২৫. একদিন বিকাল বেলা

একদিন বিকাল বেলা। তখনও কারখানায় কাজ চলছে।

কুরুসেন এদিক ওদিক দেখে পবনের ঘরে ঢুকে পড়ল।

তারা তখন বিনুনি বেঁধে খোঁপা আঁটছিল। কুরুসেনকে দেখেই লাফ দিয়ে উঠে ঘোমটা টেনে সরে দাঁড়াল।

কুরুসেন হেসে বলল, ভাগ্ যাটা কেঁও, আঁই? কান্ অন্। ফুর্টি কর, টাকা ডিবো।

তারা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, আ মলো যা, বাঁদরটা আস্কারা পেয়ে মাথায় উঠতে আসছে।

তারার মুখ চোখ এমন কিছু ভাল নয় কিন্তু দেহ সৌষ্ঠবের মহিমায় সে অপরূপ। আতা পায়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে উঠে কোনওরকমে বুকে কাপড় চাপা দিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। ঘোমটা কপাল অবধি এসে পৌঁছেছে। কিন্তু তার নগ্ন হাত ও কাঁধের দিকে কামাতুর লুব্ধ-দৃষ্টিতে তাকিয়ে কুরুসেন দুপা এগিয়ে এসে বলল, বাঁদর নহি, দেখো, সায়েব আছে, কিস্কা ঘর টুমার, পবন কো? উটো কাম মে আছে। কাম অন্, ডর লাগে টো হামার কোটি চলল।

তারা দু-পা পিছিয়ে বাঘিনীর মতো তাকিয়ে বলল, ঢ্যামনা, দুদিন কথা বলেছি তাই তোর এত। আমার সোয়ামী শুধু জাতে চাঁড়াল লয়, মনেও। যদি বলে দিই, তোর কাঁচা মাংস খাবে সে।

কামোন্মত্ত কুরুসেন ছড়ি দিয়ে তারার স্তনে হঠাৎ খোঁচা দিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। পহেলে টুমার কাঁচা মাংস আমি খাবে।

খোঁচা খেয়ে ক্ষিপ্ত ভল্লুকের মতো তারা গর্জন করে উঠল, মা বোন-খেগো ঢ্যামনা, শশারের বাচ্চা!…

এদিকে কুরুসেনকে নারান আজ ঢুকতেই দেখেই পবনকে খবর দিয়ে দিয়েছিল।

পবন যখন এল তখন কুরুসেন তারাকে চিত করে ফেলে, কাপড়টা খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। পবন একমুহূর্ত ভাববার অবসর পেল না। গলা দিয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত বেরুল না। লাফ দিয়ে পড়ে সে সমুদ্রের কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দুই হাতে কুরুসেনকে গলা টিপে ধরল।

মুহূর্তে নীল হয়ে কুরুসেন আঁ করে উঠল।

তারা উঠে পড়ে কুরুসেনের মুখ দেখে আতঙ্কে ড়ুকরে উঠল, মরে যাবে যে?

সেকথা কানে যেতেই পবনের হাত শিথিল হয়ে এল। কুরুসেন মুক্তি পেয়ে মাটি ঘটাতে ঘটাতে প্রাণভরে পবনের দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে সরে যেতে লাগল।

কিন্তু পবন নির্বাক নিশ্চল। সেই রক্তচোখে ভাবলেশহীন দৃষ্টি নিয়ে তারার দিকে তাকিয়ে রইল।

সে-চোখের দিকে তাকিয়ে প্রথমে তারার বুকের মধ্যে. শিরশির করে উঠল, তারপরে প্রাণ শিউরে উঠল তার। এ কী চোখ পবনের! মনে হল যেন, খুন করতে চায় পঞ্চন, রক্ত চায় খেতে। সে হঠাৎ বলে উঠল, আমার কোনও দোষ নেই, বিশ্বাস করো।..

কুরুসেন ততক্ষণে কোনওরকমে একবার বাইরে গিয়ে কুঠিতে পালিয়েছে।

তারার কথা শুনে পবনের সেই বিচিত্র ভাবের চোখ আরও বড় হয়ে উঠল।

তারা আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে আবার বলে উঠল, আমার কোনও দোষ নেই, কোনও দোষ নেই। বলতে বলতে হঠাৎ এক লাফে দরজার কাছ গিয়ে পুব দিকে ছুটতে আরম্ভ করল সে।

পবন একমুহূর্ত থকে থেকে বাইরে এল। দেখল নারান দাঁড়িয়ে আছে।

নারান বলল, যাও, ফিরে নে এসো। ভয় খেয়েছে।

আঁ, ভয়? কেন? পবন যেন হঠাৎ চমকে উঠে ছুট দিল পুব দিকে। চিৎকার করে উঠল, তারা, তারি ফিরে আয়, ফিরে আয়।…

কিন্তু সে যত ছোটে, তারাও ছোটে তত। ছুটতে ছুটতে গঙ্গার পাড়ে নেমে গেল সে। পবনও নামল। চিৎকার করে ডাকল, তারি… তারি ফিরে আয়; তোর কোনও দোষ নাই। ফিরে আয়।…

কিন্তু তারা তা শুনতে পেল না। ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণভয়ে সে ছুটে আসছে।

অন্ধকার নেমে আসছে। অমাবস্যার দিন। জোয়ারের ভরা টুটুকু গঙ্গা।

হঠাৎ কীসের গোঁ-গোঁ শব্দে পবন থমকে দাঁড়াল। কীসের শব্দ?

বান! বান আসছে অমাবস্যার গঙ্গাকে প্লাবিত করে।

তারা একবার তাকিয়ে দেখল পেছনে। পবন অনেকখানি কাছে এসে পড়েছে। সেও তার শেষ শক্তিতে ছুটল। গলায় জোর নেই, তবু বিড়বিড় করছে, আমার কোনও দোষ নেই…কোনও দোষ নেই।…।

বলতে বলতে সে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তে জোয়ারের তীব্র গতি তাকে কুটোগাছার মতো নিয়ে গেছে।

দূরে টেনে নিয়ে গেল।

অদূরেই মস্ত উঁচু ফেনা তুলে বানের জলরাশি ছুটে আসছে গোঁ-গোঁ করতে করতে।

পবন আর্তনাদ করে উঠল। যেখানে তারা লাফ দিয়ে পড়েছে সেখানেই লাফ দিয়ে এসে জলে পড়ল সে। ডাকলে…তারি…তারি—মুহূর্তে বান ঝাপটা দিয়ে ড়ুবিয়ে দিল তাকে।

দূরে দুখানি কাচের চুড়ি পরা হাত যেন ঠেকাতে চাইল বানকে।

চকিতে সে বাধা আত্মসাৎ করে বান ছুটে গেল হা-হা করে।

অসীম ক্লেশে ও শক্তিতে পবন মাথা তুলল আবার। জোয়ার তাকে টেনে নিয়ে চলেছে। তবু সে ডাকল, তারি..তারি আমার জন্মো-পিরিতের বউরে…

কিন্তু কোথায় তারা? অসংখ্য তরঙ্গরাশি বন্যায় ফুলে উঠে মাথা তুলে নাচছে। জোয়ারের তীব্র স্রোত তাকে টেনে নিয়ে চলেছে দূরে হু-হু করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *