১৩. মিত্ৰাণী পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে

মিত্ৰাণী পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।

মাথার চুল বেণীবদ্ধ। একটা কালো সাপ যেন পিঠের উপর এলিয়ে পড়ে আছে।

পরনে একটি ফিকে গোলাপী রঙের চওড়াপাড় মিলের শাড়ি। সেই শাড়ির উপর মৃদু মোমবাতির আলো পড়েছে।

মিত্ৰাণী তার শ্রবণেন্দ্রিয় যেন উৎকর্ণ করে জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু মিত্ৰাণীর প্রতীক্ষ্ণ যেন বৃথাই যায়।

আরও একটা ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেল।

ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বেজে গেল। মিত্ৰাণী যেন এবার একটু চিন্তিত হয়ে ওঠে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন ওর বুকট কাপিয়ে বের হয়ে আসে মনে হল।

জানালার ধার থেকে মিত্ৰাণী সরে এল। রাহুলের শয্যাপাশে এসে দাঁড়াল। রাহুল ঘুমোচ্ছ। মাথার চুলগুলো ঘুমন্ত রাহুলের কপালের উপর থেকে সরিয়ে দিল ধীরে ধীরে মিত্ৰাণী। কি ভেবে যেন বসল রাহুলের শয্যার পাশটিতে। একদৃষ্টে ঘুমন্ত রাহুলের মুখের দিকে চেয়ে থাকে মিত্ৰাণী। শকুন্তলাতার দিদি-ঐ একটিমাত্র সন্ত্রনকে তার যেন সমস্ত প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। অসুস্থ রুগ্না হয়েও সর্বক্ষণ যেন দুটো চোখ মেলে রাখত। রাহুল এতটুকু কাদলে বা কিছু করলে অশ্রাব্য কুশ্রাব্য ভাষায় শকুন্তলা মিত্ৰাণীকে গাল দিত। অথচ মিত্ৰাণী সত্যিই রাহুলকে ভালবাসত।

এখানে আসতে-না-আসতেই রাহুলকে সে যেন আপন করে নিয়েছিল। আর রাহুলও-রাহুলও মিত্ৰাণীকে সত্যিই ভালবাসে। মাসীমণি বলতে সে যেন অজ্ঞান।

তথাপি যে কেন শকুন্তলা রাহুলের ব্যাপারেও তাকে সন্দেহ করত সেটাই যেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনি মিত্ৰাণী। ভাল লাগছে না আর মিত্ৰাণীর এখানে থাকতে।

শকুন্তলা যেমন একদিন তাকে এখানে এনে আশ্রয় দিয়েছিল, ঠিক তেমনি মৃত্যুর ভিতর দিয়ে তার সেই দেওয়া আশ্ৰয়টা যেন নিজেই আবার ভেঙে দিয়ে গিয়েছে।

তাই এক মুহূর্তও যেন এখানে আর মন টিকছে না তার। ইচ্ছা করছে ফিরে যায় সে আবার মালদহে। কিন্তু

মৃদু একটা খসখস শব্দ শোনা যায় জানালার বাইরে অন্ধকার বাগানে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল মিত্ৰাণী। এগিয়ে গিয়ে জানালার সামনে আবার দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাইরের অন্ধকারে কি যেন সে খোঁজে, কিন্তু দেখতে পায় না কিছু। কিছুই তার নজরে পড়ে না।

প্রিয়তোষ বলে ছেলেটি এখনও বাগানের দিকে একটা গাছের নীচে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল।

তার দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ-মিত্ৰাণীর ঘরের দিকে। ঘরের মধ্যে মোমবাতির আলো জ্বলছে। মিত্ৰাণী জেগে আছে।

অনেকক্ষণ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে তাকিয়ে। ফিরে গেল। আবার কিছুক্ষণ বাদে জানালার সামনে ফিরে এল।

প্রিয়তোষ ওখানে রাত নটা থেকে ডিউটি দিচ্ছে।

কাটাতারের বেড়ার পরেই সরু একটা পায়ে-চলা কাঁচা রাস্তা। তারও ওদিকে রেলওয়ে ইয়ার্ড। রেললাইন চলে গিয়েছে এঁকেবেঁকে পাশাপাশি আড়াআড়ি সমস্ত ইয়ার্ডটা জুড়ে। কিছু দূরে মালগাড়ির কয়েকটা ওয়াগন দাঁড়িয়ে রয়েছে বিচ্ছিন্ন ভাবে যেন।

এদিকটায় বিশ্রী মশার উৎপাত।

মাঝে মাঝে হাওয়া যখন জোরে বইছে মশা থাকে না-হাওয়া কমে গেলেই মশা ছেকে ধরে যেন। একসময় ক্রমশঃ ভোর হয়ে এল।

ভোরের আলো চারিদিকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। প্রিয়তোষ ফিরে গেল।

.

বেলা সাতটা নাগাদ সুশান্ত ডিউটি সেরে ফিরে এল। রাত্রি-জাগরণের ক্লান্তি, চোখের তারা দুটো লাল। মাথার চুল বিস্ত। মেজাজটা যেন ভাল নয়।

মিত্ৰাণী রান্নাঘরে ছিল। রাহুল তাড়াতাড়ি খেয়ে স্কুলে যায়—উনুনে ভাতের হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। তরকারির ধামায় গতদিনের আনা সামান্য যা তরকারি অবশিষ্ট ছিল তাই একটা থালায় বঁটি পেতে কুটে কুটে রাখছিল মিত্ৰাণী।

রাহুল তার ঘরে বসে পড়ছে।

মিত্রা!

নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুশান্ত ডাকে মিত্ৰাণীকে।

মিত্ৰাণী সাড়া দেয়, আসছি

ভাতের হাঁড়িটা উনুন থেকে নামিয়ে কেতলীতে চায়ের জল চাপিয়ে দিয়ে মিত্ৰাণী এসে সুশান্তর ঘরে ঢোকে।

শকুন্তলার ঘরটায় তালা দেওয়া থাকায় ইদানীং ঘোট যে স্টোররুমের মত একটা ছিল তারই ঘরের লাগোয়া সেই ঘরেই শুচ্ছিল সুশান্ত।

ঐ ঘরটা খোলাবার কোন চেষ্টাও করেনি সুশান্ত।

ঐ ঘরটার দিকে তাকালেই যেন সুশান্তর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।

ছোট্ট ঘর—একটিমাত্র জানালা। এত ছোট্ট যে ঘরটায় কোন মানুষ থাকতে পারে না। কিন্তু উপায় কি?

তাছাড়া একটিমাত্র দরজা যাতায়াতের। কোনমতে ক্যাম্প-খাটটা পড়েছে, তাতেই যেন ঘরের সব জায়গাটা ভরে গিয়েছে।

সুশান্ত ক্যাম্প-খাটটার উপর বসে গায়ের জামাটা খুলছিল। আমাকে ডাকছিলেন জামাইবাবু? মিত্ৰাণী দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়াল।

জামাটা গা থেকে খুলে একপাশে রেখে সুশান্ত মিত্ৰাণীর দিকে তাকাল, হুঁ, এক কাপ চা খাওয়াতে পার?

চায়ের জল চাপিয়েছি, এখুনি করে এনে দিচ্ছি। টোস্ট না বিস্কুট দেব?

আরে না না, কিছু না। শুধু চা।

মিত্ৰাণী ফিরে যাচ্ছিল।

সুশান্ত ডাকে, আরে শোন–শোন!

কি? ফিরে দাঁড়াল মিত্ৰাণী।

একটা কথা—

কি?

ভাবছি আজ একবার নিউ মার্কেটে যাব।

নিউ মার্কেটে!

হ্যাঁ, অনেকদিন কেক, মাটন-পেস্ট্রি এসব খাইনি, নিয়ে আসি—কি বল? রাহুলও বলছিল।

মিত্রাণী কোন জবাব দেয় না।

তুমি বরং চা-টা জলদি দাও। চা-টা খেয়ে তাড়াতাড়ি এখুনি বের হয়ে পড়ি।

মিত্ৰাণী চলে গেল নিঃশব্দে।

সুশান্ত আপনমনে গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজে।

একটু পরে মিত্ৰাণী চায়ের কাপ হাতে সুশান্তর ঘরে এসে প্রবেশ করল।

হাত বাড়িয়ে দেয় চায়ের কাপটা নেবার জন্য সুশান্ত, কিন্তু তার আগেই সামনে ছোট টুলটার উপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে মিত্ৰাণী।

সুশান্ত ভ্রূকুটি করে তাকায় মিত্ৰাণীর দিকে।

হাতটা গুটিয়ে নেয়।

চায়ের কাপটা টুলটার উপরে নামিয়ে রেখে মিত্ৰাণী চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সুশান্ত ডাকল, মিতা!

মিত্ৰাণী ঘুরে দাঁড়াল নিঃশব্দে। সুশান্তর মুখের দিকে তাকাল মিত্ৰাণী।

তোমার ব্যাপারটা কি বল তো?

প্রশ্নটা করে সুশান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মিত্ৰাণীর দিকে।

মিত্ৰাণী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কথা বলে না।

সুশান্ত আবার বলে আজ কদিন থেকেই দেখছি তুমি যেন আমার উপরে একটু বিরক্ত!

বিরক্ত হব কেন?

কেন হবে তা তুমিই জান। তবে দেখছি তাই-তুমি কি—

কি?

মিত্ৰাণী!

বলুন?

একটা কথার সত্যি জবাব দেবে?

কি?

সত্যি করে বল তো, কুন্তলার মৃত্যুর জন্য কি আমাকে তুমি সন্দেহ করছ?

কথাটা বলতে বলতে সুশান্ত উঠে দাঁড়ায়।

দু-পা এগিয়ে এসে মিত্ৰাণীর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ায়।

তুমি কি আমাকে সত্যিই সন্দেহ কর নাকি?

এসব কি বলছেন আপনি? ছি!

শোন মিতা, কারো মনে যদি আমাদের কোন সন্দেহ থাকে পরস্পরের প্রতি, সেটার স্পষ্টাস্পষ্টি একটি মীমাংসা হয়ে যাওয়াই ভাল নয় কি?

আমি যাই, ভাতটা ফুটে গিয়েছে

না, দাঁড়াও।

জামাইবাবু, এসব কথা থাক!

না, কথাটা যখন উঠেছে শেষ করতে হবে।

আমাকে যেতে দিন জামাইবাবু!

সুশান্ত ইতিমধ্যে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল।

মিত্ৰাণী যাবার চেষ্টা করে বোধ হয় পাশ কাটিয়ে।

জামাইবাবু-জামাইবাবু—

হঠাৎ যেন ক্ষেপে ওঠে সুশান্ত, কে তোমার জামাইবাবু-আমি তোমার জামাইবাবু নই!

কি বলছেন আপনি?

ঠিকই বলছি। ভারি তো দূর-সম্পৰ্কীয় বোন—

মিত্ৰাণী যেন কেমন ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকায় সুশান্তর মুখের দিকে।

তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, আপনি হয়ত জানেন না জামাইবাবু, কুত্তাদির সঙ্গে আমার তেমন কোন নিকটতম সম্পর্ক না থাকলেও আমার নিজের মায়ের পেটের বোনের চাইতেও বেশী ছিল সে।

তাই বুঝি!

হ্যাঁ, আপনি জানেন না, আমার নিজের কোন সহোদর বোন নেই, কিন্তু থাকলেও বোধ হয় সে কুত্তাদির চাইতে আপন হত না।

ব্যঙ্গভরে জবাব দেয় কটুকণ্ঠে সুশান্ত, তাই বুঝি বোনটি তোমাকে এত ভালবাসত।

কথাটায় কান দিল না বা দাঁড়াল না মিত্ৰাণী। ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সুশান্ত কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে মিত্ৰাণীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে; তার মুখের ওপর একটা বিচিত্র কুটিল ছায়া যেন ভেসে ওঠে।

হাত বাড়িয়ে সুশান্ত চায়ের কাপটা তুলে নেয়। চায়ের কাপে চুমুক দেয়। কিন্তু অত্যন্ত বিস্বাদ যেন লাগে চা-টা সুশান্তর। গলা পর্যন্ত যেন তার তেতো হয়ে গিয়েছে।

ঠক করে চায়ের কাপটা পুনরায় টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে।

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়, কিন্তু মুখটা যেন আরও বেশী বিস্বাদ হয়ে যায় তাতে করে। সিগারেটটা জানালা-পথে বাইরে নিক্ষেপ করে।

অতঃপর ঐ ছোট্ট ঘরটার মধ্যেই পায়চারি করতে থাকে। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ কি ভেবে পায়চারি থামিয়ে জামাটা আবার গায়ে দিয়ে নেয় সুশান্ত। জুতোর মধ্যে পা গলিয়ে বের হয়ে আসে ঘর থেকে।

রান্নাঘরের সামনেই মিত্ৰাণীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মিত্ৰাণী শুধায়, কোথায় যাচ্ছেন আবার এসময়?

চুলোয়! বলে সুশান্ত হনহন করে বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

মিত্ৰাণী বুঝি শেষ চেষ্টা করে বলে, সারাটা রাত ডিউটি করে এসেছেন। রান্না হয়ে গিয়েছিল, স্নান করে খেয়ে বেরুলেই পারতেন জামাইবাবু।

সুশান্ত ফিরে তাকাল মিত্ৰাণীর দিকে একবার। দু-চোখে তার অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি।