১৪. লক্ষ্মীকান্ত সাহা সহসা

লক্ষ্মীকান্ত সাহা সহসা সন্তোষ চৌধুরীকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে যেন একটা নাটকীয় সংঘাতের সষ্টি করে গেলেন।

ক্রমে দুজনের জুতোর শব্দ ঘরের বাইরের বারান্দায় মিলিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ সকলেই ঘরের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কোন কথা বলে না। সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে পর পর দুটি ঘটনা যেন অত্যন্ত আকস্মিক ভাবেই ঘটে গেল। প্রথমতঃ কানাইয়ের মার নিরুদ্দিষ্ট হওয়া, দ্বিতীয়তঃ লক্ষ্মীকান্তর কতকটা জোর করেই সন্তোষ চৌধুরীকে সঙ্গে করে থানায় নিয়ে যাওয়া।

ঘটনার পরিস্থিতিতে সকলেই যেন অল্পবিস্তর হকচকিয়ে গিয়েছে।

সত্যজিৎই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরীটীকে প্রশ্ন করল, লক্ষ্মীকান্তবাবু, কি সন্তোষবাবুকে arrest করে নিয়ে গেলেন নাকি মিঃ রায়?

না, না—তা কেন হবে, বোধ হয় ওঁকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করতে চান। সন্তোষবাবুর কাছ থেকে সহজে কোন কথা বের করা যাবে না বলেই বোধ হয় সঙ্গে করে থানায় নিয়ে গেলেন।

নায়েব বসন্ত সেন একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন অত্যন্ত যেন আকস্মিক ভাবেই। বসন্ত সেনের এভাবে অকস্মাৎ ঘর ছেড়ে চলে যাওয়াটা সকলের কাছেই বেশ যেন একটু রূঢ় ও অপ্রত্যাশিত বলেই মনে হল এবং ঘটনার রূঢ়তাটুকু সবিতাকেই যেন লজ্জিত করে তোলে বিশেষ করে, কারণ বসন্ত সেনের কিরীটীর প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকানোর ব্যাপার সবিতার দৃষ্টিকেও এড়ায়নি।

লজ্জিত ও সঙ্কুচিত সবিতার মনের অবস্থাটা কিরীটী তার মুখের ওপরে পলকমাত্র দৃষ্টিপাত করেই উপলব্ধি করতে পেরে স্মিত কণ্ঠে বলে, চলুন সবিতা দেবী, উপরে আপনার বাবা যে ঘরে শুতেন সে ঘরটা একবার ভাল করে দেখতে চাই। আপনার আপত্তি নেই তো?

না, না—নিশ্চয়ই না, চলুন না। কিন্তু কানাইয়ের মার ব্যাপারটা যে কিছুই বুঝে উঠতে পরছি না মিঃ রায়। কোথায় গেল সে? সবিতার কণ্ঠ স্বরে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ পায়।

সবিতার প্রশ্নে কিরীটী বারেকের জন্য মুখের দিকে তাকাল, তারপর অত্যন্ত শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললে, ভুল আমারই হয়েছে মিস চৌধুরী। পূর্বাহ্নেই আমার কানাইয়ের মার সম্পর্কে সাবধান হওয়া উচিত ছিল। সত্যিই আমি দুঃখিত।

তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী সবিতা কিরীটীর কথার তাৎপর্যটা বোধ হয় অতি সহজেই অনুমান করে উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, কিরীটীবাবু, তবে কী

হ্যাঁ, হঠাৎ যদি হতভাগিনী কানাইয়ের মার মৃতদেহটা এই প্রমোদভবনের আশেপাশে কোথাও আবিষ্কৃত হয়ে যায় আশ্চর্য হব না এতটুকুও, তবে

কিরীটীর অসমাপ্ত কথার কতকটা জের টেনেই সবিতা প্রশ্ন করে, তবে মিঃ রায়?

না, থাক। মানুষের মন কিনা তাই খারাপটাই মনের মধ্যে সর্বাগ্রে এসে উঁকি দেয়। আপনার মা হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুর ব্যাপারেও যে একটা রহস্য জড়িয়ে আছে, কথাটা এত তাড়াতাড়ি বোধ হয় আমাদের প্রকাশ করা উচিত হয়নি।

মিঃ রায়, তবে কি, কতকটা যেন আর্তকণ্ঠেই সবিতা কিরীটীকে কি একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে সহসা চুপ করে ব্যাকুল দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।

সবিতা দেবী, অসংযত রসনা বড় মারাত্মক জিনিস। তাছাড়া আপনার হয়ত জানা নেই ইট-সিমেন্ট-সুরকির তৈরী ঘরের দেওয়ালেরও কান আছে। মানুষের মত তারাও শুনতে পায়। শুধু যে শুনতে পায় তাই নয়, কথাও অনেক সময় বলতে পারে। চলুন উপরে যাওয়া যাক। কিরীটী যেন বক্তব্যটা জোর করেই একপ্রকার শেষ করে দিয়েই অর্ধপথে খোলা দরজার দিকে পা বাড়ালে।

দরজার ঠিক মুখেই কল্যাণীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে সান্যালের দিকে তাকিয়ে বললে, বাবা, তোমার প্রভাতী উপাসনার যে সময় চলে গেল। কতক্ষণ তোমার উপাসনার সব ব্যবস্থা করে বসে আছি। উপাসনায় বসবে না?

সান্যাল ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন, হ্যাঁ মা, চল যাই। দয়াময় প্রভু! বলতে বলতে সান্যাল অন্যান্য সকলকে অতিক্রম করে বেশ একটু দ্রুত পদবিক্ষেপেই এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন।

কল্যাণীও তার পিতাকে অনুসরণ করল।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে বললে, একটা শাবল আর একটা কোদালের প্রয়োজন আমার মিস চৌধুরী। পাওয়া যাবে এখানে?

বিস্মিতা সবিতা কিরীটীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কোদাল আর শাবল! কি হবে তা দিয়ে?

কিরীটী হাসতে হাসতে জবাব দেয়, অতীতকে খুঁড়ে দেখবো!

অতীতকে খুড়ে দেখবেন?

হ্যাঁ। কে জানে হয়ত তক্ষশিলার মত অত্যাশ্চর্য ধংসাবশেষের সন্ধানও মিলতে পারে। কিন্তু জিনিস দুটো পাওয়া যাবে কি?

কেন যাবে না? গোবিন্দকে বললেই সে দেবেখন। কখন চাই আপনার ও দুটো।

আমার ঘরে রেখে দিতে বলবেন, সময়মত কাজে লাগাবো। কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়।

ইতিমধ্যে সিঁড়ি অতিক্রম করে সকলে প্রায় দোতলায় এসে পৌচেছে। সবিতা সকলের আগে, কিরীটী ও সত্যজিৎ পাশাপাশি অগ্রবর্তিনী সবিতাকে অনুসরণ করে।

চলতে চলতে চাপা নিম্নকণ্ঠে সত্যজিৎকে সম্বোধন করে কিরীটী বলে, কাল দুপুরের দিকে আপনাকে আমার একটু প্রয়োজন সত্যজিৎবাবু। সময় হবে তো?

নিশ্চয়ই হবে।

বেশ।

মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর শয়নকক্ষ।

দরজায় তালা দেওয়া ছিল, সবিতা তার ঘর থেকে চাবিটা এনে তালা খুলে ঘরটা খুলে দিল। সবিতার এবারে এখানে আসা অবধি ঐ ঘরটায় সর্বদা তালা দেওয়াই থাকে, কেবল সন্ধ্যার কিছু আগে একবার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কানাইয়ের মাকে দিয়ে ঘরটা ঝাড়পোঁছ করে বাবার ফটোর নিচে একটা ধূপদানিতে ধূপ রেখে আসত।

মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরের মধ্যে যে জিনিসটি যেমন ভাবে সজ্জিত ছিল, এখনো অবিকল ঠিক তেমনটিই আছে। কোন কিছুই নাড়াচাড়া করা হয়নি বা ছোঁয়া হয়নি।

প্রথমে সবিতা কক্ষমধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল, তার পশ্চাতে কিরীটী ও সত্যজিৎ।

কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে বারেকের জন্য কিরীটী তার চিরাচরিত তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে চতুপার্শ্বস্থিত ঘরের যাবতীয় কিছু দেখে নিল নিঃশব্দে।

ঘরে ঢুকতেই সামনে দেওয়ালে যে এনলার্জড ছবিটি টাঙানো আছে— মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও তাঁর শিশু বালিকা কন্যা সবিতা—অনুমানেই বুঝে নেয় কিরীটী।

ঠিক মুখোমুখি না হলেও ঘরের অন্য দিককার দেওয়ালে একটা সেকালের ভারী মেহগনী কাঠের পালিশ-করা দেরাজ। দেরাজ পুরাতন হলেও পালিশ যেন এখনো চক চক করছে। দেরাজের ঠিক উপরে একখানা এনলার্জ করা ছবি দেওয়ালের গায়ে টাঙানো। ছবিটা বাঁধানো সোনালী রংয়ের সূক্ষ্ম কারকার্যমণ্ডিত মোটা চওড়া ফ্রেমে। ছবির মধ্যে দেখা যাচ্ছে বছর ২৪/২৫-এর এক নারীকে। চিনতে কষ্ট হয় না কিরীটীর এবারেও অনমানে, ঐ হেমপ্রভার প্রতিকৃতি—সবিতার জননী। ঠিক অবিকল যেন সবিতাই ছবির মধ্যে। মায়ের চেহারার, এমন কি চোখ-মুখ-কপালের হবহু আদলটি পর্যন্ত পেয়েছে। সবিতা তার জননীর।

ঘরের দক্ষিণ কোণে একটা ভারী কাঠের চৌকির উপরে বসানো একটা লোহার সিন্দুক।

সবিতা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেই চারটে জানালার কবাটই খুলে দিয়েছিল। ঘরটি এমন ভাবে তৈরী যে, প্রচুর আলো-হাওয়ার অবাধ গতিবিধি আছে।

বিলের দিকে দুটো জানালা ঘেষে একেবারে একটি উঁচু পালঙ্কের উপরে নিভাঁজ একটি শয্যা সবুজ বর্ণের বেডকভার দিয়ে ঢাকা।

একপাশে আলনায় খানকয়েক ধুতি জামা গোছানো। এবং আলনার নিচে দুই জোড়া জুতো।

ঘরের অন্যদিকে একটা ছোট সেক্রটারিয়েট টেবিল। টেবিলের উপরে কিছু কাগজপত্র ও খানকয়েক পুস্তক।

সামনেই একটা চেয়ার ছাড়াও একটা দেওয়াল-আলমারি, একটা দামী আরামকেদারা ও একটা জলচৌকি আছে ঘরে।

ঘরের দুটো দরজা—একটা প্রবেশের ও নির্গমনের, অন্য দরজাটা সামনে দিকে ছাদে যাতায়াতের জন্য।

ঐ দেওয়াল-আলমারি, সিন্দুক ও ড্রয়ারের চাবি আপনাব কাছেই তো সবিতা দেবী? কিরীটী প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। সবিতা একটা চাবির রিং কিরীটীর হাতে তুলে দিল, এই চাবির রিংয়েই সব চাবি পাবেন।

আচ্ছা মিস চৌধুরী, আপনার পিতা রাত্রে যখন নিদ্রা যেতেন, জানালাদরজা শুনেছি খোলাই থাকত! ছাদের ঐ দরজাটা, ওটাও কি ভোলাই থাকত, জানেন? কিরীটী সহসা প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। যতদূর জানি, ঐ দরজাটাও রাত্রে তিনি খুলেই শুতেন। সবিতা জবাব দেয়।

সাধারণতঃ রাত কটা পর্যন্ত জেগে তিনি পড়াশুনা ও জমিদারী সংক্রান্ত কাজকর্ম করতেন?

শুতে প্রায়ই তাঁর বারোটা সাড়ে-বারোটা হয়ে যেত। সকালের দিকে তাই বোধ হয় তিনি একটু দেরিতেই উঠতেন।

কিরীটী প্রথমেই কথা বলতে বলতে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল, সাধারণতঃ এই টেবিলে বসেই তো তিনি কাজকর্ম করতেন?

হ্যাঁ।

কিরীটী লক্ষ্য করে দেখে, টেবিলটার উপরে সূক্ষ্ম একটা ধুলোর পর্দা পড়ে আছে।

টেবিলটা ইদানীং কতদিন ঝাড়-পোঁছ করা হয়নি?

কানাইয়ের মাকে ও টেবিলটা ছুতে বারণ করে দিয়েছিলাম। এখানে আসবার পর আমি একদিন মাত্র টেবিলটা পরিষ্কার করেছিলাম।

কিরীটী নিঃশব্দে তাকিয়ে টেবিলটার উপরে যাবতীয় কিছু খুটিয়ে দেখছিল, সহসা তার নজরে পড়ল একটা লম্বা চুল টেবিলের কাঠের জোড়ের মুখে আটকে আছে।

চুলটা কৌতূহলভরে টেনে বের করল কিরীটী। লম্বা কোঁকড়ানো চুল। কোন নারীর কেশ একগাছি।

কিরীটী লম্বা কোঁকড়ানো কেশগাছি দুই হাতের আঙুলে ধরে টেনে টেনে দেখতে লাগল এবং মধ্যে মধ্যে সবিতার দিকে তাকাতে লাগল। কৌতুহলী সবিতা ও সত্যজিৎ একই সঙ্গে প্রশ্ন করে, কি কিরীটীবাবু?

একগাছি কেশ! বলতে বলতে পকেট হতে একটা কাগজ বের করে কেশগাছি সেই কাগজের মধ্যে রেখে সযতনে কাগজটা ভাঁজ করে পকেটের মধ্যে রাখতে রাখতে বললে, কই, এর মধ্যে বলুন তো কোন চাবিটা ড্রয়ারগুলোর?

চাবির রিংটা সবিতার হাতে দিতে দিতে সবিতা একটা লম্বা মোটা চাবি ড্রয়ারের গায়ে ঢুকিয়ে ড্রয়ারটা খুলে দিল।

এক এক করে সবিতার সাহায্যে কিরীটী দুই দিককার ছটা ড্রয়ারই খুলে তার ভিতরকার কাগজপত্র সব পরীক্ষা করতে লাগল। এবং কাগজপত্রগুলো দেখতে দেখতে একসময় একটা মোটা বোর্ডে বাঁধাই সুদৃশ্য অ্যালবাম টেনে বের করল। অ্যালবামটার মধ্যে অনেক ফটো আঁটা রয়েছে।

কিরীটী বিশেষ কৌতূহলের সঙ্গেই অ্যালবামের পাতাগুলো উল্টে উল্টে দেখে যেতে লাগল।

ফটোগুলো তোলা বোধ হয় অনেকদিন আগেকার। একটু লালচে রং ধরেছে প্রায় প্রত্যেক ফটোতেই এবং ফটোগুলোর মধ্যে বেশীর ভাগই নানা জায়গার ফটো। ঘরবাড়ি, পুরাতন মন্দির, ফোর্ট, জলাশয়, রাস্তাঘাট, বাগানবাগিচা, কবর ইত্যাদির।

বেশীর ভাগই রাজপুতানার ফটো দেখছি! অ্যালবামটা কার সবিতা দেবী।

অ্যালবামটা এর আগে কখনও আমি দেখিনি; বোধ হয় বাবারই

আপনার বাবার ফটো তুলবার শখ ছিল বুঝি একসময়?

বলতে পারি না ঠিক। কখনও বাবাকে ফটো তুলতে আমি দেখিনি।

এককালে হয়ত তিনি খুব দেশভ্রমণ করেছেন। আপনার বাবার মুখে। কখনও দেশ ভ্রমণের গল্প শোনেননি মিস চৌধুরী?

না।

সাধারণতঃ আপনার বাবার সঙ্গে আপনার কি ধরনের কথাবার্তা হত?

এই আমার লেখাপড়া, আমার কলেজের কথা এই সবই আলোচনা করতাম আমরা। সবিতা জবাব দেয়।

হুঁ। অ্যালবামটা আমার কাছে আমি রাখতে পারি আপাততঃ?

বেশ তো, রাখুন না।

কিরীটী অতঃপর কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। কাগজগুলো দেখতে দেখতে একটা খামের মধ্যে খানকতক পুরাতন চিঠি যত্নের সঙ্গে লাল সুতো দিয়ে বাঁধা অবস্থায় পেল।

চিঠিগুলো খুলে পরীক্ষা করতে গিয়ে কিরীটী একটু আশ্চর্যই হয়, চিঠিগুলো অনেকদিন আগেকার এবং হিন্দী ভাষায় লেখা।

হিন্দী ভাষায় দেবনাগরী অক্ষরে লেখা চিঠি!

খান-চার-পাঁচ চিঠি। চিঠিগুলো কিরীটী অ্যালবামটার মধ্যেই খাম সমেত রেখে দিল। সহসা একসময়ে কিরীটী শূন্য শয্যাটির দিকে তাকিয়ে সবিতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললে, যে রাত্রে আপনার বাবা নিহত হন, সে রাত্রে শয্যার উপর যে চাদর ও বেডকভার বিছানো ছিল সেগুলো কি বদল করা হয়েছে মিস চৌধুরী?

না। কেবল ঐ বেডকভারটা বিছানার উপর ছিল না, ওটা পরে আমি পেতে বিছানাটা ঢেকে রেখেছি।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর থেকে বেডকভারটা টেনে তুলে ফেলে বিছানার চাদরটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল।

একটা কথা সবিতা দেবী, যে রাত্রে আপনার বাবা নিহত হন, পরের দিন সকালে ঐ ছাদের দিকের দরজাটা কি খোলা দেখা গিয়েছিল?

তা তো বলতে পারি না! বনমালী হয়ত বলতে পারবে।

ঐদিন দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর কিরীটী একাকী তার ঘরের মধ্যে বসে একটা চেয়ারের উপরে সকালবেলা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর টেবিলের ড্রয়ার থেকে আনা ফটোর অ্যালবামটা আবার একবার উল্টেপাল্টে দেখছিল।

একটা পাতায় এসে দৃষ্টি যেন মুগ্ধ বিস্ময়ে স্থির হয়ে থাকে।

একটি মন্দিরের চত্বরে দাঁড়িয়ে পূজারিণীর বেশে একটি অপরুপ সুন্দরী ১৯।২০ বৎসর বয়স্কা রাজপুতানী মেয়ে। ফটোটা অনেকদিনের পুরাতন হলেও এবং ফটোর বর্ণ অনেকটা ফিকে হয়ে এলেও মেয়েটির অপরুপ দেহশ্রী ও সৌন্দর্য এখনও একেবারে চাপা পড়ে যায়নি।

মেয়েটি হাসছে। পরিধানে ঘাগরা ও গায়ে ওড়না। বুকের দুপাশ দিয়ে ঝুলছে দুটি বেণী।

সহসা বাইরে পদশব্দ শোনা গেল।

চমকে উঠে তাড়াতাড়ি হাতের অ্যালবামটা বন্ধ করে বিছানার তলায় রেখে দিয়ে দরজার দিকে তাকাল। দরজাটা অবশ্য ভেজানোই ছিল।

দরজার গায়ে মৃদু করাঘাত শোনা গেল, আসতে পারি? কে, কল্যাণী দেবী! আসুন, আসুন। কিরীটী মৃদু আহ্বান জানাল। কল্যাণী এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

অপূর্ব সাজ পরেছে সে। পাঞ্জাবী মেয়েদের মত ঢিলা পায়জামা, পাঞ্জাবি ও রেশমী একটা উড়নী গলায় ভাঁজ করা।

বাঃ! চমৎকার মানিয়েছে কিন্তু আপনাকে এই বেশে মিস সান্যাল! কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে।

নিজেকে অত্যন্ত free মনে হয় এই পোশাকে।

তা তো হবেই। ওই বেশেই যে আপনি অভ্যস্ত। কিরীটী জবাব দেয়।

বোধ হয় তাই। কিন্তু একা একা ঘরের মধ্যে বসে আপনি করছিলেন কি?

বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? কিরীটী কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে স্মিতভাবে বললে।