১২. আবার যাত্রা শুরু

আবার যাত্রা শুরু

পিনটা কালো রংয়ের– দেখতে একটা মোটা বেলের কাঁটার মতই। তার এক দিক সূচের আগার মত তীক্ষ্ণ ও ধারালো, অন্য দিকটা ভোঁতা। পিনটা যেখানে বিধেছিল, সেখানে হাত বুলোতে বুলোতে সুব্রত কাতর স্বরে বললো, উঃ, এখনও জ্বালা করছে!

ট্যাক্সিটা তখনও হ্যারিসন রোড ধরে পুবদিকে ছুটে চলেছে। ট্যাক্সিচালক মুখ ফিরিয়ে শুধাল, আমহাস্ট স্ট্রীট মে কিধার বাবুসাব?

তুমি চল। আমি বলব খন। কিরীটী ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বলল।

হ্যারিসন রোড ও আমহাস্ট স্ট্রীটের সংযোগস্থলে এসে কিরীটী ড্রাইভারকে বললে, গাড়ির মোড় ফিরিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রীট ধরে এগিয়ে যেতে।

সুব্রতদের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়িতে পৌঁছে কিরীটী সেখানে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করল। তারপর বিকেলের দিকে আবার আসবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাস্তায় গিয়ে নামল।

বেলা প্রায় তখন দেড়টা হবে। আবার যাত্রার উদ্যোগে সুব্রত একটা একটা করে আবশ্যকীয় জিনিসপত্র রাজুর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, আর রাজু সেগুলো একটা চামড়ার সুটকেসের মধ্যে সাজিয়ে-গুছিয়ে ভরে রাখছে।

একটা বড় তোয়ালে ভাঁজ করে সুটকেসের মধ্যে রাখতে রাখতে একসময় রাজু বললে, কিন্তু তোমরা যতই বল ভাই, মনের মধ্যে থেকে কিছুতেই যেন আমি সাড়া পাচ্ছি না সুব্রত। সনৎদা এখানে পড়ে রইল, আমরা চলেছি রেঙ্গুনের দিকে। এমনি ভাবে বৃথা অতদূর ছুটে গিয়ে যে কি লাভ হবে, তা মিঃ রায়ই জানেন।

সুব্রতও মন থেকে সায় পাচ্ছিল না। সে বললে, মিঃ রায়ের মত তো শুনলে।

শুনলাম তো, যা ভাল বোঝ কর। তিনি নিশ্চয়ই ভাল বুঝেই রেঙ্গনে চলেছেন।

এমন সময় মা এসে ঘরে ঢুকলেন, বললেন, হ্যাঁ রে, তা হলে সত্যিই কাল ভোরের জাহাজেই আবার তোরা সেই মগের মুল্লকে চললি?

এখন পর্যন্ত তো তাই ঠিক মা, তবে জাহাজে চাপবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বলা যায় না।

কিন্তু সনৎ-এর তো কোন খোঁজখবর মিলল না!

খোঁজ পাওয়া গেছে মা। সনৎদা প্রাণে বেচে আছে, এই পর্যত জেনে রাখ।

আহা, বেচে আছে তো? ঠিক খবর পেয়েছিস তো?

হ্যাঁ, মা। মিঃ রায় খবর এনেছেন।

আহা, ভগবান তার ভাল করন। বলতে বলতে মার চোখের কোণ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তিনি আবার বললেন, কোথায় তিনি তার দেখা পেলেন?

তা তো জানি নে মা, জিজ্ঞাসা করিনি সে কথা।

তা বাছাকে আমার নিয়ে এল না কেন?

সুব্রত মার কথায় মৃদু হেসে বলল, তারা ছেড়ে দেবে বলে তো আর কত কষ্ট করে চুরি করে নিয়ে যায়নি মা?

তা সে এইখানে পড়ে রইল, আর তোরা চললি রেঙ্গুনে?

ভয় নেই মা, এখানে থেকে তাকে উদ্ধার করা যাবে না, তাই আমরা রেঙ্গুন যাচ্ছি কাল।

হঠাৎ সকলে ঘরের মধ্যে অন্য একজনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ফিরে তাকায়। দেখলে দরজার কপাটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে কিরীটী রায়।

রাজু বললে, মিঃ রায়, কতক্ষণ এসেছেন?

কিরীটী ঘরের মধ্যে ঢুকে এগিয়ে আসতে আসতে বললে, আপনাদের সকলেরই মনে একটা সংশয় জেগেছে যে, সনৎবাবু এখানে পড়ে রইলেন, অথচ আমরা বর্মা চলেছি। আমার কথা যদি বিশ্বাস করতে না পারেন, তবে এইটকুই এখন শুধু জেনে রাখুন যে, সনৎবাবুকে যেমন করেই হোক ওরা কালকে রেঙ্গুনগামী জাহাজে তুলবেই। আমি আপনাদের আগেও বলেছি, এখনও বলছি কালো ভ্রমর যেমনি শয়তান তার চাইতেও ঢের বেশী তীক্ষ্ণধী। তার ওপর আরও একটা কথা হচ্ছে এই যে, সনৎবাবুকে ওরা প্রাণে মারবে না। তাই সনৎবাবু যেখানেই থাকুন না কেন, আমাদের দুর্ভাবনার আপাততঃ তেমন কিছু নেই। কালো ভ্রমর দুধর্ষ হলেও তার শত্রুর অভাব নেই, এমনি দুনিয়ার নিয়ম। এই দেখুন—বলতে বলতে কিরীটী জামার পকেট থেকে সেই সকালের ১৮নং বাড়িতে পাওয়া সাংকেতিক কাগজখানা বের করে সকলের চোখের সামনে ধরল।

সুব্রত ও রাজু উভয়েই একান্ত কৌতুহলে দেখি দেখি বলে কাগজটার ওপরে ঝুকে পড়ল।

কিরীটী আবার বলতে লাগল, সমস্ত জীবনভরে কালো ভ্রমর হয়তো প্রভূত অর্থ সংগ্রহ করেছে; কিন্তু তা থেকে তার ভোগে একটি পাইপয়সাও বোধ হয় লাগাতে পারেনি। আজ পর্যন্ত যতদিন সে বেচে আছে এবং ভবিষ্যতে আরও যতদিন সে বেচে থাকবে, সে শুধু সেই সংগৃহীত অর্থ যক্ষের মত আগলেই থাকবে। এ জীবনের অর্থপিপাসা মত্যুর পরও হয়তো তাকে এই পৃথিবীর মাটির বুকে টেনে আনবে। যে হাহাকার নিয়ে সে সারাজীবন কাটিয়ে গেল, সেই হাহাকারই থেকে যাবে তার বায়ভূত দেহে!

কিরীটীর কথাগুলো যেমনি দরদভরা তেমনি সতেজ। সকলেই বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনছিল, উত্তরে কেউ একটি কথাও বলতে পারে না।

রাজু বললে, আমি কটা দিনই বা ওদের দলে ছিলাম, কিন্তু যে দলের সর্দার, তার দেখা মাত্র একবারের বেশী দুবার মেলেনি, তাও ছদ্মবেশে মুখোশের অন্তরালে অন্ধকার ঘরে। শুনেছি ওদের দলের কেউ নাকি আজ পর্যন্ত সর্দারকে স্বাভাবিক বেশে একদিনও দেখেনি। সে হরেক রকমের রুপ ধরে সকলের মাঝে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, পাশে থেকেই তার হকুম চালায় সকলের ওপরে, অথচ তাকে দেখলেও চেনা যায় না। একটা কথা ওদের মুখে আমি বরাবর শুনেছি, সর্দারকে নাকি রাত্রি ছাড়া দিনের আলোয় আজ পর্যন্ত কেউই দেখেনি এবং তাও ছদ্মবেশে। যে মুহতে দিনের আলো নিভে গিয়ে রাতের অন্ধকার চারিদিকে নেমে আসে, ঠিক সেই মুহূর্তে সর্দারও তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। আবার যেমনি পুব আকাশে ভোরের আলো প্রকাশ পায়, সর্দার যে কোন ফাঁকে কোথা দিয়ে আপনাকে লুকিয়ে ফেলে, শত চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত কেউ তা ধরতে পারেনি।

***

রাত্রি দশটা হবে।

আকাশ বেশ পরিষ্কার। কালো আকাশের কোলে—দূরে, অনেক দূরে মেঘপুরীর বাতায়নে যেন তারার প্রদীপ জালিয়েছে। তারই আলো সৃষ্টি করেছে পৃথিবী ও আকাশের মাঝে এক অপূর্ব আলো-ছায়াঘেরা পথ। ওপরে একখানা মাদুর পেতে মার পাশে বসে সুব্রত ও রাজু আসন্ন বিদেশযাত্রা সম্বন্ধে নানা গল্প করছে।

সনৎদার বাড়ির সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে, রাজু? সেই ড্রাগন– কালো ভ্রমরের মৃত্যুদূত! একসময় বললে সুব্রত।

রাজু হাসতে হাসতে বললে, মনে নেই আবার? কিন্তু যাই বল, ড্রাগনের সত্যসত্যই ক্ষমতা আছে বলতে হবে। অন্য কোন ক্ষমতা না থাকলেও আকর্ষণী ক্ষমতা যে আছে—সে বিষয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ!

হু, ক্ষমতা আছে বৈকি। কিন্তু একজনের কথা আমার বারবারই মনে হচ্ছে রাজু। সেবার আমাদের বিদেশযাত্রার সময় এমন একজন বন্ধু ছিলেন আমাদের পাশে পাশে সর্বদা, যাঁর সদাসতর্হ স্নেহদৃষ্টি সারাক্ষণ আমাদের নিরাপদে রেখেছিল। তিনি না থাকলে সেই মগের মুল্লক থেকে ফিরে এসে বাংলার মাটিতে পা দেওয়া হয়ত এ জীবনে আর আমাদের কারোরই ঘটে উঠত কিনা সন্দেহ। আবার সেই বিদেশের পথে চলেছি। সেবার যেমন অচেনা ছিল, এবারেও ঠিক তাই। সেদিনকার সেই পরম বন্ধুটি আজ আর আমাদের সঙ্গে নেই। এ পৃথিবী হতে তিনি চিরবিদায় নিয়ে গেছেন। আর সত্যি সত্যি কথা বলতে গেলে সেজন্য দায়ী তো আমরাই।…

শেষের দিকে সুব্রতর কণ্ঠস্বর যেন বুজে এল অশ্রুতে।

সত্যি, অমরবাবুর ঋণ আমরা আর এ জীবনে শোধ করার সুযোগ পেলাম না। রাজু বললে।

***

তখনও রাতের আকাশ থেকে ভাল করে আঁধারের ঘোর কেটে যায়নি। সবেমাত্র পুবদিক লালচে আভায় রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

সুব্রতর ঘুমটা ভেঙে গেল রাজুর ডাকে। রাজু ডাকছিল, এই সুব্রত, ওঠ ওঠ। কত রবি জলে রে, কে বা আঁখি মেলে রে! এরপর ব্যায়াম করবিই বা কখন, আর যাবিই বা কখন? জাহাজের সময় তো হয়ে এল।

সুব্রত চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল। পাশের ঘর থেকে স্টোভের গর্জন কানে আসে।

আসন্ন যাত্রার জন্য মা নিশ্চয়ই খাবার তৈরী করছেন।

সুব্রত তাড়াতাড়ি শয্যা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে ছাদে চলে গেল এবং খোলা বাতাসে বারবেলটা নিয়ে ব্যায়াম করতে শুরু করে দিল। তাড়াতাড়ি ব্যায়াম শেষ করে স্নানটাও সেরে নিল। স্নান শেষ করে জামাকাপড় পরে নীচের ঘরে এসে দেখে, ইতিমধ্যে কিরীটী ওদের বাড়িতে পৌঁছে গেছে।

কিরীটীবাবু এসে গেছেন দেখছি!

আগের দিন কথা হয়েছিল যে সকলে মিলে সুব্রতদের বাড়ি থেকে রওনা হবে।

কিরীটী বলে, হ্যাঁ, জাহাজের আর বেশী দেরি নেই, একটু তাড়াতাড়ি করুন।

অদূরে একটা মোড়া পেতে রাজ, বসেছিল। সে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিল।

মা গরম গরম লুচি ভেজে একটা পাত্রে রাখছিলেন। সকলে মিলে সেগুলোর সৎকার করতে লেগে গেল।

মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সকলে এসে গাড়িতে চেপে জাহাজঘাটে এসে পৌঁছে দেখলে, জাহাজ ছাড়তে তখন আর বেশী দেরি নেই। জাহাজের ঘন ঘন হুইসেল চারিদিক প্রকম্পিত করে তুলছে। যাত্রী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনে জাহাজঘাটে বেশ ভিড়।

একটা সেকেণ্ড ক্লাস কেবিন রিজার্ভ করা হয়েছিল। সুব্রত, কিরীটী, রাজু ও চাকর জংলী সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে গিয়ে উঠল।

নির্দিষ্ট সময়েই জাহাজ ভোঁ দিতে দিতে জেটি ছেড়ে এগিয়ে চলল।

নবোদিত সূর্যের রঙিন আলোয় গঙ্গার ছোট ছোট ঢেউগুলি যেন গলিত রুপোর মতই ঝকঝক করে জলছে।

গঙ্গাবক্ষ থেকে বয়ে আসছে প্রথম ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া মৃদু মৃদু যেন স্নেহের স্নিগ্ধ করপ্রলেপ কারও।

নির্মেঘ নীলাকাশ সূর্যালোকে যেন ঝলমল করছে।

বর্ষার গঙ্গার গৈরিক জলরাশি ভেদ করে ধীরে মন্থরগতিতে জাহাজ এগিয়ে চলেছে। গঙ্গার দুপাশে সদ্য ঘুম ভাঙার সাড়া পড়ে গেছে। এদিকওদিকে বড় জাহাজ নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট স্টীমলঞ্চগুলো এদিকওদিক যাতায়াত করে। ছোট বড় নানা আকারের নৌকো অনেক দেখা যায়। মাঝে মাঝে শোনা যায় জাহাজের ইঞ্জিনঘরের ঘণ্টা।

রাতের রহস্যজনক অন্ধকার কেটে গিয়ে আবার নতুন দিনের যাত্রা হয় শুরু। দিনের শেষে ঘুমের দেশের পথের বাঁকে সাঁঝের আঁধার আবার বিদায় নেয় শেষদিনের আলোর কাছে। রাত্রি আবার ফিরে আসে তার রহস্য নিয়ে।

এই তো নিয়ম।

আকাশের প্রতি গ্রহতারাও এগিয়ে চলেছে অনন্ত যাত্রাপথে। মানুষও তেমনি দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি তাদের নব নব যাত্রার পথে এগিয়ে চলেছে।

কালো ভ্রমর ওদের ডাক দিয়েছে।

সুব্রত ভাবে : কালো ভ্রমর!

কিরীটী ভাবে : কালো ভ্রমর!

রাজুও ভাবে : কালো ভ্রমর!

ডেকের উপর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কিরীটী, সুব্রত ও রাজু ক্রমবিলীয়মান কূলের দিকে চেয়ে।

কিরীটী বললে একসময়, মাটি আর জলের মধ্যে যেন একটা স্নেহের বাঁধন আছে সুব্রতবাবু। দেখুন কূলের মাটি যেন বুক পেতে দিয়েছে জলের স্পর্শটুকু পেতে।

জাহাজ কূল ছেড়ে অনেকখানি এগিয়ে চলে। ক্রমে বজবজ উলুবেড়িয়া পশ্চাতে পড়ে গেল।

হঠাৎ একসময় সুব্রত রাজুর দিকে ফিরে বললে, গেলবার নীতীশটা আমাদের সঙ্গে ছিল।

এবারেও নীতীশকে চিঠি দিয়ে নিয়ে এলে হত!

এখন তো সে হোস্টেলে থাকে না, রাধানগরে তার মামার ওখানে থাকে। ওদের রাধানগরের বাসার ঠিকানাও আমার জানা নেই। সুব্ৰত জবাব দেয়।