০০. ভূমিকা : কিরীটীর আবির্ভাব

কিরীটীর আবির্ভাব
ভূমিকা

প্রীতিভোজ উৎসব সুব্রতর বাড়িতে।–

আমহার্স্ট স্ট্রীটে প্রকান্ড বাড়ি কিনেছে সুব্রতরা। সেই বাড়িতেই গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে এই প্রীতিভোজের উৎসব।

অনেক আমন্ত্ৰিতই এসেছেন, তাঁদের মধ্যে এসেছে বিশেষ একজন, কিরীটী রায়।

রহস্যভেদী কিরীটী রায়।

কিরীটী রায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, গৌরবর্ণ, বলিষ্ঠ চেহারা, মাথাভতি কোঁকড়ানো চুল, ব্যাকব্রাশ করা।

চোখে পর লেন্সের কালো সেললয়েডের ফ্রেমের চশমা। দাড়িগোঁফ নিঁখুতভাবে কামানো। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে, সদানন্দ, আমুদে।

ওদের পাড়াতেই এক নবলব্ধ বন্ধুর গৃহে কিরীটীর সঙ্গে ওদের আলাপপরিচয় হয়।

প্রীতিভোজের পর বিদায়ের পূর্ব-মুহূর্তে কিরীটী বলে, এই কালো পাথরের ড্রাগনটি আমি চাই সুব্রতবাবু। অপূর্ব মূর্তিটির গঠন কৌশল। ঐটি আমি আমার মিউজিয়ামে রাখতে চাই।

বেশ তো, তা নিন না! সুব্রত বলে।

কিরীটী বলে, শুধু যে মূর্তিটিই তা নয়, ওর সঙ্গে যার নাম জড়িয়ে আছে, কেন জানি না, আপনাদের কাহিনী শুনে সেই নামটির প্রতিও আমার একটা দুর্বলতা জন্মে গেছে।

সুব্রত কিরীটীর কথায় হেসে ফেলে, জানেন না বোধ হয়, মা বলেন, ওটা নাকি একটা অমঙ্গলের চিহ্ন।

তবে তো ভালই হল। অমঙ্গলকে সাদরে আমার গৃহে বহন করে নিয়ে যাই আপনাদের ঘর থেকে। দেখা যাক কি অমঙ্গল আমার সঙ্গে ও নিয়ে আসে!

***

রাত্রি তার ঘন কালো পক্ষ বিস্তার করে দিয়েছে বিরাট এ কলকাতা মহানগরীর বুকে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি।

জনহীন রাস্তা যেন ঘুমন্ত অজগরের মত গা এলিয়ে পড়ে আছে। সাড়া নেই শব্দ নেই।

কিরীটী একা একা পথ অতিক্রম করে চলেছে। পকেটের মধ্যে কালো পাথরের ড্রাগনটি।

আশ্চৰ্য, কিরীটীর যেন মনে হয়, নিঃশব্দে কে বুঝি আসছে কিরীটীর পিছু পিছু!

যে আসছে তার পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, সে আসছে।

এরকম নাকি ঘটে, শুনেছে কিরীটী অনেকের মুখেই এবং এও শুনেছে, চোখ ফেরালেও নাকি তাকে দেখা যায় না। কেউ ওদের দেখতেও পায় না! অথচ বিশ্ৰী অস্বস্তিকর একটা অনভূতি যেন সমগ্র চেতনাকে ওরা ঘিরে থাকে। কখনও নিঃশব্দে মরা চাঁদের আলোয় জনহীন প্রান্তরেও ওরা এমনি করে হেঁটে বেড়ায়, অনুসরণ করে। কখনও বা অন্ধকারে পিছনে পিছনে আসে। তা আসে আসুক। অনুসরণ করে করুক।

কিরীটী এগিয়ে চলে। অভিশাপকে বরণ করে নিয়ে চলেছে নিজের গৃহে। কালো ভ্রমরের মৃত্যু-পরোয়ানা!

***

কালো পাথরের ড্রাগনটির কথা সকলে একরকম ভুলেই গিয়েছিল। তা হল না বলেই আবার এ কাহিনীর শুরু।

কালো ভ্রমর আবার ফিরে এল। সেই তাদের মত বুঝি নিঃশব্দ পদসঞ্চারে রাত্রির রহস্য-ঘন অন্ধকারে। পৃথিবী যখন ঘামিয়ে পড়ে, নিঃসীম। অতলান্তি অন্ধকারে চারিদিক যখন হয়ে আসে নিঝুম, মাথার ওপরে শুধু তারায় ভরা আকাশ বোবা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে, রাতের বাতাসের চুপিসাড়ে তখন যেন তাদের মতই আসে!

