশাঙ্ককে তিন হাত পিছিয়ে যেতে হল।

হাতের তেলোতে অসহ্য যন্ত্রণা।

শশাঙ্ক চেয়ে দেখল–ফোস্কা।

সৌভাগ্যক্রমে ফাস্ট এডের বাক্সটি আনতে ভোলেনি শশাঙ্ক। বার্নল দিয়ে নিজের হাতে নিজেই ব্যান্ডেজ করে আরেকবার টেবিলের কাছে ফিরে গিয়ে শশাঙ্ক দেখল, জেলি এখন নিষ্পন্দ, পাত্রও ঠাণ্ডা। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষণীয়।

সুর্যের আলোর অভাবেও জেলিটি থেকে আপনা হতেই একটা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। মাথার উপরে এখনও নীলাভ চাঁদোয়া।

এতে কি তবে ফসফরাস আছে? কিন্তু সে জাতীয় কোনও পদার্থ তো উপাদানে ছিল না।

শশাঙ্ক এবার সাহস করে পাত্রটি হাতে তুলে নিল। জেলির ওজন মন্দ নয়। দেখে তো মনে হয়নি। জেলির বদলে পারা থাকলেও এর চেয়ে বেশি ওজন হত না। শশাঙ্ক এবার ধীরে ধীরে পাত্রটিকে কাত করতে লাগল। পাত্রের পাশ টেবিলের উপর পড়ে একটি কম্পমান গোলকের আকার ধারণ করল।

আধারমুক্ত হবার ফলে জেলির ঔজ্জ্বল্য যেন আরও বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে গোলকের অস্থিরতা দূর হল। এখন সেটি, একটি নিটোল নিষ্কলঙ্ক ময়রকণ্ঠিবর্ণযুক্ত স্বত:সূর্ত আলোক-পিণ্ড।…

.

সাড়ে আটটায় শশাঙ্ক তার বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে ফিরে এল। ব্যান্ডেজবদ্ধ ডান হাতের তেলোয় এখনও। সে মৃদু যন্ত্রণা অনুভব করছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই। তার সমস্ত সত্তা এখন নবাবিষ্কৃত অপরূপ বর্ণচ্ছটা-সম্পৃক্ত জেলির ভাবনায় আচ্ছন্ন। আয়ুবৃদ্ধির প্রশ্নটা এখন তার কাছে বড় নয়। যে পদার্থটি এখন তার গবেষণাগারে বন্দি অবস্থায় রয়েছে, পার্থিব জগতে তার রূপের তুলনা বিরল। গুণও যদি কিছু থাকে সেটার, মানুষের প্রয়োজনে যদি আসে সেটা, তবে সেটা হবে ফাউ।

এগারোটার কিছু পরে অমিতাভ এল। তার চাহনির অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা শশাঙ্কর দৃষ্টি এড়াল না। শশাঙ্কর খাটে ধপ করে বসে খোলা খবরের কাগজের উপর একটা চাপড় মেরে অমিতাভ বলল, আই ওয়াজ রাইট।

শশাঙ্ক উৎকণ্ঠা দমন করে চেয়ারে বসে সিগারেটের টিনটা অমিতাভর দিকে এগিয়ে দিল।

অমিতাভ বলল, ওসব রাখ। এই দ্যাখ।

পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে অমিতাভ শশাঙ্কর দিকে এগিয়ে দিল।

আজ নিভার ওখানে গেসলাম। এই অসমাপ্ত চিঠিটা প্রদোষের শোয়ার ঘরের টেবিলের দেরাজে পাওয়া গেছে। আই ওয়াজ রাইট!

চিঠিটা ইংরেজিতে লেখা। তর্জমা করলে এই দাঁড়ায়—

প্রিয় অমিতাভ,

এত অল্প সময়ের মধ্যেই আরেকখানা চিঠি পেয়ে নিশ্চয়ই খুব অবাক লাগবে তোমার। কিন্তু না লিখে পারলাম না। গত চিঠিতেই আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে গবেষণার কথা উল্লেখ করেছিলাম, মনে আছে বোধহয়। তাতে একটা নতুন ড্রাগ আবিষ্কারের সম্ভাবনার কথা লিখেছিলাম। এবারে তার ফরমুলাটা তোমাকে জানিয়ে দিতে চাই, কারণ আমি নিজে একাজ শেষ করে উঠতে পারব কিনা জানি না। কদিন থেকেই আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যে, আমার নিজের আয়ু বোধহয়

চিঠিটা একবার শেষ করে দ্বিতীয়বার পড়ার সময় শশাঙ্ক শুনল অমিতাভ বলছে, এখন কথা হচ্ছে–হোয়ার ইজ দ্যাট ফরমুলা? অ্যান্ড হোয়্যার ইজ দ্যাট নোটবুক?

শশাঙ্ক চিঠিটা ফিরিয়ে দিল।

কী করে জানব বল! আর এমনও তো হতে পারে প্রদোষ শেষকালে সে খাতা ডেস্ট্রয় করে ফেলেছে। হয়তো মনে হয়েছে সে ভুল পথে চলেছে–তার গবেষণার কোনও মূল্য নেই। তা ছাড়া শশাঙ্কর মাথায় হঠাৎ একটা পৈশাচিক বুদ্ধি খেলে গেল–তা ছাড়া আমিও যে ও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি সেটা তো আমি প্রদোষকে বলেছিলাম। হয়তো সে কারণেই

তুইও ভাবছিস মানে? অমিতাভর দৃষ্টিতে যুগপৎ বিস্ময় ও অবিশ্বাস।

মানে যা বুঝছ তাই। আমি সেকথা প্রদোষকে বলেছিলাম। প্রদোষ জানত। তুই তো চিনতিস প্রদোষকে। সেন্টিমেন্টাল। বন্ধুর যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য নিজে স্যাক্রিফাইস করতে দ্বিধা করত না–তাই নয় কি?

অমিতাভ কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে শশাঙ্কর দিকে চেয়ে বলল, তুইও লঞ্জিভিটি নিয়ে রিসার্চ করছিস? তোর নোক্স আছে?

আছে বইকী! তুই কি ভাবছিস আমি বসে কেবল পৈতৃক সম্পত্তি ভোগ করছি–আর আমার ভাগ্যে লবডঙ্কা?

না না, তা কেন! অমিতাভ যেন কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত, অনুতপ্ত। তোর যে বুদ্ধি নেই একথা তো কোনওদিন বলিনি, ভাবিওনি। তোর যেটার চিরকালই অভাব ছিল সেটা হচ্ছে একাগ্রতা, অ্যাপ্লিকেশন। তা ছাড়া তোর চিন্তায় কোনওদিন ডিসিপ্লিন ছিল না। কিন্তু চিন্তাশক্তিটাই যে নেই এসব কথা কি কখনও বলেছি?

শশাঙ্ক একটা সহজ হাসি হেসে বলল, যাই হোক, ধরে নে যে, শশাঙ্ক আর সে শশাঙ্ক নেই।

অমিতাভ খাট থেকে উঠে পায়চারি শুরু করেছে। তার অস্থিরতা যে ষোলো আনা বিশ্বাসের অভাবেই, তা শশাঙ্ক জানে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কী? কী করতে পারে অমিতাভ। সন্দেহ যতই হোক না কেন, জিনিসটার সম্ভাব্যতা সে উড়িয়ে দিতে পারে না কখনওই। আর তাকে মিথ্যাবাদীই বা প্রমাণ করবে সে কীভাবে?

তুই প্রদোষের বাড়িতে গিয়ে কাজ শুরু করার আগে আর কেউ ওর কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল?

ঠিক তা জানি না।

অমিতাভ থেমেছে। জানলা থেকে মুখ ফেরাতে শশাঙ্ক লক্ষ করল তার কপালে স্বেদবিন্দু। অমিতাভ কণ্ঠস্বর দৃঢ় করে বলল, কিছু মনে করিস না–কিন্তু তোর কথা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না।

শশাঙ্ক বিবেক বস্তুটিকে আগেই বর্জন করেছে। সুতরাং এমন সংকটময় মুহূর্তেও সে বিচলিত হল। উপযুক্ত কাঠিন্য ও শ্লেষমিশ্রিত কণ্ঠে সে বলল, তা হলে তুই বলতে চাস আমি মিথ্যেবাদী?

অমিতাভ হঠাৎ যেন ভেঙে পড়ল। খাট থেকে সিগারেটের টিনটা তুলে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সরি ভাই। ভেরি সরি। মাথাটা গণ্ডগোল হয়ে গেল। কাজের কাজ বলতে তো কিছুই করিসনি। অ্যাদ্দিন, তাই ছাত্র হিসেবে যে তুই ভালই ছিলি সে কথাটা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। যাগে–আমি উঠি।

শশাঙ্ক হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করে দিল।

তোর ঝামেলা মিটুক। একদিন তোকে বেলঘরিয়া নিয়ে যাব।

তোর সেই মামাবাড়ি?

মামা আর থাকেন না। এখন একটা ল্যাবরেটরি করেছি ওখানে। কাজ করছি।

এক্সলেন্ট!…এই দ্যাখ–তোকে নেমন্তন্ন চিঠিটাই দেওয়া হয়নি!

অমিতাভকে সিঁড়ির মুখটাতে পৌঁছে দিয়ে ঘরের দিকে ফিরে আসার পথে শশাঙ্কর মনে হল–একবার নিভার বাড়ি যাওয়া দরকার। প্রথম চিঠিটার কথা না জানলেও, অসমাপ্ত চিঠিটার বিষয় নিভাই প্রথম জেনেছে। চিঠির বিষয়বস্তু কী অমিতাভ জানে। নিভার মনেও যদি কোনও সন্দেহের বীজ প্রবেশ করে থাকে, তবে সেটাকে অঙ্কুরিত হতে দেওয়া চলে না।

নিভা সবে স্নান খাওয়া শেষ করে দ্বিপ্রহরিক বিশ্রামের আয়োজন করছে, এমন সময় শশাঙ্ক গিয়ে উপস্থিত।

নিভার রুচির প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় প্রদোষের বৈঠকখানায়। এখানে সর্বত্র সচেতন শিল্পীর ছাপ–আপনভোলা বৈজ্ঞানিকের নয়। টেবিলের উপর স্বহস্তে এমব্রয়ডারি করা ঢাকনি, দরজা-জানলায়। সুদৃশ্য পরদা, সোফার কুশনে নাগা লোকশিল্পের বাহার। ফুলদানিতে রজনীগন্ধাগুচ্ছের স্নিগ্ধ শুভ্রতা যেন নিভার নিরাভরণ সৌন্দর্যেরই প্রতিধ্বনি।

বসুন।…এভাবে খবর না দিয়ে তো আসার কথা ছিল না।

শশাঙ্ক নিভার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। আজানুলম্বিত এলোচুলে আজ সে বুঝি প্রথম দেখল নিভাকে।

আপনি বলাটা আর ছাড়তেই পারলে না। শান্তভাবে কোলের উপর হাতদুটি জড়ো করে বসে আছে নিভা। শশাঙ্কর কথায় তার ঠোঁটের কোণে একটা ম্লান হাসির আভাস ফুটে উঠল।

শশাঙ্কর বক্তব্য তার মনে পরিষ্কার ভাবে দানা বেঁধেছে। কোনও জড়তাই আজ আর সে অনুভব করবে না।

একটা কথা তোমাকে জানানো দরকার, নিভা।

বলুন।

বললে তুমি দুঃখ পাবে জানি। কিন্তু না বললে আমার নিজের বিবেক-যন্ত্রণা। দুঃখটা হয়তো তুমি সয়ে উঠতে পারবে–মৃত্যুশোকই যখন এভাবে বহন করছ–কিন্তু আমার বিবেকের দংশন বড় সাংঘাতিক। আর না-বলে পারছি না।

বলুন না!

অমিতাভর কাছে প্রদোষের শেষ চিঠির কথা জানলাম। তাতে আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে গবেষণার উল্লেখ আছে।

জানি। অমিতাভবাবু বলেছেন।

তার খাতাটা কেন পাওয়া যায়নি তার কারণ আমি জানি। নিভার দৃষ্টিতে কৌতূহল।

কী কারণ?

