০৮. একটা ভারী বস্তু পতনের শব্দ

অতর্কিত সেই কোন একটা ভারী বস্তু পতনের ও ঠিক সেই সঙ্গে সঙ্গে কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দটা ঘরের মধ্যে আমাদের সকলকেই সচকিত করে দিয়ে গেল। কথা বললে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রথমে আমাদের মধ্যে কিরীটীই, কাঁচের কোন জিনিস ভাঙার শব্দ!

তাই তো, শব্দটা উপরের তলা থেকেই এল বলে মনে হল! যাই দেখে আসি কি ভাঙল শতদল ঘর হতে বের হয়ে যেতেই কিরীটীও তাকে অনুসরণ করে আর আমি করি কিরীটীকে। দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির দেওয়ালের গায়ে যে ওয়াল-ল্যাম্পটা টিমটিম করে জ্বলছে, তাতে করে সিঁড়িপথের অন্ধকার দূরীভূত হওয়া তো দূরের কথা, দুপাশের দেওয়ালের চাপে পড়ে আরো যেন ঘন হওয়ায় এবং তার মধ্যে আলোর স্বল্পতায় যেন একটা কেমন ছমছমে ভাবের সৃষ্টি করেছে।

সর্বাগ্রে শতদলবাবু তার পশ্চাতে কিরীটী ও সবার শেষে আমি সিঁড়িপথ অতিক্রম করে উপরের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই একটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। ছায়ামূর্তি যেন সোঁ করে আমাদের চোখের সামনে দিয়েই বারান্দার শেষপ্রাতের দরজাপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ব্যাপারটা এত চকিতে, যেন মনে হল, একটা স্বপ্নের মতই ছায়ামূর্তিটি অন্ধকারে বারান্দার ওদিকে মিলিয়ে গেল।

কিরীটী কিন্তু মুহূর্তের জন্যও সময় নষ্ট করেনি, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যেন একপ্রকার দৌড়েই বারান্দার শেষপ্রান্তে যেদিকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েছে ক্ষণপূর্বে সেই ছায়ামূর্তি, সেই দিকে এগিয়ে গেল।

আমিও কতকটা যেন যন্ত্রচালিতের মতোই কিরীটীকে অনুসরণ করলাম।

দরজাটা পার হলেই একটা অপরিসর ছাদের মতো, তিনদিকে তার এক বুক-সমান প্রায় প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। কিরীটী দেখি সেই প্রাচীরের উপর দিয়ে ঝুঁকে অন্ধকারে নিচে তাকিয়ে আছে। আমি ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম।

নিচে অন্ধকারে বাগানের মধ্যে গাছপালাগুলো নিঃশব্দে ছায়ার মত গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে। দোতলার ছাদ থেকে নিচের বাগানে চট করে কারো পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়া সম্ভবপর না হলেও, প্রাণের দায়ে যে কেউ ঝাপিয়ে পড়বে না এমন কোন কথা নেই। এবং বেকায়দায় নিচে পড়লে গুরতর জখম বা আহত হওয়াও এমন কিছু আশ্চর্য নয়।

ছায়ামূর্তিটা এই ছাদের দিকেই যখন এসেছে এবং স্পষ্ট আমরা যখন সকলেই চোখে দেখেছি এবং এই ছাদ থেকে অন্য কোথাও যাওয়া যখন সম্ভবপর নয়, তখন একমাত্র নিচের ঐ বাগানে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মগোপন করা ছাড়া ছায়ামূর্তিটা আর অন্য কোথায় যেতে পারে?

সু তোর সঙ্গে টর্চ আছে? কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে।

না তো! জবাব দিই।

হঠাৎ এমন সময় আমাদের ঠিক পশ্চাতেই শতদলবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমার ঘরে টর্চ আছে মিঃ রায়, এনে দেব?

না, প্রয়োজন নেই। চলুন দেখা যাক কিসের শব্দ হয়েছিল! বলতে বলতে কিরীটীই আবার বারান্দার দিকে পা বাড়াল।

সকলে ভিতরে এসে প্রথমে বারান্দা অতিক্রম করে। শতদলবাবুর শয়নঘরের ঠিক পাশের ঘরটির দরজা হাঁ করে খোলা দেখে প্রথমে শতদলবাবুই থেমে বললে, এ কি! ঘরের দরজাটা খোলা কেন?

দরজাটা বন্ধ ছিল সেদিনও দেখেছি, যতদূরে আমার মনে পড়ছে তালাবন্ধই ছিল, না শতদলবাবু? কথাটা বললে কিরীটী।

হ্যাঁ। দাদার স্টুডিও-ঘর। এটা সর্বদা বন্ধই থাকে, আমি এখানে আসা পর্যন্ত,-মৃদুকণ্ঠে শতদল জবাব দেয়, আশ্চর্য! এ দরজায় একটা হবস-এর ভারী তালা লাগানো ছিল—তালাটাই বা কোথায় গেল? পরক্ষণেই ঘরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে অল্প একটু এগিয়ে শতদল উচ্চকণ্ঠে ডাকল, অবিনাশ? অবিনাশ?

অমনি অবিনাশকে একটা আলো নিয়ে আসতে বলুন তো! কিরীটী কথাটা বললে।

কিন্তু অবিনাশের কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

শতদল সিঁড়ির দু-চারটে ধাপ এগিয়ে গিয়ে আবার উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিল, অবিনাশ? ভুখনা?

এবারেও অবিনাশের বা ভুখনার কারোরই কোন সাড়া পাওয়া গেল না নিচের তলা হতে।

উপরে একটা বাতি নিয়ে আয় ভুখনা! তথাপি শতদল চেচিয়ে বললে।

কিছুক্ষণ পরেই সিঁড়িতে ক্ষীণ পদশব্দ পাওয়া গেল এবং দেখা গেল শতদলবাবুর সেই বিচিত্র চেহারার রাঁধুনী বামন একটা হারিকেন হাতে উপরে উঠে আসছে।

হ্যারিকেন বাতিটা হাতে নিতে নিতে শতদল ভুখনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, অবিনাশ কোথায়?

নিঃশব্দে ভুখনা মাথাটা একবার দোলাল মাত্র, সে জানে না। যা, দেখ অবিনাশ কোথায় আছে, তাকে একবার ডেকে দে। ভুখনা চলে গেল।

সর্বাগ্রে হ্যারিকেন হাতে শতদল এবং পশ্চাতে আমি ও কিরীটী ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।

হ্যারিকেনের বাতিটার অনুজ্জ্বল আলোয় অকস্মাৎ যেন ঘরের মধ্যে চারিদিক হতে অনেকগুলো চোখের দৃষ্টি একসঙ্গে আমাদের উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

একসঙ্গে অনেকগুলো চোখের দৃষ্টি আমাদের চারিদিকে হঠাৎ সজীব হয়ে জিজ্ঞাসায় প্রখর হয়ে উঠেছে, কে তোমরা? কি চাও?

ঘরের দেওয়ালে বিরাট সব প্রমাণ-সাইজের কলার ও অয়েলপেন্টিং, নানা আকারের পাথর, প্লাস্টার ও ব্রোঞ্জের প্রতিমূর্তি। মনে হয় একটু আগেও বুঝি ওদের প্রাণ ছিল, হঠাৎ কেউ মন্ত্রোচ্চারণে ওদের বোবা করে দিয়ে গিয়েছে। অনুজ্জ্বল আলোর অপর্যাপ্ত আভা চারিদিককার ছবি ও মূর্তিগুলোর উপরে প্রতিফলিত হয়ে যেন সৃষ্টি করেছে কি এক ঘনীভূত রহস্যের!

কিরীটী শতদলবাবুর হাত হতে হ্যারিকেনটা নিয়ে উঁচু করে চারিদিকে ঘুরিয়ে একবার দেখতেই, সকলেরই আমাদের যুগপৎ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ঘরের পূর্বে কোণে মেঝেতে একটা ভারী কারুকার্যখচিত চওড়া বোঞ্জের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি মেঝেতে পড়ে আছে এবং তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কাঁচের টুকরো। বোঝা গেল ক্ষণপূর্বে আমরা ঐ ভারী ছবিটারই পড়ে গিয়ে ভাঙ্গার শব্দে নীচে থেকে সচকিত হয়ে উঠেছিলাম। কিরীটী নিঃশব্দে বাতিটা হাতে নিয়ে সর্বাগ্রে সেই দিকে গেল।

ছবিটা উবুড় হয়ে পড়ে আছে।

একটা মোটা তার দিয়ে দেওয়ালের গায়ে বড় একটা পেরেকের সাহায্যে ছবিটা দেওয়ালে টাঙানো ছিল। দেখা গেল ছবির সঙ্গে তারটাও অক্ষতই আছে, দেওয়ালের গায়ে পেরেকটাও ঠিক আছে। তবে ছবিটা এইভাবে মাটিতে খসে পড়ল কী করে?

কিরীটী হ্যারিকেনটা মেঝেতে একপাশে নামিয়ে রেখে নীচু হয়ে মাটি হতে ছবিটা তুলে সোজা করে দাঁড় করাল।

চোগা-চাপকান পরিহিত মাথায় পাগড়ি-আঁটা বিরাট এক পুরুষের প্রতিকৃতি অয়েলকলারে অঙ্কিত। প্রশস্ত ললাট, উন্নত খড়্গের মত নাসিকা, দীর্ঘ আয়ত চক্ষু এবং সেই চক্ষুর দৃষ্টি যেন মনে হয় সজীব এবং অন্তর্ভেদী।

ছবিখানা দুহাতের সাহায্যে একবার মাটি থেকে উঁচু করে কিরীটী বোধ। হয় ছবিটার ওজনটা পরীক্ষা করে আবার নামিয়ে রাখল, বেশ ভারী ছবিখানা! ওজনে অন্ততঃ পনের-ষোল সের হবে!

মৃদু আত্মগত ভাবেই যেন কথাগুলো কতকটা উচ্চারণ করল কিরীটী। তার পরই শতদলের দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, চেনেন শতদলবাবু এ ছবিটা কার?

না। এখানে আসবার পর একদিন মাত্র এ ঘরে ঢুকেছিলাম। এর আগে দু-একবার যা এখানে এসেছি, এই স্টুডিও-ঘরে কখনো প্রবেশ করিনি। দাদু কখনো কাউকে এ ঘরে ঢুকতে দিতেন না।

কেন? প্রশ্নটা করলাম এবারে আমিই।

তিনি ঠিক কারো এই স্টুডিও-ঘরে প্রবেশ করাটা পছন্দ করতেন না। বরাবরই লক্ষ্য করেছি, এই স্টুডিও-ঘরে প্রবেশ সম্পর্কে তাঁর যেন একটা sentiment ছিল। দিবারাত্র এই ঘরের মধ্যেই প্রায় রং-তুলি, ইজেল অথবা ছেনী-বাটালী নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকতেন। দীর্ঘকাল ধরে একবেলাই আহার করতেন শুনেছি রাত্রে। এও শুনেছি অনেক রাত্রে নাকি তিনি খাওয়ার কথা পর্যন্ত ভুলে যেতেন, এই ঘরের মধ্যে তাঁর রাত কেটে যেত

শিল্পীর সাধনা-ক্ষেত্রই বটে। শিল্পী রণধীর চৌধুরী যেন এখনো এই মূর্তি ও ছবিগুলোর মধ্যেই বেঁচে আছেন। নিভৃত এই কক্ষখানির মধ্যে তিনি আপনাকে যে একান্তভাবে সমর্পণ করেছিলেন এবং যে সমর্পণের ভিতর দিয়ে এই বিস্ময় তিল তিল করে গড়ে উঠেছে তারই সাক্ষ্য যেন কক্ষের চতুর্দিকে।

এই ঘরের চাবিটা?

সেটা তো আমি যে ঘরে থাকি সেই ঘরের আলমারির ড্রয়ারের মধ্যে থাকত একটা রিংয়ে অন্যান্য চাবির সঙ্গে।

দেখুন তো সে রিংয়ে চাবিটা আছে কিনা? কিরীটী শতদলকে অনুরোধ জানায়।

দেখছি, শতদলবাবু ঘর হতে বের হয়ে যাবার আগেই আবার কিরীটী বললে, শতদলবাবু just a minute, ঐ সঙ্গে kindly একটা টর্চও নিয়ে আসবেন।

শতদল ঘর হতে অতঃপর নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে এখন আমরা দুজনই—কিরীটী ও আমি। হ্যারিকেন-বাতির স্বল্প আলোয় কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম।

মুখের রেখায় রেখায় কোন কিছু একটা চিন্তার সুস্পষ্ট আভাস। তার ইতিপূর্বের ধীর মৃদু সংযত কণ্ঠস্বর ও নিস্ক্রিয়তা থেকেই বুঝেছিলাম, ঐ মুহূর্তে গভীর ভাবেই কোন একটা চিন্তা কিরীটীর মাথার মধ্যে পাক খেয়ে চলেছে। এবং ঐ সময়ে সে নিজ হতে স্বেচ্ছায় মুখ না খুললে কারো সাধ্য নেই তাকে কথা বলায়। বুঝতে পারছিলাম ছবিটা অমনি আকস্মিক ভাবে মাটিতে পড়ে গিয়ে ভাঙার ব্যাপারটা সে খুব সহজভাবে নেয়নি। শতদলের ক্ষণপূর্বের জবানিতে জানা গিয়েছে ঘরটা বন্ধ ছিল এবং এ ঘরের চাবিটাও তারই ঘরে ছিল। অথচ দেখা যাচ্ছে ঘরের দরজায় কোন তালা নেই-দরজা খোলা এবং ঘরের মধ্যে ঐ ছবিটা ভগ্ন কাঁচের টুকরোর মধ্যে পড়ে আছে। আরো ভাঙার শব্দটা কিছুক্ষণ পূর্বে আমরা নিচের তলা থেকেই শুনেছি। ছবিটা আপনা হতেই পড়ে গিয়ে যে ভাঙেনি তারও প্রমাণ পাচ্ছি।

সব কিছু পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এ কথাটা স্বতঃই মনে হচ্ছে, কেউ নিশ্চয়ই এ ঘরে এসেছিল। এবং ছবিটা পাড়তে গিয়ে বা নামাতে গিয়ে দেওয়াল থেকে আচমকা অসাবধানতাবশতঃ তার হাত থেকে হয়তো মাটিতে পড়ে গিয়ে কাচটা ভেঙেছে। খুব সম্ভব সেই কারণেই হয়তো তাকে আচমকা ঘটনাবিপর্যয়ে স্থানত্যাগ করতে হয়েছে।

এক্ষেত্রে তাহলে বক্তব্য হচ্ছে, কেউ না কেউ কিছুক্ষণ আগে এ ছবিটার জন্য এ-ঘরে এসেছিল। যেই আসুক! কিন্তু কেন?

এ ছবিটার প্রয়োজন নিশ্চয় ছিল তার। কিন্তু কেন? কী প্রয়োজন ছিল তার?

ওজনে অত ভারী এবং আকারে অত বড় ছবিটা চট করে কোথায়ও নিয়ে যাওয়া বা লুকোনোও তো সহজ নয়। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, তার ছবিটা সরাবার বা কোথাও নিয়ে যাওয়ার ঠিক প্রয়োজন ছিল না, কেবল হয়তো ছবিটা দেওয়াল হতে নামিয়ে দেখতেই চেয়েছিল সে। কিন্তু ছবিটা দেখবারই যদি প্রয়োজন ছিল তার, দেওয়ালে টাঙানো অবস্থাতেও তো দেখতে পারত? দেওয়াল হতে নামাবার কী প্রয়োজন ছিল?

বাইরে এমন সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। বুঝলাম শতদলবাবু চাবির রিং ও টর্চ নিয়ে এই ঘরেই আসছে।

অনুমান মিথ্যা নয়। শতদলবাবুই ঘরে এসে প্রবেশ করলেন এবং নিঃশব্দে চাবির রিংটা ও পাঁচ-সেলের একটা হান্টিং টর্চ কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন।

ডান হাতে চাবির রিংটা ধরে বাম হাতে টর্চটা নিল কিরীটী।

এই রিংয়ের মধ্যেই এই ঘরের তালার চাবিটা ছিল? কিরীটী শতদলকে প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। দেখুন তো সে চাবিটা আছে কি না? সু বাতিটা একটু তুলে ধর। কিরীটীর নির্দেশমতো বাতিটা আমি তুলে ধরলাম।

চাবির গোছাটা কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে শতদল মৃদুকণ্ঠে বললে, এই তো, চাবিটা রিংয়ের মধ্যেই আছে দেখছি।

একটা বড় আকারের চাবি গোছার ভিতর থেকে আলাদা করে কিরীটীর। সামনে ধরল শতদল।

চাবির রিংটা আপনার ঘরে যে আলমারির ড্রয়ারে ছিল বলছিলেন, সেটা কি চাবি দেওয়াই থাকত শতদলবাবু?

হ্যাঁ। চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলেই তো রিংটা নিয়ে এলাম।

ড্রয়ারের চাবিটা কোথায় ছিল?

আমার পকেটেই ছিল। সর্বদা পকেটেই রাখি।

আপনার ঘরটা কি সাধারণতঃ যখন আপনি থাকেন না, তালা দেওয়া থাকে

না।

কিরীটী অতঃপর টর্চের আলো ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে কী যেন দেখল, এরং ফিরে এসে বললে, তালাটা নেই দেখছি। ভাল কথা, আজ কখন আপনি বাইরে বের হয়েছিলেন? কতক্ষণই বা বাইরে ছিলেন শতদলবাবু?

প্রায় গোটা-চারেকের সময় বাইরে গিয়েছি–

যাওয়ার সময়ও এই ঘরের দরজার সামনে দিয়েই আপনি গিয়েছিলেন, তখন লক্ষ্য করেছিলেন কি, এই ঘরের দরজার তালাটা ছিল কিনা?

না, লক্ষ্য করিনি।

কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

থানায় গিয়েছিলাম দারোগাবাবুকে গতরাত্রের ব্যাপারটা জানাতে।

দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা হল?

হয়েছে।

হোটেলে কখন গিয়েছিলেন?

থানায় ঘণ্টাখানেক ছিলাম, বোধ করি সাড়ে ছটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছাই। সেখানে আপনাদের না পেয়ে বরাবর এখানে ফিরে আসি।

হুঁ। আচ্ছা একটা কথা বলতে পারেন, শতদলবাবু হিরন্ময়ী দেবীরা এখন নিচের মহলে যে ঘরটায় আছেন সেই ঘরের দেওয়ালে পাশাপাশি যে দুটি মহিলার ছবি টাঙানো আছে তাঁরা কারা?

আমি লক্ষ্য করে দেখিনি তো! বিস্মিত দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শতদল জবাব দেয়।

দেখেননি? কাল একবার দিনের বেলা ছবি দুটো ভাল করে দেখে আমাকে বলবেন তো, চিনতে পারেন কিনা ছবি দুটো কার? কতকটা যেন নির্দেশের সুরেই কথাগুলো বললে কিরীটী।

কিরীটী প্রস্তাবে শতদল যেন একটু ইতস্ততঃ করে বলে, উনি মানে আপনার ঐ হিরন্ময়ী দেবী, আমাকে ঠিক যেন পছন্দ করেন বলে আমার মনে হয় না মিঃ রায়। কাজেই তাঁর ঘরে যাওয়া–

অবিশ্যি যদি কিছু মনে না করেন—আপনার ওরকম মনে হওয়ার কোন কারণ আছে কি?

থাকলেও অন্ততঃ আমি জানি না মিঃ রায়, কারণ এবারে এখানে আসবার পূর্ব পর্যন্ত ওঁদের সঙ্গে আমার কোন চেনা-পরিচয়ই ছিল না।

হরবিলাসবাবু, হিরন্ময়ী দেবী ও ওঁদের মেয়ে ঐ সীতা—এদের কারও সঙ্গেই পূর্বে আপনার আদৌ কোন পরিচয় ছিল না আপনি বলতে চান শতদলবাবু?

প্রশ্নটার মধ্যে যেন কোন গুরুত্ব নেই, কথার পিঠে কথাপ্রসঙ্গে এসে গিয়েছে এমনি ভাবেই অত্যন্ত শান্ত ও নির্লিপ্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে ইতিমধ্যে হাতের টর্চটা জেলে তার আলোয় কিরীটী ঘরের চতুর্দিকে দেওয়ালে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। শতদল মুহূর্ত কাল চুপ করে থেকে মৃদু সংযত কণ্ঠে জবাব দিল, না।

আচমকা কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল শতদলের মুখোমুখি হয়ে এবং তার স্বাভাবিক অনুসন্ধানী চাপা অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ছিল না?

না।

মুহূর্তের জন্য কিরীটীর কণ্ঠে যে অনুসন্ধিৎসা জেগে উঠেছিল তার পরবতী প্রশ্নে যেন তার আর লেশমাত্রও অবশিষ্ট রইল না, আপনার সঙ্গে ওঁদের পূর্ব-পরিচয় যদি কিছু না-ই থেকে থাকে, তাহলে হঠাৎই বা হিরন্ময়ী দেবী আপনাকে অপছন্দ করতে যাবেন কেন?

তাহলে কথাটা আপনাকে খুলেই বলি মিঃ রায়, যদিচ কারণটা আমার কাছে একান্তই হাস্যাপদ বলে মনে হয়। হিরন্ময়ী দেবী দাদুর মত্যুর পর আমার এভাবে এখানে আসাটাই যেন পছন্দ করেননি। আমি না এলে দাদুর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী তো তিনিই হতেন, যদিচ দাদুর সম্পত্তির মধ্যে তো এই বাড়িখানা ও একগাদা ছবি ও মূর্তি। আমার কাছে তো এর কোন মূল্যই নেই আর দাবিও করব না। একা মানুষ, বিয়ে-থাও করিনি, হ্যাঁ। মাইনে পাই প্রফেসারি করে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। এ কথা এখানে আসবার পরই ওদের আমি বলেছিলাম, কিন্তু

কিন্তু কী

কিন্তু উনি জবাব দিলেন, যতটুকু তাঁর প্রাপ্য তার এক কড়াক্ৰান্তিও উনি বেশী চান না এই সম্পত্তির!

হুঁ। মনে কিছু করবেন না শতদলবাবু একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল এবং না বলেও পারছি না—

নিশ্চয়ই, বলুন না?

প্রথমে যেদিন সৈকতে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়, মনে আছে নিশ্চয়ই আপনার, আপনি কথায় কথায় বলেছিলেন, যতদূর আমার মনে পড়ে যে শিল্পী রণধীর চৌধুরীর বিরাট সম্পত্তির শেষ ও একমাত্র অবশিষ্ট তাঁর এই নিরালার ওয়ারিশ আপনি। তাই নয় কি?

কিরীটীর অমন সোজা ও স্পষ্ট অভিযোগে শতদল প্রথমটায় কেমন যেন একটু বিহ্বল হয়েই পড়ে, কিন্তু মুহূর্তে সে বিহ্বলতাটুকু কাটিয়ে হাস্যতরল কণ্ঠে বলে ওঠে, হ্যাঁ বলেছিলামই তো এবং এখনও তাই বলব, কিন্তু ওঁরা সে কথা মানতে চান না।

মানতে চান না কেন? রণধীরবাবুর কোন উইল নেই?

উইল-সেটাকে উইলই বলা চলে, মানে দাদুর লেখা একখানি চিঠি আমার কাছে আছে যেটা অনায়াসে আইনের চোখে উইলের সমপর্যায়ে পড়ে।

ওঃ, তবে সেটা ঠিক উইল নয়?

না। ঠিক উইলের খসড়ায় ফেলে রেজেস্ট্রী করবার বা কোন আইনজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করবারও হয়তো তিনি সময় পাননি, কারণ সেটাকে চিঠিই বলুন বা উইলই বলুন, তাঁর মত্যুর মাত্র দিনসাতেক আগে লেখা–

সেই উইলে কী আছে?

চলুন না আমার ঘরে—ঐ ঘরের দেওয়াল-সিন্দুকেই উইলটা আছে—

 যাবখন, তবু বলুন না আপনি কী লেখা আছে সেই চিঠিতে?

বিশেষ কিছুই না, লেখা আছে এই নিরালা ও এ-বাড়ির যাবতীয় সব কিছু আমাকে তিনি দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মৃত্যুর পরে।

বাইরের দালানে এমন সময় অস্পষ্ট পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং ঘরের মধ্যস্থিত একমাত্র হ্যারিকেন বাতিটা, হঠাৎ মনে হল, কেমন যেন তার আলোর শিখাটা নিস্তেজ হয়ে আসছে।

আলোটার দিকে দৃষ্টি আমারই প্রথম পড়ল, আলোটায় তেল নেই বলে যেন মনে হচ্ছে শতদলবাবু!

আমার কথায় আকৃষ্ট হয়ে কিরীটী ও শতদল দুজনেই আলোটার দিকে তাকাল।

আলোটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে।

পদশব্দটা ঠিক দরজার গোড়ায় এসে থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষবারের মত বার-দুই দপ দপ করে আলোর শিখাটা কেঁপে নিবে গেল হঠাৎ।

অত্যন্ত আকস্মিক ভাবেই যেন আলোর শিখাটা নিবে গেল।

অন্ধকার। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার হতে যেন আমাদের সমস্ত দৃষ্টিকে গ্রাস করল।

অন্ধকারে কিরীটীর গলা শোনা গেল, কে? কে ওখানে?

কথার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর হস্তধৃত পাঁচ-সেলের হানটিং টর্চের সতীব্র অনুসন্ধানী আলোর রশ্নিটা উন্মুক্ত দ্বারপথে গিয়ে পড়ল।

কে?

চিনতে কষ্ট হল না টর্চের আলোয়। দরজার ঠিক ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে এ-বাড়ির পুরাতন ভৃত্য অবিনাশ।

আজ্ঞে আমি অবিনাশ! অবিনাশ জবাব দিল, আমায় ডাকছিলেন দাদাবাবু?

হ্যাঁ। কোথায় থাক তোমরা? আলোগুলোতে তেল থাকে কি না থাকে সেদিকেও তোমাদের এতটুকুও নজর নেই, কী কর যে সব সারাদিন বসে বাড়িতে? ঝাঁজালো বিরক্তি-পূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন শতদলবাবু।

কেন? আজ দুপুরেও সব বাতিতে তেল ভরে দিয়েছি!

তেল ভরেছ তো বাতি নিবে যায় কি করে? যাও, আর একটা বাতি নিয়ে এস শিগগির করে।

যাই। অবিনাশ নিঃশব্দে চলে গেল।

কিরীটী হস্তধৃত টর্চের আলো ফেলে ঘরের মেঝেটা আবার দেখতে লাগল। যে জায়গায় দেওয়াল থেকে ছবিটা মেঝেতে পড়েছিল তার চারিদিকে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত।

দেওয়ালের গায়ে যেখানে ছবিটা টাঙানো ছিল কিরীটী সেখানে আলো ফেলল, তারপর আবার ঘরের চারিদিকে অনুসন্ধানী আলো ফেলে মৃদুকঠে বললে, কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই, আশ্চর্য! টুলটা দেখছি না–গেল কোথায়?

কী বললেন মিঃ রায়? প্রশ্নটা করলেন শতদলবাবুই।

একটা টুল–

টুল! বিস্মিত কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন শতদল।

হ্যাঁ, টুল বা ঐ জাতীয় একটা কিছু– হ্যাঁ ভাল কথা, আপনার কাছে মজবুত তালা আছে শতদলবাবু?

তালা! তা আছে বোধ হয়—

নিয়ে আসুন। ঘরটা তালা দিয়ে রাখতে হবে।

শতদলবাবু ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

কিরীটী হাতের আলোটা ততক্ষণে ভূপতিত ছবিটির উপরে ফেলেছে এবং আমাকে এবারে লক্ষ্য করে বললে, ছবির ফ্রেমটা কিসের তৈরী বলে মনে হয় সু?

ছবি—মানে ঐ ছবির ফ্রেমটা?

হ্যাঁ। চেয়ে দেখ ছবির ফ্রেমটা একটু যেন peculiar! ব্রোঞ্জ-জাতীয় কোন মেটালের তৈরী। এবং যেমন মজবুত তেমনি ভারি। ওয়াটার-কলার একটা ছবি ও তার কাঁচের ওজন এত বেশী হতে পারে না। ছবিটার যা-কিছু ওজন ওই ফ্রেমটার জন্যই। কথাগুলো বলে সহসা যেন অতঃপর কতকটা স্বগতোক্তির মতই আস্তে আস্তে বললে, কিন্তু কেন?

কী বললি! প্রশ্নটা করলাম আমিই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।

ভাবছি ছবির ফ্রেমটার কথাই। বিনা প্রয়োজনে এ জগতে কিছুই তৈরী হয় না, সু। ছবির ফ্রেমটাও নিশ্চয়ই ঐভাবে তৈরী করবার আর্টিস্টের কোন একটা উদ্দেশ্য ছিল।

হয়তো ছবিটাকে মজবুত ও টেকসই করবার জন্যই।

There you are! You are cent per cent right, সু।

বাইরে এমন সময় পদশব্দ শোনা গেল।

অবিনাশ একটা আলো হাতে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।

হঠাৎ কিরীটী অবিনাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, পায়ে তোমার বুঝি চোট লেগেছে অবিনাশ?

কিরীটীর আচমকা প্রশ্নে অবিনাশ যেন একটু চমকে থতমত খেয়ে বলে, আজ্ঞে?

কেমন একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছ দেখছি কিনা। পায়ে চোট লেগেছে নাকি? বেশ মোলায়েম কণ্ঠে কিরীটী আবার শুধোয়।

আজ্ঞে ঠিক খুঁড়িয়ে নয়, তবে জন্ম হতেই বাঁ পা-টা একটু খাটো কিনা, তাই একটু টেনে চলতে হয় চিরদিনই।

শতদলবাবু এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। হাতে তাঁর একটা ভারী পিতলের বড় তালা ও একটা চাবি।

এই নিন তালা কিরীটীবাবু! তালা ও চাবিটা এগিয়ে দিল শতদল কিরীটীর দিকে।

হ্যাঁ, দিন। কিরীটী তালা ও চাবি শতদলবাবুর হাত থেকে নিল, চাবি কি এই একটাই, না duplicate key আছে?

আছে।

সেটা কোথায়?

ও-ঘরে চাবির রিঙে আছে। এনে দেব কি?

না, থাক। চলুন বাইরে যাওয়া যাক।

সকলে আমরা বাইরে এলাম। কিরীটী নিজ হাতে দরজায় তালাচাবি দিয়ে চাবিটা নিজের জামার পকেটে রেখে দিল, এটা আমার কাছেই রইল শতদলবাবু। ডুপ্লিকেট চাবিটাও আমাকে দেবেন।

বেশ তো।

তারপর হঠাৎ যেন কথাটা মনে পড়েছে এইভাবে আলো হাতে দণ্ডায়মান অবিনাশের দিকে ফিরে তাকিয়ে কিরীটী তাকেই প্রশ্নটা করলে, ভাল কথা অবিনাশ, আজ এই কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যার দিকে তুমি যখন আমাদের সদর দরজা খুলে দিতে গিয়েছিলে, বলেছিলে না, বড়বাবু মানে হরবিলাসবাবু, তোমাকে আমাদের আসবার কথাটা জানতে পেরেই সদর দরজাটা খুলতে পাঠিয়েছিলেন

অ্যাজ্ঞে! মৃদুকন্ঠে অবিনাশ জবাব দিল।

আমরা যখন এ-বাড়ির সদরে এসে বাইরে থেকে ঘণ্টার দড়ি নাড়া দিই, তুমি আর তোমার বড়বাবু, কোথায় ছিলে?

আমি রান্নাঘরের দিকে ছিলাম—

আর বড়বাবু?

বড়বাবু রান্নাঘরের সামনে অন্ধকার বারান্দায় পায়চারি করছিলেন।

হুঁ। ভুখনা কোথায় ছিল?

সে তো রান্নাঘরেই ছিল। পূর্ববৎ মৃদুকণ্ঠে অবিনাশ জবাব দেয়, রান্না করছিল বোধ হয়।

হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পার। আলোটা এইখানেই রেখে যাও।

অবিনাশ কিরীটীর নির্দেশমত হাতের হ্যারিকেনটা বারান্দায় নামিয়ে রেখে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

একদৃষ্টে কিরীটী অবিনাশের গমনপথের দিকে তাকিয়ে ছিল।

এবার আমিও স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, সত্যিই অবিনাশ যেন তার বাঁ পা-টা একটু টেনেটেনেই চলছে। যতক্ষণ অবিনাশকে দেখা গেল, কিরীটী একদৃষ্টে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। ক্ৰমে অবিনাশ সিঁড়ি-পথে নেমে নিচের দিকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কিরীটী শতদলের দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, একটা ব্যাপার কখনো লক্ষ্য করেছেন শতদলবাবু—আপনাদের ঐ পুরনো চাকর অবিনাশের চলাটা একটু defective! মানে চলবার সময় বাঁ পা-টা একটু টেনে টেনে চলে?

কই, না? কখনো লক্ষ্য করিনি তো? শতদল জবাব দেয়।

লক্ষ্য করেননি? আশ্চর্য!

না, সত্যি লক্ষ্য করিনি। তবে সাধারণতঃ ও একটু আস্তেই যেন চলাফেরা করে বলে মনে হয়। শতদল বললে।

চলুন আপনার ঘরে যাওয়া যাক। কিরীটী যেন তার নিজের দিক হতেই উত্থিত ক্ষণপূর্বের প্রশ্নটা অতঃপর এড়িয়ে গিয়ে শতদলবাবুর শয়নকক্ষের দিকে সবাগ্রে পা বাড়াল।

সকলে এসে আমরা কিরীটীর পিছু পিছু শতদলবাবুর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এক কোণে একটা উঁচু, টুলের ওপরে সাদা ডোম-ঢাকা আলো জ্বলছে। সমস্ত ঘরটা কিন্তু তবু সমানভাবে আলেকিত হয়নি। ঘর। আকারে বড় হওয়ার দরুনই বোধ হয় একটিমাত্র আলোয় সমস্ত ঘরটিকে তেমনভাবে আলোকিত করতে পারেনি। ঘরের একটিমাত্র জানালা ছাড়া বাকি সব কয়টি জানালাই বন্ধ। এবং একটিমাত্র ঐ খোলা জানালাপথে হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করছিল।

কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সর্বাগ্রে ঐ খোলা জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। আমিও কিরীটীকে অনুসরণ করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

দূরে সম্মুখে দৃষ্টির সামনে যেন একটা দিগন্তপ্রসারী কৃষ্ণ চাদর আর কানে ভেসে আসে একটানা একটা চাপা গর্জন অন্ধকার ভেদ করে। কিরীটীর হাতে তখন শতদলবাবুর দেওয়া পাঁচ সেলের হান্টিং টর্চটা। তারই আলো সম্মুখের দিকে ফেলল কিরীটী।

আলোর রশ্মিটা বহু দূর পর্যন্ত গেল—একেবারে এ-বাড়ির গেট পর্যন্ত।

হাতের আলোটা বার কয়েক কিরীটী নীচে চারিদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল, তারপর আলোটা নিবিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং শতদলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি তো বলছিলেন শতদলবাবু এ ঘরটা আপনার অনুপস্থিতিতে তালা দেওয়াই থাকে, তাই না?

হ্যাঁ।

আজও তালা দেওয়াই তো ছিল?

না, বোধ হয় তালা দেওয়া ছিল না।

ছিল না?

না, এসেও দেখলাম একটু আগে টর্চটা নিতে এসে-ঘরের দরজাটা কেবল ভেজানোই আছে, তালা লাগানো নেই। কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে, বিকালে বেরবার আগে যেন তালা দিয়েই গিয়েছিলাম। কী জানি, বোধ হয় তালা দিতে ভুলে গিয়েছি!

চাবিটা কোথায় ছিল?

আমার পকেটেই ছিল।

আপনার এ-ঘরের তালার কোন duplicate চাবি তো নেই? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে শতদলকে।

আছে, সেও ঐ চাবির রিঙের মধ্যেই।

দেখুন তো, রিঙের মধ্যে চাবিটা আছে কিনা? হ্যাঁ, ঐ সঙ্গে রিং থেকে স্টুডিয়োর ঘরের তালার duplicate চাবিটাও আমাকে খুলে দিন।

কিরীটীর নির্দেশে শতদলবাবু ঘরের কোণে রক্ষিত একটা কাঠের ভারী চেস্ট ড্রয়ারের টানা খুলে তার ভিতর হতে অনেকগুলো চাবির গোছাসমেত একটা রিং বের করলেন। চাবির রিং থেকে প্রথমেই শতদল স্টুডিও-ঘরের তালার ড়ুপলিকেট চাবিটা খুলে কিরীটীকে দিলেন; তারপর এ-ঘরের তালার ডুপ্লিকেট চাবিটা রিঙের চাবির মধ্যে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু রিঙের সমস্ত চাবিগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও প্রয়োজনীয় ডুপ্লিকেট চাবিটা খুঁজে পাওয়া গেল না।

কী হল, চাবিটা নেই? আমি প্রশ্ন করলাম।

আশ্চর্য, সত্যিই চাবিটা তো নেই দেখছি! বুঝতে পারছি না সুব্রতবাবু-পরশু তো যতদূর মনে পড়ছে দেখেছিলাম যেন রিঙের মধ্যে সে চাবিটা ছিল!

যাক, ও নিয়ে আর মিথ্যে ব্যস্ত হবেন না শতদলবাবু। আমি পূর্বেই অনুমান করেছিলাম চাবিটা পাওয়া যাবে না। কথাটা বললে কিরীটীই।

অনুমান করেছিলেন। বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান শতদল কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ। কিরীটীর কণ্ঠ হতে ছোট্ট সংক্ষিপ্ত জবাবটি উচ্চারিত হল।

আমি আপনার কথা তো ঠিক বুঝতে পারলাম না মিঃ রায়।

আপনিই হয়তো দু-চার দিনের মধ্যেই আমার কথার তাৎপর্যটা বুঝতে পারবেন, আমাকে আর কষ্ট করে বলতে হবে না শতদলবাবু। কিন্তু সেকথা থাক, আপনি যে একটু আগে কী একটা চিঠির কথা বলছিলেন, চিঠিটা একটিবার দেখতে পারি কি?

নিশ্চয়ই। শতদলবাবু এগিয়ে গিয়ে ঘরের একটা দেওয়াল-আলমারি খুলে তার ড্রয়ার থেকে একটা সাদা বড় আকারের রঙ ও তুলির সাহায্যে চিত্র-বিচিত্র খাম বের করে এনে কিরীটীর হাতে দিলেন।

কিরীটী শতদলবাবুর হাত হতে খামটা নিয়ে আলোর সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে লাগল। আমিও পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

খামটার উপরে রঙের বাহার যেন চিত্র-বিচিত্র হয়ে উঠেছে। মানুষের মুখ হতে শুরু করে পশু-পাখি, ফল-ফল, লতা-পাতা কী যে নেই তার ঠিকানা নেই!

অনেকক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে কিরীটী খামের উপরে আঁকা চিত্রগুলি দেখতে লাগল। খামের মুখটা খোলাই ছিল, অতঃপর তার ভিতর হতে একটা ভাঁজ-করা কাগজ টেনে বার করল।

আলোর সামনে ভাঁজ খুলে কাগজটা মেলে ধরল।

একটা চিঠিঃ চিঠির শীর্ষে ব্র্যাকেটের মধ্যে দুই লেখা।