প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৯

নয়

“রহস্যটা জানতে চন?” বেশ একটু গম্ভীর মুখে বললে পরাশর, “তাহলে শুনুন। এসবকিছু জানতে পেরেছি জ্যোতিষের গণনায়।”
“জ্যোতিষের গণনায়!” বিস্ময় আমিও প্রকাশ না করে পারলাম না।
“হ্যাঁ, জ্যোতিষের গণনায় । এই দেখুন না জ্যোতিষের আর একটা গণনার কথা আপনাদের শোনাচ্ছি।” পরাশর আমার কাছ থেকে গালা দেওয়া খামটা চেয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ভেতরকার কাগজটা পড়তে পড়তে বললে, “আপনাদের হোটেলের দোতলার সবচেয়ে ভালো স্যুইটটা আজ খালি হবার কথা আছে। কিন্তু তা হবে না। মিঃ র্যা থবোন আর তাঁর স্ত্রী আরো পাঁচদিনের জন্যে স্যুইটটা বুক করবেন অর তার মধ্যে ওঁদের একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা। সেইটেই ঠেকাবার জন্যে আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।”
“আপনি জ্যোতিষের গণনার জোরে এসব ভবিষ্যদ্বাণী করছেন!” বারোহা বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়েই জিজ্ঞাসা করলে। “র্যা থবোন দম্পতির মধ্যে দুর্ঘটনাটা কার হবে আর কি ধরণের তা আপনার জ্যোতিষের গণনায় কিছু পাচ্ছেন?”
“গণনা ত আমার নয়!” পরাশর তার হাতের কাগজতা দেখতে দেখতে বললে – “আমি একজন অসামান্য জ্যোতিষীর কাছ থেকে এসব ‘টিপস’ মানে হদিস পাই। তাঁর এ কাগজ থেকে যা পাচ্ছি তাতে দুর্ঘটনা মিস্টার বা মিসেস র্যা থবোন যে কোনো জনেরই হতে পারে। দুজনেরই একসঙ্গে হওয়া অসম্ভব নয়। আর দুর্ঘটনাটা আপনাদের যা হয়েছে তারই একটু বড় সংস্করণ।”
“তার মানে?” বারোহা আর ম্যানেজার দুজনেই প্রায় একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন। “এ হোটেলে আবার এইরকম বিষক্রিয়া গোছের ব্যাপার দেখা যাবে আর তা হবে আরো গুরুতর।”
একটু থেমে বারোহা একটু তীক্ষ্ণস্বরেই পরাশরকে প্রশ্ন করলে, “এবারে আমাদের যা হয়েছে তা কোনো বিষ থেকেই হয়েছে বলে আপনি মনে করেন! কিন্তু বিষ আসবে কোথা থেকে? মিঃ সেঙ্গার সমস্ত খাদ্য আর পানীয়ই চেক করে গ্যারাণ্টি দিচ্ছেন। তাতে কোন বিষ থাকতেই পারে না।”
“তাতে না থাক।” পরাশর গম্ভীর হয়েই জানালে, “আপনারা যা খেয়েছেন পান করেছেন তার মধ্যেই বিষ ছিল।”
“কেমন করে থাকবে।” বারোহা বেশ একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বললে, “আমাদের খাবার আর ড্রিংক বিষ দেবে কে, আর কি উদ্দেশ্যে।”
“তাই এখন খুঁজে বার করতে হবে!” বললে পরাশর।
“আপনি আমাদের হোটেলের রেস্তোরাঁর ওয়েটার বা বারবয়দের সন্দেহ করছেন কি?” মিঃ সেঙ্গার বেশ তীক্ষ্ণ স্বরেই জিজ্ঞাসা করলেন।
“না, তা করছি না।” শান্তভাবে জানালে পরাশর।
“তাহলে!” উত্তেজনায় বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ পেটে যেন একটা ব্যাথা বোধ করে বারোহা মুখটা একটু বিকৃত করে আবার বিছানায় বসে পড়ল।
“আপনি মিছিমিছি অত উত্তেজিত হবেন না মিঃ বারোহা।” পরাশর কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত করতে চাইলে।

ফল কিন্তু উল্টো হল। বারোহা সাময়িক ব্যাথাটা ঝেড়ে ফেলে আবার সোজা হয়ে বসে বললে, “আমার এ উত্তেজনা মিছিমিছি বলছেন! আপনি যা বলছেন তার মানেটা নিজেই তলিয়ে বুঝেছেন। আপনার মতে আমাদের খাবার বা পানীয়ে বিষ অতি অবশ্য কিছু ছিল। সে বিষের জন্যে এ হোটেলের ব্যবস্থা বা লোকজন দায়ী নয়। তার অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে নাকি যে আমাদের খাবারে বা ড্রিংকে আমাদের পার্টির কেউই বিষ মিশিয়েছে? কিন্তু পার্টির চারজনই আমরা যে অসুস্থ সেটা হিসেবে ধরেছেন?”
“মিস এলসার অসুস্থ হওয়ার খবর অবশ্য আমি এখনো পাইনি।” জানালে মিঃ সেঙ্গার।
“খবর না পেলেই তিনি সুস্থ মনে করার কোনো কারণ নেই।”
ম্যানেজারের মন্তব্যটা সংশোধন করলে বারোহা, “মিস এলসার কোনো খবর না পাওয়া ত আরো ভাবনার ব্যাপার বলে আমার মনে হচ্ছে। তিনি হয়ত আমাদের চেয়ে বেশী অসুস্থ বলে কোনো খবর দিতেও পারেন নি?”
“না, তিনি অসুস্থ নন।” বাধ্য হয়েই প্রতিবাদ জানালাম।
“অসুস্থ নয়। আপনি কি করে জানলেন।” একটু সন্দিগ্ধ ভাবেই জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
“জানলাম, আমি তাঁকে সুস্থ শরীরে ওপরের ল্যাণ্ডিং-এ নিচে নামবার লিফটের জন্যে অপেক্ষা করতে দেখেছি বলে।”
“সেই অত সকালে আপনি নিজের কামরায় যাবার সময় তাঁকে ল্যাণ্ডিং-এ দেখেছেন!” মিঃ সেঙ্গার সবিস্ময়ে বললেন, “কিন্তু মিস এলসা ত সে লিফটে নিচে নামেন নি। আমি আর মিঃ বর্মা ঐ লিফটে ওপরে আসব বলেই অপেক্ষা করছিলাম। লিফট ত কোথাও না থেমে সোজা নিচে নেমে এসেছে।”
তাহেল তিনি বোধহয় কিছু ভেবে তাঁর কামরাতেই আবার ফিরে গেছেন! বারোহা বললে, “তার কারমায় একবার ফোন করে দেখলে ত পারেন।”
“হ্যাঁ, তাই করুন।” বললে পরাশর, “নম্বর ত চারশ’ পঁচিশ।”

চারশ’ পঁচিশ শুনে মনে মনে একটু চমকালাম। পঁচিশ মানে একেবারে আমার পাশের কামরা। আমাকে ঠিক ছাব্বিশ নম্বরেই ঘর দেবার মধ্যে সেদিক দিয়ে কোনো অর্থ আছে নাকি?
মিঃ সেঙ্গার তখন এলসার ঘরে ডায়াল করে কোনো সাড়াই কিন্তু পাচ্ছেন না। ফোনটা ধরে রেখেই তিনি আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “এ তো শুধু রিং-ই হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না।”
“তাহলে মিঃ ভদ্র আর কাউকে দেখে এলসা মনে করে ভুল করেননি ত?” সন্দেহ প্রকাশ করলে বারোহা।
“না, সে-ভুল হওয়াও সম্ভব নয়,” বললেন ম্যানেজার, “ফ্লোরে এলসার বয়স বা চেহারার কোনো মেয়েই নেই।”

লিফটের জন্যে ল্যাণ্ডিং-এ দাঁড়িয়ে থাকলেও কোন কারণে হয়ত তখন না গিয়ে এলসা পরে নেমে গেছে মনে করে নিচের রিসেপশন কাউণ্টারে খোঁজ নেওয়া হল এর পর। না, মিস এলসা নিচে নামেই নি বলে সেখান থেকে জানা গেল।
“তাহলে তার কামরাতেই খোঁজ করতে যেতে হয়।” উদ্বিগ্ন হয়ে বললে বারোহা।
“তা যাওয়া যাবেখন, পরে।” বললে পরাশর, “আপাততঃ উপরের তলায় একবার ফোন করে দেখুন ত মিঃ সেঙ্গার।”
“ওপরের তলায় ফোন করে দেখব,” ম্যানেজার বেশ অবাক, “সে কি!”
“নিচে না নেমে থাকলে ওপরে গেছে ভাবাই স্বাভাবিক নয় কি!” পরাশরের গলায় একটু যেন প্রচ্ছ্ন্ন কৌতুক।
“কিন্তু ওপরতলায় ফোন করা হবে কাকে।” জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
“র‍্যাথবোনদেরই ফোন করে দেখুন।” নির্দেশ দিলে পরাশর।
“র‍্যাথবোনদের?” বারোহার গলায় তার অবিশ্বাসের সুরটা অস্পষ্ট রইল না। কিন্তু র‍্যাথবোনদের কামরাতেই এলসার খবর পাওয়া গেল। সে কিচ্ছুক্ষণ আগে ও-কামরাতেই গেছে। এই মিনিট দুযেক হল নিজের কামরয় নেমে গেছে।
“মিস এলসার হঠাৎ র‍্যাথবোনদের ঘরে যাবার মানে।” ভুরু কুঁচকে নিজের বিমূঢ়তাটা বুঝিয়ে বারোহা এবার সোজাসুজি পরাশরকেই চেপে ধরতে চাইল, “কিন্তু আপনি সবকিছু জড়িয়ে যে রকম একটা শয়তানী ষড়যন্ত্র কল্পনা করছেন, এই সবেমাত্র দিল্লীর ঐ শোভরাজের দল ধরা পড়ার পর নেহাৎ গবেট ছাড়া কারুর পক্ষে সেরকম কিছু করা কি সম্ভব? খবরের কাগজে কাগজে এখনো ত সে দলের নানা খবর বার হচ্ছে। কি করে তারা ট্যুরিস্ট সেজে নিরীহ সরল অন্য ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের বিষ দিয়ে অজ্ঞান কে যথাসর্বস্ব লুট করত সে বিবরণ ত এখন কারুর অজানা নয়। সদ্য সদ্য ঐ ঘটনার পর ঐ এক প্যাঁচ দিয়ে বাজিমাৎ করার কথা কোনো আহাম্মকও নিশ্চয় ভাববে না।”
“আহাম্মকেরা পারবে না বলেই অতি বুদ্ধিমানেরা ভাববে।” পরাশর তার নিজস্ব ব্য্খ্যা শোনালে, “সাধারণের পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত বলেই এই সময়টা তারা বেছে নেবে একই প্যাঁচ খাটাবার জন্যে।”
“না। আমায় মাপ করবেন মিঃ বর্মা,” নিজের মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে বললে বারোহা। “আমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।”
“বোঝবার চেষ্টা এখন তাহলে করবেন না।” পরাশর উপদেশের সুরেই বললে, “আপনি শুধু একটু সাবধানে থাকবেন।”
“আমি সাবধানে থাকব।” পরাশরের কথায় বারোহা আমাদের মতই হতভম্ব, “আমারও এখনো ভয়ের কিছু আছে নাকি? কাল রাত্রের ব্যাপারেও তা কেটে যায় নি?”
“না, মিঃ বারোহা!” বেশ গম্ভীর হয়েই জানালে পরাশর, “আপনার আসল বিপদ এইবারেই আসছে। আর র্যা থবোনদের চেয়েও তা অনেক গুরুতর।”
“বলেন কি?” বারোহার মুখ দেখে মনে হল পরাশরের কথাটা ঠাট্টা না সত্যি সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। হেসে উঠবে না ভয় পাবে ঠিক করতে পারছে না তাই।

বারোহার এ প্রতিক্রিয়াটা পরাশর লক্ষ্য করল কিনা বুঝতে পারলাম না। ম্যানেজারের দিকে ফিরে সে তখন তাঁকে আরেকবার এলসার ঘরে ফোন করতে বলছে।
“আবার মিস এলসার ঘরে!” ম্যানেজার একটু আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলেন কিন্তু পরাশর সে আপত্তি খণ্ডন করে বললে, “এতক্ষনে মিস এলসা নিজের ঘরেই ফিরেছেন বলে মনে হচ্ছে। ওঁকে ফোন করে শুধু বলুন যে বিশেষ একটা জরুরী প্রয়োজেনে আপনি দুজন সঙ্গীকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে চান।”
“দেখা করতে যদি না চান?” রিসিভারটা তুলে ধরেও ডায়াল করবার আগে ম্যানেজার তাঁর সন্দেহটা জানালেন।
“আপত্তি করলে ভিন্ন ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আপত্তি করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।” আশ্বাস দিলে পরাশর।

পরাশরের আশ্বাস মতই এলসাকে ফোন করলেন ম্যানেজার। হঠাৎ তাঁর মুখে হিন্দী শুনে প্রথমটা অবাক হবার পরই মনে পড়ল এলসা ইংরেজী জানে না। ফোনে ম্যানেজারের কথা থেকে বোঝা গেল পরাশরের অনুমানই ঠিক। এলসা দেখা করতে আপত্তি জানাল না, একনকি দেখা করার উদ্দেশ্য বা ম্যানেজারের সঙ্গীদেরও নামও জানতে চাইল না।
এলসার কামরাতেই এবার গেলাম, যাবার আগে কামরা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বারোহা শুধু একটু ক্ষুণ্ণ স্বরে জানালে, “আপনাদের সঙ্গে আমিও যদি থাকতে পারতাম।”
“তার জন্যে দুঃখ করবেন না।” তাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেল পরাশর। “যা যা কথা ওখানে হবে সব আপনি আমার বা মিঃ ভদ্রের মুখে জানতে পারবেন। অচ্ছা শেষবার বলে যচ্ছি সাবধানে থাকবেন!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *