১১-১৫. আমার বিরুদ্ধে গুঞ্জন উঠছে

এদিকে বাড়িতে আমার বিরুদ্ধে গুঞ্জন উঠছে।

রোজ রোজ বান্ধবীর সঙ্গে এত কি দরকার?

তুমি রোজ যাও, সে তো কই একদিনও আসে না?

তার মানে তুমি হ্যাংলা, সে মানিনী।

না, এতক্ষণ আড্ডা দিতে যাওয়া চলবে না। ইত্যাদি। ইত্যাদি।

মা বলতেন, দাদা বলত।

আর বউদি টিপে টিপে হেসে বলত, কে জানে বান্ধবী না বান্ধব।

মা তখন আড়ালে রেগে রেগে বলতেন, কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।

আমি বুঝতে পারতাম, বউদির উপস্থিতিই আমার পথ কিছুটা সুগম করে দিয়েছে। মা বউদিকে অগ্রাহ্য করবার জন্যেই আমার গতিবিধির এদিক-ওদিককে অগ্রাহ্য করছেন। ভাবটা যেন—তুমি যা খুশি করতে পারো, বোনের বাড়ি যেতে পারো, দোকানে যেতে পারো, আর ও বেরোলেই দোষ? বেশ করবে ও বেড়াত যাবে।

সোচ্চারে না হলেও এই নিরুচ্চার বাক্যই আমার পৃষ্ঠবল ছিল। না হলে বউদির সঙ্গে এই টেক্কা দেওয়াদিয়ি না হলে মা কবেই হয়তো আমার ওপর পাহারা বসাতেন।

.

১২.

বসাননি পাহারা, তাই আমি যথারীতি ওর সঙ্গে দেখা করছিলাম। কোনদিন ও প্রতীক্ষা করত, কোনোদিন আমি।

একদিন ও আলো-জ্বলা মুখে এসে বলল, বছর সাতেকের জন্যে ছেড়ে দিতে পারবে আমায়?

বছর সাতেক!

ছেড়ে দেওয়া! দু

টো শব্দই অবোধ্য।

বললাম, ধরলাম কবে যে ছেড়ে দেব?

ধরনি? উঃ! আষ্টেপৃষ্ঠে নাগপাশে বেঁধে রেখেছ। যাক শোনো, একটা চাকরি পাচ্ছি দুবছরের ট্রেনিং, পাঁচ বছরের কনট্রাক্ট সার্ভিস। ট্রেনিংয়ের দুবছর চোদ্দ-শো করে দেবে, সার্ভিসে সাড়ে তিন হাজার।

মনে মনে হিসেব করে নিয়ে উৎসাহের গলাতেই বলি, তা মন্দ কি? কোথায়? কোন কোম্পানি? ওদের বুঝি বাৎসরিক হিসেবে মাইনে?

দুরন্ত আমার কথা শুনে প্রবলভাবে হেসে উঠল হা-হা করে।

হাসি আর থামতে চায় না।

তারপর বলল, বাৎসরিক মানে? মাসিক। বুঝলে? মান্থলি সাড়ে তিন হাজার।

আমিও অতএব হেসে ফেললাম।

বুঝলাম ঠাট্টা।

বললাম, শুধুই মাইনে? তার সঙ্গে একটি সুন্দরী রাজকন্যা নয়?

কী ভাবছ, ঠাট্টা? তাহলে এই দেখো।

ও পকেট থেকে কতকগুলো ছাপানো কাগজপত্র বার করল। ফরম, প্রসপেক্টাস, আরও কি যেন। তারপর আমায় ধরে বসিয়ে বোঝাতে বসল।

সত্যিই ওই রকম অবিশ্বাস্য হারের মাইনে।

কিন্তু কাজটা যে কি তার উল্লেখ নেই। ট্রেনিং নিতে হবে এই উল্লেখ আছে।

আর উল্লেখ আছে শর্তের।

ওই সাত বছরের মধ্যে দুবছর কোনো ছুটি পাবে না। চাকরির পাঁচ বছরের মধ্যে অবশ্য ছুটি পাবে, বছরে তিন সপ্তাহ, তার মধ্যে, দেশে আসতে পারো, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের ব্যবস্থাপনায়, ও বিষয়ে কোম্পানি তোমাকে কোনো সাহায্য করত অসমর্থ।

কিন্তু ছুটিতে তুমি তোমার দেশে আসবে তাতে সাহায্যের প্রয়োজনই বা কি?

তা আছে প্রয়োজন।

চাকরিটি যে পশ্চিম আফ্রিকায়।

আফ্রিকার মানচিত্রের কোণে ছোট্ট একটি নাম। কে জানে সেখানে অরণ্য উপড়ে উপনিবেশ স্থাপনের আয়োজন চলছে, না উপনিবেশ গড়ে ফেলে কাজ করবার মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না, তাই সারা পৃথিবীতে প্রলোভনের জাল ফেলেছে। একদল ছেলে চাই তাদের। স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ।

পড়বে কেউ না কেউ সে জালে।

হয়তো বা দলে দলেই পড়বে।

পৃথিবীতে বেকারের সংখ্যা তো কম নয়। যারা বেকারিত্বের জ্বালায় বাঘের মুখে যেতেও প্রস্তুত। কুমীরের হাঁয়ের মধ্যে হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত।

তাই বলে তুমি? বললাম, পাগল নাকি?

ও বলল, কেন পাগল কিসে? টাকার দরকার কি আমার কম?

এত কি দরকার?

ও দৃঢ় গলায় বলল, আছে দরকার।

আমার ওপর রাগ করে বলছ?

না বেবি, তোমার ওপর নয়, হয়তো নিজেরই ওপর। শুধু একটা কথাই বলব—আমাদের দুজনের মধ্যে এই ভালোবাসা আমার অন্নদাতাদের চোখ এড়ায়নি, আর এই সূত্রেই তারা আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীটা শুধু নেমকহারামের বাসভূমি। সে ধারণাটা যে ভুল সেটাই প্রমাণ করতে হবে আমায়।

এই প্রথম ও কাকাবাবু কাকিমা না বলে অন্নদাতা বলল।

কিন্তু আমাদের ভালোবাসার সঙ্গে ওঁদের সম্পর্ক কি?

আছে বৈকি।

কে না জানে রমেশবাবুর ছেলে নেই, কে না জানে রমেশবাবুকে এবার অবসর গ্রহণ করতে হবে। আর এটাই বা কে না জানে, একটা লোক যদি বিয়ে-থাওয়া করে সংসারী হয়ে বসে, তার আর পুরনো ঋণ শোধ দেবার ক্ষমতা থাকে না, গরজ থাকে না।

এই সব কথাগুলোই হয়তো জানা ছিল অমিতাভর, শুধু এইটা জানা ছিল না-দেবতার মুখ থেকেও এই জানা কথাগুলো বেরোতে পার।

রমেশবাবুকে অমিতাভ দেবতার প্রাপ্য আসনে বসিয়ে রেখেছিল।

হয়তো দেবতার মনেও হঠাৎ ক্ষোভ জন্মাতে পারে, হয়তো দেবতাও হঠাৎ বিচলিত হতে পারে। হয়তো সেটা নিতান্তই সাময়িক। কিন্তু ওই বিশ্বস্তহৃদয় ছেলেটার সে বিচারের ক্ষমতা থাকবার কথা নয়। তাই তার দেবতা আসনভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তার হাতের পুস্পাঞ্জলি স্খলিত হয়ে পড়েছে।

কিন্তু সেই ক্ষোভে সে পাহাড়ের চূড়া থেকে খাদে ঝাঁপ দেবে?

ও বলল, একথা বলছ কেন? মানুষ তো শুধু ভ্রমণের পিপাসাতেও পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে গিয়ে হাজির হয়। ইতিহাসের সাক্ষী হয় সেই সব পর্যটকদের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত।

সে আলাদা। সেটা স্বেচ্ছাধীন।

ওটা ভুল। কোনো সময়েই মানুষ স্বেচ্ছাধীন নয়। প্রতিমুহূর্তেই তাকে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।

তবু অনেক কথা বললাম।

অনেক নিষেধ-বাণী, অনেক প্রতিবাদ, অনেক অভিমান, অনেক যুক্তি খরচ করলাম। কিন্তু ও অটল। ও বলছে, কষ্ট হবার ভয় করলে উন্নতির আশা কোথায়?

.

১৩.

ও কোনো কথাই শুনল না, চলে গেল। আমাকে বলল, সাতটা বছর অপেক্ষা করতে পারবে না। আমার জন্যে?

আমাকে উৎপীড়িত হতে হবে।

সইবে আমার জন্যে।

আমি অভিমানে চুপ করে রইলাম।

ও বলল, উপায় থাকলে রেজিস্ট্রিটা সেরে ফেলে যেতাম। কিন্তু আইনের চোখে যে তুমি এখনও নাবালিকা। আশ্চর্য, এখনও এত কম বয়েস তোমার!

তারপর যাবার আগে ও আমার চোখে চোখে চেয়ে বলল, ফিরে এসে তোমায় ঠিক এমনি পাব তো?

সন্দেহ হচ্ছে?

না, সন্দেহ নয়, ভয়। মনে হচ্ছে যদি বদলে যাও।

কে জানে বদলটা কার হয়!

আমি? আমি ঠিক থাকব। জলে, জঙ্গলে, অরণ্যে, সভ্যতায়, বর্বরতায়, আদিমতায়।

জোর করে কিছু বলা যায়?

মনের জোর থাকলে যায়।

আমার অভিমান ক্ষুব্ধ হল। আমিও মনের জোর দেখালাম। বললাম, তোমার বদল না হলে, আমারও বদল হবে না।

.

১৪.

বলেছিলাম।

বলেছিলাম, আমারও বদল হবে না।

কিন্তু আমার বদল হল।

আমার নাম বদল হল, আমার সাজ বদল হল, আমার আচার-আচরণের বদল হল, আমার মুখের ভাষারও বদল হল। আমি এখন কথা বলি শান্ত গম্ভীর মৃদু ছন্দে। আর সেই কথার মধ্যে দার্শনিকের ঔদাস্য থাকে, থাকে আধ্যাত্মিকতার ধোঁয়াটে রহস্য।

আমি ভাবি এগুলি আমার ভান, আমার ছলনা, কিন্তু হঠাৎ এক এক সময় মনে হয়, নাকি ওইগুলোই সত্যি হয়ে উঠেছে আমার জীবনে? ওই ছলনার খোলসের মধ্যেই আমি আমার সত্তাকে সমর্পণ করেছি?

তাই বউদির বোন শানু যখন বলেছিল, আশ্চর্য! কুমারী মেয়ে হয়েও তুমি অনায়াসে এতখানি কৃচ্ছ্বসাধন করছ। তোমাকে দেখে আমার নিজের উপর ঘৃণা আসছে বেবি!

তখন বলতে পারিনি, এ-কথা বোল না শানু! বরং ঘৃণা তুমি আমাকেই করতে পার। তুমি তো সরল, সত্যবাদী, খাঁটি। আমি কি? মেকি। ভেজাল। একটা ঝুটো মাল।

আমি শুধু মিষ্টি করে একটু হেসে শানুর গায়ে হাত রেখেছিলাম। কারণ, মনে হয়েছিল শানু যা বলছে, তা অস্বীকার করা যায় না। আমার মধ্যে আছে নিশ্চয় কিছু। নইলে শঙ্কর মহারাজ কেন ওকে অবহেলা করলেন, আর আমায় এতখানি মর্যাদা দিলেন।

অথচ যে সার্কেলের মধ্যে আমার মর্যাদা, সে সার্কেলটাকে আমি কোনোদিনই মর্যাদা দিতাম না। আমি মনে করতাম—জীবনে যারা বঞ্চিত, যারা ব্যর্থ, যারা পৃথিবীর সত্যকার আলো-বাতাসের স্বাদ পায়নি, তারাই ভগবান ভগবান করে মাথা ঠোকে, তারাই গুরুর দরজায় ভিড় বাড়ায়। অতএব তাদের অভিমতের মূল্য ছিল না আমার কাছে।

কিন্তু এখন যখন সেই গুরুর দরজায় ভিড় করা মেয়ে-পুরুষের দল আমার দিকে ঈর্ষার চোখে তাকায়, তখন আত্ম-অহমিকায় স্ফীত হই আমি।

আসল কথা, আমাদের সত্তা আমাদের পরিবেশের কাছে বিক্রিত। পরিবেশই আমাদের গড়ে ভাঙে। আর সেই পরিবেশের সমীহ দৃষ্টিই আমাদের কাছ সবচেয়ে মূল্যবান।

আগে আগে যখন কখনও কখনও তার গুরুভগিনী বা গুরুভ্রাতাদের বাড়িতে ডাকতেন, তাদের জন্যে তটস্থ হতেন, তখন মায়ের উপর কৃপা হত, আর ওদের দেখে হাসি পেত। হাসি পেত ওদের সম্বন্ধে মা-র মূল্যবোধের বহর দেখে। কিন্তু এখন আমি আমার গুরুভ্রাতা বা গুরুভগিনীদের চোখে একটু বিশেষ হয়ে উঠতে পারাকে রীতিমতো গৌরবের মনে করি। অথচ সেই একই শ্রেণীর তো এঁরাও।

.

১৫.

কিন্তু ওই আমিটা যেন সমুদ্রের উপরকার ঢেউয়ের মতো। আসল জলটা নয়, জলের ফেনা। কখনও অনেকখানি উঁচু হয়ে ওঠে বলে মনে হয় এটাই সত্য, কখনও হঠাৎ স্তিমিত হয়ে যায়। তখন নীচে দিয়ে বয়ে যাওয়া স্তিমিত জলটা চোখে পড়ে।

সেই রকম স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল আমার আমিটা শানুর যাবার আগের দিন। সন্ধ্যাবেলা শানু আমার কাছে এসে বসেছিল।

আলতোভাবে আমার বিশুদ্ধ শয্যার একাংশে বসে বলেছিল, সেই বাড়িটায় আবার যেতে ভয় করছে। সেই শ্বশুরবাড়ি।

আমার দেবিত্বটা তখন যেন ঝাঁপসা হয়ে গেল। বললাম, তুমি ভারী বোকা শানু, তাই তুমি এই বৈধব্যটাকেই নিজের জীবনের শেষ কথা বলে মেনে নিচ্ছ। তোমার জীবনে অফুরন্ত দিন-রাত্রি, তোমার রূপ আছে, বয়েস আছে, স্বাস্থ্য আছে। তুমি কেন আবার তোমার ভাগ্যটাকে যাচাই করে দেখবে না? ক্লাসে একবার ফেল হলে কি লোকে পড়া ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে? এত কিসের ইয়ে তোমার?

শানু আস্তে বলল, তোমার কাছে লুকোব না ভাই, জীবনের প্রতি এখনও সম্পূর্ণ লোভ আছে আমার, লোভ আছে খাওয়া-পরায়, আমোদ-প্রমোদে। তা ছাড়া আর আমায় কেউ ভালোবাসবে না, আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পাব না, একথা ভাবতে বসলে চেঁচিয়ে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয় : আমার, কিন্তু সেকথা চেঁচিয়ে বলতে লজ্জা করে।

বললাম, লজ্জার কিছু নেই শানু, তোমার এই বৈধব্যটা কৃত্রিম। সমাজের আরোপিত একটা জুলুম। এটাকে জোরের সঙ্গে অস্বীকার কর। তাছাড়া তোমাদের বাড়িটা তো বেশ প্রগতিশীল? বাপের বাড়িটার কথাই বলি।

শানু নির্বোধ, তবু শানু একটু হেসে বলে, প্রগতির পোশাক পরলেই প্রগতিশীল হওয়া যায় না বেবি! এখন আমি একটা রঙিন শাড়ি পরলে দাদা-বউদিরা তো দূরের কথা, আমার বাবা সুষ্ঠু বিরক্ত হন। বিধবা মেয়েকে তারা আহা আহা করবেন, কিন্তু তার আবার বিয়ের কথা? ভাবতেই পারবেন না।

তাহলে এবারে তোমায় নিজে হাতে ভার নিতে হবে।

শানু কেমন একরকম চোখে তাকিয়ে বলে, লজ্জা আমার সবচেয়ে বেশি বেবি তোমার কাছেই। তুমি অকারণ এইভাবে স্বেচ্ছায় জীবনকে হাত দিয়ে ঠেলে দিতে পারছ–

আমি লজ্জা পেলাম।

আমি যেন আমার ভেতরটা দেখতে পেলাম, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ভুল শানু, ওটা তোমার সম্পূর্ণ ভুল। আমার সব কিছুই ভান। এই বৈরাগ্যটা আমার ছদ্মবেশ।

ও অবাক হয়ে বলল, কিন্তু কেন? তোমার এতে দরকার কি?

এমনি মজা। খেলা।

শানু আরও অবাক হল।

বলল, মজা! খেলা! কিন্তু এই খেলাটা যখন আর ভালো লাগবে না?

তখন টান মেরে ফেলে দেব লোটা-কম্বল।

শানু বিশ্বাস করল না। বলল, এ তুমি আমাকে স্তোক দিয়ে বলছ

না শানু, সত্যিই বলছি। আর সত্যিই তোমায় উপদেশ দিচ্ছি, জীবন জিনিসটা এমন তুচ্ছ নয় যে তুমি শুধু তুচ্ছ একটু লোকলজ্জার মুখ চেয়ে সেটা বরবাদ দেবে। তুমি আবার ভালোবাস, ভালোবাসা নাও।

শানু একটু বিষণ্ণ হাসল। বলল, তুমি এমনভাবে বলছ, যেন আমার জন্যে কী, একখানা ভালোবাসা অপেক্ষায় বসে আছে। ভালোবাসাটা আসছে কোথা থেকে?

আজ নেই, কাল আসতে পারে। তোমার মনটা প্রস্তুত রেখে তাকে গ্রহণ করবার জন্যে।

শানু আস্তে উঠে গেল।

শানুর নিশ্বাসটা ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল।

আর শানু চলে যেতেই আমার রক্ত উত্তাল হয়ে উঠল। যে ভালোবাসা আমার জন্যে প্রহর গুনছে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে, তার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলাম। ইচ্ছে হল ছিঁড়ে ফেলি এই খোলশ, সবাইকে ডেকে ডেকে বলি, শোন তোমরা, আমার ভালোবাসা আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে বলে মরুভূমিতে সোনা কুড়োতে গেছে। অতীতের সব গ্লানি মুছে ফেলে, সব ঋণ শোধ করে ফেলে ও আমায় নিয়ে ঘর বাঁধবে, তাই আমার এই শবরীর প্রতীক্ষা।

কিন্তু আবেগকে শাসন করে বুদ্ধি। তাই আমি কিছু বলি না। শুধু আমার ছদ্মনামের খোলশেই স্থির হয়ে বসে থাকি। যখন মা কাঁদো-কঁদো মুখে বলেন, কোনোদিন ভাবিনি তুই এমন হয়ে যাবি তখন মৃদু হেসে বলি, কেন মা, এ তো বেশ। তোমার কাছেই রয়ে গেছি, ছেড়ে কোথাও চলে যাচ্ছি না–

মা নিশ্বাস ফেলে বলেন, আমার কাছেই বটে!

বলেন, কারণ মা-র ধারণা আমি এখন আর মা-দের এই জানা পৃথিবীর মানুষ নই, আমি অন্য এক গ্রহের! যেখানে বাসনা নেই, কামনা নেই, বরং ভোগ-সুখের প্রতি তীব্র বিরাগ। সেই এক নির্মল জ্যোতিলোকে বিরাজ করছি আমি আমার ভগবতী সত্তা নিয়ে।

কিন্তু আমি তো জানি, আমি তোমাদেরই লোক।

আমি যখন একটি বিরল নির্জনতার আশায় বলেছিলাম, আলাদা একটা ঘর না হলে আমার ধ্যান-ধারণার অসুবিধে হয়, তখন সে কোন্ ধ্যানের কথা বলেছিলাম?

সে ধ্যান কি শঙ্কর মহারাজের দেওয়া ইষ্ট-মূর্তির? তা যদি হয়, সে ধ্যান জননীর স্নেহ বাহুবেষ্টনের মধ্যে থেকেও হতে পারত না?

কিন্তু সে ইষ্ট-মূর্তির ধ্যান তো করতে চাইনি আমি। একক শয্যায় শুয়ে ধ্যানে বিভোর হই আমি একটি বলিষ্ঠ পুরুষ-মূর্তির।

রক্ত-মাংসের সজীব পুরুষ।

পাথরের নওল কিশোর নয়। যার প্রেমকাহিনী নিয়ে শঙ্কর মহারাজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কীর্তন করেন, ব্যাখ্যা করেন। শুনি তিনি নাকি বিশ্বের সমগ্র নারীর প্রেমাস্পদ। আর বিশ্বের সবাই তো নারী। তিনি ছাড়া পুরুষ কই এই বিশ্ব ব্রজভূমিতে? হ্যাঁ, এসব কথা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে, কারণ মুখস্থ করার ক্ষমতাটা নাকি আমার অদ্ভুত। এসব কথা আমিও গুছিয়ে বলতে পারি মহারাজের প্রধান শিষ্যা বৃন্দাদির মতোই। যার জন্যে বৃন্দাদি আজকাল আমায় বিষনজরে দেখতে শুরু করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *