০২. নায়েব বসন্তবাবু

নায়েব বসন্তবাবু, নিজেই স্টেশনে এসেছিলেন সবিতা তার পেয়েই রওনা হবে এই আশা করে।

বসন্তবাবুর বয়স ষাটের কোঠা প্রায় পার হতে চললেও বার্ধক্য এখনো তাঁকে খুব বেশী কাবু করতে পারেনি।

চুলগুলো পেকে একেবারে সাদা হয়ে গেলেও শরীরের গঠন ও কার্যক্ষমতার মধ্যে কোথায়ও এতটুকু বার্ধক্যের ছায়া পড়েনি এখনো। তাঁর পেশল উঁচু লম্বা দেহের গঠন দেখলে মনে হয় দেহে এখনও তাঁর প্রচুর ক্ষমতা। এখনো তিনি দশ-পনের মাইল পথ অনায়াসে হেঁটে চলে যেতে পারেন।

লাঠি হাতে পেলে এখনো দুজন লোকের মহড়া অনায়াসেই নিতে পারেন।

বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে চাকরিতে তিনি এসে ঢুকেছিলেন, আজ দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর এই জমিদারীতে তিনি চাকরি করছেন।

এই চৌধুরী-বাড়িতে তাঁর একটা যুগ কেটে গেল।

জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বয়সে তাঁর চাইতে বছর তিনেক মাত্র বড় ছিলেন।

একটু বেশী বয়সেই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বিবাহ করেছিলেন এবং বিবাহের প্রায় বছর দশেক বাদে সবিতার জন্ম হয়।

সবিতার যখন চার বছর বয়স তখন সবিতার মা হেমপ্রভা মারা যান। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আর বিবাহ করেননি।

বসন্তবাবু, অকৃতদার। এবং যতদূর তাঁর সম্পর্কে জানা যায়, ত্রিসংসারে তাঁর সত্যিকারের আপনার বলতে কেউ নেই এবং কোনদিন কেউ তাঁর আত্মীয়স্বজন আছে বলেও তিনি স্বীকার করেন না।

দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরের মধ্যে মাত্র বারচারেক তিনি তীর্থভ্রমণের নাম করে মাস-দুই করে ছুটি নিয়ে বাইরে গিয়েছেন।

ঐ চারবার ছাড়া কেউ তাঁকে কোনদিন ঐ জায়গা ছেড়ে একটা দিনের জন্যও বাইরে যেতে দেখেনি।

যত বড় বিপদই হোক—বিপদে ভেঙে পড়া বা বিমূঢ় হয়ে পড়ার মত লোক নন বসন্তবাবু।

সবিতা ও সত্যজিৎকে পাশাপাশি ট্রেন থেকে নেমে আসতে দেখে বসন্তবাবু, আর অগ্রসর না হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে ছিলেন সত্যজিতের দিকে।

সত্যজিৎ কিন্তু নিজেই এগিয়ে এসে নিজের পরিচয়টা দিল, আমি রেঙ্গুনের সত্যভূষণবাবুর ছেলে সত্যজিৎ।

সত্যজিৎ সম্পকে সকল ব্যাপার জানা থাকলেও ইতিপূর্বে বসন্তবাবু, সত্যজিৎকে দেখেননি।

নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন, এসো। তোমার আসবার কথা ছিল আমি বাবুর মুখেই শুনেছিলাম।

অতঃপর সবিতার দিকে ফিরে তাকিয়ে সস্নেহে বললেন, চলো মা, বাইরে টমটম দাঁড়িয়ে আছে।

মালপত্র সামান্য যা সঙ্গে ছিল সহিস লছমনের সাহায্যে টমটমের পিছনে তুলে দিয়ে তিনজন পাশাপাশি টমটমে উঠে বসলেন।

বসন্তবাবু নিজেই টমটম হাঁকিয়ে নিয়ে এসেছেন।

জায়গাটা আধা শহর আধা গ্রামের মত।

বেলা প্রায় পড়ে এলো।

আজ গাড়িটা প্রায় ঘণ্টা আড়াই লেট ছিল।

নিঃশেষিত দ্বিপ্রহরের ম্লান বিধুর আলোয় উঁচু কাঁচা মাটির সড়কের দুপাশের গাছপালা, গৃহস্থের ক্ষেতখামার, ঘরবাড়িগুলো কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।

সারাটা দিনের অসহ্য গ্রীষ্মের রৌদ্রতাপে সব কিছু যেন ঝলসে গিয়েছে বলে মনে হয়। বসন্তবাবু একধারে বসে নিঃশব্দে টমটম চালাচ্ছেন, অন্য পাশে ওরা সবিতা ও সত্যজিৎ নিঃশব্দে বসে আছে গা ঘেষে পাশাপাশি।

তিনজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। স্টেশন থেকে বর্তমান জমিদারবাড়ি প্রায় দীর্ঘ পাঁচ মাইল পথ হবে।

স্টেশন থেকে প্রায় মাইলখানেক দুরে ছোট শহরটি গড়ে উঠেছে হাজার দশেক লোকজন নিয়ে, জমিদারের বর্তমান বাসভবন শহর থেকেও প্রায় তিন মাইল দূরে নির্জন একটা বিলের ধারে।

বর্তমান জমিদারদের বাসভবনের আশেপাশে কোন বসতবাটিই নেই।

প্রথম দিকে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বাপের আমলের পুরাতন যে জমিদার বাটি একটা ছিল তাতেই বাস করতেন।

প্রমোদভবনে এসে বসবাস করছিলেন তাও আজ দীর্ঘ উনিশ বৎসর হয়ে গেল।

মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পূর্বপুরুষেরা বছরের কিছুটা সময় এই দূরবর্তী নিরালা প্রমোদভবনে এসে আনন্দ ও স্ফুর্তি করে কাটিয়ে যেতেন মাত্র।

প্রমোদভবনের ব্যবহারটা ক্রমে কমে আসতে থাকে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পিতার আমল থেকেই।

দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর প্রমোদভবন অব্যবহার্য হয়ে পড়ে থাকবার পর আবার একদা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী প্রমোদভবনের সংস্কার সাধন করে পুরাতন পৈতৃক আমলের জমিদার-বাটি থেকে অসুস্থ স্ত্রী হেমপ্রভা ও একমাত্র চার বৎসরের কন্যা সবিতাকে নিয়ে কিছুকাল বাস করবেন বলে এসেছিলেন। কিন্তু প্রমোদভবনে আসবার চারদিনের মধ্যেই হেমপ্রভা অকস্মাৎ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় অসুস্থা স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেলেন এবং ফিরে এসে পুরাতন জমিদার-ভবনে গিয়ে উঠলেও একটা বেলাও সেখানে কাটাতে পারলেন না।

হেমপ্রভার সহস্র স্মৃতিবিজড়িত বিরাট প্রাসাদের কক্ষগুলো দিবারাত্রি যেন মৃত্যুঞ্জয়কে পীড়িত ও ব্যথিত করে তুলতে লাগল। সন্ধ্যার দিকেই আবার পালিয়ে এলেন ঐ দিনই তিনি পুরাতন জমিদার-ভবন ত্যাগ করে প্রমোদ ভবনেই।

সবিতার বাল্য ও শৈশব ঐ প্রমোদভবনে কেটেছে।

জমিদারী আর মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর চাল ও পাটের ব্যবসা ছিল। পরিত্যক্ত বিরাট প্রাসাদটা জুড়ে মৃত্যুঞ্জয় তাঁর কাছারী করলেন।

প্রত্যহ টমটমে চড়ে দ্বিপ্রহরের আহারাদির পর মৃত্যুঞ্জয় পুরাতন প্রাসাদে আসতেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে সমস্ত কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করে, ব্যবস্থাপত্র করে রাত্রে একেবারে ফিরতেন।

ঘোড়ার গলার ঘন্টিটা ঠুং ঠুং করে সায়াহ্নবেলার মন্থর বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল।

বৈশাখের করুণ রিক্ততা।

আজও আকাশের পশ্চিম প্রান্তে মেঘের ইশারা দেখা দিয়েছে। গতকালের মত এবং আজও হয়ত কালবৈশাখী দেখা দিতে পারে।

ক্রমে আদালত, স্কুলবাড়ি, বাজার ছাড়িয়ে টমটম শহরকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলে।

এর পর মাঝখানে সরু কাঁচামাটির অপ্রশস্থ সড়ক এবং দুপাশে চষা ভূমি।

শহর ছাড়িয়ে প্রায় মাইল দুই গেলে বৌরাণীর বিল।

বৌরাণীর বিলের ধার দিয়ে প্রায় সোয়া ক্রোশটাক পথ এগিয়ে গেলে রাস্তাটা যেন বিলের জলের মধ্যে গিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হঠাৎ।

বিলের মধ্যেই দোতলা পাকা ইটের গাঁথুনি বাড়িটাই প্রমোদভবন, বর্তমান জমিদারের বসতবাটি।

প্রমোদভবনে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

সহিসের হাতে ঘোড়ার লাগাম তুলে দিয়ে বসন্তবাবু, টমটম থেকে নেমে ওদের দুজনকেও নামতে বললেন।

সামনেই একটা টানা প্রকাণ্ড বারান্দা রেলিং দিয়ে ঘেরা।

বারান্দার ঝোলানো বাতিটা জেলে দেওয়া হয়েছে। বাইরে বাতাস ছেড়েছে, বাতিটা দুলছে বাতাসে।

সবিতা প্রমোদভবনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়।

সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে সমগ্র প্রমোদভবনের উপরে যেন একটা বিষাদের করুণ ছায়া নেমে এসেছে।

ক্রমেই বাতাসের বেগ বাড়ছে।

সকলে এসে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল।

তোমরা হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করো মা—আমি ততক্ষণ হাতে-মুখে একটু জল দিয়ে আহ্নিকটা সেরেই আসছি।

সারাটা পথ একেবারে কঠিন মৌনব্রত অবলম্বন করে থেকে এই সর্বপ্রথম বসন্তবাবু ওদের সঙ্গে কথা বললেন।

এবং ওদের জবাবের কোনরূপ প্রতীক্ষা মাত্রও না করে সোজা তাঁর মহলের দিকে চলে গেলেন।

বনমালী ও কানাইয়ের মা।

বনমালী চৌধুরী-বাড়ির বহুদিনকার পুরাতন ভৃত্য।

আর দাসী কানাইয়ের মাও চৌধুরী-বাড়িতে আছে—তাও আজ পঁচিশ বছর হবে বৈকি।

কানাইয়ের মা-ই কোলে-পিঠে করে সবিতাকে মানুষ করেছে।

বনমালী আর কানাইয়ের মা দুজনেই একসঙ্গে এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল।

বনমালীর হাতে একটা লণ্ঠন।

কানাইয়ের মা ঘরের মধ্যে ঢুকেই সবিতাকে লক্ষ্য করে বোধ হয় কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু সহসা সবিতার পাশে সত্যজিৎকে দেখে সে অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিল।

বনমালীর চোখেও জল আসছিল, সেও কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সবিতাকেই সম্বোধন করে ভাঙা গলায় বললে, ভিতরে চল দিদিমণি।

হ্যাঁ, আপনি যান সবিতা দেবী, হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করুন গে। আমি এই ঘরেই বসছি ততক্ষণ–

আপনিও আসুন সত্যজিৎবাবু। বলে কানাইয়ের মার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, কানাইয়ের মা, দোতলায় আমার পাশের ঘরটাতেই এই বাবুর থাকবার ব্যবস্থা করে দাও। বনমালী, তুমিও যাও—ঘরটা কানাইয়ের মাকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি একটু গুছিয়ে দাও গে।

সত্যজিৎ বাধা দেয়, আপনি কেন ব্যস্ত হচ্ছেন সবিতা দেবী। ওসব হবেখন।

বাবা থাকলে কোন কিছুর জন্যেই অবিশ্যি আমাকে ভাবতে হতো না সত্যজিৎবাবু! বলতে বলতে সবিতার চোখের কোল দুটো জলে চকচক করে ওঠে।

রাত বোধ করি দশটা হবে। কিছুক্ষণ আগে কালবৈশাখীর একপশলা ঝড়জল হয়ে গিয়েছে। খোলা জানালা-পথে ঝিরঝির করে জলে ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ঘরের মধ্যে।

সবিতার কক্ষের মধ্যেই বসন্তবাবু, সত্যজিৎ ও সবিতা তিনজনে বসে কথা হচ্ছিল।

ঘরের এক কোণে কাঠের একটা ত্ৰিপয়ের উপরে সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া কেরোসিনের টেবিল-বাতিটা কমানো, মৃদুভাবে জ্বলছে। বাতির শিখাটা ইচ্ছে করে কমিয়ে রাখা হয়েছে। মৃদু আলোয় কক্ষের মধ্যে একটা আলোছায়ার স্বপ্ন যেন গড়ে উঠেছে।

বসন্তবাবু, বলছিলেনঃ

ব্যাপারটা শুধু, আশ্চর্যই নয়, রহস্যময়! পরশুদিন সকালে বৌরাণীর বিলের মধ্যে নন্দনকাননে বকুল গাছটার তলায় চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহটা যখন আবিস্কৃত হলো–

সত্যজিৎ বাধা দিল, মৃতদেহ প্রথম কে আবিষ্কার করে?

আমি। আমিই প্রথমে মৃতদেহ দেখতে পাই। সাধারণত চৌধুরী মশাইয়ের ইদানীং মাসখানেক ধরে শরীর একটু খারাপ যাওয়ায় বেলা করেই ঘুম থেকে উঠছিলেন।

তাহলেও সাতটার মধ্যেই তিনি শয্যাত্যাগ করতেন। পরশু সকালে আটটা বেলা পর্যন্তও যখন চৌধুরী মশাই শয়নঘর থেকে বের হলেন না, বনমালীই চৌধুরী মশাইকে ডাকতে গিয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে ঘর খালি। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। বনমালী এদিক ওদিক বাড়ির মধ্যে খোঁজাখুজি করে আমাকে সংবাদ দেয়। আমি তো আশ্চর্যই হলাম বনমালীর কথা শুনে। কারণ এত সকালবেলা বেড়ানো বা বাড়ি থেকে কোথাও বের হওয়া তো তাঁর কোন দিনই অভ্যাস নেই। যাহোক সমস্ত বাড়িটা খুঁজেপেতেও যখন তাঁকে পেলাম না তখন বাড়ির চারপাশে খোঁজাখুজি শুরু করলাম। তারপর আমিই খুঁজতে খুঁজতে তাঁর মৃতদেহ বৌরাণীর বিলের মধ্যে নন্দন কাননে গিয়ে দেখতে পেলাম।

কি অবস্থায় দেখলেন? সত্যজিৎ প্রশ্ন করল আবার।

দেখলাম বকুল গাছতলায় দেহটা লম্বালম্বি হয়ে পড়ে আছে। পরিধানে সেই আগের দিনেরই ধুতিটা, খালি গায়ে একটা মুগার চাদর জড়ানো। এক পায়ে চটিটা আছে, অন্য পায়ের চটিটা একটু দূরে পড়ে আছে।

মৃতদেহে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল? সত্যজিৎ আবার প্রশ্ন করে।

না, তেমন কোন বিশেষ আঘাতের চিহ্নই দেহের কোথায়ও ছিল না, তবে নাকে ও মুখে রক্তমিশ্রিত ফেনা জমে ছিল।

আপনার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে তাঁকে কেউ বোধ হয় throttle–শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। তাই কি?

সত্যজিতের প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকালেন বসন্তবাবু, এবং বললেন, এখানকার সরকারী ডাক্তারের তাই অভিমত। মৃতদেহ ময়না-তদন্তের ফলে নাকি তাঁকে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে, এইটাই প্রমাণ হয়।

সত্যজিৎ তাকাল বসন্তবাবুর মুখের দিকে। সবিতা নিজের অজ্ঞাতেই একটা অর্ধস্ফুট আর্তকাতর শব্দ করে ওঠে।

বসন্তবাবুর বুকখানা কাঁপিয়েও একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।

বললেন, মৃতদেহ কালই প্রত্যুষে সৎকার করা হবে।

কথাটা যেন কোনমতে জানিয়ে দিয়ে নিজের দায় থেকে মুক্তি পেলেন বসন্তবাবু।

পাষাণের ভারের মত যে ব্যথাটা এ দুদিন তাঁর বুকের মধ্যে জমাট বেধে ছিল, সবিতার কাছে সব খুলে বলবার পর থেকে যেন কতকটা লাঘব বোধ করলেন।

আচ্ছা নায়েব মশাই, এই মৃত্যুরহস্য তদন্ত করে কোন কিছুই কি আপনারা জানতে পারেননি?

না। কিছুই আজ পর্যন্ত জানতে পারা যায়নি। দারোগা সাহেব এ বাড়ির চাকর-বাকর ঝি দারোয়ান সহিস সকলকেই যতদূর সম্ভব জেরা করেছেন, কিন্তু

বনমালী ও কানাইয়ের মা ছাড়া এ বাড়িতে আর কারা আছে?

আমি, সরকার রামলোচন, দারোয়ান ঝোটন সিং, সহিস লছমন, ঠাকুর শিবদাস

এরা কেউ কিছু বলতে পারলে না?

না।

এরা সকলেই বিশ্বাসযোগ্য?

হ্যাঁ, তা বৈকি। অনেকদিন ধরেই তো ওরা এ বাড়িতে কাজ করছে। তাছাড়া চৌধুরী মশাইকে গলা টিপে হত্যা করে এদের কারই বা কি লাভ হতে পারে!

লাভালাভের কথাটা কি অত সহজেই বিচার করা চলে নায়েবমশাই। মানুষের লাভক্ষতির তুলাদণ্ডটি এত সূক্ষ্ণ ভারবৈষম্যেই এদিক-ওদিক হয় যে ভাবতে গেলে যেন অনেক সময় বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। অবশ্য আপনি আমার চাইতে অনেক বেশী প্রবীণ ও বিচক্ষণ, শেষের দিকের কথা কটা সত্যজিৎ যেন কতকটা ইচ্ছে করেই যোগ করে দেয় নিজের বক্তব্যের সঙ্গে; কারণ সত্যজিৎ কথা বলতে বলতেই লক্ষ্য করেছিল ওঁর শেষের কথাগুলি শুনে, বসন্তবাবুর মুখের রেখায় একটা চাপা বিরক্তি ভাব যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সত্যজিতের শেষের কথাগুলোতেও কিতু বসন্তবাবুর মুখের বিরক্তি ভাবটা গেল না। এবং সত্যজিতের কথার উত্তরে তিনি যখন কথা বললেন, তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা বিরক্তির আভাস স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছিল, তোমার কথাটা যে মিথ্যে তা আমি বলছি না সত্যজিৎ। তবে এ বাড়িতে যারা আজ ৮/১০ বছর ধরে কাজ করছে তাদের সম্পকে আর যে যাই ধারণা করুক না কেন, আমি জানি অন্ততঃ তারা সকল প্রকার সন্দেহেরই অতীত।

নিশ্চয়ই তো। কিন্তু এটাও আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে probabilityর বা সম্ভাবনার দিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে এক্ষেত্রে একটা কথা আমরা না ভেবে পারছি না যে, চৌধুরী মশাইয়ের হত্যার ব্যাপারে সব কিছু বিবেচনা করে দেখতে গেলে একটা কথা আমাদের স্বতই মনে হবে এ বাড়িতে ঐ সময় যে বা যারা ছিল তাদের মধ্যে কেউই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যায় না বা যেতে পারে না।

সহসা বসন্তবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সত্যজিতের কথার জবাব মাত্রও না দিয়ে এবং সোজা একেবারে সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাত অনেক হয়েছে মা, কাল সারা রাত ট্রেনে জেগে এসেছো, এবারে শুয়ে পড়। আমিও অত্যন্ত পরিশ্রান্ত—আমি শুতে চললাম।

বসন্তবাবু, সোজা ঘর থেকে চলে গেলেন।

ক্রমে তাঁর পায়ের চটিজুতোর শব্দটা সিঁড়ি-পথে মিলিয়ে গেল।