০৬. শকুন্তলার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট

শকুন্তলার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পরের দিন নয়, তার পরের দিন পাওয়া গেল।

শকুলার মৃত্যুর কারণ বিষ নয়, শ্বাসরোধ করে বিচিত্র এক কৌশলে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

অর্থাৎ শ্বাসরোধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

তার মুখের মধ্যে অবিশ্যি কিছুটা মালিশের ঔষধ পাওয়া গিয়েছে কিন্তু সেটা তার মৃত্যুর কারণ নয় বলেই ডাক্তারের মত।

তাঁর সন্দেহ সেটা সম্ভবত তার মৃত্যুর পর কৌশলে তার মুখ-গহ্বরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কিরীটী মৃদু শান্ত কণ্ঠে বললে, যাক, দুটো ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হলাম ১নং-শকুন্তলা আত্মহত্যা করেনি, কেসটা সুইসাইড নয়, কেসটা হোমিসাইড এবং ২নং-মৃত্যুর কারণ বিষ নয়, শ্বাসরোধে মৃত্যু। অতএব দেখা যাচ্ছে কেসটাকে হত্যাকারী একটা সুইসাইড প্রমাণ করবার জন্যই সম্ভবত ঐভাবে সাজিয়েছে।

অবনী সাহা বলেন, প্রথম থেকেই মনের মধ্যে ঐ সন্দেহটা আমার জেগেছিল।

ঠিক সন্দেহ করেছিলেন আপনি।

আর এও আমার সন্দেহ কিরীটীবাবু–

কি?

ঐ ওদের দুজনেই একজন হত্যাকারী-মার্ডারার।

মানে আপনি বলতে চান সুশান্তবাবু ও মিত্ৰাণী দেবীর মধ্যে কোন একজন?

হ্যাঁ। কেন, আপনারও তাই মনে হচ্ছে না এখন?

প্রশ্নটা করে অবনী সাহা কিরীটীর মুখের দিকে প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান।

হত্যাকারী একজন যে আছে সে বিষয়ে তো কোন সন্দেহই নেই সত্যি, তবে–

কিরীটী কথাটা যেন অসমাপ্ত রেখেই থেমে যায় মুহূর্তের জন্য। তারপর আবার বলে, কথা হচ্ছে এখনও কোন নির্ভরযোগ্য সত্যিকারের প্রমাণ ওদের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি।

আমার তো মনে হয় কিরীটীবাবু–

কি?

অবিলম্বে ওদের দুজনকে অ্যারেস্ট করে হাজতে পুরে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই ওরা ওদের অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হবে। আর কোন প্রমাণ সংগ্রহের প্রয়োজনই হবে না।

না, না-অবনীবাবু, অমন কাজ করবেন না। হত্যাকারী যদি সত্যিই ওরা হয়, তাহলে আপাততঃ ওরা কেউ যাতে কোনরকমে আমাদের সন্দেহমাত্রও না করতে পারে সেটাই সর্বাগ্রে দেখতে হবে।

কিন্তু তাতে করে যদি বিপরীত হয়?

কি হবে?

মানে বলছিলাম, যদি ওরা গা-ঢাকা দেয়?

দেবে না। আর দিলেই বা। আপনাদের চোখকে এড়িয়ে যেতে পারবে না।

কিরীটী মৃদু হাসে।

অবনী বলেন, তাহলে আপনি বলছেন ওদের অ্যারেস্ট করব না?

নিশ্চয়ই না। শুনুন, কাল সকালে আর একবার চলুন, ওদের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলে আসা যাক। মানে আরও কিছু প্রশ্ন ওদের আমি করতে চাই অবনীবাবু।

অবনী সাহা কিরীটীর যুক্তিটা তেমন করে মনের মধ্যে গ্রহণ করতে না পারলেও পরের দিন সকালের দিকে কিরীটীর সঙ্গে গিয়ে হাজির হন সুশান্তর কোয়াটারে।

গাড়িতে যেতে যেতেই একটা কথা বলেছিল কিরীটী, সেদিন আমাদের একটা ভুল হয়ে গিয়েছে অবনীবাবু।

ভুল?

হ্যাঁ।

কি রকম?

আপনি বলেছিলেন না, সুশান্তর বাবা বৃদ্ধ হাঁপানীর রোগী সুকান্ত ঐ বাড়িতেই থাকেন।

হ্যাঁ।

তাঁর সঙ্গে তোকই দেখা করিনি। এবং কোন্ ঘরে তিনি থাকেন সে ঘরটাও দেখা হয়নি।

আমি প্রথম দিন সুশান্তর বাবা সুকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা অবিশ্যি করেছিলাম।

করেছিলেন?

হুঁ। রান্নাঘরের পিছনে যে একটা ছোট ঘর আছে, ঘরটা ঠিক শকুন্তলা যে ঘরে থাকত তার লাগোয়া, সেই ঘরেই আছেন সুকান্তবাবু।

আজ একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করব।

বেশ তো।

.

ওরা যখন কোয়াটারে এসে পৌঁছাল বেলা তখন প্রায় পৌনে নটা।

সুশান্ত বাড়িতে ছিল না। বাজারে গিয়েছে। মিত্ৰাণীই ওদের সাড়া পেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল।

সুশান্তবাবু আছেন? কিরীটীই শুধায়।

না, তিনি তো বাজারে গিয়েছেন। মিত্ৰাণী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।

কখন ফিরবেন?

এখনই হয়ত ফিরবেন।

মিত্ৰাণীর চোখের দৃষ্টি ভূমিতলে নিবদ্ধ।

কতক্ষণ গিয়েছেন?

অনেকক্ষণ গিয়েছেন।

মিত্ৰাণী দেবী!

বলুন?

সুশান্তবাবুর বাবা এ বাড়িতে আছেন, না?

আছেন।

তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?

হ্যাঁ। একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছেন, চা খাচ্ছিলেন। আসুন।

চলুন।

যেতে যেতে কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, সুশান্তবাবুর ছেলে রাহুল কেমন আছে মিত্ৰাণী দেবী?

একটু ভাল। জ্বরটা সকাল থেকে আজ কমেছে।

ভুল বকছে না আর?

না। ভিতরের বারান্দার শকুন্তলার ঘরের পাশেই ছোট ঘরটা। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। সকলে গিয়ে দরজাটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।

ছোট অপরিসর ঘরটা। একটি মাত্র ছোট জানালা ও একটিমাত্র ছোট দরজা। জানালাটা খোলা থাকা সত্ত্বেও দেখা গেল ঘরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার বেশ। ঘরের বদ্ধ বাতাসে একটা রোগের ঔষধের মিশ্র কটু গন্ধ যেন।

ঘরের মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে গন্ধটা নাকে এসে ঝাপটা দেয়।

ঘরজোড়া একটা তক্তপোশ, তারই উপরে অযত্ন-মলিন শয্যায় এক বৃদ্ধ উবু হয়ে বসে শ্বাস টানছিলেন।

প্রাণপণে যেন বাতাস থেকে অক্সিজেন টানবার চেষ্টা করছেন। সামনের একটা টুলের উপরে কিছু ঔষধের শিশি। চায়ের কাপ, জলের গ্লাস আর তার মধ্যে একটা শূন্য পিতলের ফুলদানি। ভদ্রলোকের বয়েস সত্তরের ঊর্ধ্বে বলেই মনে হয়।

পরনে একটা মলিন হেঁড়া লুঙ্গি ও গায়ে একটা হেঁড়া ময়লা গেঞ্জি, তার উপর একটি মলিন বালাপোশ আলগাভাবে জড়ানো।

কঙ্কালসার দেহ।

পদশব্দে বৃদ্ধ সুকান্তবাবু মুখ তুলে তাকালেন, কে?

জবাব দিল মিত্ৰাণীই, তাওইমশাই, থানার দারোগাবাবু এসেছেন, আপনার সঙ্গে কি কথা বলতে চান।

কে?

অবনী বললেন, আমি থানা থেকে আসছি-ও-সি।

খনখনে বিরক্তিভরা কর্কশ গলায় সুকান্ত প্রশ্ন করলেন, কেন, আমার কাছে কি দরকারটা আবার আপনাদের?

আপনি সুশান্তবাবুর বাবা? কিরীটী শুধায়।

না, সৎ বাপ-স্টেপ ফাদার, বুঝলেন?

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন।

কিরীটী বুঝতে পারল বৃদ্ধের ঐ একটিমাত্র কথাতেই—যে কোন কারণেই হোক বৃদ্ধ বাপ পুত্রের প্রতি আদৌ সন্তুষ্ট নন।

বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, কি জন্যে এসেছেন, আর কেনই বা এসেছেন? বৌটা মালিশের ওষুধ খেয়ে মরেছে, আমিও তাই মরব একদিন। তারপর ওরা নিশ্চিন্ত হবে।

সুকান্তবাবু! কিরীটী ডাকে।

বাবু বলছেন কেন? দেখছেন না কি হালে আছি? বলুন চাকর!

সুশান্তবাবুই তো আপনার একমাত্র ছেলে?

নচেৎ এখানে এই নরক-যন্ত্রণার মধ্যে এমনি করে পড়ে থাকি আজও?

উনি বুঝি আপনার যত্ন নেন না? কিরীটী শুধায়।

যত্ন? দিন গুনছে কবে যাব! জানেন মশাই, মুখ বুজে পড়ে আছি-নচেৎ জানি না কী, বুঝি না কী দারোগাবাবু? সেদিন আপনাকে আমি বলিনি, বলতে সাহস পাইনি—ওরা দুটোতে মিলে নিশ্চয়ই আমার বৌমাকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছে!

এ আপনি কি বলছেন? কিরীটী বলে।

ঠিকই বলছি-ওরাই ওকে হত্যা করেছে। নচেৎ আমার মালিশের ওষুধটা ওর-বৌমার ঘরে গেল কি করে বলতে পারেন?

আপনার মালিশের ওষুধ?

হ্যাঁ হ্যাঁ, পরেরদিন দুপুরে খোঁজ করতে গিয়েই তো জানতে পারলাম, শিশিটা আমার টুলের উপরে নেই!

অবনীবাবু?

বলুন?

শিশিটা আছে না আপনার কাছে?

হ্যাঁ, থানায় আছে।

ওষুধের শিশির গায়ে লেবেলে কার নাম আছে দেখেছিলেন?

না।

আচ্ছা সুকান্তবাবু!

কি?

আপনার পুত্রবধূ তো আপনার এই ঘরের লাগোয়া ঘরটাতে থাকতেন, সে রাত্রে কোনরকম শব্দ-টদ কিছু শুনেছিলেন?

শুনব কি মশাই—যে ঝড়-জল-বৃষ্টি! জানালা দিয়ে জল আসছিল, চেঁচিয়ে গলা ফাটালাম, তাও কেউ এলো না। তবে আমি যা বলছি তার মধ্যে ভুল নেই জানবেন। ওরাই আমার সতীলক্ষ্মী বৌমাকে দুজনে ষড়যন্ত্র করে বিষ খাইয়ে মেরেছে।

বলতে বলতে বুড়ো কাশতে শুরু করেন।