০৩. হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন

হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন, সীতার কুকুর টাইগারটা অমন করে চেঁচাচ্ছে কেন?

কিরীটী ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হরবিলাসবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, আজ এবার তাহলে আমরা উঠি মিঃ ঘোষ!

উঠবেন? এখনি উঠবেন? হিরন্ময়ী দেবী প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, রাত হয়ে গেল। আবার কাল-পরশু আসব। শতদলবাবুকে তাহলে বলবেন আমরা এসেছিলাম।

বলব, দেখা হলে বলব। হরবিলাস জবাব দিলেন।

কেন, আপনাদের সঙ্গে কি দেখা-সাক্ষাৎ হয় না? এক বাড়িতেই তো—

এক বাড়ি হলে কি হয়? বাইরের মহলের সঙ্গে ভিতরের মহলের কোন যোগাযোগ নেই, সম্পূর্ণ পৃথক। আমরা থাকি বাইরের মহলে, তাই বড় একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। জবাব দিলেন হিরন্ময়ী দেবী।

হরবিলাসই আমাদের দোরগোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। এবং কিরীটীই তাঁকে অনুরোধ জানাল আর বেশী দূর না আসবার জন্যে।

আপনাকে আর গেট পর্যন্ত কষ্ট করে আসতে হবে না, মিঃ ঘোষ। এবারে আমরা নিজেরাই যেতে পারব।

না না, তাতে কি, চলুন না গেট পর্যন্ত।

না, আপনি যান।

হরবিলাস ফিরে গেলেন। পাশাপাশি আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম।

গেটের কাছাকাছি প্রায় এসেছি, হঠাৎ একটা চাপা ক্রুদ্ধ গর-র শব্দ শুনে দুজনেই থমকে দাঁড়াই।

শব্দটা লক্ষ্য করে সামনের অন্ধকারে গেটের ঠিক পাশেই চামেলী-ঝাড়টার দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টি আমার পাথরের মতই স্থির হয়ে গেল। অন্ধকারে দুটো আগুনের ভাঁটা যেন ক্রুদ্ধ জিঘাংসায় ধকধক জ্বলছে। অশরীরী কোন প্রেত যেন হিংস্রলোলুপ হয়ে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে।

গোঁ-গর-র একটা চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন।

আঃ Tiger, stop! Stop! চাপা মেয়েলী কণ্ঠের একটা নির্দেশ শোনা গেল।

সীতার গলা।

অন্ধকারে চামেলী-ঝোপটার নিচু থেকে ছায়ার মত নিঃশব্দে সামনের দিকে এগিয়ে এল সীতা এবং তার পাশে এগিয়ে এল প্রকাণ্ড একটা কালো আলসেসিয়ান কুকুর তো নয় যেন একটা বাঘ!

কিন্তু আশ্চর্য, কুকুরটা তার মনিবের নির্দেশে তখন একেবারে চুপ করে গিয়েছে—শান্ত, স্থির!

চলে যাচ্ছেন বুঝি? সীতা আবার প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ। আপনার ঐ টাইগারের ডাকই বুঝি একটু আগে শোনা গিয়েছিল! প্রশ্ন করল কিরীটী।

হ্যাঁ। অচেনা কারো সাড়া পেলে টাইগারটা যেন একেবারে ক্ষেপে ওঠে। বোধ হয় কোনমতে আপনাদের সাড়া পেয়েছিল। হাসতে হাসতে জবাব দেয়।

কিন্তু একটু দেরিতে পেয়েছিল বোধ হয় মিস ঘোষ! প্রত্যুত্তরে হাসতে হাসতে কিরীটী জবাব দেয়।

কিরীটীর ইঙ্গিতটা সীতা বুঝতে পারল কিনা বোঝা গেল না, কারণ জবাবে সে বললে, আর কখনো আপনাদের দেখলে ও গোলমাল করবে না। টাইগার, চিনে রাখ, এরা আমাদের বন্ধু। ভাল লোক।

কুকুরুটি আপনার কী খায় মিস ঘোষ? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

মাংস আর রুটি। জবাব দেয় সীতা।

আচ্ছা চলি, মিস ঘোষ, নমস্কার। কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে এগিয়ে গেল।

চলুন, নিচু পর্যন্ত আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি কিরীটীবাবু। এ পাহাড়টার উপর বেজায় সাপের উৎপাত।

তাই নাকি? কিরীটী চলতে চলতেই বলে।

হ্যাঁ। সব একেবারে ভয়ঙ্কর বিষধর গোখরো।

সাপকে বুঝি আপনার ভয় করে না? কিরীটী প্রশ্ন করে।

না, সঙ্গে টাইগার থাকলে এ জগতে কিছুকেই আমি ভয় করি না।

মিস ঘোষ, তার আর প্রয়োজন হবে না। আপনি ফিরে যান। আয় সুব্রত। কিরীটী বেশ দ্রুতপদেই গেট অতিক্রম করে পাহাড়ের গা দিয়ে ঢালু পথ বেয়ে এগিয়ে চলল। আমি কতকটা একপ্রকার বাধ্য হয়েই অতঃপর কিরীটীকে অনুসরণ করি।

এগিয়ে চলেছি অন্ধকার পথ ধরে আবার হোটেলের দিকে।

শীতের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি হলেও কালো আকাশটা তারায় তারায় যেন ঝকঝক করছে। বাঁয়ে কালো কালির মত গর্জন-উদ্বেলিত সমুদ্র।

মাঝামাঝি পথ আসতেই দূরে হোটেলের আলোগুলো অন্ধকার আকাশপটে ক্ৰমে ফুটে উঠতে লাগল। কিরীটী নিঃশব্দে পথ অতিক্রম করছিল, এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। কিন্তু কিরীটীর নিস্তব্ধতা আমাকে যেন কেমন পীড়ন করছিল। আমিই কথা বললাম, হিরন্ময়ী দেবীকে কেমন লাগল, কিরীটী?

কেন, ভদ্রমহিলা বেশ ভালই তো!

হরবিলাসের উপরে একটা অসাধারণ হোল্ড রয়েছে বলে যেন মনে হল!

স্বাভাবিক। ধনীর কন্যা বিবাহ করলে স্বামীকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় ও মধ্যে মধ্যে স্ত্রীর আজ্ঞাবহুও হতে হয়। বিশেষ করে আবার এক্ষেত্রে শ্রীমতী হিরন্ময়ী দেবীর মত প্রখর বুদ্ধিমতী নারীর কাছে হরবিলাসের একটা inferiority complx থাকাটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু তা তুই ভাবছিস না, অন্য কিছু ভাবছিস! আমি আবার কিরীটীর চিন্তান্বিত মনটাকে একটা খোঁচা দিয়ে আমার প্রতি সজাগ করে তোলবার চেষ্টা করি।

এবং কিরীটীর পরবর্তী জবাব শুনে বুঝলাম প্রচেষ্টা আমার একেবারে নিষ্ফল হয় নি। কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে জবাব দিল, শতদলবাবু যে আজ সকালবেলাতে বললেন এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী এখন তিনিই, তা তো কই মনে হচ্ছে না। তিনি নাতি এবং হিরন্ময়ী দেবী বোন। সেদিক দিয়ে শ্রীমতী সীতাও তো মালিকের নাতনী। আরো আছে কিনা তাই বা কে জানে!

এতক্ষণে বুঝতে পারি কিরীটীর বর্তমান চিন্তাধারাটা ঠিক কোন পথ ধরে চলেছে। সকালবেলাকার আকস্মিক দুর্ঘটনা থেকে শতদলের রহস্যটাই তার সমস্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এবং এও বুঝতে পারলাম, শতদলরহস্য মীমাংসিত না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে কিরীটী নড়বে না। সঙ্গে সঙ্গে আমারও নড়া চলবে না। অতএব অনির্দিষ্ট কালের জন্য এখন এখানেই অবস্থানও হবে অবধারিত।

বস্তুতঃ শতদলের রহস্যটা যে আমার মনকেও বেশ কিছুটা চঞ্চল করে তোলেনি তা নয়। কিন্তু কোন কিছুরই যেন হদিস পাচ্ছিলাম না। সকাল হতে কতকগুলো ছিন্ন ছিন্ন ঘটনা ও কয়েকটি বিভিন্ন চরিত্রের নর-নারী যার সংস্পর্শে আমরা এসেছি, কোন কিছুর মধ্যেই যেন একটা পূর্ণ যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সহসা একটা প্রশ্ন আমার মনের অন্ধকারে বিদ্যুৎ-চমকের মতই যেন ঝিলিক হেনে গেল, কিন্তু কিরীটীকে সে প্রশ্নটা করবার পূর্বেই সে আমাকে বললে, রাত আটটা বাজে প্রায়, একটু পা চালিয়ে চল সুব্রত, হোটেলের ক্লাব-ঘরে বহু জনসমাগম হয়, দেখা যাক আজ তাদের মধ্যে কারো সঙ্গে একটু-আধটু আলাপ-পরিচয় করা যায় কিনা। এতদিন এখানে এসেছি, হোটেলে আছি, অথচ কারো সঙ্গে আলাপ হল না! এ অন্যায়। চল।

হোটেলে এসে যখন পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা।

কিরীটী ও আমি সোজা একেবারে হোটেলের নিচের তলায় যে হলঘরটি স্থানীয় ক্লাব-ঘর বলে এখানে পরিচিত, সেই ঘরে এসে প্রবেশ করলাম।

প্রশস্ত হলঘরটি তখন হোটেলের ও স্থানীয় অধিবাসী নরনারীতে গমগম করছে। বলতে গেলে হোটেলে আসবার পর এই সর্বপ্রথম ঐ ঘরে আমাদের পদার্পণ।

হলঘরের একধারে কাউন্টার। সেখানে উর্দি-পরা হোটেলের ওয়েটার নানাজাতীয় কড়া ও নরম পানীয়ের বোতলগুলো সাজিয়ে তৃষিতজনদের পানীয় পরিবেশন করছে। মধ্যে মধ্যে ছোট-বড় সব চৌকো ও গোলাকর টেবিল ও চেয়ার পাতা। সেই চেয়ারগুলো অধিকার করে নানাবয়সী নরনারীর ভিড় জমেছে। উচ্চ ও চাপা হাসির গুঞ্জন ও তর্কাতর্কির শব্দে সমগ্র হলঘরটি মুখরিত। চারদিকেই সর্বত্র একটা আনন্দঘন উচ্ছাসের সাড়া। কেউ গল্প করছে, কেউ তাস খেলছে, কেউ দাবা, কেউ টেবিল-টেনিসু আবার কেউ কেউ বা পানীয়ের ক্লাসে নিয়ে বসে আছে ও মধ্যে মধ্যে এক-আধ সিপ ড্রিংক করে স্বপ্নালু দৃষ্টিতে আশেপাশে চেয়ে দেখছে।

ঘরের এক কোণে একটা গোলাকার খালি টেবিলের পাশে খানতিনেক খালি চেয়ার পড়েছিল। কিরীটী আমাকে আকর্ষণ করে সেই দিকে নিয়ে গেল। এবং নিজে একটা চেয়ারে বসে আমাকে বললে, বোস।

পকেট থেকে চামড়ার সিগারের কেসটা বের করে একটা সিগার কেস থেকে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, যস্মিন দেশে যদাচারঃ-কী খাবি বল?

চেয়ে দেখি ইতিমধ্যে আমাদের চেয়ারে বসতে দেখে একসময় একজন উর্দিপরিহিত ওয়েটার আমাদের সামনে জার্মান-সিলভারের একটা ট্রে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

একঠো ছোটা বিয়ার অ্যান্ড জিন—তুই কী খাবি বল সুব্রত?

আমি—মানে ওসব আমার চলবে না ভাই।

এক যাত্রায় পৃথক ফল নেই, you must keep company! আর দেখো, এ সাবকে লিয়ে একঠো ছোটো জিন অ্যাণ্ড লাইম লাও!

ওয়েটার সেলাম জানিয়ে কাউন্টারের দিকে চলে গেল।

কিন্তু ভাই, ওসব খেয়ে যদি মাতাল হই? ভয়ে ভয়ে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম।

একটা ছোট জিন অ্যাণ্ড লাইম খেয়েই মাতাল হবি? Rubbish!

অভ্যাস নেই যে ভাই।

আমার যেন কতকালের অভ্যাস আছে! থাম।

একটু পরে ওয়েটার ট্রেতে করে দুটো পেগ গ্লাস এনে টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল, আউর কুছ সাব?

হ্যাঁ, দোনোমে থোড়া করকে পানি মিলা দো।

ওয়েটার একটু একটু করে দুটো পেগ গ্লাসে জল ঢেলে দিয়ে চলে গেল।

সন্তর্পণের সঙ্গে একটু একটু করে সিপ করছি আর অনুভব করবার চেষ্টা করছি নেশা ধরল কিনা। হঠাৎ এমন সময় খোলা দরজার দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলাম, শ্রীমতী রাণু ও শতদল হাসতে হাসতে প্রবেশ করল ঘরের মধ্যে।

এবং তারা আমাদের দুটো টেবিলের পরের টেবিলে এসে বসল। ওরা আমাদের দুজনকে লক্ষ্য করেনি।

বোয়—বোয়? শতদলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

বয় এসে ওদের সামনে দাঁড়াল।

একঠো হুইস্কি সোডা, আউর একঠো অরেঞ্জ স্কোয়াসু শতদল অর্ডার দিল।

কিরীটীর দিকে তাকালাম। সে দেখি অন্যদিকে তাকিয়ে একমনে সিগার টেনে যাচ্ছে, শতদল বা রাণুর দিকে তার দৃষ্টি নেই।

কিন্তু তোমার মা, simply I cant stand her রাণু! তিনি যে আমাকে খুব বেশী পছন্দ করেন তা বলে মনে হয় না, শতদল রাণুকে বলছে কানে এল।

ওটা তোমার ভুল ধারণা দল

না, ভুল ধারণা নয়। কুমারেশের প্রতিই তাঁর একটু– কথাটা শতদল শেষ করে না।

Dont be silly, দল! রাণু জবাব দেয়।

একটু বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। কাউন্টারের পাশে কনসার্ট বাজানো শুরু হয়েছিল। বেহালা, পিয়ানো ও ফ্লুট—মাত্র তিনটি যন্ত্রের সহযোগে চমৎকার ঐকতান বাদ্য। সুরটা একটা পরিচিত বাংলা গানের। কনসার্ট-বিরতি কয়েক মিনিটের জন্য হতেই আবার শতদলের কণ্ঠ শোনা গেল, কুমারেশের আজ পর্যন্ত কোনো সংবাদুই আর পাওয়া যায়নি?

না। রাণু জবাব দেয়।

কিন্তু এবারও কুমারেশের অলিম্পিকে যোগ দেবার কথা। সারা ভারতবর্ষ থেকে তো ওই একা সাঁতারে সিলেকটেড হয়েছে।

এতক্ষণে বুঝতে পারি কুমারেশ মানে বিখ্যাত সাঁতারু কুমারেশ সরকারের কথা হচ্ছে। নামটা তাই প্রথম থেকেই কেমন যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল।

এখানে আসবার দিন পনেরো আগে সংবাদপত্রে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, বিখ্যাত সাঁতারু কুমারেশ সরকার তার কলকাতার বাসভবন থেকে হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। সংসারে তার আপনার বলতে একমাত্র বৃদ্ধ বাপ অধ্যাপক ডঃ শ্যামাচরাণু সরকার। বছর পাঁচেক হল ডঃ সরকার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। কুমারেশ সরকার শুধু একজন বিখ্যাত সাঁতারুই নয়, কণ্ঠসংগীতেও আধুনিক গায়কদের মধ্যে সে অন্যতম। গায়কদের মধ্যেও কুমারেশ রেডিও গ্রামোফোন জগতে একচ্ছত্র সম্রাট। সেইজন্যই কুমারেশ সরকারের নিরুদ্দেশের সংবাদ যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং এ-ও জানি, এখন পর্যন্ত সেই নিরদিষ্ট কুমারেশের কোন সংবাদুই পাওয়া যায়নি। ব্যাপারটা সত্যিই যেমন রহস্যপূর্ণ তেমনি চাঞ্চল্যকর।

আবার রাণুর গলা শোনা গেল, সত্যিই শতদল তুমি জান না কুমারেশ কোথায় গিয়েছে?

সকালবেলাতেই তো বলেছি জানি না।

কিন্তু আমি কি ভেবেছিলাম, জান?

কি

তুমিই তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু, অন্ততঃ তুমি বোধ হয় জান সে কোথায়!

শুধু তোমার কেন, সকলেরই তাই ধারণা। অথচ এরা কেউ বিশ্বাস করে না যে, তার সংবাদ জানা সত্ত্বেও গোপন করে রাখার কী আমার স্বার্থ থাকতে পারে! জগতে কুমারেশের চাইতে প্রিয় বন্ধু আর আমার নেই। সেই স্কুলের জীবন থেকে আমাদের বন্ধুত্ব, তার প্রতিটি কাজে চিরদিন আমিই সর্বাগ্রে তাকে উৎসাহ দিয়েছি, তার জীবনের প্রতিটি success-এ আমিই তাকে এগিয়ে দিয়েছি। সে শুধু আমার বন্ধুই নয়, সহোদরের চাইতেও অধিক।

জানি। মৃদুকণ্ঠে রাণু কেবল জবাব দেয়।

আবার বাজনা শুরু হয়, এবারে কিন্তু আর ঐকতান নয়, কেবল বেহালাবাদক বেহালা বাজাতে শুরু করে। চমৎকার বাজনার হাত লোকটির। আমার মনটা বাজনার প্রতি আবার আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।

হঠাৎ কিরীটী চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। চেয়ে দেখি, রাণু আর শতদলও চেয়ার ছেড়ে উঠে খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিরীটী দূর থেকে ওদেরই অনুসরণ করে, আমিও কিরীটীর পিছনে চললাম।

মাথাটা একটু হালকা হালকা বোধ হয়। বুঝলাম জিন ও লাইমের কার্য শুরু হয়েছে আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোতে।

শতদলবাবু? কিরীটীর ডাকে চমকে শতদল ফিরে তাকাল, কে? ও মিঃ রায়, our detective! Hallow! মনে আছে স্যার, আপনার সেই সাবধান বাণী। আর বলতে হবে না।

ব্যাপার কি শতদল? বিস্মিতা রাণু প্রশ্ন করে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে।

মিঃ রায়ের ধারণা, আমার জীবনের উপরে কেউ না কেউ attempt নিচ্ছে, উনি আমাকে তাই আজ সকালে সাবধান করে দিয়েছেন, মৃদু হাস্যসহকারে বলে শতদল।

তোমার life-এর ওপরে attempt! বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আবার তাকাল রাণু শতদলের মুখের দিকে।

কিন্তু আমি অন্য কথা বলবার জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম শতদলবাবু কিরীটী বললে।

কী বলুন তো?

আপনার বাড়িতে আজ সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম। হরবিলাসবাবু, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল।

Really! তিনটে পাগল—তিন শ্রেণীর। কেমন লাগল পাগলগুলোকে? হাসতে হাসতে শতদল বলে।

কিন্তু আপনার নিরালা দেখা হল না, তাই ভাবছি কাল সকালের দিকে যাব।

নিশ্চয় নিশ্চয়। আসবেন। তুমিও এস না রাণু। রাণুর দিকে ফিরে তাকিয়ে শতদল বলে।

কোথায়, তোমার ওখানে?

হ্যাঁ। সকালে চা-পর্বটা আমার ওখানেই না হয় হবে সকলের, কী বলেন মিঃ রায়!

বেশ তো। তাহলে রাণু দেবী যাবেন নাকি!

কখন যাবেন? রাণু প্রশ্ন করে।

একটু সকাল-সকালই না হয় বের হওয়া যাবে। কিরীটী জবাব দেয়।

হঠাৎ একটা ভারিক্কী মেয়েলী কণ্ঠে সামনের দিকে তাকালাম। এই যে রাণু, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? সেই কখন বের হয়েছিস–

একটি বিধবার বেশ পরিহিতা মধ্যবয়সী মহিলা। পরিধানে বিধবার বেশ থাকলেও ঐশ্বর্য ও আভিজাত্যের চিহ্ন যেন তাঁর চোখ-মুখ হাব-ভাব, এমন কি দাঁড়াবার ভঙ্গীটকু থেকে পর্যন্ত ফুটে বের হচ্ছে। পরিপাটি চুল আঁচড়ানো। হাতে একগাছি করে সোনার চুড়ি। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।

কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আবার মহিলা প্রশ্ন করলেন।

এই—মানে, বলতে বলতে এদিক-ওদিক তাকায় রাণু।

চেয়ে দেখি, আমাদের ধারে-কাছে কোথাও শতদলের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কখন একসময় ইতিমধ্যেই নিঃশব্দে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে সে গা-ঢাকা দিয়েছে।