১৯. নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম

নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম—আমি, হিরণ্ময়ী দেবী, হরবিলাস, কুমারেশ, রাণু, কবিতা গুহ ও ঘোষাল। এবং ঘোষাল সাহেবের অনুরোধেই কিরীটী নিরালা ও সীতার হত্যা-রহস্য সবিস্তারে বর্ণনা করল পরের দিন।

খেয়ালী শিল্পী রণধীর চৌধুরীর নিজের কন্যা বনলতা অধ্যাপক শ্যামাচরণ সরকারকে তাঁর অমতে ভালবেসে অসবর্ণ বিবাহ করায় ত্যাগ করলেও কন্যাকে তিনি কোন দিনই ভুলতে পারেননি এবং যদিও কন্যার জীবিতকালে কন্যা বনলতার কোন দিন মুখদর্শন করেননি, কন্যার মৃত্যুর পর ও নিজের মৃত্যুর পূর্বে বোধ হয় পিতার মনে অনুশোচনা এসেছিল। ফলে তাঁর সত্যিকারের যে সম্পদ ছিল, কতকগুলো বহু মূল্যবান জুয়েল, সেগুলো তাঁরই হাতে অঙ্কিত প্রপিতামহের অয়েল-পেন্টিংটার ফ্রেমের মধ্যে কৌশলে ভরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো তাঁর মৃতা কন্যার একমাত্র পুত্র কুমারেশবাবুকেই দিয়ে যান উইল করে। অবশ্য শিল্পীর খেয়ালী মন তাঁর, তাই উইলটাকে একটা বিচিত্র চিঠির মত করে রেখে গিয়েছিলেন এবং তার একটি কপি নিরালার সিন্দুকে রেখে অন্য একটি কপি ডাকে কুমারেশের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে অবশ্য একটা কথা উঠতে পারে, জুয়েলগুলো কুমারেশবাবুকেই যদি তাঁর দেবার ইচ্ছে ছিল—খোলাখুলিভাবেই তো একটা চিঠিতে সেকথা কুমারেশবাবুকে জানিয়ে যেতে পারতেন বা দিয়ে যেতে পারতেন। তবু, যে কেন তা না করে অমন একটা কৌতুক করে রেখে গিয়েছিলেন তা তিনিই জানতেন। তবে মনে হয়, এও তাঁর খেয়ালী মনের একটা বিচিত্র খেয়াল ভিন্ন কিছু নয়। যা হোক, রণধীর চৌধুরীর মৃত্যুর পর শতদলবাবু এখানে নিরালায় এসে ঐ চিঠির সরল মানে অনুযায়ীই সমস্ত সম্পত্তি নিজের হাতে নেন। চিঠিটার অপ্রকাশ্য সাংকেতিক অর্থটা তিনি প্রথমে ধরতে পারেননি। তারপর হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে যখন সম্পত্তির ব্যাপার নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়, তখন হয়তো হিরণ্ময়ী দেবীকে শতদল ঐ চিঠিটা দেখায়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী হিরণ্ময়ী দেবী চিঠিটা পড়ে মনে মনে সন্দেহযুক্ত হয়ে ওঠেন। এবং খুব সম্ভবত ঐ চিঠিটার কথা ভাবতে ভাবতে কোন এক মুহূর্তে চিঠির সাংকেতিক রহস্যটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এবং তিনি কোন সময়ে হয়তো শতদলকে কিছু বলেন। এই গেল প্রথম পর্ব বা অধ্যায়। এবারে আসব আমি রহস্যের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। শতদল যে মুহূর্তে জানতে পারলে চিঠির আসল রহস্য, মনে মনে তার প্ল্যান ঠিক করে নিল। হরবিলাসের নামে বেনাম চিঠি দিয়ে ভুখনার সাহায্যে প্রথমেই কুমারেশবাবুকে এনে নিরালার বাগানের মধ্যে secluded outhouse-এ বন্দী করে ধীরে ধীরে মরফিয়ায় addict করে তুলতে লাগল ও সেই সঙ্গে অপর্যাপ্ত আহার দিয়ে দুর্বল করে ফেলতে লাগল। তার ইচ্ছা ছিল হয়তো চট করে কুমারেশকে হত্যা না করে ধীরে ধীরে তাকে morphiaর নেশা ধরিয়ে cripple করে ফেলবে এবং পরে হয়তো প্রয়োজনমত সুযোগ বুঝে একেবারে শেষ করে ফেলতেও কষ্ট পেতে হবে না। দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই তার প্রথম খেলা। দ্বিতীয় খেলা শুরু হল হরবিলাস ও হিরণ্ময়ী দেবীর উপরে সন্দেহ জাগিয়ে তুলতে তাঁদেরও নিজের পথ থেকে সরানো। ঘটনাচক্রে এই সময় আমি ও সুব্রত এখানে এলাম এবং এখানকার স্থানীয় সংবাদপত্রে আমার এখানে আগমনের সংবাদ পেয়ে আমাকেও এই ঘটনার মধ্যে টেনে এনে নিজেকে আরও safe করবার মতলব করলে। আমার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও সংবাদপত্রের মারফৎ আমার চেহারা ও আমার পরিচয় শতদলের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। এবং এখানে এসে যে হোটেলে উঠেছি সেও শতদলের পূর্বাহ্নেই জানা ছিল। একটা নাটকীয় কৌতুকের মধ্যে দিয়ে নিজে যেন আচমকা কোন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে পিস্তলের গুলিতে আহত হয়েছে এই রকম pose নিয়ে শতদল আমার সামনে এসে আবির্ভূত হয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের পরিচয় ঘটাল। প্রথমটায় frankly বলতে গেলে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি। পরে যখন তলিয়ে ভাবি, তখনই সর্বপ্রথম আমার মনে সন্দেহ জাগে। শতদলের life-এর উপরে তিন-চারবার attempt হয়েছে—একবার হোটেলের সামনে গুলি করে, একবার নিরালার পথে পাথর গড়াবার গল্প বলে, একবার শয়নঘরে ছবির তার কেটে, একবার নিজের ঘরে রিভলবার ছুড়ে আলোর চিমনি ভেঙ্গে—সে আমার কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছে ব্যাপারটা। প্রতিবারই ব্যাপারগুলো আমি প্রথমে genuine ভেবেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা ব্যাপার মনের মধ্যে আমার সর্বদাই খচখচ করে অদৃশ্য কাঁটার মত বিধেছে—why at all somebody should be after his life? কেন কেউ তাকে হত্যা করতে চাইবে? কী মোটিভ—কী উদ্দেশ্য, এবং ঐ সঙ্গে আরো একটা যুক্তি মনের মধ্যে এসে আমার উদয় হয়েছে—হত্যার attemptগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটু ফাঁক আছে। একটা বা দুটো attempt ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু বার বার চার বার কেন attempt বিফল হবে? শেষবারের attempt-এর পর যে মুহূর্তে ঐ ধরনের অসামঞ্জস্যটা আমার মনকে আকর্ষণ করল, সেই মুহূর্ত হতেই মন আমার সজাগ হয়ে উঠেছে। কঠিন বিশ্লেষণে যুক্তি ও নিরঙ্কুশ বিচারে ঘটনাগুলোকে চিন্তা করতে শুরু করলাম এবং চিন্তা করতে গিয়ে একই জায়গায় এসে বারবার শুরু করলাম এবং চিন্তা করতে গিয়ে একই জায়গায় এসে বার বার থেমে যেতে হল আমাকে। ব্যাপারটা যুক্তিহীন। এলোমেলো। তারপরই তৃতীয় অধ্যায়ে আমি আসব : শতদল ও সীতার ব্যাপারে। সীতা ভালবেসেছিল সমস্ত প্রাণ দিয়ে শতদলকে কিন্তু শতদল চাইছিল রাণুকে। রাণু ভালবাসে আবার শতদলকে নয়, কুমারেশকে। অর্থ অনর্থ তো ছিলই সঙ্গে এসে যোগ দিল প্রেমের ব্যাপার। একটা জটিল পরিস্থিতির হল উদ্ভব। শতদল চায় রাণুকে, রাণু চায় কুমারেশকে, সীতা চায় শতদলকে। আবার শতদল চায় কুমারেশের ন্যায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে। কুমারেশই হল এক শতদলের পথের কাঁটা দুই দিক দিয়ে। একা রামে রক্ষা নেই তাতে সুগ্রীব দোসর! আকাঙ্ক্ষিতা নারী ও আকাঙ্খিত অর্থ। অতএব কুমারেশকে সরাতে পারলেই দুদিক পরিষ্কার শতদলের। কাজেই কুমারেশের ওপরেই পড়ল শতদলের যত আক্রোশ। শতদল আটঘাট বেধে আসরে অবতীর্ণ হল। শতদলের বুদ্ধির প্রশংসাই করতাম যদি না বড়ের চালে দুটো মারাত্মক ভুল করে নিজে মাত হয়ে না যেত। শেষ পর্যন্ত! এক নম্বর ভুল সে করলে, কুমারেশকে হত্যা না করে এনে বন্দী করে রেখে—কারণ তাতে করে সীতাকে হত্যা করতে হত না। সীতা কুমারেশের কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই তাই হতভাগিনীকে সরাতে হল ইহজগৎ হতে। আর সেইটেই হল শতদলের দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল—অর্থাৎ সীতাকে হত্যা করা। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত সন্দেহের মীমাংসা হয়ে গেল।

আমি বুঝলাম সকল রহস্যের মেঘনাদ কে! সীতাকে হত্যা করবার পূর্বমুহূর্তে নিজের লাল রঙের শালটা সীতার গায়ে দিয়ে ব্যাপারটা শতদল এমন করে সাজাতে চেয়েছিল, যাতে করে লোকের ধারণা হয় আসলে হত্যাকারী শতদলকেই হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু আলোয়ানের ব্যাপারে ভুল করে সীতাকে হত্যা করে ফেলেছে! সীতার হত্যা একটা pure accident ভিন্ন কিছুই নয়! বলতে বলতে কিরীটী থামল।

হাতের পাইপটা কখন একসময় নিবে গিয়েছিল। সেটায় আবার অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী তার অসমাপ্ত কাহিনী শুরু করলে।

এবারে আমি আসব চতুর্থ অধ্যায়ে। রাণু দেবীর সহাধ্যায়ী কবিতা দেবী, রাণুদের কলকাতার বাসাতেই শতদলের সঙ্গে কবিতা দেবীর পরিচয় হয়। এবং কবিতা দেবীর মনে সেই পরিচয়টা গাঢ় হয়ে উঠে ভালবাসায় পরিণত হয়। প্রথম victim সীতা ও দ্বিতীয় victim হলেন কবিতা দেবী।

কবিতা দেবীর দিকে তাকালাম। মাথাটা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে তাঁর।

কিরীটী বলে চলে, টের পেলাম আমি ব্যাপারটা একটি প্রবাল পাথর থেকে।

হিরণ্ময়ী দেবী এবার কথা বললেন, সেদিন আপনাকে আমি বলিনি মিঃ রায়, একই ধরনের প্রবাল পাথর দেওয়া দুটি আংটি ছিল বাবার! একটি দাদা নিয়েছিল, অন্যটি আমি নিয়েছিলাম। আমার আংটিটা আমার স্বামীকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম—আর দ্বিতীয়টি রণধীর চৌধুরীর মৃত্যুর পর শতদলের হাতে যায়। পরে আমার মনে পড়ে, শতদলের হাতে প্রথম দিন আংটিটা দেখেছিলাম। এবং সেটাই বোধ হয় শতদল কবিতা দেবীকে দেয়। কেমন তাই না কবিতা দেবী?

কবিতা গুহ মৃদুভাবে ঘাড় নাড়লেন।

এবং সেই জন্যই পাথরটা কবিতা দেবীর বাইরের ঘরে কুড়িয়ে পাওয়ায় ও পরে কবিতা দেবীর আংটির পাথরটা হারানোর সংবাদে কবিতা দেবী যখন আংটিটা এনে আমাকে দেখালেন, চকিতে আমার সব কথা মনে পড়ে গেল। ও সেই সঙ্গে সঙ্গে কবিতা দেবী ও শতদলের relationটা চোখের উপরে আমার স্পষ্ট হয়ে উঠল। বুঝলাম কবিতা দেবীও শতদলের ফাঁদে পা দিয়ে মজেছেন। ডন জুয়ান শতদল! যাক, আবার পূর্বের কথায় ফিরে যাই। সীতাকে হত্যা করবার পরই আমি সাবধান হলাম। শতদলকে আর free রাখতে সাহস হল না। নার্সিং হোমে নিয়ে চোখে চোখে রাখলাম—so that he might not play any more dirty tricks। কিন্তু এবারে কবিতা দেবী হলেন তার সহায়। নার্সিং হোমের ব্যাপারগুলো সব কবিতা দেবীর সাহায্যেই ঘটে। কবিতা দেবীর বাড়িতে সন্দেশ ও ফুল নার্সিং হোমে পাঠাবার জন্য কেউ সংবাদ দেয়নি তাঁকে। A made-up story কবিতা দেবীর! শতদলের পরামর্শমতই কবিতা দেবী যা করবার করেছেন। এদিকে শতদল নার্সিং হোমে বন্দী থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছিল, কারণ কুমারেশ একবার যখন ছাড়া পেয়েছে সমস্ত planটাই তার বানচাল হয়ে যেতে পারে যে-কোন মুহূর্তে। সে ভয়ও ছিল, তাই ভুখনার সাহায্যে ফটোটা চুরি করে রাতারাতি এখান হতে সরে পড়বার মতলব ছিল! নার্সিং হোমের জানালাপথে ধুতি ঝুলিয়ে তার সাহায্যে নেমে গিয়ে নিরালায় যায়। নার্স দুধ নিয়ে যখন তার কেবিনে যায় শতদল আলো নিবিয়ে তখন ঘুমের ভান করেছে। এবং নার্স চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কেবিন ত্যাগ করে। কিন্তু ধর্মের কল নড়ে উঠল বাতাসে ভাগ্যচক্রে সব গেল ভেস্তে, বাধ্য হয়েই তাকে তাই ছবিটা ফেলে কেবিনে ফিরে আসতে হল। এবং আবার করতে হল অভিনয়—তার উপরে আর-একবার attempt হয়েছে। কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। রঙের খেলার আগেই ড্রপ পড়েছে!

ঘোষাল সাহেব প্রশ্ন করলেন, কিন্তু শতদলবাবুই যে সব কিছুর মূলে জানলেন কী করে মিঃ রায় সর্বপ্রথম?

বললাম তো। সীতা নিহত হবার পরই। তার আগে পর্যন্তও সন্দেহটা দৃঢ় হতে পারেনি। ভাসা-ভাসা অবস্থাতেই মনের মধ্যে ছিল। সে রাত্রে সর্বক্ষণই আমার দুজনের ওপরে নজর ছিল, একজন সীতা ও অন্যজন শতদল। সীতা ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার পরই কিছুক্ষণ বাদে শতদলকে আমি নীচে যেতে দেখেছি এবং ঠিক তার পশ্চাতেই দেখেছিলাম নীচে যেতে কবিতা দেবীকে। কবিতা দেবীর চিৎকারেই আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়, সীতার হত্যার ব্যাপারটা কবিতা দেবী সবটা না জানলেও যে অনেক কিছুই জানেন, সেটা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েই সে রাত্রে বুঝেছিলাম। তখনি মনে হয় কবিতা দেবী কাউকে shield করছেন deliberately! কিন্তু কাকে? হঠাৎ চকিতে একটা কথা ঐ সঙ্গে মনে হয়, কবিতা দেবী শতদলকেই shield করছেন না তো! ভাবতে গিয়ে দেখলাম সেটাই সম্ভব। সেটাই স্বাভাবিক। আর তখন সন্দেহ রইল না। বুঝলাম এ খেলা শতদলেরই। ইতিমধ্যে রণধীরের চিঠির কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। তাই শতদলকে দোষী বুঝতে পেরেও, strong একটা motive খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কবিতা দেবীর বাড়ি থেকে ফিরবার পথে আংটির পাথর-রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় ব্যাপারটা আর একবার গোড়া থেকে নতুন করে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল চিঠিটার কথা। হোটেলে ফিরেই চিঠিটা নিয়ে বসলাম। ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যেই সব স্পষ্ট হয়ে গেল, দুয়ে দুয়ে চার অঙ্ক মিলে গেল। তখনি বুঝলাম, গত রাত্রে ছবিটা চুরি করবার চেষ্টা করে যখন হত্যাকারী সফল হয়নি, আর একবার সে সম্ভবত ঐ রাত্রেই attempt নেবে। সঙ্গে সঙ্গে নিরালায় গিয়ে হানা দিলাম এবং অনুমান যে আমার মিথ্যা হয়নি তার প্রমাণও পাওয়া গেল হাতে হাতে। কিরীটী তার কথা শেষ করল।

দিন-দুই বাদে ফিরবার পথে ট্রেনের কামরায় কিরীটী বলছিল, হিরণ্ময়ী দেবীর কথাই ঘুরে-ফিরে মনে পড়ছে সুব্রত। একমাত্র মেয়ে সীতার মৃত্যুটা সত্যিই বড় মর্মান্তিক হয়েছে তাঁর কাছে, ঘুণাক্ষরেও তিনি সন্দেহ করেননি কখনো যে সীতা শতদলকে ভালবাসে। এবং সেটাই যখন প্রকাশ পেল, তাঁর মুখের দিকে তখন যদি তুমি তাকাতে দেখতে কি সর্বস্ব হারানোর বেদনাই না তাঁর মুখের ওপরে ফুটে উঠেছিল। একেই বলে মর্মান্তিক বিয়োগান্ত ব্যাপার। যে সম্পত্তির লোভে তিনি নিরালা আঁকড়ে পড়েছিলেন সে সম্পত্তিও তাঁর হস্তগত হল না, ঐ সঙ্গে হারাতে হল মর্মান্তিক দুঃখ ও লজ্জার মধ্যে দিয়ে একমাত্র কন্যাকেও। শতদলও শুন্য হাতে চরম দণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছে, হিরণ্ময়ীকেও ফিরে যেতে হল শূন্য হাতে। সীতাকে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হল, কবিতা ফিরে গেল শুন্য হাতে। রণধীর চৌধুরীর এত সাধের নিরালা-তাও পড়ে রইল শূন্য, কুমারেশ বা রাণু, কোনদিনই হয়তো ওখানে পা দেবে না। হিরণ্ময়ী ও হরবিলাস তো দেবেনই না।

কথা শেষ করে কিরীটী পাইপটা মুখে তুলে নিল। ট্রেন ছুটে চলেছে কলকাতা অভিমুখে।