• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১৭. শক্তিগড়

লাইব্রেরি » শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » উপন্যাস সমগ্র - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ঝিন্দের বন্দী » ১৭. শক্তিগড়

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
শক্তিগড়

কিস্তা নদী যেখানে দুন্দুভির ন্যায় শব্দ করিতে করিতে নিম্নের উপত্যকায় ঝরিয়া পড়িয়াছে, সেখান হইতে প্রায় দুইশত গজ দূরে কিস্তার উত্তর তীরে শক্তিগড় দুর্গ অবস্থিত। কিস্তার তীরে বলিলে ঠিক বলা হয় না; বস্তুত দুর্গটি উত্তরটলগ্ন জলের ভিতর হইতেই মাথা তুলিয়াছে। এই স্থানে কিস্তা অসমতল প্রস্তরবন্ধুর খাতের ভিতর দিয়া বহিয়া গিয়াছে, জলের ভিতর হইতে বড় বড় পাথরের চাপ মাথা জাগাইয়া আছে। এইরূপ কতকগুলি অর্ধনগ্ন প্রস্তরশীর্যের ভিত্তির উপর উত্তর তীর ঘেঁষিয়া শক্তিগড় দুর্গ নির্মিত।

জলের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া শক্তিগড়ের চারিপাশে পরিখা খননের প্রয়োজন হয় নাই; কিস্তার প্রস্তরবিক্ষুব্ধ ফেনায়িত জলরাশি তাহাকে বেষ্টন করিয়া সগর্জনে বহিয়া গিয়াছে। একটি সঙ্কীর্ণ সেতু খরস্রোতা প্রণালীর উপর দিয়া তীরের সহিত শক্তিগড় দুর্গের সংযোগ সাধন করিয়াছে। ইহাই দুর্গপ্রবেশের একমাত্র পথ।

শক্তিগড় দুর্গটি আয়তনে ছোট। দুর্গের আকারে নির্মিত হইলেও প্রকৃতপক্ষে ইহা একটি প্রাচীর পরিখাবেষ্টিত রাজপ্রাসাদ। নিরুপদ্রব ভোগবিলাসের জন্যই বোধ করি অতীতকালের কোনো বিলাসী। রাজা ইহা নির্মাণ করাইয়াছিলেন। দুর্গটি এমনভাবে তৈয়ারি যে, মাত্র পাঁচ-ছয় জন বিশ্বাসী লোক লইয়া দুর্গের লৌহদ্বার ভিতর হইতে রোধ করিয়া দিলে অগণিত শত্ৰু দীর্ঘকাল অবরোধ করিয়াও ইহা দখল করিতে পারিবে না। কিস্তার গর্ভ হইতে কালো পাথরের দুর্ভেদ্য প্রাকার উঠিয়াছে; মাঝে মাঝে স্থূল স্তম্ভাকৃতি বুরুজ। প্রাকারগাত্রে স্থানে স্থানে পর্যবেক্ষণের জন্য সঙ্কীর্ণ ছিদ্র। বাহির হইতে দেখিলে দুর্গটিকে একটি নিরেট পাথরের সুবর্তুল তৃপ বলিয়া মনে হয়।

দুর্গদ্বারের সম্মুখে প্রায় দেড়শত গজ দূরে ফাঁকা মাঠের উপর গৌরীর তাম্বু পড়িয়াছিল। মধ্যস্থলে গৌরীর জন্য একটি বড় শিবির; তাহার চারিপাশে সহচরদিগের জন্য কয়েকখানা ছোট তাম্বু। সবগুলি তাম্বু ঘিরিয়া কাঁটাতারের বেড়া। ধনঞ্জয় কোনো দিকেই সাবধানতার লাঘব করেন নাই। এইখানে হেমন্ত অপরাহের সোনালী আলোয় গৌরী সদলবলে আসিয়া উপনীত হইল।

অশ্বপৃষ্ঠে এতদূর আসিয়া গৌরী ঈষৎ ক্লান্ত হইয়াছিল; ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস অনেক দিন গিয়াছে। তাই নিজের তাম্বুতে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিয়া ও কিছু জলযোগ করিয়া সে নিজেকে চাঙ্গা করিয়া লইল। ধনঞ্জয়ের দেহে ক্লান্তি নাই, তিনি আসিয়া বলিলেন–উদিতের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বোধ হয় ঘাবড়ে গেছে। আমরা যে আসতে পারি, তা বেচারা বোধ হয় প্রত্যাশাই করেনি। চলুন কিস্তার ধারে একটু বেড়াবেন; জায়গাটা আপনাকে দেখিয়ে শুনিয়ে দিই।

দুইজনে বাহির হইলেন; রুদ্ররূপ তাঁহাদের সঙ্গে রহিল। কাঁটাবেড়ার ব্যহমুখে বন্দুক-কিরিচ-ধারী শাস্ত্রীর পাহারা। তাহাকে অতিক্রম করিয়া তিনজনে দুর্গদ্বারের দিকে চলিলেন।

দুর্গের কাছাকাছি কোথাও লোকালয় নাই; প্রায় অর্ধক্রোশ দূরে কিস্তার তটে ঘন-নিবিষ্ট খড়ের চাল একটি গ্রামের নির্দেশ করিতেছে। গ্রামের ঘাটে জেলেডিঙির মত কয়েকটি ক্ষুদ্র নৌকা বাঁধা। সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া ধনঞ্জয় বলিলেন— ঐ শক্তিগড় গ্রাম—ওটা উদিতের জমিদারী। ওখানকার প্রজারা সব উদিতের গোঁড়া ভক্ত।

গৌরী বলিল— কাছাকাছি কোথাও শস্যক্ষেত্র দেখছি না; এই সব প্রজাদের জীবিকা কি?

প্রধানত মাছ ধরাই ওদের ব্যবসা। এ অঞ্চলে জা কি জোয়ার পর্যন্ত জন্মায় না। তা ছাড়া কুটিরশিল্প আছে— ওরা খুব ভাল জহুরীর কাজ করতে পারে।

গৌরী দুর্গের দিকে দৃষ্টি ফিরাইল দুর্গের সিংদরজা তো বন্ধ দেখছি; কোথাও জনমানবের চিহ্ন আছে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যাপার কি? কেউ নেই নাকি?

ধনঞ্জয় হাসিয়া বলিলেন— আছে বৈকি! তবে বেশী লোক নেই, গুটি পাঁচ-ছয় বিশ্বাসী অনুচর আছে। কিন্তু আপনি অত কাছে যাবেন না। প্রাকারের গায়ে সরু সরু ফুটো দেখতে পাচ্ছেন? ওর ভেতর থেকে হঠাৎ বন্দুকের গুলি বেরিয়ে আসা অসম্ভব নয়— পাল্লার বাইরে থাকাই ভাল।

দুর্গের এলাকা সাবধানে অতিক্রম করিয়া পশ্চিমদিকে খানিকদুর গিয়া তাঁহারা কিস্তার পাড়ে দাঁড়াইলেন। কিস্তার জলে অস্তমান সূর্যের রাঙা ছোপ লাগিয়েছে; শক্তিগড়ের নিকষকৃষ্ণ দেহেও যেন কুঙ্কুমপ্রলেপ মাখাইয়া দিয়াছে। গৌরীর মনে পড়িল প্রহ্লাদের চিঠির কথা। এই দিকেই প্রাকার গাত্রে কোথাও একটি ক্ষুদ্র গবাক্ষ আছে–সেই গবাক্ষ চিহ্নিত কক্ষে শঙ্কর সিং অবরুদ্ধ। গৌরী পর্যবেক্ষণ করিয়া দেখিল এদিকে জল হইতে তিন-চার হাত উপরে কয়েকটি চতুষ্কোণ জানালা রহিয়াছে; তাহার মধ্যে কোনটি শঙ্কর সিং-এর জানালা, তাহা অনুমান করা শক্ত। জানালাগুলির নিম্নে ক্ষুব্ধ জলরাশি আবর্তিত হইয়া বহিয়া গিয়াছে নিম্নে নিমজ্জিত পাথর আছে। সাঁতার কাটিয়া বা নৌকার সাহায্যে জানালার নিকটবর্তী হওয়া কঠিন।

দুর্গের দিক হইতে চক্ষু ফিরাইয়া গৌরী কিস্তার অপর পারে তাকাইল। এতক্ষণ সে লক্ষ্য করে নাই; নদীর অপর পারে দুর্গের প্রায় সমান্তরালে একটি বেশ বড় বাগানবাড়ি রহিয়াছে। কিস্তা এখানে প্রায় তিনশত গজ চওড়া, তাই পরপার পরিষ্কার দেখা যায় না; তবু একটি উপবন-বেষ্টিত প্রাসাদ সহজেই চোখে পড়ে। বাগানের প্রান্তে একটি বাঁধানো ঘাটও কিস্তার জলে ধাপে ধাপে অবগাহন করিতেছে। এই বাগান ও বাড়িতে বহুলোকের চলাচল দেখিয়া মনে হয়, যেন ওই বিজনপ্রান্তে কোনও উৎসবের আয়োজন চলিতেছে।

গৌরী বলিল—একটা বাগানবাড়ি দেখছি। ওটাও কি উদিতের নাকি?

ধনঞ্জয় বলিলেন— না। নদীর ওপারে উদিতের সম্পত্তি কি করে হবে— ওটা ঝড়োয়া রাজ্যের অন্তর্গত। বাগানবাড়িটা ঝড়োয়ার বিখ্যাত সর্দার অধিক্রম সিংয়ের সম্পত্তি; ওদিকটা সবই প্রায় তার জমিদারী। তারপর চোখের উপর করতল রাখিয়া কিছুক্ষণ সেইদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন—কিন্তু অধিক্রমের বাগানবাড়িতে এত লোক কিসের? অধিক্রম মাঝে মাঝে তার জমিদারীতে এসে থাকে বটে, কিন্তু এ যেন মনে হচ্ছে কোনও উৎসব উপলক্ষে বাগানবাড়ি সাজানো হচ্ছে! কি জানি, হয়তো তার মেয়ের বিয়ে।

রুদ্ররূপ পিছন হইতে সসম্ভ্রমে বলিল— আজ্ঞে হাঁ, অধিক্রম সিংয়ের মেয়ে কৃষ্ণাবাঈয়ের সঙ্গে হাবিলদার বিজয়লালের বিয়ে।

গৌরী সচকিত হইয়া বলিল— তাই নাকি! তুমি কোথা থেকে শুনলে?

রুদ্ররূপ বলিল— শহরে অনেকেই বলাবলি করছিল। শুনেছি, ঝড়োয়র রানী নাকি স্বয়ং এ বিয়েতে উপস্থিত থাকবেন। কৃষ্ণাবাঈ রানীর সখী কিনা।

গৌরী জিজ্ঞাসা করিল—কবে বিয়ে?

তা বলতে পারি না। বোধ হয় পরশু।

সে রাত্রে কৃষ্ণা যে ইঙ্গিত করিয়াছিল শীঘ্রই আবার সাক্ষাৎ হইতে পারে, গৌরী এতক্ষণে তাহার অর্থ বুঝিতে পারিল। বাপের জমিদারী হইতে কৃষ্ণার বিবাহ হইবে; রানীও আসিবেন। সুতরাং এত কাছে থাকিয়া দেখা সাক্ষাৎ হইবার কোনো বিয় নাই। অধিক্রম সিং কন্যার বিবাহে হয়তো রাজাকে নিমন্ত্রণ করিতেও পারেন।

গৌরীর ধমনীতে রক্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল; সে একদৃষ্টে ঐ উদ্যানবেষ্টিত বাড়িটার দিকে চাহিয়া রহিল।

এই সময় দূরে দুর্গদ্বারে ঝনৎকার শুনিয়া তিনজনেই সেইদিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। দুইজন অশ্বারোহী আগে পিছে সঙ্কীর্ণ সেতুর উপর দিয়া বাহিরে আসিতেছে। দূর হইতে অপরাহের আলোকে তাহাদের চেহারা ভাল দেখা গেল না। ধনঞ্জয় শ্যেনদৃষ্টিতে কিয়ৎকাল সেইদিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন— উদিত আর ময়ূরবাহন। তাঁহার মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল; তিনি একবার কাঁটা-তার বেষ্টিত তাম্বুর দিকে তাকাইলেন, কিন্তু এখন আর ফিরিবার সময় নাই; উদিত তাঁহাদের দেখিতে পাইয়াছে এবং এই দিকেই আসিতেছে। তিনি গৌরীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন–ওরা আপনার কাছেই আসছে, সম্ভবত দুর্গের ভিতরে নিয়ে যাবার আমন্ত্রণ করবে। রাজী হবেন না। আর সতর্ক থাকবেন প্রকাশ্যে কিছু করতে সাহস করবে না বোধ হয়—তবু। রুদ্ররূপ, তোমার পিস্তল আছে?

আছে।

বেশ। তৈরি থাকো। বিশেষভাবে ময়ূরবাহনটার দিকে লক্ষ্য রেখো। বলিয়া তিনি গৌরীর পাশ হইতে কয়েক পা সরিয়া দাঁড়াইলেন। রুদ্ররূপও পিছু হটিয়া কিছু দূরে সরিয়া গেল। দুইজনে এমনভাবে দাঁড়াইলেন যাহাতে উদিত ও ময়ূরবাহন আসিয়া গৌরীর সম্মুখে দাঁড়াইলে তাঁহারা দুইপাশে থাকিয়া তাহাদের উপর নজর রাখিতে পারেন।

উদিত ও ময়ূরবাহন ঘোড়া ছুটাইয়া গৌরীর দুই গজের মধ্যে আসিয়া ঘোড়া থামাইল; তারপর ঘোড়া হইতে নামিয়া যুক্তকর কপালে ঠেকাইয়া অবনতশিরে গৌরীকে অভিবাদন করিল। ধনঞ্জয় তাহা দেখিয়া মনে মনে বলিলেন–ভক্তি কিছু বেশী দেখছি।

বাহ্য ব্যবহারে সম্ভ্রম প্রকাশ পাইলেও উদিতের মুখের ভাবে কিন্তু বিশেষ প্রসন্নতা লক্ষ্যগোচর হইল না; সে যেন নিতান্ত গরজের খাতিরেই বাধ্য হইয়া অযোগ্য ব্যক্তিকে সম্মান দেখাইতেছে। বস্তুত তাহার চোখের দৃষ্টিতে বিদ্রোহপূর্ণ অসহিষ্ণুতার আগুন চাপা রহিয়াছে তাহা দেখিলেই বুঝা যায়। ময়ূরবাহনের মুখের ভাব কিন্তু অতি প্রসন্ন, তাহার কিংশুকফুল্ল অধরে যে হাসিটি ক্রীড়া করিতেছে তাহাতে ব্যঙ্গ বিদ্রূপের লেশমাত্র নাই, বরঞ্চ ঈষৎ অনুতপ্ত পিরবশ্যই ফুটিয়া উঠিতেছে। সে যেন পূর্বদিনের ধৃষ্টতার জন্য লজ্জিত।

উদিত প্রথম কথা কহিল। একবার গলা ঝাড়িয়া লইয়া পাখিপড়ার মত বলিল— মহারাজ স্বাগত। মহারাজকে সানুচর আমার দুর্গমধ্যে আহ্বান করতে পারলাম না সে জন্য দুঃখিত। দুর্গে স্থানাভাব। তবে যদি মহারাজ একাকী বা দু-একজন ভৃত্য নিয়ে দুর্গে অবস্থান করতে সম্মত হন, তাহলে আমি সম্মানিত হব।

গৌরী মাথা নাড়িল, নিরুৎসুক স্বরে বলিল— উদিত, তোমাকে সম্মানিত করতে পারলাম না। নর্গের বাইরে আমি বেশ আছি। ফাঁকা জায়গায় থাকাই স্বাস্থ্যকর, বিশেষত যখন শিকার করতে বেরিয়েছি।

উদিত বলিল— মহারাজ কি সন্দেহ করেন দুর্গের ভিতরে থাকা তাঁর পক্ষে অস্বাস্থ্যকর? তাহার কথার খোঁচাটা চোখের অনাবৃত বিদ্রূপে আরো স্পষ্ট হইয়া উঠিল।

গৌরী উত্তর দিতে যাইতেছিল, কিন্তু তৎপূর্বেই ময়ূরবাহন হাসিতে হাসিতে বলিল–অস্বাস্থ্যকর বৈকি! মহারাজ, আপনি দুর্গে থাকতে অস্বীকার করে দূরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছেন। দুর্গে একজন লোক সংক্রামক রোগে ভুগছে। আপনার বাইরে থাকাই সমীচীন।

গৌরী তাহার দিকে ভ্রুকুটি করিয়া জিজ্ঞাসা করিল-সংক্রামক রোগটা কি?

ময়ূরবাহন তাচ্ছিল্যভরে বলিল—বসন্ত। লোকটা বোধ হয় বাঁচবে না।

গৌরী জিজ্ঞাসা করিল—লোকটা কে?

এবার উদিত উত্তর দিল; প্রত্যেকটা শব্দ দাঁতে ঘষিয়া ধীরে ধীরে বলিল—একটা বাঙালী—চেহারা অনেকটা আপনারই মত। লোকটা আমার এলাকায় এসে রাজদ্রোহিতা প্রচার করছিল, তাই তাকে বন্দী করে রেখেছি।

সংযতস্বরে গৌরী বলিল-বটে। কিন্তু তুমি তাকে বন্দী করে রেখেছ কোন্ অধিকারে?

ঈষৎ বিস্ময়ে ভু তুলিয়া উদিত বলিল— আমার সীমানার মধ্যে আমার দণ্ডমুণ্ডের অধিকার আছে কথা কি মহারাজ জানেন না?

গৌরী পলকে নিজেকে সামলাইয়া লইল, অবজ্ঞাভরে বলিল— শুনেছি বটে। কিন্তু সে-লোকটা ব রাজদ্রোহ প্রচার করে থাকে তাহলে তাকে রাজ-সকাশে পাঠানোই উচিত ছিল, তার অপরাধের বিচার আমি করব। উদিত, তুমি অবিলম্বে এই বিদ্রোহীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।

উদিত অধর দংশন করিল। কুটিল বাক্য হানাহানিতে সে পটু নয়; তাই নিজের কথার জালে নিজেই জড়াইয়া পড়িয়াছে। সে ক্রুদ্ধ-চোখে চাহিয়া কি একটা রূঢ় উত্তর দিতে যাইতেছিল ময়ূরবাহন মাঝে পড়িয়া তাহা নিবারণ করিল। প্রফুল্লস্বরে বলিল—মহারাজ ন্যায্য কথাই বলেছেন। কুমার উদিতেরও তাই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু লোকটা হঠাৎ রোগে পড়ায় আর তা সম্ভব হয়নি। তার অবস্থা ভাল নয়, হয়তো আজ রাত্রেই মরে যাবে। এ রকম অবস্থাতে তাকে মহারাজের কাছে পাঠানো নিতান্ত নৃশংসতা হবে। তবে যদি সে বেঁচে যায়, তাহলে কুমার উদিত নিশ্চয় তাকে বিচারের জন্য মহারাজের হুজুরে হাজির করবেন। কিন্তু বাঁচার সম্ভাবনা তার খুবই কম।

গৌরী আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া যেন ভাবিতে ভাবিতে বলিল–লোকটা যদি মারা যায়। তাহলে কিন্তু বড় অন্যায় হবে। মৃত্যু বড় সংক্রামক রোগ, দুর্গের অন্য অধিবাসীদেরও আক্রমণ। করতে পারে।

অকৃত্রিম হাসিতে ময়ূরবাহনের মুখ ভরিয়া গেল। এই নিগুঢ় বাকযুদ্ধ সে পরম কৌতুকে উপভোগ করিতেছিল, এখন সপ্রশংস নেত্রে গৌরীর মুখের পানে চাহিল। উদিত কিন্তু আর। অসহিষ্ণুতা দমন করিতে পারিল না, ঈষৎ কর্কশস্বরে বলিয়া উঠিল–ওকথা থাক। মহারাজকে দুর্গে নিমন্ত্রণ করলাম— তিনি যদি সম্মত না হন, তাঁবুতে থাকাই বেশী স্বাস্থ্যকর মনে করেন, সে তাঁর অভিরুচি! বলিয়া অশ্বে আরোহণ করিতে উদ্যত হইল।

ময়ূরবাহন মৃদুস্বরে তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিল— শিকারের কথাটা–

উদিত ফিরিয়া বলিল— হাঁ–। মৃগয়ার সব আয়োজন করেছি। আমার জঙ্গলে বরাহ হরিণ পাওয়া যায় জানেন বোধ হয়। যদি ইচ্ছা করেন, কাল সকালেই শিকারে বেরোনো যেতে পারে।

গৌরী বলিল-বেশ, কাল সকালেই বেরোনো যাবে।

উদিত লাফাইয়া ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া বসিল, তারপর ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া অবজ্ঞাভরে একটা নমস্তে বলিয়া ঘোড়া ছুটাইয়া দিল।

ময়ূরবাহন তখনও ঘোড়ায় চড়ে নাই। উদিত দূরে চলিয়া গেলে ময়ূরবাহন রেকাবে পা দিয়া অনুচ্চস্বরে বলিল–আপনার সঙ্গে আমার একটা গোপনীয় কথা আছে। কথাগুলি সে এত। নিম্নকণ্ঠে বলিল যে অদূরস্থ ধনঞ্জয়ও তাহা শুনিতে পাইলেন না।

গৌরী সপ্রশ্ননেত্রে চাহিল।

ময়ূরবাহন পূর্ববৎ বলিল— এখন নয়। আজ রাত্রে আমি আসব। এগারোটার সময় এইখানে আসবেন, তখন কথা হবে। নমস্তে! বলিয়া মাথা ঝুঁকাইয়া সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়া ঘোড়ায় চড়িল; তারপর তাহার শাহত ঘোড়া দ্রুতবেগে উদিতের অনুসরণ করিল।

Category: ঝিন্দের বন্দী
পূর্ববর্তী:
« ১৬. বিনিয়োগ
পরবর্তী:
১৮. রাত্রির ঘটনা »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