১২. ভেজানো দরজাটা ঠেলে

ভেজানো দরজাটা ঠেলে মিত্ৰাণী ঘরের মধ্যে পা দিল।

কে?

কাশতে কাশতেই চোখ তুলে তাকাল সুকান্ত।

মিত্ৰাণী কোন কথা না বলে চায়ের কাপটা নিঃশব্দে সুকান্তর শয্যার সামনে টুলটার ওপর নামিয়ে রাখল।

বিষ দিতে এসেছ-দাও দাও—এ কাজটাই বা আর বাকি থাকে কেন?

ঐ এক বুলি হয়েছে শকুন্তলার মৃত্যুর পর থেকে সুকান্তর।

খাবার দিতে ঘরে ঢুকলেই ঐ এক কথা।

বিষ-বিষ দিতে এসেছ-দাও দাও—কিন্তু এভাবে slowpoisoning করছ কেন—ধীরে ধীরে না মেরে একেবারে বেশ খানিকটা বিষ দিয়ে শেষ করে দাও না, ল্যাঠা চোকে আর তোমরাও বাঁচ।

আজও সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে নিতান্ত যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই চায়ের কাপটা তুলে নিল সুকান্ত।

মিত্ৰাণী ঘর থেকে বেরুবার জন্য পা বাড়ায়।

সুকান্ত পিছন থেকে ডাকে, শোন—

ফিরে দাঁড়ায় মিত্ৰাণী।

কিন্তু তোমরা যদি ভেবে থাক, ঐভাবে জ্যান্ত একটা মানুষকে বিষ দিয়ে হত্যা করে তোমরা বিয়ে করে সুখী হবে তো ভুল করছ–

মিত্ৰাণী কোন কথা বলে না।

বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে।

চেয়ে আছ কি? বুড়োর কথা সত্যি কি মিথ্যা জানতে পারবে একদিন। তারপর একটু বেশ দম নিয়ে বলে, হয় না-হয় না—এভাবে একজনের সর্বনাশ করে সুখ পাওয়া যায় না। কেউ কোনদিন পায়নি।

মিত্ৰাণী আর দাঁড়ায় না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

.

রাহুল ডাকছে।

মাসী-মাসীমণি দরজা খোল!

২৩৭ রাহুল স্কুল থেকে বোধ হয় ফিরল। তাড়াতাড়ি গিয়ে মিত্ৰাণী সদর দরজা খুলে দেয়।

কি করছিলে? এত যে ডাকছি, শুনতে পাও না?

এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?

বাঃ, আজ না শনিবার-হাফডে!

সত্যিই তো! আজ শনিবার—মিত্ৰাণীর মনেই ছিল না দিনটা।

মাসীমণি!

কি বাবা?

বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে, কিছু খেতে দাও না।

হাত-মুখ ধুয়ে নাও, আমি খাবার আনছি।

মিত্ৰাণী রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

রাহুল ঘরের মধ্যে বইগুলো রাখছিল-সুকান্তর ডাক শোনা গেল।

দাদু-দাদুভাই!

রাহুল একটু পরে সুকান্তর ঘরে এসে ঢুকল।

আমাকে ডাকছিলে দাদু?

শোন, আয়, কাছে আয়-ফিস্ ফিস্ করে ডাকে সুকান্ত নাতিকে।

কী দাদু?

আয় না, কাছে আয়।

রাহুল এগিয়ে যায়, বল!

খাস না, বুঝলি-খাস না ও যা দেবে–

কী খাব না?

বিষ—বিষ দেবে তোকে-তোর মাকে ওরা মেরেছে, এখন আমাদের দুজনকে মারতে পারলেই–ব্যস, সব চুকে গেল—নিশ্চিন্ত।

তাওইমশাই?

মিত্ৰাণীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে চকিতে মুখ তুলে তাকায় সুকান্ত দরজার দিকে।

কখন ইতিমধ্যে দরজার উপর এসে মিত্ৰাণী দাঁড়িয়েছে সুকান্ত টেরও পায়নি।

ওসব কি যা-তা বলছেন ঐ একটা বাচ্চাকে?

তীক্ষ্ণ গলায় একটা ধমক দিয়ে ওঠে মিত্ৰাণী সুকান্তকে যেন।

সুকান্ত প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবটা সামলে নিয়ে বলে, বেশ করেছি বলেছি। সত্যি কথা বলব না কেন, একশ বার বলব। মারনি-মারনি তোমরা বৌটাকে আমার বিষ দিয়ে?

রাহুল, যাও এখান থেকে, যাও এ ঘর থেকে।

রাহুল সত্যিই মিত্ৰাণীকে ভালবাসে। সে মিত্ৰাণীর নির্দেশ লঙ্ঘন করতে সাহস পায় না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

মিত্ৰাণী আবার সুকান্তর দিকে ফিরে তাকায়।

কঠিন কণ্ঠে বলে, জানেন—আপনি জানেন তাকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে?

মেরেছ—নিশ্চয়ই মেরেছ।

না।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভাব আমি কিছু বুঝি না? কিছু শুনিনি? জানিনি? সব—সব শুনেছি, সব জেনেছি–

কী-কী জেনেছেন আপনি? কী শুনেছেন?

যা সবাই জেনেছে, যা সবাই শুনেছে!

তাই তো জিজ্ঞাসা করি, কি জেনেছে কি শুনেছে?

তোমরা দুজনে মিলে—

থামুন! ধমকে ওঠে মিত্ৰাণী আবার সুকান্তকে।

কেন—কেন থামবে শুনি?

আপনি কি আপনার ছেলেকে ফাসির দড়িতে ঝোলাতে চান?

চাই, চাই—তাকে একলা নয় শুধু, সেই সঙ্গে তোমাকেও-বুঝলে, তোমাকেও!

একটা কুটিল হিংসায় যেন ফেটে পড়ে সুকান্ত।

প্রত্যেকটি কথার মধ্যে যেন একটা আক্রোশ ঝড়ে পড়ে, একটা ঘৃণা।

আপনি না তার বাবা?

না, না, আমি তার কেউ নয়—কেউ নয়। He is not my son,Iam not his father!

মিত্ৰাণী যেন বিস্ময়ে একেবারে পাথর হয়ে যায়।

কোন বাপ তার ছেলের সম্পর্কে এত বড় কঠিন কথা উচ্চারণ করতে পারে?

ও কি সত্যিই বাপ?

মিত্ৰাণী যেন আর দাঁড়াতে পারে না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

সত্যিই সে বুঝি বোবা হয়ে গিয়েছে।

মিত্ৰাণী সোজা নিজের ঘরে এসে ঢোকে। এবং ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়।

রাহুল জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে।

কী-কী হয়েছে রাহুল?

মিত্ৰাণী এসে তাড়াতাড়ি রাহুলকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়।

মাথার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, কাঁদছ কেন বাবা, কি হয়েছে?

মা-আমার মা—

কি হয়েছে?

সত্যিই মাকে তোমরা—তুমি আর বাবা বিষ দিয়ে মেরেছ মাসীমণি?

ছি বাবা, ওসব কথা বলতে নেই। মিথ্যে কথা।

তবে যে দাদু বলল একটু আগে!

দাদু কিছু জানে না।

জানে না?

না, তোমার মা অসুখে মারা গিয়েছে। অসুখে?

হ্যাঁ, চল—হাত মুখ ধুয়ে খাবে চল। তোমার জন্য আমি চিংড়িমাছের কাটলেট করে রেখেছি।

সত্যি?

আনন্দে রাহুলের চোখের মণি দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। ভিজে চোখে খুশির আলো।

হ্যাঁ–চল।

সেই দিনই রাত্রে। রাত্রি তখন বোধ করি দশটা হবে। পাড়াটা নিঝুম হয়ে এসেছে। মধ্যে মধ্যে কেবল একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।মিত্ৰাণী জেগে বসে ছিল। বসে বসে একটা বই পড়ছিল, আর মধ্যে মধ্যে বাড়ির পশ্চাতের বাগানের দিককার খোলা জানালা-পথে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাচ্ছিল। বইয়ের পাতায় যে তার মন নেই সেটা বোঝা যায়। রাহুল সামনের শয্যায় নিদ্রিত। ও-ঘর থেকে মধ্যে মধ্যে সুকান্তর ঘং ঘং কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কয়েক দিন থেকেই যেন কাশিটা বেড়েছে ওর। সুশান্ত সন্ধ্যের দিকে খবর পাঠিয়েছে রাত্রে সে আসবে না। সে কাজে জয়েন করার সঙ্গে-সঙ্গেই তার ডিউটি পড়েছে। গাড়ি নিয়ে সে লালগোলা গিয়েছে। আকাশটা বেশ পরিষ্কার। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। আকাশ-ভরা তারা। বারান্দায় টাঙানো ওয়াল-ক্লকটায় একসময় ঢং ঢং করে রাত এগারটা ঘোষিত হল, মিত্ৰাণী উঠে দাঁড়ায় হাতের বইটা পাশে রেখে। ড্রয়ার থেকে একটা মোমবাতি বের করে বাতিটা জ্বালায়। প্রজ্বলিত মোমবাতিটা বাগানের ধারের জানালাটার একেবারে মুখোমুখি আলমারির উপর বসায়।বাতির শিখাটা মৃদু মৃদু কাঁপছে হাওয়ায়। মিত্ৰাণী এসে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়ালো।