১৮. পর পর দুটি প্রভাত

পর পর দুটি প্রভাত দুটি আকস্মিক ঘটনা-বিপর্যয়ে প্রমোদভবনের উপরে যেন প্রচণ্ড আঘাত হেনে গেল।

কানাইয়ের মার অকস্মাৎ নিরুদ্দিষ্টা হওয়া, নায়েব বসন্ত সেনের লক্ষ্মীকান্ত কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়া।

বসন্ত সেন কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করার ব্যাপারটা আদৌ একটা গুরুতর ঘটনা বলে ধরেননি। ঘর হতে বের হয়ে বারান্দায় দণ্ডায়মান সত্যজিৎ ও সবিতার ব্যাকুল সপ্রশ্ন দৃষ্টির সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হলো।

সত্যজিৎ সবিতা দুজনেই যেন একটু বিস্মিত হয়। বসন্ত সেনের মুখের কোথাও উদ্বেগের বা চাঞ্চেল্যের বিন্দুমাত্র চিহ্নও নেই যেন। প্রশান্ত মুখ এবং ওষ্ঠপ্রান্তে নিশ্চিন্ত একটি হাসির স্পষ্ট আভাস। কোন বাক্যবিনিময়ই হলো না পরষ্পরের মধ্যে, কেবল নির্বাক দৃষ্টির মধ্যে দিয়েই যেন বসন্ত সেন বুঝিয়ে দিলেন চিন্তার উদ্বেগের কোন কারণ নেই।

অন্দর অতিক্রম করে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বসন্ত সেন হাঁক দিয়ে দারোয়ানকে ডাকলেন।

ভোজপুরী দারোয়ান সেলাম ঠুকে এসে দাঁড়াল, জি!

লছমনকে বোলনা টমটম তৈয়ার করকে তুরন্ত ইধার আনেকে লিয়ে! নায়েবের হকুমে দারোয়ান সহিস লছমনকে সংবাদ দিতে চলে গেল।

অদূরে গেটের পাশে দারোগার ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, সেদিকে তাকিয়ে বসন্ত সেন বললেন, আপনার সঙ্গে ঘোড়া আছে দেখছি দারোগাবাবু-আপনি বরং তাহলে এগোন, আমি টমটমে থানায় আসছি।

আমিও আপনার সঙ্গেই টমটমে যাবোখন—

কিন্তু আপনার ঘোড়া?

সে থানায় গিয়ে একজন সেপাইকে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

দারোগার কথায় বসন্ত সেন মুচকি একটু হাসলেন। বুঝতে পারছিলেন, অতঃপর লক্ষ্মীকান্ত সাহার আর সাহসে কুলোচ্ছে না তাঁকে একলা ছেড়ে যেতে।

বস্তুতঃ কতকটা তাই বটে। বসন্ত সেনকে ঘাঁটাবারও এখানে এই বাড়িতে দাঁড়িয়ে যেমন আর তাঁর সাহস ছিল না তেমনি তাঁকে এখানে একা ছেড়ে থানায় ফিরে যেতেও ভরসা পাচ্ছিলেন না। যেমন করে হোক যত শীঘ্র সম্ভব এখন বসন্ত সেনকে নিয়ে থানায় নিজের এলাকার মধ্যে গিয়ে তুলবার জন্য মনে মনে সত্যিই তিনি ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন।

ক্ষণপূর্বে কক্ষের মধ্যে বসন্ত সেনের উচ্চারিত তাঁর সদম্ভোক্তিগুলো লজ্জায় অপমানে আক্রোশে যেন তাঁর ভিতরটা পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছিল, কিন্তু এখানে একাকী অসহায়ভাবে তাঁরই চৌহদ্দির মধ্যে দাঁড়িয়ে হুমকি ছাড়বার মত দুঃসাহস আর তাঁর ছিল না।

কিন্তু তার কোন প্রয়োজন নেই দারোগাবাবু! স্বেচ্ছায় যখন আপনার হাতে নিজেকে ধরা দিতে চলেছিই, আর যাই হোক বসন্ত সেন কথার খেলাপ করবে না। বেশ, তাহলে না হয় একটু অপেক্ষাই করুন—টমটমটা আসুক।

বারান্দার উপরেই দুজনে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে লছমন টমটম জুতে নিয়ে এল।

বসন্ত সেন এগিয়ে যেতেই লছমন নায়েবের হাতে লাগামটা তুলে দিল সসম্ভ্রমে।

বসন্ত সেন বরাবরই টমটম নিজেই চালান।

পাদানীর উপরে পা দিয়ে টমটমে উঠে বসে লাগামটা জুত করে ধরে চাবুকটা হাতে নিচ্ছেন বসন্ত সেন, লক্ষ্মীকান্ত এগিয়ে এলেন পাদানীর দিকে টমটমে উঠে বসবার জন্য। কিন্তু ঠিক সেই মুহর্তে যেন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। চকিতে ঘোড়াটার লাগামটা টেনে উদ্ধত ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে লক্ষ্মীকান্তকে সম্বোধন করে বসন্ত সেন বললেন, উহ! এ টমটমে নয়, এ ঘোড়াটা নতুন, বড় তেজী। কখন কি বিপদ ঘটায় বলা যায় না, আপনি আপনার ঘোড়ায় চেপেই বরং আমার পিছনে পিছনে আসুন-বলতে বলতে হাতের মুঠোয় ধরা চাবুকটা শূন্যে আন্দোলিত হয়ে হুস করে একটা শব্দ তুলতেই শিক্ষিত তেজী ঘোড়া নক্ষত্রবেগে ছুটে যেন টমটমটাকে টেনে নিয়ে সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হতভম্ব লক্ষ্মীকান্ত স্তব্ধ হয়ে গেটের সামনে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

সমস্ত অন্তরটা তখন যেন একটা ভীষণ অগ্নুৎপাতের মত জলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল তাঁর।

দাঁতে দাঁত চেপে অদূরে গাছের সঙ্গে বাঁধা রোগ-জীর্ণ ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রচণ্ড আক্রোশে সমস্ত শরীর যেন তাঁর কাঁপছে, পা টলছে।

ঘোড়াটার উপরে উঠতে গিয়ে দুদুবার উঠতে পারলেন না লক্ষ্মীকান্ত! এখনো অশ্ব ব্যাপারে লক্ষ্মীকান্ত খুব বেশী রপ্ত হননি।

তিনবারের বার উঠে বসলেন তিনি ঘোড়ার পিঠে।

ধীরে ধীরে দুলকি চালে ঘোড়া চলতে লাগল। রাস্তায় পড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কেবল একটা ধুলোর চক্র সম্মুখের পথটাকে ধুম্রজালের মত আচ্ছন্ন করে আছে—টমটমের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

***

কক্ষের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিরীটী। ক্ষণপূর্বের হাসির যে বঙ্কিম রেখাটি ওষ্ঠপ্রান্তে তার দেখা দিয়েছিল সেটা একসময় মিলিয়ে গিয়েছে, কপালের রেখাগুলো কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ পদশব্দে চোখ তুলে তাকাতেই নজরে পড়ল কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করছে সত্যজিৎ ও সবিতা।

আসুন সত্যজিৎবাবু, সবিতা দেবী! ওরা চলে গেলেন?

হ্যাঁ, নায়েব টমটমে গেলেন আগে-পিছনে গেলেন দারোগাবাবু। জবাব দিল সত্যজিৎ।

তাই নাকি! কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে আবার সেই বিচিত্র হাসি জেগে ওঠে, বেশ শক্ত পাল্লায় পড়েছেন এবারে আমাদের সাহা মশাই!