আমিও ওই একই বিষয় নিয়ে রিসার্চ করছিলুম। সে কথা আমি প্রদোষকে বলি–ওর…ইয়ের…মাস দু-এক আগে। আমার বিশ্বাস সে নিজের গবেষণা বিসর্জন দিয়ে আমার পথ খোলসা করে দিয়েছে।

নিভা এখনও শশাঙ্কর দিকে চেয়ে আছে। কী বলতে চায় তার চাহনি? শশাঙ্কর মনে হল এমনভাবে একদৃষ্টে নিভা কোনওদিন তার দিকে চায়নি। ভাগ্যবান প্রদোষ! আজ সে নেই–কিন্তু বিশ বৎসর সে নিভার সান্নিধ্যলাভ করেছে।

শশাঙ্ক বলল, তার অন্তঃকরণ যে কত মহৎ ছিল, এ থেকেই তা বোঝা যায়।

এবার নিভা কথা বলল।

আগে বলেননি কেন?

ভেবেছিলাম প্রদোষের গবেষণা আর আমার গবেষণা একত্র করে একটা কিছু করব–কিন্তু যখন। বুঝলাম যে, সে নিজে তার গবেষণার কোনও চিহ্ন রাখতে চায়নি–

আশা করি আপনার কাজ সফল হবে।

প্রদোষের গবেষণার ইঙ্গিত পেলে হয়তো আরও সহজে হত। তবে এ-বিশ্বাস আছে যে, এতদিনে হয়তো সত্যিই একটা কাজ, একটা প্রতিষ্ঠা হবে। বিফলতাই তো জীবনের মূল সূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যা চেয়েছি তার কোনওটাই পাইনি–কোনওদিনই।

নিভা তার দৃষ্টি নত করল। কয়েক মুহূর্তের গভীর স্তব্ধতা ভঙ্গ করে এবার শশাঙ্ক গাঢ়স্বরে বলল, আমি কেবল জানতে চাই–আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস আছে কি না।

নিভার উত্তর যেন বহুদূর থেকে ভেসে এল।

সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

এর পরের কথাটির জন্য শশাঙ্ক নিজেই যেন প্রস্তুত ছিল না।

নিভা–তোমার মনে আমার প্রতি এতটুকুও প্রসন্নভাব…আকর্ষণ…কি স্থান পেতে পারে?

ক্ষণিকের জন্য নিভার দৃষ্টি শশাঙ্কর দিকে নিবদ্ধ। তারপর সে দৃষ্টি নত করে আবার সেই শান্ত গলায় বলল, ও প্রশ্ন আজ থাক। এখন থাক।

শশাঙ্ক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। নিভার যেন ব্যস্ত ভাব।

শরবত–?

শশাঙ্কর ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি।

আজ থাক। এখন থাক।

আপনার হাতে…? নিভার চোখ ব্যান্ডেজের দিকে।

চায়ের জল। ফুটন্ত। চাকরটা ছুটিতে। আমি আবার ব্যাচেলার–জানোই তো…

.

নিভার লেক প্লেসের বাড়ি থেকে ট্যাক্সি করে বেলঘরিয়া পৌঁছতে শশাঙ্কর লাগল পঞ্চাশ মিনিট। সারা পথ সে তার জেলির মনোমুগ্ধকর রূপটি মনে করতে চেষ্টা করেছে; কিন্তু সকালে অল্প সময়ের মধ্যেই তার এত বিচিত্র পরিবর্তন সে দেখেছে যে, পদার্থটির কোনও একটি বিশেষ আকৃতি বা বর্ণ তার পক্ষে মনে করা সম্ভব হল না। কেবল এইটুকুই সে বুঝল যে, অস্পষ্টতা সত্ত্বেও ময়ূরকণ্ঠি জেলি তাকে আকর্ষণ করেছে এক অমোঘ সম্মোহনী শক্তির মতো।

হাতের তেলোটায় সামান্য জ্বালা এখনও রয়েছে। বাঁ হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে চাবিটা বার করে শশাঙ্ক ল্যাবরেটরির দরজা খুলল। বাইরে মেঘের ঘনঘটা, ঘরের জানলা সব বন্ধ। শশাঙ্ক জানে ঘরের সুইচবোর্ড ঠিক ডানদিকেই।

দরজা খুলে অভ্যাসমতো সুইচের দিকে হাত বাড়াতেই শশাঙ্ক বুঝল আলোর কোনও প্রয়োজন হবে না।

জেলি-প্রসূত ময়ূরকণ্ঠি আলোই তার ঘরটিকে আলোকিত করে রেখেছে।

টেবিলের উপর সকালের সেই গোলাকার পিণ্ড অবস্থাতেই জেলি এখনও অবস্থান করছে, কেবল তার আভা সকালের চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি।

শশাঙ্ক মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। নীল আলো এত তীব্র হয় কী করে? শশাঙ্কর চোখে জল আসছে। আনন্দাশ্রু? হবেও বা!

টেবিল থেকে যখন তিন হাত দূরে, তখন শশাঙ্ক দেখল জেলিপিণ্ডের মধ্যে মৃদুস্পন্দন আরম্ভ হয়েছে। তবে স্পন্দনটা জেলির সর্বাঙ্গে নয়–কেবল মাথার উপরের একটি অংশে। সেই স্পন্দমান অংশটি থেকেই যেন একটা উত্তাপ নির্গত হচ্ছে। শশাঙ্ক সে উত্তাপ তার দেহে অনুভব করল। বড় সর্বনেশে এ-উত্তাপ, কারণ এতে বিকর্ষণ নেই। শীতের দিনে আর্তের হাত যেমন আগুনের দিকে এগিয়ে যায়, এই ভর গ্রীষ্মের গুমোট অপরাহে শশাঙ্ক ঠিক সেইভাবেই তার দেহের উত্তমা জেলির দিকে এগিয়ে দিল।

তারপর যেটা ঘটল সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত–এবং সেটা হৃদয়ঙ্গম করার আগেই তীব্র যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবস্থায় শশাঙ্ক দেখল সে মেঝেতে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।

জেলির স্পন্দমান অংশটি থেকে একটি ফুলিঙ্গ সদৃশ জেলির কণা তীরবেগে ধাবিত হয়ে তার ডান গালে একটি গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু আশ্চর্য এই যে, এই আক্রমণ সত্ত্বেও শশাঙ্ক জেলির প্রতি কোনও বিরূপ ভাব অনুভব করল না। সে জানে, সে পড়েছে, শুনেছে যে, নতুন কোনও আবিষ্কারের পথে বৈজ্ঞানিককে অনেক বাধা, অনেক বিপত্তি সহ্য করতে হয়, অতিক্রম করতে হয়। আপাতত তার কাজ হওয়া উচিত জেলির জাত ও ধর্ম নির্ণয় করা। তা হলেই এর অপ্রত্যাশিত কার্যকলাপ বৈজ্ঞানিক নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়বে।

শশাঙ্ক তার প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বার করে গালের ক্ষতের উপর চাপা দিয়ে রক্তের স্রোত অবরোধ করে মেঝে থেকে উঠে পড়ল।

তারপর টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ জেলিপিণ্ডের উপর ফেলে সেটিকে আচ্ছাদিত করল। সাবধানের মার নেই।

গালের ক্ষতে মলম লাগিয়ে স্টিকিং প্লাস্টার চাপা দেওয়ার সময় শশাঙ্ক একটি গাড়ির আওয়াজ পেল। তারই বাড়ির গেটের ভিতর দিয়ে গাড়িটা ঢুকছে।

অমিতাভর ফিয়াট।

এস্তপদে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে ল্যাবরেটরির দরজা তালা দিয়ে বন্ধ করে শশাঙ্ক বিপরীত দিকের বৈঠকখানার দরজাটি খুলে দিয়ে ঘরে ঢুকে বাতিটা জ্বালিয়ে দিল। সিঁড়িতে অমিতাভর বিলাতি জুতোর শব্দ।

শশাঙ্ক সিঁড়ির মুখটাতে গিয়ে বন্ধুকে স্বাগত জানাল। এই ব্যস্ততার মধ্যে এতদূর আসার কারণ একটাই হতে পারে। অমিতাভর মুখের ভাবও শশাঙ্কের অনুমানের সত্যতাই প্রমাণ করে।

বৈঠকখানায় গিয়ে সোফায় বসার পর অমিতাভ মুখ খুলল। তার কণ্ঠস্বরে ইস্পাতসুলভ কাঠিন্য।

তুই মিথ্যা কথা বলেছিস।

শশাঙ্ক স্থির, নির্বাক।

প্রদোষ স্যাক্রিফাইস করতে পারে কিন্তু করবার আগে তার ফাইন্ডিংস্ সে তোকে দিয়ে যেত নিশ্চয়ই। তার মনে সংকীর্ণতা ছিল না বলেই সে এটা করত–এবং তার সাহায্যের জন্যই।

তুই কী বলতে চাস?

প্রদোষের খাতা কোথায়?

বলেছি তো, সে নষ্ট করে ফেলেছে।

অমিতাভর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তীব্র বিদ্বেষ জ্বলে উঠল।

তোর লজ্জা করে না? যে লোকটা মরে গেছে তার জিনিস…শুধু জিনিস নয়–তার এতবড় একটা কাজ–তার শেষ কাজ–সেটা তুই বেমালুম–

অমিতাভর কথা শেষ হল না। যোড়শ শতাব্দীর একটি ইতালীয় চিনামাটির ফুলদানি তার মস্তকের উপর সজোরে প্রক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে সে একটি সামান্য আঁ শব্দ করে সোফার উপর কাত হয়ে পড়ল। শশাঙ্ক উঠে এসে তার নাড়ি অনুভব করার সময় লক্ষ করল অমিতাভর ব্রহ্মতাল থেকে একটি তরল ধারা নির্গত হয়ে মেঝের গালিচায় চুঁইয়ে পড়ে তাতে একটি রক্তিম স্ফীতিমান নকশা আরোপ করছে।

সংকটকালে তার বুদ্ধির স্থির তীক্ষ্ণতায় শশাঙ্ক নিজেই বিস্মিত অনুভব করল।

তিন ঘণ্টার মধ্যেই শশাঙ্ক তার প্রাক্তন বন্ধুর মৃতদেহ বন্ধুরই ফিয়াট গাড়িতে নিয়ে গিয়ে কলকাতার উপকণ্ঠে একটি নির্জন স্থানে গাড়িসমেত রেখে বেলঘরিয়ায় ফিরে এল। গাড়ি জখম করতে গিয়ে সে নিজেও কিঞ্চিৎ জখম হয়েছে কিন্তু সেটা যাকে বলে মাইনর ইনজুরি। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে দেড় মাইল পথ হেঁটে সিক্ত অবস্থায় বাস ধরে তাকে ফিরতে হয়েছে। বৃষ্টিতে পথঘাটের জনশূন্যতা তাকে অবশ্য সাহায্য করেছে। মালিকে ছুটি দিয়েছিল আগেই। সে ফিরবে রাত দশটার পর। বাঁ হাতেও শশাঙ্ককে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হয়েছে–দস্তানার অভাব পূরণ করার জন্য। ছাত্রাবস্থায় গোয়েন্দা কাহিনী পড়ার অভ্যাস আজ তার কাজে লেগেছে।

বেলঘরিয়ার বাড়িতে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় শশাঙ্ক ঘড়ির দিকে দেখল–আটটা বেজে তেরো মিনিট।

বাঁ হাতে ব্যান্ডেজবদ্ধ অবস্থাতেই শশাঙ্ক চাবি দিয়ে ল্যাবরেটরির দরজা খুলল।

সারাদিন বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা গন্ধের বদলে তার থেকে এল মাদকতাপূর্ণ এক অনির্বচনীয় সৌরভ। সত্তর বছরের পুরনো ঘর যেন সহস্র ফুলের সুবাসে মশগুল হয়ে আছে।

শশাঙ্ক প্রায় নেশায় বিভোর হয়ে ঘরে প্রবেশ করল। টেবিলের দিকে চাইতে এক অভাবনীয় দৃশ্য তার চেতনাকে বিহ্বল করে দিল।

কাচের আবরণটি টেবিলের একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে, আর জেলির আকারে এক আশ্চর্য পরিবর্তন। সেটা এখন আর গোলাকৃতি নয়। গোলকের দেহ থেকে অজস্র নীলাভ পাপড়ি নির্গত হয়েছে, এবং প্রতিটি পাপড়ি যেন মৃদু সমীরণে হিল্লোলিত হচ্ছে।

গন্ধ যে এই সহস্রদল ময়ূরকণ্ঠি জেলিপুষ্প থেকেই নিঃসৃত হচ্ছে, শশাঙ্কর সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না। দুরু দুরু বক্ষে ধীর পদক্ষেপে সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। এমনই এই সৌরভের মহিমা যে, শশাঙ্কর মন থেকে আজই সন্ধ্যার কালিমালিপ্ত ঘটনাটি সম্পূর্ণ মুছে গেছে।

শশাঙ্ক এবার লক্ষ করল যে, টেবিলের যত কাছে সে এগিয়ে আসছে, পাপড়ির আন্দোলন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরেকটি আশ্চর্য জিনিস শশাঙ্ক লক্ষ করল–এবারে উত্তাপের পরিবর্তে একটি পরম স্নিগ্ধ শীতলতা জেলি থেকে নিঃসৃত হয়ে তার দেহমনের সমস্ত অবসাদ দূর করে দিচ্ছে। শশাঙ্কর অজ্ঞাতসারেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল–কী অদ্ভুত। কী সুন্দর!

এবারে ফুলের একটি বিশেষ পাপড়িকে যেন লম্বিত হতে লক্ষ করল শশাঙ্ক। ফুলের সমস্ত জ্যোতিটুকু যেন সেই লম্বমান পাপড়ির অগ্রভাগে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।

পাপড়িটি ক্রমশ একটি সাপের আকার ধারণ করল–তার উজ্জ্বল নীলাভ ফণাটি যেন কোনও অদৃশ্য সাপুড়ের বাঁশির সঙ্গে তাল রেখে দুলছে।

শশাঙ্ক অনুভব করল যে, ক্রমবর্ধমান শৈত্যে তার স্নায়ু সব অসাড় হয়ে আসছে।

জেলিসর্পের ফণার অগ্রভাগের অত্যুজ্জ্বল নীল জ্যোতি তার দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করছে।

শশাঙ্ক এখন শক্তিহীন, অনড়। জেলিসর্পের ফণা তার গলদেশ লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে।

শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে এখন শশাঙ্কর কারণ ফণা তার গলদেশে বেষ্টন করে চাপ দিতে শুরু করেছে। ব্যান্ডেজবদ্ধ ডানহাতটা তুলে শশাঙ্ক ফাঁসমুক্ত হবার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করল। কিন্তু এ নাগপাশে সহ অজগরের শক্তি।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শশাঙ্কর নিষ্প্রাণ দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

ফণা তখন শশাঙ্ককে মুক্তি দিয়ে টেবিলের বিপরীত দিক লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। ফণার অগ্রভাগ থেকে এখন পাঁচটি নীলাভ আঙুল উদগত হয়েছে। সেই অঙ্গুলিবিশিষ্ট জেলিহস্ত শশাঙ্কর পেনসিলটি টেবিলের উপর থেকে অনায়াসে তুলে নিয়ে শশাঙ্করই কালো খাতার খোলা পাতার দিকে অগ্রসর হল।

.

মালি দুঃখীরাম যখন বেলঘরিয়া থানা থেকে ইনস্পেক্টর বসাককে তার মনিবের মৃতদেহ দেখতে নিয়ে এল তখন প্রায় রাত বারোটা। বসাক অবশ্য জেলিজাতীয় কোনও পদার্থর চিহ্ন দেখতে পাননি। শশাঙ্কর মৃতদেহ ছাড়া যে জিনিসটি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেটি হল শশাঙ্কর নোটবুকের পাতায় শশাঙ্করই হস্তাক্ষরে একটি স্বীকারোক্তি–

আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমারই বিবেক।

শারদীয়া আশ্চর্য: ১৩৭২ (১৯৬৫)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *