১৪. অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে

অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে দু-চোখে যেন মিত্ৰাণীকে ঝলসে দিয়ে সুশান্ত মুখটা ঘুরিয়ে আবার দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

জামাইবাবু? আবার ডাকল মিত্ৰাণী।

ঘুরে দাঁড়াল সুশান্ত, আমার নিমন্ত্রণ আছে বাইরে।

নিমন্ত্রণ!

হ্যাঁ, তুমি খেয়ে নিও। তাছাড়া রাত্রে হয়ত আমি না-ও ফিরতে পারি।

একটা কথা বলছিলাম—

মিত্ৰাণীর কণ্ঠস্বরে সুশান্ত আবার ঘুরে তাকায় ওর মুখের দিকে।

বলছিলাম কি–আপনি একটা অন্য ব্যবস্থা করে নিন।

তার মানে? কিসের ব্যবস্থা?

রাহুল ও আপনাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন লোকের দরকার হবে তো আমি চলে গেলে!

কেন, তুমি চলে যাচ্ছ নাকি?

হ্যাঁ।

কোথায় যাবে শুনি? মালদহে ফিরে গেলে আর তোমাকে তারা জায়গা দেবে মনে কর নাকি?

নাই যদি দেয় তো কি আর করা যাবে। মৃদু হেসে শান্ত গলায় কথাটা শেষ করে মিত্ৰাণী, মালদহই তো পৃথিবীর শেষ একটিমাত্র স্থান নয়!

ওঃ, পৃথিবীটা চিনে ফেলেছ তাহলে?

চিনতে তো হবেই।

তাই বুঝি?

নচেৎ আমাদের মত মেয়েদের চলবে কি করে?

কিন্তু হঠাৎ এ মতলব কেন? সুশান্তর গলার স্বরটা যেন হঠাৎ কেমন করুণ শোনায়।

মতলব আর কি, দিদির জন্যই তো এসেছিলাম, সে-ই যখন-তাছাড়া–

কি?

এখানে যেন আর এক মুহূর্তও আমি টিকতে পারছি না। দম যেন আমার বন্ধ হয়ে আসছে।

দম বন্ধ হয়ে আসছে!

আপনি একজন লোক ঠিক করে নিন—

হুঁ, কারণটা কি তাই, না অন্য কোথায়ও আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়েছ কারও কাছ থেকে? মিত্ৰাণী হাসল। বললে, কে দেবে আশ্রয়? গলগ্রহ যারা অন্যের হয় তাদের লজ্জা বা অনিচ্ছা বলে কিছুর বালাই না থাকলেও যারা আশ্রয় দেবে তাদের সর্বক্ষেত্রেই প্রায় বলতে গেলে ঐ দুটোই যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেজন্য আপনাকে ভাবতে হবে না!

ভাবতে হবে না।

না। তেমন যদি বিপাকে পড়িই, অন্ততঃ রাস্তা বলেও একটা জায়গা তো আছেই সংসারে, সেখানে তো অন্ততঃ ঢোকবার বা বেরুনোর জন্য কেউ দরজার সৃষ্টি করে রাখেনি!

বেশ, তাই তবে যেও।

কিন্তু রাহুলের–

আমাদের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি আসবার আগেও যদি আমাদের চলে গিয়ে থাকতে পারে, তুমি চলে যাবার পরও চলে যাবে। যেদিন যখন খুশি তোমার যেতে পার।

সে তো নিশ্চয়, কার জন্য আর আটকে থাকে এ সংসারে!

কথাটা বলে মিত্ৰাণী ঘুরে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে।

সুশান্ত তথাপি কয়েকটা মুহূর্ত স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকে।

ইচ্ছা হচ্ছিল তার, ছুটে গিয়ে মেয়েটার গালে ঠাস্ ঠাস্ করে কয়েকটা চড় বসিয়ে দেয়। বলে, অকৃতজ্ঞ—ঝিয়েরও অধম হয়ে সেখানে পড়েছিলি-ভাত তো পেটভরে দুবেলা জুটতই না, উপরন্তু লাথি-ঝাটা—এই বুঝি সেই কৃতজ্ঞতারই ঋণশোধ?

কিন্তু কিছুই বলল না সুশান্ত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একসময় বের হয়ে এল বাড়ি থেকে।

আজ দিনে বা রাত্রে আর ডিউটি নেই। ডিউটি পড়েছে সেই কাল ভোরের ট্রেনে। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে সুশান্ত অফিসের দিকেই চলে। খিদেয় পেট চো চো করছে। কাল রাত্রে ক্যানটিনে পেটভরে খাওয়া হয়নি। স্টেশনে পৌঁছে রেলওয়ে ক্যানটিনেই শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঢুকল সুশান্ত। পেটে কিছু না পড়লে আর চলছে না। ক্যানটিনে ঐসময় বিশেষ ভিড় ছিল না। একটা লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে সুশান্ত কোণের একটা টেবিলে গিয়ে বসল।

মিত্ৰাণী চলেই যাবে মনে হচ্ছে!

যদি চলে যায়—একটা ব্যবস্থা করতে হবেই, রাহুলকে দেখাশোনা করবার জন্য—তাছাড়া অসুস্থ বাপ-একজন লোক না হলে মুশকিল। সে নিশ্চিন্তে ডিউটিও করতে পারবে না। মামার বাড়িতে যে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেবে তার উপায় নেই-হাঁসের পালের মত একপাল ওর মামার সংসারে সর্বক্ষণ প্যাক প্যাক করছে।

ক্যানটিন-বয় এসে সামনের টেবিলে ভাতের প্লেটটা নামিয়ে রাখল।

একটা অল্পবয়সের দুঃস্থ গরীবের মেয়ে রাখলে কেমন হয়? দেখাশোনাও করবে এবং রান্নাবান্নাও করবে। কিন্তু চট করে মিলবে কোথায়? লোকের কথা যে সুশান্ত ভাবেনি তা নয়—মিত্ৰাণীর কথা ছেড়ে দিয়েও সে কদিন ধরে ঐ কথাটাই ভাবছিল।

সমরেশকে কথাটা বলায় সে বলেছিল, পেপারে একটা বিজ্ঞাপন দে!

বিজ্ঞাপন দিয়ে কি হবে? সুশান্ত শুধিয়েছিল।

বিজ্ঞাপনে অনেক সময় অনেক সন্ধান পাওয়া যায়—ভাল কাজ হয়।

সন্ধান পাওয়া যায়—কিন্তু—

কি?

সেরকম খাটতে পারে অল্পবয়সের মেয়ে পাব কোথায়?

সমরেশ ঠাট্টা করে বলেছিল, তা ছেলেমানুষেরই বা দরকার কি? মাঝবয়সী বা বুড়ো–

না, ওগুলো কোন কর্মের হয় না, খালি খায় আর পড়ে পড়ে ঘুমোয়!

সমরেশ চোখ নাচিয়ে বলেছিল, তাহলে বল্ house-keeper housewife- একজন বয়সে তরুণী–

সুশান্ত বাধা দিয়েছিল, কি যা-তা বলিস? মুখে আর কিছু আটকায় না! যত সব অশ্লীল–

অশ্লীল! কি বলছিস সুশান্ত? জীবনের যেটা সর্বাপেক্ষা বড় কথা, সেটাই হয়ে গেল অশ্লীল।

থাম্ তো!

থামিয়ে দিয়েছিল সমরেশকে সুশান্ত।

এ কি, সুশান্ত!

চমকে মুখ তুলে তাকাতেই সমরেশের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল সুশান্তর।

সামনে দাঁড়িয়ে সমরেশ।

কি ব্যাপার রে, ক্যানটিনে খাচ্ছিস ডিউটি-অফ ডে-তে?

গৃহে যে আজ অরন্ধন!

অরন্ধন?

হ্যাঁ।

তোদের আবার ওসব আছে নাকি? তাছাড়া আজ তো অরন্ধন নয়।

পাঁজিতে না থাকলেই কি অরন্ধন গৃহে থাকতে নেই?

বেশ একটুকরো মাছের সঙ্গে একগ্লাস ভাত মুখে তুলেছিল সুশান্ত, মাছের সঙ্গে একটা বড় কাটা মুখে চলে গিয়েছিল, সেটা দু-আঙুলে টেনে বের করতে করতে কথাটা বলে সুশান্ত।

সমরেশ ততক্ষণে সামনের একটা চেয়ার টেনে সুশান্তর মুখোমুখি বসে গিয়েছে।

সে বলে, তাহলে বৌদি যেতে-না-যেতেই তোর হাঁড়ির এই হাল হয়েছে বল।

হুঁ, নিজে তো মরেছেই আমাকেও মেরে রেখে গিয়েছে। সুশান্ত জবাব দেয়।

কিন্তু তুই না সেদিন বলছিলি তোর এক শ্যালিকা গৃহে আছে, সংসার ও ছেলের ব্যাপারে তুই নিশ্চিত!

হ্যাঁ, পুরোপুরি।

তার মানে?

বুঝলি সমরেশ-প্লেট থেকে মুখ তুলে তাকাল সুশান্ত, ঐ মেয়ে জাতটা—

কি?

মানে ঐ মেয়ে জাতটার মত নিমকহারাম ও স্বার্থপর দ্বিতীয় প্রাণী আর নেই সংসারে। তোর তাহলে মত বদলেছে বল আবার?

হ্যাঁ।

দেখ, এক কাজ কর—

কি?

তুই তো বলছিলি তোর শ্যালিকাটি তোরই আশ্রিতা একপ্রকার এবং এখনও অবিবাহিতা–

তাই কি?

বিয়ে করে ফেল না তাকে—সেও বেঁচে যাবে, তোরও এভাবে ছুটির দিনে ক্যানটিনের ভাত এসে গিলতে হবে না।

যেন চমকে ওঠে সুশান্ত।

কি যে বলিস!

কেন, খারাপটা কি বললাম?

যাঃ, তাই হয় নাকি!

হয়, হয়-হামেশাই হচ্ছে, আকছার হচ্ছে। প্রস্তাব করেই দেখ—

হুঁ-তারপর রাজী যদি না হয়?

কেন রে? কণ্ঠস্বরে তোর মনে হচ্ছে, প্রস্তাব করেছিলি! করেছিলি নাকি?

না, না—

তবে?

কি তবে?

প্ৰস্তবটা পেশ করেই দেখ না।

যদি না করে দেয়?

করলেই অমনি হল। তাছাড়া তোর বয়সই বা কি এমন হয়েছে?

সুশান্তর ইতিমধ্যে খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে উঠে পড়ে।

সমরেশ ঐসময় বেয়ারাটাকে এক কাপ চা দিতে বলে।

হাত-মুখ ধুয়ে সুশান্ত এসে চেয়ারে পুনরায় বসে একটা সিগারেট ধরায়।

তুই আবার সিগারেট ধরলি কবে থেকে রে?

ধরলাম! উদাস কণ্ঠে জবাব দেয় সুশান্ত।

বেয়ারাটা এক কাপ ধূমায়িত চা এনে নামিয়ে রেখে গেল টেবিলে।

সমরেশ চায়ের কাপটা টেনে নেয়।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সমরেশ বলে, তোর দেখছি সত্যিই আবার একটি বিয়ে করা দরকার।

সুশান্ত কোন জবাব দেয় না, কেমন যেন অন্যমনস্ক। মনে হয়, যেন কি ভাবছে।

সমরেশ আবার বলে, যা বললাম তাই কর-ওসব বলাবলির মধ্যে যাস না। আবার মেয়ে জাতটার হচ্ছে পেটে ক্ষিধে মুখে লাজ-শ্যালিকাটিকে সিনেমা দেখবার নাম করে বের হয়ে সোজা চলে যা রেজিষ্ট্রি অফিসে–

হুঁ, তারপর?

তারপর আবার কি? একেবারে husband and wife!

মৃদু হাসে সুশান্ত।

হাসছিস?

না, উঠলাম। সুশান্ত উঠে দাঁড়ায়।

সমরেশের কথাটা তখনও তার মনের মধ্যে একটা গুঞ্জন তুলে ফিরছে।