০৮. রমণীগণ মুকুটমণি

অষ্টম পরিচ্ছেদ
–রমণীগণ মুকুটমণি—

মূর্ছা ভাঙিতেই গৌরী সটান উঠিয়া বসিয়া চোখ রগড়াইয়া বলিল— মনে পড়েছে ময়ূরবাহনের হাসি। তারপর চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেল।

দেখিল, সে মেঝের উপর বসিয়া আছে এবং তাহাকে ঘিরিয়া একপাল সুন্দরী উৎসুক কৌতূহলীনেত্রে তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। যে তরুণীটির কোলে মাথা রাখিয়া সে এতক্ষণ শুইয়া ছিল, সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া আর একজনকে মৃদুস্বরে বলিল–খবর দে।

গৌরী বলিল—ব্যাপার কি? এ আমি কোথায়?

ক্রোড়দায়িনী তরুণী চপল হাসিয়া বলিল— আপনি স্বর্গে এসেছেন। কিস্তার জলে ড়ুবে গিয়েছিলেন মনে নেই?

গৌরী বলিল— তা হবে। আপনারা সব কারা?

তরুণী বলিল— আমরা সব অপ্সরী। একটি ন্যাগ্রোধপরিমণ্ডলা রক্তাধরা অষ্টাদশী মোহিনীকে দেখাইয়া বলিল— ইনি হচ্ছেন উর্বশী। আর একটিকে দেখাইয়া–ইনি মেনকা। আর আমি—আমি রম্ভা।

গৌরী গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করিল— কাঁচা না পাকা?

যুবতী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল— আপনিই বিচার করে বলুন দেখি? বলিয়া গৌরীর সম্মুখে বসিয়া নিজের সহাস্য মুখখানি গৌরীর চোখের কাছে তুলিয়া ধরিল।

গৌরীও জহুরীর মত ভাল করিয়া পরখ করিয়া বলিল—হুঁ, নেহাৎ কাঁচা বলা চলে না, দিব্যি রঙ ধরেছে।

এমন সময় সুন্দরীচক্রের বাহির হইতে একজন বলিল— আঃ–লছমি, কি বেহায়াপনা করছিস? তোরা সব সরে যা।

সকলে সরিয়া গেলে একটি তন্বী বাঁ হাতের উপর শুষ্ক জামা কাপড় ও তোয়ালে লইয়া গৌরীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, হাসিয়া বলিল—এখন বেশ সুস্থ বোধ করছেন?

গৌরী তাহার দিকে চাহিয়া বলিল— আপনি কি তিলোত্তমা?

তন্বী বলিল না, আমি কৃষ্ণা। কিন্তু পরিচয় পরে হবে; এখন উঠুন, ভিজে কাপড়-চোপড়গুলো ছেড়ে ফেলুন।

এতক্ষণে নিজের দেহের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া গৌরী লজ্জায় একেবারে শিহরিয়া উঠিল। মুক্তার বুটিদার ঢিল-হাতার রেশমী পাঞ্জাবি জলে ভিজিয়া গায়ের সহিত একেবারে সাঁটিয়া গিয়াছে, নিম্নাঙ্গের পট্টবস্ত্রও তথৈবচ। সে জড়সড় হইয়া বলিল—এঁদের সরে যেতে বলুন।

কৃষ্ণা সকলের দিকে ফিরিয়া বলিল—তোরা বেররা এখান থেকে।

সকলে প্রস্থান করিল, বেহায়া তরুণীটি যাইতে যাইতে বলিল— আচ্ছা, আমরা আসছি আবার, পেয়েছি যখন সহজে ছাড়ছি না।

কৃষ্ণা কাপড়গুলা গৌরীর কাছে রাখিয়া বলিল— আমাদের মহলে পুরুষের পাট নেই, তাই পুরুষের কাপড় জোগাড় করা গেল না। এগুলো সব কস্তুরীর। পরে দেখুন, স্বস্তি যদি বা না পান, সুখ পাবেন নিশ্চয়! বলিয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া প্রস্থান করিল।

কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে তাহা বুঝিতে গৌরীর বাকি ছিল না। সে মনে মনে ভারি একটা কৌতুকপূর্ণ আনন্দ অনুভব করিতে লাগিল। ঝড়োয়ার পুর-ললনাদের এই অসঙ্কোচ রঙ্গ-তামাসা তাহার মনকে যেন এক নূতন রসে অভিষিক্ত করিয়া দিল। সে ভাবিল যুবক-যুবতীদের মধ্যে এমন সুন্দর এমন অবাধ স্বচ্ছন্দ মেলামেশা ভারতবর্ষের আর কোথাও নাই। গৌরী বিবাহিত হইলে বুঝিতে পারিত, বিবাহের রাত্রে নূতন বরকে লইয়া ঠিক অনুরূপ ব্যাপার বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ঘটিয়া থাকে এবং নূতন জামাইয়ের সম্মুখে ঘোমটা ও পর্দা বাঙালীর অন্তঃপুর হইতেও নিমেষে অন্তর্হিত হইয়া যায়।

কাপড় তুলিয়া লইয়া গৌরী দেখিল— সেখানা ছয় ইঞ্চি চওড়া পাড়যুক্ত ময়ূরকণ্ঠী শাড়ি। মনে মনে হাসিয়া গৌরী সেখানা পরিধান করিল। কিন্তু জামা পরিতে গিয়াই লজ্জায় তাহার মুখখানা লাল হইয়া উঠিল। ছি ছি, কৃষ্ণা যে বলিয়াছিল স্বস্তি না পান সুখ পাবেন— তার অর্থ এই! গৌরী তাড়তাড়ি সেটাকে তোয়ালে ঢাকা দিয়া রাখিয়া দিল। মনে মনে একটু রাগও হইল। কৃষ্ণা বাহিরে বেশ ভালমানুষটি, লছমির মত চপলা নয়, কিন্তু ভিতরে তাহার এত কুবুদ্ধি! দাঁড়াও, তাহাকে জব্দ করিতে হইবে।

উত্তরীয়খানা ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া লইতেই কৃষ্ণা পুনঃপ্রবেশ করিল, বলিল— হয়েছে? এবার আসুন আমার সঙ্গে।

গৌরী জিজ্ঞাসা করিল—কোথায় যেতে হবে?

কৃষ্ণা বলিল— আমি যেখানে নিয়ে যাব। অত কৌতূহল কেন?

গৌরী বলিল—বেশ চল। তোমার শাস্তি কিন্তু ভোলা রইল।

নিরীহভাবে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল— শাস্তি কিসের?

গৌরীও পাল্টা জবাব দিল অত–কৌতূহল কেন? শাস্তি যখন পাবে তার কারণও জানতে পারবে।

কৃষ্ণা গৌরীকে মর্মরের সিঁড়ি বাহিয়া উপরে লইয়া চলিল, সিঁড়ি উঠিতে উঠিতে জিজ্ঞাসা করিল— কি হয়েছিল বলুন তো? আমরা সবাই ঘাটে দাঁড়িয়ে জল-বিহার দেখছিলাম, এমন সময় একটা ভারি গণ্ডগোল শুনতে পেলাম। তার কিছুক্ষণ পরেই আপনি ভাসতে ভাসতে আমাদের ঘাটে এসে হাজির। হলেন।

গৌরী বলিল— কি যে হয়েছিল সেটা আমি এখনো ভাল রকম বুঝতে পারিনি। বাঁটুল থেকে যেমন গুলি বেরিয়ে যায় তেমনি ছিটকে কিস্তার জলে পড়েছিলুম, এইটুকুই মনে আছে।

দ্বিতলে উঠিয়া একটা দরজার সম্মুখে কৃষ্ণা দাঁড়াইল, এক হাতে পর্দা সরাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল— ভিতরে যান।

গৌরীর মনে হইল সে যেন তাহার জীবনের এক মহারহস্যের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। বুকের ভিতরটা দুরু দুরু করিয়া উঠিল। সে কৃষ্ণাকে জিজ্ঞাসা করিল–আর তুমি?

অল্প হাসিয়া কৃষ্ণা বলিল— আমিও আছি। আপনি আগে যান।

একটু ইতস্তত করিয়া গৌরী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।

প্রথমটা গৌরী ঘরের মধ্যে কাহাকেও দেখিতে পাইল না। ঘরটি প্রকাণ্ড, চমৎকারভাবে সাজানো, কিন্তু আসবাবের বাহুল্য নাই। ছাদ হইতে চারিটি বহু শাখাযুক্ত ঝড় সোনালী জিঞ্জিরে ঘরের চারি কোণে ঝুলিতেছে। তাহাদের শাখায় শাখায় অসংখ্য দীপ। ঘরের কোণে কোণে আবলুস কাঠের তেপায়ার উপর প্রায় দুই ফুট উচ্চ পিতলের নারীমূর্তি। মূর্তিগুলি অর্ধনগ্ন, একহাতে স্খলিতবস্ত্র বুকের কাছে ধরিয়া আছে— অপর হস্তটি উধ্বোঙ্খিত; সেই হস্তে ধৃত অর্ধস্ফুট কমলাকৃতি পাত্র হইতে মৃদু মৃদু সুগন্ধি ধূম উত্থিত হইতেছে। ঘরের মেঝেয় কোনো আস্তরণ নাই; পঙ্খের কাজের উপর নানা বর্ণের ঝিনুক বসাইয়া অপূর্ব কারুকার্য করা হইয়াছে। তিনদিকের দেয়ালে দশফুট উচ্চ দরজা ভারী মখমলের পর্দা দিয়া ঢাকা, চতুর্থ দিকে একটি বাতায়ন। বাতায়ন দিয়া কিস্তার দৃশ্য চোখে। পড়ে।

ঘরে কেহ নাই দেখিয়া গৌরী বিস্মিত হইয়া চারিদিকে চাহিল। পিছন ফিরিতেই দেখিল, যে-দরজা দিয়া সে প্রবেশ করিয়াছে তাহার বাহিরে দাঁড়াইয়া কৃষ্ণা হাসিতেছে এবং ঘরের ভিতরে সেই দরজারই অনতিদূরে আর একটি নারীমূর্তি দাঁড়াইয়া আছে।

সেই মূর্তিটির দিকে চাহিয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য গৌরীর হৃৎস্পন্দন যেন রুদ্ধ হইয়া গেল।

ফলফুল লতাপাতার সহিত তুলনা করিয়া সেরূপের বর্ণনা করা অসম্ভব। চুলচেরা বিশ্লেষণ করিতে যাওয়াও মুঢ়তা, কারণ বিশ্লেষণে শরীরটাই ধরা পড়ে রূপ ধরা পড়ে না। গৌরী নিস্পন্দবক্ষে সেই অপরূপ মূর্তির দিকে তাকাইয়া রহিল। তাহার মনে হইল সে যেন অজন্তার একটি জীবন্ত চিত্র দেখিতেছে। তেমনি অপূর্ব ভঙ্গিতে কাপড়খানি পরা, চোলিটি তেমনি মধুর শাসনে ঊর্ধ্বাঙ্গের চপল লাবণ্য সংযত করিয়া রাখিয়াছে, উত্তরীয়খানি তেমনি স্বচ্ছভাবে দেহটিকে যেন চন্দ্রকিরণে ঢাকিয়া রাখিয়াছে, চোলি ও নীবির মধ্যবর্তী স্থানটুকু তেমনি নির্লজ্জভাবে অনাবৃত; মাথায় তেমনি বিচিত্র সুন্দর কবরীবন্ধ, হস্তে তেমনি অপরিস্ফুট লীলাকমল। গৌরী নিশ্বাস ফেলিতে ভুলিয়া গেল।

জীবন্ত ছবিটির চোখ দুইটি একবার কাঁপিয়া খুলিয়া গিয়া আবার তৎক্ষণাৎ নত হইয়া পড়িল।

একটি ছোট্ট হাসির শব্দে গৌরী চমকিয়া চেতনা ফিরিয়া পাইল। সহসা তাহার অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিল, সে কোথায় আসিয়াছে, এ কোন্ নন্দনবনে অনধিকার প্রবেশ করিয়াছে?

কৃষ্ণা হাসিতে হাসিতে আসিয়া ছবির হাত ধরিয়া বলিল–দুজনেই যে চুপচাপ, চিনতে পারছ না নাকি? তা হবে, চোখের দেখা তো ইতিমধ্যে হয়নি, সেই যা আট বছর বয়সে একবার হয়েছিল। আচ্ছা, আমিই না হয় নূতন করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি–ইনি হচ্ছেন দেবপাদ মহারাজ শঙ্কর সিং—তোমার বর, আরইনি দেবী কস্তুরীবাঈ—আপনার রানী। আর কি—পরিচয় হয়ে গেল এবার তাহলে আমি যাই।

কস্তুরীবাঈয়ের রজনীগন্ধার কলির মত আঙুলগুলি কৃষ্ণার হাত চাপিয়া ধরিল। কৃষ্ণা তখন কানে কানে বলিল— আচ্ছা, আমি যাব না, রইলাম। কিন্তু তোমার প্রভু সাঁতার কেটে আজকের দিনে। দেখা দিতে এসেছেন, তাঁকে অভ্যর্থনা কর। বলিয়া হাত ধরিয়া তাঁহাকে গৌরীর সম্মুখে লইয়া আসিল।

গৌরী অপরাধীর মত দ্রুত-স্পন্দিত বক্ষে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মনে হইল সে ছদ্মবেশে চোরের মত পরস্ব অপহরণ করিতেছে। এই প্রীতির রত্নাগারে প্রবেশ করিবার তাহার অধিকার নাই।

কস্তুরী গৌরীর পায়ের কাছে নত হইয়া প্রণাম করিল। গৌরী অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিল— থাক থাক—হয়েছে।

কৃষ্ণা বিদ্যুৎচপল চক্ষে চাহিয়া বলিল— আপনি জল থেকে উঠেই ওঁর রাঙা পা-দুখানির ওপর মুখ রেখে শুয়ে পড়েছিলেন, তাই উনি সেটা ফেরত দিলেন।

গৌরী দেখিল, কস্তুরীর গাল দুইটি লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, সেও দেখাদেখি অত্যন্ত লাল হইয়া উঠিল। তারপর লজ্জা দমন করিয়া সহজভাবে কথা বলিবার চেষ্টা করিয়া বলিল— কি  শুভক্ষণে জলে পড়ে গিয়েছিলাম, তা এখন বুঝতে পারছি।

কৃষ্ণা কস্তুরীর গা ঠেলিয়া বলিল–নাও জবাব দাও। আমি বার বার তোমার হয়ে কথা কইতে পারি না।

কস্তুরীর ঠোঁট দুইটি একটু কাঁপিয়া উঠিল, সে নত-নয়নে ধীরে ধীরে বলিল— আপনার যে আঘাত লাগেনি এই আমাদের সৌভাগ্য।

গলাটি একটু ভাঙা-ভাঙা, কথাগুলি বাধ-বাধ; কিন্তু গৌরীর মনে হইল এমন মিষ্ট কণ্ঠস্বর বুঝি আর কাহারো নাই। আরো শুনিবার আশায় সে সতৃষ্ণভাবে কস্তুরীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল।

দুইজনেই কিছুক্ষণ নীরব; কস্তুরী নতমুখী, নখ দিয়া পদ্মের পাতা ছিড়িতেছে। কৃষ্ণা হাসিয়া উঠিল— সব কথা ফুরিয়ে গেল? আর কথা খুঁজে পাচ্ছ না? বেশ, তাহলে এবার একটু জলযোগ হোক— আসুন।

ঘরের মধ্যস্থলে মেঝের উপর কার্পেটের আসন বিছাইয়া জলযোগের আয়োজন সজ্জিত করা ছিল; মেঝের কারুকার্যের জন্য এতক্ষণ তাহা গৌরীর চোখে পড়ে নাই। সোনার থালায় ফলমূল ও মিষ্টান্ন সাজানো ছিল; গৌরী দেখিয়া আপত্তি করিয়া বলিল—এত রাত্রে আবার এ সব কেন?

কৃষ্ণা বলিল— রাত এমন কিছু বেশী হয়নি। বসুন, রাত্রির আহারটা না হয় এখানেই সম্পন্ন হল, ক্ষতি কি? আজকের দিনে আপনাকে সামনে বসিয়ে খাইয়ে সখীর কত তৃপ্তি হবে–সেটাও ভেবে দেখুন।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও গৌরী আসনে বসিল, কস্তুরী কৃষ্ণার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চুপি চুপি বলিল— তুমি খাওয়াও—আমি চললাম।

কৃষ্ণা বলিল— তা কি হয়? তুমি বসে না খাওয়ালে উনি খেতে পারবেন কেন? গলা খাটো করিয়া বলিল— তাছাড়া মহামান্য অতিথির অমর্যাদা হবে যে!

দুই সখীতে মেঝের উপর বসিল। গৌরী নীরবে আহার সম্পন্ন করিয়া জলের পাত্রটা তুলিয়া লইয়া দেখিল তাহাতে লাল রঙের পানীয় রহিয়াছে। এই কয়দিন ঝিন্দে থাকিয়া সে জানিতে পারিয়াছিল যে এখানে সংযত-মাত্রায় সুরাপান করা দোষের নয়, এমনকি ছেলে বুড়ো স্ত্রী-পুরুষ সকলেই তাহা অসঙ্কোচে করিয়া থাকে। সুতরাং এ পাত্রের লাল-পানি যে কোন্ দ্রব্য তাহাতে তাহার সন্দেহ রহিল না; সে পাত্রটি নামাইয়া রাখিয়া বলিল— আমাকে একটু সাদা জল দিন—মদ আমি খাই না।

কৃষ্ণা বিস্ফারিতনেত্রে চাহিল; গৌরী নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া চট্‌ করিয়া সামলাইয়া বলিল— অথাৎ ছেড়ে দিয়েছি, আর খাই না। ঝিন্দের শঙ্কর সিং যে ঐ রক্তবর্ণ তরল পদার্থটি কিছু অধিক মাত্রায় সেবন করিয়া থাকেন একথা ঝড়োয়ার রাজপ্রাসাদে অবশ্য অবিদিত থাকিবার কথা নয়।

কস্তুরীর মুখ সহসা আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, সে চোখ দুটি একবার গৌরীর মুখের পানে তুলিয়াই আবার নত করিয়া ফেলিল। কিন্তু এই পলকের দৃষ্টিপাতেই তাহার মনের প্রীতি-প্রফুল্ল কথাটি প্রকাশ হইয়া পড়িল। গৌরীর সারাদেহে যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল।

কৃষ্ণা দ্রুত-পদে জল আনিতে উঠিয়া গেল, গৌরী ও কস্তুরী মুখোমুখি বসিয়া রহিল। দুইজনেই সঙ্কুচিত; গোপনে কস্তুরীর দেহ আলোড়িত করিয়া লজ্জার একটা ঝড় বহিয়া গেল। ওড়নাখানা সে গায়ে ভাল করিয়া জড়াইয়া বসিল।

দুইজনে মুখোমুখি কতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকা যায়? এদিকে কৃষ্ণাও বোধ করি দুষ্টামি করিয়া ফিরিতে দেরি করিতেছে। গৌরী কণ্ঠের জড়তা দূর করিয়া আস্তে আস্তে বলিল— মদ আমি ছেড়ে দিয়েছি, প্রতিজ্ঞা করেছি জীবনে আর ও জিনিস ছোঁব না।

কথাটা বলিয়াই সে মনে মনে ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। কেন সে অকারণে এই মিথ্যা কথাটা বলিতে গেল? মদ সে ধরিলই বা কবে, ছাড়িলই বা কবে? শঙ্কর সিং-এর ভূমিকা অভিনয় করিবার হয়তো প্রয়োজন আছে, কিন্তু তাই বলিয়া অপ্রয়োজন মিথ্যাচারে কি আবশ্যক? সে নিজের উপর ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হইয়া উঠিল।

কিন্তু যে বস্তুটির লোভে সে নিজের অজ্ঞাতসারে ওকথা বলিয়াছিল তাহা পাইতে বিলম্ব হইল! আবার তেমনি একটি চকিত সলজ্জ চাহনি সুস্মিত সপ্রশংস প্রসন্নতার রসে তাহাকে অভিষিক্ত করিয়া দিয়া গেল।

কি আশ্চর্য চক্ষু! কি অপূর্ব সম্মোহন দৃষ্টি! গৌরী মাথা হেঁট করিয়া ভাবিতে লাগিল— এমন সুন্দর লজ্জা সে আর কোথায় দেখিয়াছে? ইহারা পুরুষের সম্মুখে অসঙ্কোচে বাহির হয়, ঘোমটার বালাই নাই, অথচ ভাব-ভঙ্গিতে কোথাও এতটুকু সম্ভ্রমশালীনতার অভাব নাই। বাঙালীর মেয়েরা কি ইহাদের চেয়ে অধিক লজ্জাশীলা?

জলের গেলাস লইয়া কৃষ্ণা ফিরিয়া আসিল, বলিল–ওদের আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না, ওরা আসছে সদলবলে এই ঘরে চড়াও করতে।

জল পান করিয়া গৌরী আসনে উঠিয়া দাঁড়াইল। কৃষ্ণা পানের বাটা কস্তুরীর হাতে দিয়া বলিল— নাও, বরকে পান দাও।

একটু হাসিয়া একটু লাল হইয়া কস্তুরী পানের বাটা দুই হাতে ধরিয়া গৌরীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। গৌরী সোনালী তবকমোড়া পান তুলিয়া লইয়া মুখে পুরিল।

এমন সময় আর কোনো বাধা না মানিয়া সখীর দল একঝাঁক প্রজাপতির মত ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। তাহাদের কিঙ্কিনী পাঁয়জোরের শব্দে ঘর মুখরিত হইয়া উঠিল। সকলে আসিয়া গৌরীকে ঘিরিয়া ধরিল; লছমি কপট অভিমানের সুরে বলিল–সখীকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেলেন?

সখি-বহের বাহিরে কস্তুরী কৃষ্ণার গলা জড়াইয়া কানে কানে বলিল–তোরা এখন যা হয় কর, আমি পালাই। বলিয়া অলক্ষ্যে ঘর ছাড়িয়া প্রস্থান করিল।

কিছুক্ষণ লছমির সহিত রঙ্গ-তামাসার পর গৌরী কৃষ্ণাকে ডাকিয়া বলিল–একটা বড় ভুল হয়ে গেছে, সিংগড়ে খবর পাঠানো হয়নি। তারা হয়তো ভাবছে আমি—

কৃষ্ণা বলিল— খবর অনেক আগে পাঠানো হয়েছে। আপনার স্মরণশক্তির যে রকম অবস্থা, প্রজাদের পক্ষে মোটেই শুভ নয়।

গৌরী বলিল—প্রজাপতিদের মধ্যে পড়ে প্রজাদের কথা ভুলে যাওয়া আর বিচিত্র কি?

কৃষ্ণা বলিল–আমরা কি প্রজাপতি

গৌরী হাসিয়া বলিল—সবাই নয়। তুমি ভিমরুল।

ভ্রূভঙ্গি করিয়া কৃষ্ণা বলিল–কেন—আমি ভিমরুল কেন?

গৌরী বলিল—মধুর দিকেও তোমার লোভ আছে, আবার হুল ফোটাতেও ছাড় না। 

বাঁকা হাসিয়া কৃষ্ণা বলিল—কখন হুল ফোটালাম?

গৌরী একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল কস্তুরী নাই। ভর্ৎসনাপূর্ণ চক্ষু কৃষ্ণার দিকে ফিরাইয়া বলিল— তোমার শাস্তি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম অল্প শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেব, কিন্তু তা আর হতে দিলে না।

কৃষ্ণা বলিল-সে কি? আপনার জন্য এত করলাম, তবু শাস্তি বেড়ে গেল?

ঘাড় নাড়িয়া গৌরী বলিল— হ্যাঁ!

কি করলে শাস্তি থেকে রেহাই পাব বলুন তো?

গৌরী উত্তর দিতে যাইতেছিল, এমন সময় এক প্রৌঢ়া পরিচারিকা আসিয়া কৃষ্ণার কানে কানে কি বলিল। কৃষ্ণা পরিহাস ত্যাগ করিয়া বলিল–সর্দার ধনঞ্জয় এসেছেন, বাহির-মহলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

এত শীঘ্র! গৌরীর মুখখানা একটু ম্লান হইয়া গেল; সে আর একজনের চরিত্র অভিনয় করিতেছে তাহা স্মরণ হইল। তবু হাস্যমুখে সকলের দিকে ফিরিয়া বলিল–আজ তাহলে চললাম। স্বর্গে আসবার ইচ্ছা হলে আবার কিস্তার জলে ড়ুব দেওয়া যাবে–কি বল রম্ভাবাঈ?

বোধ হয় আগে হইতে মন্ত্রণা ছিল, সকলে একসঙ্গে হাত পাতিয়া বলিল— আমাদের বকশিশ?

কি বকশিশ চাও?

আপনি যা দেবেন।

আচ্ছা বেশ। আমার সঙ্গে তো এখন কিছু নেই, এমন কি কাপড়টা পর্যন্ত ধার করা। আমি তোমদের বকশিশ পাঠিয়ে দেব। ভাল কথা, তোমাদের বিয়ে হয়েছে?

লছমি বলিল—না, আমরা সবাই কুমারী। শুধু কৃষ্ণার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

গৌরী বলিল— আচ্ছা বেশ, তাহলে কৃষ্ণা ছাড়া আর সকলকে একটি করে বকশিশ পাঠিয়ে দেব।

কৌতূহলী লছমি জিজ্ঞাসা করিল–কি বকশিশ দেবেন?

একটি করে বর। বলিয়া হাসিতে হাসিতে কৃষ্ণাকে সঙ্গে করিয়া প্রস্থান করিল।

অন্দর ও সদরের সন্ধিস্থলে কৃষ্ণা বিদায় লইল, বলিল–আমার শাস্তি কিসে লাঘব হবে, তা তো বললেন না?

আজ নয়—যদি সুবিধা হয় আর একদিন বলব। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া প্রতিহারীর অনুসরণ করিয়া গৌরী সদর মহলে প্রবেশ করিল।

মজলিশ-ঘরে ঝড়োয়ার মন্ত্রী অনঙ্গদেও এবং কয়েকজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ধনঞ্জয় ও রুদ্ররূপকে সসম্মানে মধ্যে বসাইয়া আদর আপ্যায়ন করিতেছিলেন— স্বভাবতঃই নদীবক্ষে দুর্ঘটনার কথা হইতেছিল, ধনঞ্জয় একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক আখ্যায়িকা রচনা করিয়া বুঝাইতেছিলেন যে, ব্যাপারটা নিতান্তই দৈব-দুর্ঘটনা—এমন সময় গৌরী আসিতেই সকলে সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিয়া দাঁড়াইলেন। ধনঞ্জয় দ্রুতপদে কাছে আসিয়া সামরিক প্রথায় অভিবাদন করিয়া কুশল প্রশ্ন করিলেন মহারাজ, অক্ষত আছেন? কোনো প্রকার অসুস্থতা বোধ করছেন না?

গৌরী হাসিয়া বলিল— কিছু না, বরঞ্চ ভালই বোধ করছি। কিন্তু তোমার চেহারাখানা তো ভাল ঠেকছে না সর্দার?—চোট পেয়েছ?

ধনঞ্জয় হাসিলেন; হাসিটা কিন্তু আমোদের নয়। বলিলেন— বিশেষ কিছু নয়, শরীরে চোট সামান্যই লেগেছে। কিন্তু সে যাক। অনঙ্গদেওয়ের দিকে ফিরিয়া বলিলেন–এখন অনুমতি করুন, রাজাকে নিয়ে আমরা সিংগড়ে ফিরি। সেখানে সকলেই অত্যন্ত উল্কণ্ঠিত হয়ে আছেন।

মন্ত্রী অনঙ্গদেও ঝড়োয়ার পক্ষ হইতে রাজার বিপন্মুক্তিতে আনন্দ ও অভিনন্দন প্রকাশ করিয়া শেষে বলিলেন–কিন্তু আজ রাত্রিটা মহারাজ এই পুরে বিশ্রাম করলে হত না? মহারাজের শুভাগমন এতই আকস্মিক যে, আমরা তাঁর যোগ্য সংবর্ধনা করবার অবকাশ পেলাম না

ধনঞ্জয় দৃঢ়ভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন–তা সম্ভব নয়। আজ রাত্রে মহারাজকে রাজধানীতে ফিরতেই হবে। পরে মহারাজকে সংবর্ধনা করবার আপনারা অনেক সুযোগ পাবেন, আজ অনুমতি দিন।

অনঙ্গদেও সহাস্যে বলিলেন–উনি এখন আমাদেরও মহারাজ, ওঁর ইচ্ছাই আমাদের কাছে। আদেশ। তাঁহার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে গৌরী ঘাড় নাড়িল— ভাল, পঞ্চাশজন সওয়ার সঙ্গে দিই?

একটু চিন্তা করিয়া ধনঞ্জয় বলিলেন–তা দিন। মহারাজ জীবিত আছেন সংবাদ পেয়েই আমি রুদ্ররূপকে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এসেছি। পার্শ্বচর আনবার কথা মনেই হয়নি।

অল্পকাল মধ্যেই সম্মুখে ও পশ্চাতে পঞ্চাশজন বল্লমধারী ঘোড়সওয়ার লইয়া তিনজন অশ্বারোহণে বাহির হইয়া পড়িলেন।

পথে কোনো কথা হইল না। গৌরী ঘোড়ার উপর বসিয়া হেঁটমুখে নিজের চিন্তায় মগ্ন হইয়া রহিল। কিস্তার সেতু পার হইয়া সিংগড়ে পদার্পণ করিবার পর, ধনঞ্জয় একবার মাত্র কথা কহিলেন, তীক্ষ্ণ চক্ষু তুলিয়া প্রশ্ন করিলেন—রানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল?

গৌরী নিদ্রোখিতের মত মুখ তুলিয়া বলিল–হয়েছিল।

ধনঞ্জয় আর কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না, কিন্তু তাঁহার মুখ ভীষণ অন্ধকার ও ভুকুটি কুটিল হইয়া উঠিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *