২৩. ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে

ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে।

দরজার ফাঁক দিয়ে ওরা দেখলো ঘরের মধ্যে সন্তোষ চৌধুরী ও কানাইয়ের মা।

তুই আবার ফিরে এলি কেন? রুক্ষ সন্তোষের কণ্ঠস্বর।

তুই বলেছিলি আসবি—আসিসনি বলে—চল, এবার তোকে সঙ্গে করে নিয়ে তবে আমি যাব।

আমার যাবার এখনও সময় হয়নি, তুই যা।

না, তোকে না নিয়ে যাবো না।

যা বলছি হারামজাদী! এখনো ফিরে যা, নইলে তোকে খুন করবো বলছি!

তাই কর, তাই কর। তবু, সবুর অমঙ্গল আমি করতে দেব না।

রাক্ষসী শয়তানী! সবু তোর কে যে তার জন্যই তুই হেদিয়ে মরছিস?

তোর সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। তুই যাবি কিনা বল?

না-না-না। তুই যা।

তুই তাহলে যাবি না? কানাইয়ের মা দৃঢ়কণ্ঠে প্রশ্ন করে

না।

যাবি না?

না।

এক্ষনি তবে আমি চেচিয়ে সকলকে ডেকে তোর আসল পরিচয় দেবো!

খুন-খুন করে ফেলবো তবে তোকে রাক্ষসী। হিংস্র রাগে এগিয়ে গিয়ে সত্যি সত্যি সন্তোষ কানাইয়ের মার গলা টিপে ধরে।

সেই মুহূর্তেই কিরীটীর ইঙ্গিতে লক্ষ্মীকান্ত দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেচিয়ে ওঠেন, দরজা খোল! দরজা খোল!

কিন্তু ভিতর হতে কোন সাড়া নেই।

দরজা খোল! না হলে দরজা ভেঙে ঢুকবো!

তথাপি কোন সাড়া নেই।

ভাঙুন দরজা। কিরীটীই বলে।

তিনজনে মিলে একত্রে ধাক্কা দিতেই ভিতর হতে মড়াৎ করে দরজার খিল ভেঙে গেল। তিনজনেই হড়মড় করে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।

সন্তোষবাবু, you are under arrest! লক্ষ্মীকান্ত গর্জন করে ওঠেন।

হতচকিত বিহ্বল সন্তোষ ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, পাশেই আবক্ষ অবগুণ্ঠন টেনে নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মত দাঁড়িয়ে কানাইয়ের মা।

কি, ব্যাপার কি! কি ব্যাপার? খোলা দ্বারপথে ঠিক ঐ সময় সান্যালের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

এই যে সান্যাল মশাই! আসুন আসুন—ঠিক সময়েই আপনি এসেছেন। সহসা অত্যন্ত উচ্ছসিত কণ্ঠে যেন সাদর আহ্বান জানাল কিরীটী দ্বারপ্রান্তে উপনীত নিত্যানন্দ সান্যালকে।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই চমকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে। এবং সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ-চমকের মতই অবগুণ্ঠনবতী কানাইয়ের মা তার দীর্ঘ অবগুণ্ঠন সহসা মাথার উপরে তুলে দিয়ে তাকাল সান্যালের মুখের দিকে।

এ কি, সেই কানাইয়ের মা না? আকস্মিক উত্তেজনায় অসতর্ক কণ্ঠ হতে নিত্যানন্দের উচ্চারিত হলো কথাগুলো।

হ্যাঁ, আমি। ফিরে আসতে হলো আমাকে।

ব্যাপারটা যেন আদৌ কিছুই নয় এমনি একটা উদাসীন শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে নিত্যানন্দ বললেন, হঠাৎ তুই কাউকে না বলে চলেই বা গেলি কেন, আবার ফিরেই বা এলি কেন? এদিকে তোর জন্য সকলে আমরা ভেবে মরি!

কানাইয়ের মা নিত্যানন্দ সান্যালের কথার কোন জবাব দিল না, কেবল তার ওষ্ঠপ্রাতে অদ্ভুত হাসির একটা বঙ্কিম রেখা জেগে উঠলো মাত্র।

বিস্মিত নির্বাক কিরীটী কানাইয়ের মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

এ তার পূর্ব-পরিচিতা এ বাড়ির পুরাতন দাসী কানাইয়ের মা নয় যেন। ভীরু সঙ্কোচে দৈন্যবিলুণ্ঠিতা কানাইয়ের মাও নয়।

দাঁড়াবার ভঙ্গীটি পর্যন্ত যেন পাল্টে গিয়েছে। মাথার উপরে অবগুণ্ঠন স্খলিত। মাথার সম্মুখের দিকে কাঁচা-পাকায় মিশানো চুলগুলো। ছোট ললাট। ধোপদুরস্ত একটা সাদা থানকাপড় পরিহিতা। গায়ে একটা সাদা খদ্দরের মোটা চাদর।

ওর সর্বাঙ্গ দিয়ে, এমন কি দাঁড়াবার ভঙ্গীতে পর্যন্ত যেন একটা আভিজাত্য ফুটে বের হচ্ছে।

সেই চিরপরিচিত কানাইয়ের মা যেন দাসীর পদ হতে অভিজাত বংশের এক নারী-পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছে হঠাৎ। গৌতম-অভিশাপে পাষাণী অহল্যা যেন অকস্মাৎ রাঘবের রতুল চরণস্পর্শে ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে।

আর কেন, এবার ক্ষান্ত হও দাদা। মাথার উপরে ভগবান আছেন, এত পাপ তিনি সহ্য করবেন না। অবিচলিত শান্ত কণ্ঠ হতে কানাইয়ের মার কথাগলো বজ্রের মতই উচ্চারিত হল।

ঘরের মধ্যে যেন অকস্মাৎ কানাইয়ের মার নিত্যানন্দ সান্যালকে সম্বোধিত কথাগুলো উচ্চারিত হল।

নিত্যানন্দ সান্যালের সমস্ত মুখে যেন কে একপোঁচ কালি বুলিয়ে দিয়েছে। কালো মুখখানা থমথম করছে একটা হিংস্র উত্তেজনায়।

কিন্তু মুহূর্তে সামলে নিলেন নিত্যানন্দ সান্যাল নিজেকে, কানাইয়ের মা! অনেক দিনের চাকরানী তুই আমাদের বাড়ির। বালবিধবা হেম তোকে বড় স্নেহ করত। হেম আমাকে দাদা বলে ডাকত, তুইও তার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দাদা বলে ডাকতিস। দাসী হলেও তোকে আমি চিরদিন ছোট বোনের মতই দেখেছি। বুঝতে পারছি, কোন কারণে তুই মনে বড় ব্যথা পেয়েছিস। তাই বোধ হয় মাথারও ঠিক নেই তোর। চল, পাশের ঘরে চল, বুঝতে পারছি তোর বিশ্রামের প্রয়োজন—আর, বলে নিজেই সান্যাল ঘর ছেড়ে যাবার জন্য পা বাড়ান।

কানাইয়ের মা কোন কথা বলার পূর্বেই কিরীটী গমনোদ্যত নিত্যানন্দ সান্যালকে বাধা দিল, দাঁড়ান সান্যাল মশাই! ঘর ছেড়ে যাবেননা!

নিঃশব্দে ফিরে দাঁড়ালেন সান্যাল এবং চোখ তুলে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

কিরীটীও তাকিয়ে আছে সান্যালের মুখের দিকে।

যুধ্যমান দুটো শাণিত তরবারি যেন পরস্পরের প্রতি উদ্যত।

সহসা কানাইয়ের মার কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, মাথা আমার ঠিকই আছে দাদা। দেখছি গোলযোগ ঘটেছে আপনারই, নইলে মায়ের পেটের বোনকে চিনতে পারছেন না।

তবে রে হারামজাদী ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতই যেন অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাত দিয়ে কানাইয়ের মার কণ্ঠদেশ টিপে ধরলেন সান্যাল।

মুখোশটা খুলে গেল সান্যালের।

ঘটনাটা এত দ্রুত ও আকস্মিক ভাবে ঘটে গেল যে, ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই মুহূর্তের জন্য হতচকিত ও বিহ্বল হয়ে পড়ে।

নিষ্ঠুর পেষণে কানাইয়ের মার গলা দিয়ে একটা গোঁ গোঁ শব্দ কেবল বের হচ্ছে।

তোকে খুনেই করে ফেলবো হারামজাদী, গর্জাতে থাকে ক্রোধান্ধ সান্যাল, আর পেষণ আরো কঠিন করেন হাতের মুষ্টির।

কিরীটী সর্বাগ্রে এগিয়ে বলিষ্ঠ দুই বাহুতে সান্যালের কাঁধ টিপে ধরে প্রবল এক ঝাঁকুনি দেয়, ছাড়ন, ছাড়ুন!

কিন্তু মরীয়া হয়ে উঠেছেন সান্যাল। চীৎকার করে ওঠেন, না না—খুনখুন করবো ওকে আমি। বাধ্য হয়ে কিরীটী তখন যুযুৎসর প্যাঁচে সান্যালের কঠিন মুস্টি শিথিল করে কানাইয়ের মাকে মুক্তি দেয়।

কানাইয়ের মা ঢলে পড়ে যাচ্ছিল, সত্যজিৎ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলে। এলিয়ে পড়ে কানাইয়ের মা চেয়ারটার উপরেই।

বাইরে এমন সময় পদশব্দ পাওয়া গেল। সকলেই সোৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় খোলা দরজার দিকে। ঘরে প্রবেশ করলেন নায়েব বসন্ত সেন।

হ্যাঁ, আমি। কিন্তু এসব কি ব্যাপার লক্ষ্মীকান্ত?

জবাব দিল কিরীটী, আসুন নায়েব মশাই। আজকের ঘটনার you were the missing link,হারানো সূত্র!

কিরীটী তখনও নিত্যানন্দ সান্যালকে দুই হাতে ধরে আছে। নিত্যানন্দকে অতঃপর অন্য একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে কিরীটী বললে, সুবোধ বালকের মত এবারে বসুন তো সান্যাল মশাই! Dont try to play any more dirty tricks! আপনার খেলা শেষ হয়েছে।

চোখের জলের মধ্যে দিয়েই কানাইয়ের মা—হতভাগিনী সৌদামিনী তার জীবনের কলঙ্ক-মাখা ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো একের পর এক মেলে ধরতে লাগল।

নির্বাক সকলে বসে ঘরের মধ্যে। কিরীটী, সত্যজিৎ, নিত্যানন্দ সান্যাল, সন্তোষ চৌধুরী, বসন্ত সেন, কল্যাণী, সবিতা, সৌদামিনী দেবী, লক্ষ্মীকান্ত সাহা ও অতীনলাল।

রাত শেষ হয়েছে। ভোরের প্রথম আলো পূর্বাকাশ রাঙিয়ে তুলছে।

.

সৌদামিনীর কথা

হতভাগিনী কলঙ্কিনী সৌদামিনীর কথা কি আর নতুন করে শুনবেন কিরীটীবাবু! বাংলাদেশের ঘরে ঘরেই তো এমনি কত ইতিহাস আছে, কিন্তু কজনা তার খোঁজ রাখে! তিলতিল করে কত হতভাগিনীর জীবন-প্রদীপ যে নিভে যায়—তুষানলে ধিকিধিকি জলে নিঃশেষ হয়ে যায় কত সৌদামিনী, সে সংবাদই বা কজনে এ সংসারে পায়!

তের বৎসর বয়সের সময় বিবাহ হল আমার। স্বামী কেমন চিনলামই না। খেলাঘরের মতই স্বামীর ঘর আমার নিষ্ঠুর পদাঘাতে ভেঙে গুড়িয়ে গেল। হাতের নোয়া, সিথির সিদূর মুছে এক বৎসরের মধ্যেই ফিরে এলাম বাপের ঘরে; রাক্ষসী পোড়াকপালী আমি।

হেম আমার তিন বৎসরের ছোট হলেও আমার খেলার সাথী সে ছিল। সে-ই ছিল আমার সঙ্গী। ফিরে এসে আবার হেমের সঙ্গেই খেলাঘর পাতলাম। তিনটি বছর কেটে গেল, হঠাৎ একদিন শিউরে উঠলাম নিজের দিকেই তাকিয়ে। দেহের দুকূল ভেঙে নেমেছে কখন জোয়ারের জলোচ্ছাস। টেরও পায়নি। অসংবৃত দেহকে যেন কোনমতেই আর লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে পারি না। এমন সময় হেমের হল বিয়ে।

হেমের স্বামী মৃত্যুঞ্জয় বিবাহের পর একটা বছর ঘন ঘন আমাদের ওখানে আসত। প্রথম প্রথম মৃত্যুঞ্জয়কে এড়িয়েই চলতাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা ছাদের ওপরে একাকী দাঁড়িয়ে আছি, সহসা কার পদশব্দে ফিরে তাকালাম। যাকে দেখলে আমার এত ভয়, যার চোখের দিকে তাকাতে বুকে কেঁপে ওঠে, নিজেকে যেন আর কোনমতেই ধরে রাখতে পারি না—সেই মৃত্যুঞ্জয়! আমার দেবতা! আমার সব!

***

ভয় পেলে সৌদামিনী?

না, সৌদামিনীর বুক তখন কাঁপছে দুরু দুরু। তুমি আমাকে এড়িয়ে চল কেন মিনি? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? কেন তুমি আমায় ভয় কর বল তো?

কই, না তো! ভয় করি কে বললে? মনে মনে বলে সে, ওগো দেবতা, আমার ভয় নয় গো, ভয় নয়—আমি কেমন বিবশ হয়ে যাই।

চাও তো দেখি আমার চোখের দিকে? কই, চাও? সহসা হাত বাড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয় সৌদামিনীর একটা হাত ধরে ফেলেন।

না, ছাড় কেউ এসে যাবে এখুনি লক্ষীটি!

এত ভয় তোমার সৌদামিনী?

না না! ছিঃ!

সমস্ত যৌবন সৌদামিনীর তৃষিত হয়ে উঠেছিল কিন্তু সে তৃষ্ণা তার মিটল না। বরং দিনকে দিন যে বেড়েই চলে। শেষ পর্যন্ত যেদিন তার খেয়াল হল, সারা দেহ ছাপিয়ে এসেছে তার অনাকাঙ্ক্ষিত মাতৃত্ব সেদিন ভয়ে সে নীল হয়ে গেল।

নীলকণ্ঠ সারা বিশ্বের গরল ধারণ করে যেখানে কলকল্লোলকান্তি জাহ্নবীবেষ্টিত হয়ে অন্নপূর্ণার দুয়ারে ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়েছেন, সৌদামিনী সেখানে ছুটে এলো তার কলঙ্কিত দেহের যৌবনমথিত গরলটুকু নিয়ে; সেই গরলে নীলকণ্ঠ দেবাদিদেবের চরণেরই আশ্রয়ে।

ধনঞ্জয় সেখানেই জন্ম নিল এক সেবাশ্রমে।

সৌদামিনী যেদিন সেবাশ্রম হতে দুই মাসের শিশুপুত্রকে বুকে করে ফিরে এলো, নিত্যানন্দ তখন দুয়ার রোধ করে দাঁড়ালেন, যাও, এখানে নয়।

কলঙ্কিনী! লজ্জা করে না তোর! দূর হ!

কি করবে এখন সে? কোথায় যাবে? অনন্যোপায় সৌদামিনী আবার কাশীতেই ফিরে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে এক পত্র দিল।

মৃত্যুঞ্জয় পত্র পেয়ে কাশীতে এলেন এবং বললেন, এখানে এভাবে তোমার সন্তানকে তুমি, মানুষ করতে পারবে না মিনি। তার চাইতে ওকে কোন অনাথ আশ্রমে দাও, আমি সব ব্যয়ভার বহন করবো, আর তুমি আমার ওখানেই চলো।

কি জানি কেন, সৌদামিনী তাতেই রাজী হলো। ধনঞ্জয়কে এক আশ্রমে রেখে সৌদামিনী মৃত্যুঞ্জয়ের গৃহেই এসে উঠলো।

কিন্তু পরিচয় দিল তার সৌদামিনী নয়-দাসী কানাইয়ের মা বলে।

কানাইয়ের মা পরিচয়েই সৌদামিনি চৌধুরী-গৃহে থেকে গেল। সৌদামিনী মরেছে।

হেমপ্রভার ব্যাপারটা আদৌ মনঃপুত না হলেও, মুখে সে কিছু বললে না বটে তবে দুঃখ পেল স্বামীর ব্যবহারে।

সৌদামিনীর মাতৃত্বের সংবাদ না পেলেও সৌদামিনীর সম্পর্কে তার স্বামীর দুর্বলতার কথাটা তার অবিদিত ছিল না।

কিন্তু ক্রমে সৌদামিনীকে হেমপ্রভার সহ্য হয়ে গিয়েছিল, যখন সে দেখলে সৌদামিনী তার গৃহে এলেও সত্যি-সত্যিই দাসীর মতই সে দিন কাটাচ্ছে। সে তার অধিকারের সীমাকে কোন অজুহাতেই লঙ্ঘন করে না বা করবার চেষ্টাও করে না। সবিতা এলো হেমপ্রভার গর্ভে এবং ঐ সময় হতেই হেমপ্রভা স্বামীর ব্যবহারে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে লাগল। স্বামী যেন তার সদাই গম্ভীর, চিন্তাকুল।

আরো দেখলে, প্রতি মাসে স্বামী তার দাদা নিত্যানন্দকে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ইনসিওর করে পাঠায়।

একদিন প্রশ্ন না করে আর পারে না, কিন্তু স্বামীর কাছে কোন জবাবই পায় না।

কথাটা একদিন সৌদামিনীর কাছে কিন্তু প্রকাশ হয়ে গেল।

সৌদামিনী ঐ বাড়িতে থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর কোন ব্যাপারেই থাকত না।

কিন্তু হেমের মুখের দিকে চেয়েই একদিন রাত্রে সৌদামিনী মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে এসে প্রবেশ করল, ওখানে আসবার দীর্ঘ আট মাস পরে।

দীর্ঘদিন পরে সৌদামিনীকে নিজের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে মৃত্যুঞ্জয় প্রশ্ন করেন, সৌদামিনী, তাহলে তুমি আজও বেঁচে আছো?

সৌদামিনী তো অনেকদিন আগেই মরে গেছে চৌধুরী মশাই-এ কানাইয়ের মা সৌদামিনীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে, যে পাপ সে তার নিজের কাছে করেছিল। কিন্তু সে কথা যাক, আমি একটা কথা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম চৌধুরী মশাই!

বল?

প্রতি মাসে আপনি লুধিয়ানায় দাদাকে টাকা পাঠান, এ কথা কি সত্য?

সৌদামিনীর প্রশ্নে মৃত্যুঞ্জয় কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ সত্য। কিন্তু একান্তই শুনতে চাও কি কেন?

হ্যাঁ বলুন।

হেমও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে অনেকবার, কিন্তু বলতে পারিনি। দুঃখের ও লজ্জারই কথা, তোমাকে বলছি তবু হেমকে বলতে পারিনি, এবং কেন পারিনি হেম না বুঝতে পারলেও তুমি বুঝবে। হেমকে বিবাহ করবার মাস আষ্টেক আগে একবার দেশভ্রমণে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে উজ্জয়িনীতে গিয়েছিলাম। সেখানে এক চৌহান রাজপুতের মেয়ে কাঞ্চনমালার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করি।

চৌধুরী মশাই! একটা আর্ত চীৎকার যেন সৌদামিনীর কণ্ঠ চিরে বের হয়ে আসে।

ভাবছো আমি মহাপাষণ্ড, না! তাই। আমারও পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়েছে। মুক্তি পাইনি। কিন্তু যা শুনতে চাইছিলে শোন। বিবাহের পর মাস তিনেক কেটে গেল, ভাবছি বাবাকে সব লিখে জানাব এবং বৌকে নিয়ে দেশে আসব, এমন সময় কাঞ্চনের এক বন্ধু ছিল রাজপুত যুবক চেৎ সিৎ, তারই সঙ্গে একদিন রাত্রে বাগানে কাঞ্চনকে দেখে হিংসায় বুক আমার জ্বলে গেল। ওদের উপর নজর রাখতে লাগলাম। বুঝলাম কাঞ্চন চেং সিং কে ভালবাসে। মাঝখানে আমি এসে না পড়লে ওদের বিবাহও হত একদিন। হিংসায় ক্রোধে অন্ধ হয়ে কাঞ্চনকে ফেলে এক রাত্রে চুপে চুপে পালিয়ে এলাম। ওরা আমার ঠিকানাও জানত না। পরে ফিরে এসে মাস আষ্টেক বাদে হেমকে বিবাহ করি। ওদের আর খোঁজ নিইনি। মাস পাঁচেক পূর্বে তোমার দাদা নিত্যানন্দর চিঠিতে জানতে পারি, যখন চলে আসি কাঞ্চন তখন নাকি অন্তঃসত্বা ছিল। এবং একটি মেয়ের জন্মদান করেই সে মারা গিয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় চুপ করলেন।

তারপর?

তারপর তোমার দাদা নিত্যানন্দ উজ্জয়িনীতে গিয়েছিল বেড়াতে। কেমন করে জানি না কাঞ্চনের বাপ লক্ষণ সিংয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং বোধ হয় সে সব কথা জানতে পারে এবং বুঝতে পারে আমিই সেই।

কেমন করে বুঝতে পারলেন তিনি?

কাঞ্চনের কাছে আমার একটা ফটো ছিল সেই ফটোটা দেখে। ফটোটাই এখন তার সম্পত্তি এবং তারই জোরে গত কয়েক মাস ধরে সে আমাকে শোষণ করছে। মাথা নীচু করলেন মৃত্যুঞ্জয়।

দাদার এতদূর অধঃপতন হয়েছে।

মাঝে মাঝে ভাবি কি জান সৌদামিনী, কলঙ্কসাগরে তো ডুবেছিই। কাঞ্চনের মেয়ে সে তো আমারই, তাকে এখানে নিয়ে আসি।

আপনি কি পাগল হলেন? ও চিন্তাও মনে স্থান দেবেন না। একবারটি ভাবুন তো, এ সংবাদ হেম জানতে পারলে সে কত বড় দুঃখ পাবে? কিন্তু আমার একটা কথা শুনবেন?

বল? দাদাকে এখানে একবার আসতে লিখুন, আমি তার সঙ্গে কথা বলবো।

তাতে কি কোন ফল হবে সৌদামিনী, বরং টাকা যেমন সে নিচ্ছে নিক। এতে যদি সে সন্তুষ্ট থাকে তো

সন্তুষ্ট! জানেন না চৌধুরী মশাই, লোভ বেড়েই চলে ক্রমে, ওর হাঁ সামলাতে আপনাকে সর্বস্বান্ত হতে হবে। তার চাইতে লিখে দিন দাদাকে এখানে আসতে।

বেশ।

মাসখানেক বাদে নিত্যানন্দ এলেন। সৌদামিনী ভুল করেছিল। নিজের মায়ের পেটের ভাই হলেও নিতানন্দ-চরিত্র সে ঠিক বুঝতে পারেনি। যাবার আগে বরং সে শাসিয়েই গেল উল্টে সৌদামিনীকে।

নিত্যানন্দ চলে গেল বটে, তবে মনে মনে যাবার আগে সে নতুন এক ফন্দী মাথায় নিয়ে ফিরে গেল এবং তারপর দেখা গেল, ঘন ঘন সে কাঞ্চনপুরে যাতায়াত শুরু করেছে। হেমপ্রভার প্রতি তার স্নেহ ও ভালবাসা যেন উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে দিনের পর দিন।

বৎসর দুই এইভাবে নিয়মিত মৃত্যুঞ্জয়ের ওখানে আসা-যাওয়া করে করে এবারে সে আর এক মর্মঘাতী তীর নিক্ষেপ করল মৃত্যুঞ্জয়ের বুকে।

দুর্বলচিত্ত সন্দিগ্ধ-চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় সহজেই সেই নিক্ষিপ্ত শরাঘাতে কাবু হয়ে পড়লেন, হেমপ্রভা মধ্যে মধ্যে একমাত্র নিত্যানন্দকেই পত্র দিত। হঠাৎ একবার দুদিনের জন্য এসে নিত্যানন্দ হেমপ্রভা ও তার শিশুকন্যাকে সঙ্গে করে লুধিয়ানায় নিয়ে গেল মৃত্যুঞ্জয়ের অবর্তমানেই। সেই সময় কিছুদিন ধরে হেমপ্রভার সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়ের মন-কষাকষিটা একটু বেশীই চলছিল। বাড়ী ফিরে মৃত্যুঞ্জয় হেমপ্রভাকে না দেখতে পেয়ে মনে মনে ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। স্ত্রীকে চিঠিও দিলেন না। হেমপ্রভাও অভিমানভরে একখানি চিঠিও স্বামীকে লিখল না। সৌদামিনী এসবের কিছুই জানত না। দীর্ঘ ছয় মাস পরে হেমপ্রভা আবার ফিরে এল স্বামীর গৃহে এবং শরীর তার তখন খুবই খারাপ। মনে যার ঘুণ ধরে, দেহ তার ভাঙ্গতে দেরি হয় না। হেমপ্রভারও হয়েছিল তাই। হেমপ্রভা ফিরবার দিন পাঁচেক বাদেই মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে নিয়ে প্রমোদভবনে উঠে এলেন এবং ওখানে আসবার দিন চারেক বাদে এক রাত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রচণ্ড বচসা হয়ে গেল। নিত্যানন্দকে নিয়ে হেমপ্রভার চরিত্রে সন্দেহ করে স্পষ্টাস্পষ্টিই মৃত্যুঞ্জয় অভিযোগ জানালেন এবং বললেন, নিত্যানন্দ নিজে নাকি চিঠিতে অনেক দিন আগেই তাকে ও সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিল। ঘৃণায় লজ্জায় হেমপ্রভা একেবারে পাথর হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জা! এর চেয়ে যে মৃত্যুও ছিল ভাল।

এবারে কিরীটী বললে, এবং সেই দুঃখ ও অপমানেই তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন নিশ্চয়ই! কেউ তাঁকে হত্যা করেনি!

সৌদামিনী বললে, হ্যাঁ। কিন্তু আপনি সেকথা জানলেন কি করে মিঃ রায়?

আপনার বর্ণিত কাহিনী প্রথমে সত্যজিৎবাবুর ও পরে আপনার মুখে শুনেই বুঝেছিলাম, আসল ও সত্যি কথাটা আপনি গোপন করেছেন। আপনার বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে অনেকটা ফাঁক ছিল। তাছাড়া যে মুহর্তে বুঝেছিলাম দীর্ঘ উনিশ বৎসরের ব্যবধানে দুটো মৃত্যুর কারণ এক নয় এবং শেষেরটা যখন অবিসংবাদিত ভাবেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল সত্য বলে, তখনই বুঝেছিলাম আগের ব্যাপারটা আত্মহত্যা ভিন্ন আর কিছুই হতে পারে না। অবশ্য এরূপ ভাববার আমার দুটি কারণ ছিল। প্রথমত হেমপ্রভা দেবীকে একমাত্র হত্যা করা সম্ভব ছিল তাঁর স্বামীর পক্ষেই, কিন্তু তা তিনি যে করেননি সেটা বুঝেছিলাম সাত দিন বাদে কলকাতা হতে ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীর মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারেই। তিনি প্রথম হতেই সন্দেহ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী গৃহত্যাগ করেছে এবং গেছে নিত্যানন্দবাবুর ওখানেই। তাই তিনি অসুস্থা স্ত্রীর একটা কল্পিত চিকিৎসার ভান করে মেয়ে ও আপনাকে নিয়ে কলকাতায় যান, কিন্তু আসলে কলকাতা থেকে নিত্যানন্দবাবুর ওখানে গিয়ে স্ত্রীর খোঁজ নেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল—

ঠিক তাই। চৌধুরীমশাই লুধিয়ানাতেই দাদার ওখানে হেমের খোঁজে গিয়েছিলেন। জবাব দেয় সৌদামিনী।

কিন্তু সেখানে স্ত্রীর খোঁজ না পেয়ে গৃহত্যাগিনী স্ত্রীকে জন্মের মত ত্যাগ করবেন এই মনস্থ করে ও নিজের বংশমর্যাদা ও সম্মান বাঁচাতে রটনা করে দিলেন তার মৃত্যুর কথা। ফিরে এলেন তিনি এখানে। কিন্তু চরম দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে স্ত্রীর প্রতি তিনি যতই সন্দিহান হন আসলে হয়তো স্ত্রীকে সত্যিই প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তাই স্ত্রীকে অমন করে চলে যেতে দেখে মর্মান্তিক যাতনায় ছটফট করে বেরিয়েছিলেন, এমন সময় মতো স্ত্রীর দেহ আবিষ্কৃত হল নন্দনকাননে। তার পরের ব্যাপারটাও স্বাভাবিক গতিই নিয়েছে। এ ছাড়া হেমপ্রভা যে নিহত হয়নি কারো দ্বারা সন্দেহ করেছিলাম দ্বিতীয় অন্য একটি কারণে হেমপ্রভা দেবীকে যদি তাঁর স্বামী না হত্যা করে থাকেন আর কারো পক্ষে যেমন তাঁকে হত্যা করবার কোন কারণই থাকতে পারে না, তেমনি নিহত হলে অন্তত কানাইয়ের মা অর্থাৎ আপনি সর্বদা যখন তাঁর পাশের ঘরে শুতেন ও সর্বদা প্রাণ দিয়ে তাঁর দেখাশুনা করতেন, আপনি নিশ্চয় সেটা জানতে পারতেন। আপনার কাছে সে ধরা পড়তই এবং সেক্ষেত্রে অন্তত আপনি এতদিন পরে বিশেষ করে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুর পরে আর সে কথা গোপন করে রাখতেন না।

সৌদামিনী চুপ করে রইলেন।

কিরীটী আবার তার বক্তব্য শুরু করে, হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুরহস্যটা আমার কাছে খোলসা হয়ে যায়, যে রাত্রে সৌদামিনী দেবী এখান হতে চলে যান সেই রাত্রে ওঁর সঙ্গে ঐ সম্পর্কে আলোচনা করবার পরই। এবং যে মুহূর্তে বুঝলাম হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুর সাক্ষাৎ কোন যোগাযোগ নেই, পরোক্ষে থাকলেও তখনই ভাবতে লাগলাম এতকাল পরে তাহলে মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিহত হলেন কেন? এইখানে একটা ব্যাপার প্রথমটায় সত্যিই আমাকে বিশেষভাবে delimma-র মধ্যে ফেলেছিল—অকুস্থানটি। একই স্থানে বকুলবৃক্ষতলে দুটি মৃতদেহ কেন আবিষ্কৃত হল! পরে অনেক ভেবে দেখেছি এবং সৌদামিনী দেবীর মুখে একটা কথা শুনে বুঝেছি, তাঁরও সম্ভবত, মানে হেমপ্রভা দেবীর বকুলতলে আত্মহত্যা করবার দুটি কারণ ছিল। ১নং সৌদামিনী দেবী বলেছিলেন প্রমোদভবনে আসা অবধি তো বটেই, তারও পূর্বে দুএকবার হেমপ্রভা দেবী নাকি প্রমোদভবনে বেড়াতে এসেও ঐ বৃক্ষতলটিতে গিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। স্থানটি নাকি তাঁর বড় প্রিয় ছিল, শুনেছি বৌরাণীর বিল বলা হত ঐ বিলটিকে—এই চৌধুরী বংশেরই নাকি কোন বৌরাণীর ইচ্ছাতেই বিলের মধ্যে ঐ বিরাম-কুটিরটি তৈরী হয়েছিল বলে এবং পরে ঐ বিলের জলে সেই বৌরাণী সাঁতার কাটতে গিয়ে তলিয়ে যান আর ওঠেন না। সেই হতেই বিলটিকে লোকে বৌরাণীর বিল নাকি বলত। এবং সেই হতেই চৌধুরীবংশে একটা প্রবাদের মতই শেষে দাঁড়িয়েছিল ঐ বিল এ বাড়ির বৌদের পক্ষে নাকি অভিশপ্ত। যাক যা বলছিলাম, ২নং কারণ হয়ত হেমপ্রভা দেবীর ইচ্ছা ছিল ঐখানে গিয়েই আত্মহত্যা করবার, নিজের মৃতদেহটা যাতে আদরিণী একমাত্র কন্যার চোখে না পড়ে। অবশ্য সবই আমার অনুমান। সে যাই হোক, হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু রহস্যটা মীমাংসিত হবার পরই মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুরহস্যে আমি মন দিই। একটা ব্যাপার অবশ্য—গোড়া হতেই সব ইতিহাস শুনে বুঝেছিলাম, চৌধুরী মশাইয়ের নিহত হবার পশ্চাতে কোন একটা পারিবারিক জটিল কাহিনী আছে এবং আর অকুস্থান যে রাজপুতানায়—তাও বুঝতে পারি, তাঁর ড্রয়ার হতে যে অ্যালবামটি উদ্ধার করি তারই ফটোগুলো দেখে। সেই ফটোগুলোর মধ্যে একটা ফটো ছিল এক নবযৌবনা অপরুপ সৌন্দর্যময়ী এক নারীর। বুঝলাম মিঃ চৌধুরীর জীবনের কয়েকটি ছিন্ন পৃষ্ঠা সুদূর ঐ রাজপুতানাতেই ছড়িয়ে রয়েছে যার সাক্ষ্য দিচ্ছে আজও তাঁরই সযত্নরক্ষিত অ্যালবামটি। কিন্তু কে ঐ তরুণী? কেন তার ফটো অ্যালবামের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত? তার পরই কুড়িয়ে পেলাম নন্দনকাননে একটি স্বর্ণঅঙ্গুরীয়। যার উপরে খোদাই করা ছিল একটি দেবনাগরী অক্ষর ল। কার অঙ্গুরীয়? অঙ্গরীয়টি দেখেই বুঝেছিলাম সদ্য না হলেও দুদশ দিনের মধ্যে কোন এক সময় কারো হাত হতে ঐ অঙ্গুরীয়টি ওখানে খসে পড়েছে। আর একটা জিনিস ঐ জায়গায় জলের ধার ঘেষে পাড়ে ঘাসের অবস্থা দেখে বুঝেছিলাম নিয়মিত কিছুদিন ধরে ওখানে নৌকা বা বোট জাতীয় কিছু এসে ভিড়বার জন্যেই ঘাসগুলো যেন নিস্তেজ হয়ে আছে। বুঝলাম এখানে বোটে চেপে কারো যাতায়াত ছিল। তারও প্রমাণ পেলাম বিরাম-কুটিরের ঘরে ধুলোর ওপরে জুতোর সোলের ও খালি পায়ের ছাপ দেখে। সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল মন। খোঁজ নিতে গিয়ে সরমল সিং ও তার নাতনী চন্দ্র লেখার সন্ধান পেলাম। সরমলের সঙ্গে সামান্য আলাপ করতেই বুঝলাম তারা রাজপুত। এবং চন্দ্রলেখার মুখের আদলটি হবহু, একেবারে মিলে গেল অ্যালবামের ফটোর সেই রাজপুতানী মেয়েটির মুখের সঙ্গে। ছিন্নসূত্র জোড়া লাগল।

হ্যাঁ, ঐ চন্দ্রলেখাই চৌধুরী মশাইয়ের মেয়ে কাঞ্চনমালার বা লছমীর (কাঞ্চনের ডাকনাম) গর্ভজাত কন্যা এবং সবিতার চাইতে বছরখানেকের বড়। সূরযমল লক্ষণের ছোট ভাই লছমীর কাকা। জবাব দিল সৌদামিনী।

তাহলে ওই আংটিটা বোধ হয় চন্দ্রার মায়েরই! কিরীটী বলে।

লক্ষ্মীকান্ত তখন হঠাৎ বলেন, কিন্তু ক্রেপসোল দেওয়া কোন জুতো সেখানে পাইনি মিঃ রায়!

প্রমোদভবনের আস্তাবল খুজলেই পাবেন। সেটা লছমনের সম্পত্তি।

লছমনের?

হ্যাঁ, কারণ সে-ই যে সেটা ব্যবহার করতো! জবাব দেয় কিরীটী। কিন্তু

ভয় নেই। মোক্ষম বন্ধনে বাঁধা রয়েছেন শ্রীমান। পালাবার উপায় নেই।

মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দেয়, এ বাড়ির নূপুর-রহস্যের মেঘনাদ ঐ লছমনই। আসলে লছমন ওর ছদ্মনাম মাত্র।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই বিস্ময়ে কিরীটীর দিকে তাকায়।

বসন্ত সেন বলেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? লছমন যে অনেক দিনকার পুরাতন সহিস এ বাড়ির!

সে পুরাতন সহিস আসল লছমন এতদিন বন্দী হয়ে বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ দিকের বাড়িতে সুরযলের হেপাজতে ছিল। তাই না মিঃ সাহা?

হ্যাঁ, তাকে মুক্তি দিয়ে থানায় রেখে এসেছি। জবাব দিলেন লক্ষ্মীকান্ত।

বৃদ্ধ লছমনকে গায়েব করে তার ছম্মবেশ ধারণ করে চেৎ সিং, একদা যে প্রথম যৌবনে কাঞ্চনমালার পাণিপ্রার্থী ছিলেন। তাঁর এখানে এসে সকলের চোখে ধুলো দিতে কষ্ট হয়নি। প্রথমে নানারূপ ভয় দেখিয়ে নুপুরের শব্দ শুনিয়ে চৌধুরী মশাইকে চেৎ সিং সন্দিগ্ধ করে তোলে। এবং খুব সম্ভবত হয়ত কৌতুহলী হয়ে অদৃশ্য নূপুরের শব্দ অনুসরণ করতে করতে কোন এক রাত্রে ঘটনাচকে যখন হতভাগ্য চৌধুরী মশাই নন্দনকানন পর্যন্ত চলে যান, সেই সময় সুযোগ পেয়ে চেৎ সিং তাকে আক্রমণ করে কৌশলে অজ্ঞান করে, পরে গলা টিপে হত্যা করে। ঐ কারণেই হয়ত চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহ বকুলবৃক্ষতলে পাওয়া যায়। সব ব্যাপারটাই আকস্মিক এবং নিষ্ঠুর নিয়তি চালিত।

সৌদামিনী আবার বলে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে হতেই প্রায় চৌধুরী মশাই আমাকে বলতেন হেম নাকি প্রত্যহ রাত্রে তাঁকে ডাকে। তার পায়ের নূপুরে তিনি স্পষ্ট শুনেছেন। হেম নূপুর পরতে খুব ভালবাসত।

তাহলেই দেখুন, অনুমান আমার মিথ্যা নয়। এবারে আসা যাক আসল পরিকল্পনাকারীর রহস্যে। নিত্যানন্দ সান্যাল সমস্ত ঘটনাটির তিনিই ছিলেন মূল। প্রথমে তিনি কাঞ্চনমালার ব্যাপার নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করেছেন, পরে নিজেকে হেমপ্রভার প্রেমিক প্রতিপন্ন করে সন্দিগ্ধ চৌধুরীর মনে সংশয় এনে দিয়ে further blackmail করেছেন। শেষ পর্যন্ত যখন চৌধুরী মশাই সহ্যের শেষ সীমায় এসে পৌচেছেন, তখন তিনিই সূরযমল প্রভৃতিকে এখানে আনিয়ে চেৎ সিংকে চৌধুরীর সংবাদ দিয়ে তার নৃশংস প্রতিশোধস্পৃহার অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়ে তাকে দিয়েই হত্যা করিয়েছেন চৌধুরীকে। উনি যখন বুঝেছিলেন, লেবু তেতো হয়ে গিয়েছে টিপতে টিপতে, গাই আর দুধ দেবে না, তখন ওদের দিয়ে কাজ হাসিল করিয়ে সমস্ত সম্পত্তিটা বাগাবার চেষ্টায় ছিলেন। প্রত্যক্ষ না থেকে পরোক্ষে বসে কলকাঠি ঘুরিয়েছেন। আর ঐ হতভাগ্য ধনঞ্জয়—আমাদের সন্তোষবাবু, সৌদামিনী দেবীর বখে যাওয়া-পুত্র সন্তোষ চৌধুরীর পরিচয় এখানে এসেছিল সম্পত্তির লোভে। কিন্তু সন্তোষবাবু তো আজ দুবছর মৃত, তবে পরিকল্পনাটি উনি পেলেন কোথায়? সন্তোষের সংবাদ জানলেনই বা কেমন করে? বলুন ধনঞ্জয়বাবু, অন্যথায় আপনি কিন্তু প্রতারণার চার্জে পড়বেন।

সন্তোষ নিত্যানন্দের দিকে আঙুল দেখিয়ে চেচিয়ে উঠলো, ঐ—ঐ নিত্যানন্দই প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে এখানে এনেছে। আমার-আমার কোন দোষ নেই। আমি কিছু জানি না।

কিরীটী মৃদু হাসে, চমৎকার! একেবারে আটঘাট বেধেই নেমেছিলেন সান্যাল মশাই। এবং এত করেও শেষ বজায় রাখতে পারলেন না। ধর্মের কল এমনি করেই বাতাসে নড়ে। Really I pity you!

উঃ, কি শয়তান উনি! আপনি জানেন না মিঃ রায়, ওঁর আরো কীর্তি আছে। সত্যজিৎ বলে।

কিরীটী মৃদু হাসির সঙ্গে জবাব দেয়, জানি। শেষ পর্যন্ত মেয়ে কল্যাণীকে আপনার পিছনে লাগিয়েছিলেন, force করে আপনার ও সবিতা দেবীর মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে, তাই না?

কিন্তু আপনি সে কথা জানলেন কি করে?

জানাটাই যে আমার কাজ সত্যজিৎবাবু! কিরীটী জবাব দেয়। কল্যাণীর মাথাটা লজ্জায় নুয়ে আসে।

লক্ষ্মীকান্তবাবু, আমার যা বলবার ছিল বললাম। কেবল একটা কথা বসন্তবাবুকে জিজ্ঞাস্য আছে—সেই শীলমোহর করা লোফাপাটা, আয়রণ সেফে যেটা ছিল, কিরীটী বসন্তবাবুর মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, আমিই সেটা সরিয়ে ফেলেছিলাম, সবিতার নামে লেখা আছে দেখে এবং কৌতূহলের বশে খুলে পড়তে গিয়েই চৌধুরীর অতীত জীবনের ইতিহাস আমি সব জানতে পারি। আমার ইচ্ছা ছিল না সবিতা আর ওসব জানতে পারে, তাই আমি আপনাকে ফিরে যেতে বলেছিলাম। সবিতাকেও নিবৃত্ত হতে বলেছিলাম। শেষকালে যখন বুঝলাম, আমরা কত অসহায় নিয়তির হাতে তখনই বাধ্য হয়ে লক্ষ্মীকান্তর হাতে না ধরা দিয়ে উজ্জয়িনীতে ছুটেছিলাম ব্যাপারটার শেষ জানতে, কিন্তু গিয়ে তাদের সন্ধান পেলাম না। তখনও বুঝিনি সান্যাল মশাই এমন জঘন্য খেলায় নেমেছেন।

সে চিঠি কোথায় কাকা? সবিতা প্রশ্ন করে।

সে চিঠি ছিড়ে আমি বৌরাণীর বিলেই ভাসিয়ে দিয়েছি। বাপ যত অপরাধীই হোন না কেন, তাঁর পদস্খলনের কথা সন্তানের শোনা বা জানাও মহাপাপ মা। ভুলে যাও সে কথা। বসন্ত সেন বললেন।

তাহলে এবারে আমার উইলটা পড়তে আর আপত্তি নেই, বলে অতীনলাল খাম ছিড়ে উইল পাঠ করলেন। নতুন উইলে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। তাঁর স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি সন্তোষ মৃত জেনে সমান তিন অংশে ভাগ করে দিয়েছেন তাঁর তিন পুত্র-কন্যাদের মধ্যে। সবিতা, চন্দ্রলেখা ও ধনঞ্জয় সম্পত্তির সকলেই সমান অংশীদার।

সবিতা সকলের নিকট হইতে দূরে এসে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়েছিল। পূব আকাশকে রাঙা করে সূর্যোদয় হচ্ছে। দিগন্তপ্রসারী বৌরাণী বিলের জলে কে যেন মুঠো মুঠো রাঙা আবির ছড়িয়ে দিয়েছে। চৌধুরীবংশের সমস্ত পাপ স্খলিত করে সর্বপাপঘ্ন দিবাকর যেন উদয়াচল থেকে শান্তির মন্ত্র আকাশে মাটিতে জলে সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন দিক হতে দিগন্তে।

সবিতার দু চোখের কোলে জল।

মৃত পিতাকে স্মরণ করে দুটি হাত একত্র করে সে প্রণাম জানায়, তার পিতার আত্মা যেন শান্তি পায়। হে সর্বপাপঘ্ন সবিতা—সবিতাকেও ক্ষমা করো।