১২. একটা বেদনার ঝড়

একটা বেদনার ঝড় তুলে যেন প্রস্থানরত হরবিলাসের কতকটা আত্মোক্তির মত উচ্চারিত কথাগুলো তাঁর পিছনে পিছনে মিলিয়ে গেল চাপা হাহাকারের মতই।

এবং আমাদের বিমূঢ় ভাবটা কাটবার আগে আচমকা জ্ঞান হারিয়ে শতদলের শিথিল দেহটা চেয়ারের উপরেই ঢলে পড়ল। আমার আগেই কিরীটী ক্ষিপ্রগতিতে শতদলের দিকে এগিয়ে এসে উৎকণ্ঠিতভাবে বললো, শতদলবাবু হঠাৎ বোধ হয় জ্ঞান হারিয়েছেন সুব্রত। আয়, ধর। ওঁকে ঐ সোফাটায় শুইয়ে দিই—

আমি ও কিরীটী দুজনে ধরাধরি করে শতদলের জ্ঞানহীন দেহটা কোনমতে পাশের সোফাটায় শুইয়ে দিলাম। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে তখন শতদলের। চোখ দুটো বোজা। মুখটা ফ্যাকাশে বিবর্ণ। ঘরের কোণে রক্ষিত কুজো থেকে একটা গ্লাসে করে জল নিয়ে শতদলের চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে লাগলাম।

কয়েক মিনিট শুশ্রুষা করবার পরই শতদল চোখ মেলে তাকাল। লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে নিল।

শুয়ে থাকুন শতদলবাবু। একটু বিশ্রাম নিন। আমিই বলি বাধা দিয়ে।

ইতিমধ্যে কিরীটী শতদলের শয়নকক্ষ হতে একটা সাদা চাদর এনে মৃতদেহটা ঢেকে দিয়েছিল। চোখের সামনেই রক্তাক্ত বীভৎস মৃতদেহটা যেন ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছিল।

কিছুক্ষণ আগেও যাকে ছাতের ওপরে শতদলের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি, তারই নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত দেহটা সামনে ঐ মেঝেতে পড়ে আছে।

সামান্য এই দু-ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কখনই বা সে নিচে নেমে এল, আর কার হাতেই বা এমন নিষ্ঠুরভাবে নিহত হল? ঘুর্ণাবর্তের মতই প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে।

আর কখনই বা তাকে হত্যা করা হল? নিরীহ ঐ মেয়েটির পৈশাচিক হত্যার মূলে কী মোটিভ (উদ্দেশ্য) আছে? ছাতের উপর থেকে অলক্ষ্যে অলঙ্ঘ্য মত্যুই যেন ওকে টেনে নিয়ে এসেছিল নিচে। কিন্তু হত্যা করলে কে? কে? হত্যাকারী কে?

শরীরটার মধ্যে কেমন যেন অস্থির-অস্থির করছে! শতদল ক্ষীণকণ্ঠে বললে।

সুব্রত, শতদলবাবুকে ওঁর ঘরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দাও। কিরীটী আমাকে সম্বোধন করে বলে।

না, না, আমি একা থাকতে পারব না। অস্থির উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে শতদল এখানেই আমি থাকব। শতদলের সমস্ত মুখখানা যেন ভয়ে পাঁশটে হয়ে গিয়েছে, অভাবনীয় আকস্মিক আঘাতটা যেন খুবই লেগেছে।

তাহলে সোফাটার ওপরে ভাল করে শুয়ে পড়ুন। কিরীটী স্নিগ্ধকণ্ঠে বলে।

একজন ডাক্তারকে ডাকলে হত না? কথাটা আমিই বলি।

সুব্রত মন্দ কথা বলেনি। কোন জানা-শোনা ভাল ডাক্তার আছে আপনার মিঃ ঘোষাল? প্রশ্ন করে কিরীটী।

আছেন। ডাঃ আদিত্য চ্যাটার্জী। সব চাইতে তাঁরই এখানে ভাল প্র্যাকটিস। ছোটখাটো একটা নার্সিং হোম মতও তাঁর আছে।

তাঁকে একটা খবর দেওয়া যায় না?

বিপিন গেটের বাইরে plain dress-এ পাহারায় আছে, তাকেই আমি বলে আসছি। মিঃ ঘোষাল বলেন।

সুব্রত, মিঃ ঘোষালের সঙ্গে যা।

কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। বুঝলাম একাকী শতদলের সঙ্গে ও কিছুক্ষণ থাকতে চায়। আমিও আর দ্বিধা না করে ঘোষালের দিকে তাকিয়ে বললাম, চলুন মিঃ ঘোষাল।

সিঁড়ির ঠিক শেষ ধাপের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল অবিনাশ—এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য।

সিঁড়ির আলোর খানিকটা অবিনাশের মুখের একাংশে তির্যকভাবে এসে পড়েছে। আমাদের দেখে অবিনাশ তাড়াতাড়ি সরে গেল। মনে হল অবিনাশ আমাদের সান্নিধ্য থেকে যেন পালিয়ে গেল। অভ্যাগতের দল সকলেই চলে গিয়েছেন।

সমস্ত বাড়িটার মধ্যে একটা অদ্ভুত ভৌতিক স্তব্ধতা যেন থমথম করছে।

টানা বারান্দার মাঝামাঝি আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে ঘরের খোলা দরজার সামনেই ইনভ্যালিড চেয়ারটার উপরে নিশ্চল পাথরের মত বসে আছেন হিরণ্ময়ী দেবী। বারান্দায় ঝুলন্ত বাতির আলো ওঁর ওপর এসে পড়েছে। সমস্ত মুখখানা ফ্যাকাশে বিবর্ণ। প্রাণের চিহ্ন পর্যন্ত যেন সে চোখে-মুখে নেই। হাত দুটি শ্লথভাবে কোলের ওপরে ন্যস্ত। তাঁর নিত্যসহচর উলের বল ও বুননটা কোলের ওপরে নেই।

        আমাদের দুজনের পদশব্দেও কোনরূপ স্পন্দন জাগল না যেন হিরণ্ময়ী দেবীর মধ্যে। যেমন নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মত স্তব্ধ-অনড় বসেছিলেন ইনভ্যালিড চেয়ারটার ওপর, ঠিক তেমনই বসে রইলেন। চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে নিবদ্ধ।

আরো একটু এগিয়ে গেলাম ইনভ্যালিড চেয়ারে উপবিষ্ট হিরণ্ময়ী দেবীর কাছে।

এবারে নজরে পড়ল দুই চোখের কোল বেয়ে দুটি অশ্রুর ধারা। হিরণ্ময়ী দেবী কাঁদছিলেন। তাঁর চোখে জল।

আমি আর অগ্রসর হলাম না। দেওয়াল ঘেষে একটা থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে কোন শব্দ না করে কেবল নিঃশব্দে চোখের ইঙ্গিতে ঘোষালকে এগিয়ে যেতে বললাম। ঘোষাল চলে গেলেন বারান্দার অন্য প্রান্তে দ্বারের দিকে।

হরবিলাস বোধ হয় এতক্ষণ ঘরের মধ্যেই ছিলেন, বের হয়ে এলেন। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে হিরণ্ময়ীর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা স্ত্রীর কন্ধের ওপরে রাখলেন। মৃদুকঠে ডাকলেন, হিরণ!

তথাপি নিশ্চল স্তব্ধ হিরণ্ময়ী। এতটুকু কম্পনও নেই। স্বামীর ডাক যেন তাঁর কানে পৌঁছয়নি।

ঘরে চল হিরণ! তথাপি হিরণ্ময়ীর দিক থেকে কোন সাড়া এল না। পূর্ববৎ নিশ্চল স্তব্ধ। হিরণ! আবার মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন হরবিলাস।

স্বামী-স্ত্রীর এই শোকের মধ্যে নিজেকে কেমন যেন আমার বিব্রত মনে হতে লাগল। এমন সময় এখানে না থাকাই উচিত বোধ হয়। স্থানত্যাগ করাই কর্তব্য।

আচমকা এমন সময় হিরণ্ময়ীর পাথরের মত স্তব্ধ দেহটা ঈষৎ নড়ে উঠল। হিরণ্ময়ী স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন। নিষ্প্রাণ অর্থহীন দৃষ্টি। স্বামী ডাকলেও যেন কিছু বুঝতে পারেননি তিনি।

ঘরে চল।

১৭৬

সীতাকে কি ওরা নিয়ে গিয়েছে? ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন হিরণ্ময়ী।

ঘরে চল হিরণ। স্নিগ্ধ কণ্ঠে হরবিলাস কেবল বললেন।

তুমি দেখেছ? সত্যিই সীতা মরে গিয়েছে? মনে নেই তোমার, ছোটবেলায় ওর ফিটের ব্যামো ছিল! ফিট হয়নি তো? সত্যিই হয়তো ও মরেনি, ফিট হয়ে আছে। Smelling Salt-এর শিশিটা নিয়ে যাও–

না, তুমি ঘরে চল।

না, ঘরে যাব না। এখান দিয়েই তো সীতাকে ওরা নিয়ে যাবে!

তা তো জানি না। ওসব কথা আর ভেবে কী হবে হিরণ? মনকে শক্ত করা ছাড়া তো আর উপায় নেই।

কিরীটীবাবু, কোথায়?

উপরেই আছেন।

তিনি কি বললেন? তিনিও ধরতে পারলেন না কে আমার সীতাকে খুন করল?

কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ হিরণ্ময়ী দেবী চুপ করে রইলেন, তারপর আবার যেন আপন মনেই বলে উঠলেন, সে ঠিক ধরতে পারবে, আমার সীতাকে কে মেরেছে। সে ধরতে পারবে—পারবে।

ক্ষীণ পদশব্দ কানে এল।

চেয়ে দেখি ঘোষাল ফিরে আসছেন, আমিও আর বিলম্ব না করে পা টিপে টিপে সোজা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। সত্যিই ঐ শোকের দৃশ্য যেন আর সহ্য করতে পারছিলাম না।

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দেখি, কিরীটী নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে আপনমনে পায়চারি করছে। মুখে পাইপ। শতদলবাবু সোফার ওপরে যেমন অর্ধশয়ান অবস্থায় ছিল তেমনই আছে।

আমার পদশব্দে কিরীটী পায়চারি থামিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ঘোষাল কই?

আসছেন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘোষাল ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

ডাক্তারকে ডাকতে লোক পাঠিয়েছেন?

হ্যাঁ। বিপিনও সেই লোকটির কথা বললে মিঃ রায়।

কার কথা?

মিস সেন যে লোকটির কথা বলছিলেন! লোকটাকে বিপিন সদর দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখেছে। রাত তখন পৌনে নটা হবে।

আসতে দেখেনি লোকটাকে? কিরীটী প্রশ্ন করে।

না। কেবল বের হয়ে যেতেই দেখেছে। তবে মিস সেন তার বেশভুষার যে description দিয়েছেন তার সঙ্গে মিল নেই।

কি রকম?

গায়ে একটা কালো রঙের গ্রেট কোট ছিল, আর মাথায় একটা কালো রঙের ফেল্ট ক্যাপ ছিল। ক্যাপটা ডানদিকে একটু টেনে নামানো ছিল। চেহারার বর্ণনায় মিল আছে। উঁচু, লম্বা বলিষ্ঠ গড়ন। এবং সদর দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় সদরের আলোয় লোকটার মুখের একাংশ যা দেখতে পেয়েছিল, বললে মুখে নাকি খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল, কিছুদিন যে লোকটা shave করেনি বোঝা যায়।

ঘোষালের কথা শেষ হতেই কানে এল একটা কুকুরের গরুগম্ভীর ডাক।

চমকে উঠেছিলাম প্রথমটায়, পরক্ষণেই মনে পড়ল সীতার কুকুরের ডাক। আজ সন্ধ্যায় এখানে লোকসমাগমের জন্য সীতার কুকুরটাকে নিচের তলার একটা ঘরে চেন দিয়ে বেধে রাখা হয়েছিল।

ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে কুকুরটা একলাফে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল এবং সোজা এসে সীতার ভূপতিত নিষ্প্রাণ হিমশীতল দেহটার সামনে দাঁড়িয়ে গেল।

সকলেই আমরা স্তব্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি অ্যালসেসিয়ান প্রকাণ্ড কুকুরটার দিকে। স্থির দৃষ্টিতে সীতার মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুকুরটা।

হঠাৎ কুকুরটা হাঁটু ভেঙে সীতার মৃতদেহের সামনে বসে পড়ল। তারপর মুখটা সীতার গায়ের উপর রেখে কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল।

কুকুরটা কাঁদছে।

অত বড় একটা জানোয়ার যে অমন করে তার প্রভুর জন্য কাঁদতে পারে, অমন করে তার শোক প্রকাশ করতে পারে, দেখে সত্যিই যেন বিস্ময়ের অবধি ছিল না। নির্বাক আমরা সকলেই। একটা জানোয়ারের শোকপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে সমস্ত ঘরের আবহাওয়াটাও যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে।

ঠিক এমনি সময় হাঁপাতে হাঁপাতে খালি গায়েই হরবিলাস ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। হাতে তাঁর কুকুর বাঁধার মোটা শিকলটা।

কুকুরটা কিছুতেই তাঁর প্রভুর মৃতদেহের পাশ হতে নড়বে না। একপ্রকার জোর করেই গলার বকলসে শিকল এঁটে হরবিলাস কুকুরটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন।

রাত প্রায় পৌনে বারোটায় ডাক্তার আদিত্য চ্যাটার্জী এলেন, বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। দার্শনিকের মত এলোমেলো কাঁচা-পাকা চুল। মিঃ ঘোষালই ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে আমাদের সকলের পরিচয়টা করিয়ে দিলেন এবং নিরালার দুর্ঘটনাটাও সংক্ষেপে তাঁর গোচরীভূত করলেন।

ডাঃ চ্যাটার্জী ওখানকার অনেক দিনের বাসিন্দা। শহরেই প্র্যাকটিস করেন এবং নিজের একটি ছোটখাটো নার্সিং হোমও আছে। মিঃ ঘোষালের মুখে সমস্ত কাহিনী শুনে তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কেবল একবার মৃদুকণ্ঠে বললেন, How horrible!

আরও বললেন, এ গৃহ তাঁর পরিচিত, আগেও নাকি দু-একবার এসেছেন এখানে শিল্পী রণধীর চৌধুরীকে দেখতে। এবং সীতাকেও তিনি চিনতেন। এই বাড়িতেই আলাপ হয়েছিল রণধীর চৌধুরীর জীবিতকালে।

কিরীটীর অনুরোধে শতদলকে ডাঃ চ্যাটার্জী পরীক্ষা করলেন। বললেন, Simple nervous shock! একটু স্টিমিউলেন্ট ও কটা দিন বিশ্রাম পেলেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।

এমন সময় কিরীটী ডাঃ চ্যাটার্জীকে অনুরোধ জানাল, আমারও তাই মত ডাঃ চ্যাটার্জী। এবং আমার ইচ্ছে, শতদলবাবুর উপর দিয়ে উপর্যপুরি কয়েক দিন ধরে যে নার্ভাস স্ট্রেন গিয়েছে তাতেই তিনি আজকের দুর্ঘটনায় একেবারে ব্রেকডাউন করেছেন, এ অবস্থায় আমার মনে হয় যদিও আমি ডাক্তার নই—ওঁর কিছুদিন রেস্ট নেওয়া অবশ্যই কর্তব্য—complete bodily and mental rest এবং এখানে নয়—অন্য কোন জায়গায় স্থান-পরিবর্তন করা এখন বিশেষ প্রয়োজন। আপনি কী বলেন ডাঃ চ্যাটার্জী?

খুব ভাল হয় তাহলে! You are right!

আপনার নার্সিং হোমে সুবিধা হয় না?

আমার নার্সিং হোমে?

হ্যাঁ। আমার তো মনে হয়, ওঁর পক্ষে আপনার নার্সিং হোমই সব চাইতে ভাল জায়গা হবে। আপনার কেয়ারেও থাকবেন উনি এবং strict order থাকবে। কেউ যেন ওঁর সঙ্গে দেখা না করতে পারে।

বেশ তো। তা হতে পারে।

কোন সিঙ্গল রুম খালি আছে কি?

তা আছে।

তবে সেই ব্যবস্থাই ভাল। এখনি ওঁকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তাহলে করুন।

বেশ তো, আমার টমটম এনেছি—আমার সঙ্গে উনি চলুন।

সেই মত ব্যবস্থাই হল। আমার ওপরেই কিরীটী ভার দিল ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে শতদলবাবুকে নিয়ে গিয়ে একেবারে নার্সিং হোমে পৌঁছে দিয়ে আসার।

কিরীটী ও মিঃ ঘোষাল থেকে গেলেন মৃতদেহের একটা ব্যবস্থা করবার জন্য।

গতকাল থেকে শতদলবাবু ডাঃ চ্যাটার্জীর নার্সিং হোমেই আছেন। নার্সিং হোমে স্ট্রিক্ট অর্ডার দেওয়া আছে একমাত্র কিরীটী ও রসময়বাবু ছাড়া এবং তাঁদের বিনানুমুতিতে কোন ভিজিটার্সকেই কোন উপলক্ষে শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে না।

সীতার আকস্মিক মৃত্যুর পর হতেই কিরীটীকে লক্ষ্য করেছিলাম হঠাৎ যেন সে বেজায় গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কি একটা চিন্তা যেন তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আরো একদিন পরের ঘটনা। হঠাৎ নার্সিং হোম থেকে একজন লোক সংবাদ নিয়ে এল, সন্ধ্যার কিছু পরে ঘণ্টাখানেক আগে থেকে শতদলবাবু নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং ডাঃ চ্যাটার্জী অবিলম্বে কিরীটীকে একবার নার্সিং হোমে যেতে বলেছেন। ডাক্তার তাঁর টমটম পাঠিয়ে দিয়েছেন।

আমি ও কিরীটী আর কালবিলম্ব না করে তখনি নার্সিং হোমে যাবার জন্য টমটমে উঠে বসলাম।

ছোট্ট শহর। হোটেল থেকে প্রায় মাইলখানেক দুরে স্টেশনের কাছে ডাঃ চ্যাটার্জীর নার্সিং হোম। প্রায় একবিঘে জমির ওপরে বাগান, এক-মানুষ সমান উঁচু প্রাচীরঘেরা সীমানার মধ্যে দোতলা একটি বাড়িনার্সিং হোম। বাইরে থেকে একমাত্র গেট ছাড়া নার্সিং হোমের মধ্যে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না।

সোজা আমরা টমটম থেকে নেমে দোতলার কোণের ঘরে যেখানে শতদলবাবু আছেন সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

শয্যার ওপরে শতদলবাবু শুয়ে। বুক পর্যন্ত চাদরে আবৃত। চোখ দুটি বোজা।

পাশে দাঁড়িয়ে ডাঃ চ্যাটার্জী শতদলকে একটা ইনজেকশন দিচ্ছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে একজন নার্স।

ইনজেকশন দেওয়া শেষ হলে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন ডাক্তার নাসের হাতে সিরিঞ্জটা দিয়ে, চলুন আমার ঘরে। ভয় বোধ হয় কেটে গিয়েছে।

ডাঃ চ্যাটার্জীর ঘরে এসে আমরা বসলাম।

কি ব্যাপার ডাঃ চ্যাটার্জী?

Morphia poisoning-কেউ বোধ হয় শতদলবাবুকে মরফিয়া খাইয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল।

বলেন কি? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। হঠাৎ নার্স এসে ঠিক সময়মত আমায় খবরটা না দিলে বোধ হয় রক্ষা করা যেত না life। অতঃপর একটু থেমে বললেন, এখন তো দেখছি সেদিন ওঁকে এখানে এনে ভালই করেছি।

কিন্তু কি করে সম্ভব হল? How it was done? প্রশ্ন করলাম আমি।

প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি দুপুরের দিকে কে একজন ভিজিটার্স দেখা করতে এসেছিল, কিন্তু দেখা করার অর্ডার না থাকায় নার্স দেখা করতে দেয়নি। ভদ্রলোক কিছু ফুল ও একটা কাগজের বাক্সে কিছু মিঠাই রেখে যান ওঁকে দেবার জন্য। সেই মিঠাই খেয়েই নাকি–

হুঁ। আচ্ছা ডাক্তার, আপনার সেই নার্স—যার হাতে সেই ভদ্রলোক ফল ও মিঠাই দিয়ে গিয়েছিল, এখানে তাকে একবার ডাকতে পারেন? তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

নিশ্চয়ই।

ডাক্তার বেল বাজালেন। বেয়ারা এসে ঘরে ঢুকল, ডঃ চ্যাটার্জী তাকে বললেন, নার্স সরলা মিত্রকে ডেকে দিতে। নিচের ওয়ার্ডে সরলা মিত্র তখন ডিউটিতে ছিল।

ভাল কথা ডাঃ চ্যাটার্জী, যে মিষ্টি খেয়ে শতদলবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন তার কিছু অংশ এখনো বাকি আছে নিশ্চয়ই! কিরীটী ডাক্তারকে শুধায়।

হ্যাঁ, বোধ হয় গোটা দুই সন্দেশ খেয়েছিলেন বাকিটা এখনো বাক্সেই আছে, রেখে দিয়েছি বাক্সটা সমেত, বলতে বলতে বসবার টেবিলের ডানদিককার ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুলে ড্রয়ারটা টেনে কাগজের একটি ফ্যান্সি চৌকো বাক্স বের করে দিলেন ডাঃ চাটাজী।

ফ্যান্সি কাগজের চৌকো বাক্স। বাক্সের উপরে চমৎকার একটা ডিজাইন ও দোকানের নাম লেখা—বান্ধব সুইট হোম। কাগজের বাক্সের উপর লেখা নামটা পড়তে পড়তে কিরীটী বললে, এ তো দেখছি এখানকারই দোকান!

ডাক্তার জবাব দিলেন, হ্যাঁ, এখানকার বিখ্যাত মিষ্টান্নের দোকান। এদের কড়াপাকের সন্দেশ খুবই বিখ্যাত এবং খেতেও খুব ভাল।

বাক্সের ডালা খুলতেই দেখা গেল, গোটা-বারো সন্দেশ তখনও অবশিষ্ট আছে।

সরলা মিত্র এসে কক্ষে প্রবেশ করল, আমাকে ডেকেছিলেন ডাঃ চ্যাটার্জী?

কে, সরলা? এস। আমি ঠিক নয়, ইনি। একে তুমি চেন না, বিখ্যাত লোক—কিরীটী রায়।

নমস্কার। সরলা হাত তুলে নমস্কার জানায়।

চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে মিস মিত্রের। বেশ গোলগাল চেহারা এবং চোখে-মুখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে।

নমস্কার। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই মিস মিত্র। কিরীটী বললে।

বলুন!

৩নং কেবিনে অর্থাৎ শতদলবাবুর কাছে আজ যখন ভিজিটার্স আসেন, আপনি সে সময় নিচে ডিউটিতে ছিলেন শুনলাম!

হ্যাঁ।

সময়টা আপনার মনে আছে কি?

হ্যাঁ, সাড়ে তিনটে হবে।

যিনি এসেছিলেন তিনি দেখতে কেমন?

বাইশ-তেইশ বছরের একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা।

মহিলা!

হ্যাঁ। তিনি শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বললাম পারমিশন নেই—তখন একথোকা গোলাপফুল ও একটি মিষ্টির বাক্স দিয়ে আমায় অনুরোধ জানান শতদলবাবুর ঘরে সেগুলো পেছে দিতে।

সঙ্গে তাঁর আর কেউ ছিল?

না।

তাঁকে দেখলে চিনতে পারবেন?

হয়তো চিনতে পারব, তবে চোখে কালো চশমা ছিল।