১০. বিষ্কম্ভক

দশম পরিচ্ছেদ
বিষ্কম্ভক

পরদিন প্রভাতে ঈষৎ জ্বরভাব লইয়া গৌরী শয্যাত্যাগ করিল। তাহার শরীরে রোগ প্রতিরোধ করিবার প্রভূত শক্তি সঞ্চিত ছিল, তাই ক্লান্ত দেহের উপর জলমজ্জনেও তাহাকে বিশেষ কাবু করিতে পারে নাই-নচেৎ নিউমোনিয়া কি ঐ জাতীয় কোনো রোগ পাকাইয়া ভোলা অসম্ভব ছিল না।

উপরন্তু কাল রাত্রে ঘুমও ভাল হয় নাই। রুদ্ররূপকে শয়নঘরের দ্বারের কাছে পাহারায় রাখিয়া সে শয্যা আশ্রয় করিয়াছিল বটে কিন্তু নানা চিন্তায় রাত্রি তিনটা পর্যন্ত নিদ্রা তাহার চোখে দেখা দেখা দেয়। নই। যতই তাহার মন কস্তুরীবাঈকে কেন্দ্র করিয়া মাধুর্যের রসে পরিপ্লুত হইয়া  উঠিতেছিল, মাধুর্যের আবেশে একথাও সে কিছুতেই ভুলিতে পারে নাই যে,–সে অনধিকারী, এই সাহচর্যের অমৃত মনে মনে আস্বাদন করিবারও তাহার সত্যকার দাবি নাই। কে সে? আজ যদি শঙ্কর সিংকে উদ্ধার করা যায়, কাল গৌরীশঙ্কর রায় নামধারী যুবককে ছদ্মবেশে মুখ লুকাইয়া এদেশ ছাড়িয়া যাইতে হইবে। আর তাহাই তো ঘটিবে—আজ হোক, কাল হোক, শঙ্কর সিং ফিরিয়া আসিয়া নিজের ন্যায্য স্থান অধিকার করিবে, কস্তুরীবাঈয়ের সহিত তাহার বিবাহ হইবে। তখন এই অখ্যাতনামা বাঙালী যুবককে কে স্মরণ রাখিবে? দু একটা ধন্যবাদের বাঁধাবুলি বলিয়া তাড়াতাড়ি বিদায় করিয়া দিবে। কস্তুরী কিছু জানিতেও পারিবে না।

কিন্তু শঙ্কর সিং যদি ফিরিয়া না আসে? যদি উদিত তাহাকে সত্যই খুন করিয়া থাকে?—গৌরী জোর করিয়া এ চিন্তা মন হইতে দূরে ঠেলিয়া দিল। সে সম্ভাবনার কথা ভাবিতেও তাহার বুক দুরুদুরু করিয়া কাঁপিয়া উঠিল।

কস্তুরীকেও সে মন হইতে সরাইয়া দিবার চেষ্টা করিল। না— পরের বাগদত্তা স্ত্রীর কথা সে ভাবিবে না, এবং ভবিষ্যতে যদিও সে সম্ভাবনা খুবই কম—যাহাতে দেখা না হয় সেদিকে সতর্ক থাকিবে।

এইরূপ স্থির করিয়া সে শেষরাত্রে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।

প্রাতে উঠিয়া সে দেখিল চম্পা দ্বারের কাছে হাজির আছে। আশ্চর্য হইয়া বলিল— চম্পা, তুমি কি রাত্রে ঘুমোও না?

চম্পা সরল চোখদুটি তুলিয়া বলিল— ঘুমিয়েছিলাম তো!

গৌরী বলিল— কিন্তু এত সকালে উঠলে কি করে?

চম্পা গভীরভাবে বলিল—আমি না উঠলে যে মহলের আর কেউ ওঠে না, সবাই কাজে গাল করে। তাই সবার আগে আমায় উঠতে হয়।

গৌরী হাসিল। বৃহৎ রাজ-সংসারের সহস্র কমভারে অবনত এই ছোট্ট মেয়েটি তাহার স্নেহ জয় করিয়া লইয়াছিল। তাহার মনে হইল চম্পা যেন এই ঝি রাজবংশের রাজলক্ষ্মী। এত সহজ সরল অথচ এমন গৃহিণীর মত কর্মপটু মেয়ে সে আর কখনো দেখে নাই! চম্পাকে প্রাসাদের দাসী চাকরানী অত্যন্ত সম্ভ্রম ও ভয় করিয়া চলে তাহা সে দেখিয়াছিল। মাঝে যেকয়মাস চম্পা ছিল না, সে কয়মাস রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে একপ্রকার অরাজকতার সৃষ্টি হইয়াছিল; চম্পার পুনরাবিভাবের সঙ্গে সঙ্গে আবার সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিয়াছে।

গৌরীর অসুস্থতার কথা শুনিয়া চম্পা উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল—ডাক্তারকে ডেকে পাঠাই। এখনো তো সর্দারজি আসেননি, রুদ্ররূপকেই পাঠাই।

রুদ্ররূপ কোথায়?

চম্পা হাসিয়া বলিল— আপনার দোরের বাইরে নাক ডাকিয়ে পাহারা দিচ্ছে।

আহা, বেচারা বোধহয় শেষরাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাকে এখন ডেকো না। আমার ডাক্তারের দরকার নেই, তুমি শুধু একবাটি গরম দুধ আমাকে পাঠিয়ে দাও।

তা আনছি! কিন্তু ডাক্তারেরও আসা দরকার। বলিয়া চম্পা প্রস্থান করিল।

অল্পকাল পরেই রুদ্ররূপ ঘরে ঢুকিয়া স্যালুট করিয়া দাঁড়াইল। তাহার গায়ে তখনো গত রাত্রির যোচূবেশ, কোমরে লম্বিত তলোয়ার, মাথার পাগড়ি অটুট—কিন্তু চোখে ঘুম জড়াইয়া রহিয়াছে। গৌরী হাসিয়া বলিল–চম্পা ঘুমতে দিলে না?

রুদ্ররূপ লজ্জিতভাবে বলিল—সকালবেলা একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল।

তা হোক—বোসো— গৌরী নিজে একটা কৌচে বসিয়াছিল, পাশের স্থানটা দেখাইয়া দিল।

রুদ্ররূপ বলিল— কিন্তু চম্পাদেঈ যে ডাক্তার ডাকতে বললেন!

তা বলুক— তুমি বোসো।

রাজার পাশে একাসনে বসিতে রুদ্ররূপ রাজী হইল না। সে ঘরের এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করিল, কিন্তু নিম্ন আসন কিছু চোখে পড়িল না। তাহাকে ইতস্তত করিতে দেখিয়া গৌরী বলিল—–আমার পাশে এসে বোসো, এখন তো বাইরের কেউ নেই।

রুদ্ররূপ তখন সঙ্কুচিত হইয়া কৌচের একপাশে বসিল। কিছুক্ষণ একথা সেকথার পর বাহিরে চম্পার পদধ্বনি শুনা গেল। রুদ্ররূপ অমনি তড়াক করিয়া উঠিয়া ফৌজী প্রথায় শক্ত হইয়া গোড়ালিতে গোড়ালি ঠেকাইয়া যষ্টিবৎ দাঁড়াইল। রাজার পাশে একাসনে বসিবার বেয়াদবি যদি চম্পার চোখে পড়ে তাহা হইলে আর রক্ষা থাকিবে না।

রেকাবের উপর দুধের বাটি লইয়া চম্পা প্রবেশ করিল। রুদ্ররূপকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া ভ্রূকুটি করিয়া বলিল— তুমি এখনো যাওনি যে?

রুদ্ররূপ চমকাইয়া উঠিয়া আমতা-আমতা করিয়া বলিল–কুমার বললেন যে ডাক্তারের দরকার নেই।

চম্পা মুখ রাঙা করিয়া বলিল— রাজার মত নিতে আমি তোমায় বলেছিলাম?

রুদ্ররূপ অপরাধীর মত চুপ করিয়া রহিল। চম্পা দ্বারের দিকে অঙ্গুলি দেখাইয়া বলিল— যাও এখনি।

করুণ নেত্রে রুদ্ররূপ গৌরীর দিকে চাহিল। গৌরী হাসিতে লাগিল, বলিল— যাও, রুদ্ররূপ। এ মহলে চম্পার হুকুমই সকলকে মেনে চলতে হয়– এমন কি আমাকেও।

যো হুকুম বলিয়া রুদ্ররূপ দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।

দুধের বাটিতে এক চুমুক দিয়া গৌরী সকৌতুকে বলিল–এখানে সবাই তোমাকে ভয়ঙ্কর ভয় করে—না চম্পা?

চম্পা সহজভাবে সায় দিয়া বলিল— হ্যাঁ।

বিশেষত রুদ্ররূপ।

ও ভারি বোকা—তাই ওকে কেবলি বকতে হয়।

গৌরী হাসিয়া উঠিল। দুধের বাটি শূন্য করিয়া চম্পার হাতে ফেরত দিয়া বলিল–যাও, গিন্নি ঠাকরুন, এখন সংসারের কাজকর্ম কর গে।

রুদ্ররূপ অবিলম্বে ডাক্তার লইয়া ফিরিয়া আসিল। ডাক্তার গঙ্গানাথ পরীক্ষা করিয়া বলিলেন— বিশেষ কিছু নয়, একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। আজ আর কোনো পরিশ্রম করবেন না—ঘরেই থাকুন। ব্রাণ্ডি ও কুইনিনের ব্যবস্থা করিয়া ডাক্তার প্রস্থান করিলেন।

ডাক্তার চলিয়া গেলে রুদ্ররূপকে জোর করিয়া ছুটি দিয়া গৌরী একাকী হেলান দিয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল। কলিকাতা ছাড়িবার পর আজ অসুস্থদেহে তাহার বাড়ির কথা মনে পড়িল। এ কয়দিন অভিষেকের আয়োজন ও হুড়াহুড়িতে কাহারো নিশ্বাস ফেলিবার অবকাশ ছিল না-দাদাকে। পৌঁছানোর সংবাদ দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া আসিয়াছিল, তাহাও ঘটিয়া উঠে নাই। দাদা বৌদিদি নিশ্চয় উদ্বেগে কালযাপন করিতেছেন। আর বিলম্ব করিলে হয়তো দাদা নিজেই টেলিগ্রাম করিয়া সংবাদ জানিতে চাহিবেন। অভিষেক হইয়া গিয়াছে–এ খবর অবশ্য তিনি সংবাদপত্রে জানিতে পারিয়াছেন। কিন্তু গৌরীই যে রাজা তিনি বুঝিবেন কি করিয়া? হয়তো নানা দুশ্চিন্তায় অধীর হইয়া। উঠিয়াছেন। গৌরীও ভাবিতে ভাবিতে নিজের অবহেলার জন্য অনুতপ্ত ও বিচলিত হইয়া উঠিল।

ঠিক নয়টার সময় ধনঞ্জয় দেখা দিলেন। তাঁহাকে দেখিয়াই গৌরী বলিয়া উঠিল— সর্দার, একটা বড় ভুল হয়ে গেছে, দাদাকে খবর দিতে হবে।

ধনঞ্জয় বলিলেন-বেশ তো, একখানা চিঠি লিখে দিন না।

গৌরী মাথা নাড়িয়া বলিল—না, চিঠি পৌঁছুতে তিন-চার দিন দেরি হবে। তার চেয়ে তাঁকে একটা টেলিগ্রাম করে দাও।

ধনঞ্জয় চিন্তা করিয়া বলিলেন— সে কথাও মন্দ নয়। কিন্তু আপনার নামে টেলিগ্রাম পাঠালে চলবে না। চারিদিকে শত্রু—এমনভাবে তার লিখতে হবে যাতে আপনার দাদা ছাড়া আর প্রকৃত মর্ম কেউ না বুঝতে পারে।

গৌরী বলিল— বেশ, তোমার নামেই তার পাঠানো হোক। খবরটা দাদার কাছে পৌঁছুলেই হল। এস, একটা খসড়া তৈরি করি।

দুইজনে মিলিয়া টেলিগ্রামের খসড়া তৈয়ারি করিলেন, তাহাতে লিখিত হইল—

এখানকার সংবাদ ভাল। শুভকার্য হইয়া গিয়াছে কোনো বিঘ্ন হয় নাই। ভ্রাতার জন্য চিন্তা নাই। আপনাকে মাঝে মাঝে সংবাদ দিব। আপনি আপাতত চিঠিপত্র লিখিবেন না।ধনঞ্জয়।

ধনঞ্জয় টেলিগ্রামের মুসাবিদা লইয়া প্রস্থান করিলে গৌরী অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করিতে লাগিল।

পরদিন অপরাহে গৌরী কিস্তার ধারের মুক্ত বারান্দায় গিয়া বসিয়াছিল। কাছে কেবল রুদ্ররূপ ছিল। আজ গৌরী বেশ ভালই ছিল, এমন কি এইখানে বসিয়া কিছু রাজকার্য সম্পন্ন করিয়াছিল। বজ্ৰপাণি কয়েকখানা জরুরী সনন্দ ও পরোয়ানা তাহার দ্বারা মোহর করাইয়া লইয়া গিয়াছিলেন। যদিও এসকল দলিলে মোহরের সঙ্গে রাজার সহি-দস্তখৎ দেওয়া বিধি, তবু আপাতত শুধু মোহরেই কাজ চালাইতে হইয়াছিল। শঙ্কর সিং-এর দস্তখৎ গৌরী এখনো ভাল আয়ত্ত করিতে পারে নাই।

ধনঞ্জয়ও এতক্ষণ গৌরীর কাছেই ছিলেন, এইমাত্র একটা কাজে বাহিরে ডাক পড়িয়াছে তাই উঠিয়া গিয়াছেন।

দুজনে নীরবেই বসিয়াছিল। রুদ্ররূপ একটু অন্যমনস্কভাবে বিস্তার নৌকা চলাচল দেখিতেছিল ও কোমরবন্ধে আবদ্ধ তলোয়ারখানা আঙুল দিয়া নাড়িতেছিল। তাহার পাতলা সুশ্রী ধারালো মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিয়া গৌরী হঠাৎ প্রশ্ন করিল-রুদ্ররূপ, ঝিন্দে সবচেয়ে ভাল তলোয়ার খেলোয়াড় কে বলতে পার?

রুদ্ররূপ চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল; একটু চিন্তা করিয়া বলিল— ঝিন্দের সবচেয়ে বড় তলোয়ারবাজ বোধহয় সর্দার ধনঞ্জয়না ময়ূরবাহন।

বল কি? গৌরী বিস্মিতভাবে চাহিল।

রুদ্ররূপ ঘাড় নাড়িল—হ্যাঁ–সদারজিও খুব ভাল খেলোয়াড়—বিশ বছর আগে হলে বোধহয় ময়ূরবাহনকে হারাতে পারতেন কিন্তু এখন

আর তুমি?

আমিও জানি। কিন্তু ময়ূরবাহন কিম্বা সর্দার আমাকে বাঁ হাতে সাবাড় করে দিতে পারেন।

গৌরী ঈষৎ বিস্মিত চোখে এই সরল নিরভিমান যোদ্ধার দিকে চাহিয়া রহিল— তারপর বলিল— আচ্ছা, তুমি ময়ূরবাহনের সঙ্গে লড়তে পার?

রুদ্ররূপ একটু হাসিয়া বলিল–হুকুম পেলেই পারি। লড়াই করব বলেই তো আপনার কুট খাচ্ছি।

মৃত্যু নিশ্চয় জেনেও?

হ্যাঁ। মৃত্যুকে আমার ভয় হয় না রাজা।

রুদ্ররূপের কাঁধে হাত রাখিয়া গৌরী জিজ্ঞাসা করিল–কিসে তোমার ভয় হয় ঠিক করে বলতে রুদ্ররূপ?

রুদ্ররূপ চিন্তা করিয়া বলিল— কি জানি। আপনাকে সম্মান করি আপনি রাজা, সর্দারকেও সম্মান করি; কিন্তু ভয় কাউকে করি বলে তো মনে হয় না।

গৌরী পুনরায় তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া গম্ভীরভাবে বলিল–কিন্তু আমি জানি তুমি একজনকে ভয় কর।

রুদ্ররূপ চকিত হইয়া চাহিল—কাকে?

চম্পাকে।

রুদ্ররূপের মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিল, সে নতনেত্রে চুপ করিয়া রহিল।

গৌরী তরলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল তুমি চম্পাকে ভালবাস-না?

রুদ্ররূপ তেমনি হেঁটমুখে বসিয়া রহিল-উত্তর করিল না।

গৌরী জিজ্ঞাসা করিল ওকে বিয়ে কর না কেন?

রুদ্ররূপ মুখ তুলিল, চোখ দুটি অত্যন্ত করুণ; আস্তে আস্তে বলিল-আমি বড় গরীব, চম্প বাবা আমার সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন না।

গৌরী চমকিয়া উঠিল, রাজার পার্শ্বচর যে গরীব হইতে পারে একথা সে ভাবিতেই পারে নাই বলিল— গরীব?

হ্যাঁ। আমরা পুরুষানুক্রমে সিপাহী, আমাদের টাকা কড়ি নেই।

তাতে কি হয়েছে?

ত্রিবিক্রম সিং একজন প্রকাণ্ড বড়মানুষ—রাজ্যের প্রধান শেঠ। তিনি আমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন কেন?

তুমি কখনো প্রস্তাব করে দেখেছ?

না।

একটু চিন্তা করিয়া গৌরী প্রশ্ন করিল—চম্পা তোমার মনের কথা জানে?

না। সে এখনো ছেলেমানুষ; তাকে রুদ্ররূপ চকিতভাবে দ্বারের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল— সর্দার আসছেন। তাঁকে–তাঁর সামনে–

না না, তোমার কোনো ভয় নেই।

সর্দার ধনঞ্জয় প্রবেশ করিলেন। গৌরী ফিরিয়া দেখিল তাঁহার মুখ গম্ভীর, হাতে একখানা চিঠি। জিজ্ঞাসা করিল—কি সর্দার?

সর্দার নিঃশব্দে চিঠি তাহার হাতে দিলেন। ঝড়োয়ার রাজ-দরবার হইতে দেওয়ান অনঙ্গদেও কর্তৃক লিখিত পত্র—সাড়ম্বরে বহু সমাসযুক্ত ভাষায় অশেষপ্রতাপ দেবপাদ শ্ৰীমন্মহারাজ শঙ্কর। সিংহকে সবিনয়ে ও সসম্রমে স্বস্তিবাচনপূর্বক জ্ঞাপন করা হইয়াছে যে, এখন মহারাজ বস্তুত ঝড়োয়া রাজ্যেরও ন্যায্য অধিপতি; সুতরাং তিনি কৃপাপূর্বক কিছুকাল তাঁহার ঝড়োয়া রাজ্যে আসিয়া রাজগৌরবে বাস করতঃ প্রজা ও ভৃত্যবৃন্দের সেবাগ্রহণ করিলে ঝড়োয়ার আপামর সাধারণ কৃতকৃতার্থ হইবে। ঝড়োয়ার মহিমময়ী রাজ্ঞী, পারিষদবৃন্দ ও প্রজা সামান্যের পক্ষ হইতে দেবপাদ মহারাজের শ্রীচরণে এই নিবেদন উপস্থাপিত হইতেছে। অলমিতি।

চিঠি পড়িতে পড়িতে গৌরীর মুখে রক্তিমাভা আনা-গোনা করিতে লাগিল। পাঠ শেষ হইয়া যাইবার পরও সে কিছুক্ষণ চিঠিখানা চোখের সম্মুখে ধরিয়া রহিল। তারপর সর্দারের দিকে চোখ। তুলিয়া দেখিল, তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছেন। সে তাচ্ছিল্যভরে পত্র ফেরত দিয়া বলিল— এ চিঠি এল কখন?

এই মাত্র।

বজ্ৰপাণি এ চিঠির মর্ম জানেন?

জানেন—তিনিই পত্র খুলেছেন।

তুমিও জানো বোধ করি?

জানি।

ঈষৎ হাসিয়া গৌরী প্রশ্ন করিল–তা তোমরা দুজনে কি স্থির করলে?

ধনঞ্জয় দুই চক্ষু গৌরীর মুখের উপর নিশ্চল রাখিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন— আমরা কিছুই স্থির করিনি। আপনি যা আদেশ করবেন তাই হবে।

গৌরী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, অজ্ঞাতসারে তাহার দৃষ্টি কিস্তার পরপারে শুভ্র রাজসৌধের। উপর গিয়া পড়িল। সে চক্ষু ফিরাইয়া লইয়া বলিল— ঝড়োয়ায় যাবার কোনো দরকার দেখি না। ওদের লিখে দাও যে অশেষপ্রতাপ দেবপাদ এখন নিজের রাজ্য নিয়েই বিশেষ ব্যস্ত আছেন, তাছাড়া তাঁর শরীরও ভাল নয়। এখন তিনি ঝড়োয়ায় গিয়ে থাকতে পারবেন না। একটু হাসিয়া বলিলচিঠিখানা বেশ মোলায়েম করে ভাল ভাল কথা দিয়ে সাজিয়ে লিখো। কিন্তু সে কাজ বোধ হয় বজ্ৰপাণি খুব ভাল রকমই পারবেন।

ধনঞ্জয়ের মুখ হইতে সংশয়ের মেঘ কাটিয়া গেল, তিনি প্রফুল্লস্বরে যো হুকুম বলিয়া প্রস্থানোদ্যত হইলেন।

গৌরী তাঁহাকে ফিরিয়া ডাকিল—তাড়াতাড়ি কিছু নেই কাল-পরশু চিঠি পাঠালেই চলবে।—এখন তুমি বোসো, কথা আছে?

ধনঞ্জয় হাঁটু মুড়িয়া গালিচার একপাশে বসিলেন। গৌরী বলিল— শঙ্কর সিং সম্বন্ধে কি হচ্ছে? তোমরা যে রকম ঢিলাভাবে কাজ করছ তাতে আমার মনঃপূত হচ্ছে না।

ধনঞ্জয় বলিলেন–ঢিলাভাবে কাজ হচ্ছে না—তবে খুব গোপনে কাজ করতে হচ্ছে। সোরগোল করে করবার মত কাজ তো নয়।

কি কাজ হচ্ছে?

শক্তিগড়ে কোনো বন্দী আছে কিনা তারি সন্ধান নেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের অনুমান বৈ তো নয়, ভুলও হতে পারে।

সন্ধান করে কিছু জানা গেল?

না। এত শীঘ্র জানা সম্ভবও নয়; মাত্র কাল থেকে লোক লাগানো হয়েছে।

গৌরী চিন্তা করিয়া বলিল— হুঁ। অন্যদিকে কোনো অনুসন্ধান হচ্ছে?

ধনঞ্জয় মাথা নাড়িয়া বলিলেন— না, অন্যদিকে যারা শঙ্কর সিং-এর অনুসন্ধান করছিল তাদের ডেকে নেওয়া হয়েছে। শঙ্কর সিং যখন সিংহাসনে আসীন রয়েছেন তখন তাঁর তল্লাস করতে গেলেই লোকে নানারকম সন্দেহ করবে।

তা ঠিক, গুপ্তচরেরা নিজেরাই সন্দেহ করতে আরম্ভ করবে।

এখন যা-কিছু অনুসন্ধান আমাদের নিজেদের করতে হবে। বাইরের লোককে কোনো কথা ঘুণাক্ষরে জানতে দেওয়া যেতে পারে না।

কিন্তু আমার আর চুপ করে বসে থাকতে ভাল লাগছে না সর্দার। এখন তো অভিষেক হয়ে গেছে, এবার উঠে পড়ে লাগা দরকার। তোমাদের রাজা-গিরি আর আমার ভাল লাগছে না।

ঈষৎ বিস্ময়ে ধনঞ্জয় তাহার দিকে চাহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন— কিন্তু উপস্থিত কিছুদিন ধৈর্য ধরে থাকতেই হবে। অন্তত যতদিন না শক্তিগড়ের পাকা খবর পাওয়া যাচ্ছে।

আরো কিছুক্ষণ এই বিষয়ে কথাবার্তার পর ধনঞ্জয় উঠিয়া গেলেন। সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছিল, কিস্তার কালো বুকে অন্ধকার পুঞ্জীভূত হইতেছিল। পশ্চিমাকাশের অস্তরাগের পশ্চাৎপটে কিস্তার সেতুটি কঙ্কাল-সেতুর মত প্রতীয়মান হইতেছিল। সেইদিকে তাকাইয়া থাকিয়া গৌরী একটা নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিল— রুদ্ররূপ, দারিদ্র কি ভালবাসার পথে খুব বড় বিঘ্ন বলে তোমার মনে হয়?

রুদ্ররূপ হেঁটমুখে কি চিন্তা করিতেছিল, চকিতভাবে মুখ তুলিয়া চাহিল।

গৌরী মুখের একটা বিমর্ষ ভঙ্গি করিয়া বলিল— তার চেয়ে ঢের বড় বাধা আছে–যা অলঙ্ঘনীয়। তুমি হতাশ হয়ো না।

আশার উল্লাসে রুদ্ররূপের মুখ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। সে আরো কিছু শুনিবার আশায় সাগ্রহে গৌরীর দিকে তাকাইয়া রহিল।

ঝড়োয়ার প্রাসাদে তখন একটি একটি করিয়া দীপ জ্বালিয়া উঠিতেছিল। গৌরী সহসা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে চল, ভেতরে যাওয়া যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *