ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ৫

ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ৫

উত্তর কলকাতার একটা অখ্যাত চুল-ছাঁটাইয়ের দোকানে (প্রোঃ নরহরি দত্তরায়) দুটি লোক ঢুকে দুটো পাশাপাশি চেয়ারে বসে বিশ মিনিটের মধ্যে নিজেদের চেহারা সম্পূর্ণ পালটে নিল। যে বেশি জোয়ান আর বেশি লম্বা, যার কাঁধ দুটো ধরে পরেশ নাপিত চমকে উঠেছিল, তার ছিল চাপদাড়ি আর গোঁফ, আর মাথায় কাঁধ অবধি চুল। তার দাড়ি-গোঁফ বেমালুম সাফ হয়ে গেল, তার মাথার চুল হয়ে গেল দশ বছর আগে বেশিরভাগ লোক যেরকম চুল রাখত—সেই রকম। অন্য লোকটির ঝুলপি বাদ হয়ে গেল, সিঁথি ডান দিক থেকে বাঁ দিকে চলে গেল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফের জায়গায় রয়ে গেল শুধু একটা সরু গোঁফ। পরেশ আর পশুপতি তাদের পাওনার উপরি বাবদ ষণ্ডা লোকটার কাছ থেকে এমন একটা মুখ-বন্ধ-করা চাহনি পেল, যেটা তারা কোনওদিন অমান্য করতে পারবে না।

চুল ছাঁটার বিশ মিনিট পরে লোক দুটি শোভাবাজারের একটা গলিতে একটা ঘুণ-ধরা একতলা বাড়ির কড়া নাড়ল। দরজা খুললেন। একজন বেঁটে শুকনো বুড়ো ভদ্রলোক। যণ্ডা লোকটি তাঁর বুকের উপর পাঁচটা আঙুলের ডগার চাপ দিয়ে তাঁকে ভিতরে ঠেলে দিয়ে নিজেও ঢুকে গেল, আর সেইসঙ্গে অন্য লোকটাও ঢুকে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। সময়টা সন্ধ্যা, ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে একটা বিশ পাওয়ারের বাল্‌ব।

‘চিনতে পারছ, দাদু?’—বলল যণ্ডা লোকটা বুড়োর উপর ঝুঁকে পড়ে।

বুড়োর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। মাথার কাঁপুনির চোটে ইস্পাতের ফ্রেমের আদ্যিকালের চশমাটা নাকের উপর নেমে আসছে।

‘কই-কে-কই না তো…’

ষণ্ডা লোকটা একটা বিশ্রী হাসি হেসে বলল, ‘দাড়ি কামিয়েছি যে!—এই দ্যাখো—’

লোকটা বুড়োর মাথাটা টেনে এনে চশমাসুদ্ধু নাকটা নিজের গালে ঘষে দিল।

‘গন্ধ পাচ্ছ না দাদু? শেভিং সোপের খুশ্‌বু? আমার নাম যে স্যামসন। এবার মনে পড়েছে?’

বৃদ্ধ এবার কাঁপতে কাঁপতে তক্তপোশে বসে পড়লেন, কারণ লোকটা তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে।

‘তোমার হুঁকো খাবার সময় ডিসটার্ব দিলুম—ভেরি সরি দাদু!’

স্যামসন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো হুঁকোটাকে তুলে নিয়ে কলকেটা মাথা থেকে খুলে নিল। তক্তপোশের উপর একটা ডেস্‌ক, তার উপর একটা খোলা পাঁজি। পাঁজির পাতার উপর চাপা-দেওয়া একটা ছ’ কোনা পাথরের পেপারওয়েট। স্যামসন পেপারওয়েটটা সরিয়ে কলকেটা পাঁজির উপর ধরে উপুড় করতেই জ্বলন্ত টিকেগুলো পাঁজির পাতার উপর পড়ল। তারপর কলকেটা ঘরের কোণে ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটা হাতল-ভাঙা চেয়ার টেনে নিয়ে তক্তপোশের সামনে বুড়োর মুখোমুখি বসে বলল, ‘এবার বলো তো দিকি দাদু—গাঁট যদি কাটার ইচ্ছে থাকে তো সোজাসুজি কাটলেই হয়; গনৎকারীর ভড়ং ধরেচ কেন?’

বুড়ো কোনদিকে চাইবে বুঝতে পারছে না। পাঁজির পাতা থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকে ঘরটার কড়িবরগার দিকে, পাতায় কালশিটে পড়ে গর্ত হয়ে যাচ্ছে, তামাকের গন্ধের সঙ্গে পোড়া কাগজের গন্ধ মিশে যাচ্ছে।

স্যামসন তার ঝাঁঝালো ফিসফিসে গলায় বলে চলল, ‘সেদিন যে এলুম—এসে বললুম একটা বড় কাজে হাত দিতে যাচ্ছি, একটা ভাল দিন দেখে দাও। তুমি বই দেখে হিসেব করে বললে, আষাঢ়ের সাতুই। লোকে বলে বাড়ির আলসেতে কাগ এসে বসলে ভৈরব ভট্‌চায তার ভাগ্য গুনে দিতে পারে। আমরাও বিশ্বাস করে এলুম, তুমি বলে-টলে গাঁট থেকে দশটি টাকা বার করে নিয়ে তোমার ওই কাঠের বাক্সের মধ্যে গুঁজে রেখে দিলে। তারপর কী হয়েছে জানো?’

গনৎকার মশাই পাঁজি থেকে চোখ সরাতে পারছেন না বলেই। বোধহয় রঘুনাথ লোকটি তাঁর থুতনি ধরে মুখটা ঘুরিয়ে স্যামসনের দিকে করে দিল। আর সেইসঙ্গে দুটো চোখের পাতাও আঙুল দিয়ে টেনে খুলে রাখল, যাতে ভট্‌চায মশাই স্যামসনের মুখ থেকে চোখ সরাতে না পারেন। চোখের ব্যাপারটা করার আগে অবিশ্যি ভট্‌চাযের চশমাটি খুলে তক্তপোশের উপর ফেলে দিয়েছিল রঘুনাথ।

‘বলছি শোনো,’ বলল স্যামসন, ‘যে গাড়িতে করে মাল নিয়ে যাচ্ছিলাম, এক শালা লরি তাতে মারে ধাক্কা। গাড়ি খোলামকুচি। লরি ভাগলওয়া। দো পার্টনার খতম। স্পট ডেড। আমার লোহার শরীর, তাই জানে বেঁচে গেছি। তাও মালাইচাকি ডিসলোকেট হতে হতে হয়নি। আর এই যে—এ আমার পার্টনার—এর তিন জায়গায় জখম, ডান পাশে ফিরে ঘুমুতে পাচ্চে না! ওদিকে যার জন্য এত মেহনত—সে মালটিও খতম।…এসব তুমি গুনে পাওনি কেন?’

‘আমরা তো বাবা ভগবান—’

‘চ্যাওপ্‌!’

রঘুনার বুড়োর মাথাটা ছেড়ে তাকে খানিকটা রেহাই দিল, কারণ। বাকি খেলাটা স্যামসন একাই খেলবে।

‘এবার বার করো তো দেখি দাদু দশ ইনটু দশ।’

‘আ-আমি—’

‘চ্যাওপ্‌!’

স্যামসনের চাপা চিৎকারের সঙ্গেই তার হাতে একটা ছুরি এসে গেল, আর তার ভাঁজ-করা অদৃশ্য ফলাটা হাতলে একটা বোতাম টেপার ফলে ‘সড়াৎ’ শব্দে খুলে গেল।

ছুরি-সমেত হাতটা গনৎকারের দিকে এগিয়ে এল।

‘দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি।’

ভৈরব জ্যোতিষীর থরথরে হাত প্রথমে তার ট্যাঁক, তারপর তার তেলচিটে-পড়া কাঠের ক্যাশবাক্সটার দিকে এগিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *