ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ১০

ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ১০

আজ সকাল থেকেই ফটিকের মনটা চনমনে। আজ হারুনদা প্রথম ময়দানে চোখ বেঁধে জাগ্‌লিং দেখাবে। সেদিন থেকে হারুন রোজই নিয়মমতো উপেনবাবুর দোকানে এসেছে। আগে একবার করে আসত, এ ক’দিন দু’বেলা এসেছে। সেদিন ওর বাড়ি থেকে ফিরতে ফটিকদের কোনও অসুবিধা হয়নি। শ্যামলাল আর সেই লোকটা ওদের পিছু নেয়নি।

হারুন যে কলকাতার অলিগলি কীরকম ভালভাবে জানে, সেটা ফটিক সে দিন বুঝতে পেরেছে। লোকগুলো পিছু নিলেও হারুনের চরকিবাজির চোটে হিমশিম খেয়ে যেত।

হারুন প্রতিবার এসেই ফটিককে জিজ্ঞেস করেছে, সেই দুটো লোক আর এসেছিল কিনা। কিন্তু তারা আর আসেনি। দোকানের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে কিনা সেটা ফটিক জানে না, কারণ রোজই তাকে সকাল থেকে রাত অবধি ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। বাইরে গিয়ে দু’-দণ্ড দাঁড়াবারও সময় পায়নি। এ ক’দিনে তার কাজ আরও অনেকটা সড়গড় হয়ে এসেছে। গোড়ায় রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে বুঝতে পারত হাত দুটোতে একটা অবশ ভাব, কিন্তু গত ক’দিন সেটাও হয়নি। এমনকী বিষ্যুদবার থেকেই ও কাজের পর খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় বসে দুটো কাঠের বল নিয়ে লোফালুফি অভ্যাস করেছে। বল দুটো হারুনদাই এনে দিয়েছে, একটা হলদে, একটা লাল। কী করে লুফতে হয় সেটাও হারুনদা শিখিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘তুই যে আর্টটা শিখছিস, সেটা পাঁচ হাজার বছর আগেও মিশরদেশে ছিল। পাঁচ হাজার কী বলছি—সৃষ্টির আদি থেকে ছিল। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বছর আগে।’ ফটিক অবাক হয়ে গিয়েছিল। ভাবল, হারুনদা বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু হারুন বুঝিয়ে দিল:

‘এই যে পৃথিবী—এটাও তো একটা বল। আরও যত গ্রহ আছে—মঙ্গল বুধ বিষ্যুদ শুক্কুর শনি—সব এক-একটা বল। আর সব ব্যাটা ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে। আবার চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীর চার দিকে। অথচ কেউ কারুর গায়ে গায়ে লাগছে না। ভাবতে পারিস? এর চেয়ে বড় জাগ্‌লিং হয়? রাত্তিরে আকাশের দিকে চাইলেই বুঝবি কী বলছি। …বল দুটো যখন হাতে নিবি, তখন এই কথাটা মনে রাখিস।’

কিন্তু লোক দুটো না এলেও ফটিক বুঝতে পারছে যে হারুনদার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে যেটা সহজে যাবার নয়। এক এক সময়ে মনে হয় শুধু ভয় না, আরও কিছু; কিন্তু সেটা যে কী সেটা ফটিক বুঝতে পারে না। ও খালি লক্ষ করে যে হারুনদার চোখের জ্বলজ্বলে ভাবটা মাঝে মাঝে চলে গিয়ে চোখ দুটো কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ে।

এসব কথা অবিশ্যি ময়দানে গিয়ে আর ফটিকের মনে হয়নি। হারুন গত রবিবারে যেখানে খেলা দেখিয়েছিল, সেখানে আজ আগে থেকেই ছেলের দল ভিড় করে রয়েছে। ফটিক তাদের কয়েকজনকে দেখেই চিনল। ওই যে সেই মুখে বসন্তের দাগওয়ালা কানা ছেলেটা; ওই যে সেই বেঁটে বামনটা যাকে দূর থেকে দেখলে বাচ্চা মনে হয়, আর কাছে এসেই গোঁফদাড়ি দেখে চমকে যেতে হয়; আর ওই যে সেই লুঙ্গি-পরা ঢ্যাঙা ছেলেটা যার দাঁত সবসময়ে বেরিয়ে থাকে। হারুনকে দেখেই ছেলের দল হাততালি দিয়ে হইহই করে উঠল।

হারুন তার জায়গায় বসে একবার আকাশের দিকে চেয়ে নিল। ফটিক জানে কেন। পশ্চিমের আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি এলে খেলা ভণ্ডুল হয়ে যাবে। হে ভগবান—যেন বৃষ্টি না হয়, যেন হারুনদা আজ চোখ বেঁধে খেলা দেখিয়ে এদের চোখ টেরিয়ে দিতে পারে, যেন সে আজ আঠারো টাকা বত্রিশ পয়সার চেয়ে অনেক বেশি রোজগার করতে পারে। ইস্‌, কয়েকটা সাহেব-মেম ভিড়ের মধ্যে থাকলে বেশ হত! এখানে কে ফেলবে দশ টাকা, পাঁচ টাকার নোট!

দূর থেকে আসা একটা মেঘের ডাকের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে হারুন তার খেলা শুরু করে দিল। আজ থুতনির উপর লাট্টুর খেলাটা শেষ করে হারুন ভিড়ের মধ্যে থেকে ইশারা করে ফটিককে কাছে ডাকল। লাট্টুটা তখনও হারুনের তেলোতে ঘুরছে। ফটিক আসতেই হারুন তাকে হাত পাততে বলে নিজের হাত থেকে লাট্টুটা ফটিকের হাতে চালান দিয়ে বলল, ‘ধর এটা।’

তেলোতে সুড়সুড়ি লাগার সঙ্গে সঙ্গে ফটিকের সমস্ত শরীরে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে আজ হারুনদার অ্যাসিস্ট্যান্ট, হারুনদার শিষ্য!

হারুন এবার আরেকটা ঘুরন্ত লাট্টু ডান হাতে নিয়ে অন্যটা ফটিকের হাত থেকে নিজের বাঁ হাতে নিয়ে নিল। তারপর যতক্ষণ দুটো লাট্টুতে দম থাকে, ততক্ষণ চলল চোখ-ধাঁধানো ঘুরন্ত লাট্টুর জাগ্‌লিং।

তারপর এমনই বলের খেলা শেষ হলে ফটিকের আবার ডাক পড়ল। হারুনদা থলি থেকে বুটিদার সিল্কের রুমালটা বার করে ফটিকের হাতে দিল। ফটিক রুমাল দিয়ে হারুনের চোখ ঢাকতেই ভিড়ের মধ্য থেকে একটা হইহই রব উঠল। অন্ধকার হয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু ফটিক জানে তাতে কিছু এসে যাবে না; হারুনদার চোখেও এখন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। এ খেল্‌ দেখাতে হারুনদার আলোর দরকার হয় না।

দু’ বলের খেলা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ফটিক বুঝেছে যে, আজকে আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি পয়সা পড়বে। অনেক নতুন লোক এসে জমা হয়েছে এই কয়েক মিনিটের মধ্যেই।

হারুন থলে হাতড়ে তিন নম্বর পিতলের বল বার করল। বেশ জোরে একটা মেঘের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে চোখ-বাঁধা হারুন ওস্তাদের উদ্দেশে সেলাম জানিয়ে বল আকাশে ছুড়ল। বল চার পাক ঘোরার পর পাঁচ পাকের বেলা ফটিকের চোখের সামনে যেটা ঘটল, তার চেয়ে যদি আকাশ ভেঙে ওর মাথায় পড়ত তাতে ওর কষ্ট অনেক কম হত।

ঠিক হারুনদার মাথার উপরে একটা বল আরেকটা বলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে একটা সাত-চড়া কান-ফাটানো শব্দ করে ছিটকে গিয়ে পড়ল দু’ দিকে ঘাসের উপর।

আরও অবাক এই যে, যে-লোকগুলো এতক্ষণ হারুনকে তারিফ করছিল, তালি দিচ্ছিল, শাবাশ দিচ্ছিল, তারা হঠাৎ রাক্ষস হয়ে গিয়ে বিকট সুরে হেসে উঠে সেই একই হারুনকে দুয়ো দিতে লাগল।

তাও বেশিক্ষণের জন্য নয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভিড় উধাও হয়ে গিয়ে জায়গাটা খালি হয়ে গেল। এদিকে হারুন নিজেই চোখের বাঁধন খুলে থলির মধ্যে তার খেলার সরঞ্জাম তুলে ফেলেছে। ফটিক পয়সাগুলো তুলতে যাচ্ছিল, হারুন তার দিকে একটা ধমক ছুড়ে সেটা বন্ধ করে দিল। তারপর ঘাসের উপর বসেই একটা বিড়ি ধরাল। ফটিক তারপাশে গিয়ে বসল। নিজে থেকে কিছু বলার সাহস নেই তার; সে ইচ্ছেও নেই। চৌরঙ্গি থেকে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে, যা এর আগের দিন, বা একটুক্ষণ আগে পর্যন্ত ফটিকের কানেই যায়নি। দুটো টান দিয়ে বিড়িটাকে ঘাসের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে হারুন বলল, ‘মনের সঙ্গে হাতের এমন যোগ না রে ফটিক—একটা গুম্‌সে গেলে অন্যটাও খেলতে চায় না।…যদ্দিন না তোর একটা হিল্লে হচ্ছে, তদ্দিন ব্লাইন্ড জাগ্‌লিং এস্টপ্‌।’

কী বলছে এসব আবোল-তাবোল হারুনদা? বেশ তো আছে ফটিক। আবার কী হিল্লের দরকার? হারুন বলে চলল, ‘সেদিন শ্যামলালকে দেখার পর থেকেই তোর ঘটনাটা একটা ছকে এসে গেছে। লোকগুলো তোকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। তোকে কোনও একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে তোর বাবার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে তবে তোকে ছাড়ত। ওদের প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে যায় গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে। শ্যামলাল আর আরেক ব্যাটা বেঁচে যায়, অন্য দুটো মরে। তোকে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে শ্যামলালের হয়তো ধারণা হয়েছিল তুইও মরে গেছিস, তাই তোকে ফেলেই পালায়। তার পর সেদিন উপেনদার দোকানে গিয়ে দেখে ফস্‌কে-যাওয়া শিকার আবার হাতের কাছে এসে গেছে।

‘সেদিন তোকে পৌঁছে বাড়ি ফিরে এসে দেখি, দু’ ব্যাটা তখনও ঘুরঘুর করছে। এগারোটা পর্যন্ত ছিল, তারপর চলে যায়। আমি পিছনে ধাওয়া করে ওদের ডেরাটা জেনে নিই। পুলিশে বললে ওরা ধরা পড়ে যায়; কিন্তু ওদের ধরিয়ে দিলেই তো আর খেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে না।…আমার উচিত তোকেও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া।’

‘না না, হারুনদা।’

‘জানি। তোর মন আমি জানি। তাই তো কিছু করতে পারছি না। আর সত্যি বলতে কী, তোর পরিচয়টা জানা হয়ে গেলে অন্য কথা ছিল। এখন তোকে পুলিশে দেওয়া আর একটা রাস্তার কুকুরকে পুলিশে দেওয়া একই ব্যাপার।’

কথাটা শুনে ফটিকের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ও বলল, ‘রাস্তার কুকুর কাঠের বল নিয়ে জাগ্‌লিং করতে পারে?’

‘তুই অভ্যেস করচিস?’ হারুন জিজ্ঞেস করল, এই প্রথম ফটিকের দিকে সোজা তাকিয়ে, এই প্রথম একটু হেসে।

‘করছি না?’—ফটিকের অভিমান এখনও যায়নি। —‘সারাদিন কাজের পর রাত্তিরে ঘুমোনোর আগে এক ঘণ্টা রোজ।’ ফটিক পকেট থেকে বল দুটো বার করে হারুনকে দেখিয়ে দিল।

‘গুড,’ বলল হারুন। ‘দেখি, আর দুটো দিন দেখি। কেউ যদি তোর খোঁজখবর না করে তো তোকে সঙ্গে নিয়েই যাব।’

‘কোথায়?’—ফটিক অবাক। হারুনদা যে আবার কোথাও যাবার কথা ভাবছে সেটা ও এই প্রথম শুনল।

‘এখনও ঠিক করিনি। কাল সেই ভেঙ্কটেশের একটা চিঠি পেয়েছি। আসতে লিখেচে। এইভাবে মাটি থেকে পয়সা কুড়িয়ে নিতে আর ভাল লাগছে না রে। অনেকদিন তো—’

‘তোমার এই খুদে শাগরেদটি কে হে?’

কথাটা এমন আচমকা এল যে, ফটিকের মনে হল, তার কলজেটা এক লাফে গলার কাছে চলে এসেছে।

সেই দুটো লোক অন্ধকারে পিছন থেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ফটিকের ডান কাঁধের পাশে এখন শ্যামলালের ধনুকের মতো বাঁকা প্যান্ট-পরা বাঁ পা।

এবার ফটিক দেখল তার কানের পাশ দিয়ে একটা ছুরির ফলা এগিয়ে গিয়ে তার আর হারুনের মাঝখানে এসে থেমে গেল।

হারুনদাও আড়চোখে দেখছে শ্যামলালের দিকে।

‘রোঘো—চাকতিগুলো তুলে নে। নন্দর দোকানের দেনাটা শোধ হয়ে যাবে।’

অন্য লোকটা পয়সাগুলো তুলতে আরম্ভ করে দিল।

‘কী হে, আমার কথার—’

শ্যামলালের কথা শেষ হল না। ফটিক দেখল চারটে পিতলের বল, চারটে ছোরা আর দুটো বোমা লাট্টু সমেত হারুনদার থলিটা মাটি থেকে হাউইয়ের মতো শূন্যে উঠে গিয়ে শ্যামলালের থুতনিতে লেগে তাকে পাঁচ হাত পিছনে ছিটকে ফেলে দিল।

‘ফট্‌কে!’

হারুনদার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ফটিক দেখল, সে-ও থলিটার মতো শূন্যে উঠে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে হারুনের বগলদাবা হয়ে। এদিকে ধুলোর ঝড় উঠেছে শহিদ মিনারের চারদিকে, আর ময়দানের যত লোক—সব ছুটে চলেছে চৌরঙ্গির দিকে বৃষ্টির প্রথম ঝাপটা থেকে রেহাই পাবার জন্য।

‘ছুটতে পারবি?’

‘পারব।’

ফটিক বুঝল তার পায়ের তলায় আবার মাটি, আর বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই তার পা-ও চলতে লাগল হারুনের সঙ্গে পা মিলিয়ে গাড়িগুলোর দিকে।

‘ট্যাক্সি!’

একটা ব্রেক কষার শব্দ। ফটিকের সামনে একটা কালো গাড়ির দরজা খুলে গেল।

‘সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ!’

সামনে অন্য গাড়ি, ট্যাক্সি, বাস, স্কুটার। হারুন-ফটিক দু’জনেই পাশ ফিরে দেখছে, শ্যামলাল আর রঘুনাথ দৌড়ে এগিয়ে আসছে ঝড়ের মধ্যে। এখনও দিনের আলো আছে, তবে রাস্তায় আর দোকানে বাতি জ্বলে গেছে।

ট্যাক্সি সামনে ফাঁক পেয়ে রওনা দিল। হারুন ড্রাইভারকে বলল, ‘বাড়তি পয়সা দেব ভাই—একটু তেজ লাগান।’

বাঁয়ে ঘুরে চৌরঙ্গি ধরে ট্যাক্সি এগিয়ে চলল ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সামনে চৌমাথা। ধরমতলার মোড়। বাতি লাল ছিল; ফটিকদের ট্যাক্সি পৌঁছতে না পৌঁছতে সবুজ হয়ে গেল। গাড়ি মোড় পেরিয়ে বিজলি-আপিস বাঁয়ে ফেলে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর চওড়া রাস্তা ধরল। রবিবার, তাই ভিড় কম। ফটিক বুঝল তার কানের পাশ দিয়ে শনশন করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে।

ফটিকচাঁদ - অধ্যায় ১০

‘আরও জোরে ভাই—পিছনে গণ্ডগোল।’

হারুনের কথায় ফটিক মাথা ঘুরিয়ে পিছনের কাচ দিয়ে দেখল আরেকটা ট্যাক্সির জোড়া আলো ক্রমে বড় হয়ে তাদের দিকে ধাওয়া করে আসছে।

‘হারুনদা—ওরা ধরে ফেলবে আমাদের!’

‘না, ফেলবে না।’ ফটিকের কান বাতাসে বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। জোড়া আলো আবার ছোট হচ্ছে। এবার ঝাপসা হয়ে গেল, কারণ কাচে বৃষ্টি পড়ছে। ফটিক সামনের দিকে ফিরল। সামনের কাচেও বৃষ্টি। সামনেও জোড়া জোড়া গোল আলো একটার পর একটা হুশ্‌ হুশ্‌ করে ট্যাক্সির পাশ দিয়ে বেরিয়ে উলটো দিকে চলে যাচ্ছে।

এবার একটা জোড়া আলো যেন তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। গাড়ি নয়, বাস। ধুমসো বাস। দৈত্যের মতো বাস। রাক্ষসের মতো বাস। ওই দুটো ওর চোখ। ক্রমে বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে। হতে হতে বাসটা হঠাৎ লরি হয়ে গেল। দু’পাশের বাড়িগুলো আর নেই…আলোগুলো আর নেই। তার বদলে অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার, জঙ্গল, জঙ্গল, জঙ্গল…

‘কী হল ফট্‌কে? এলিয়ে পড়লি কেন? কী হল?’

হারুনের প্রশ্নটা একরাশ ফিরে আসা শব্দের মধ্যে হারিয়ে গেল। প্রথমেই সেই গাড়িতে-গাড়িতে লাগার কান-ফাটা শব্দ—যার পরেই ওর মনে হয়েছিল, ও ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়ছে। সেটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা কানে তালা লেগে যাওয়ার ভাব হল, আর তারপরেই তার বারো বছর তিন মাসের জীবনে যা-কিছু ঘটেছিল সব যেন হুড়মুড় করে এসে তাকে ঘিরে ধরে বলল—আমরা এসেছি, যখন চাও, যাকে চাও, বেছে নাও। তারাই বলল, তোমার ভাল নাম নিখিল, ডাকনাম বাবলু, তোমার বাবার নাম শরদিন্দু সান্যাল; তোমার তিন দাদা, এক দিদি; দিদির নাম ছায়া। দিদি বিয়ে করে চলে গেছে বরের সঙ্গে সুইটজারল্যান্ড। তারাই বলল, তোমার ঠামা তোমাদের বাড়ির দোতলায় বারান্দার শেষের বাঁ দিকের ঘরটাতে—রাত-দিন পুজোর ঘরে খুটুং খাটুং—নাকের উপর সোনার চশমা এঁটে ইয়া মোটা কাশীরামের ছেঁড়া পাতার উপর ঝুঁকে পড়ে সুর করে দুলে দুলে পড়া ঠামা…ছোড়দা বলল, ‘এই দ্যাখ, ড্রাইভ মারার সময় রিস্ট কী ঘোরে,’ আর অঙ্কের স্যার মিস্টার শুক্‌লা বলছে, ‘স্টপ ইট মনমোহন!’—মনমোহনের গোল মুখ গোল মাথায় এত সরু বুদ্ধি—যতবার বিক্রমটা পেনসিল কেটে ডেস্কের উপর রাখছে, ও পিছন থেকে কাগজের নল পাকিয়ে ফুঁ দিয়ে সেটাকে গড়িয়ে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। সবচেয়ে হাসি পায় মনে করলে, দিদির বিয়েতে গ্রামোফোনে বিসমিল্লার সানাই, আর পুরনো রেকর্ড ফাটা জায়গায় এসে প্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও একই জিনিস বার বার আর তাই শুনে শামিয়ানার তলায় যত লোক সব খাওয়াটাওয়া ফেলে হো হো হো— আর হ্যাঁ, দার্জিলিং তো মনে পড়েই, আর তার আগের বছর পুরী, তার আগে মুসুরি, তার আগে আবার দার্জিলিং, আর তারও অনেক অনেক আগে ছোটবেলায় ওয়ালটেয়ারে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে পায়ের তলায় বালি সরে সরে যাচ্ছে আর সুড়সুড়ি লাগছে আর মনে হচ্ছে ভিজে ভিজে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ে সরসর সরসর করে সরে যাচ্ছে, আর মা যেই বললেন, পড়ে যাবে বাবলু সোনা, অমনি ধপাস্‌ ঝপাং!—মা’র কথা অবিশ্যি বেশি মনে নেই। এখন খালি একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। এখন বাড়িতে লোক আর নেই। এতবড় বাড়ি আর তিনজন মাত্র লোক। ছোটকাকার তো মাথাই খারাপ। আগে ছিল বাড়িতেই, যখন মাথা ঠিক ছিল। এখন লুম্বিনীতে।…

ও আবার শুনতে পেল ট্যাক্সির শব্দ। বাইরের রাস্তার আলো দেখতে পেল। হারুনদা—হ্যাঁ, ওই তো হারুনদা—ওর পাশের জানলার কাচটা তুলে দিল।

‘ভয় পেলি নাকি—আই ফট্‌কে,’ হারুনদা বলছে। ‘আর ভয় নেই। ওরা আর নেই পেছনে।’

ও শুনতে পেল, পাশের বাড়ির রাইট সাহেবদের অ্যালসেশিয়ানটা ভারী গলায় ঘেউ-ঘেউ করছে। কুকুরের নাম ডিউক। ও ডিউককে ভয় পায় না। ওর ভীষণ সাহস। ও রাত্রে একা শোয়। একবার দার্জিলিঙে ও বার্চ হিলের রাস্তা দিয়ে অনেকদূর গিয়ে—হঠাৎ কুয়াশা এসে সব ঢেকে দিল। ও তখন একা। ওর মনে আছে ও ভয় পায়নি।

‘শরীর খারাপ লাগছে? না মন খারাপ?’ হারুনদা জিজ্ঞেস করছে।

ও মাথা নাড়ল।

‘তবে কী?’

ও হারুনদার দিকে চাইল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ট্যাক্সি চলছে এখনও। কাচ তোলা, তাই আস্তে বললেও কথা শোনা যায়। ও আস্তেই বলল—

‘সব মনে পড়ে গেছে হারুনদা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *