১৬. আর বলেন কেন

আর বলেন কেন? মিথ্যে খানিকটা হয়রান করলে কেবল। আমার নামও সান্টা চৌধুরী—কেমন দারোগা বুঝিয়ে দেবো!

প্রমাণটা যখন আপনার কাছেই আছে, সেটা সকালে এখানে দেখিয়ে দিলেই তো পারতেন, সকলের সন্দেহভঞ্জন হয়ে যেত। মিথ্যে তাহলে আর এমনি করে হয়রান হতে হতো না আপনার!

প্রমাণ আর প্রমাণ! এ কি জুলুম মিঃ রায়? এই বাড়িরই ছেলে আমি? সবিতা আর আমার দেহে একই রক্তের ধারা বইছে। আমার কথাই কি প্রমাণ নয়? সবিতার বাবা ও আমার বাবা আপন জাঠতুত খুড়তুত ভাই ছিলেন।

নিশ্চয়ই সেটাই প্রমাণ বৈকি। তবে কি জানেন সন্তোষবাবু, বলতে গেলে একটা যুগ এ বাড়ির সঙ্গে আপনাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। আপনার পিতাঠাকুর আপনার জন্মের পূর্বেই এ গৃহ ছেড়ে চলে যান। তারপর দীর্ঘকাল ধরে যতদূর শুনেছি কোন পত্র দেওয়া-নেওয়াও হতো না। এক্ষেত্রে যদি এদের মনে সন্দেহ জেগেই থাকে তাতে করে এদের খুব বেশী দোষ দেওয়া যায় কি আপনিই বলুন না? কিরীটী মৃদুকণ্ঠে প্রশ্নটা করে সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ও বুড়ো শয়তানটার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু সবিতা? সেও আমাকে কি বিশ্বাস করতে পারছে না?

আপনি তো বুঝতেই পারছেন সন্তোষবাবু, বসন্তবাবুই এখন একদিক দিয়ে সবিতা দেবীর গার্জেন।

গার্জেন! I can tell you Mr. Roy that old শকুনি—ঐ যত অনর্থের মূল। কাকামণির হত্যার আসল ব্যাপারটা আমি কিছুই জানতাম না। আজই থানায় গিয়ে সব শুনলাম

বিস্মিত প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে কিরীটী তাকাল সন্তোষ চৌধুরীর দিকে,

আপনি জানতেন না? কি জানতেন না? মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যে নিহত হয়েছেন, জানতেন না?

তা নয়, তবে কাকার মৃত্যুর আগাগোড়া ব্যাপারটা জানতাম না। জানতাম না যে সত্যসত্যই তাঁকে হত্যা করেছে কেউ।

কিরীটী কিছুক্ষণ সম্মুখে উপবিষ্ট সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালে ঈষৎ কুঞ্চন দেখা দেয়।

সন্তোষ চৌধুরী ইতিমধ্যে যেন তার পুর্বোক্ত কথার জের টেনেই বলতে থাকে, আপনাকে আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না মিঃ রায়, সংবাদটা যে কত বড় একটা শক দিয়েছে আমাকে! মাত্র বছর দুই আগে বাবা মারা গিয়েছেন। মা মারা গেছেন বছর বারো আগে। লেখাপড়াও বিশেষ কিছু করিনি। বাবার এডেনের স্টীমার পয়েন্টের কাছে মস্ত বড় একটা স্টেশনারী দোকান ছিল ওখানকারই একজন আফ্রিকান মুসলমান পার্টনারের সঙ্গে। প্রচুর লাভ হতো দোকানটা থেকে। আমিও ঐ দোকানটাতেই কাজ করতাম। হঠাৎ মাস চারেক আগে ঐ পার্টনার আমাকে জানাল দোকানে নাকি আমার কোন শেয়ার নেই। আমি ওখানকার একজন মাইনে-করা কর্মচারী মাত্র। বাবা নাকি মৃত্যুর কিছু দিন আগেই তাঁর দোকানের অর্ধেক শেয়ার ওকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

তা আপনি তো বললেন আপনার বাবা বছর দুই হলো মারা গেছেন—এত দিন সে কথা সে জানায়নি কেন?

বললে পাছে আমি মনে আঘাত পাই সেকারণেই কোন কথা আমাকে নাকি জানায়নি।

তাহলে এতদিন পরেই বা হঠাৎ জানাল কেন?

দোকানের একটা ব্যাপারে গোলমাল হওয়ায় আমার সঙ্গে তখন সব কথা খুলে আমায় সে বলে।

তারপর?

অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন ফলই হলো না। দীর্ঘ উনিশ-কুড়ি বছরের ব্যাপার। কোন দলিলপত্রও খুঁজে পেলাম না। অবশেষে বাধ্য হয়েই একপ্রকার বিরক্ত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম ভারতবর্ষে।

যদি কিছু মনে না করেন মিঃ চৌধুরী, একটা প্রশ্ন আপনাকে আমি করতে চাই।

নিশ্চয়ই। বলুন না শুনি?

আপনার কাকা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যে মারা গিয়েছেন এ সংবাদটা আপনি কোত্থেকে পেলেন?

কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরীটীর প্রশ্নটা সে সন্তোষ চৌধুরীকে বেশ একটু বিব্রত করে তুলেছে তার চোখে-মুখেই সেটা যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বাংলা সংবাদপত্রে সংবাদটা বের হয়েছিল। তাতেই আমি জানতে পারি। একটু যেন ইতস্তত করেই কথাগুলো বলে সন্তোষ চৌধুরী।

বাংলা সংবাদপত্রে! এডেনে কি বাংলা সংবাদপত্র যায় নাকি?

হ্যাঁ। মর্মবাণী, বাংলার অর্ধ-সাপ্তাহিক কাগজটা আমাদের বাসায় নিয়মিত যেত। তাতেই সংবাদটা পাই, এখানে রওনা হবার দিন দুই আগে।

সংবাদটায় কি লেখা ছিল? .

এই যে দেখুন না কাগজের কাটিংটা, এখনো আমার ব্যাগেই আছে। I kept it. বলতে বলতে সন্তোষ চৌধুরী তার জামার পকেট হতে সুদৃশ্য একটা চামড়ার পাস বের করে পার্স থেকে সংবাদপত্রের ছোট একটা কাটিং কিরীটীর হাতে তুলে দিল।

কিরীটী ঘরের আলোয় কাটিংটা পড়তে লাগল। স্থানীয় সংবাদদাতা প্রেরিত সংবাদ!—স্থানীয় জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর প্রাণহীন দেহ গতকল্য বৌরাণীর বিলের মধ্যস্থিত যে দ্বীপটি—যাহাকে স্থানীয় লোকেরা নন্দনকানন বলিয়া জানে সেখানেই পাওয়া গিয়াছে। জমিদারের মৃত্যুর কারণ জানা যায় নাই। রহস্যজনক বলিয়াই মনে হয়। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী অত্যন্ত অমায়িক ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার জমিদারীর উন্নয়নকল্পে এযাবৎকাল তিনি বহু অর্থ ব্যয় করিয়াছিলেন। ইত্যাদি।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে এক নিঃশবাসে লেখাটা পড়ে কিরীটী কাগজটা সন্তোষ চৌধুরীকে ফেরত দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, চৌধুরী মশাইয়ের যে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে সে তো এই সংবাদেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে দেখতে পাচ্ছি সন্তোষবাবু!

কথাগুলো বলতে বলতেই কিরীটী সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।

এবার প্রত্যুত্তরে কতকটা যেন ইতস্তত করেই সন্তোষ চৌধুরী জবাব দেয়, হ্যাঁ। তবে তাঁর মৃত্যুটা রহস্যজনক বলতে যে ব্যাপারটা এতটা ঘোরাল হত্যা এটাই বুঝে উঠতে পারিনি দারোগাবাবুর সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে সব জানতে পারবার পূর্ব পর্যন্ত।

অতঃপর কিরীটী ক্ষণকাল চুপ করেই থাকে। তারপর একসময় মুখ তুলে মৃদুকণ্ঠে বলে, দারোগাবাবুর সঙ্গে আপনার কি কথা হলো?

ভদ্রলোকটিকে বিশেষ সুবিধাজনক বলে মনে হল না মিঃ রায়। কথাবার্তা আমাদের মধ্যে যা কিছু হয়েছে কাকার হত্যা সম্পর্কেই। তাঁর ধারণা হত্যাকারী বাইরেরই কোন লোক। কিন্তু আমিও তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি

কি বুঝিয়ে দিয়েছেন? আদপেই সেটা সম্ভবপর নয়!

সম্ভবপর নয় কেন?

কেন আবার কি! এ বাড়িরই কেউ না কেউ তাঁকে হত্যা করেছে।

আপনার কি তাই মনে হয় মিঃ চৌধুরী?

নিশ্চয়ই। এ বিষয়ে কোন ভুল নেই। এই গোবিন্দপুরে কে তাঁকে বাইরে থেকে হত্যা করতে আসবে? আর কেনই বা আসবে?

সন্তোষ চৌধুরীর কথায় কিরীটী মৃদু হাস্য করে, কোন জবাব দেয় না।

হাসছেন যে? আপনিই বলুন না, তাঁর সঙ্গে বাইরের লোকের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

ভুলে যাচ্ছেন কেন মিঃ চৌধুরী, তিনি এখানকার জমিদার ছিলেন এবং শুধু তাই নয় তাঁর ব্যবসা ছিল ও বন্ধকী কারবারও কিছু কিছু করতেন। তাঁর পক্ষে বাইরের শত্রু থাকা কিছুই বিচিত্র নয়। বরং স্বাভাবিকই বলতে পারেন।

কিন্তু আপনি যাই বলুন মিঃ রায়, আমার স্থির বিশ্বাস বাইরের কেউ নয়। এ বাড়ির মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল সেরাত্রে তাদের মধ্যেই কেউ না কেউ কাকাকে হত্যা করেছে। তাছাড়া এ বাড়ির পুরাতন ঝি কানাইয়ের মা, নিশ্চয়ই সে মারাত্মক কিছু জানত যার জন্য তাকেও রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হতে হয়েছে এ বাড়ি থেকে গতরাত্রে। আমাদের প্রত্যেকেরই কি এখন কর্তব্য জানেন?

কি? কৌতুকভরা দৃষ্টিতে কিরীটী সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল।

নিরুদ্দিষ্টা কানাইয়ের মাকে যেমন করে যে উপায়ে হোক এখন সর্বাগ্রে খুঁজে বের করা।

সন্তোষ চৌধুরীর কথার কোনো জবাব দেয় না কিরীটী। নিঃশব্দে ঠোঁটের মধ্যে পাইপটা চেপে ধরে ধূমপান করতে থাকে। কিছুক্ষণ একটা স্তব্ধতার মধ্যেই অতিবাহিত হয়ে যায়।

একসময় কিরীটী পীড়াদায়ক স্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কিন্তু আমাকে আপনার কি বলবার ছিল বলুন তো? যেজন্য এখানে আমার অপেক্ষায় বসেছিলেন?

হ্যাঁ, থানা থেকে আসতে আসতে আমার কি মনে হচ্ছিল জানেন

কি?

এ হত্যা-রহস্যের একটা মীমাংসা করা প্রয়োজন। এবং আপনি যখন এ কাজে হাত দিয়েছেন তখন আমাদের প্রত্যেকেরই আপনাকে আমাদের সাধ্যমত সাহায্য করা কর্তব্য। আমি তা করবো সেই কথাটা বলবার জন্য আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।

ধন্যবাদ। আপনাদের সকলেরই সাহায্যের আমার প্রয়োজন। মৃদুভাবে কিরীটী জবাব দেয়।

***

ঐ রাত্রেই। রাত তখন গোটা এগার হবে। অল্পক্ষণ আগে মাত্র সকলের আহারাদি শেষ হয়েছে। অনুজ্জল টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় দ্বিপ্রহরে কিরীটী যে এ্যালবামটা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ঘরের ড্রয়ার থেকে এনেছিল তারই পাতাগুলো পুনরায় অন্যমনস্ক ভাবে ওল্টাচ্ছিল। সহসা এমন সময় অতর্কিতে দরজার বাইরে একটা দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল। কিরীটী ক্ষিপ্রহস্তে অ্যালবামটা বাজিয়ে তার শয্যার নিচে একেবারে চালান করে দিল। এবং বিস্মিত দৃষ্টি ভেজানো দরজার দিকে তুলে ধরল।

পরমুহূর্তেই ভেজানো দরজা ঠেলে কমধ্যে এসে প্রবেশ করল কল্যাণী।

কল্যাণী দেবী! কি সংবাদ? এত রাত্রে?

কল্যাণীর চোখেমুখে একটা সুস্পষ্ট উত্তেজনার আভাস।

লক্ষ্মীকান্ত সাহা! অস্ফুট কণ্ঠে কল্যাণী উচ্চারণ করল।

বসো। বসো। ঐ চেয়ারটায় বসো। কিরীটী পাশেরই শুন্য চেয়ারটা দেখিয়ে কল্যাণীকে শান্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাল।

কল্যাণী কিন্তু বসে না। চেয়ারের একটা হাতলের উপরে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে মনের উত্তেজনাটা সামলে নেবার চেষ্টা করে মুহূর্তের জন্য। তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, নায়েব মশাইয়ের ঘরে লক্ষ্মীকান্ত সাহা গোপনে বোধ হয় কোন পরামর্শ করছে আর সেই ঘরের বন্ধ দরজার গায়ে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে শুনছেন সন্তোষবাবু।

কিরীটী কল্যাণী-প্রদত্ত সংবাদটায় কোন গুরুত্বই আরোপ না করে মৃদু হাস্য তরল কণ্ঠে বলে, তাতে হয়েছে কি?

বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় কল্যাণী কিরীটীর মুখের দিকে।

কিন্তু আমাদের ব্যাপারটা কি জানালে হতো না মিঃ রায়? কল্যাণীর কণ্ঠস্বরে উদ্বেগটা অস্পষ্ট থাকে না।

বসো। আজকের রাতে যে সভা বসেছে তার সমস্ত রহস্যই হয়ত আর দুচার দিনের মধ্যেই সর্বসমক্ষে উঘাটিত হয়ে যাবে। এখন তাড়াহুঁড়ো করতে গেলে হয়ত সব কেচে যাবে।

কিরীটীর কথাগুলো কল্যাণী যে ঠিক স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি সেটা কিন্তু কিরীটীর আদপেই বুঝতে কষ্ট হয় না কল্যাণীর চোখমুখের দিকে তাকিয়ে।

আমার কথাটা হয়ত ঠিক বুঝতে পারনি কল্যাণী। খুব সম্ভবত ঘটনাচক্রে নিজের ব্যর্থতায় লক্ষ্মীকান্ত সাহা সাদা কথায় যাকে বলে একেবারে মরীয়া হয়ে উঠেছে। কাজেই যে কোন একটা কাজের দ্বারা নিজের ক্ষমতা জাহির করবে হয়ত সে দুচার দিনের মধ্যেই। এ হয়ত তারই প্রস্তুতি চলেছে।

বারান্দার দামী ওয়াল-ক্লকটা এমন সময় ঢং করে রাত্রি সাড়ে এগারটা ঘোষণা করল। রাত অনেক হলো কল্যাণী, এবারে তুমি শুতে যাও। আমারও ঘুম পেয়েছে। বলতে বলতে নিদ্রাকাতর হয়েই যেন সে একটা হাই তুলল। এবং কথাটা শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

কল্যাণীকে ঘর ত্যাগ করবার জন্য সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। কল্যাণীও আর দ্বিরুক্তি না করে ঘর হতে বের হয়ে গেল। কিন্তু তার কৌতূহলী মন কিরীটীর কথায় নিবৃত্ত হয় না। পায়ে পায়ে সে নিচের সিঁড়ি বেয়ে একতলার দিকে অগ্রসর হয়।

আহারাদির পর নিদ্রা আসছিল না দেখে কল্যাণী প্রমোদভবনের সামনে দক্ষিণাংশে যে ফুলের ছোটখাটো একটা বাগান আছে সেখানে আপন মনে অন্ধকারেই একটা পাথরের বেদীর উপরে বসেছিল। দুপুর থেকেই একটা অসহ্য গুমোট গরমে প্রকৃতি যেন থমথম করছে। বাতাসের লেশমাত্রও নেই। বিকালের দিকে আকাশের এক প্রান্তে একটু মেঘ উঠেছিল কিন্তু সেটাও ঘন চাপ বেধে উঠতে পারেনি, অন্ধকার রাত্রির আকাশপটে তারাগুলো কেবল মিটিমিটি জ্বলছে। কল্যাণী আপন মনে বসে বসে কিরীটীর সঙ্গে দ্বিপ্রহরে যে আলোচনা হয়েছিল তাই ভাবছিল। কে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে হত্যা করেছে? আর কেনই বা করেছে? কিরীটীর কথায় মনে হয় স্বার্থটা অর্থ-সম্পর্কিত। অর্থই এ অনর্থের মূল। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বিরাট সম্পত্তির প্রকৃতপক্ষে মালিক এখন ঐ সবিতাই। তবে সন্তোষ চৌধুরী তার যে পরিচয় দিয়েছে তা যদি সত্য হয়, তাহলে এ সম্পত্তির একটা অংশ তারও প্রাপ্য। নায়েব বসন্ত সেন সন্তোষ চৌধুরী তার পরিচয়ের উপযুক্ত প্রমাণ না দেওয়া পর্যন্ত তাকে স্বীকার করে নিতে রাজী নন। স্পষ্টই সেকথা তাকে জানিয়ে দিয়েছেন এখানে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। সন্তোষ চৌধুরীও জোর গলায় জানিয়ে দিয়েছে উপযুক্ত প্রমাণ তার কাছে আছে এবং প্রয়োজন হলে সে প্রমাণ করবেও যে সে এই বংশেরই সন্তান। সত্য হোক মিথ্যা হোক প্রমাণ তার হাতে নিশ্চয়ই আছে, নচেৎ এভাবে জোর গলায় সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করত না। তা ছাড়া সে কি বোঝে না প্রতারক প্রমাণিত হলে আইনের হাতে কিভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে। শুধু তাই নয়, শাস্তিও তাকে পেতে হবে এবং নায়েব বসন্ত সেন সহজে তাকে নিষ্কৃতি দেবে না। সহসা এমন সময় সাইকেলের ঘণ্টি শুনে সচকিত হয়ে কল্যাণী অদূরে গেটের দিকে তাকাল, গেটের আলোয় সাইকেলআরোহীকে দেখে চিনতে ওর কষ্ট হলো না। দারোগা লক্ষীকান্ত সাহা। লক্ষ্মীকান্ত দারোগা এত রাত্রে এখানে! সকালেই তো ভদ্রলোক এখানে এসেছিলেন এবং যাবার সময় সঙ্গে করে সন্তোষ চৌধুরীকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার কিছু আগে সন্তোষ চৌধুরী ফিরে এসেছে ও দেখেছে। এও জানে কল্যাণী, রাত্রের আহার্য সবিতাই বনমালীকে বলে সন্তোষের ঘরে প্রেরণ করেছিল। কৌতুহলী হয়ে কল্যাণী দূর থেকেই লক্ষ্মীকান্ত দারোগাকে অনুসরণ করে। লক্ষ্মীকান্ত সাইকেলটা গেটের একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে সোজা ভিতরে প্রবেশ করে নায়েব বসন্ত সেনের ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে কল্যাণী লক্ষ্মীকান্তকে লক্ষ্য করতে লাগল। নায়েবের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই অল্প পরে দরজা খুলে খোলা দরজার সামনে দাঁড়ালেন বসন্ত সেন।

কি দারোগা সাহেব! এত রাত্রে?

বসন্ত সেনের প্রশ্নে বদ্ধ ওষ্ঠের উপরে ডান হাতের তর্জনী তুলে চাপা গলায় লক্ষ্মীকান্ত বললেন, আস্তে। কথা আছে, উপরে চলুন।

উভয়ের ঘরের মধ্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ভিতর হতে পুনরায় দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

কল্যাণী একটু অবাকই হয়েছিল। প্রথমতঃ এত রাত্রে লক্ষনীকান্তের আবির্ভাব এবং তাঁর আগমনের ব্যাপারে ঐভাবে সতর্কতা অবলম্বন। কল্যাণী চিন্তা করবারও অবকাশ পেল না, অতর্কিতে একটা অস্পষ্ট শব্দ ওর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই ও ফিরে তাকাল। পাশের ঘরের দরজা খুলে সন্তোষ চৌধুরী পা টিপে টিপে বের হয়ে এলো। কল্যাণী থামের আড়ালে আত্মগোপন করেই লক্ষ্য করতে লাগল সন্তোষ চৌধুরীর গতিবিধি।

সন্তর্পণে পা ফেলে সন্তোষ এগিয়ে এসে দাঁড়াল বসন্ত সেনের ঘরের বন্ধ দরজার গায়ে একেবারে যেন ঘেষে। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ সন্তোষ দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। বারান্দার ঝোলানো বাতির আলো সন্তোষের চোখেমুখে এসে পড়েছে। কপালের রেখাগুলো কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

কল্যাণী বুঝতে পারে সন্তোষ আড়ি পেতে ঘরের ভিতরকার বসন্ত সেন ও লক্ষ্মীকান্তর কথাবার্তা শোনবার চেষ্টা করছে। সহসা কল্যাণীর মনে হয় এ সংবাদটা কিরীটীকে এক্ষনি দেওয়া প্রয়োজন।

এত রাত্রে লক্ষ্মীকান্তর আবির্ভাব ও সন্তোষ চৌধুরীর আড়ি পেতে ওদের কথা শোনবার চেষ্টাব্যাপার দুটোই যেন কেমন একটা সন্দেহের উদ্রেক করে। আজ সকাল হতেই পরের পর ঘটনাগুলো কানাইয়ের মা গত রাত থেকে সহসা নিরুদিষ্টা হয়ে গেল। লক্ষ্মীকান্ত সাহা এসে সন্তোষ চৌধুরীকে থানায় ধরে নিয়ে গেলেন। ফিরে এলো সে সন্ধ্যার মুখে। তারপর রাত প্রায় এই এগারোটায় সহসা লক্ষ্মীকান্তর এখানে আবির্ভাব। সন্তোষ চৌধুরীর ঐ ধরনের সন্দেহজনক গতিবিধি। কল্যাণী আর দেরি করে না। থামের আড়াল থেকে সরে গিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

সমস্ত বাড়িটা জুড়ে একটা স্তব্ধতা।

কল্যাণী পা টিপে টিপে সিঁড়ি অতিক্রম করে নিচে নামছে। সিঁড়ির আলোটা অপর্যাপ্ত হওয়ায় সমগ্র সিঁড়ি-পথটা তেমন স্পষ্টভাবে আলোকিত করতে পারছে না। আধো-আলো আধো-ছায়ায় যেন একটা আলোছায়ার রহস্য ঘন হয়ে উঠেছে। নিচে নেমে এসে সোজা কল্যাণী থামের আড়ালে আড়ালে বারান্দা দিয়ে বসন্ত সেনের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু সেখানেও সন্তোষকে দেখতে পেল না। বসন্ত সেনের ঘরের দরজা পূর্বের মতই এখনো বন্ধ।

কে?

মুহূর্তে অন্ধকারেও গলাটা চিনতে কল্যাণীর কষ্ট হয় না। সন্তোষ চৌধুরী।

কে?

আমি কল্যাণী। মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয় কল্যাণী।

কল্যাণী দেবী! লাগেনি তো?

না।

এত রাত্রে নিচে যে আপনি? শুতে যাননি এখনো? সন্তোষ প্রশ্ন করে।

না। শুইনি যে এখনো দেখতেই তো পাচ্ছেন। আপনিও তো শোননি এখনো দেখছি? পাল্টা প্রশ্ন করে কল্যাণী।

না। ঘুম আসছিল না তাই অন্ধকার বারান্দায় ঘুরে বেড়াছিলাম।

আমিও তাই। মৃদু হাস্য-তরল কণ্ঠে কল্যাণী প্রত্যুত্তর দিল।

কল্যাণীর কণ্ঠস্বরের মধ্যে যে একটা হাসির চাপা আভাস আছে সন্তোষের কিন্তু বুঝতে সেটা কষ্ট হয় না। অজ্ঞাতেই বোধ হয় ভ্রূ দুটো তার একটু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।

অতর্কিতেই সন্তোষ বলে ওঠে, হাসছেন যে?

হাসছি! কই না তো!

সন্তোষ কোন জবাব দেয় না কল্যাণীর কথায়। চুপ করেই থাকে।

ক্ষণপরে সন্তোষ আবার প্রশ্ন করে, আপনি তো সবিতার মামাতো বোন, তাই না?

হ্যাঁ। রক্তের সম্পর্ক না হলেও আত্মীয়তার সম্পর্কে।

তার মানে?

তার মানে আর কি! রক্তের কোন সম্পর্ক নেই আমাদের পরস্পরের মধ্যে। সবিদির মা আমার বাবার পাতানো বোন ছিলেন, এই আর কি!

ওঃ। একটা স্বস্তির সঙ্গে যেন ও শব্দটি সন্তোষের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো।

নিশ্চিন্ত হয়েছেন বোধ হয় মিঃ চৌধুরী, আমি সম্পত্তির একজন দাবীদার নই বলে? ক্ষণপূর্বের সেই হাস্য-তরল কণ্ঠস্বর অন্ধকারে ধ্বনিত হয়ে উঠলো।

আপনি একজন ভাগীদার হলেই বা অসন্তোষের আমার কি কারণ থাকতে পারতো বলুন? সবিতার সম্পত্তির দাবী নিয়ে তো এখানে আমি আসিনি।

কিন্তু সকলের ধারণা তো তাই।

সকলের ধারণাই যে তাহলে ভুল, এইটুকুই আমি বলতে পারি। আমি এসেছি আমার নিজের দেশের বাড়িতে ফিরে, আমার সাত পুরুষের ভিটাতে। সম্পত্তির ওপরে বা কোন টাকা-পয়সার ওপরে আমার কোন লোভই নেই। এদের কারো সঙ্গে আমার কোন বিবাদও নেই, কেবল আমি আমার ন্যায্য অধিকারে এখানে থাকতে চাই। কিন্তু আশ্চর্য, দেখুন তাও এরা দিতে রাজী নয়!

কল্যাণী সন্তোষের কথার কোন জবাবই দেয় না। জবাব দেবার মত তার কি-ই বা আছে।

সন্তোষ আবার বলতে শুরু করে, এ বাড়ির উপরের তলায় পর্যন্ত নায়েব বসন্ত সেন আমাকে প্রবেশাধিকার দেয়নি। অথচ শুনলেন তো আজ সকালে, বসন্ত সেন নিজের মুখেই স্বীকার করল কাকার উইলে স্পষ্ট লেখা আছে আমি ফিরে এলে আমি আমার ভাগের সম্পত্তি পাবো।

আমাকে এসব কথা বলছেন কেন? এতক্ষণে কোনমতে কল্যাণী কথা কয়টি বলে।

না, না-রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সবিতার তো আপনি আত্মীয়ের মতই। অতঃপর সহসা যেন আলোচনার মধ্যে একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে সন্তোষ বলে ওঠে, আচ্ছা চলি। রাত অনেক হলো। বলতে বলতে সন্তোষ তার ঘরের দিকে পা বাড়াল।

শয়নকক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে কল্যাণী থমকে দাঁড়াল। পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল হাত দুটি পশ্চাতের দিকে নিবদ্ধ করে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে নিঃশব্দে কক্ষমধ্যে পায়চারি করছেন।

কল্যাণীর পদশব্দে নিত্যানন্দ কন্যার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে তাকালেন। মুখখানা থম থম করছে—চোখের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট অসন্তোষ। গম্ভীর ঘরে প্রশ্ন করলেন নিত্যানন্দ, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে?

নিচে বাগানে বেড়াচ্ছিলাম।

এই মাঝরাত্রে নিচের অন্ধকার বাগানে বেড়াচ্ছিলে! বেড়াবার চমৎকার সময়! কন্ঠে শ্লেষ।

কল্যাণী পিতার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।

এ সেই নিত্যানন্দ সান্যাল নন, যিনি সর্ব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত নির্বিকার। যিনি শান্ত সহিষ্ণু, অমায়িক।

দুই চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা ক্রুদ্ধ আক্রোশ ঝকঝক করছে। ক্ষণকাল সেই আক্রোশ-ঝরা দৃষ্টিতে কন্যার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে সহসা যেন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বিষোদ্গার করলেন, মিথ্যুক! লজ্জা করলো না তোমার মিথ্যা কথা বলতে! নিচের বারান্দায় থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঐ বখাটে ছোকরার সঙ্গে গল্প করছিলে না?

কল্যাণী নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কথার জবাব দিতেও তার ঘৃণা হয়। সমস্ত মন সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে।

এত রাত্রে ঐ ছোকরাটার সঙ্গে কি তোমার এমন কথা হচ্ছিল শুনি?

তথাপি কল্যাণী নিরুত্তর। এতটুকু স্বরও ওর কণ্ঠ হতে বের হয় না।

আক্রোশে ও জ্বালায় নিত্যানন্দ চাপা কণ্ঠে আবার তর্জন করে ওঠেন,

কি? চুপ কেন? জবাব দাও?

নিরুত্তর। কল্যাণী এখনো নিরুত্তর।

কল্যাণী! কটু তিক্ত কণ্ঠে আবার তর্জন করে উঠলেন নিত্যানন্দ।

কিছুই আমার বলবার নেই। এতক্ষণে ধীরে সংযত কণ্ঠে কল্যাণী জবাব দেয়।

কিছুই তোমার বলবার নেই?

না।

বেশ। কালই তোমাকে আমি লুধিয়ানায় পাঠিয়ে দেবো। গ্রীষ্মের ছুটিটা তুমি হস্টেলেই থাকবে।

বলতে বলতে নিত্যানন্দ কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলেন।

আর নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মত কল্যাণী দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মধ্যে। প্রচণ্ড একটা অগ্ন্যুৎপাতের মত তখন তার সমস্ত অন্তরটা জলে পড়ে যেন একেবারে খাক হয়ে যাচ্ছে।