২০. কিরীটীর গলার স্বরে

কিরীটীর গলার স্বরে ও দরজার গায়ে ধাক্কার শব্দে সুশান্তর দুটো হাত সঙ্গে সঙ্গে মিত্ৰাণীর গলার উপর থেকে শিথিল হয়ে যায়।

মিত্ৰাণীও নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।

বৈদ্যুতিক শক খেলে যেমন মানুষ হঠাৎ স্তব্ধ অনড় হয়ে যায়, সুশান্তও বুঝি তেমনি অসাড় নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছিল কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।

সুশান্তবাবু দরজা খুলুন—আমি অবনী সাহা, থানার ও. সি.! অবনী সাহা ঘন ঘন দরজার গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলেন। সুশান্তবাবু—মিঃ চ্যাটার্জী? মিত্ৰাণীই দরজাটা খুলে দেয়। কিরীটী ও অবনী সাহা ঘরে প্রবেশ করেন। সুশান্ত তখনও যেন প্রস্তর-মূর্তির মত ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

শুনুন মিত্ৰাণী দেবী–সুশান্তবাবু-কিরীটী বলে ওদের লক্ষ্য করে, কেউ আপনারা আর পালাবার চেষ্টা করবেন না। অবনীবাবু প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। বাড়ি আপনাদের পুলিসে ঘেরাও করে আছে।

সুশান্ত ও মিত্ৰাণী নির্বাক।

সুশান্তবাবু, অবনীবাবু এসেছেন আপনাকে গ্রেপ্তার করতে আপনার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে। হত্যার অপরাধে–

না, না, আমি—আমি হত্যা করিনি, কুন্তকে হত্যা করেছে ঐ–ঐ নীচ চরিত্রের মেয়েলোকটা-সুশান্ত চিৎকার করে ওঠে।

না—কঠিন কণ্ঠে অবনী সাহা বলেন-হত্যা করেছেন আপনি। মিত্ৰাণীকে বিবাহ করবার জন্য আপনি প্যাশানে অন্ধ হয়ে নিজের রুগ্ন স্ত্রীকে হত্যা করেছেন সেরাত্রে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে–

না, না, অবনীবাবু

হ্যাঁ-কিরীটী বলে, হ্যাঁ এবং হত্যা করবার জন্যই সে-রাত্রে আপনি রেস্টিং রুম থেকে এখানে এসেছিলেন—এসে নিঃশব্দে হত্যা করে যখন বের হয়ে যান মিত্ৰাণী দেবী আপনাকে দেখতে পান।

মিথ্যে কথা।

মিথ্যে কথা নয়—আরও প্রমাণ আমার আছে-আপনি স্ত্রীকে হত্যা করবার জন্যই সেরাত্রে এসেছিলেন। তারপর নিঃশব্দে হত্যা করে ব্যাপারটাকে একটা সুইসাইড প্রমাণ করবার জন্য আপনার বাবার ঘরে যান মালিশের শিশিটা আনতে–

প্রমাণ আছে কিছু তার?

আছে। মালিশের ঔষধের শিশির গায়ে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে। তারপর আপনার কাদা-মাখা জুতো। আপনার বাড়ির সামনের রাস্তায় কোন কাদা নেই-কিন্তু সে-রাত্রে বৃষ্টির দরুন আপনার বাড়ির পিছনের বাগানে কাদা হয়েছিল, সেই কাদা আপনার জুতোয় লেগে যায়। স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করবেন বলেই সে-রাত্রে সামনের রাস্তা দিয়ে না এসে গোপনে পিছনের রাস্তা দিয়ে এসেছিলেন।

হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম—কিন্তু স্ত্রীকে হত্যা করতে নয়। তাকে আমি হত্যা করিনি। ঐ স্বৈরিণীর একটা চিঠি আমার হাতে পড়ে-ও আমার অনুপস্থিতিতে ওর নাগরকে ডাকে বলে ওদের হাতেনাতে ধরতে এসেছিলাম সে-রাত্রে।

মৃদু হেসে কিরীটী বলে, কিন্তু জানতেন না যে মিত্ৰাণী আপনাকে ভালবাসে না—সে মনে মনে অন্যকে ভালবাসে!

হ্যাঁ, জানতাম না—আমি সত্যিই জানতাম না।

জানলে হয়ত এত বড় ভুলটা আপনাকে করতে হত না! কিরীটী বলে।

ভুল!

নয়? নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে বসলেন—প্যাশানে অন্ধ হয়ে—

করিনি-আমি করিনি-সুশান্ত বলে।

করেছেন-ইউ-ইউ-আপনি-আপনিই আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ–ঐ ইতরটাই করেছে!

সুকার কণ্ঠস্বরে অকস্মাৎ সকলে ফিরে তাকাল।

দরজার ওপরে হাঁপানী রোগী বৃদ্ধ সুকান্ত-সুশান্তর বাবা দাঁড়িয়ে।

আমি-আমি জেগে ছিলাম তখন। ও মালিশের শিশিটা নিয়ে যায়—ও যে সত্যিই এত ইতর, এত ছোট হয়ে গিয়েছে কল্পনাও করতে পারিনি!

বাবা?

আমি তোর বাবা নই, তোর মুখ দেখতেও আমার ঘৃণা হয়।

কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারে না সুকান্ত-হঠাৎ একটা প্রচণ্ড কাশি ওঠে।

কাশতে কাশতে পড়ে যায় সুকান্ত।

সুশান্ত ছুটে এসে বাপের মাথাটা কোলে তুলে নেয়, বাবা, বিশ্বাস কর বাবা, বিশ্বাস কর, আমি কুন্তকে হত্যা করতে এসেছিলাম সত্যি কিন্তু আমার হাতের চাপে তার মৃত্যু হয়নি-তার আগেই সে হার্টফেল করেছিল—নিজে নিজের গলা টিপে আত্মহত্যা করতে গিয়ে–

সুকান্তর চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়।

সুশান্ত ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে।

.

সুশান্তকে অ্যারেস্ট করে জীপে তুলে দেন অবনী।

অন্য আর একটা জীপে অবনী আর কিরীটী ফিরছিল।

অবনী বলেন, সুশান্ত যা বলেছে তা কি সত্যি কিরীটীবাবু?

মনে হয় তাই-তবে—

কি তবে?

তবে এও ঠিক, সুশান্তই তার স্ত্রীর গলা টিপে সে-রাত্রে ধরেছিল এবং শ্বাসরোধেই তার মৃত্যু হয়েছে-হাটফেল করে নয়।

কিন্তু–

ভয় নেই অবনীবাবু, পাপ আর গরল কখনও চাপা থাকে না। একদিন সুশান্তকে স্বীকার করতেই হবে-ও পাপ সে স্বীকার করবেই-আজ হোক বা কাল হোক।