০৮. মাহজাবীন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে

বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাহজাবীন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। এক মুহূর্ত বাড়িতে ভালো লাগে না তার। আবার ইয়াসমিনের মতো তার পছন্দটা অস্পষ্ট নয়। ইয়াসমিন চায় বন্ধনহীন জীবন, শাসন নেই, বাবা-মা, এমনকি স্বামীরও নয়। বিয়ের কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। তবে, কাউকে ভালো লাগলে তার সঙ্গে বাস করতে আপত্তি নেই তার। তেমন ভালো লেগেছে, এখনো কেউ নেই অবশ্য! ইয়াসমিন ভালোবাসে গান, বন্ধুত্ব, পায়ে হেঁটে ভ্রমণ, যাযাবরের মতো খোলা আকাশের নিচে রাতবাস। জীবিকার জন্যে লেখাপড়াকে ঘৃণা করে, বিয়ের। জন্যে নিজেকে বড় করে তোলা তার কাছে কুসংস্কার বলে বোধ হয়। জীবিকা উপার্জনের একটা ধারণা তার আছে। সে কাঠমিস্ত্রি হবে এবং কেবল জানালাই বানাবে। তার মাথায় নতুন নতুন ডিজাইনের জানালা ঘোরে। নিজেকে সে কল্পনা করে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান জানালা নির্মাতা হিসেবে।

আর মাহজাবীন চায় যত শিগগির সম্ভব, সময়কে ঠেসে খাটো করে হলেও, ষোল বছর অতিক্রম করতে। তারপর সে বেরুবার স্বাধীনতা আদায় করে নেবে। বাবা মায়ের কাছ থেকে সে স্বাধীনতা না পাওয়া গেলে বিপ্লবী যেমন দেশত্যাগ করে, সে গৃহত্যাগ করবে। সে ডাক্তারের কাছে গিয়ে মাসের একুশ বড়ি ব্যবহার করবার ব্যবস্থা নেবে। তারপর কিছুদিন ছেলেদের সঙ্গে তারিখ করবে, হল্লা করবে, নাচ করবে, ছেলের গাড়িতে শেষরাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াবে, ছুটির দিনে দূরদূরান্তে যাবে, একদিন বাগদত্তা হবে, বিয়ে হবে, মাহজাবীনের নিজের সংসার হবে। সে পরিষ্কার জানে, রাড়ি থেকে এর কোনোটিই সম্ভব নয়। এমনকি তুচ্ছ সিগারেট পর্যন্ত সে খেতে পারবে না। তাই যতদিন তার মোল বছর না হচ্ছে, চমৎকার অভিনয় করে যাচ্ছে বাড়িতে। সিদ্ধান্ত করে অভিনয় নয়, একটু একটু করে সহজভাবে সে এই কৌশলটি অবলম্বন করেছে।

বেরিয়ে সে চন্দনার বাড়ির কাছাকাছি যায়। চন্দনার কথাটা তখন মনে এসে ভালোই হয়েছে। বরং ওকে নিয়েই ইয়াসমিনের কাছে যাওয়া যাবে। অলবানি স্ট্রীট টিউব স্টেশনের একেবারে কাছে।

পথে লাইব্রেরি পড়ে। বই দুটো চট করে ফিরিয়ে দেয় মাহজাবীন। ফুটপাতে লাল টেলিফোনের বাক্সে ঢোকে। চন্দনাকে ফোন করে দেখে নেয়া দরকার, বাড়িতে আছে কিনা।

ফোন করতে ঢুকে, প্রথমে সে কাঁধের ঝুলি থেকে সিগারেট বের করে। নিপুণ হাতে ধরিয়ে লম্বা একটা টান দেয়। মাথাটা বেশ হাল্কা আর শরীরটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে ওঠে তার।

চন্দা?

বীন?

হাঁ, বীন বলিতেছি। বাড়িতে আছ?

আছি।

তোমার পিতা মাতা?

তাহারা কাজে গিয়াছে। আটটায় ডিউটি শেষ হইবে। তুমি কোথায়?

নিকটেই। আসিতেছি।

চন্দা পৌঁলের বাবা-মা দুজনেই লন্ডন ট্রান্সপোর্ট বাসে কাজ করে, চন্দনা তাদের একমাত্র মেয়ে। ভালোই হলো, খালি বাড়িতে বসে মনের সুখে সিগারেট খাওয়া যাবে।

মিনিট খানেকের ভেতরেই মাহজাবীন পৌঁছে যায়। দরোজা খুলে দিয়েই দুই বন্ধু হেসে গড়িয়ে পড়ে। ঐ বয়সে এভাবেই হাসি পায়; এর বিশেষ কোনো কারণ থাকে না।

ভেতরে ঢুকে মাহজাবীন ব্যাগটা ধপ করে নামিয়ে রেখে সোফার ওপর দুপা তুলে জোড়াসন হয়ে বসে। নিজে আরেকটা সিগারেট ধরায়, চন্দনাকে দেয়।

না, ধন্যবাদ। আমি এই মাত্র একটি শেষ করিয়াছি।

একগাল ধোঁয়া ছেড়ে মাহজাবীন বয়সের তুলনায় বেশি সাবালক স্বরে বলে, ইহা কি সম্ভব?

কী?

পানীয় যাহাই হউক।

আমি চেষ্টা করিব।

চন্দনা কার্পেটের ওপর, মাহজাবীনের পায়ের কাছে বসেছিল। উঠে দাঁড়ায়। ড্রিংকস ক্যাবিনেটের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলে, ড্যাডি চাবি দিয়া যায়।

তোমার চাবি নাই?

তাহা তোমাকে বলিব কেন?

মাহজাবীন সপ্রশংস দৃষ্টিতে চন্দনার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ঈর্ষাও হয় তার। এই চন্দনা কী সুখে আছে! তার বাবা-মা একসঙ্গে কাজে বেরিয়ে গেছে। সারা বাড়িতে সে এখন একা। যা খুশি কর। তার বাবার আপিস বাড়ির মধ্যে। হতভাগ্য আর কাকে বলে! চন্দনা তো ইচ্ছে করলে বালক-বন্ধুকেও নিমন্ত্রণ করতে পারে। কী সৌভাগ্য!

চন্দনা বলে, তুমি এদিকে দেখিও না। ক্যাবিনেট খুলিতেছি।

ক্যাবিনেটটা দেহ দিয়ে আড়াল করে চন্দনা কী এক কৌশলে মুহূর্তের ভেতরে খুলে ফেলে।

কী পান করিবে? চাহিয়া দ্যাখো। তবে সামান্য দিতে পারিব, নহিলে ড্যাডি সন্দেহ করিবেন। মারধোর করিবেন।

মারধোর করেন?

হাঁ, প্রায়ই।

মাহজাবীনের চিত্ত লঘু হয়ে যায়। যাক, তাহলে ততটা সুখে চন্দনা নেই। অন্তত তার বাবা। গায়ে হাত তোলে না। সে উঠে এসে ক্যাবিনেটের ভেতরে সাজানো সারি দেওয়া। বোতলগুলোর দিকে পরীক্ষামূলক দৃষ্টিপাত করে। ঐ গেঁথে রাখে। তারপর বলে, সময় সংকীর্ণ। বেশিক্ষণ থাকিতে পারি না। আমাকে ভোদকার সহিত অনেকখানি লাইম। মিশাইয়া দাও।

শিস দেয় চন্দনা। বলে, কার কাছে শিখিয়াছ?

জন।

তারিখ করিয়াছিলে?

উহাকে ততটা পছন্দ করি না। আমাকে চুম্বন করিয়াছিল। জিহ্বা প্রবেশ করাইয়া দিয়াছিল। আমি তাহা রুঢ় মনে করিয়াছিলাম। আর বাহির হই নাই।

দুজনেই সুরা নেয়। মাহজাবীন আবার সোফায় গিয়ে জোড়াসন হয়ে বসে। আবার সে সিগারেট ধরায়। চন্দনা কার্পেটের ওপর, পায়ের কাছে বসে। মুখোমুখি হয়ে।

একের পর এক সিগারেট ধরাইতেছ?

হাঁ, একটি জোড়ের ভেতরে বর্তমানে আছি।

কী ব্যাপার। সঙ্গে একটি ভারি ব্যাগও দেখিতেছি। কী আছে উহাতে?

ইয়াসমিনের কাপড় পৌঁছাইয়া দিতে হইবে।

বুঝিলাম না।

ইয়াসমিন বাড়ি ছাড়িয়াছে। আজ কন্যা দেখিবার জন্য এক ষাঁড়ের আসিবার কথা! ইহা ব্যতীত পথ ছিল না।

আবার শিস দেয় চন্দনা। জিগ্যেস করে, বাড়ির পরিস্থিতি কী?

মাম কাঁদিতেছে। ড্যাডি কাঁদিতেছে। উহারা বুঝে না। উহারা বাঙালিই রহিয়া গেল। আজ শুনিতেছিলাম আমাদের কোরান পড়াইবার কথা হইতেছে। উহারা কোরানকে সার্ফ সাবানের গুঁড়াতুল্য জ্ঞান করে। সমস্ত নির্মল বিশুদ্ধ হইয়া যাইবে।

লম্বা একটা চুমুক দেয় গেলাশে মাহজাবীন। তালু জিভেয় টক করে শব্দ তুলে বলে, লাইম বেশি দিয়াছ। আমি কিঞ্চিত ভোদকা ঢালিয়া লই।

চন্দনা বলে, ইয়াসমিনকে দোষ দিই না। সে উত্তম করিয়াছে। আমারও হয়তো বিপদে পড়িতে হইবে। কিন্তু আমি বাড়ি ছাড়িতে পারিব না।

কেন পারিবে না?

আমার সাহস হয় না। এই জন্যই আমার মৃত্যু হইবে। মহিষের মতো গন্ধযুক্ত কোনো অজানা ব্যক্তিকে গ্রহণ করিতে হইবে। না, আমি আর ভাবিতে পারিতেছি না।

এত সুযোগ থাকিতেও তুমি এত ভীতু, অবাক হইতেছি।

দুঃখিত স্বরে চন্দনা বলে, ড্যাডি আমাকে খুন করিতেও দ্বিধা করিবে না।

মাহজাবীনের ভাবনা হয়। চন্দনার জন্যে নয়, এত যার ভয়, তাকে নিয়ে অলবানি স্ট্রীটে যাওয়া বোধহয় আর হবে না। একা যাওয়া সে ভালো মনে করে না। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রেরণায় সে কিছুক্ষণ থেকেই টের পাচ্ছে যে, ইয়াসমিনের অনুপস্থিতির প্রথম দিনে তার নিজের দীর্ঘক্ষণ একা বাইরে থাকাটা গোলমেলে হয়ে দেখা দিতে পারে। বাড়িতে কিছুক্ষণের ভেতরেই খোঁজ পড়বে। চন্দনা থাকলে, তাকে নিয়ে না হয় একসঙ্গে বাড়ি ফেরা যেত, মাকে বলা যেত— দুজনে ইলিং ব্রডওয়ের বিপণী বিতান ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।

মুশকিলের কথা।

মাহজাবীন নিজের পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্যটি করলেও চন্দনা সেটাকে তারই ওপর মন্তব্য বলে ধরে নেয় এবং বন্ধুর প্রতি আরো অন্তরঙ্গতা বোধ করে। চন্দনা বলে, তুমি আর খানিকটা পানীয় লও?

না।

বিপদ অবশ্য আসিয়া পড়িলে আমি শেষ চেষ্টা করিব। ততদিনে কোনো বালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তাহার সহিত পালাইয়া যাইব।

মাহজাবীন অন্য কথা ভাবছে। সে বলে, চন্দনা, ভাবিয়াছিলাম তোমাকে লইয়া বাহির হইব।

তা থাক। আমাকে শীঘ্র বাড়ি ফিরিতে হইবে। তুমি একটা কাজ করিবে?

কী কাজ?

ইয়াসমিনের এই ব্যাগ লইয়া বাড়িতে ফিরিয়া যাইতে পারিব না। ড্যাডি হয়তো ফিরিয়া আসিয়াছে। চোখে পড়িলে ওয়াটারগেট হইয়া যাইবে। ব্যাগটি তুমি রাখিবে?

হাঁ, রাখিব।

পরে লইয়া যাইব।

যখন খুশি লইও। ইয়াসমিন কোথায় আছে?

অলবানি স্ট্রীটে, সে অনেক দূর। অক্সফোর্ড স্ট্রীটের নিকটবর্তী।

বালকবন্ধুর সহিত আছে?

না, আমি যতদূর জানি, তাহার কেহ নাই। ইয়াসমিন স্বপ্নজগতে বাস করে। সেই জগত স্বভাবতই নিঃসঙ্গ। সহসা সঙ্গী জুটে না। না, আমার মনে হয় না, ইয়াসমিনের দৃঢ় কোনো বালকবন্ধু আছে।

চন্দনা উঠে দাঁড়ায়। নিঃশ্বাস ফেলে বলে, চলিলে?

হাঁ। দাঁড়াও, আরেকটি সিগারেট শেষ করিয়া লই। বাড়িতে ঢুকিলে তো আর সম্ভব হইবে না।

আমাকে দুইটি ধার দাও। আমার ফুরাইয়া গিয়াছে। ড্যাডির পকেট হইতে একটির বেশি সংগ্রহ করিতে পারি নাই।

মাহজাবীন তাকে ব্যাগ রাখবার পুরস্কার হিসেবে গোটা প্যাকেটটাই দিয়ে দেয়। ব্যাগটি লুকাইয়া রাখিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *