০৬. দুই ভাই

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
দুই ভাই

পরদিন প্রাতঃকালে গৌরী তখনো অনভ্যস্ত রাজপালঙ্ক ছাড়িয়া উঠে নাই সর্দার ধনঞ্জয় ভারী মখমলের পর্দা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। বলিলেন— ঘুম ভেঙেছে?

গৌরী চোখ মুছিতে মুছিতে শয্যায় উঠিয়া বসিয়া বলিল—ভেঙেছে। তুমি উঠলে কখন?

ধনঞ্জয় হাসিয়া বলিলেন— আমি ঘুমইনি। — দেওয়ান দেখা করতে আসছেন। তাঁকে সব কথা বলেছি।

গৌরীর বুকের ভিতরটা ধড়াস করিয়া উঠিল। এইবার তবে রাজা অভিনয় আরম্ভ হইল . সে একবার চক্ষু বুজিয়া মনকে স্থির ও সংযত করিয়া লইবার চেষ্টা করিল। সুদুর কলিকাতায় দাদা ও বৌদিদির মুখ একবার মনে পড়িল।

ধনঞ্জয় তাহার মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া সাহস দিয়া বলিলেন–কোনো ভয় নেই আমি আছি।

ঘরের বাহিরে খড়মের শব্দ হইল, পরক্ষণেই দেওয়ান বজ্ৰপাণি ভার্গব প্রবেশ করিলেন।

বিশেষত্ববর্জিত শীর্ণ চেহারা বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি, দেখিলে পুরোহিত ব্রাহ্মণ বলিয়া মনে হয়।

বজ্ৰপাণি তীক্ষ্মদৃষ্টিতে শয্যায় উপবিষ্ট গৌরীকে একবার দেখিয়া লইয়া হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিলেন। ভাঙা গলায় জিজ্ঞাসা করিলেন– আজ কুমার কেমন আছেন? জ্বর বোধ করি নেই?

ধনঞ্জয় সসম্রমে উত্তর করিলেন–আজ কুমার ভালই আছেন। ডাক্তার গঙ্গানাথের ঔষধে উপকার হয়েছে বলতে হবে। আজ বোধ হয় বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।

বজ্ৰপাণি বলিলেন–সেটা উচিত হবে কিনা গঙ্গানাথকে আগে জিজ্ঞাসা না করে কোনো কাজই হতে পারে না; বিশেষত অভিষেকের যখন আর মাত্র অল্পদিন বাকি তখন সাবধানে থাকতে হবে তো!

গৌরী নির্বাকভাবে একবার ইহার মুখের দিকে, একবার উহার মুখের দিকে তাকাইতে লাগিল। কিন্তু কাহারও মুখে তিলমাত্র ভাবান্তর দেখা গেল না। যেন সত্যকার কুমারের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে দুইজন পরম হিতৈষীর মধ্যে চিন্তাযুক্ত গবেষণা হইতেছে।

বজ্ৰপাণি বলিলেন –কুমার তাহলে এখন শয্যাত্যাগ করুন আমার পূজা এখনো শেষ হয়নি। বলিয়া এই বৃদ্ধ রূপদক্ষ পুনশ্চ গৌরীকে আশীর্বাদ করিয়া বিদায় হইলেন।

গৌরী জিজ্ঞাসা করিল— ব্যাপার কি? আমার আবার অসুখ হল কবে?

ধনঞ্জয় গভীরভাবে বলিলেন— আপনি আজ পঁচিশ দিন অসুখে ভুগছেন–মাঝে অবস্থা বড়ই খারাপ হয়েছিল, এখন একটু ভাল আছেন! রাজবৈদ্য এসে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে, আপনার বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করবার মত অবস্থা হয়েছে কিনা।

গৌরী খুব খানিকটা হাসিয়া লইয়া বলিল— বুঝেছি। কিন্তু অসুখটা কি হয়েছিল সেটা অন্তত আমার তো জানা দরকার।

ধনঞ্জয় মৃদু হাসিলেন— অত্যন্ত মদ খাওয়ার দরুন আপনার লিভার পাকবার উপক্রম করেছিল।

গৌরী বিছানায় শুইয়া পড়িয়া আরো খানিকটা হাসিল। এতক্ষণে সে আবার সুস্থ অনুভব করিতে লাগিল; কহিল-এ একরকম মন্দ ব্যাপার নয়! একেই বলে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে।

ধনঞ্জয় বলিলেন— হাসি নয়, কথাগুলো মনে রাখবেন শেষে বেফাঁস কিছু মুখ দিয়ে বেরিয়ে না যায়! নিন, এবার বিছানা ছেড়ে উঠুন।

গৌরী শয্যাত্যাগের উপক্রম করিতেছে, এমন সময় একটি বার-তেরো বছরের মেয়ে ভিতরের একটা দরজা দিয়া প্রবেশ করিল। ফুটন্ত গোলাপের মত সুন্দর হাসি-হাসি মুখখানি, রাঙা ঠোঁট দুটির ফাঁক দিয়া মুক্তার মত দাঁতগুলি একটুমাত্র দেখা যাইতেছে গৌরী অবাক হইয়া তাকাইয়া রহিল। মেয়েটি পালঙ্কের কাছে আসিয়া মৃদু সুমিষ্টস্বরে বলিল—কুমার, স্নানের আয়োজন হয়েছে।

গৌরী সবিস্ময়ে ধনঞ্জয়ের দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল—এটি কে?

ধনঞ্জয় মেয়েটির পিঠে হাত দিয়া বলিলেন–তুমি বাইরে অপেক্ষা করগে, কুমার যাচ্ছেন।

মেয়েটি একবার ঘাড় নীচু করিয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। তখন ধনঞ্জয় বলিলেন— এটি আপনার খাস পরিচারিকা।

সে কি রকম?

রাজ-অন্তঃপুরে পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই; রাজবংশীয় পুরুষ ছাড়া আমরা কয়েকজন মাত্র প্রবেশ করতে পারি। অন্দরমহলে চাকরবাকর সব স্ত্রীলোক; আপনি যতক্ষণ অন্তঃপুরে থাকবেন, ততক্ষণ স্ত্রীলোকেরাই আপনার পরিচর্যা করবে।

গৌরী অত্যন্ত বিব্রত হইয়া বলিল–এ আবার কি হাঙ্গামা। এ যে আমার একেবারে অভ্যাস নেই সর্দার!

তা বললে আর উপায় কি? রাজবংশের যখন এই কায়দা তখন মেনে চলতেই হবে।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া গৌরী বলিল— কিন্তু এই মেয়েটিকে তো দাসী চাকরানী বলে মনে হল না। মনে হল ভদ্রঘরের মেয়ে।

শুধু ভদ্রঘরের নয়, সম্রান্ত ঘরের মেয়ে। ওর বাবা ত্রিবিক্রম সিং ঝিন্দের একজন বনেদী  বড়লোক।

বিস্ফারিত চক্ষে গৌরী বলিল–তবে?

ধনঞ্জয় সিয়া বলিলেন— এটা একটা মস্ত মর্যাদা। রাজ্যের যে-কেউ নিজের অনুঢ়া মেয়ে বা বোনকে রাজ-অন্তঃপুরে রাজার পরিচারিকা করে রাখতে পেলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন। আমার যদি মেয়ে থাকত আমিও রাখতাম। অবশ্য পরিচারিকা নামে মাত্র রানীদের কাছে থেকে সহবত শিক্ষাই প্রধান উদ্দেশ্য।

এরকম পরিচারিকা আমার কয়টি আছে?

উপস্থিত এই একটি, আর যারা আছে তারা মাইনে করা সত্যিকারের বাঁদী?

অনেকক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া থাকিয়া গৌরী বলিল— কিছু মনে করো না সর্দার। কিন্তু এই রকম প্রথায় বনেদী ঘরের মেয়েদের কিছু অনিষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই কি?

ধনঞ্জয় বলিলেন— সম্ভাবনা নেই এমন কথা বলা যায় না, তবে বাস্তবে কখনো কোনো অনিষ্ট হয়নি। এরা বনেদী ঘরের মেয়ে বলেই একরকম নিরাপদ।

গৌরী বলিল— কিন্তু শঙ্কর সিংয়ের মত চরিত্রের লোক—

শঙ্কর সিংয়ের একটা মহৎ গুণ ছিল— তিনি নিজের অন্তঃপুরের কোনো স্ত্রীলোকের দিকে চোখ তুলে চাইতেন না।

গৌরীর মন বারবার এই সুন্দরী মেয়েটির দিকেই ফিরিয়া যাইতেছিল; সে জিজ্ঞাসা করিল— আচ্ছা, এ মেয়েটি কতদিন এই অন্তঃপুরে আছে?

ধনঞ্জয় বলিলেন— তা প্রায় দুবছর। ও-ই এখন বলতে গেলে অন্দর মহলের মালিক রানী তো কেউ এখন নেই। গত মাস-দুই ও এখানে ছিল না, ওর বাপ ওকে বিয়ে দেবার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেল, তাই আজ সকালেই আবার ফিরে এসেছে।

গৌরী গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— চমকার মেয়েটি কিন্তু!

ধনঞ্জয় হাসিয়া বলিলেন— হ্যাঁ, তবে এখনো বড় ছেলেমানুষ। ত্রিবিক্রম কেন যে সাত-তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে দেবার জন্যে লেগেছেন তা তিনিই জানেন।

গৌরী বলিল—কেন মেয়েটির বিয়ের বয়স তো হয়েছে?

ধনঞ্জয় বলিলেন— এদেশে মেয়ে পূর্ণ যৌবনবতী না হলে বিয়ে হয় না। পদাপ্রথা তো নেই, সাধারণত মেয়েরা নিজেরাই মনের মত বর খুঁজে নেয়। অবশ্য বাপ-মার অনুমতি পেলে তবে বিয়ে হয়।

গৌরী মনে মনে বলিল— বাংলাদেশের চেয়ে ভাল বলতে হবে।

এই সময় সেই মেয়েটি দরজা হইতে আবার মুখ বাড়াইয়া বলিল— কুমার, আপনার স্নানের জল ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে।

গৌরী হাসিয়া তাহাকে কাছে ডাকিল, সকৌতুকে চিবুক ধরিয়া তাহার মুখটি তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল—তোমার নাম কি?

সঙ্কোচশুন্য দুইচক্ষু গৌরীর মুখের পানে তুলিয়া মেয়েটি বলিল— আমি চম্পা।

কিছুক্ষণ গভীর স্নেহে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া গৌরী বলিল— সত্যি। তুমি চম্পা–সূর্যের সৌরভ।

স্নানান্তে যে ঘরটায় গিয়া গৌরী আহারে বসিল, সে ঘরের জানালার নীচেই কিস্তার কালো জল ছলছল শব্দে প্রাসাদমূল চুম্বন করিয়া চলিয়াছে। জানালার বাহিরের রৌদ্র প্রতিভাত ছবির দিকে তাকাইয়া গৌরী একটা নিশ্বাস ফেলিল। বাংলাদেশে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। দূরে পরিষ্কার আকাশের পটে কালো পাহাড়ের রেখা, নিকটে আলোঝলমল খরস্রোতা পার্বত্য নদী–নদীর দুইকূলে দুইটি সমৃদ্ধ নগর। প্রায় আধ মাইল দূরে একটি সরু ক্ষীণদর্শন সেতু দুই নগরকে স্থলপথে সংযুক্ত করিয়া রাখিয়াছে। সেতুর উপর দিয়া জরীর ঝালর টাঙানো তাঞ্জাম, দ্রুতগতি টাঙা, রঙবেরঙের পোশাক পরিহিত পদাতিক যাতায়াত করিতেছে। নদীবক্ষে অজস্র ছোট ছোট নৌকা ব্যস্তভাবে ছুটাছুটি করিতেছে।

বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখিতে দেখিতে গৌরী বলিল— এ কোন্ অমরাবতীতে আমাকে নিয়ে এলে সর্দার! মনে হচ্ছে যেন সেই সেকালের প্রাচীন সুন্দর ভারতবর্ষে আবার ফিরে এসেছি।

ধনঞ্জয় ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন— অমরাবতী যদি ভাল করে দেখতে চান তো আমার সঙ্গে আসুন, এখনো ডাক্তার আসতে দেরি আছে।

গৌরীকে লইয়া ধনঞ্জয় প্রাসাদের ছাদে উঠিলেন। প্রকাণ্ড সমচতুষ্কোণ মাঠের মত ছাদ, কোমর পর্যন্ত উঁচু পাথরে কাজ করা প্যারাপেট দিয়া ঘেরা। চারিকোণে চারিটি গোল মিনার বা স্তম্ভ, সরু সিঁড়ি দিয়া তাহার চূড়ায় উঠিতে হয়। দুইজনে নদীর দিকের একটা মিনারে উঠিলেন; তখন সমগ্র ঝিন্ঝড়োয়া দেশটি যেন চোখের নীচে বিছাইয়া পড়িল।

কিস্তা নদী এইস্থানে প্রায় তিনশ গজ চওড়া, যত পূর্বদিকে গিয়াছে তত বেশী চওড়া হইয়াছে। গৌরী পরপারের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল—ওটি কি?

ওটি ঝড়োয়ার রাজপ্রাসাদ।

শ্বেতপ্রস্তরের প্রকাণ্ড রাজভবন, ঝি রাজপ্রাসাদের যমজ বলিলেই হয়। চারিকোণে তেমনি চারিটি উচ্চ বুরুজ মাথা তুলিয়া আছে। এদিকটা প্রাসাদের পশ্চাদ্ভাগ; প্রাসাদের কোল হইতে শতহস্ত প্রশস্ত সোপানসারি নদীর কিনারা পর্যন্ত নামিয়া আসিয়াছে।

ঘাটের দৃশ্য দেখিয়া মনে হয়, ওদিকের রাজভবনেও আসন্ন উৎসবের হাওয়া লাগিয়াছে। অনেক স্ত্রীলোক সকলেই রাজপুরীর পুরন্ধ্রী-জলে নামিয়া স্নান করিতেছে; তাহারা কেহ রানীর সখী, কেহ ধাত্রী, কেহ পরিচারিকা, কেহ বা বর্ষীয়সী আত্মীয়া। যাহারা অল্পবয়সী তাহারা বুক পর্যন্ত জলে নামিয়া নিজেদের মধ্যে জল ছিটাইতেছে; অপেক্ষাকৃত প্রবীণরা তাহাদের ধমক দিতে গিয়া মুখে জলের ছিটা খাইয়া হাসিয়া ফেলিতেছে। তদপেক্ষাও যাহারা প্রাচীনা–যাহারা এ সংসারের অনেক খেলাই দেখিয়াছে তাহারা ঘাটের পৈঠায় বসিয়া ঝামা দিয়া পা ঘষিতেছে এবং চাহিয়া চাহিয়া ইহাদের রঙ্গরস দেখিতেছে। মাঝে মাঝে সুমিষ্ট কলহাস্যের উচ্ছ্বস উঠিতেছে।

সেদিক হইতে চোখ ফিরাইয়া লইয়া গৌরী চারিদিক ফিরিয়া ফিরিয়া দেখিতে লাগিল। এটা কি, ওটা কি, জিজ্ঞাসা করিতে করিতে শেষে বহু দূরে পূর্বদিকে যেখানে নদী শেষ হইয়াছে বলিয়া মনে হয়, সেই দিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া কহিল–একটা পুরোনো কেল্লা বলে মনে হচ্ছে, ঐ যে দূরে—ও জিনিসটা কি?

কেল্লাই বটে— ওর নাম হচ্ছে শক্তিগড়, প্রায় তিনশ বছর আগে ঝিন্দের শক্তি সিং তৈরি করেছিলেন। এখন শক্তিগড় আর তার সংলগ্ন জমিদারী উদিত সিংয়ের খাস সম্পত্তি। স্বর্গীয় মহারাজ ভাস্কর সিং বাবুয়ান হিসেবে ঐ সম্পত্তি ছোট ছেলেকে দিয়ে গেছেন।

বাবুয়ান কাকে বলে?

রাজার ছোট ছেলেরা, যাঁদের গদিতে বসবার অধিকার নেই, তাঁরা উচিত মর্যাদার সঙ্গে থাকবার জন্য কিছু কিছু সম্পত্তি পেয়ে থাকেন–তাকেই বাবুয়ান বলে।

উদিত বুঝে ঐখানেই থাকে?

হ্যাঁ, তা ছাড়া সিংগড়েও তার একটা বাগানবাড়ি আছে–সেখানেও মাঝে মাঝে এসে থাকে।

দেখছি ছোট ছেলেরাও একেবারে বঞ্চিত হন না!

মোটেই না। তাঁদের অবস্থা অনেক সময় বড় ছেলের চেয়ে বেশী আরামের। রাজা হবার ঝঞ্জাট নেই, অথচ মর্যাদা প্রায় সমান। সাধারণত দরবারের বড় বড় সম্মানের পদ তাঁরাই অধিকার করে থাকেন।

হুঁ, উদিত কোন্ পদ অধিকার করে আছেন?

ধনঞ্জয় হাসিয়া বলিলেন–তিনি রাজ্যের সবচেয়ে বড় পদটা অধিকার করবার মতলবে ফিরছেন–তার চেয়ে ছোট পদে তাঁর রুচি নেই। কিন্তু সে পদের আশা তাঁকে ছাড়তে হবে, অন্তত যতদিন ধনঞ্জয় ক্ষেত্রী বেঁচে আছে।

গৌরী বলিল— তা তো বুঝতে পারছি কিন্তু শঙ্কর সিংয়ের কোনো খবরই কি পাওয়া গেল না?

কিছু না। তিনি একেবারে সাফ লোপাট হয়ে গেছেন। আমার সন্দেহ হচ্ছে এর মধ্যে একটা ভীষণ শয়তানী লুকোনো আছে। হয়তো আর কিছু না পেয়ে উদিত তাকে গুমখুন করেছে। উদিত। আর ঐ ময়ূরবাহনটার অসাধ্য কাজ নেই।

গৌরীর বুকের ভিতরটা তোলপাড় করিতে লাগিল— যদি তাই হয়, তাহলে উপায়? ধনঞ্জয়ের মুখ লোহার মত শক্ত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন—যদি তাই হয়, তাহলেও উদিতকে গদিতে বসতে দেব না। সিংহাসনে উদিতের চেয়ে আপনার দাবি কোনো অংশে কম। নয়।

গৌরী স্তম্ভিত হইয়া বলিল— সে কি! আমার আবার দাবি কোথায়?

ও কথা থাক। বলিয়া ধনঞ্জয় নীচে নামিতে লাগিলেন।

নামিয়া আসিয়া দুইজনে একটি বৃহৎ কক্ষে প্রবেশ করিলেন। এই ঘরটি প্রাসাদের সদর ও অন্দরের মধ্যবর্তী এইখানে বসিয়া রাজা দর্শনপ্রার্থীদের দেখা দিয়া থাকেন। বিশালায়তন ঘরের চারিদিকে বহু জানালা ও দ্বার; মেঝেয় চার ইঞ্চি পুরু পারসী কার্পেট পাতা; রেশমের গদি-আঁটা। কৌচ ঘরের মধ্যে ইতস্তত সাজানো আছে। রাজার বসিবার জন্য ঘরের মধ্যস্থলে একটি সোনার কাজ-করা মখমল-ঢাকা আবলুশের চেয়ার। দেয়ালের গায়ে সূক্ষ্ম পদায় আবৃত বড় বড় ভিনীসিয় আয়না।

গৌরী আসনে বসিবার অল্পক্ষণ পরে নকিব দ্বারের নিকট হইতে ডাক্তারের আগমন জানাইল। ডাক্তার আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। বয়সে প্রৌঢ়–গঙ্গানাথ দ্বারের নিকট হইতে রাজাকে সসম্ভমে অভিবাদন করিয়া হাস্যমুখে তাঁহার কাছে আসিয়া বসিলেন। দুই-একটা মামুলি কুশল প্রশ্নের পর গৌরীর কজিটা আঙ্গুলে টিপিয়া ধরিয়া বলিলেন— বাঃ, নাড়ী তো দিব্যি চলছে দেখছি, আমার চিকিৎসার গুণ আছে বলতে হবে। বলিয়া নিজের গুঢ় কৌতুকে হাসিতে লাগিলেন। গৌরী ও ধনঞ্জয় মুখ টিপিয়া হাসিলেন।

ডাক্তার বলিলেন— এবার জিভ দেখি— গৌরী জিভ বাহির করিল। — চমৎকার! চমৎকার! লিভারটাও একবার দেখা দরকার। লিভার পরীক্ষা করিয়া ডাক্তারের মুখে সন্দেহের ছাপ পড়িল— আপনার এত ভাল স্বাস্থ্য আমি অনেক দিন দেখিনি। একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন— ও জিনিসটা কি সত্যিই ছেড়েছেন নাকি?

গৌরী মুখখানা ম্রিয়মাণ করিয়া বলিল—–হ্যাঁ ডাক্তার, ও বিষ আর আমার সহ্য হচ্ছিল না। ডাক্তার সানন্দে দুই করতল ঘষিতে ঘষিতে বলিলেন— বেশ বেশ, আমি বরাবরই বলে আসছি ও না ছাড়লে আপনার শরীর শোধরাবে না কিন্তু এতটা উন্নতি আমি প্রত্যাশা করিনি; এ হাওয়া বানোর গুণ!

ধনঞ্জয় মৃদুস্বরে বলিলেন— তাতে আর সন্দেহ কি? ডাক্তারকে একটু দূরে সরাইয়া লইয়া গিয়া ধনঞ্জয় চুপি চুপি বলিলেন— কথাটা যেন প্রকাশ না হয় ডাক্তার, তুমি তো সব জানোই। এবার কুমারকে বাংলাদেশ থেকে ধরে এনেছি।

ডাক্তার অবাক হইয়া বলিলেন–কি, বাংলাদেশে গিয়ে উনি এত ভাল ছিলেন? সেখানে যে ভয়ঙ্কর ম্যালেরিয়া!

ধনঞ্জয় বলিলেন— ভাল যে ছিলেন তা তো দেখতেই পাচ্ছ। যাহোক, উনি এতদিন তোমার চিকিৎসাধীনে এখানেই ছিলেন একথা যেন ভুলো না।

তা কি ভুলি? বলিয়া ডাক্তার গৌরীকে তাহার পুনঃপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যের জন্য বহু অভিনন্দন জ্ঞাপন করিয়া এবং নিজের চিকিৎসার আশ্চর্য গুণ সম্বন্ধে পুনশ্চ রসিকতা করিয়া প্রস্থান করিলেন।

গৌরী ধনঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করিল— ডাক্তার সব কথা বুঝি জানে না? ধনঞ্জয় মৃদুহাস্যে বলিলেন— না, গঙ্গানাথ খুব উঁচুদরের ডাক্তার, কিন্তু বড় বেশী কথা কয়। যেটুকু না বললে নয় সেইটুকুই ওকে বলা হয়েছে। তারপর গৌরীর পিঠ চাপড়াইয়া বলিলেন— সাবাস! ডাক্তার যখন জাল ধরতে পারেনি, তখন আর ভয় নেই।

গৌরী জিজ্ঞাসা করিল— আসল কথাটা কে কে জানে?

আমি, দেওয়ান বজ্ৰপাণি ও রুদ্ররূপ।ধনঞ্জয়ের মুখের কথা শেষ হইতে না হইতে রুদ্ররূপ উত্তেজিতভাবে ঘরে প্রবেশ করিয়া চাপা গলায় বলিল— হুঁশিয়ার, কুমার উদিত আসছেন–বলিয়া আবার পর্দার আড়ালে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

বেশী কথা বলবেন না, যা বলবার আমিই বলব–গৌরীর কানে কানে এই কথা বলিয়া ধনঞ্জয় জানালার কাছে সরিয়া গিয়া দাঁড়াইলেন। গৌরীর বুকে হাতুড়ির ঘা পড়িল। এইবার সত্যকার পরীক্ষা।

নকিব নাম ডাকিবার পূর্বেই উদিত দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দুই হাতে পদ সরাইয়া দাঁড়াইল; কিছুক্ষণ নিস্পলক দৃষ্টিতে গৌরীর দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর ফাঁদে পড়িবার ভয়ে সন্দিগ্ধ শ্বাপদ যেমন এদিক-ওদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে করিতে সন্তর্পণে অগ্রসর হয়, তেমনিভাবে উদিত ঘরের মধ্যে অগ্রসর হইল। অবিশ্বাস, বিস্ময় ও উত্তেজনায় তাহার সুশ্রী মুখখানা বিকৃত দেখাইতে লাগিল।

নিজের চক্ষুকে যেন বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না এমনিভাবে সে গৌরীর মুখের প্রতি তাকাইয়া। রহিল। সংশয়পূর্ণ বিস্ময়ে তাহার মুখখানা হতবুদ্ধি হইয়া গেল। গৌরীও দুই চক্ষে বিদ্রোহ ভরিয়া উদিতের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। কাহারও মুখে কথা নাই। কিছুক্ষণ এমনি নীরবে কাটিয়া গেল।

ধনঞ্জয়ের অনুচ্চ কণ্ঠের হাসি এই নিস্তব্ধতার জাল ছিড়িয়া দিল। তিনি বলিলেন— একেই বলে ভালবাসা! আপনি আরোগ্য হয়ে উঠেছেন দেখে কুমার উদিতের হৃদয় এতই পূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, তাঁর মুখ দিয়ে আর কথা বেরুচ্ছে না। অভিবাদন করতেও সা ভুলে গেছেন। বসূতে আজ্ঞা হোক কুমার!

ধনঞ্জয়ের দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া উদিত গৌরীর সম্মুখে নতজানু হইয়া বসিয়া তাহার ডান হাতখানা লইয়া নিজের কপালে ঠেকাইল। অস্পষ্ট কণ্ঠে মামুলি দুই-একটা আনন্দসূচক শিষ্ট কথা বলিয়া অভিভূতের মত কৌচে গিয়া বসিল।

গৌরী ইতিমধ্যে নিজেকে বেশ সামলাইয়া লইয়াছিল; তাহার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি ভর করিল। সে বলিল— ধনঞ্জয়, ভাই আমার সাত সকালে ব্যস্ত হয়ে আমার খোঁজ নিতে এসেছেন শীঘ্র ওঁর জন্যে গরম সরবতের ব্যবস্থা কর।–কি করব আমার উপায় নেই, ডাক্তারের মানা, নইলে আমিও এই সঙ্গে এক চুমুক খেতুম।

উদিতের মনে হইল যেন তাহার মাথা খারাপ হইয়া যাইতেছে। সে বুদ্ধিভ্রষ্টের মত কেবল গৌরীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল, একটা কথাও বলিতে পারিল না।

গৌরী জিজ্ঞাসা করিল— উদিত, তুমি কি একলা এসেছ ভাই? সঙ্গে কি কেউ নেই?

উদিত জড়াইয়া জড়াইয়া বলিল—ময়ূরবাহন এসেছে— বাইরে আছে।

গৌরী আগ্রহ দেখাইয়া বলিল— বাইরে কেন? এখানে নিয়ে এলেই তো পারতে— ময়ূরবাহন বুঝি এল না? বড় লাজুক কিনা— আর, লজ্জা হবারই কথা কত মদ যে আমাকে গিলিয়েছে তার কি ঠিকানা আছে! ভাগ্যে সময়ে সামলে নিয়েছি, নইলে তুমিই তো সিংহাসনে বসতে উদিত! লিভার পেকে উঠলে আর কি প্রাণে বাঁচতাম!

উদিত নিজের চোখের উপর দিয়া ডান হাতখানা একবার চালাইয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–এবার আমি উঠি। আমি একবার আমাকে একবার শক্তিগড়ে যেতে হবে

ধনঞ্জয়ের চোখে নষ্টামি নৃত্য করিয়া উঠিল, তিনি মহা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন–তা কি কখনো হয়! কাল বাদে পরশু অভিষেক, আপনার সঙ্গে কত পরামর্শ রয়েছে, আর আপনি এখনি চলে যাবেন? লোকে দেখলেই বা মনে করবে কি? ভাববে আপনার বুঝি দাদার অভিষেকে মত নেই। তাছাড়া আপনার সরবৎ এল বলে, না খেয়ে গেলে রাজাকে অপমান করা হবে যে! বসুন—বসুন। অভিষেক সভা সাজানো হচ্ছে–সেদিকে গিয়েছিলেন নাকি!

নিরুপায় উদিত ধনঞ্জয়ের দিকে একটা বিষদৃষ্টি হানিয়া আবার বসিয়া পড়িল।

ধনঞ্জয় বলিতে লাগিলেন— অভিষেকের কি বিধিব্যবস্থা হয়েছে আপনি তো সবই জানেন—আপনাকে আর বেশী কি বলব? সকালবেলা পঞ্চতীর্থের জলে স্নান করে রাজবংশীয় সমস্ত জহরৎ পরে রাজা অভিষেক সভায় গিয়ে হোমে বসবেন। সেখানে তিন ঘণ্টা লাগবে। হোম শেষ করে পুরোহিতের আঙ্গুলের রক্ত-টীকা পরে রাজা বাইরে আসবেন। তখন অভিষেক সম্পন্ন করে শোভাযাত্রা আরম্ভ হবে। রাজা প্রথম হাতির ওপর সোনার হাওদায় থাকবেন তার পরের হাতিতে রূপার হাওদায় আপনি থাকবেন। সবসুদ্ধ দেড়শ হাতি আর ছয়শ ঘোড়া শোভাযাত্রায় থাকবে। নগর পরিভ্রমণ করে ফিরে আসবার পর দরবার বসবে। দরবারে প্রথমেই ঝড়োয়ার রাজকুমারীর সঙ্গে রাজার তিলক হবে— ঝড়োয়ার মন্ত্রী অনঙ্গদেব অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে স্বয়ং তিলক দিতে আসবেন। তিলক শেষ হলে ভারত-সম্রাটের অভিনন্দন পত্র ও আর আর রাজরাজড়াদের অভিনন্দন পাঠ করা হবে। তারপর মহারাজ সভা ভঙ্গ করে বিশ্রামের জন্য অন্দরে প্রবেশ করবেন।

এদিকে রাজ্যময় উৎসবের আয়োজন হয়েছে সে তো আপনি স্বচক্ষেই দেখেছেন। শহরের প্রত্যেক বাড়িটি ফুল পতাকা পূর্ণকুম্ভ দিয়ে সাজানো হবে, যারা তা পারবে না সরকারী খরচে তাদের বাড়ি সাজিয়ে দেওয়া হবে। সমস্ত দিন খাওয়া-দাওয়া, আমোদ-আহ্লাদ, মল্লযুদ্ধ, বাঈজীর নাচ, হাতির লড়াই চলবে। সন্ধ্যার পর নদীতে নৌবিহার হবে। শহরে নাচ-গান, দেয়ালী বাজি সমস্ত রাত চলবে। সাত দিন ধরে শহর এমনি সরগরম হয়ে থাকবে।

উদিতের মুখ উত্তরোত্তর কালীবর্ণ হইয়া উঠিতেছিল। সে হয়তো আর সহ্য করিতে না পারিয়া একটা বেফাঁস কিছু করিয়া ফেলিত কিন্তু এই সময় ভৃত্য সোনার থালার উপর কাচের পূর্ণ পানপাত্র বহন করিয়া উপস্থিত হইল।

পানপাত্র উদিতের হাতে দিয়া গৌরী বলিল— এই নাও উদিত, খাও। আমারও লোভ হচ্ছে— কিন্তু আমি খাব না। সংযমী হওয়াই মনুষ্যত্ব। উদিত এক চুমুকে পাত্র শেষ করিয়া আবার বসিয়া পড়িল।

মদের প্রভাবে তাহার হতবুদ্ধি ভাব অনেকটা কাটিয়া গেল। সে কিছুক্ষণ স্থির হইয়া থাকিয়া গলাটা একবার পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিল— আপনার অসুখের সময় আমাকে মহলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কেন?

গৌরী নিরুপায়ভাবে হাত নাড়িয়া বলিল— ডাক্তারের মানা উদিত, ডাক্তারের মানা। গঙ্গানাথ কি রকম দুর্দান্ত লোক জান তো? একেবারে হুকুম জারি করে দিলে কারুর সঙ্গে দেখা করতে পাব না।

ধনঞ্জয় বলিলেন–কিন্তু এমনি ভ্রাতৃভক্তি কুমার উদিতের উনি প্রত্যহ একবার করে আপনার খোঁজ নিয়ে গেছেন।

স্নেহবিগলিতকণ্ঠে গৌরী বলিল— ভাইয়ের চেয়ে আপনার আর কে আছে বল? কিন্তু তবু এমন পাজি দেশের লোক, উদিতের নামেও মিথ্যে দুর্নাম দেয় বলে ও নাকি আমার বদলে সিংহাসনে বসতে চায়। বল তো উদিত-কত বড় মিথ্যে কথা!

হঠাৎ চাপা গলায় উদিত গর্জন করিয়া উঠিল— তুমি কে?

অতি বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া গৌরী বলিল— আমি কে? উদিত, উদিত, তুমি কি বলছ? আজকাল কি সকালবেলা মদ খাওয়া তুমি ছেড়ে দিয়েছ! আমাকে চিনতে পারছ না! ধনঞ্জয়, দেখছ। উদিতের মুখ কি রকম লাল হয়ে উঠেছে! এখনি গঙ্গানাথকে ডাকা দরকার!

রুদ্ররূপকে ডাকিয়া ধনঞ্জয় হুকুম দিলেন কুমার উদিত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, শীঘ্র গঙ্গানাথকে ডেকে পাঠাও।

অসীম বলে নিজেকে সংযত করিয়া উদিত দাঁতের ভিতর হইতে বলিল–থাক, ডাক্তারের দরকার নেই। আচ্ছা চললাম, আবার দেখা হবে। বলিয়া রাজার দিকে একবার মাথা কুঁকাইয়া। উদিত সিং দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।

ধনঞ্জয় রুদ্ররূপকে কাছে ডাকিয়া কানে কানে কি বলিলেন; রুদ্ররূপ প্রস্থান করিলৈ গৌরীর নিকট আসিয়া বসিয়া বলিলেন—গোড়াতেই উদিতকে এতটা ঘাঁটানো ঠিক হয়নি। একটু চেপে চললেই হত। তা যাক, যা হবার তা তো হয়েই গেছে।

গৌরী বলিল— শত্রুতা করতে হলে ভাল করে করাই ঠিক, আধমনা হয়ে শত্রুতা করা বোকামি। কিন্তু কি ব্যাপার বল তো? উদিত বুঝতে পেরেছে?

ধনঞ্জয় ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন— না, বুঝতে পারেনি ঠিক, কিন্তু বেজায় ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। এর ভেতর কিছু কথা আছে, ভ্যাবাচাকা খেলে কেন?

গৌরী বলিল— শঙ্কর সিংকে খুন করেনি তো?

ধনঞ্জয় বলিলেন–না, খুন বোধ হয় করেনি। খুন করলে আপনাকে দেখবামাত্র জাল রাজা বলে বুঝতে পারত। তাই তো! উদিত অমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল কেন? বলিয়া ধনঞ্জয় ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া ঘরময় পায়চারি করিতে লাগিলেন।

তারপর দেশের বহু গণ্যমান্য লোককে দর্শন দিবার পর সভা ভঙ্গ হইল। কোনো কিছু ঘটিল না, সকলেই রাজার রোগমুক্তিতে আনন্দ প্রকাশ করিয়া একে একে প্রস্থান করিলেন।

সেদিন সন্ধ্যার সময় নদীর দিকের একটা ভোলা বারান্দায় সিল্কের নরম গালিচা পাতা হইয়াছিল; তাহার উপর মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়া গৌরী সোনার আলবোলায় তামাক টানিতেছিল। ধনঞ্জয় তাহার সম্মুখে পা মুড়িয়া বসিয়াছিলেন।

আকাশে আধখানা চাঁদ সবেমাত্র নিজের রশ্মিজাল পরিস্ফুট করিতে আরম্ভ করিয়াছে। নদীর জল-ছোঁয়া ঠাণ্ডা বাতাস যদিও মাঝে মাঝে শরীরে একটু কাঁপন ধরাইয়া দিতেছে, তবু এ মনোরম স্থানটি ছাড়িয়া গৌরী উঠিতে পারিতেছিল না। নদীর পরপারে ঝড়োয়ার রাজবাড়িতে আলো জ্বলিয়া উঠিল, একে একে সব বাতায়নগুলি আলোকিত হইল— নদীর জলে সেই ছায়া কাঁপিতে লাগিল। দুইজনে অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া সেই দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন।

একবার খড়ম পায়ে দিয়া বৃদ্ধ বজ্ৰপাণি দুই-একটা প্রয়োজনীয় কথা জিজ্ঞাসা করিয়া গেলেন। তিনি চলিয়া গেলে গৌরী বলিল, আচ্ছা, বুড়ো মন্ত্রী এত কাজ করছেন, আর তুমি তো দিব্যি আমার কাছে বসে আড্ডা দিচ্ছ?

ধনঞ্জয় বলিলেন— আড্ডা দিচ্ছি এবং আরো দুদিন দেব। অভিষেক না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে চোখের আড়াল করছি না। শঙ্কর সিং তো গেছে, শেষে আপনাকেও খোয়ব নাকি?

আমারও খোয়া যাবার ভয় আছে নাকি?

বিলক্ষণ আছে। আসলই যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন নকল হারাতে কতক্ষণ?

গৌরী গম্ভীর হইয়া বলিল— সত্যি? শঙ্কর সিংয়ের কি কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছে না?

কিছু না, যেন কপূরের মত উবে গেছেন। অন্য অন্য বারেও খুঁজে বার করতে বেগ পেতে হয়েছে বটে, কিন্তু এরকমটা কোনো বার হয়নি। সন্দেহ হচ্ছে সত্যি সত্যিই গুমখুন করলে না তো? তা যদি করে থাকে—

রুদ্ররূপ প্রবেশ করিল। চাঁদের আলো ছিল বলিয়া অন্য আলো ইচ্ছা করিয়াই রাখা হয় নাই, ধনঞ্জয় ঠাহর করিয়া বলিলেন–রুদ্ররূপ নাকি? এস, কোনো খবর পেলে?

রুদ্ররূপ উভয়কে অভিবাদন করিয়া গালিচার উপর পা মুড়িয়া বসিল। চম্পা রুদ্ররূপকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল, তাহাকে অদূরে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া ধনঞ্জয় বলিলেন—চম্পা, রাজার জন্যে পান আনতে বল তো মা!

চম্পা প্রস্থান করিল। তখন রুদ্ররূপ বলিল— কুমার উদিত আর ময়ূরবাহন এখান থেকে বেরিয়ে সটান ঘোড়া ছুটিয়ে শক্তিগড়ে গিয়েছেন, পথে কোথাও থামেননি। এইমাত্র খবর নিয়ে লোক ফিরে এসেছে।

ধনঞ্জয় হঠাৎ কপালে করাঘাত করিয়া বলিলেন–ওঃ! ওঃ! কি আহাম্মক আমি কি নালায়েক আমি! এটা এতক্ষণ বুঝতে পারিনি!

গৌরী আশ্চর্য হইয়া বলিল–কি বুঝতে পারনি?

ধনঞ্জয় বলিলেন–ইচ্ছে করে আমায় ভুল খবর দিয়ে বাইরে পাঠিয়েছিল। ঐ শয়তান স্টেশনমাস্টারটা উদিতের দলে—ও-ই আমাকে বলেছিল যে কুমার শঙ্করকে ছদ্মবেশে মেয়েমানুষ সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে চড়তে দেখেছে। এখন সব বুঝতে পারছি।

কিন্তু আমি যে এখনো কিছুই বুঝলাম না।

বুঝলেন না? শঙ্কর সিংকে শক্তিগড়ে বন্ধ করে রেখেছে। দেশে থাকলে পাছে আমি জানতে পারি তাই মিথ্যে খবর দিয়ে আমাকে সরিয়েছিল। এ ঐ হাড়বজ্জাত ময়ূরবাহনটার বুদ্ধি।

অনেকক্ষণ সকলেই চুপ করিয়া রহিলেন। শেষে রুদ্ররূপ দ্বিধা-জড়িত স্বরে বলিল–কিন্তু তা যদি হয় তাহলে শক্তিগড়ে তল্লাস করলেই তো–

শক্তিগড় উদিতের নিজের জমিদারী–সেখানে সে আমাদের ঢুকতে দেবে না।

ফৌজ নিয়ে যদি–

পাগল। জোর করে যদি শক্তিগড়ে ঢুকি তাতে বিপরীত ফল হবে। উদিত সিং বমাল সমেত ধরা দেবে ভেবেছ? তার আগে শঙ্কর সিংহকে কেটে কিস্তার জলে ভাসিয়া দেবে।

আবার দীর্ঘকাল সকলে নীরব হইয়া রহিলেন। শেষে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া ধনঞ্জয় বলিলেন না, এখন আর কিছু হবে না–সময় নেই। অভিষেক হয়ে যাক— তারপর–। রুদ্ররূপ, তুমি এখানে থাকো, আমি একবার মন্ত্রীর কাছে চললাম। যতক্ষণ না ফিরি এঁকে ছেড়ো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *