০১. প্রথম আষাঢ়ের নববর্ষা

প্রথম আষাঢ়ের নববর্ষা।

কলকাতা শহরে বর্ষাটা এবারে বেশ দেরি করেই নেমেছে। তাপদগ্ধ ধরিত্রী যেন জলস্নান করে জুড়িয়ে গিয়েছে। মেঘলা ভিজে আকাশে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার যেন ঘন হয়ে চাপ বেধে উঠেছে। ঘরের মধ্যে কিরীটী আর সত্যজিৎ মুখোমুখি দুজনে দুটো সোফার ওপরে বসে। সত্যজিৎ তার বক্তব্য শেষ করে এনেছে তখন; দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে দুটো হত্যা। প্রথমটি স্ত্রী, উনিশ বৎসর পরে তার স্বামী। এবং দুটি হত্যারই অকুস্থান বৌরাণীর বিলের মধ্যে সেই দ্বীপ। দ্বীপটির মধ্যে আছে একটি বিরাম কুটির—তার চারপাশে ফুলের বাগান। দ্বীপটিকে ওখানকার লোকেরা ‘নন্দন কানন’ বলে।

আরো আশ্চর্য কি জানেন মিঃ রায়! নন্দন কাননের মধ্যে একটি শাখাপ্রশাখা বকুল বৃক্ষ আছে, সেই বকুল বৃক্ষের তলাতেই দুটি মৃতদেহ পাওয়া যায়।

কিরীটী মৃদু স্বরে বলে, Queer coincidence!

তাই। জবাব দেয় সত্যজিৎ।

কিরীটী ঘরের মধ্যে জমাট বেধে ওঠা আবছা আলো-আঁধারের দিকে তাকিয়ে আর একবার সত্যজিতের বর্ণিত কাহিনীটা প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করে।

মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আর ইহজগতে নেই। তিনি নিহত।

পিতা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর নিহত হওয়ার সংবাদটা কন্যা সবিতাকে যেন একেবারে কয়েক মুহূর্তের জন্য অসাড় ও পঙ্গু করে দিল। ক্ষণপূর্বে পাওয়া তারবার্তাটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে হস্টেলের কমনরুমের বারান্দায় অসহায় স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকে সবিতা।

আজই মাত্র কলেজের গ্রীষ্মের ছুটির বন্ধ হলো।

কাল রাত্রের ট্রেনে সবিতা বাড়ি যাবে, দুপুরে সে বাবাকে একটা তারও করে দিয়েছে তার যাত্রার সংবাদ দিয়ে। কয়েকটা আবশ্যকীয় জিনিসপত্র কিনবার জন্য মার্কেটে গিয়েছিল সবিতা, হস্টেলে ফিরে আসতেই হস্টেলের দারোয়ান তারটা তার হাতে দিল। একটু আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিল সবিতা হঠাৎ এসময় একটি তার পেয়ে। হঠাৎ তার এলো কেন? ভয়ে ও সংশয়ে তারটা খুলে পড়তেই মূহর্তে যেন সবিতা একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে একেবারে অসাড় হয়ে গিয়েছে।

তারটা করেছেন নায়েব কাকা বসন্ত সেন। মর্মঘাতী তার।

Baboomahashaya Killed! Come Sharp!
                   Naeb-Kaka-Basanta

নায়েব কাকা যে ওকে তার করেছেন ওর তারটা যাওয়ার আগেই, তার প্রেরণের সময়টা দেখেই সবিতা সেটা বুঝতে পারে।

বিমূঢ় হতচকিত ভাবটা কতকটা সামলে নিয়ে সবিতা তার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল; সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা তখন সবেমাত্র। ইচ্ছা করলে এবং কিছু ক্ষণের মধ্যে রওনা হতে পারলেই তো অনায়াসেই সে আজকের রাত্রের ট্রেনটাই ধরতে পারে। ট্রেন তো সেই রাত সাড়ে নটায়। এখনো পুরো দুটো ঘণ্টা সময় ওর হাতে আছে। হ্যাঁ, যেমন করেই হোক আজকের রাত্রের ট্রেনটাই ওকে ধরতে হবে। সবিতা সহসা যেন জোর করেই মনের ও দেহের অসহায়, বিমূঢ় পঙ্গু অবস্থাটাকে ঝেড়ে ফেলে, আর মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে বারান্দাটা পার হয়ে সোজা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এবং সিঁড়ি অতিক্রম করে সোজা একেবারে এসে দোতলার বারান্দার শেষপ্রান্তে হস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট মিসেস ব্যানার্জীর ভেজানো দ্বারের সামনে এসে দরজার গায়ে মৃদু আঘাত করল।

মিসেস ব্যানার্জী ঘরের মধ্যেই ছিলেন, মৃদুকণ্ঠে আহ্বান জানালেন, কে, ভিতরে এসো।

সবিতা দরজা ঠেলে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল।

সবিতার চোখমুখের দিকে তাকিয়ে মিসেস ব্যানার্জী যেন বেশ একটু বিস্মিত হন, ব্যাপার কি সবিতা! কি হয়েছে? অসুখ করেনি তো?

নিঃশব্দে কোন কথা না বলে সবিতা ক্ষণপূর্বে পাওয়া তারটা মিসেস ব্যানার্জীর দিকে এগিয়ে দিল।

বিস্মিতা মিসেস ব্যানার্জী রুদ্ধ নিঃশ্বাসে তারটা পড়ে সবিতার মুখের দিকে তাকালেন, কখন পেলে এ তার?

এই কিছুক্ষণ আগে দারোয়ান দিল–

হুঁ!

আমি আজকের রাত্রের গাড়িতেই যেতে চাই মিসেস ব্যানার্জী!

আজ রাত্রের গাড়িতেই যাবে, কটায় গাড়ি জান কিছু?

হ্যাঁ, জানি।

বেশ, পার তো যাও।

সবিতা আর দ্বিরুক্তি না করে সুপারিনটেনডেন্টের ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

কোনমতে একটা সুটকেসের মধ্যে কিছু জামা-কাপড় নিয়ে একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে সবিতা ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে বললে, শিয়ালদহ স্টেশন!

একটা সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট কেটে সবিতা যখন ট্রেনের একটা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় এসে উঠে বসল, গাড়ি ছাড়তে তখন আর মাত্র মিনিট সাতেক বাকি।

গাড়িতে সে ছাড়াও আরো চারজন যাত্রী ছিল। একটা বার্থ খালি।

একটু পরে সে বাথটাও একজন অল্পবয়সী যুবক গাড়ি ছাড়বার ঠিক মিনিট চারেক আগে এসে অধিকার করল।

গাড়ি ছাড়ল।

একটা গুমোট গরমে এতক্ষণ কামরাটা যেন ঝলসে যাচ্ছিল, গাড়ি ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে চলমান গাড়ির খোলা জানালা-পথে একটা তৃপ্তির পরশ দিয়ে গেল।

স্টেশন ইয়ার্ডের আলোগুলো ক্ৰমে একটা দুটো করে গাড়ির ক্রমবর্ধমান গতির সঙ্গে পিছিয়ে পড়ছে।

হারিয়ে যাচ্ছে আলোগুলো পশ্চাতের অন্ধকারে একটি দুটি করে।

জ্যৈষ্ঠের একেবারে গোড়ার দিক। এবারে একদিনের জন্যও কালবৈশাখী এখনও দেখা দেয়নি কে জানে কেন!

সেই সন্ধ্যা থেকেই আকাশে মেঘ করে আছে, একটা থমথমে ভাব।

সবিতা গাড়ির খোলা জানলা-পথে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ যেন শ্বাস নেবার অবকাশ পায়।

ভাল করে একবার ভেবে দেখবার চেষ্টা করে সমগ্র ব্যাপারটা আগাগোড়া।

মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী– তার বাবা। এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আশ্রয়স্থল আর ইহজগতে নেই।

বাড়ি গিয়ে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই দেউড়ি পার হয়েই কাছারী বাড়ির দালানে তাঁর সেই সৌম্য প্রশান্ত চেহারাটা আর চোখে পড়বে না।

সস্নেহ মধুর সেই হাসি দিয়ে কেউ আর অভ্যর্থনা জানাবে না, পথে কোন কষ্ট হয়নি তো মা! গাড়ি ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছেছিল?

প্রত্যেকবার ছুটিতে যাবার পর প্রথম দর্শনে কেউ আর বলবে না, তুই হাতমুখ ধুয়ে চা খা, আমি এখনি আসছি সবু!

ও আর কাউকে প্রত্যুত্তরে আব্দার-ভরা কণ্ঠে বলবে না, দেরি করো না বাবা, এখুনি এসো কিন্তু। তুমি এলে তবে দুজনে একসঙ্গে বসে চা খাবো। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে কিন্তু–

না রে না। আসছি, তুই যা—

এগিয়ে যেতে পিছন থেকে আর ও শুনতে পাবে না বাবার গলা, বসন্ত, আজ আমাকে ছুটি দাও। নকাইচকাই এসেছে, আজ ওর অনারে আমার ছুটি।

ওকে আদর করে বাবা নকাইচকাই বলে ডাকেন।

নকাইচকাই ওঁর আদরের ডাক।

ওর চার বছর বয়সে মা মারা গিয়েছেন। বাবার কাছেই ও মানুষ। মাকে ওর কিছুই মনে নেই।

বাবার শোবার ঘরে শিয়রের ধারে মায়ের এনলার্জড ফটোটার দিকে কতবার ও অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেছে, কিন্তু কিছুই মনে করতে পারেনি। মা! মায়ের স্মৃতিটা এমন অস্পষ্ট!

মা-বাপ বলতে ঐ একজনকেই চিরদিন জেনে এসেছে। কি শান্ত চরিত্রের মানুষ ওর বাবা! লোকে বলত অজাতশত্রু।

অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির জমিদার হলেও কাউকে একটা চড়া বা উঁচু, কথা বলেননি। উদার শিশুর মত প্রকৃতি তার বাপের। কে শত্রুতা করে হত্যা করলে, নায়েব কাকা বসন্তবাবু তার বিশেষ কিছুই জানাননি, কেবল টেলিগ্রামে লিখেছেনঃ

            Baboo Mahashaya killed! Come sharp!

Killed! নিহত!

কে-ই বা তাঁকে হত্যা করলে এবং কেনই বা তাঁকে হত্যা করলে!

ব্যাপারটা আগাগোড়া কিছুই যেন এখনো সবিতা বুঝে উঠতে পারছে না।

মেল ট্রেন।

এখন বেশ জোরেই চলেছে। লোহার চাকার একঘেয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দটা শ্রবণকে পীড়িত করে তোলে।

আকাশে ইতিমধ্যে একসময় কখন মেঘটা বেশ চাপ বেঁধে ঘন হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ কয়েকটা বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা ওর চোখেমুখে এসে পড়তেই ওর চমক ভাঙল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের সোনালী আলোয় মেঘাবৃত আকাশটা যেন ঝলকিয়ে উঠছে।

সবিতা ঘরে বসে গাড়ির কামরার মধ্যে দৃষ্টিপাত করল।

উপরের দুটো বার্থ ও নিচের দুটো বার্থ অধিকার করে ইতিমধ্যে কখন একসময় চারজন যাত্রী নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে।

দুজন তারা এখনো কেবল জেগে।

সে ও সর্বশেষের আগন্তুক যাত্রী সেই তরুণ যুবকটি। যুবকটির সঙ্গে কেবলমাত্র একটি মাঝারি আকারের চামড়ার সুটকেস ও হোল্ডলে বাঁধা একটি বেডিং।

বেডিংটা এখনো সে খোলেনি। তারই গায়ে হেলান দিয়ে সুটকেসটার উপরে জুতোসমেত পা দুটো তুলে দিয়ে কামরার আলোয় গভীর মনোযোগের সঙ্গে কি একটা মোটা ইংরাজী বই পড়ছে।

সবিতা কতকটা অন্যমনস্কভাবেই তার ঠিক সামনেয় মধ্যকার বার্থে উপবিষ্ট, পাঠরত একমাত্র জাগ্রত তরুণ সহযাত্রীটির দিকে তাকাল।

বছর সাতাশ-আটাশ হয়ত বয়স হবে ওর। দোহারা লম্বা গড়ন।

চোখেমুখে অর্থাৎ মুখের গঠনে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা যেন ফুটে বের হয়।

তৈলহীন রুক্ষ লম্বা চুলগুলো কামরার মধ্যস্থিত ফ্যানের হাওয়ায় কপালের উপর এসে থেকে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বাঁ গালের উপরে একটা দীর্ঘ গভীর ক্ষতচিহ্ন।

হঠাৎ ভদ্রলোকের বার্থের উপরে রক্ষিত চামড়ার সুটকেসটার উপরে নজর পড়ল সবিতার।

সত্যজিৎ রায়, রেঙ্গুন।

বাংলায় লেখা সত্যজিৎ রায়, রেঙ্গুন।

রেগুন! সত্যজিৎ রায়! কথা দুটির মধ্যে কোথায় যেন একটা পরিচয়ের ইঙ্গিত রয়েছে।

খুব বেশী দিনের কথা নয়। মাত্র বৎসরখানেক আগের কথা।

বাবার মুখে ইদানীং অনেকবার রেঙ্গুনে অবস্থিত ঐ নামটির উল্লেখ ও শুনেছে।

বাবার ছোটবেলার বন্ধ, সত্যভূষণ রায়ের একমাত্র ছেলে, সত্যজিৎ রায়। বিলেত-ফেরত ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনীয়ার। সঙ্গে সঙ্গে আবার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা নিহত হয়েছেন। বাবা নিহত হয়েছেন কেবল এই কথাটাই ও নায়েব কাকার তারবার্তায় জেনেছে, তার চাইতে বেশী কিছু ও জানতে পারেনি এখনো পর্যন্ত।

নিজের চিন্তার মধ্যেই সবিতা আবার তলিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ অপরিচিত কণ্ঠের সম্বোধনে চমকে মুখ তুলে তাকাল।

রাত বারোটা বাজে, ঘুমোবেন না? প্রশ্নকারী সম্মুখের মধ্যকার বার্থে উপবিষ্ট যুবক।

হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় সবিতা।

কিন্তু আপনার তো দেখছি সঙ্গে কোন বেডিং পর্যন্ত নেই! যুবক স্মিতভাবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবার।

সত্যি! এতক্ষণে সবিতার খেয়াল হয়। তাড়াতাড়িতে বেডিংটা পর্যন্ত সঙ্গে আনেনি সবিতা।

অবিশ্যি আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমার সঙ্গে যা বেডিং আছে সেটা শেয়ার করে নিতে পারি।

না, তার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি—

আপনি হয়ত ভাবছেন আমাকে আপনি বিব্রত করবেন! কিন্তু মোটেই তা নয় মিস।

আমার নাম সবিতা চৌধুরী।

কতদূর যাবেন আপনি মিস চৌধুরী?

সবিতা তার গন্তব্যস্থানের কথা বলতেই যুবক সবিস্ময়ে বলে ওঠে, আশ্চর্য! আমিও তো একই জায়গার যাত্রী। আপনি কি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর–

হ্যাঁ। আমি তাঁর মেয়ে, বলতে বলতে সহসা এতক্ষণে সবিতার দুচোখের দৃষ্টি অশ্রুবাষ্পে ঝাপসা হয়ে আসে নিজের অজ্ঞাতেই।

নিরুদ্ধ অন্তর-বেদনায় এতক্ষণ সবিতা ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছিল। সেই সন্ধ্যায় পিতার নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া থেকে এই পর্যন্ত একফোঁটা অশ্রুও তার চোখ দিয়ে পড়েনি।

সহসা সত্যজিৎ রায়ের প্রশ্নে সে যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীরই কন্যা এই পরিচয় দিতে গিয়ে তার চোখের পাতা দুটো অশ্রুজলে ভিজে গেল।

সত্যজিৎ অবাক বিস্ময়ে সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

পিতার পরিচয় দিতে গিয়ে হঠাৎ তার দুচোখের পাতা অশ্রুভারে টলমল করে উঠলো কেন ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।

আমার নামটা আপনি শুনেছেন কিনা মিস চৌধুরী জানি না, আমার বাবা সত্যভূষণ রায় আপনার বাবা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বাল্যবন্ধু। আপনার বাবার আমন্ত্রণ পেয়েই আমি বর্মা থেকে আপনাদের ওখানে যাচ্ছি।

সবিতা কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। নিঃশব্দে সত্যজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

এ একপক্ষে ভালই হলো। গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের কাল প্রায় দ্বিপ্রহর হবে। দীর্ঘ পথে আপনাকে সঙ্গী পেয়ে মন্দ হলো না। পথের। একঘেয়েমিটা অনেকটা সহ্য হবে। সত্যি, কি আশ্চর্য যোগাযোগ দেখুন! বলতে বলতে মৃদু হাসে সত্যজিৎ।

সহসা একসময় সত্যজিৎ লক্ষ্য করে, তার এতগুলো কথার জবাবে একটি কথাও বলেনি এতক্ষণ সবিতা। একতরফা সে-ই কেবল এতক্ষণ বকবক করে চলেছে।

এবং শুধু তাই নয়, যদি দেখবার তার না ভুল হয়ে থাকে তো সবিতার চোখে সুস্পষ্ট অশ্রুর আভাসও লক্ষ্য করেছে।

নিজের কৌতুহলকে আর দমন করতে পারে না সত্যজিৎ। এবং কোন প্রকার ইতস্তত না করে সোজাসুজিই প্রশ্ন করলে, মাফ করবেন মিসু চৌধুরী, একটা কথা না বলে আর থাকতে পারছি না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বিশেষ রকম চিন্তিত ও অন্যমনস্ক আপনি। পরস্পরের পরিচয় থেকে যখন জানা গেছে এতদিন আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও পরিচয়ের দাবী একটা উভয়েই আমরা উভয়ের কাছে করতে পারি, সেই পরিচয়ের দাবীতেই জিজ্ঞাসা করছি কথাটা। আশা করি মনে কিছু করবেন না।

না। আপনি হয়ত জানেন না মিঃ রায়, অতি বড় একটা দুঃসংবাদ পেয়েই আমি এই ট্রেনে দেশের বাড়িতে যাচ্ছি–

দুঃসংবাদ! বিস্মিত কণ্ঠে সত্যজিৎ প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। আমার বাবা, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী, হঠাৎ নিহত হয়েছেন।

নিহত হয়েছেন! মৃদু কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে বিস্ময়বিস্ফারিত চক্ষে সত্যজিৎ তাকিয়ে থাকে সবিতার মুখের দিকে।

হ্যাঁ।

আর একটু স্পষ্ট করে বলুন মিস চৌধুরী, আমি যে আপনার কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

এর চাইতে বেশী আমিও কিছুই জানি না মিঃ রায়। বসন্ত কাকা তার করে কেবলমাত্র ঐটকুই আমায় জানিয়ে যেতে লিখেছেন।

কিন্তু

আমি নিজেও এতক্ষণ ধরে ভেবে ভেবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না, কেমন করে এত বড় দুর্ঘটনাটা সম্ভব হলো! আমার অজাতশত্রু বাপকে কে হত্যা করতে পারে!

বাইরে থেকে একজন মানুষকে সব সময় সম্পূর্ণভাবে বিচার করা চলে না সবিতা দেবী। তাছাড়া আপনার বাবার মত অত বড় একটা জমিদারী চালাতে গেলে নিজের অজ্ঞাতেই দুএকজন শত্রু সষ্টি করা এমন একটা অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু সে-সব কথা পরে ভাবলেও চলতে পারে। সব চাইতে বড় কথা হচ্ছে এখন তিনি নিহত হয়েছেন। এবং এক্ষেত্রে আমি বা আপনি সে ব্যাপারে কতদূর কি করতে পারি

আমরা আর কি করতে পারি বা পারবো! কতকটা যেন হতাশাই সবিতার কণ্ঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নিশ্চয়ই। আমাদের দুজনেরই অনেক কিছুই করণীয় আছে। আপনার পিতা এবং আমার পিতা বাল্যবন্ধু। আগে চলুন সেখানে পৌঁছই, তারপর সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নিয়ে যেমন করেই হোক এ হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করবারও তো অন্তত একটা চেষ্টা করতে পারি।

সত্যজিতের কথাটা সবিতা যেন ঠিক হদয়ঙ্গম করে উঠতে পারে না।

ও বুঝে উঠতে পারে না, ওরা দুজনে ওখানে গিয়ে পৌঁছেই বা কি করে তার পিতার হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করতে পারে।

কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তার পিতার মৃত্যু-রহস্যের মীমাংসা হোক বা না হোক, পথের মাঝখানে সত্যজিতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং তার সরস মধুর কথাবার্তায় পিতার হত্যা-সংবাদে যে অসহনীয় দুঃখ তাকে একেবারে বিমূঢ় ও অসহায় করে ফেলেছিল তা থেকে ও যেন কতকটা সান্ত্বনা পায়।

অন্তত তার দুঃখের ভাগীদার যে নিঃসম্পর্কীয় হলেও একজন আছে, এ কথাটা জেনেও যেন ও মনের মধ্যে অনেকটা সান্ত্বনা পায়। অনেকটা নিশ্চিত হয়।