০৯. শেষ নির্দেশ

আমার আত্মীয়দের প্রতি—ইহাই আমার শেষ নির্দেশ             (৩)
        সজ্ঞানে লিখিয়া যাইতেছি, রণধীর চৌধুরী আমি                  (০)
        আমার যাবতীয় সম্পত্তি ও এই ‘নিরালা’ গৃহখানি আমার        (৩)
        দৌহিত্র শ্রীমান শতদল বোসকে আমার মত্যুর পর                (৫)
        বর্তাইবে। কেবলমাত্র সে যেন স্মরাণ রাখে যে আমার স্টুডিওতে (৪)
        যে সব আত্মীয়ের ছবিগুলো, যেমন পিতামহ প্রপিতামহের        (৬)
        সেইগুলো ও অন্যান্য যে সকল পেন্টিং ও ছবি                     (৩)
       এবং ঐ সঙ্গে ঐ কক্ষ-মধ্যস্থিত সমস্ত মূর্তিগলোরও স্বত্ব            (২)
        বাকি সব বর্তাইবে আমার দৌহিত্র শতদলকুমারে                  (৩)
        শুধু ঐ নয়, আমার শিল্পী-জীবনের নিন্দা ও যশের                 (২)
        উত্তরাধিকারীও একমাত্র সে-ই হইবে                               (৩)
                                                   ইতি–
                                        রণধীর চৌধুরীঃ ৩০৩৫৪৬৩২৩২৩ :
                                                          ১৮ই ভাদ্র ১৩৫৩

অবাক বিস্ময়েই চিঠিটা বার-দুই আগাগোড়া পড়বার পরও চিঠিটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। লেখা ছাড়াও চিঠিটার মধ্যে দুপাশে দুখানি মুখের রেখাচিত্র বা স্কেচ আঁকা।

কিরীটীর দিকে আড়চোখে তাকালাম। কিরীটীর সমস্ত চেতনা যেন চিঠিটার মধ্যেই তন্ময় হয়ে গিয়েছে। স্থির নিস্পন্দ ভাবে চিঠিটা আলোর সামনে প্রসারিত করে হাতের মধ্যে ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে।

সহসা শতদলবাবুর কণ্ঠস্বরে কিরীটীর তন্ময়তা ভঙ্গ হল।

দেখলেন তো চিঠিটা পড়ে মিঃ রায়? আমি আপনাকে ঠিক বলেছিলাম কিনা যে, আমিই দাদুর যাবতীয় সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী এবং তাঁর সম্পত্তি বলতে এই নিরালা গৃহটা আর স্টুডিওর মধ্যে একটু আগে যে ছবি ও মূর্তিগুলো দেখে এলেন ঐগুলোই!

হ্যাঁ, অন্ততঃ চিঠিটায় মোটামুটি ভাবে সেই নির্দেশই রয়েছে দেখলাম। অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে যেন কিরীটী শতদলের কথার জবাব দিল।

ঘরের মধ্যে দেরাজের উপর মাঝারি আকারের একটা টাইমস-পীস ছিল, হঠাৎ সেটা রিং-রিং করে বেজে উঠতেই চমকে টাইম-পীসটার দিকে তাকালাম, রাত্রি প্রায় পৌনে নটা।

শতদলও অ্যালার্মের শব্দে চমকে উঠেছিল, এগিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি অ্যালার্মের বোতামটা টিপে অ্যালার্ম বন্ধ করে দিলেন। কিরীটী রণধীর চৌধুরীর লেখা চিঠিটা ভাঁজ করে পুনরায় খামের মধ্যে ভরে রাখতে রাখতে বললে, যদি কিছু মনে না করেন শতদলবাবু এই চিঠিটাও আজকের রাতের মত নিয়ে যেতে চাই আমি। কাল আবার ফিরিয়ে দেব।

বেশ তো, নিয়ে যান না। শান্তকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেন শতদল।

ধন্যবাদ। আজকের মত তাহলে আমরা বিদায় নেব শতদলবাবু। কাল সকালে একবার পারেন তো হোটেলে আসবেন। আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করবার আছে।

যাব। শতদল আমাদের সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।

অন্ধকারে দুজনে পাশাপাশি আমি ও কিরীটী সাগরের ধার দিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে চলেছি। অকস্মাৎ যেন কিরীটী অসম্ভব রকম গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।

কোন একটা চিন্তা যে তার মাথার মধ্যে পাক খেয়ে ফিরছে বুঝতে কষ্ট হয় না। এবং যে চিন্তাই হোক, বিষয়বস্তুটা যে তাকে বেশ বিচলিত করে তুলেছে বুঝতে পারছিলাম। আমিও অনেক কিছুই ভাবছিলাম।

মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে এই সন্ধ্যায় যে সব ঘটনা পর পর ঘটে গেল, কোনটার সঙ্গে কোনটারই কোন যোগসূত্র একটা খুঁজে না পেলেও একটা ব্যাপার যেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সেটা হচ্ছে শতদলের সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা রহস্য যেন ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠছে। একটা আশু অমঙ্গলের ছায়া যেন ক্রমে ক্রমে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কোন একটা অভাবনীয় দুর্ঘটনা যেন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। এবং অবশ্যম্ভাবী সে ঘটনাকে প্রতিরোধ করবার ক্ষমতা আমাদের কারোরই হবে না।

হোটেলের সামনে সী-বীচে কয়েকদিন আগেকার সকালের একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে, এই কয়দিন ধরে যে ব্যাপারটাকে অন্ততঃ আমি আদপেই কোন গুরুত্ব দিইনি, অথচ প্রথম হতেই যেটা কিরীটীকে বিচলিত করেছে সেটাই যেন এখন ক্রমশ স্পষ্ট আকার নিয়ে সত্যিই জটিল হয়ে উঠছে।

কিরীটীই একসময় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বলে উঠল, তোকে একটা কাজ করতে হবে সু!

কী?

লুকিয়ে সীতার ও তার মায়ের গতিবিধির উপর নজর রাখতে হবে।

কেমন করে সেটা সম্ভব হবে? ওরা থাকে বাড়ির মধ্যে

যতদূর আমার মনে হয়, খুব বেশীদিন নজর রাখতে হবে না। দু-চারদিন নিরালার আশেপাশে সমুদ্রের ধারে ও নিরালার পিছনের বাগানে ঘোরাফেরা করতে পারলেই কিছু-না-কিছু তুই জানতে পারবি। তবে হ্যাঁ, তোকে জেলের ছদ্মবেশ ধরতে হবে।

বেশ, কাল সকাল থেকেই তাহলে শুরু করি!

না, আজ রাত থেকেই।

আজ রাত থেকেই?

হ্যাঁ।

হোটেলে পৌঁছে দেখি, আমাদের ঘরের সামনে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল।

কিরীটীই প্রথম ঘোষালকে সংবর্ধনা জানাল, ঘোষাল সাহেব যে, কতক্ষণ?

তা প্রায় আধ ঘণ্টাটাক তো হবেই। এসে শুনলাম আপনারা বেড়াতে বেরিয়েছেন, এখনো ফেরেননি। এত রাত হল যে?

হ্যাঁ, একটু রাত হয়ে গেল। নিরালায় গিয়েছিলাম। কিরীটী বসতে বসতে বললে, উঠছেন কেন, বসুন!

আমি কিরীটীর পাশেই উপবেশন করলাম।

এতক্ষণ নিরালায় ছিলেন? শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে? পুনরায় বসতে বসতে ঘোষাল বললে।

হয়েছে।

সব শুনেছেন তো?

পরশু রাত্রের ব্যাপারটা তো? কিরীটী শুধোয়।

হ্যাঁ। মশাই, আমিও সত্যিই তাজ্জব বনে গিয়েছি!

ভাল কথা মিঃ ঘোষাল, আপনার যে দুজন plain dress পুলিসের ও-বাড়িটা সর্বদা পাহারা দেবার কথা ছিল, পরশু রাত্রে তারা ছিল না?

ছিল।

তাদের রিপোর্ট কি?

সেরাত্রে ঐ সময় অশোক সাহা বলে আমার যে লোকটি পাহারায় ছিল, সেও নাকি গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। ঐসময় সে নিরালার পিছনের বাগানেই ছিল।

অন্য কিছু সন্দেহজনক তার নজরে পড়েনি?

না।

পরে অশোক কি ঐ রাত্রে শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিল?

করেছিল।

হুঁ। নিরালার একতলার বারান্দার শেষপ্রান্তে কতকগুলো কেডস জুতোর সোলের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল, জানেন?

জানি। এবং তার ফটোও তুলে নেওয়া হয়েছে। আজ সকালেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আমি আসতাম, কিন্তু স্থানীয় একটা আসন্ন উৎসবের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকায়

উৎসব! কিসের?

সামনেই ২রা মাঘ; ঐ রাত্রে প্রতি বৎসর এখানে একটা মেলা বসে সমুদ্রের ধারে। এখানকার লোকেরা বলে মাঘী মেলা। এবং রাত্রে একটা বিরাট বাজির প্রতিযোগিতা হয়।

বাজির প্রতিযোগিতা!

হ্যাঁ, বহু জায়গা হতে এখানে লোকেরা বাজির প্রতিযোগিতায় এসে যোগ দেয়, রাত নটা থেকে প্রায় বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বাজি পোড়ানো হয়। এই জায়গায় নিরালার উচ্চতা সব চাইতে বেশী বলে অনেকেই ঐ বাড়িতে গিয়ে ছাদে উঠে বাজি পোড়ানো দেখে। রণধীর চৌধুরীর আমল থেকেই নাকি ঐ নিয়ম চলে আসছে। বছরের মধ্যে ঐ রাতটির জন্য তিনি সকলের জন্য বাড়ির দরজা খুলে দিতেন। এখন তো বাড়ির মালিক শতদলবাবু তাই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম আমি জনসাধারণের দিক হতে, তাঁর কোন আপত্তি আছে কিনা জানবার জন্য

তা কী বললেন শতদলবাবু?

বললেন, নিশ্চয়ই তাঁর কোন আপত্তি নেই। চিরদিন যা চলে এসেছে তাঁর দাদুর আমল থেকে, এখনও সেই নিয়ম চালু থাকবে। সকলেই স্বচ্ছন্দে তাঁর ওখানে গিয়ে বাজি পোড়ানো দেখতে পারেন। সব ব্যবস্থাই তিনি করে রাখবেন। After all he is a nice man! চমৎকার লোক। ঘোষাল বিশেষণ যোগ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।

আর দিন-পাঁচেক বাদেই তাহলে সেই মেলা? প্রশ্নটা করলাম আমি।

হ্যাঁ। কাল-পরশু থেকেই সব দোকান-পসারীরা এসে ভিড় জমাবে দেখবেন। আশেপাশে অনেক জায়গা হতেই সব লোকজন আসে। কিন্তু আসলে আপনার কাছে আমার আসবার উদ্দেশ্য ছিল মিঃ রায়-শতদলবাবুর ব্যাপারটা আমাকে বিশেষ ভাবিত করে তুলেছে। এ বিষয়ে আমি আপনার পরামর্শ ও সাহায্য দুই-ই চাই। শতদলবাবু নিজেও যেন অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।

তা তো হবারই কথা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আমার পক্ষেও কোন মতামত দেওয়া তো সম্ভব নয় মিঃ ঘোষাল! তবে আজ সন্ধ্যা থেকেই একটা কথা আমার মনে হচ্ছে মিঃ ঘোষাল যে, শিল্পী রণধীর চৌধুরীর সম্পত্তি কেবল ঐ নিরালা প্রাসাদখানিই নয়—there is something more! Something more!

কী আপনি বলতে চান মিঃ রায়?

আমি নিজেও এখন অন্ধকারেই মিঃ ঘোষাল। কয়েকটা ছিন্ন সুত্র কেবল হাতে এসেছে, ভাসা-ভাসা অস্পষ্ট। হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই এমন কোন ঘটনা ঘটবে যার সাহায্যে আমরা কোন একটা সিদ্ধান্তের পথে এগিয়ে যেতে পারব। Matter will take a shape!

কিরীটীর নির্দেশমত ঐ রাত্রেই সাধারণ একজন জেলের ছদ্মবেশে আমাকে হোটেল থেকে বের হতে হল।

রাত্রি তখন বোধ করি এগারটা হবে।

সাগরের কিনার দিয়ে হনহন করে চলেছি নিরালার দিকে। চাঁদ উঠতে এখনো ঘণ্টাখানেক দেরি।

সঙ্গে আমার একটা দড়ির মই, একটা টর্চ ও লোডেড পিস্তল।

নিরালার গেটের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালাম। গেট হতে আমার দুরত্ব তখন প্রায় হাত-কুড়ি হবে।

তারার অল্প আলোয় দেখলাম, পাশাপাশি দুটি ছায়া-মূর্তি গেট খুলে বাইরে বের হয়ে এল।

চট করে রাস্তার ধারে পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করলাম।

ছায়া-মূর্তি দুটো এগিয়ে আসছে। কে? কারা ওরা? অন্ধকারেই তাকিয়ে রইলাম।