রহস্য দিয়ে ঘেরা কালো ভ্ৰমর। রহস্য-ঘন হয়েই ধরা দেয় যেন।

কতটকুই বা পরিচয় সনৎ-এর! সনৎ ভাবে : কতটকুই বা সে জানে কালো ভ্ৰমরের! মুখোশে ঢাকা ছিল। শুধু মুখোশের দুটি ছিদ্রপথে অন্তর্ভেদী দুটি চোখের দৃষ্টি।

কি সম্মোহন আছে ওই চোখের দৃষ্টিতে! একবার সে-চোখের দিকে যে, তাকিয়েছে, সে ভুলবে না। আর সে দৃষ্টি। ভুলতে পারে না।

চোখের তারা তো নয়, যেন দুটি জ্বলন্ত অঙ্গার খন্ড!

এখনও কত রাত্রে ঘামের ঘোরে দঃস্বপেনর মত সেই চোখের দৃষ্টি সনৎকে যেন বিচলিত বিবশ করে দেয়। কি এক অজানিত আশঙ্কায় সর্বাঙ্গ শিউরে শিউরে ওঠে তার।

ভুলতে পারে না রাজু।

দস্যু কালো ভ্ৰমর। শয়তান কালো ভ্ৰমর। কিন্তু সত্যিই কি তাই তার একমাত্র পরিচয়! সেই বলিষ্ঠ পেশল উন্নত গঠন! তেজোদৃপ্ত কন্ঠস্বর!

রাজু শুনেছিল—মস্ত বড় নাকি একটা দল আছে কালো ভ্রমরের। অথচ আশ্চর্য, দলের লোকের কেউ নাকি আজ পর্যন্ত জানে না, কালো ভ্রমরের আসল ও সত্যিকারের পরিচয়। কে সে, কি সে এবং কেমন দেখতে সে!

দলের লোকেরা শুধু এইটকুই জানে যে কঠোর তার অনুজ্ঞা। কঠোর তার নীতি। অপূর্ব তার সংযম। নির্লোভ। আজন্ম ব্রহ্মচারী। তবু সে শয়তান। তবু সে ডাকাত। তবু সে আতঙ্ক। তবু সে সমাজের বাইরে, সকলের ঘৃণা ও অভিশাপের পাত্র।

সুব্রত। সে ভাবে : একটা তেজোদীপ্ত অহঙ্কার। অদ্ভুত কৌশলী, ডাকাত, দস্যু! কালো পাথরের ড্রাগনটির কথা মনে হলেই মনে পড়ে সেই দুঃস্বপ্ন! রূকথার কাহিনীর মত সেই সম্পত্তি-প্রাপ্তি! তার পর সেই নীল পারাপার-হীন মহাজলধি! কি অপূর্ব বিরাট বিস্ময়! মগের দেশ! বেচারী অমরবাবু!

সত্যিই কি শয়তান কালো ভ্রমর তার ওপরে প্রতিশোধ নেবে?

আর ওদের সঙ্গে সঙ্গে ভাবে কিরীটী, রহস্যভেদী কিরীটী। রহস্য উদঘাটনের ওর আছে একটা তীব্র নেশা। আছে একটা তীব্র আকাঙক্ষা ও উত্তেজনা। কালো ভ্রমর সাধারণ ছিঁচকে চোর নয়। প্রখর বুদ্ধি ও অমিত শক্তির অধিকারী সে।

কালো ভ্ৰমর সম্পর্কে তাই বুঝি কিরীটী এক অদৃশ্য সঙ্কেত অনভব করে, কি এক গভীর রহস্য যেন ওকে আকষণ করে।

বিচিত্র এই জগৎ! আরও বিচিত্র এই জগতের মানুষ! কেন মানুষ এমনি করে অন্ধের মত ছুটে যায় সর্বনাশের পথে? অকারণে আপনাকে বিপদের মধ্যে ফেলে কেন নিজেকে করে ব্যস্ত? এও হয়তো একটা নেশা!

নেশা বৈকি। নেশা না হলে কি কেউ এমনি করে আপনাকে বিপদের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে পারে? সত্যি, বিচিত্র এই জগতের মানুষ! আরও বিচিত্র তার মতি-গতি।