কিন্তু এ অত্যন্ত অন্যায় জুলুম আপনাকে আমি বলতে পারি কিরীটীবাবু! কখনই হতে পারে না, নায়েব কাকা বাবার কোনপ্রকার অনিষ্ট চিন্তা।করতেই পারেন না। কেউ বললেও আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আবেগে উত্তেজনায় সবিতার কণ্ঠস্বরটা কাঁপছিল।

আপনি ব্যস্ত হবেন না সবিতা দেবী। স্নিগ্ধ আশ্বাস-ভরা কণ্ঠে কিরীটী বলে, বসন্তবাবু, দোষী কি নিদোষী সে বিচার করতে যাওয়া এখন হয়ত আমাদের কারো পক্ষেই বিবেচনার কাজ হবে না, আইনের জোর দেখিয়ে যে লক্ষীকান্ত ওঁকে ধরে নিয়ে গেলেন সেটার মীমাংসার অবশ্য অন্য পথও ছিল। একেবারে সটান হাজতে নিয়ে গিয়ে না পরলেও চলতো।

কিন্তু কারণটা কি মিঃ রায়? প্রশ্ন করলো এবারে সত্যজিৎ।

বসন্তবাবু, তাঁর জবানবন্দীতে বলেছিলেন যে রাত্রে মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিহত হন সেদিন সকালের দিকেই নাকি একটা মহাঁল পরিদর্শনে গিয়ে ফিরেছিলেন তিনি ঐদিন রাত দুটোর পরে। কিন্তু

কিন্তু

কিন্তু আদপেই তিনি ঐদিন কোন মহালে যাননি। নিজের ঘরেই ছিলেন। কথাটা বললে কিরীটী।

সে কি!

হ্যাঁ, তবে দারোগাবাবুও সে-কথা জানতেন না এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত। তিনি মানে আমাদের দারোগাবাবু, ওঁকে পীড়াপীড়ি করছিলেন জানবার জন্য কোন মহাল পরিদর্শনে উনি গিয়েছিলেন, কিন্তু বসন্তবাবু, সেকথা বলতে রাজী নন। পরে অবশ্য আমার কথায় ব্যাপারটা যেন আরো ঘোরালো হয়ে দাঁড়াল।

কিন্তু আপনার কথাই কি সত্যি মিঃ রায়? কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলে এবারে সবিতা।

হ্যাঁ সবিতা দেবী।

সে কথা আপনি জানলেন কি করে মিঃ রায়?

কানাইয়ের মার মুখে

ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হলো।

কানাইয়ের মার মুখে? প্রশ্ন করলে সত্যজিৎ।

হ্যাঁ।

কিন্তু আপনার সঙ্গে তার কথা হলো কখন? আবার সত্যজিৎ প্রশ্ন করে।

যে রাত্রে সে নিরুদ্দিষ্টা হয়, মানে পরশু রাত্রে শুতে যাবার আগে সিঁড়িতে কানাইয়ের মার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে এনে কয়েকটা প্রশ্ন করি। তখনই ওই কথাটা নায়েব সম্পর্কে জানতে পারি। প্রথমটায় সে বলতে রাজী হয়নি, পরে চাপ দিয়ে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে সত্য কথাটা বের করে নিয়েছিলাম।

তবে কি সত্যিই কানাইয়ের মা ওঁর, সবিতার দিকে তাকিয়ে বললে, বাবার মৃত্যুর আসল ঘটনাটা জানত নাকি?

না।

ক্ষমা করবেন মিঃ রায়, কানাইয়ের মার অতর্কিতে পরশু রাত্রে নিরুর্দিষ্টা হবার ব্যাপারটা আপনাকে যেন নাড়া দিতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে তার evidenceগুলোও অন্ততঃ বিশেষ ভাববার ছিল না কি?

নিশ্চয়ই। তাতে কোন ভুল নেই সত্যজিতবাবু। তবে এই ব্যাপারে কানাইয়ের মা যতটুকু part play করতে পারতো, she already played it এবং তার নিকট হতে যতটকু information আমাদের পাওয়ার ছিল আমরা পেয়েও গিয়েছি, তাই বর্তমানে সে অবান্তর। হত্যাকারী তাকে spot থেকে সরিয়ে ফেলে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছে বলে তো আমার মনে হয় না! বরং সে একটু দেরিই করে ফেলেছে আমার মতে। কিন্তু সর্বাপেক্ষা ভুল সে কি করেছে জানেন? শেষ পর্যন্ত ঐ কানাইয়ের মার ব্যাপারে তৎপর হতে গিয়েই। বেচারা বুঝতে পারেনি, হঠাৎ আচমকা এই case-এর evidence কতকগুলো নষ্ট করবার ইচ্ছায় কানাইয়ের মাকে না সরালে তার কাছে পৌঁছবার একটা নির্দিষ্ট পথ আমরা পেয়ে যাব। তবে এইটুকুই বলতে পারি সত্যজিতবাবু, কানাইয়ের মাকে হত্যা সে করেনি আর সেই কারণেই আমি কানাইয়ের মার নিরুদ্দেশ হওয়া সম্পর্কে খুব বেশী আকর্ষিত হইনি।

কিন্তু কি করে আপনার ধারণা হলো যে কানাইয়ের মাকে সত্যি সত্যিই হত্যা করা হয়নি?

যুক্তি দিয়ে এখনি আপনাকে আমি বলতে পারছি না সত্যজিৎবাবু তবে বলতে পারেন এটা আমার মনের একটা intuition, আমার মনের অনুভূতিই আমাকে তাই বলছে।

কিন্তু নায়েব কাকা সম্পর্কে কি করা যায় কিরীটীবাবু? এতক্ষণে সবিত্য কথা বললে।

একটু আগেই তো আপনাকে আমি বললাম সবিতা দেবী, লক্ষ্মীকান্তবাবু কতকটা জিদের বশেই বসন্তবাবুকে arrest করে নিয়ে গেলেন। আমি হলে arrest করতাম না। শেষের কথাটা কিরীটী যেন কতকটা অস্পষ্ট কণ্ঠে আত্মগতভাবেই উচ্চারণ করল।

সবিতা বা সত্যজিৎ দুজনের একজনও কিরীটীর কথার শেষটুকু তার উচ্চারণের অস্পষ্টতার দরুন শুনতে পায়নি, তাই সবিতাই প্রশ্ন করে, অ্যাঁ, কি বললেন মিঃ রায়?

না, ও কিছু না।

কিন্তু সে যাই হোক, যেমন করেই পারেন বসন্ত কাকাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আপনাকে আসতেই হবে মিঃ রায়।

দেখি।

না, দেখি নয় মিঃ রায়, মনে হয় একমাত্র হয়ত দারোগাবাবু, আপনার কথাই শুনলেও শুনতে পারেন। বলবেন না হয়, ওঁর জন্য জামিন হতে হলে আমিই হব। যা টাকার জামিন চান উনি, প্রস্তুত আছি।

কিরীটী সবিতার মুখের দিকে তাকাল, বুঝলাম, কিন্তু দারোগা সাহেব arrest করেই নিয়ে গেছেন। Arrest একবার কাউকে এইভাবে করবার পর, বিশেষ করে খুনের সন্দেহে, এখন জিলার ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া তো আর কেউই তাঁকে জামিন দেবার অধিকারী নন। তাহলে আপনাকে জিলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই গিয়ে প্রার্থনা জানাতে হয়।

সত্যজিৎ এতক্ষণ চুপ করেই ছিল, এবারে সে মুখ খুললে, মিথ্যে কেন ব্যস্ত হচ্ছে সবিতা। ওঁর উপরে আমরা যখন সব কিছুতে নির্ভর করছি, যা ভাল বোঝেন উনি করবেন।

কি বলছো তুমি জিত! জান না উনি আমাদের কতখানি! বাবা যে ওঁকে কতখানি স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন আর কেউ তা না জানলেও আমি তো জানি। আর উনিও বাবাকে যেমন শ্রদ্ধা করতেন তেমনই ভালবাসতেন।

সবিতার কথাটা শেষ হল না, ঘরের বাইরে চটিজুতোর শব্দ শোনা গেল না অথচ নিত্যানন্দ সান্যাল ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। তাঁর চোখেমুখে উদ্বেগের একটা কালো ছায়া যেন ঘনিয়ে আছে। ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, এই যে তোমরা সব দেখছি এই ঘরেই আছো, এত সক্কালে দারোগাবাবুই বা এসেছিলেন কেন আর টমটম করে বসন্তই বা অত তাড়াতাড়ি কোথায় গেল?

নিত্যানন্দ সান্যালের প্রশ্নে সবিতার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, রুদ্ধকণ্ঠে সে-ই জবাব দিল, নায়েব কাকাকে দারোগা লক্ষ্মীকান্ত arrest করে নিয়ে গেলেন।

Arrest করে নিয়ে গেলেন? বসন্তকে? মানে, বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন সান্যাল।

বাবার হত্যার ব্যাপারে, কথাটা সবিতা শেষ করতে পারল না।

দয়াময়! প্রভু! বসন্ত শেষ পর্যন্ত মৃত্যুঞ্জয়কে, উহু না—না! তা হতে পারে না—নিঃশব্দে আপন মনেই মাথা দোলাতে লাগলেন সান্যাল, বিচিত্র বিচিত্র! বসন্ত কিনা মৃত্যুঞ্জয়কে

কিরীটী আর দাঁড়ায় না, একসময় নিঃশব্দেই পাশ কাটিয়ে ঘর হতে বের হয়ে আসে।

কিরীটীকে ঘর ত্যাগ করে যেতে দেখে সান্যাল সবিতাকে সম্বোধন করে বলেন, উহু এ তো ভাল কথা নয় মা সবি! এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন।

আমিও তাই কিরীটীবাবুকে একটু আগে বলছিলাম।

কিরীটীবাবু তো চলে গেলেন দেখছি। তা উনি কি বললেন?

এখন ওঁকে জামিনে খালাস করতে হলেও নাকি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাদের যেতে হবে।

বেশ তো। সত্যজিৎবাবু, তুমিই হয় একটিবার তাহলে আজ সুদূরে চলে যাও—আমি চিঠি দিয়ে দেবোখন। কিন্তু তা যেন হলো, এদিকে এদিককার জমিদারীর ব্যাপারই বা কে সব দেখাশোনা করবে? কাছারীতে গিয়েও তো একজনের বসা দরকার? সাকসেশন সার্টিফিকেট উইলের প্রাবেট এসবও তো কিছু এখনও নেওয়া হয়নি!

কাকাবাবু, ফিরে না আসা পর্যন্ত কাছারী বন্ধই থাক মামাবাবু! সবিতা জবাব দিল।

পাগলী মেয়ে! তাই কি হয় রে! এত বড় জমিদারী, এত বড় ব্যবসা। মাথার উপরে একজন শক্ত হাতে লাগাম না ধরে থাকলে কর্মচারীরা চুরিডাকাতি করেই যে সব দুদিনে ফাঁক করে দেবে।

তাহলে কাকাবাবু, যতদিন না ফিরে আসেন আপনিই না হয় সব দেখাশোনা করুন মামাবাবু।

না, না—মা। এই বৃদ্ধ বয়সে ওসবের মধ্যে আর আমাকে জড়িয়ে ফেলবে কেন মা!

কিন্তু মামাবাবু, আপনি ছাড়া এসব আর তাহলে দেখবেই বা কে? আমি তো ওসবের কিছুই জানি না, বুঝিও না!

তাই তো! তুমি যে আমাকে বড় বিপদে ফেললে মা! অগত্যা চোখের উপরে আমি বেঁচে থাকতে হেমের একটিমাত্র সন্তানের সব ভেসে যাবে তা তো আর দেখতে পারবো না। যাই তাহলে, আমিই না হয় কাছারীতে যাই। তারপরই উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিলেন, বনমালী! এই বনমালী!

ডাক শুনে বনমালী এসে হাজির হল। সে বোধ হয় ঘরের আশপাশেই কোথাও ছিল।

আমায় ডাকছিলেন মামাবাবু?

হ্যাঁ, এই যে বাবা বনমালী! যাও তো বাবা, টমটমটাকে জুততে বল তো! কাছারী যেতে হবে।

টমটম, তো নায়েবজী নিয়ে বাইরে গেছেন, এখনও ফেরেননি।

ও হ্যাঁ। দেখেছো কি ভুলো মন আমার! সত্যিই তো, টমটমটা তো বসন্ত ভায়াই নিয়ে গেছেন—তা ঘোড়া আছে তো?

তা আছে।

তা ঘোড়াতেই জিন করিয়ে আনতে বলগে।

যে আজ্ঞে।

বনমালী চলে গেল। সান্যালও বোধ হয় কাছারিতে যাবার জন্য প্রস্তুত হতেই চলে গেলেন।

ঘরের মধ্যে কেবল সবিতা ও সত্যজিৎ।

সবিতা? সত্যজিৎ ডাকে।

বল? সত্যজিতের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকলি সবিতা।

মনে হচ্ছে আজকের ব্যাপারে তুমি যেন অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছো?

কালকের ও আজকের ব্যাপারে আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা আশঙ্কা জাগছে জিৎ। আমার সত্যি বলছি কেমন যেন ভয়-ভয় করছে।

কিন্তু এখন তো বুঝতে পারছো সবিতা, তোমার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে সত্যিই প্রকাণ্ড একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ক্রমে ক্রমে এখন সব একটু একটু করে জানা যাচ্ছে অনুসন্ধান করতে গিয়ে।

সবিতা সত্যজিতের যুক্তিকে খণ্ডনও যেমন করতে পারে না তেমন ও সম্পর্কে কোন কথাও যেন বলবার স্পৃহা পর্যন্ত বোধ করে না।

কি শান্তিই ছিল তাদের এই বাপ ও মেয়ের সংসারে। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার আবির্ভাব কেন? কেন এ কালো মেঘ?

সত্যিই জিৎ, আমার কি মনে হচ্ছে জান? এই বাড়ি-ঘর দুয়ার সমস্ত সম্পত্তি ফেলে রেখে কলকাতার হস্টেলেই আবার ফিরে যাই।

তাতেই এই সঙ্কটকে কি তুমি এড়াতে পারবে সবি?

কিন্তু এখানকার হাওয়াই যেন কেমন বিষিয়ে উঠেছে। আমার যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে।

আর কটা দিন অপেক্ষা করো, কিরীটীবাবু, তোমার বাবার হত্যা-রহস্যের একটা মীমাংসা করতে পারেন ভালো, নচেৎ আমি তো

সত্যি কথা বলতে কি তোমায় জিৎ, তাতেও যেন আর আমার খুব বেশী উৎসাহ বা রুচি নেই।

সে কি! এ তুমি কি বলছে সবি?

হ্যাঁ। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, বিশেষ করে মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানবার পর থেকে, বাবার ও মৃত্যুর ব্যাপারে কোথায় যেন একটা পারিবারিক জটিলতাই জড়িয়ে আছে, যেটা এতদিন হয়ত কালের অন্ধকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল সকলে ভুলেও গিয়েছিল, এখন আবার এই মৃত্যুর ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে হয়ত সেই সব অতীতের কাহিনী মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠবে।

ও কথাটা যে আমার মনে হয়নি তা নয় সবিতা কিন্তু অতীতে ধরেই যদি নিই একটা পারিবারিক কলঙ্ক থেকেই থাকে এবং সেই জন্যই শুধু, তুমি তোমার জন্মদাতা অমন স্নেহময় পিতার হত্যাকারীকে এমনি করে নিষ্কৃতি দাও তাহলে তুমিই কি মনে শান্তি পাবে? পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে কোন দিন?

কিন্তু তুমি— সবিতা আর নিজেকে রোধ করে রাখতে পারে না। গত কয়েক দিন ধরে যে প্রশ্নের কাঁটাটা নিরন্তর তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছিল, তার মা ও বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চয়ই একটা অতীতের পারিবারিক কলঙ্ক কোথায়ও আছে এবং সেটা একদিন যখন সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়বে দিনের আলোর মত সেদিন তখন সত্যজিৎ কি তাকে ক্ষমা করতে পারবে?

এত বড় শোক ও দুঃখের মধ্যেও যে সদ্যজাত প্রেম তার সমগ্র হৃদয়কে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, শেষ পর্যন্ত যদি তারই পারিবারিক একটা অতীত কলঙ্কের জন্য তাকে আবার ভুলে যেতে হয়, সে ব্যথাকেই বা সে ভুলবে কেমন করে কি সানায়!

সত্যজিৎ! সত্যজিৎ! না, না—তাকে আজ আর সে হারাতে পারে না! কিন্তু পিতার প্রতি কন্যার কর্তব্য

আজ দুদিন ধরে ঐ দ্বন্দ্বেই সে অহর্নিশি পীড়িত হচ্ছে।