০৩. ইয়াসমিন চা নিয়ে আপিস ঘরে এলো না

অনেকক্ষণ পরেও যখন ইয়াসমিন চা নিয়ে আপিস ঘরে এলো না, মিস্টার আলি বিরক্ত বোধ করেন। মেয়েটির কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই বাবা-মায়ের জন্য। বয়স সতের পুরো হয় নি, লেখাপড়া শেষ হয় নি, খাওয়া-পরা-জামা-কাপড়ের জন্য এখনো নির্ভরশীল, অথচ চলন দেখলে মনে হবে, কোনো এক অধিকার বলে বাবা মায়ের কাছ থেকে কর আদায় করে চলেছে, বাবা-মাকেই তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।

আলি পেছনের দরোজার দিকে একবার তাকাল। দরোজার ওপারেই সিঁড়ি। সিঁড়িতে এখনো কোনো পায়ের শব্দ নেই।

যে বাঙালটি তাকে ফাঁকি দিয়েছে, মিস্টার খানকে ব্যবসা দিয়েছে, তার জিনিসের খসড়া তালিকা টেবিলে কাগজপত্রের ওপরেই পড়ে ছিল। আলি এখন সেটা নিয়ে ফাস করে ছিঁড়ে ফেলেন। বাঙালিদের দেশপ্রেম সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়ে, মনে মনে গোটা বাংলাদেশেরই ভবিষ্যত অভিশপ্ত বলে স্থির করেন।

তালিকাটি ছিঁড়ে ফেলবার পর দ্বিতীয় যে কাগজটি সমুখে মেলে থাকে, তাতে সব বড় হাতের অক্ষরে লেখা মি. বজলুল করিম, লন্ডন-ঢাকা-লন্ডন, আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে যে-কোনো দিন। প্রথমে মনে পড়ে না। তারপর হঠাৎ লক্ষ হয়। ভদ্রলোক আজই আসবেন টিকিট নিতে। দেশে যাচ্ছেন। আলি তালিকাভুক্ত এজন্ট নন বলে তাকে নগদ টাকায় বিমান-আপিস থেকে টিকিট এনে খদ্দেরকে দিতে হয়। মিস্টার করিমের টিকিট এখনো আনা হয় নি। ভদ্রলোক বিকেলেই এসে হাজির হবেন। ঘড়ি দেখেন আলি। বিকেলে ডাঃ ভাইয়ান আসবে, কখন আসবে ঠিক নেই, ম্যানচেস্টার থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছে। টিকিট আনতে হলে এখন বেরুনোই ভাল। তিনি কি একবার ওপরে যাবেন? নাহারকে বলবেন। আপিস লক্ষ রাখতে? অজুহাতটা ভালো লাগে তার। ইয়াসমিন আসতে দেরি করছে কেন, ওপরে গিয়ে সেটাও যাচাই করা যাবে।

আলি উঠতে যাবেন, পেছনে শব্দ পাওয়া গেল।

নাহার।

জিজ্ঞাসু চোখে তিনি স্ত্রীর দিকে তাকান। প্রশ্নটা এই, ইয়াসমিনের না চা নিয়ে আসবার কথা?

নাহারকে ইতস্তত করতে দেখে আলির মাথায় রক্ত চড়ে যায়। মেয়েটি নিশ্চয়ই বিয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছে। তাই নিচে নামে নি।

ইয়াসমিন কই?

আলি প্রায় সব সময়ই মেয়েদের পুরো নাম ধরে ডাকেন। এখন তো ভেতরে ভেতরে ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন।

তুমি না বললে তাকে পাঠিয়ে দেবে?

সে নেই।

নেই?

মানে বাড়িতে নেই।

বাড়িতে নেই মানে কী? বাড়িতে থাকবে না কেন? এই ভোরে ভোরে আবার কোথায় গেছে?

বোধহয় সে বাড়িতেই ফেরে নি।

চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কথাটার অর্থ মর্মে প্রবেশ করে। নেতানো গলায় প্রতিধ্বনি করেন তখন, বাড়িতে ফেরে নি।

মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন আলি। তারপর ধীরে ধীরে চোখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকান। মুহূর্তের জন্যে নাহারকেও তার অচেনা মনে হয়।

নাহার প্রস্তুত হয়ে থাকে স্বামীর যে-কোনো অভিযোগ, যে-কোনো চিৎকার শুনবার জন্যে।

সে জানে এক্ষুণি তিনি সমস্ত দোষ তাকেই দেবেন।

তার বদলে আলি দুঃখিত গলায় উচ্চারণ করেন, কোনো দিন তো এ রকম করে নি।

মেয়ের কুশলের চেয়ে পারিবারিক মর্যাদাহানীর আতংক আলির মাথায় বড় হয়ে থাকে। এবং ক্রমশ তা আরো বড় হয়।

এর অর্থ ভেবে দেখছ?

আমিও তো ভাবি নি, মিনা এ বলবে।

হঠাৎ দ্রুত পায়ে আলি উঠে দাঁড়ান। সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে চলে যান। ল্যন্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে ডাকেন, মাহজাবীন।

সঙ্গে সঙ্গে সে বেরিয়ে আসে। আপাদমস্তক তাকে একবার দেখে নেন আলি। মেয়েটি এখনো রাতের শোবার পোশাক ছাড়ে নি। বুকের কাছে বোতামটা লাগিয়ে সে নীরবে অপেক্ষা করে।

আলি সরাসরি প্রশ্ন করে, ইয়াসমিন কোথায় বলিতে পার?

মাহজাবীন মাথা নাড়ে।

আমার সহিত আইস।

নিজের শোবার ঘরে আলি ঢুকে যান। মাহজাবীন তবু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে যায়।

আসন লও।

মাহজাবীন কতটা ভয় পেয়েছে বলা যায় না। বড় বড় চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে সে বসে পড়ে। বসবার পরও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় না।

আলি কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে বলেন, আমার ধারণা তুমি মিথ্যা কথা বলিতেছ।

চমকে মাহজাবীন বাবার দিকে তাকায়।

মিথ্যা নহে।

লুকাইও না। তোমরা শিশু। তোমরা ভবিষ্যত জান না। তোমাদের ভালোর জন্যেই বলিতেছি। আমাকে বল, ইয়াসমিন কোথায় গিয়াছে?

আমাকে বলে নাই।

সত্য?

সত্য বলিতেছি।

মাহজাবীনের দিকে আবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকান আলি। পনের বছরের এই মেয়েটির পক্ষে পরিষ্কার মিথ্যে কথা বলা সম্ভব কিনা, তাও বাবার জেরার মুখে, মনে মনে আলি আন্দোলন করেন। এবং শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হন, মাহজাবীন মিথ্যে কথাই বলছে।

মাহজাবীন আমার দিকে তাকাও।

মেয়েটি চোখ তুলে পরক্ষণেই নামিয়ে নেয়।

আমার বিশ্বাস, ইয়াসমিন হইতে তুমি ভিন্ন। তুমি তাহার মতো নও। পিতামাতাকে তুমি শ্রদ্ধা কর, বাঙালি মেয়ের শালীনতাবোধ তোমার আচরণে আমি লক্ষ করিয়াছি। তুমি কি বুঝিতে পারিতেছ না, তোমার ভগ্নি আমাদের প্রত্যেকের মুখে চুনকালি মাখাইয়া দিতে অগ্রসর হইয়াছে?

মাহজাবীন চুপ করে থাকে।

তুই নিশ্চয় জানিস, ইয়াসমিন কেথায়? বল আমাকে, তোকে না বললেও, তুই নিশ্চয়ই কখনো কিছু শুনেছিস। একদিন হঠাৎ এ রকম কেউ করে না। বল আমাকে, কিছু মনে পড়ে তোর?

মাহজাবীন অন্তত এটুকু খুশি হয় যে, বাবা মনে মনে তার বিরুদ্ধে মিথ্যে বলার অভিযোগটা তুলেই নিয়েছেন। নইলে এভাবে এখন মিনতি করতেন না।

মেয়ের পাশে এসে বসেন আলি।

কিছু কি মনে পড়িতেছে?

না ড্যাডি।

কিছুই কি মনে পড়ে না? ফোনে কোনো আলাপ? পত্র? অথবা, তাহার এমন কোনো বন্ধু  এইরূপ বুদ্ধি জোগাইতে পারে?

বন্ধুর উল্লেখ করে নিজেই শিউরে ওঠেন আলি। তিনি একাধিক ইংরেজ তরুণের কণ্ঠ মনে করতে পারেন, যারা টেলিফোনে ইয়াসমিনের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। বাড়ির টেলিফোনই আপিসের বলে, তিনি মেয়েদের কাউকে খুব বেশি ফোন ব্যবহার করতে দিতেন না। আলি জানেন, নির্দেশটা মেয়েদের বন্ধুরাও নিশ্চয়ই জানে। তা সত্ত্বেও যখন ফোন আসে, তখন খুব দরকারেই আসে, তা বোঝা শক্ত নয়। সেই দরকারটা কী? এমন কিছু যা তিনি জানতে পারেন নি কখনো।

মাহজাবীন?

আমি কিছুই স্মরণ করিতে পারিতেছি না?

গুরুত্ব উপলব্ধি কর?

হাঁ, ড্যাডি?

সমাজে মুখ দেখাইতে পারিবে?

না, ড্যাডি?

মাহজাবীন নিজেই খুশি হয়ে যায় উত্তরটা সাবলীলভাবে দিতে পারবার কৃতিত্বে। সমাজের উল্লেখে মাহজাবীনের সমুখে বাঙালি কিছু দম্পতির চেহারা ভেসে ওঠে, যারা, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, পাউন্ড জমায়, আনন্দ করে না, গান শোনে না, কারি রান্না করে, আঞ্চলিক বাংলা বলে যার অধিকাংশই তার বোধগম্য হয় না এবং যে-কোনো বাড়িতে গিয়ে বাড়ির দাম কতটা বাড়ল, কেথায় সুলভে কী পাওয়া যাচ্ছে, নতুন সামগ্রীটি কবে কত দামে কেনা হলো, এ আলোচনায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দুপুররাতে ঢেকুর তুলে বাড়ি ফেরে। এদের কাছে মুখ দেখাতে না পারল তো বয়েই গেল তার।

মনের ভেতরে খিকখিক করে হাসে মাহজাবীন। বোধহয় তার কিছুটা চোখে মুখে প্রকাশ পেয়ে থাকবে।

আলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, তুমি এখনো শিশু। তুমি উপলব্ধি করিতে পারিবে না। ইয়াসমিন আমাকে সাগরে নিমজ্জিত করিল। ডাক্তার আসিলে তাহাকেই বা কী বলিব? যথাসম্ভব করুণ ও দুঃখিত চেহারা তুলে মাহজাবীন বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *