ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ১৪

ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ১৪

সাড়ে-চারটের সময় হরিনাথ চায়ের জন্য বাবলুর খোঁজ করে বুঝতে পারল, খোকাবাবু বাড়ি নেই। তাতে হরিনাথের খুব বেশি ভাবনা হল না, কারণ তিনটে বাড়ি পরেই বাবলুর বন্ধু থাকে। অ্যাদ্দিন পরে বাড়ি থেকে খোকাবাবু নিশ্চয়ই তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছে; একটু পরেই ফিরে আসবে।

বাবলু তার বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু হরিনাথ যার কথা ভাবছে সে-বন্ধু নয়। দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে বাগানের পিছনের পাঁচিল টপকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাবলু লাউডন স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট দিয়ে, লোয়ার সার্কুলার রোড পেরিয়ে শেষটায় সি আই টি রোডে পৌঁছে একে-ওকে জিজ্ঞেস করে ঠিক হাজির হয়েছিল সেই ব্রিজটাতে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে ডান দিক বাঁ দিক হিসেব রেখে টিউব কলের ধারে মেয়েদের ভিড় পেরিয়ে একটু যেতেই, কয়েকটি ছেলে তাকে দেখে বলল, ‘হারুনদা নেই, হারুনদা চলে গেছে।’

বাবলু চোখে অন্ধকার দেখল।

‘কোথায় চলে গেছে?’ সে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল।

এবার একজন লুঙ্গিপরা বুড়ো একটা ঝুরঝুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘হারুনকে খুঁজছ খোকা? সে আজ মাদ্রাজ যাবে বলে ট্রেন ধরতে গেছে। সার্কাস কোম্পানি তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।’

হাওড়া যাবার জন্য দশ নম্বর বাস ধরতে হবে সেটা বস্তির কয়েকজন ছেলেই বাবলুকে বলে, ওকে ট্রেন লাইন পেরিয়ে একেবারে বাসস্টপে নিয়ে গিয়ে হাজির করল। উপেনবাবুর দেওয়া আগাম টাকাটা বাবলু সব সময়ই তার প্যান্টের পকেটে রাখত। তার থেকেই বাসভাড়া আর হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম টিকিট হয়ে গেল।

হারুনদার গাড়ি ছেড়ে দেয়নি তো?

‘মাদ্রাজের গাড়ি কোন প্ল্যাটফর্মে—মাদ্রাজের গাড়ি?’

‘সাত নম্বর, খোকা, ওই যে ওইদিকে। ওই দ্যাখো নম্বর।’

লম্বা ট্রেনটা দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছে লম্বা পাড়ি দেবে বলে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাবলু এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে চলল। থার্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস,…ফার্স্ট ক্লাস…লোকজন মাল কুলি বাক্স-প্যাঁটরা হোল্ডল পুঁটলি সব ডিঙিয়ে পাশ কাটিয়ে কনুই দিয়ে ঠেলে সরিয়ে একটা জায়গায় এসে বাবলু থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

একটা চায়ের দোকানের পাশে লোকে ভিড় করেছে, তাদের মাথার উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তিনটে চায়ের কাপ শুন্যে লাফ মারছে, আর লোকগুলো হো-হো করে উঠছে, হাততালি দিচ্ছে।

গাড়ি ছাড়তে কিছু দেরি, তাই হারুনদা খেলা দেখাচ্ছে।

বাবলু ভিড় ঠেলে হারুনদার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘এ কী, তুই এখানে?’

হাততালির জন্য হারুনদাকে বেশ চেঁচিয়ে বলতে হল কথাটা। তারপর কাপ তিনটে দোকানদারের হাতে তুলে দিয়ে হারুন আবার বাবলুর দিকে ফিরল।

‘আমার ওখানে গেসলি বুঝি? ওরা বলে দিল “আমি নেই”?’

ও কিছু বলছে না দেখে হারুনই বলে চলল, ‘সেদিন তোকে মাদ্রাজের সেই ভেঙ্কটেশের চিঠিটার কথা বলছিলাম না?—ভেবে দেখলাম, মওকাটা ছাড়া উচিত হবে না। ওখানে চোখ বেঁধে এক চাকার সাইকেল চালাতে চালাতে জাগ্‌লিং দেখাতে হবে। কম-সে-কম মাসখানেক প্র্যাকটিস লাগবে। তাই একটু আগে যাওয়া ভাল।’

ও টাকাটার কথা বলতে গিয়েও পারল না। হারুনদা একটা নতুন সুযোগ পেয়েছে—হয়তো অনেক বেশি রোজগার করবে। আর ওকে দেখেও মনে হচ্ছে ও ফুর্তিতে আছে। যদি টাকাটার কথা বললে ওর মনখারাপ হয়ে যায়!

ওর নিজের মনখারাপের কথাটাও বলতে হল না, কারণ হারুনদা বুঝে ফেলেছে।

‘বাড়িতে ভাল্লাগছে না তো?’

‘না হারুনদা।’

‘ফটকেটা জ্বালাছে, তাই তো? বলছে, উপেনদার দোকানে ইস্কুল করতে হত না, কতরকম লোক দেখা যেত—হারুনদা কতরকম খেলা দেখাত, কলকাতার রাস্তা দিয়ে কেমন হেঁটে বেড়াতাম দু’জনে—তাই তো?’

সব ঠিক বলেছে হারুনদা। ও মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ বলল। হারুন বলল, ‘ফটকেটাকে একটু ধমক না দিলে ও তোকে লেখাপড়া করতে দেবে না। সেটা কোনও কাজের কথা নয়। কত আফসোস হয় আমার জানিস—আরও পড়িনি বলে?’

‘তাও তো তুমি এত ভাল খেলা দেখাও। তুমি তো আর্টিস্ট।’

‘আর্টিস্ট কি শুধু একরকম হয়? তোদের বাড়ির মতো বাড়িতে থেকে কি আর্টিস্ট হওয়া যায় না? লেখাপড়া করে আর্টিস্ট হয় না? শুধু বলের খেলাতেই কি আর্টিস্ট? বলের খেলা, রঙের খেলা, কথার খেলা, সুরের খেলা—কতরকম খেলা আর কতরকম আর্টিস্ট হয় জানিস? যখন বড় হবি, তখন জানতে পারবি, কোন খেলাটা কী স্টাইলে খেলতে হবে তোকে। তখন তুই—’

ও আর পারল না। গার্ড হুইস্‌ল দিয়ে দিয়েছে। ওকে বলতেই হবে কথাটা। ও হারুনদার কথার উপরেই চিৎকার করে বলল, ‘বাবা তোমায় টাকা দেয়নি হারুনদা। পাঁচ হাজার টাকা! তুমি না নিয়েই চলে যাবে?’

হারুন ওর কামরার পা-দানিতে উঠে সামনের দিকে ঝুঁকে হেসে বলল, ‘তোর ছবিটা ওরকম হয়েছে কেন? মনে হচ্ছে খোক্কসের ছা।’

হারুনদা জানে! ও কাগজ দেখেছে!

ট্রেনের ভোঁ বেজে উঠল। ও হারুনদার কামরার দরজার দিকে এগিয়ে গেল। হারুন বলল, তোর বাবাকে বলিস, হারুনদা বলেছে ওঁর ছেলেকে ফেরত দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা নিতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু ভাইকে বিক্রি করে কেউ টাকা নেয়?’

গাড়ি ছেড়ে দিল। ও কিছু ভাবতে পারছে না। ও শুনছে হারুনদা চেঁচিয়ে বলছে, ‘গ্রেট ডায়মন্ড সাকাস—এলে দেখতে যাস—এক চাকার সাইকেলে চোখ বেঁধে বলের খেলা!’

‘এখানে আসবে হারুনদা?’

ও ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। বেশিক্ষণ পারবে না।

‘আসতেই হবে! সার্কাসের কদর কলকাতায় সবচেয়ে বেশি। দেশের সব শহরের মধ্যে!’

হারুনদা হাত নাড়ছে।

হারুনদা দূরে চলে যাচ্ছে।

হারুনদা মিলিয়ে গেল।

ট্রেন চলে গেল।

ওই যে সবুজ গোল আলো। ওটাকে বলে ‘সিগন্যাল’। বাবলু এখন জানে। ওর মানে লাইন ক্লিয়ার।

হাতের আস্তিন দিয়ে চোখ মুছে বাবলু বাড়ির দিকে পা বাড়াল। দুটো কাঠের বল ওর পকেটে। আর, একটা মানুষ—যাকে ও খুব ভাল করে চেনে—যাকে দিয়ে ওর অনেক কাজ হবে—তাকে ও মনের এক কোনায় পুরে রেখে দেবে।

তার নাম শ্রীফটিকচন্দ্র পাল।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *