০৪. ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে

এরা কে রাণু? ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে আমাদের ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করলেন।

রাণু যেন শতদলের আকস্মিক অন্তর্ধানে কতকটা আরাম অনুভব করে এবং একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার মা। ইনি মিঃ কিরীটী রায়, ইনি মিঃ সুব্রত রায়। মিঃ কিরীটী রায়ের নাম তুমি নিশ্চয়ই শুনে থাকবে মামি– বিখ্যাত রহস্যভেদী।

নমস্কার, মিঃ রায়—আমার স্বামীর নাম নিশ্চয়ই আপনি শুনে থাকবেন–স্যার আর. এন. মিত্র–

কোন স্যার আর, এন.? বিখ্যাত মার্চেন্ট, গত বৎসর সুইজারল্যান্ডে যিনি অপারেশন হতে গিয়ে মারা যান?

হ্যাঁ। পৃথিবীবিখ্যাত সার্জেনদের দিয়ে অপারেশন করানো হল এখান থেকে ফ্লাই করে গিয়ে…কিন্তু oh dear! He could not be saved– লেডি মিত্র হাতের দামী সুগন্ধযুক্ত রেশমী রুমালটা চোখের উপরে একবার বুলিয়ে নিলেন এবং মনে হল গলার স্বরটা যেন একটু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে।

হ্যাঁ, সংবাদপত্রে ঘটনাটা পড়েছিলাম। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।

শ্ৰীমতী রাণু তাহলে ক্রোড়পতি স্যার আর. এন.-এর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী এবং শ্রীমান শতদল তাহলে বেশ উঁচু ডালের দিকে হস্ত প্রসারিত করছে!

আসুন না, আমাদের ঘরে চলুন না। আপনারাও তো এই হোটেলে এসেই উঠেছেন? লেডি মিত্র তাঁর ঘরে আমন্ত্রণ জানালেন।

হ্যাঁ। আজ থাক মিসেস মিত্র, রাত হয়েছে। কিরীটী মৃদু প্রতিবাদ জানায়।

রাত আর এমন বেশী কি হয়েছে? লেডি মিত্র তাঁর সুডোল মণিবন্ধ চোখের সামনে তুলে ধরে দামী রিস্টওয়াচটার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তো সবে রাত পৌনে দশটা। আসুন আসুন, তিন-চার দিন হল এই হোটেলটায় এসে উঠেছি, তা একটা লোক পেলাম না যার সঙ্গে দু-দণ্ড আলাপ করা যেতে পারে। ও হোটেলটায় জায়গা পেলাম না, তাই কতকটা বাধ্য হয়েই এসে এই হোটেলটায় উঠতে হল। এত ভাল ভাল সী-সাইড থাকতে কেন যে রাণুর এই হতচ্ছাড়া নাস্টি জায়গাটাতে আসবার জন্যেই এত জেদ চাপল! আসুন মিঃ রায়, মিঃ সুব্রত, আপনিও আসুন।

তরল পানীয়ের প্রভাবে পেটের মধ্যে তখন আমার ক্ষুধার প্রচণ্ড আলোড়ন চলেছে। বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিরীটীকে মিসেস মিত্রকে অনুসরণ করতে দেখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকেও ওঁদের পশ্চাতে অনুসরণ করতে হল।

হোটেলের দোতলায় কোণের একটু বড় ঘর নিয়ে মাতা ও পুত্রী আছেন। এবং সঙ্গে এসেছে ওঁদের একজন বয়, একজন আয়া ও একজন দাই। এও দেখলাম ঘরে প্রবেশ করে যে, হোটেলের আসবাবপত্রের উপরেই ওঁরা একবারে নির্ভর করেননি, কিছু কিছু শয্যাদ্রব্য ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্র যা হয়তা তাঁরা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলেন, তারই সাহায্যে নিজেদের বাসের কক্ষটি যথাসাধ্য রুচিসম্মতভাবে সাজিয়েগুছিয়ে নিয়েছেন। ধনের প্রাচুর্য ও আভিজাত্যের চিহ্ন সর্বত্রই ঘরের মধ্যে পরিস্ফুট।

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে লেডি মিত্র বললেন, আসুন। May I offer you a drink Mr. Roy? লেডি মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

No, thanks! Just now we had one!

What about you Mr. Subrata Roy? এবারে আমার প্রতি প্রশ্ন বর্ষিত হল।

No, thanks!

বেশ, ড্রিঙ্ক না চান, চা-কোকো-কফি অর ওভালটিন?

বুঝলাম লেডি মিত্র নাছোড়বান্দা। অতিথিদের অন্ততঃ কিছু না পান করিয়ে সুস্থির হতে পারছেন না।

বেশ, তাহলে চা আনতে বলুন। কিরীটী জবাব দেয়।

বয়, চা লাও। বয়কে চায়ের আদেশ দিয়ে সোফাটার উপরে নিজে একটু ভাল করে গুছিয়ে বসে লেডি মিত্র আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসে বসে আলাপ করবার সময় কোন একটা ডিঙ্ক সঙ্গে না থাকলে আমি চিরদিনই যেন কেমন bored feel করি। আমার বহুদিনকার habit। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাণু, দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোসো!

রাণু এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়েই ছিল, মায়ের আদেশ পেয়ে আমাদেরই পাশের খালি চেয়ারটার ওপরে উপবেশন করল।

আমার only child এই, মিঃ রায়। লরেটো থেকে এবার সিনিয়ার কেমব্রীজ পাস করেছে। Oh dear, রণেনের ইচ্ছে ছিল রাণু বিলেত যায়, ওকে তার ব্যারিস্টারি পড়াবার কী ইচ্ছেই ছিল! But where is he now? সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দেখুন না—how cruel! আবার কণ্ঠস্বর তাঁর অশ্রুতে গদগদ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু কিরীটী কথার মোড়টা পালটে দিল।

সে বললে, আপনারা তাহলে কিছুদিন এখানেই থাকবেন, লেডি মিত্র?

হ্যাঁ, যতদিন না ওর আবার ইচ্ছে হয় ফিরে যাবার! বড্ড জেদী আর একগুঁয়ে মেয়ে আমার।

কিরীটী হাসতে হাসতে বলে, কিন্তু সামান্য ওঁর সঙ্গে আমার যা আলাপ হয়েছে, তাতে মনে হয় she is really charming!

আপনিই বলুন তো মিঃ রায়, জায়গাটি really চমৎকার নয়? মামির ধারণা, এমন বিশ্রী জায়গা নাকি আর ভূ-ভারতে নেই! রাণুই এবারে জবাব দেয়।

বয় সুদৃশ্য চায়ের ট্রের ওপরে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এসে সামনের টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, আপনি বোধ হয় হোটেলের বাইরে যাননি লেডি মিত্র, গেলে দেখতেন বাইরের দৃশ্য এখানকার সত্যিই চমৎকার!

আমার আবার পায়ে হেঁটে বেড়াতে এমন বিশ্রী লাগে! লেডি মিত্র জবাব দিলেন।

তা অবশ্য ঠিক, পায় হেঁটে বেড়ানোও আপনার অভ্যাস নেই, ভালো তো লাগবেই না আপনার। কিরীটী লেডি মিত্রের কথায় সায় দিয়েই কতকটা যেন বলে ওঠে।

এমন চমৎকার সী-সাইডে কেউ আবার গাড়িতে চেপে বেড়ায় নাকি, মামির যেমন উদ্ভট সব, রাণু প্রতিবাদ জানায়।

শুনছেন মিঃ রায় আমার মেয়েটির কথা?

তা তো সত্যি, অভ্যাস না থাকলেও, কিরীটী আবার বলে।

অভ্যাস! অভ্যাস আবার কী? দুদিন হেঁটে বেড়ালেই অভ্যাস হয়ে যায়। মেয়ে বলে উঠে।

না মিস মিত্র, তারও একটা বয়স আছে। কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে বলে।

সে রাত্রে আমাদের আহার শেষ করতে করতে প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।

দুজনে এসে হোটেলের বারান্দায় দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে পাশাপাশি বসলাম। হোটেলটি ইতিমধ্যেই যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘরে ঘরে যে যার শয্যা নিয়েছে রাত্রের মত। বোধ হয় কেবল আমরা দুজনেই জেগে এখনও।

বালুবেলার উপর অদূরে গর্জমান সমুদ্রের ঢেউগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে কলচ্ছাসে। ভাঙা ঢেউইয়ের চূর্ণগুলোতে মধ্যে মধ্যে ফসফরাসের সোনালী চমকি ঝিলমিল করে ওঠে। দিবারাত্র একটানা ঢেউ ভেঙে-গড়েই চলেছে যেন

সমুদ্রের খেলা। ওর চোখে কি ঘুম নেই!

আমিই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলাম, ব্যাপার কী বল তো কিরীটী, লেডি মিত্রকে হঠাৎ অত তোষামোদ করতে শুরু করলি কেন?

ভদ্রমহিলাকে যখন একটু তোষামোদপ্রিয়ই দেখলাম, আগে থাকতেই খানিকটা তোষামোদ করে ভবিষ্যতের জন্য হাতের মধ্যে রেখে দিলাম, প্রয়োজন হলে কাজে লাগানো যাবে।

তোর মতলবটা কি সত্যি করে বলবি? সত্যিই কি তুই সকালবেলাকার কী একটা accident হয়ে গিয়েছে, সেটার ভূতকে এখনো কাঁধে করে বেড়াচ্ছিস?

হ্যাঁ রে, কতকটা সেই সিন্দবাদ নাবিকের অবস্থা। কিন্তু আমার কথা যদি বিশ্বাস করিস তাহলে বলতে পারি, সকালবেলাকার ব্যাপারটা যোগসূত্রহীন সামান্য একটা এলোমেলো দুর্ঘটনাই নয়। পর পর কতকগুলো দুর্ঘটনা, যেগুলো একসূত্রে গাঁথলে শেষ পর্যন্ত হয়তো গিয়ে দাঁড়াবে একটা মার্ডার বা নিষ্ঠুর হত্যায়!

You mean

হ্যাঁ I mean শীঘ্রই যদি আমার পূর্বে দূরদৃষ্টির ক্ষমতা না নিঃশেষ হয়ে গিয়ে থাকে, অমি নিশ্চয় করে বলতে পারি, I can hear the footsteps! হ্যাঁ সুব্রত, আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি নিষ্ঠুর মত্যু নিঃশব্দে ফেলে এগিয়ে আসছে অবশ্যম্ভাবী অবধারিত। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার সুস্পষ্ট আভাস। কিরীটী তখনও তার বক্তব্য শেষ করেনি, কিন্তু আমার চোখে যখন ব্যাপারটা পড়েছে, আমি চেষ্টা করব to my last to stop it! প্রতিরোধ করতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

তোর কি স্থির বিশ্বাস তাহলে something is going to happen? কোনো একটা কিছু শীঘ্রই ঘটবে?

হ্যাঁ, যদি আমার ক্যালকুলেশন ভুল না হয়, চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই আবার একটা চেষ্টা হবে। বার বার চারবার।

কিরীটীর অনুমান যে কতখানি নির্ভুল, পরের দিন সকালেই সেটা জানা গেল।

খুব ভোরে উঠেই আমি, কিরীটী ও রাণু নিরালার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম।

ভোরের আলো তখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সমুদ্রের বুকে একটা আলোছায়ার পর্দা যেন থির থির করে কাঁপছে। শীতের সকাল হলেও কোথাও কুয়াশার লেশমাত্র ছিল না। আকাশের প্রান্তে শুকতারাটা নিভে যায়নি তখনও।

নিরালার লৌহফটকের সামনে এসে আমরা যখন পৌঁছলাম, পূর্ব দিগন্ত যেখানে জলকে আলিঙ্গনের মধ্যে টেনে নিয়েছে, সেখানটা সূৰ্য-সারথির রথচক্রের ঘর্ষণে ঘর্ষণে ও সপ্ত অশ্বের খুরের আঘাতে যেন রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে।

গতকাল সন্ধ্যার মত লৌহফটক খোলাই ছিল, ফটক ঠেলে তিনজনে আমরা কম্পাউণ্ডের ভিতরে প্রবেশ করলাম।

একটু অগ্রসর হতেই হরবিলাসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। কালো রঙের একটা ওভারকোট গায়ে, হাত দুটো পকেটের মধ্যে প্রবিষ্ট করে হাঁটতে হাঁটতে হরবিলাস গেটের দিকেই এগিয়ে আসছিলেন।

এই যে মিঃ ঘোষ, সুপ্রভাত! কিরীটীই প্রথমে সুপ্রভাত জানাল।

হরবিলাসও আমাদের শুভ প্রভাত জানালেন প্রত্যুত্তরে, সুপ্রভাত। খুব সকালেই এসেছেন দেখছি! যান, শতদল বোধ হয় বসেই আছে। সারাটা রাত বেচারা শোবার ঘরে খিল তুলে বসে আছে, পাশে একটা লোডেড রিভলভার নিয়ে।

ব্যাপার কী? কোন দুর্ঘটনা? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্ন করে।

কী জানি মশাই, রাত দুটো-আড়াইটের সময় হঠাৎ পর পর দুটো বন্দুকের গুলির শব্দে চমকে উঠে—

বন্দুকের গুলির শব্দ! প্রশ্নটা এবারে করলাম আমি।

হ্যাঁ। চট করে রাত্রে ঘুম আসে না, তাই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে বই পড়ি। কালও রাত্রে বসে বসে নিজের ঘরে একটা বই পড়ছিলাম, হঠাৎ বন্দুকের গুলির আওয়াজ, তারই কিছুক্ষণ পরে শতদল ও অবিনাশের চেঁচামেচি শুনে অন্দরের দিকে ছুটে যাই। শতদলের ঘরে গিয়ে দেখি, বেচারী অত্যত নার্ভাস হয়ে পড়েছে। ঘুম আসছিল না বলে জেগে টেবিলের আলোয় বসে কী একটা বই পড়ছিল, এমন সময় হঠাৎ বন্দুকের গুলির আওয়াজ ও সঙ্গে সঙ্গে টেবিলল্যাম্পের চিমনিটা ভেঙে চুরমার হয়ে ঘর আঁধার হয়ে যায়। ও কিছু বোঝবার আগেই অন্ধকারেই আবার একটা গুলি এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। কী ভয়ানক ব্যাপার বলুন তো মিঃ রায়! ও বলে, কেউ ওকে হত্যা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু হঠাৎ কে আবার শতদলকে হত্যা করবার চেষ্টা করবে বলুন তো? আমি তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ও নিজেও এমন ঘাবড়ে গিয়েছে যে, বাকি রাতটকু বোধ হয় শোয়ওনি। চলুন, আপনি এসেছেন ভালই হল, ওকে একটু সাহস দিয়ে যান।

হরবিলাস গতরাত্রের ব্যাপারটায় যে বেশ একটু উত্তেজিতই হয়ে উঠেছেন, ওঁর কথাবার্তাতেই সেটা বোঝা গেল এবং ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট উত্তেজনার খোরাক থাকা সত্ত্বেও কিরীটীকে কিন্তু একান্ত নির্বিকার বলেই মনে হতে লাগল। অস্বাভাবিক বা অত্যাশ্চর্য কিছুই তেমন ঘটেনি, শান্ত ও নির্বিকার কণ্ঠেই সে এবারে হরবিলাসবাবু কে প্রশ্ন করল, তা এত সকালে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?

সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। গতরাত্রে আপনারা চলে যাবার পর আমার স্ত্রীর মুখে আপনাদের অনেক কীর্তিকাহিনীই শুনেছি, তাতে করে আমার মনে হল এ ব্যাপারে আপনিই যোগ্য ব্যক্তি বেচারীকে একটা পরামর্শ দেবার।

কেন, শতদলবাবু কি বলেননি আজ সকালে আমাদের তিনি চায়ের নেমন্তন্ন করেছেন, আমরা আসব? কিরীটী দ্বিতীয় প্রশ্ন করল।

কই, না তো! সবিস্ময়ে জবাব দিলেন হরবিলাস।

ও, আচ্ছা চলুন দেখি।

হরবিলাসবাবুকে অনুসরণ করে আমরা তিনজন অগ্রসর হলাম। সংবাদটা শোনা অবধিই লক্ষ্য করছিলাম, রাণুর মুখের পরিবর্তন। রাণু যেন সত্যিই বিস্মিত ও হতচকিত হয়ে গিয়েছে। রাণু, আমার ও কিরীটীর মধ্যবর্তিনী হয়ে পথ চলছিল, সহসা একসময় চাপা কণ্ঠে কিরীটীকে সে প্রশ্ন করল, আপনি শতদলকে সাবধান করে দিয়েছেন, কালই সকালে আমাকে বলছিল! আপনার নাকি ধারণা, ওকে মারবার জন্য কেউ attempt নিচ্ছে! শতদল তো বিশ্বাস করেইনি, সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমিও করিনি। কিন্তু এ-সব কী শুনছি—how horrible!

         বিশ্বাস করেননি ভুলই করেছেন, এবারে বোধ হয় বিশ্বাস করবেন! কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।

অন্দর ও বহির্মহলের মধ্যে যোগাযোগের দ্বারটা, সেটা অন্দর থেকে বন্ধই ছিল। বাইরের দরজায় একটা দড়ি ঝুলছিল, হরবিলাসবাবু, সেটা ধরে বার-দুই টান দিতেই অন্দর থেকে একটা অস্পষ্ট ঘণ্টাধনি শোনা গেল এবং অল্পক্ষণ পরেই দরজাটা খুলে গেল। দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ল খোলা দ্বারপথে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধগোছের লোক। লোকটার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে তো নিশ্চয়ই। রোগা ও বেটেমত চেহারা। দেহের সমস্ত মাংসপেশীগুলো যেন একেবারে শণের দড়ির মত পাকিয়ে গিয়েছে। মাথার চুলগুলো কাঁচায়-পাকায় মেশানো। লোকটার পরিধানে একটা ধোপদুরস্ত ধুতি ও হাতকাটা গরম বেনিয়ান। বেনিয়ানের উপরে একটা চাদর জড়ানো।

অবিনাশ, শতদল কোথায়? প্রশ্ন করলেন হরবিলাসই।

বাবু তাঁর ঘরেই আছেন। এখনো দরজা খোলেননি। বাবুর কাছেই যাচ্ছিলাম, আপনাদের ঘণ্টা শুনে

এদের বাবুর ঘরে নিয়ে যাও।

আসুন—আজ্ঞে, অবিনাশ আমাদের আহ্বান জানাল।

একটা দীর্ঘ টানা বারান্দা পার হয়ে আমরা অবিনাশকে অনুসরণ করে প্রশস্ত শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে গিয়ে উঠলাম সকলে। উপরের তলাতেও ঠিক নিচের মতোই অনুরূপ একটি টানা বারান্দা। বারান্দার দু-পাশের দেওয়ালে সব বড় বড় ফ্রেমে বাঁধানো নানাপ্রকারের চিত্র টাঙানো। মধ্যে মধ্যে স্ট্যাণ্ডের উপরেও রক্ষিত জয়পুরী টবে পামট্রি। বাড়িটা যে কোন এক শিল্পীর, বুঝতে সেটা আদৌ কষ্ট হয় না। বারান্দার শেষপ্রান্তে যে বন্ধ ঘরটার সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম, তারই ঠিক দরজার দুপাশে দুটো বহুদাকারের স্ট্যাচু একটি স্ট্যাচু হচ্ছে অপূর্ব একটি অর্ধউলঙ্গ নারীর এবং দ্বিতীয় স্ট্যাচুটি হচ্ছে একটি পুরুষের।

এই ঘরে আছেন বাবু। অবিনাশ বললে আঙুল তুলে ঘরটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিয়ে।

কিরীটী দরজার গায়ে নক করল টকটক করে এগিয়ে গিয়ে, মিঃ বোস! শতদলবাবু!

ভিতর হতে আহ্বান এল, কে?

আমি কিরীটী, শতদলবাবু দরজা খুলেন—

একটু পরেই দরজা খুলে গেল। সামনেই দাঁড়িয়ে শতদল। চমকে উঠলাম শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে। মাত্র এক রাত্রের মধ্যে এ কী চেহারা হয়েছে তার? সমস্ত মুখে শুধু যে রাত্রি-জাগরণের ক্লান্তি তাই নয়, একটা নিরতিশয় ভয় ও উৎকণ্ঠা যেন মুখের রেখায়-রেখায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এই যে মিঃ রায়, again there was an attempt last night! আবার কাল রাত্রে কেউ, somebody, আমাকে গুলি করে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। এখন স্পষ্টই বুঝতে পারছি মিঃ রায়, you were right! আপনার কথাই ঠিক–সত্যিই someone is after me! কেউ আমার পিছনে লেগেছে। কিন্তু কে এবং কেন? উত্তেজনায় শতদলের কণ্ঠস্বর যেন একেবারে ভেঙে পড়ে।

Dont be nervous! চলুন শতদলবাবু ঘরের মধ্যে চলুন। হরবিলাসবাবুর মুখেই এইমাত্র গতরাত্রের সমস্ত ব্যাপার শুনেছি, কিরীটী যেন একপ্রকার শতদলকে ঠেলেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

আমরাও পিছনে পিছনে তার ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

দেখবেন, সাবধান, কাঁচের টুকরো এখনো ঘরময় ছড়িয়ে আছে! সাবধান করে দিলেন আমাদের শতদলবাবু।