প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৩

তিন

গড়িয়াহাট রোড ধরে গাড়িটা তখন উত্তরের দিকে চলেছে। সেই দক্ষিণ কলকাতায় ট্যাকসিতে ওঠবার পর থেকে মেয়েটি কেমন একটু অন্যমন্স্ক হয়ে সমানে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে। বপুটি আমার নেহাত শীর্ণ নয়। পেছনের সীটে তিনজন পাশাপাশি বসার জন্যে একটু ঘেঁষাঘেঁষিই হয়েছে। মেয়েটির সুগঠিত দেহের কিছু কিছু অংশের স্পর্শ এড়াবার তাতে উপায় নেই। দেহের সে স্পর্শ দিয়ে মনের কথা ত আর বোঝা যায় না। গেলে হয়ত তাতে খুশি হবার মত কিছু পেতাম না। পরাশর তার পরিবহন সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ সমাধান তার ঠিক মনঃপুত না হওয়ারই কথা। মেয়েটি থাকে সেই দমদমে সেখানে যাবার জন্যে নিজে থেকে সে মিনিবাসের খোঁজ করেছে। তার মানে তার আর্থিক সঙ্গতি তেমন যথেষ্ট নয় বলেই ত মনে হয়। পরাশর নিজে থেকে ট্যাকসি ডেকে তাকে পৌঁছে দেবার জন্যে সঙ্গী হওয়ায় মেয়েটির সে দিক দিয়ে এখন অবশ্য বিব্রত হতে হবে না, কিন্তু কোথায় সে থাকে তা জানাবার উৎসাহ তার নেই এমনও হতে পারে।

দমদমে কোথায় থাকবার আস্তানা সে পেয়েছে ত অবশ্য জানি না, তবে তার পোষাক-আশাক দেখে জায়গাটা ডেকে দেখাবার মত নয় বলেই ত মেন হয়।

ঠিক হিপিদের পর্যায়ে মেয়েটি পড়ে না বটে, কিন্তু হিপিরা যেখানে সেখানে যদি থাকতে পারে, মেয়েটির পক্ষে নিতান্ত সাধারণ কোনো আশ্রয়ে থাকা ত থাহলে অসম্ভব নয়। আপত্তি না করলেও তার সেই ঠিকানাটুকু বাধ্য হয়ে জানাতে হচ্ছে বলেই হয়ত মেয়েটির হঠাৎ এই মনমরা আনমনা ভাব। তাতে লোকসান অবশ্য আমাদেরই। আমাদেরই মানে আসলে পরাশরেরই। এতক্ষণ একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়ে পরিচয়টা গভীর করা পরাশরের আর হয়ে উঠল না। মেয়েটির থাকবার জায়গাটা সে দেখে আসবে বটে, কিন্তু গোড়াতেই এমনভাবে সুর কেটে যাবার পর আবার নতুন করে জমানো আর কিছু না হোক সহজ নিশ্চয় হবে ন। এ ব্যাপারে বন্ধু হিসেবে আমিই বা কি করতে পারি ভেবে পেলাম না। গায়ে পড়ে আলাপ যে না করা যায় তা নয়। তাতে আমাকে বেশ খেলো হতে হলেও বন্ধুর খাতিরে তা আমি হতে প্রস্তুত। কিন্তু আলাপটা শুরু করব কি নিয়ে? পরাশরের মত পুরাতত্ত্ব কি ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে ছিটেফোঁটা জানাশোনা থাকলেও তাই নিয়ে আলাপটা শুরু করতে পারতাম। কিন্তু এসব বিষয়ে আমার যা বিদ্যে তাতে দন্তস্ফুট করলে শুধু হাসির খোরাকই যোগাবে। আলাপ শুরু করার ও পথ সুতরাং বন্ধ। মেয়েটি বলেছে সে আর্জেণ্টিনার মেয়ে। ঐ আর্জেণ্টিনা দিয়েই কথাটা শুরু করব নাকি? আর্জেণ্টিনা সম্বন্ধেও বেশী কিছু যে জানি তা নয়, তবে তার রাজধানীর নামটা আর দু-একটা খবর জানা আছে। তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ব বলে একটু নড়েচড়ে বসতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম। প্রথমে নিজের কানটাকে বিশ্বাস করতেই একটু বাধল। তারপর বিস্ময়ের আর শেষ রইল না। যা শুনছি তা মিথ্যে নয়। মেয়েটিই নিজে থেকে কথা বলছে আর ক্ষোভ কি বিরক্তি নয় বেশ একটু কৌতুক মেশানো গলায়।
“কৃত্তিবাসবাবুর বড় বেশী শাস্তি হচ্ছে বুঝতে পারছি।”
মেয়েটি শুধু নিজে থেকে কথাই বলে নি, আমার নামটাও ঠিক মত উচ্চারন করে টিপ্পনী করেছে।
নামটা সেই একবার পরাশর বলেছিল ট্যাকসিতে ওঠবার সময়। তাতেই এতক্ষণ মনে রাখাই ত যথেষ্ট। তার ওপর ঐ কৌতুকের সুরটুকু।

এরপর আর আমায় পায় কে? অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে নামটাম সবই বার করে ফেললাম। মেয়েটির নাম এলসা। আর্জের্ণ্টিনায় বাড়ি। সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে ভারতবর্ষের গুপ্তযুগের কয়েকজন বৌদ্ধ আচার্য পণ্ডিতদের সব্মন্ধে গবেষণা করে থিসিস লিখতে এখানে এসেছে। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের কয়েকটি জায়গায় ঘুরে সেখানকার কাজ শেষ করেছে। এখন বাংলাদেশের কাজই তার বাকি। এখানকার কাজ শেষ করতে নানা কারণে দেরী হচ্ছে। তবু আশা করছে, সপ্তাহ দু-একের মধ্যেই কাজ শেষ কের ফিরে যেতে পারবে। এলসার পরিচয় যেতুকু পেলাম তা এমন কিছু নতুন কি আশ্চর্য নয়। আজকালকার দিন বিদেশ থেকে যে সব ছেলে মেয়ে ভারতবর্ষে পড়তে শুনতে কি বেড়িয়ে যেতে আসে তাদের অনেকের কাহিনীই এই ধরণের।

কিন্তু এরপর যা জানলাম তা সত্যই চমকে একেবারে বিমূঢ় করবার মত। ট্যাকসি এরোড্রোমের রাস্তায় অনেক দূর তখন চলে এসেছে। ড্রাইভার টার্মিন্যালের দিকেই গাড়ি চালাতে যাচ্ছিল, হঠাৎ এলসা বারণ করে বললে, “না, ওদিকে নয়।” ওদিকে নয় তা আগেই জানতাম, কিন্তু সত্যিই যাবে কোথায়? এরোড্রোমের এলাকা ছাড়লে অবশ্য কিছু বাগানবাড়ি গোছের কলকাতার সম্পন্ন মানুষের বিশ্রামকুঞ্জ গোছের আছে। তারই একটিতে আশ্রয় যোগাড় করেছে নাকি এলসা? না, সে রকম কোথাও নয়। নিজেই নির্দেশ দিয়ে এলসা যেখানে ট্যাকসি নিয়ে গিয়ে থামলে তার সামনের দোকানটা দেখে আমার অন্ততঃ চক্ষুস্থির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *