০৭. কিরীটীর আর জিজ্ঞাস্য

কিরীটীর আর জিজ্ঞাস্য বা জানার কিছু ছিল না সুকান্তর কাছে।

ওরা বের হয়ে এল অতঃপর ঘর থেকে।

চলুন অবনীবাবু।

বারান্দায় বের হতেই সুশান্তবাবুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সে এইমাত্র ফিরেছে বাজার থেকে বাজারের থলি হাতে।

রুক্ষ মলিন বিষণ্ণ চেহারা। মুখখানা শুকিয়ে গিয়েছে যেন দুদিনেই।

সুশান্তবাবু, নমস্কার। কিরীটী বলে।

নমস্কার।

আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা ছিল।

আপনারা বারান্দায় গিয়ে বসুন, আমি আসছি। সুশান্ত শান্তকণ্ঠে বলে।

ওরা বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে।

.

আকাশে মেঘ জমেছে। বেশ মেঘ।

চারিদিক কালো হয়ে এসেছে। বেশ জোরেই একপশলা বৃষ্টি নামবে বলে মনে হয়।

অবনী মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন, কিরীটীবাবু।

বলুন?

এখন আপনার কোন সন্দেহের আর অবশিষ্ট আছে?

কিসের বলুন তো?

যে ওরাই খুন করেছে শকুন্তলা দেবীকে?

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, না, এখনও আমি আপনার মতের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে পারছি না অবনীবাবু!

কেন? শুনলেন তো সুকান্তবাবুর কথাগুলো? কিছু একটা সেরকম ব্যাপার সত্যি সত্যি ভিতরে না থাকলে, বাপ কখনও তার ছেলের সম্পর্কে অমন রুড় রিমার্কস্ পাস করতে পারে?

অবনীবাবু, বয়স আপনার অল্প। সংসারে যে কত বিচিত্র মানুষ আছে, মানুষের মনে যে কত বিচিত্র সব দ্বন্দ্ব থাকে যদি জানতেন

কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না।

সুশান্ত চ্যাটার্জির পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

কিরীটী বললে, সুশান্তবাবু আসছেন, এসব আলোচনা এখন থাক।

সুশান্ত এসে ওদের সামনে দাঁড়াল।

 বসুন মিঃ চ্যাটার্জি। কিরীটীই বলল।

সুশান্ত একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

কিরীটীই প্রশ্ন করে, মিঃ চ্যাটার্জি।

বলুন?

একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার।

সুশান্ত কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চকিতে ওর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।

সুশাস্তুর দুচোখের দৃষ্টিতে একটা সংশয়, একটা ভীতির ছায়া পড়েছে যেন।

কাল আপনার স্ত্রীর—মানে মিসেস চ্যাটার্জির ময়না-তদন্তের রিপোর্ট আমরা পেয়েছি।

সুশান্ত চেয়ে আছে নিঃশব্দে কিরীটীর মুখের দিকে।

কিরীটী বলে চলে, রিপোর্ট কি বলছে জানেন?

কি?

ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্নটা উচ্চারিত হল যেন একটা অস্পষ্ট শব্দের মত।

আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ কোন বিষ—মানে পয়জন নয়।

তবে কি?

তাঁকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে?

কি বলছেন? কি করে মারা হরেছে!

শ্বাসরোধ করে তাঁকে কেউ হত্যা করেছে। নচেৎ–

না না, তা কি করে হয়? হাউ অ্যাবসার্ড!

তাই হয়েছে মিঃ চ্যাটার্জি। ব্যাপারটা সুইসাইড নয়, হোমিসাইড মার্ডার এবং শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

কিন্তু কে—কে করবে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা মিঃ রায়? আর কেনই বা করবে?

কেন করবে, কে করবে সে তো পরের কথা। আমাদের সেটা অনুসন্ধান করে বের করতে হবে। তবে যা ফ্যাক্ট-আমরা যতটা জানতে পেরেছি, যা সত্যি বলে ও সঙ্গত বলে মনে হচ্ছে আমাদের, তাই আপনাকে বলছি।

না, না-মিঃ রায়–

সুশান্তর দু-চোখের কোলে জল ভরে আসে-টলটল করতে থাকে জল। সে বললে, ঠিকই, এক এক সময় তার ইদানীংকার ব্যবহারে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। এমন কি মনে হয়েছে ওকে শেষ করে দিই, কিন্তু পরের মুহূর্তেই যখন মনে পড়েছে কি কষ্টটাই পাচ্ছে বেচারী ঐভাবে দিনের পর দিন শয্যাগত থেকে, তখনই সব রাগ আমার জল হয়ে গিয়েছে। জানেন মিঃ রায়, আজ সে নেই, আমার এগার বছরের সাথী এতদিন পঙ্গু হয়ে ঘরের মধ্যে ছিল, অসুস্থ ছিল—তবু ছিল। আজ দুদিন থেকে মনে হচ্ছে এ বাড়ি যেন আমার খালি হয়ে গিয়েছে।

দু-ফোটা চোখের জল আবার গড়িয়ে পড়ে সুশান্তর গাল বেয়ে।

সুশান্ত আবার বলে, এ বাড়িতে আমি যেন আর এক মুহূর্তও টিকতে পারছি না।

কিরীটী শাস্তকণ্ঠে বলে, তবু মিঃ চ্যাটার্জি, সত্য যা ফ্যাক্ট যা-তাকে তো অস্বীকার করা এখন যাবে না। কাজেই সর্বপ্রকার অনুসন্ধানই আমাদের চালাতে হবে-আর আপনিও নিশ্চয়ই চান, যে হত্যাকারী অমন নিষ্ঠুরভাবে আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেছে সে ধরা পড়ুক, তার যথোচিত শাস্তি হোক। শুনুন, যে প্রশ্নগুলো এবারে আমি করব তার জবাব দিন!

রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সুশান্ত বলে, বলুন।

সে রাত্রে, মানে যে রাত্রে মিসেস চ্যাটার্জি নিহত হন, সে রাত্রে রাত আড়াইটেয় আপনার ডিউটি শেষ হবার পর এবং এখানে এসেছেন ভোর সাড়ে পাঁচটায়—এই তিন ঘণ্টা সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

আপনাদের তো সে কথা আগেই বলেছি-বাড়ি ফিরিনি, রেস্টিং রুমে শুয়ে ছিলাম।

না! কিরীটী শান্ত গলায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।

কি বলছেন আপনি? প্রশ্নটা করে সুশান্ত চ্যাটার্জি তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে।

ঠিকই বলছি। ভাল করে মনে করে দেখুন। আপনি সত্যি কথা বলছেন না!

সত্যি কথা বলছি না?

না।

তবে সত্যিটা কি?

আপনি ঐ তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কোন এক সময় এখানে এসেছিলেন, এসে আবার ফিরে গিয়েছেন রেস্টিং রুমে।

এসেছিলাম—এসে ফিরে গিয়েছি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু কেন? কেন এসেই আবার ফিরে গিয়েছিলেন? বলুন, চুপ করে থেকে লাভ নেই মিঃ চ্যাটার্জি। আমি জানি আপনি এসেছিলেন এবং তার প্রমাণও আমার কাছে আছে জানবেন।

অকস্মাৎ যেন ভেঙে পড়ে সুশান্ত।

তার সমস্ত প্রতিবাদ অসহায় কান্নায় যেন আত্মসমর্পণ করল।

বললে, হ্যাঁ, আমি-আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ রায়, আমি এসেছিলাম—এসেছিলাম–

কিন্তু কেন-কেন? যদি এসেই ছিলেন তো আবার ফিরে গিয়েছিলেন কেন? বলুন, চুপ করে থাকবেন না, বলুন?

আ-আমি–

বলুন?

আমি—

আপনি নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রীর ঘরে ঢুকেছিলেন সে-রাত্রে।

হ্যাঁ ঢুকেছিলাম, কিন্তু তখন সে মৃত।

তবু তখন জানাননি কথাটা কাউকে কেন? বলুন কেন কথাটা চেপে গেলেন?

না, না-না-বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি কিছু জানি না। কুন্তকে আমি হত্যা করিনি।

কিন্তু তাহলে কেন ঢুকেছিলেন আপনার স্ত্রীর ঘরে? কেনই বা আবার ফিরে গিয়েছিলেন তাঁকে মৃত দেখেও? তা তো বললেন না এখনও?

সে-সে কথা আমি বলতে পারব না।

বলতে পারবেন না?

না।

বললে বোধ হয় ভাল করতেন মিঃ চ্যাটার্জি। নিদারুণ সন্দেহ থেকে আপনি নিষ্কৃতি পেতেন।