১৮. রাত্রির ঘটনা

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
রাত্রির ঘটনা

ছাউনির দিকে ফিরিতে ফিরিতে গৌরী ধনঞ্জয়কে ময়ূরবাহনের কথা বলিল। শুনিয়া ধনঞ্জয় বলিলেন— আবার একটা কিছু নূতন শয়তানি আঁটছে।

তা তো বটেই। কিন্তু এখন কর্তব্য কি?

দীর্ঘকাল আলোচনা ও পরামর্শের পর স্থির হইল যে ময়ূরবাহনের সহিত দেখা করাই যুক্তিসঙ্গত। তাহার অভিপ্রায় যদিও এখনও পরিষ্কার বুঝা যাইতেছে না, তবু অনুমান হয় যে সে উদিতের সহিত বেইমানি করিবার মতলব আঁটিয়াছে। ইহাতে রাজাকে উদ্ধার করিবার পন্থা সুগম হইতে পারে। গৌরী যদিও ময়ূরবাহনের সহিত কোনো প্রকার সম্বন্ধ রাখিতেই অনিচ্ছুক ছিল, তথাপি নিজেদের মূল উদ্দেশ্য স্মরণ করিয়া ব্যক্তিগত ঘৃণা ও বিদ্বেষ দমন করিয়া রাখিল।

কর্তব্য স্থির করিয়া ধনঞ্জয় অন্য প্রকার আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন। দুইজন গুপ্তচর দুর্গের সেতু-মুখে লুক্কায়িত করিয়া রাখিলেন— যাহাতে ময়ূরবাহন একাকী আসিতেছে কিনা পূর্বাহে জানিতে পারা যায়। এমন হইতে পারে যে কুচক্রী উদিত গৌরীকে হঠাৎ লোপাট করিয়া দুর্গে লইয়া যাইবার এই নুতন ফন্দী বাহির করিয়াছে। উদিত ও ময়ূরবাহনের পক্ষে অসাধ্য কিছুই নাই।

রাত্রি এগারোটার সময় চর আসিয়া খবর দিল যে ময়ূরবাহন একাকী আসিতেছে। তখন গৌরী, রুদ্ররূপ ও ধনঞ্জয় তাস্তু হইতে বাহির হইলেন। অন্ধকার রাত্রি নক্ষত্রের সম্মিলিত আলো এই। অন্ধকারকে ঈষৎ তরল করিয়াছে মাত্র।

নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া তিনজনে দাঁড়াইলেন। অদূরে কিস্তা কলধ্বনি করিতেছে, দুর্গের কৃষ্ণ অবয়ব একচাপ কঠিন প্রস্তরীভূত অন্ধকারের মত আকাশের একটা দিক আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। দুর্গের পাদমূলে কেবল আলোকের একটা বিন্দু দেখা যাইতেছে, হয়তো উহাই শঙ্কর সিংয়ের গবাক্ষ!

কিয়ৎকাল পরে সতর্ক পদধ্বনি শুনা গেল। পদধ্বনি তিন-চার গজের মধ্যে আসিয়া থামিল, তারপর হঠাৎ বৈদ্যুতিক টর্চ জ্বলিয়া উঠিয়া প্রতীক্ষমান তিনজনের মুখে পড়িল।

ময়ূরবাহন বলিয়া উঠিল—একি! আমি কেবল রাজার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

গৌরী ও রুদ্ররূপ দাঁড়াইয়া রহিল, ধনঞ্জয় ময়ূরবাহনের দিকে অগ্রসর হইয়া গেলেন। তাঁহার দক্ষিণ করতলে পিস্তলটা আলোকসম্পাতে ঝম করিয়া উঠিল; তিনি বলিলেন–তা বটে। কিন্তু তোমার যা বলবার আছে আমাদের তিনজনের সামনেই বলতে হবে।

তাহলে আদাব, আমি ফিরে চললাম। বলিয়া ময়ূরবাহন ফিরিল।

ধনঞ্জয়ের বাম হস্ত তাহার কাঁধের উপর পড়িল—অত সহজে ফেরা যায় না ময়ূরবাহন।

ময়ূরবাহন ভ্রূকুটি করিয়া ধনঞ্জয়ের হস্তস্থিত পিস্তলটার দিকে তাকাইল, অধর দংশন করিয়া কহিল তোমরা আমাকে আটক করতে চাও?

আপাতত তুমি যা বলতে এসেছ তা বলা শেষ হলেই তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি।

তোমাদের সামনে আমি কোনো কথা বলব না। ময়ূরবাহন বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইল।

তাহলে আটক থাকতে হবে।

বেশ। কিন্তু আমাকে আটক করে তোমাদের লাভ কি?

লাভ যে কিছু নাই তাহা ধনঞ্জয়ও বুঝিতেছিলেন। তিনি ঈষৎ চিন্তা করিয়া বলিলেন–তুমি রাজার সঙ্গে এই মাঠের মাঝখানে একলা কথা বলতে চাও। তোমার যে কোনো কু-অভিপ্রায় নেই আমরা বুঝব কি করে?

এবার ময়ূরবাহন হাসিল, বলিল— কি কু-অভিপ্রায় থাকতে পারে? রাজা কি ক্ষীরের লাড় যে আমি টপ্ করে মুখে পুরে দেব?

তোমার কাছে অস্ত্র থাকতে পারে।

তল্লাস করে দেখ, আমার কাছে অস্ত্র নেই।

ধনঞ্জয় কথায় বিশ্বাস করিবার লোক নহেন; তিনি রুদ্ররূপকে ডাকিলেন। রুদ্ররূপ আসিয়া ময়ূরবাহনের বস্ত্রাদি তল্লাস করিল, কিন্তু মারাত্মক কিছুই পাওয়া গেল না।

ময়ূরবাহন বিদ্রূপ করিয়া কহিল—কেমন, আর ভয় নেই তো!

ধনঞ্জয় আবার বলিলেন–আমাদের সামনে বলবে না?

না–ময়ূরবাহন দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িল।

তখন ধনঞ্জয় কহিলেন— বেশ। কিন্তু আমরা কাছাকাছি থাকব মনে রেখো। যদি কোনো রকম শয়তানির চেষ্টা কর তাহলে–ধনঞ্জয় মুষ্টি খুলিয়া পিস্তল দেখাইলেন।

ময়ূরবাহন উচ্চৈঃস্বরে হাসিল–সর্দার, তোমার মনটা বড় সন্দিগ্ধ। বয়সকালে তোমার ক্ষেত্রিয়াণীকে বোধ হয় এক লহমার জন্যও চোখের আড়াল করতে না! ক্ষেত্রিয়াণী অবশ্য তোমার চোখে ধুলো দিয়ে–হা হা হা–

হাসিতে হাসিতে ময়ূরবাহন গৌরীর দিকে অগ্রসর হইয়া গেল।

.

টর্চের আলো নিবাইয়া ময়ূরবাহন কিয়ৎকাল গৌরীর সঙ্গে ধীরপদে পদচারণ করিল। রুদ্ররূপ ও ধনঞ্জয় তাহাদের পশ্চাতে প্রায় বিশ হাত দূরে রহিলেন।

হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করিয়া ময়ূরবাহন বলিল— আপনার সব পরিচয়ই আমরা জানি।

শুষ্কস্বরে গৌরী বলিল—এই কথাই কি এত রাত্রে বলতে এসেছ?

ময়ূরবাহন উত্তর দিল না; কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া যেন আত্মগতভাবেই বলিতে আরম্ভ করিলআপনার ভাগ্যের কথা ভাবলে হিংসা হয়। কোথায় ছিলেন বাংলাদেশের এক নগণ্য জমিদারের ছোট ভাই, হয়ে পড়লেন একেবারে স্বাধীন দেশের রাজা। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে পেলেন এক অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যার প্রেম। একেই বলে ভগবান যাকে দেন, ছপ্পর ফোড়কে দেন। কিন্তু তবু পৃথিবীতে সবই অনিশ্চিত; অসাবধান হলে সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারীও রাস্তার ফকির বনে যায়। সুখ সৌভাগ্যকে যত্ন না করলে তারা থাকে না। তাই ভাবছি, আপনার এই হঠাৎ-পাওয়া সৌভাগ্যকে স্থায়ী করবার কোনো চেষ্টা আপনি করছেন কি? অথবা, কেবল কয়েকজন ফন্দিবাজ কুচক্রীর খেলার পুতুল হয়ে তাদের কাজ হাসিল করে দিয়ে শেষে আবার পুনর্মুষিক হয়ে দেশে ফিরে যাবেন?

ময়ূরবাহনের এই ব্যঙ্গপূর্ণ স্বগতোক্তি শুনিতে শুনিতে গৌরীর বুকে রুদ্ধ ক্রোধ গর্জন করিতে লাগিল; কিন্তু সে নিজেকে সংযত করিয়া রাখিল, ধৈর্যচ্যুতি ঘটিতে দিল না। ময়ূরবাহন একটা কিছু প্রস্তাব করিতে চায়, তাহা শেষ পর্যন্ত না শুনিয়া ঝগড়া করা উচিত হইবে না। সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল–কাজের কথা যদি কিছু থাকে তো বল। তোমার বেয়াদপি শোনবার আমার সময় নেই।

ময়ূরবাহন অবিচলিতভাবে বলিল–কাজের কথাই বলছি, যা বললাম সেটা ভূমিকা মাত্র। সে টর্চ জ্বালিয়া একবার সম্মুখের পথ খানিকটা দেখিয়া লইল, তারপর আলো নিবাইয়া বলিলউদিতের সঙ্গে আমার আর পোট হচ্ছে না। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই।

ময়ুরবাহনের কথার বিষয়বস্তুটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত নয়; কিন্তু তাহার বলিবার ভঙ্গি এমন অতর্কিত ও আকস্মিক যে, গৌরী চমকিয়া উঠিল। ময়ূরবাহন বলিল— স্পষ্ট কথার ঘোর-পাঁচ না করে স্পষ্টভাবেই বলতে আমি ভালবাসি। উদিত সিংয়ের মধ্যে আর শাঁস নেই—আছে শুধু। ছোবড়া। তাই স্রেফ ছোবড়া চুষে আমার আর পোষাচ্ছে না।

গৌরী ধীরে ধীরে বলিল— অথাৎ উদিতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাও?

ময়ূরবাহন হাসিল— সাদা কথায় তাই বোঝয় বটে। আপনি বোধ হয় ঐ কথাটা বলে আমাকে লজ্জা দেবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু নিজের কোনো কাজের জন্য লজ্জা পাবার অবস্থা আমার অনেকদিন কেটে গেছে।

নীরস স্বরে গৌরী বলিল–তাই তো দেখছি। চেহারা ছাড়া মানুষের কোনো লক্ষণই তোমার নেই! যাহোক, তোমার নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে আমার কৌতূহল নেই। কি করতে চাও?

ময়ূরবাহন কিছুক্ষণ কথা বলিল না। অন্ধকারে তাহার মুখ দেখা গেল না; তারপর সে সহজ স্বরেই বলিল— আগেই বলেছি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। অবশ্য নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার করা আমার উদ্দেশ্য নয়, এটা বোধ হয় বুঝতে পারছেন; আমার নিজেরও যথেষ্ট স্বার্থ আছে। মনে করুন আমি যদি আপনাকে সাহায্য করি, তাহলে তার বদলে আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন না?

তুমি আমাকে কি ভাবে সাহায্য করতে চাও সেটা আগে জানা দরকার।

সেটা এখনও বুঝতে পারেননি?

না।

বেশ, তাহলে খোলসা করেই বলছি। আমি ইচ্ছে করলে আপনাকে ঝিন্দের গদীতে কায়েমীভাবে বসাতে পারি, এটা অনুমান করা বোধহয় আপনার পক্ষে শক্ত নয়?

কি উপায়ে?

ধরুন, আসল রাজার যদি হঠাৎ মৃত্যু হয়। তিনি যে অবস্থায় আছেন তা প্রায় মৃত্যুতুল্য, তবু যতদিন তিনি বেঁচে আছেন ততদিন আপনি নিষ্কণ্টক হতে পারছেন না। আমি যদি আপনাকে সাহায্য করি তাহলে আপনার রাস্তা একেবারে সাফ—আপনি যে শঙ্কর সিং নয়, একথা কেউ চেষ্টা করলেও প্রমাণ করতে পারবে না। সিংহাসনে আপনার দাবি পাকা হয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছেন?  

গৌরী বুঝিল; আগেও সে বুঝিয়াছিল। প্রলোভন বড় কম নয়। শুধু ঝিন্দের সিংহাসন নয়, সেই সঙ্গে আরও অনেক কিছু। তথাপি গৌরীর মন লোভের পরিবর্তে বিতৃষ্ণায় ভরিয়া উঠিল। স্বার্থে স্বার্থে এই প্রাণপণ টানাটানি, নীচতা চক্রান্ত নরহত্যার এই ঘূর্ণিপাক—ইহার আবর্তে পড়িয়া জগতের অতিবড় লোভনীয় বস্তুও তাহার কাছে অত্যন্ত অরুচিকর হইয়া উঠিল। সে একবার গা-ঝাড়া দিয়া যেন দেহ হইতে একটা পঙ্কিল অশুচিতার স্পর্শ ঝাড়িয়া ফেলিবার চেষ্টা করিল। তারপর পূর্ববৎ নিতান্ত নিরুৎসুক স্বরে বলিল— তাহলে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজাকে হত্যা। করতেও তোমার আপত্তি নেই। কিন্তু তোমার স্বার্থ-টা কি শুনি?

ময়ূরবাহন বলিল— আমার স্বার্থ গুরুতর না হলে এত বড় একটা সাংঘাতিক প্রস্তাব আমি পরিকল্পনা করতে পারতাম না। কিন্তু গরজ বড় বালাই। আমার অবস্থার কথা প্রকাশ করে বললে আপনি বুঝবেন যে আমার এই প্রস্তাবে বিন্দুমাত্র ছলনা নেই— এ একেবারে আমার খাঁটি মনের কথা। একটু থামিয়া ময়ূরবাহন সহজ স্বচ্ছন্দতার সহিত বলিতে আরম্ভ করিল–যেন অন্য কাহারও কথা বলিতেছে আমি একজন ঘরানা ঘরের ছেলে এ বোধ হয় আপনি জানেন। বিষয়-আশয় টাকাকড়িও বিস্তর ছিল, কিন্তু সে সব উড়িয়ে দিয়েছি। গত দুবছর থেকে উদিত সিংয়ের স্কন্ধে। চেপেই চালাচ্ছিলাম কিন্তু এভাবে আর আমার চলছে না। উদিতের রস ফুরিয়ে এসেছে; শুধু তাই নয়, গদানা নিয়েও টানাটানি পড়ে গেছে। লুকোচুরি করে কোনো লাভ নেই, এখন আমি আমার গদানা বাঁচাতে চাই। বুঝতে পারছি উদিতের মতলব শেষ পর্যন্ত ফেঁসে যাবে কিন্তু আমিও সেই সঙ্গে ড়ুবতে চাই না। তাকে ঝিন্দের সিংহাসনে বসাতে পারলে আমিই প্রকৃতপক্ষে রাজা হতাম; কিন্তু সে দুরাশা এখন ত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই—আপনি এসে সব ওলট-পালট করে দিয়েছেন।

এবার আমার প্রস্তাব শুনুন। এতে আমাদের দুজনেরই স্বার্থ সিদ্ধ হবে অর্থাৎ আপনি ঝিন্দের প্রকৃত রাজা হবেন, আর আমিও গদানা নিয়ে সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে থাকব।

গৌরী বলিল— তোমার প্রস্তাব বোধ হয় এই যে, রাজা হবার লোভে আমি তোমার গুদানা রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দেব—কেমন?

প্রতিশ্রুতি! ময়ূরবাহন মৃদুকণ্ঠে একটু হাসিল—দেখুন, ও জিনিসের ওপর আমার বিশেষ শ্রদ্ধা নেই। অবস্থাগতিকে মানুষ প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়; আপনিও হয়তো রাজা হয়ে প্রতিশ্রুতি মনে না রাখতে পারেন। আমার প্রস্তাবটা একটু অন্য ধরনের।

বটে! কি তোমার প্রস্তাব শুনি?

আমার প্রস্তাব খুব মোলায়েম। আমি একটি বিয়ে করতে চাই।

বিয়ে করতে চাও?

হ্যাঁ। ভেবে দেখুন, বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করবার আমার সময় উপস্থিত হয়েছে।

তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করবার চেষ্টা করছ?

আজ্ঞে না, স্থান কাল-পাত্র কোনটাই রসিকতা করবার অনুকূল নয়। আমি খুব গম্ভীরভাবেই বলছি। তবে শুনুন। ত্রিবিক্রম সিংয়ের মেয়ে চম্পাবাঈকে আমি বিয়ে করতে চাই। উদ্দেশ্য খুব সোজা— ময়ূরবাহনের গদানার ওপর কারুর মমতা না থাকতে পারে কিন্তু ত্রিবিক্রম সিংয়ের জামাইয়ের গদীনার দাম যথেষ্টই আছে। চম্পাবাঈকে বৈধব্য যন্ত্রণাভোগ করাতে সর্দার ধনঞ্জয়েরও সঙ্কোচ হবে। তারপর, ত্রিবিক্রম সিংয়ের ঐ একটি মেয়ে, তাঁর মৃত্যুর পর মেয়েই উত্তরাধিকারিণী হবে। সুতরাং, সবদিক দিয়েই চম্পাবাঈ আমার উপযুক্ত পাত্রী।

এই প্রস্তাবের কল্পনাতীত ধৃষ্টতা গৌরীকে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক্‌ করিয়া দিল। চম্পা! অনাঘ্রাত ফুলের মত নিষ্পাপ চম্পাকে এই ক্লেদাক্ত পশুটা চায়! গৌরী দাঁতে দাঁত ঘষিয়া বলিল— তোমার স্পর্ধা আছে বটে।

ঈষৎ বিস্ময়ে ময়ূরবাহন বলিল— এতে স্পর্ধা কি আছে? ত্রিবিক্রম আমার স্বজাতি, বংশগৌরবে আমি তার চেয়ে ছোট নয়, বরং বড়। তবে আপত্তি কিসের?

গৌরী রূঢ়স্বরে বলিল–ও সব আকাশ কুসুমের আশা ছেড়ে দাও। তোমার হাতে মেয়ে দেবার আগে ত্রিবিক্রম চম্পাকে কিস্তার জলে ফেলে দেবে।

তা দিতে পারে, লোকটা বড় একগুঁয়ে। কিন্তু আপনি রাজা—আপনি যদি হুকুম দেন, তাহলে সে না বলতে পারবে না।

আমি হুকুম দেব–চম্পার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে! তুমি তুমি একটা পাগল।

ময়ূরবাহন মৃদুস্বরে বলিল— বিনিময়ে আপনি কি পাবেন সেটাও স্মরণ করে দেখবেন।

ও–গৌরী উচ্চকণ্ঠে হসিল। তাহারা কিস্তার একেবারে কিনারায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সম্মুখে পঞ্চাশ হাত দূরে অন্ধকার দুর্গ; সেইদিকে তাকাইয়া গৌরী বলিল— বিনিময়ে রাজাকে হত্যা করে তুমি আমার প্রত্যুপকার করবে—এই না?

সহজভাবে ময়ূরবাহন বলিল–এতক্ষণে আমার সমগ্র প্রস্তাবটা আপনি বুঝতে পেরেছেন।

গৌরী তিক্তস্বরে কহিল— তুমি মনে কর ঝিন্দের সিংহাসনে আমার বড় লোভ?

মনে করা অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া আর একটি লোভনীয় জিনিস আছে— ঝড়োয়ার কস্তুরীবাঈ–

গৌরীর কঠিন স্বর তাহার কথা শেষ হইতে দিল না— চুপ! ও নাম তুমি উচ্চারণ কোরো না। এবার তোমার প্রস্তাবের উত্তর শোনো-তুমি একটা নরকের কীট, কিন্তু আমাকে লুব্ধ করতে পারবে না। সিংহাসনে আমার লোভ নেই, যা ন্যায়ত আমার নয় তা আমি চাই না। পৃথিবীতে রাজ-ঐশ্বর্যের চেয়েও বড় জিনিস আছে—তার নাম ইমান। কিন্তু সে তুমি বুঝবে না। ময়ূরবাহন, তুমি আমাকে অনেকভাবে ছোট করবার চেষ্টা করেছ, তার মধ্যে আজকের এই চেষ্টা সবচেয়ে অপমানজনক। তুমি এখন আমার মুঠোর মধ্যে, ইচ্ছে করলে তোমাকে মাছির মত টিপে মেরে ফেলতে পারি, শুধু একটু হুকুমের ওয়াস্তা। কিন্তু তোমার ওপর আমার বিদ্বেষ এত বেশী যে এভাবে মারলে আমার তৃপ্তি হবে না। তোমার সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার দিন এখনো আসেনি, কিন্তু সেদিন আসবে–হুঁশিয়ার!

গৌরী খুব সংযতভাবে ওজন করিয়া কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছিল কিন্তু শেষের দিকে তাহার কথাগুলা ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের অন্তর্গঢ় গর্জনের মত শুনাইল। সে চুপ করিলে ময়ূরবাহনও কিয়ৎকাল কথা কহিল না; তারপর ধীরে ধীরে কহিল–আপনি তাহলে আমার প্রস্তাবে রাজী নন? এই আপনার শেষ কথা?

হ্যাঁ।

ভেবে দেখুন—

দেখেছি। তুমি এখন যেতে পার।

বেশ, যাচ্ছি। কিন্তু আপনি ভাল করলেন না।

তুমি কি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ?

ময়ূরবাহন গৌরীর নিকট হইতে দুই-তিন হাত দূরে দাঁড়াইয়াছিল; এবার সে ফিরিয়া টর্চের আলো গৌরীর মুখে ফেলিল, বলিল-না—ভয় দেখিয়ে শত্রুকে সাবধান করে দেওয়া আমার স্বভাব নয়। কিন্তু আমার প্রস্তাবে রাজী হলেই সবদিক দিয়ে ভাল হত। আপনি বোধ হয় বুঝতে পারছেন না যে আপনার জীবন সূক্ষ্ম সুতোয় ঝুলছে, যে-কোনো মুহূর্তে সুতো ছিঁড়ে যেতে পারে। উদিত সিং মরীয়া হয়ে উঠেছে; কোণঠাসা বন-বেড়ালের সঙ্গে খেলা করা নিরাপদ নয়।

গৌরী হাসিল এটা তোমার নিজের কথা, না উদিতের জবানি বলছ?

নিজের কথাই বলছি।

বটে! আর কিছু বলবার আছে?

আছে। ময়ূরবাহনের স্বর বিষাক্ত হইয়া উঠিল—দৈবের কথা বলা যায় না, আপনি হয়তো বেঁচে যেতেও পারেন। কিন্তু জেনে রাখুন, ঝড়োয়ার রানীকে আপনিও পাবেন না, শঙ্কর সিংও পাবে না— তাকে ভোগ-দখল করবে উদিত সিং-বুঝেছেন?-হা-হা-হা–

তাহার হাসি শেষ হইতে না হইতে দুর্গের দিক হইতে বন্দুকের আওয়াজ হইল। কাঁধের কাছে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করিয়া গৌরী উঃ করিয়া উঠিল। ধনঞ্জয় পিছন হইতে চিৎকার করিয়া উঠিলেন— সরে আসুন! সরে আসুন! ময়ূরবাহন হাতের জ্বলন্ত টর্চটা গৌরীর গায়ে খুঁড়িয়া মারিয়া উচ্চহাস্য করিতে করিতে জলে লাফাইয়া পড়িল। মুহূর্তমধ্যে একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার ঘটিয়া গেল।

ধনঞ্জয় ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া বলিলেন—চোট পেয়েছেন? কোথায়?

গৌরী বলিল—কাঁধে। বিশেষ কিছু নয়। কিন্তু ময়ূরবাহনটা পালাল।

অন্ধকার কিস্তার বুক হইতে ময়ূরবাহনের হাসি ভাসিয়া আসিল হা-হা-হা—

ধনঞ্জয় শব্দ লক্ষ্য করিয়া পিস্তল ছুঁড়িলেন। কিন্তু কোনো ফল হইল না; আবার দুর হইতে হাসির আওয়াজ আসিল। তীব্র স্রোতের মুখে ময়ূরবাহন তখন অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে।

ধনঞ্জয় রুদ্ররূপকে বলিলেন–তুমি যাও; পুলের মুখে আমাদের লোক আছে, সেখানে যদি ময়ূরবাহন জল থেকে ওঠবার চেষ্টা করে, তাকে ধরবে।

রুদ্ররূপ প্রস্থান করিল।

ধনঞ্জয় তখন গৌরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন— আপনার আঘাত গুরুতর নয়? সত্যি বলছেন?

গৌরী বলিল—এখন সামান্য একটু চি-চিন্ করছে। বোধ হয় কাঁধের চামড়াটা ছিঁড়ে গেছে।

যাক, কান ঘেঁষে গেছে। চলুন— ছাউনিতে ফেরা যাক।

চল।

যাইতে যাইতে ধনঞ্জয় বলিলেন—উঃ-কি ভয়ানক শয়তানি বুদ্ধি। নিজে নিরস্ত্র এসেছে, আর দুর্গে লোক ঠিক করে এসেছে। কথায় বার্তায় আপনাকে দুর্গের কাছে বন্দুকের পাল্লার মধ্যে নিয়ে গিয়ে তারপর মুখের উপর টর্চের আলো ফেলেছে— যাতে দুর্গ থেকে বন্দুকবাজ আপনাকে দেখতে পায়। ব্যাপারটা ঘটবার আগে পর্যন্ত ওদের মতলব কিছু বুঝতে পারিনি।

না। কিন্তু আমি ভাবছি, ময়ূরবাহন শেষকালে যা বললে তার মানে কি!

কি বললে?

গৌরী জবাব দিতে গিয়া থামিয়া গেল। বলিল—কিছু না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *