১৮. ঐদিন সন্ধ্যার কিছু আগে

ঐদিন সন্ধ্যার কিছু আগেই ওরা বের হয়ে পড়েছিল মানিকতলা খালপারের বস্তীর উদ্দেশ্যে।

বস্তীটা যেমন ঘিঞ্জি তেমনি বহু বিচিত্র লোকের বাস সেখানে। প্রায় দু-ঘণ্টা খোঁজবার পর এক ছোরার কাছে সঞ্জীব দত্তর সন্ধানটা পাওয়া গেল।

মাস্তান গোছের একটি বছর আঠারো-উনিশ বয়সের ছেলে। নাম জানা গেল সুবিমল। ‘স’ ‘স’ করে ছেলেটি কথা বলে। পরনে একটা ড্রেন-পাইপ প্যান্ট, গায়ে রংচঙে একটা হাওয়াই শার্ট। পায়ে চপ্পল। মাথার চুল সিনেমার অ্যাক্টরের ধরনের ছাঁটা।

সে কি নাম বললেন, স্যার? সুবিমল শুধায়।

সঞ্জীব দত্ত।

সে ভদ্রলোকের কত বয়েস হবে বলতে পারেন, স্যার?

বয়েস?

হ্যাঁ।

তা বয়েস—

মানে যা বলছিলাম—তিনি young না old?

এই ধরুন চব্বিশ-পঁচিশ!

সে তাহলে বলুন স্যার ইয়ংম্যান!

তাই হবে।

হুঁ, তা সে কোথায় চাকরি করে জানেন কিছু–মানে এখানে চারজন সঞ্জীব আছে কিনা–

চারজন।

হ্যাঁ।

এখানে কোন্ সঞ্জীব দত্ত পোর্ট কমিশনারে চাকরি করে?

তাই বলুন-সেই সঞ্জীব দত্ত নিউকামার আমাদের এখানে। তা যান না, এগিয়ে ডানহাতি দশ-বারোটা বাড়ির পরে একটা টিউবওয়েল দেখবেন, তার ওপাশেই খান-দুই বাড়ির পরে রতন মিস্ত্রীর একটা ঘর নিয়ে থাকে।

ছোকরা মিথ্যা বলেনি। সেই মতই পাওয়া গেল সঞ্জীব দত্তর সন্ধান।

পর পর কয়েকটি ঘর। অন্ধকার আর ধোঁয়ায় ঝাপসা অস্পষ্ট। দু-একটা ঘরে তখন সবে আলো জ্বলেছে। সব ঘরে আলো জ্বলেনি। সামনের দিকেই একটা ঘর নিয়ে সঞ্জীব থাকে।

নাম ধরে ডাকতেই সঞ্জীব বের হয়ে এল।

কে?

আপনিই সঞ্জীববাবু? কিরীটী শুধায়।

সঞ্জীব বলে, হ্যাঁ, আপনি কে? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!

আমাকে আপনি তো চিনবেন না। একটু ভিতরে আসতে পারি?

আসুন।

ছোট অপরিসর একখানা ঘর। একটা উজ্জ্বল হ্যারিকেন বাতি জ্বলছিল ঘরের মধ্যে, তারই আলোয় ঘরটা বেশ উজ্জ্বল! একটা তক্তাপোশ, গোটা-দুই টুল, একটা সুটকেস, একটা সরাই, কাপ ডিশ ও জলের গ্লাস।

বসুন।

সঞ্জীব দত্ত ওদের ঐ চৌকির ওপরেই বসতে বলে।

কিরীটীর ইতিমধ্যে নজরে পড়েছিল ঘরের কোণে দুজোড়া জুতো। একজোড়া চপ্পল সু ও একজোড়া কালো কাদা-মাখা কেডস। কিরীটী না বসে সেই জুতোর দিকে তাকিয়ে ছিল।

বসুন!

হ্যাঁ, বসি। কিরীটী বলে, আসুন পরিচয় করিয়ে দিই–

সঞ্জীববাবু-অবনীকে দেখিয়ে কিরীটী বলে, এই ভদ্রলোকও আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন। ইনি বেলেঘাটা থানার ও. সি.।

থানার ও, সি!

একটা ঢোঁক গিলে কোনমতে যেন শুষ্কপ্রায় গলায় কথাটা উচ্চারণ করল সঞ্জীব দত্ত।

কিরীটী তখনও তাকিয়ে সঞ্জীবের দিকে। বয়েস কিরীটীর অনুমানে ভুল হয়নি।

চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যেই হবে। বেশ সবল বলিষ্ঠ চেহারা। মাথায় পরিপটি করে আঁচড়ানো চুল। নাকটা একটু ভোতা, কিন্তু দু চোখের দৃষ্টির মধ্যে একটা বুদ্ধির দীপ্তি। দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ।

সরু চিবুক। দাড়িগোঁফ নিখুতভাবে কামানো। পরনে একটা পায়জামা ও শার্ট।

কিন্তু আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না মশাই! আমার কাছে আপনাদের কি দরকার। থাকতে পারে।

আছে বৈকি। কিরীটী বলে।

কি দরকার?

মিত্ৰাণী বলে কাউকে আপনি চেনেন?

মিত্ৰাণী।

হুঁ।

কিন্তু কেন বলুন তো?

ভ্রু কুঁচকে তাকায় সঞ্জীব ওদের মুখের দিকে।

জিজ্ঞাসা করছি, জবাব দিন। এবারে অবনী বলেন।

তা চিনব না কেন—

অনেক দিনের পরিচয় আপনাদের? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ।

আপনারা পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসেন?

এককালে বাসতাম।

মানে?

মানে বাসতাম-সেটা অতীতে—এখন আর বাসি না।

কেন?

সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। ক্ষমা করবেন।

একটা কথা বোধ হয় আপনি জানেন না সঞ্জীববাবু! কিরীটী বলে।

কি কথা বলুন তো?

মিত্ৰাণীর দিদি শকুন্তলা দেবী দিন-কুড়ি আগেকার এক ঝড়জলের রাত্রে নিহত হয়েছেন।

সে কি?

হ্যাঁ, গলা টিপে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং সম্ভবতঃ যে সময় দুর্ঘটনাট ঘটে তার কিছু আগে পরে সে-রাত্রে আপনি মিত্ৰাণী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন যখন-তখন–

ননসেন্স। কি সব যা-তা বলছেন?

যা বলছি তার এক বর্ণও মিথ্যা নয়।

সম্পূর্ণ মিথ্যা।

না। শুনুন সঞ্জীববাবু, প্রমাণ আমার হাতে আছে- আপনি সে-রাত্রে সেখানে গিয়েছিলেন এবং প্রমাণও আছে আমার–

প্রমাণ!

হ্যাঁ।

কি প্রমাণ?

ঐ-ঐ যে ঘরের কোণে আপনার কাদা-মাখা জুতোজোড়া, ঐ তার সাক্ষী দিচ্ছে। আর শুধু তাই নয়, যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আপনি সেই রাত্রে—সেই মিত্ৰাণী তার জবানবন্দিতে বলেছেন

কি-কি বললেন? মিত্ৰাণী বলেছে?

হ্যাঁ।

সে বলেছে তার সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম সে-রাত্রে?

হ্যাঁ। অতএব বুঝতেই পারছেন, আর অশ্বীকার করবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই!

বলতে বলতে এবারে কিরীটী পকেট থেকে সেই সিগারেটের টুকরোটা বের করল।

আর এই যে সিগারেটের টুকরো, এটাও মিত্ৰাণীর ধরেই পরের দিন পাওয়া গিয়েছে। আমি ঘরে ঢুকেই লক্ষ্য করেছি, খাটের ওপরে আপনার ঐ সিগারেটের প্যাকেটটা-চর্মিনার সিগারেট—এটাও তাই, বলুন—এখনও বলবেন সে-রাত্রে আপনি সেখানে যাননি?

উপায় ছিল না আর অস্বীকার করবার।

সঞ্জীবকে-যাকে বলে কোণঠাস—তাই করেছিল কিরীটী।

সঞ্জীব যেন চুপসে যায়। সেই উদ্ধত প্রতিরোধ ঝিমিয়ে এসেছে তখন।

ধীরকণ্ঠে বলে, হ্যাঁ—মানে আমি গিয়েছিলাম—

কেন?

শুনবেন কেন?

হ্যাঁ।

তাকে-তাকে হত্যা করতে-সেই বিশ্বাসঘাতিনী—

সঞ্জীববাবু-আপনি একটা মহা ভুল করতে উদ্যত হয়েছিলেন—

কি বললেন?

তাই—এবং সে ভুল করলে সারাটা জীবন আপনি হয়ত অনুতাপ করতেন!

তাই বুঝি?

হ্যাঁ, কারণ মিত্ৰাণী সত্যিই আপনাকে ভালবাসেন।

হো হো করে হেসে ওঠে সীব। বলে, কি বললেন—ভালবাসে?

হ্যাঁ।

মিত্ৰাণী আমাকে ভালবাসে?

হ্যাঁ।

না—আপনি জানেন না মশাইও সাক্ষাৎ কালসাপিনী—

না—সে আপনাকে সত্যিই ভালবাসে।

বিশ্বাস করি না।

বিশ্বাস করুন আমার কথা।

হঠাৎ যেন অতঃপর সঞ্জীব দত্ত কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল।

এখন বলুন, ঠিক কটার সময় আপনি সেরাত্রে সেখানে গিয়েছিলেন সঞ্জীববাবু?

রাত তখন—

কত? সম্ভবত দেড়টা দুটো হবে-প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে তখন—

কিরীটী এবারে বলে, ঐ রাত্রে—ঐ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে অতটা পথ নিশ্চয়ই পায়ে হেঁটেই গিয়েছিলেন, কারণ ঐ সময় যানবাহন পাওয়া কঠিন–

পায়ে হেঁটেই গিয়েছিলাম। সঞ্জীব দত্ত বলে।

তাই তো জিজ্ঞাসা করছি সঞ্জীববাবু, কি এমন জরুরী প্রয়োজন হয়েছিল যে অত রাত্রে ঐ দুর্যোগের মধ্যেও আপনাকে অতটা পথ যেতে হয়েছিল!

মিথ্যা বলব না মিঃ রায় আপনাকে–দিনের বেলা সবার চোখের উপর দিয়ে মিত্ৰাণীর সঙ্গে গিয়ে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।

কেন?

কারণ আমাদের পরস্পরের ভালবাসাটা কেউ ওর আত্মীয়স্বজন ক্ষমার চোখে দেখেনি। মালদহে আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও গোপনে এবং সর্বদা রাত্রির অন্ধকারেই পরস্পর আমরা পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতাম। তাছাড়া ঐ সুশান্ত চ্যাটার্জি-মিত্ৰাণীর জামাইবাবু লোকটার সঙ্গে যদিও আমার সাক্ষাৎ পরিচয় কোনদিনও হয়নি—হবার সুযোগও হয়নি, শুনেছিলাম ভীষণ নাকি রাগী প্রকৃতির–সাহস হয়নি তাই দিনের বেলা সেখানে যেতে।

এখানে আপনি কতদিন এসেছেন?

তা প্রায় মাস চারেক হবে। আমার এক মামা আমার পোর্ট কমিশনারের চাকরিটা যোগাড় করে দেওয়ায় এসেছি।

এই চার মাসের মধ্যে কবার আপনাদের পরস্পরের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে?

তা দশ-বারো বার তো হবেই-বেশীও হতে পারে।

প্রত্যেক বারই বোধ হয় রাত্রে?

হ্যাঁ। মিত্ৰাণীর জামাইবাবুর রাত্রে নাইটডিউটি পড়লে সে চিঠি দিয়ে আমায় জানাত-আমি যেতাম।