০৬-১০. শঙ্কর মহারাজ

না, শানুকে দীক্ষা দেননি শঙ্কর মহারাজ। বলেছিলেন, এর এখনও সময় আসেনি।

বউদি কদিন ঘোরাঘুরি করল, তারপর আশ্রমে আমার আদর আর আধিপত্য দেখে বিতৃষ্ণ হয়ে ছেড়ে দিল। রাগ করে বোনকে তার মাসের শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিল। ক্রমশ ক্লান্তও হয়ে উঠেছিল বোঝা যাচ্ছিল। রাত্রে স্বামীসান্নিধ্য ত্যাগ করে বোনকে নিয়ে পড়ে থাকা, কতদিন চলতে পারে?

এ একটা ছুতো হল।

মাকে আর আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, মহারাজ ওভাবে ফিরিয়ে দেওয়ায় বড্ড মন-ভাঙা হয়ে পড়েছ, যাক, দুদিন ঘুরে আসুক।

আমি সেদিন আর-একবার ওর বিয়ের কথাটা তুলোম। দাদার উপস্থিতিতে। বললাম, ভাঙা মন জোড়া লাগাতে ওকে নিয়ে যা-তা না করে আর একবার বিয়েরই চেষ্টা কর না বাপু!

দাদা ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে?

মানে তো কিছু শক্ত নয় দাদা! বেচারা তো বলতে গেলে কুমারীই। নিজের বোনের জন্যে তো পাত্র খুঁজছিলে, সেই খাটুনিটা না হয়ে বউয়ের বোনের জন্য খাটলে।

থাক, তোমাকে আর উপদেশ দিতে হবে না, বেঁজে উঠল বউদি, তুমি ঊর্ধ্বলোকের জীব, এসব তুচ্ছ চিন্তায় না-থাকাই ভালো।

তখন বলেছিল।

তখন ওরা অভিভূত হয়নি।

দাদা বলেছিল, নিজের বোনের জন্যে খোঁজাটা ছেড়েই দিতে হবে তাহলে?

নিশ্চয়।

দেবী মা হয়েই থাকবে ঠিক করেছ?

দেখা যাক না বলে হাসলাম মনে মনে। মনে ভাবলাম, আমার দিন আসুক, আসুক দুরন্ত অমিতাভ আফ্রিকার অরণ্য থেকে সোনার তাল কুড়িয়ে নিয়ে। তখন জানাব কেন তোমায় মুক্তি দিচ্ছি বোনের বর খোঁজার দায় থেকে।

.

০৭.

হ্যাঁ, দুরন্তই ওর আসল নাম, ডাক-নাম। অমিতাভটা পোশাকী নাম। বলতাম, পোশাকী নামটা তোমার সম্পর্কে স্রেফ অচল। এই এইটেই হচ্ছে ঠিক। দুরন্ত!

ও বলত, ঠিক তো? তাহলে আমার দোষ নেই, নামের উপযুক্ত কাজই করছি।

আমি ছিটকে সরে আসতাম, বলতাম, রক্ষে কর, ক্ষ্যামা দাও। শ্রীযুক্ত অমিতাভবাবুই হও।

নাঃ। দুবার দুরকম নির্দেশ চলবে না।

বলতাম, তাহলে আমারও থাকা চলবে না। বলতাম, তবু বসে থাকতাম। কে যেন পেরেক দিয়ে পুঁতে রাখত আমায় সে-ঘরের মাটির সঙ্গে। যদিও সেই ঘরটায় দুরন্তর কোনো অধিকার ছিল না। দুরন্ত হচ্ছে রমেশবাবুদের আশ্রিত। যে রমেশবাবুর কাছে আমি পড়তে যেতাম। রমেশবাবু আমাদের স্কুলের ইংলিশের টিচার।

এমন কিছু বড়োলোক নয় রমেশবাবু, তবু একটা ছেলেকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিলেন, তার লেখাপড়ার ভার নিয়েছিলেন। বিনা স্বার্থেই নিয়েছিলেন।

কিন্তু রমেশবাবুর গিন্নি এটা বরদাস্ত করতে পারতেন না। তিনির মনোভাব—বেশ, আছে থাক, কিন্তু কিছুটা উসুল হোক।

সেই উসুলটা করতেন তিনি চাকর তুলে দিয়ে।

ঝি না এলে বাসনও ধুইয়েছেন দুরন্তকে দিয়ে। নিজের অসুখ করলে ভাতও রাঁধিয়েছেন।

আমি রেগে যেতাম, বলতাম, এসব তুমি সহ্য কর কি করে?

ও হেসে বলত, কী হয়েছে? গ্রামের বাড়িতে মায়ের অসুখ করলে তো কতদিন রান্না করেছি, কাপড় কেচেছি, বাসনও মেজেছি।

সেটা আর এটা এক নয়।

এক ভাবলেই এক।

এই বলিষ্ঠতা ছিল ওর চরিত্রে।

আশ্রিতের কর্তব্যবোধ ছিল, আশ্রিতের ক্ষোভ-অভিযোগ ছিল না। ছিল না চিত্তদৈন্য, ছিল না অভিমান বা অপমান জ্ঞান। যেন নিজের বাড়িতেই আছে। ও যেমন স্বচ্ছন্দে স্নানের ঘর থেকে হাঁক পাড়তে পারত, কাকিমা, শীগগির! শীগগির! ভাতটা রেডি করে ফেলুন। তেমনি স্বচ্ছন্দেই বলতে পারত, ঠ্যাংটা বাড়ান তো একটু, মালিশটা করে দিয়ে যাই। নিজে তো আর করবেন না। মালিশের ওষুধ টেবিলে পড়ে থাকলেই কি বাত সারবে?

এই সহজ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ছিল বলেই বোধহয় ও প্রথম দিনেই আমায় তুমি বলেছিল।

ও তখন রমেশবাবুর জুতোটা নিয়ে পালিশ করছিল, বলল, কাকাকে খুঁজছ, কাকা তো বাড়ি নেই। বসতে চাও তো বসবার ঘরে বস।

আমি জানতাম না যে, রমেশবাবুর বাড়িতে এমন কোনো ছেলে আছে। ভাবলাম চাকর। আর ভাবলাম এতই গাঁইয়া যে, তুমি আপনির ভেদ জানে না। কিন্তু দেখলে কে বলবে চাকর!

সেদিন চলে এলাম।

পরদিন আর একটু দেরিতে গেছি, দেখি দিব্যি ফর্সা কাপড়-জামা পরে বেরোচ্ছে, হাতে বইয়ের গোছা। বললাম, স্যার বাড়ি আছেন?

আছেন।

বই নিয়ে যাচ্ছ কোথায়?

কলেজে, আর কোথায়?

কলেজে? তুমি কি কলেজে পড় নাকি?

তা নইলে গ্রাম থেকে এলাম কি করতে?

তুমি বলা হয়ে গেছে আর আপনি চলে না, তাই বললাম, মাস্টারমশাইয়ের কোনো আত্মীয় হও বুঝি?

আত্মীয়? ও হাসল।

বলল, আমি ওঁর আত্মীয় হই না, তবে উনি আমার আত্মীয়।

চাকর যে নয়, তা বুঝে ফেলেছিলাম। আর ওর ওই ভয়ঙ্কর উজ্জ্বল চোখ দুটো যেন আমাকে তীব্রভাবে সম্মোহিত করছিল।

তাই কথার পিঠে কথা বাড়ালাম, তুমি ওঁর আত্মীয় নয়, উনি তোমার আত্মীয়? সেটা আবার কি রকম?

বুদ্ধি থাকলে বুঝতে।

রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল।

বললাম, বুদ্ধি না থাকতে পারে, তবে কথার একটা মানে থাকা দরকার।

মানেটা বুঝতে না-পারাই তো আশ্চয্যি। থাক, আর মানে বুঝতে হবে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।

দেরি! ইস! কলেজে পড়ে না হাতি! বই নিয়ে কাউকে দিতে যাওয়া হচ্ছে। তা হলে তাই।

বলে হেসে চলে গেল ও।

ও যদি সতেজে প্রতিবাদ করত, তাহলে আমার অভিমানবোধ এমন ক্ষুণ্ণ হত না। আর সেই সূত্রে আরও কথা চালাতে পারতাম। অবচেতন মনে যা চাইছিলাম। কিন্তু ও অবজ্ঞা করে চলে গেল।

তখন হায়ার-সেকেন্ডারির জন্য টেস্টে অ্যালাউ হয়েছি, স্যার বলছেন খুব নাকি ভালো পড়ছি আমি, তাই মনের মধ্যে বিরাট আত্মমর্যাদাবোধ, তাই এই অবজ্ঞাটা প্রাণে লাগল। ভাবলাম, রোসো শোধ নিচ্ছি!

.

০৮.

সেই প্রথম পরিচয়।

শোধ নেবার সংকল্পে দৃঢ় হলাম।

তারপর জানলাম ও রমেশবাবুর বাল্যবন্ধুর ভাইপো, দীনহীন আশ্রিত। জানলাম ওর নাম দুরন্ত। জানলাম আশুতোষে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। জানলাম যেমনি সপ্রতিভ, তেমনি জলি।

তারপর জানলাম ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।

ও বলত—মানে পরে, যখন আমি মাকে নানা মিথ্যা কথায় ছলনা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ওর সঙ্গে লুকিয়ে বেড়াতে পালিয়ে যাচ্ছি।

কলেজে ভর্তি হয়েছি তখন, সুবিধে কিছু সঞ্চয় হয়েছে। কোনোদিন বলি বান্ধবীর বাড়িতে পড়তে যাচ্ছি, কোনোদিন বলি লাইব্রেরি যাচ্ছি। কোনোদিন হয়তো—অর্থাৎ এরকম ক্ষেত্রে অন্য যে-কোনো মেয়েই যা যা বলত, যেভাবে ছলনা করত, ঠিক তাই করতাম। নতুন কিছু না।

ছলনা করে বেরিয়ে পড়ে আবার ওর সঙ্গে ছলনা করতাম। বলতাম, আর এরকম চলবে না। মা জেনে ফেলেছেন।

তখন বাবা মারা গেছেন, শুধু মা। মা-র কথাই বলতাম।

ও বলত, লুকোচুরির কি আছে? বললেই পার স্পষ্ট করে।

আহা রে! কী বলব শুনি?

কেন? বলবে, মা, মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির জুতো-ঝাড়া চাকর সেই দুরন্তটার প্রেমে পড়ে গেছি আমি। তাই তাকে নিত্য একবার না-দেখলে ছটফটিয়ে মরি।

রেগে বলতাম, আমি তোমায় বলেছি কোনোদিন জুতো-ঝাড়া চাকর?

বলনি, ভেবেছ।

আহা একেবারে অন্তর্যামী! কে কি ভেবেছে–

অন্তর্যামীই তো। হেসে উঠত ও, না হলে সেই প্রথম দিনেই কী করে বুঝলাম, মেয়েটা স্কুলের বালিকা হলে কি হয়, রীতিমতো পরিপক্ক। একটা ছেলেকে দেখল আর প্রেমে পড়ল! একেবারে অগ্নিতে পতঙ্গবৎ।

ইস, অহমিকার আর শেষ নেই! দেখল আর প্রেমে পড়ল!

পড়নি তো এত ছটফটানি কিসের?

ছটফটানি আবার কি?

ও, নেই বুঝি? আচ্ছা, ঠিক আছে, কাল থেকে আর আসবার দরকার নেই।

বেশ।

ও হঠাৎ দুরন্ত বেগে এক সেকেন্ডের মধ্যে আমার চোখের কাজল, ঠোঁটের রং, খোঁপার বাঁধুনী, সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে বলত, এই খবরদার! অ্যাবসেন্ট হলে চলবে না। আমার দরকার আছে।

রেগে যেতাম, হাঁপিয়ে যেতাম, বলতাম, কে তোমার নামটা রেখেছিল?

কি জানি। নিশ্চয়ই কোনো দূরদ্রষ্টা ঋষি।

কক্ষণো আসব না আর।

পাগল! কালই আসবে আবার আরও সেজে-গুঁজে।

এইভাবে ঘোচাতে?

ও একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলত, এ আর কিই বা! ওর সেই চোখদুটোয় যেন আগুন জ্বলে উঠত।

আমার বুকটা কেঁপে উঠত।

পালিয়ে আসতাম।

ভাবতাম, নাঃ, সত্যিই আর নয়।

কিন্তু কদিন থাকত সে প্রতিজ্ঞা?

.

০৯.

ছেলেমানুষী মজা থেকে ক্রমশ জ্বলে ওঠে বাসনার আগুন, তীব্র থেকে তীব্রতর হয় আকর্ষণ। রাতে মা-র শয্যার একাংশে শুয়ে শুধু সেই পরম রমণীয় ক্ষণটুকুরই চিন্তা করি, যে ক্ষণটুকু অনেক চেষ্টায় আহরণ করি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আস্বাদ করি ওর কথা, ওর হাসি, ওর দুরন্ত আবেগ।

কোনো কোনোদিন মনে হয় কাল আর বাড়ি ফিরব না, বলব, চল আমরা কোথাও পালিয়ে যাই।

কিন্তু দিনের আলোয় সে চিন্তার অবাস্তবতা ধরা পড়ে। ও তখনও পরাশ্রিত পড়ুয়া ছেলে, আর আমি মা-দাদার পরম বিশ্বাসস্থল একটা থার্ড ইয়ারের ছাত্রী মাত্র। পালিয়ে গিয়ে কি গাছতলায় সংসার পাব?

বলতাম, এম.এ. পড়ে তোমার কী ডানা গজাবে? এটা কিছু কর না?

করছি তো—

কী করছ?

কেন, প্রেম।

থামো অসভ্য! রোজগারপাতির চেষ্টা কর না?

তা সেটাই তো করছি। এম.এ. দিয়ে বেরোতে আর একটা বছর, তারপর দুটো বছর যাবে রিসার্চে। একটা ডক্টরেট নিয়ে

প্রফেসরি করবে, এই তো?

সেটাই আমার আপাতত লক্ষ্য। আমার বাবা শিক্ষকতা করতেন, আমিও তাই করব। মা-র তাই ইচ্ছে ছিল।

ঠিক আছে। মাস্টারিও শিক্ষকতা। যা তোমার বাবা করতেন। আমিও বি.এ. দিয়ে বেরোলেই—

নাঃ। স্কুলমাস্টারি নয়।

তা তো বটেই। আমি রেগে বলতাম, তাতে সুবিধে কি? কলেজের অধ্যাপনা, দোহাত্তা ছাত্রীদের সঙ্গে প্রেম, তবেই তো সুখ।

কী সর্বনাশ! দেখছি যে তুমিই অন্তর্যামী। এত কষ্টে মনের গোপন ইচ্ছেক লুকিয়ে রেখেছি, তাও ধরে ফেলেছ?

ফেলব না কেন? প্রকৃতিটি জেনে ফেলেছি যে।

ঘরে একটি বাঘিনী থাকতে কি সে সুযোগ হবে? হয়তো সেই অবলা হলগুলিকে কামড়েই দিয়ে আসবে।

আসবই তো। ভেবেই তো কামড়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

ও গম্ভীরভাবে বলত, তা সে ইচ্ছের কিছুটা পূরণ করতে পার। আসামীর একজন হাতের কাছে হাজির।

সে আসামীকে কুচি কুচি করে কাটলেও রাগ মিটবে না।

বলতাম ঠাট্টা করে।

কিন্তু ক্রমশই যেন ওর সম্পর্কে একটা আক্রোশ ভাবের সৃষ্টি হচ্ছিল। মনে হত যেন ওর তেমন গরজ নেই। নইলে এমন ধীর মাথায় ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা করছে? বসে বসে পরের অন্ন খাচ্ছে, আর কলেজ যাচ্ছে বাড়ি আসছে?

আর তার মাঝখানে আমায় নিয়ে খেলা করছে।

আমি অতএব ক্রমশ দুমুখ হলাম, মুখরা হলাম, রোজগার রোজগার করে ওকে উৎখাত করতে শুরু করলাম।

অথচ সত্যি কীই বা বয়েস ছিল তখন ওর। কী-ই বা বয়েস ছিল আমার। বুঝতে পারি, শুধু যে আমার দুর্দাম বাসনাই এই জ্বালাতন করাত আমায় দিয়ে তা নয়, ওর ওই অন্নদাসত্বও অসহ্য হচ্ছিল আমার।

আমার প্রেমাস্পদ তুচ্ছ একটু অন্নঋণ শোধ করতে সকালবেলা উঠে থলি হাতে বাজারে ছুটবে, পাতানো কাকার জুতো পালিশ করবে, পাতানো কাকিকে ঘুমের সুযোগ দিতে চা বানাবে, ডাল চড়াবে, এ অসহ্য! ভাবলেই আমার আপাদমস্তক রি-রি করে উঠত।

কিন্তু ওর যেন কোনো বিকার নেই।

বলত, ছোটো কাজ? কাজের আবার ছোটো-বড়ো কি? আমার কাছে ছোটো কাজের সংজ্ঞা আলাদা। তা ছাড়া কষ্টই বা কি? তুমি কর না এসব কাজ?

আমি করি নিজের বাড়িতে।

নিজের বাড়ি!—ও হেসে ফেলত, তা বটে। তবে দুদিন বাদে বাড়িটিও পরের বাড়ি হয়ে যাবে, এই যা।

কক্ষনো না। মা আমায় কী দারুণ ভালোবাসে জানো? পর করে দেবে ভেবেছ?

বেশ, ওখানে হারলাম। কিন্তু তোমার বউদি? ওই সব ছোটো কাজ করেন না কখনও? তার তো পরের বাড়ি।

আহা কী বুদ্ধির ছিরি! বরের বাড়িটা বুঝি পরের বাড়ি?

তাও নয়? তাহলে সম্পূর্ণ হারলাম। আপন-পর জ্ঞানটা ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারিনি।

রেগে বলতাম, মহাপুরুষগিরি রাখো, এই অন্নদাসত্বর পালা শেষ কর। কাগজে কত কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখি, দরখাস্ত করে যাও চোখ বুজে। একটা না একটা লেগেই যাবে।

ও একটু চুপ করে থেকে বলে, ভেব না করছি না। তাও করছি। হবে, হয়ে যাবে।

ও আবার একটু চুপ করে থেকে বলে, ধর যদি অনেক দূর চলে যেতে হয়?

আমি মহোৎসাহে বললাম, সে তো আরও ভালো। অজানা সাগরে পাড়ি দেব মোরা দুজনে। কেটে যাবে দিন শুধু গানে আর কুজনে।

ও বলল, স্বপ্নটা বেশ গোলাপী দেখছি। নেশা টেশা করলে শুনেছি এ-ধরনের গোলাপী স্বপ্ন দেখে।

নেশা তো করেইছি— বলে হেসে উঠলাম।

হঠাৎ ওর চোখে বিদ্যুৎ জ্বলে উঠল। বলল, নেশা একলা করতে নেই। দেখি, পানপাত্রটা আমার হাতে দাও তো একবার।

এই ওর স্বভাব।

কখনও স্থির, কখনও অস্থির।

কখনও বিজ্ঞ, কখনও বেপরোয়া।

কারণ ওর বুদ্ধিটা তীক্ষ্ণ আর মাথাটা ঠাণ্ডা হলেও ওর প্রকৃতি উদ্দাম, ওর বাসনায় বন্যতা। ক্রমশই ওর মধ্যে দুটো সত্তা সমান প্রবল হয়ে উঠছে।

আমার কিন্তু ইচ্ছে হয় এই দুই বিভিন্ন সত্তার সমন্বয় দেখি ওর মধ্যে। কিন্তু তা হয় না, ও কখনও উদাসীন হয়ে বসে থাকে, কখনও দুরন্ত মূর্তিতে প্রকাশিত হয়।

একদিন হঠাৎ এসে বলল, ভেবে দেখলাম প্রফেসরি করে কিচ্ছু হবে না। টাকা চাই, অনেক টাকা। অতীত জীবনের সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলবার মতো টাকা, ভবিষ্যতের সোনার প্রাসাদ গড়বার মতো টাকা। আচ্ছা, কি করলে বেশ রাশি রাশি টাকা পাওয়া যায় বলতে পারো?

বোধহয় চুরি করলে।

খবরদার ঠাট্টা কোরো না এখন। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।

হল কি? কিছু না বলে ও মাথার লম্বা লম্বা চুলগুলো মুঠোয় চেপে টানতে লাগল।

.

১০.

কি ওর হয়েছিল সেদিন জানি না, কিন্তু সেই দিন থেকে ওর যে একটা পরিবর্তন ঘটেছিল তাতে সন্দেহ নেই। ওর ভিতরকার সেই মানসিক প্রশান্তি—যা দেখে এক এক সময় আমার রাগে গা জ্বালা করত, তা যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ও বেশিক্ষণ কথা বলতে পারত না, আমি দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে চঞ্চল হয়ে ওঠবার আগেই বলত, আচ্ছা, আজ চলি।

আর কোনো কোনোদিন বলত, আকাশ থেকে একবোঝা টাকা পড়তে পারে না? উল্কাপিণ্ডের মতো?

একদিন বললাম, এত টাকার তোমার দরকার কি? যা তোক একটা কাজকর্ম করলেই তো বেশ চলে যাবে আমাদের।

ও অস্থির গলায় বলল, না, সেভাবে খুঁড়িয়ে চলায় আমার সুখ নেই, আমি রথে চড়ে রাজপথে চলতে চাই।

কেন জানি না হঠাৎ চোখে জল এল।

মনে হল, সেটা কি শুধু তুমি একলাই চাও? কে না চায়? কিন্তু চাইলেই তো পাওয়া যায় না! আর সেটা পাওয়া যাবে না বলে অভিমান করে জীবনের সুন্দর দিনগুলো, কবিরা যাকে নাকি বলে থাকেন নবযৌবন, বসে বসে বিকিয়ে দেবে?

কিন্তু মনে হলেই তো ঠিক গুছিয়ে বলা যায় না। ওর মনে এ আগুন তো আমিই জ্বেলে দিয়েছি, ওর চিত্তের প্রশান্তি তো আমিই নষ্ট করে দিয়েছি। ও তো ওর ওই অন্নদাসের জীবনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মুঠো মুঠো মাটি দিয়ে পথ তৈরি করতেই চেয়েছিল। ওর গলাতেই তো একদা শুনেছি, পৃথিবীর এককোণে রহিব আপন মনে, ধন নয়, মান নয়, এতটুকু বাসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *