৭.২ উপসংহার

উপসংহার

‘না, নারী আমাদের ভাই নয়; আলস্য ও কপটতার মাধ্যমে আমরা করে তুলেছি তাকে একটি ভিন্ন সত্তা, অজ্ঞাত, তার কাম ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নেই, যা শুধু নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহই বোঝায় না বরং বোঝায় অন্যায় যুদ্ধ–ভক্তি বা ঘৃণা, কিন্তু কখনই সোজাসুজি বন্ধু নয়, একটি সত্তা এসপ্রি দ্য কর্প ও সহমর্মীদের সঙ্গে অসংখ্যের এক বাহিনী–চিরন্তন ক্ষুদ্র দাসের স্পর্ধিত ভঙ্গি’।

বহু পুরুষ আজো একমত হবে লাফর্গের এসব কথার সাথে; অনেকে মনে করে সব সময়ই ঘটবে দ্বন্দ্ব ও কলহ, যেমন বলেছেন মতেইন, এবং কখনোই সম্ভবপর হবে না ভ্রাতৃত্ব। সত্য হচ্ছে আজকাল পুরুষ বা নারী কেউই পরস্পরকে নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু এটা জানা দরকার যে রয়েছে কি-না কোনো আদি অভিশাপ, যা তাদের বাধ্য করে পরস্পরকে বিদীর্ণ করতে, না-কি তারা পরস্পরবিরোধী যে-বিরুদ্ধতায়, সেগুলো নিতান্তই চিহ্নিত করে মানব-ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালীন মুহূর্তকে।

কিংবদন্তি সত্ত্বেও, কোনো শারীরবৃত্তিক নিয়তি নারী ও পুরুষের মধ্যে চিরন্তন বৈরিতা চাপিয়ে দেয় নি; এমনকি বিখ্যাত আরাধনাকারী ম্যান্টিসও পুরুষটিকে খায় শুধু অন্য খাদ্যের অভাবে এবং প্রজাতির কল্যাণে : প্রাণীজীবনের মাপদণ্ডের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই প্রজাতির অধীন। এছাড়া, মানবমণ্ডলি নিতান্ত একটি প্রজাতির থেকেও বেশি কিছু : এটা ঐতিহাসিক বিবর্তন; এটি কী আচরণ করে তার প্রাকৃতিক, স্থির বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে, এর ফাঁকতিসিতের সাথে, সে-অনুসারে একে। সংজ্ঞায়িত করতে হবে। সত্যিই, এমনকি চরম প্রতারণার উদ্দেশ্যে হলেও পুরুষ ও নারীর মধ্যে প্রকৃত কোনো শারীরবৃত্তিধর্মী বৈরিতার অস্তিত্ব দেখানো অসম্ভব। আরো, তাদের বৈরিতা হয়তো বণ্টন করা হয়েছে জীববিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের মাঝামাঝি এক অঞ্চলে : মনোবিশ্লেষণে। নারী, বলা হয়েছে আমাদের, পুরুষকে ঈর্ষা করে তার শিশ্নের জন্যে এবং খোজা করতে চায় তাকে; কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর জীবনে শিশ্নের জন্যে বালখিল্য বাসনা তখনই শুধু গুরুত্বপূর্ণ যখন সে তার নারীত্বকে মনে করে একটি অঙ্গহানি বলে; এবং তখন সে এটিকে পুরুষের সমস্ত সুযোগসুবিধার প্রতীক হিশেবে ধরে আত্মসাৎ করতে চায় পুরুষের লিঙ্গটি। আমরা এটা স্বীকার করতে প্রস্তুত যে তার খোজা করার স্বপ্নের আছে এ-প্রতীকী তাৎপর্য : মনে করা হয় যে সে চায় পুরুষকে তার সীমাতিক্ৰমণতা থেকে বঞ্চিত করতে।

কিন্তু তার বাসনা, যেমন দেখেছি আমরা, অনেক বেশি দ্ব্যর্থবোধক : সে চায়, একটি স্ববিরোধী রীতিতে, এ-সীমাতিক্ৰমণতা পেতে, এতে মনে করা যায় সে একই সাথে একে শ্রদ্ধা করে ও অস্বীকার করে, একই সঙ্গে সে এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় এবং একে রাখতে চায় নিজের মধ্যে। এর অর্থ হচ্ছে লৈঙ্গিক স্তরে নাটকটি উন্মোচিত হয় না; আরো, লৈঙ্গিক পরিচয় কখনোই নিজের মধ্যে মানবাচরণের চাবি সরবরাহ করে একটি নিয়তি নির্দেশ করে বলে আমাদের মনে হয় নি, বরং এটি প্রকাশ করে একটি পরিস্থিতির সমগ্রতা, যাকে সংজ্ঞায়িত করতে এটি সাহায্য করে। পুরুষ ও নারীর দেহসংস্থানে নিহিত নেই লিঙ্গের সংগ্রাম। সত্য হচ্ছে যখন কেউ এর আশ্রয় নেয়, তখন সে এটাকে অবধারিত বলে মনে করে যে ভাবনার জগতে অনন্ত কাল ধরে যুদ্ধ চলছে চিরন্তন নারী ও চিরন্তন পুরুষ নামের দুটি অস্বচ্ছ সারসত্তার মধ্যে; এবং সে এ-সত্যটি উপেক্ষা করে যে ইতিহাসের দুটি ভিন্ন মুহূর্তের সাথে সঙ্গতি রেখে পৃথিবীতে এ-দানবিক দ্বৈরথ পরিগ্রহ করে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ।

যে-নারী আটকে আছে সীমাবদ্ধতায়, সে পুরুষকেও আবদ্ধ করতে চায় ওই কারাগারে; এভাবে কারাগার হয়ে উঠবে বিশ্বের সাথে পরস্পরপরিবর্তনীয়, এবং নারী আর ভোগ করবে না সেখানে বন্দী হয়ে থাকার যন্ত্রণা : মা, স্ত্রী, প্রিয়া হচ্ছে। কারারক্ষক। পুরুষদের দ্বারা বিধিবদ্ধ হয়ে সমাজ বিধান জারি করে যে নারী নিকৃষ্ট : সে এ-নিকৃষ্টতা এড়াতে পারে শুধু পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ধ্বংস করে। সে লেগে যায়। পুরুষের অঙ্গহানি করতে, পুরুষের ওপর আধিপত্য করতে, সে পুরুষের বিরোধিতা করে, সে অস্বীকার করে পুরুষের সত্য ও মূল্যবোধ। কিন্তু এটা করতে গিয়ে সে শুধু নিরাপত্তাবিধান করছে নিজের কোনো অপরিবর্তনীয় সারসত্তা বা ভুলক্রমে বাছাই তাকে সীমাবদ্ধতায়, নিকৃষ্টতায় দণ্ডিত করে নি। এগুলো চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার ওপর। সব অত্যাচারই সৃষ্টি করে একটি যুদ্ধাবস্থা। এবং এটিও কোনোব্যতিক্রম নয়। যে-অস্তিমানকে গণ্য করা হয় অপ্রয়োজনীয়, সে তার সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি না জানিয়ে থাকতে পারে না।

আজ দ্বৈরথটি নিয়েছে এক ভিন্ন আকার; পুরুষকে কারাগারে ঢোকানোর ইচ্ছের বদলে নারী মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে কারাগার থেকে; সে আর পুরুষকে সীমাবদ্ধতার রাজ্যে টেনে নিতে চায় না, বরং সে নিজে বেরিয়ে আসতে চায় সীমাতিক্ৰমণতার আলোতে। এখন পুরুষের মনোভাব সৃষ্টি করে একটি নতুন বিরোধ : পুরুষ নারীকে মুক্তি দিতে চায় অনিচ্ছেয়। সে নিজে সুখ পায় সার্বভৌম কর্তা, পরম শ্রেষ্ঠ, অপরিহার্য সত্তারূপে থাকতে; সে তার সঙ্গীকে বাস্তবিকভাবে তার সমান বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তার ওপর পুরুষের আস্থাহীনতার জবাব দেয় সে একটি আক্রমণাত্মক মনোভাব গ্রহণ করে। এটা আর সে-ব্যক্তিদের মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপার নয়, যারা প্রত্যেকে আটকে আছে তার নিজের এলাকায় : একটি জাত আক্রমণ করে তার অধিকার দাবি করে এবং প্রতিহত হয় সুবিধাভোগী জাতটি দিয়ে। এখানে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুটি সীমাতিক্ৰমণতা; পরস্পরকে স্বীকার করে নেয়ার বদলে একটি মুক্ত সত্তা আধিপত্য করতে চায় অন্যটির ওপর।

মনোভাবের এ-পার্থক্য প্রকাশ পায় যেমন লৈঙ্গিক স্তরে, তেমনি আধ্যাত্মিক স্তরে। নারীধর্মী নারী নিজেকে শিকারের বস্তু করে তুলতে গিয়ে চেষ্টা করে পুরুষকেও তার দৈহিক অক্রিয়তায় পর্যবসিত করতে; সে নিজেকে ব্যস্ত রাখে পুরুষকে তার ফাঁদে ফেলার জন্যে, সে পুরুষের মধ্যে জাগায় যে-কামনা, তা দিয়ে নিজেকে একটি অনুগত বস্তু করে তুলে সে শৃঙ্খলিত করতে চায় পুরুষকে। মুক্তিপ্রাপ্ত নারী, এর বিপরীতে, হতে চায় সক্রিয়, একজন গ্রহীতা, এবং সে মেনে নেয় না সে-অক্রিয়তা, পুরুষ যা চাপাতে চায় তার ওপর। ‘আধুনিক’ নারী গ্রহণ করে পুরুষের মূল্যবোেধ : পুরুষের মতো একই শর্তে সে গর্ববোধ করে চিন্তায়, ব্যবস্থা গ্রহণ করে, কাজ করে, সৃষ্টি করে; পুরুষদের অবজ্ঞা না করে সে নিজেকে ঘোষণা করে তাদের সমান বলে।

পুরুষ ও নারী যতো কাল পরস্পরকে সমান বলে গণ্য করতে ব্যর্থ হবে, ততো কাল চলবে এ-কলহ; এর অর্থ হচ্ছে, যতো কাল যেমন আছে তেমন অবস্থায়ই স্থায়ী করে রাখা হবে নারীদের। কোন লিঙ্গটি বেশি ব্যগ্র এটা বজায় রাখার জন্যে? নারী, যে মুক্তি পাচ্ছে এর থেকে, সেও বজায় রাখতে চায় এর বিশেষ সুবিধাগুলো; এবং পুরুষ, সে-ক্ষেত্রে, চায় যে নারী ধারণ করবে এর সীমাবদ্ধতাগুলো। ‘অন্য লিঙ্গটিকে ক্ষমা করার থেকে একটি লিঙ্গকে অভিযুক্ত করা সহজ,’ বলেছেন মতেইন। প্রশংসা ও নিন্দা ভাগাভাগি করা বৃথা। সত্য হচ্ছে দুষ্টচক্রটি ভাঙা যে এতো কঠিন, তার কারণ। দুটি লিঙ্গ একই সঙ্গে পরস্পরের ও নিজের শিকার। শুদ্ধ-স্বাধীনভাবে পরস্পরের। মুখোমুখি দুটি প্রতিপক্ষের মধ্যে সহজেই একটি চুক্তিতে পৌছোনো যেতো : আরো বেশি সম্ভব হতো, কেননা যুদ্ধে কেউই লাভবান হবে না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটি এজন্যেই জটিল হয়ে ওঠে যে প্রতিটি শিবিরই সাহায্য ও আরাম দেয় শত্রুদের; নারী রত থাকছে আনুগত্যের স্বপ্নে, পুরুষ রত থাকছে একাত্মতাবোধের স্বপ্নে। যথার্থতার অভাব থেকে উপকার পাওয়া যায় না: সহজ পথের প্রলোভনে পড়ে পুরুষ বা নারী যে-অসুখবোধ করেছে, তার জন্যে তারা পরস্পরকে দোষী করে; পুরুষ ও নারী পরস্পরের মধ্যে যা অপছন্দ করে, তা হচ্ছে প্রত্যেকের নিজের প্রতারণা ও হীনতার ভেঙে চুরমার করার মতো হতাশা।

আমরা দেখেছি পুরুষ কেনো প্রথমে নারীদের দাসত্বে আবদ্ধ করেছিলো; নারীদের অবমূল্যায়ন ছিলো মানুষের বিকাশের এক অত্যাবশ্যক পর্যায়, তবে এটা দুটি লিঙ্গের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি করতে পারতো; যে-অপরকে সে চুড়ান্তরূপে পীড়ন করে, তার সঙ্গে একাত্মতাবোধের মাধ্যমে অস্তিমানের নিজের থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে পীড়নকে। প্রতিটি পুরুষের মধ্যে আজ বিরাজ করে ওই প্রবণতা; এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠরা এর কাছে আত্মসমর্পণ করে। স্ত্রীর মধ্যে স্বামী পেতে চায় নিজেকে, দয়িতার মধ্যে প্রেমিক পেতে চায় নিজেকে, একটা প্রস্তরমূর্তিরূপে; নারীর মধ্যে সে খাজে তার পৌরুষের, তার সার্বভৌমত্বের, তার অব্যবহিত বাস্তবতার কিংবদন্তি। কিন্তু সে ক্রীতদাস তার নিজের ডবলের : কী প্রয়াস তার একটি মূর্তি তৈরির, যার মধ্যে সব সময় সে বিপন্ন! সব কিছু সত্ত্বেও এতে তার সাফল্য নির্ভর করে নারীর চপল স্বাধীনতার ওপর : এ-শুভকে তার কাছে রাখার জন্যে তাকে অবিরত চেষ্টা চালাতে হয়। নিজেকে পুরুষ, গুরুত্বপূর্ণ, শ্রেষ্ঠরূপে দেখানোর প্রয়াসে পুরুষ ব্যস্ত; সে এর ছল করে বিনিময়ে ছল পাওয়ার জন্যে; সেও আগ্রাসী, অস্থির; সে নারীদের প্রতি শত্রুতা বোধ করে, কেননা সে তাদের ভয় করে, সে তাদের ভয় করে, কেননা সে ভয় করে সম্রান্ত ব্যক্তিকে, মূর্তিকে, যার সঙ্গে সে অভিন্ন করে তোলে নিজেকে। কতো সময় ও শক্তি যে সে অপচয় করে গূঢ়ৈষাগুলোকে খতম করতে, উর্ধ্বগামী করতে, স্থানান্তরিত করতে, নারীদের সম্পর্কে কথা বলে, তাদের কামে প্রলুব্ধ করে, তাদের ভয় করে নারীদের মুক্তির মধ্যে সে পাবে নিজের মুক্তি। তবে ঠিক এটাকেই সে ভয় করে। তাই নারীদের শৃঙ্খলিত রাখার লক্ষ্যে রহস্যীকরণে সে রত থাকে একগুঁয়েভাবে।

একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে উৎপীড়নকারীরা সাধারণত উৎপীড়িতদের কাছে থেকে দুষ্কর্মে যতোটা সহযোগিতা পায়, পুরুষেরা নারীর মধ্যে সহযোগিতা পায় তার থেকে অনেক বেশি। এবং এটা থেকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে তারা একথা ঘোষণার অধিকার পায়যে নারীর ওপর তারা যে-নিয়তি আরোপ করেছে, তা নারী কামনা করেছে। আমরা দেখেছি যে নারীর প্রশিক্ষণের সবগুলো দিক মিলিত হয়েতাকে বাধা দেয় বিদ্রোহ ও দুঃসাহসিক কর্মের পথে। সমাজ সাধারণভাবে–তার শ্রদ্ধেয় পিতামাতাদের থেকে শুরু করে–প্রেম, ভক্তি, তার নিজের গুণের সুউচ্চ মূল্যের প্রশংসা করে তার কাছে মিথ্যা কথা বলে, এবং তার কাছে একথা গোপন করে রাখে যে এগুলোর গুরুভার বইতে তার প্রেমিকও রাজি হবে না, স্বামীও রাজি হবে না, এমনকি তার সন্তানেরাও রাজি হবে না। সে আনন্দে বিশ্বাস করে এসব মিথ্যায়, কেননা এগুলো তাকে আমন্ত্রণ করে সহজ ঢাল বেয়ে নেমে যেতে : তার বিরুদ্ধে এতে জঘন্যতম অন্যায় করে অন্যেরা; শৈশব থেকে তার জীবনভর, তারা তাকে নষ্ট ও দূষিত করে এটা নির্দেশ করে যে এ আনুগত্যই তার প্রকৃত বৃত্তি, স্বাধীনতার মধ্যে প্রতিটি অস্তিমানের যা প্রলোভন। যদি কোনো শিশুকে সারাদিন আমোদে রেখে আলস্য শেখানো হয় এবং তাকে কখনো পড়াশুনোয় মন দিতে বলা না হয়, বা এর উপকারিতা দেখানো না হয় তাহলে বলাই বাহুল্য যে বড়ো হয়ে সে হবে অপদার্থ ও মূখ; তবে এভাবেই লালনপালন করা হয় নারীদের, তার নিজের অস্তিত্বের ভার নিজে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তাকে কখনো বোঝানো হয় না। তাই সে সানন্দে নিজেকে অর্পণ করে অন্যদের সুরক্ষা, প্রেম, সহায়তা ও তত্ত্বাবধানের কাছে, সে কিছু না করে আত্মসিদ্ধির আশায় মোহিত হয়। এ-প্রলোভনে সাড়া দিয়ে সে ভুল করে; তবে পুরুষ তাকে দোষী করার মতো অবস্থানে নেই, কেননা সে-ই এ-প্রলোভনে তাকে প্রলুব্ধ করেছে। যখন তাদের মধ্যে বিরোধ বাধে, এ-পরিস্থিতির জন্যে একজন দায়ী করে অন্যজনকে; নারী যা হয়েছে তার জন্যে বকবে পুরুষকে : ‘কেউ আমাকে যুক্তি প্রয়োগ করতে বা আমার নিজের জীবিকা অর্জন করতে শেখায় নি’; এ-পরিণতি স্বীকার করে নেয়ার জন্যে পুরুষ তাকে বকবে : ‘তুমি কিছু জানো না, তুমি একটা অপদার্থ’, এবং এমন আরো। প্রতিটি লিঙ্গ মনে করে আক্রমণ করে সে নিজের যাথার্থ্য প্রতিপাদন করতে পারে; তবে একজনের অন্যায় কাজ আরেকজনকে নিরপরাধ করে না।

এ-অসাম্য বিশেষভাবে প্রকাশ পায় এ-ঘটনায় যে তারা যে-সময়টুকু একত্রে কাটায়–যা বিভ্রান্তিকরভাবে একই সময় বলে মনে হয়–সেটার মূল্য উভয় সঙ্গীর কাছে এক নয়। প্রেমিক তার দয়িতার সঙ্গে কাটায় যে-সন্ধ্যাটি, সে-সময়টায় সে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে, ব্যবসায়িক সম্পর্ক পাতিয়ে, বিনোদন খুঁজে তার কর্মজীবনের জন্যে সুবিধাজনক কিছু একটা করতে পারতো; সমাজে স্বাভাবিকভাবে বিন্যস্ত পুরুষের কাছে সময় একটি ইতিবাচক মূল্য : অর্থ, খ্যাতি, বিনোদন। অলস, একঘেয়েমিক্লান্ত নারীর কাছে, এর বিপরীতে, এটা এক বোঝা, যার থেকে সে মুক্তি পেতে চায়; যখন সে সফল হয় সময় কাটাতে, তখন সেটা তার জন্যে একটা উপকার : পুরুষটির উপস্থিতি হচ্ছে খাঁটিলাভ। একটি অবৈধ যৌন সম্পর্কের মধ্যে পুরুষকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে যা আকৃষ্ট করে, অনেক ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে এর থেকে সে যে-যৌন উপকার লাভ করে, সেটা : দরকার হলে, যৌনকর্মের জন্যে যতোটা সময় দরকার তার থেকে বেশি সময় দয়িতার সঙ্গে না কাটাতে হলেই সে সুখ পায়; কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদে–দয়িতা চায় তার হাতে যে-অতিরিক্ত সময় আছে, সেটা কাটাতে; এবং সেই শজিবিক্রেতার মতোক্রেতা শালগম না কিনলে যে আলু বিক্রি করবে নাসে দেহদান করবে না যদি না তার প্রেমিক ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে কথাবার্তায় এবং একটা ‘রফা’ করে। একটা আপোসরফায় পেছোনো হয় যদি না, সব কিছু মিলে, পুরুষটির কাছে খরচটা খুব বেশি মনে হয়, এবং এটা অবশ্যই নির্ভর করে তার কামনার তীব্রতা এবং সে যা ত্যাগ করছে, তার ওপর সে কতোটা গুরুত্ব দেয়, তার ওপর। কিন্তু নারীটি যদি চায়–দেয়–খুব বেশি সময়, তাহলে নারীটি, তীরপ্লবী নদীর মতো, হয়ে ওঠে পুরোপুরি অবাঞ্ছিতপ্রবেশী, এবং পুরুষটি তখন অতি বেশি পাওয়ার থেকে কিছু না পেতেই বেশি পছন্দ করবে। তখন নারীটি কমিয়ে আনে তার দাবিদাওয়া; তবে প্রায়ই দ্বিগুণ স্নায়বিক চাপের মূল্যে পৌছোনোহয় মীমাংসায় : নারীটি বোধ করে যে পুরুষটি তাকে সুলভ মূল্যে ‘পেয়েছে’, এবং পুরুষটি মনে করে নারীটির দাম অত্যন্ত বেশি। এ-বিশ্লেষণ, অবশ্য, করা হয়েছে কিছুটা কৌতুককর। ভাষায়; তবে–সে-সব ঈর্ষাকাতর ও একান্ত কামনার ক্ষেত্র বাদে, যাতে পুরুষটি চায়নারীটির পুরোপুরি মালিকানা—এ-বিরোধ অবিরাম দেখা দেয় স্নেহ, কামনা, এমনকি প্রেমের বেলা। পুরুষটি সময়ের মধ্যে সব সময়ই অন্য কিছু করার আছে; আর নারীটির আছে বিপুল সময় যা তাকে কাটাতে হবে; এবং পুরুষটি মনে করে নারীটি তাকে যে-সময় দেয়, তার অধিকাংশই উপহার নয়, বরং ভার।

পুরুষটি সাধারণত ভারগ্রহণে সম্মত হয়, কেননা সে ভালোভাবেই জানে যে সে আছে সুবিধাজনক ধারে, সে বিবেকহীন; এবং যদি সে মোটামুটি বিবেকবান হয়, তাহলে উদারভাবে সে অসাম্যের ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করে। তবে সে তার করুণার জন্যে গর্ববোধ করে, এবং প্রথমবার অমিল হওয়ার সঙ্গেই সে নারীকে গণ্য করে অকৃতজ্ঞ বলে এবং বিরক্তির সঙ্গে ভাবে : আমি তার জন্যে বেশি ভালো। নারীটি বোধ করে সে আচরণ করছে ভিখিরির মতো, যদিও সে নিশ্চিত যে তার আছে অসাধারণ গুণাবলি, এবং এটা তাকে অবমানিত করে।

এমন একটি বিশ্ব, যেখানে পুরুষ ও নারী হবে সমান, তার রূপ মনশ্চক্ষে দেখা বেশ সহজ, কেননা সোভিয়েত বিপ্লব দিয়েছে ঠিক তারই প্রতিশ্রুতি : পুরুষের মতো একইভাবে লালিতপালিত ও প্রশিক্ষিত নারীরা কাজ করবে একই অবস্থায় এবং পাবে একই মজুরি।কামস্বাধীনতা অবশ্য স্বীকৃত হতে হবে সমাজকে দিয়ে, তবে যৌনকর্মকে বিবেচনা করা যাবে না এমন একটি ‘সেবা’ বলে, যার জন্যে অর্থ পরিশোধ করতে হবে; নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্যে নারীকে গ্রহণ করতে হবে অন্য কোনো উপায়; বিয়ের ভিত্তি হবে একটি স্বাধীন চুক্তি, যা চুক্তিবদ্ধ পক্ষরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাঙতে পারবে; মাতৃত্ব হবে ঐচ্ছিক, যার অর্থ হচ্ছে জন্মনিরোধ ও গর্ভপাত হবে অনুমোদিত এবং বিয়ের মধ্যে বা বাইরে সব মা ও সন্তানের থাকবে ঠিক একই অধিকার; গর্ভধারণের ছুটির ব্যয় বইবে রাষ্ট্র, যে দায়িত্ব নেবে সন্তানদের, যার তাৎপর্য এ নয় যে তাদের বাবা-মার কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে সন্তানদের, বরং এটা যে সন্তানদের পরিত্যাগ করা হবে না তাদের মা-বাবার কাছে।

তবে পুরুষ ও নারীদের প্রকৃতভাবে সমান হওয়ার জন্যে আইন, প্রতিষ্ঠান, প্রথা, জনমত, এবং সমগ্র সামাজিক পরিস্থিতি বদলানোই কি যথেষ্ট? ‘নারীরা চিরকালই থাকবে নারী’, বলে থাকে সংশয়বাদীরা। অন্য দ্রষ্টারা ভবিষ্যদ্বাণী করে যে নারীত্ব। বিসর্জন দিয়ে নারীরা নিজেদের পুরুষ করে তুলতে পারবে না, বরং তারা হয়ে উঠবে দানব। এর মানে হচ্ছে একথা স্বীকার করে নেয়া যে আজকের নারী প্রকৃতির সৃষ্টি; একথা আরেকবার পুনরাবৃত্তি করা আবশ্যক যে মানবসমাজে কিছুই প্রাকৃতিক নয় এবং নারী, অন্য অনেক কিছুর মতোই, সভ্যতার উৎপাদিত সামগ্রী। তার নিয়তিতে অন্যদের হস্তক্ষেপ এক মৌল ব্যাপার : এ-প্রক্রিয়া যদি যেতো অন্য দিকে, তাহলে এর ফল হতো বেশ ভিন্ন। নারী তার হরমোন বা রহস্যময় প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত সে-রীতি দিয়ে, যার ফলে তার নিজের ছাড়া অন্যদের কর্মকাণ্ড দিয়ে পরিবর্তিত হয় তার শরীর ও বিশ্বের সাথে তার সম্পর্ক। যে-অতল গহ্বর বিচ্ছিন্ন করে রাখে কিশোর ও কিশোরীকে, তাদের মধ্যে সেটা স্বেচ্ছাকৃতভাবে প্রসারিত করা হয় আদিশৈশব থেকেই; তারপর, নারীকে যে-রূপে তৈরি করা হয়েছে, নারী তার থেকে অন্য কিছু হতে পারতো না, এবং অতীত অবশ্যই জীবনভর ছায়াপাত করবে তার ওপর। যদি আমরা এর প্রভাব বুঝতে পারি, তাহলে স্পষ্টভাবে দেখতে পাই যে তার নিয়তি চিরকালের জন্যে নির্ধারিত নয়।

আমাদের, নিশ্চিতভাবে একথা বিশ্বাস করলে চলবে না যে তাকে রূপান্তরিত করার জন্যে শুধু নারীর আর্থনীতিক অবস্থার বদলই যথেষ্ট, যদিও এ-ব্যাপারটি তার বিকাশে ছিলো এবং এখনো আছে মৌল ব্যাপার হয়ে; তবে যে-পর্যন্ত না এটা নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও অন্যান্য পরিণতি সংঘটিত করবে, এটা যার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং এর জন্যে যা দরকার, সে-পর্যন্ত নতুন নারী দেখা দিতে পারে না। এ-মুহূর্তে এগুলো কোথাও বাস্তবায়িত হয় নি, রাশিয়ায়ও নয়, ফ্রান্সে বা যুক্তরাষ্ট্রেও নয়; এবং এটাই ব্যাখ্যা করে কেননা আজকের নারী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে। পুরুষের ছদ্মবেশে প্রায়ই সে দেখা দেয় ‘খাঁটি নারী’রূপে, এবং সে নিজের দেহে যেমন অস্বস্তি বোধ করে তেমনি অস্বস্তি বোধ করে পুরুষের পোশাকে। তাকে ছেড়ে দিতে হবে তার পুরোনো খোলস এবং বানাতে হবে নিজের নতুনপোশাক। এটা সে করতে পারতো শুধু একটা সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে। কোনো একক শিক্ষকই আজ এমন একটি নারী মানুষ তৈরি করতে পারবেন না যে হবে একটি পুরুষ মানুষ-এর যথাযথ তুল্যরূপ; তাকে যদি ছেলের মতো লালনপালন করা হয়, তাহলে বালিকা মনে করে সে একটি অদ্ভুত জিনিশ এবং তাই তাকে দেয়া হয় একটা নতুন ধরনের লিঙ্গ পরিচয়। তেঁদাল এটা বুঝেছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন : ‘হঠাৎ গাছ বুনতে হবে অরণ্যে’। কিন্তু আমরা যদি, এর বিপরীতে, কল্পনা করি এমন একটি সমাজের, যাতে বস্তুগতভাবে বাস্তবায়িত হবে লৈঙ্গিক সাম্য, তাহলে প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে এ-সাম্য লাভ করবে নতুন প্রকাশ।

ছোটো মেয়েকে, তার ভাইদের মতো, যদি শুরু থেকেই বড়ো করা হতো একই দাবি ও পুরস্কার, একই কঠোরতা ও একই স্বাধীনতার মধ্যে, যদি তাকে অংশ নিতে দেয়া হতো একই পড়াশুনোয়, একই খেলাধুলোয়, তাকে যদি প্রতিশ্রুতি দেয়া হতো একই ভবিষ্যতের, যদি তার চারপাশের নারী ও পুরুষদের তার কাছে নিঃসন্দেহে। সমান মনে হতো, তাহলে গভীরভাবে বদলে যেতো খোজা গূঢ়ৈষা ও ইডিপাস গূঢ়ৈষার অর্থ। পিতার সঙ্গে একই ভিত্তিতে দম্পতির বস্তুগত ও নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করে মাও উপভোগ করতে একই স্থায়ী মর্যাদা; শিশু তার চারদিকে দেখতে পেতো, পুরুষের জগত নয়, একটি নারীর জগত। যদি সে তার পিতার দিকে আবেগগতভাবে বেশি আকৃষ্ট হতো–যা এমনকি নিশ্চিত নয়। তাহলে পিতার প্রতি তার প্রেম রঞ্জিত হতো পিতার সমকক্ষ হওয়ার সাধনার ইচ্ছে দিয়ে, শক্তিহীনতার বোধ দিয়ে নয়; অক্রিয়তার দিকে সে চালিত হতো না। ছেলেদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ ও খেলার অনুমতি পেয়ে সে শিশ্নের অভাবকে সন্তান লাভের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে যার ক্ষতিপূরণ করা হয়–হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষা জন্ম দেয়ার জন্যে যথেষ্ট মনে করতো না; পরস্পরসম্পর্কিতভাবে ছেলেরও থাকতো না একটা শ্রেষ্ঠতাগূঢ়ৈষা, যদি না তা ঢুকিয়ে দেয়া হতো তার ভেতরে এবং যদি সে পুরুষদের মতো নারীদেরও সমান শ্রদ্ধা করতো। বালিকা বন্ধ্যা ক্ষতিপূরণ খুঁজতো না আত্মরতি ও স্বপ্নের মধ্যে, সে তার ভাগ্যকে অবধারিত বলে মনে করতো না; সে যা করছে তার প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করতো, নিজেকে সংবরণ না করে সে ঝাঁপিয়ে পড়তো কর্মোদ্যোগে।

নারী কোনো রহস্যময় নিয়তির শিকার নয়; যে-সব বিশিষ্টতা তাকে নির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে নারী বলে সেগুলোর ওপর আরোপ করা হয় যে-তাৎপর্য, তারই জন্যে গুরুত্ব লাভ করে সেগুলো। অদূর ভবিষ্যতে যখন এগুলোকে বিচার করা হবে নতুন প্রেক্ষিতে, তখন ঐলোকাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। তাই, আমরা যেমন দেখেছি, তার কামের অভিজ্ঞতার ভেতরে নারী বোধ করে এবং প্রায়ই তীব্রভাবে ঘৃণা করেপুরুষের আধিপত্য; তবে এজন্যে কিছুতেই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারি না যে তার ডিম্বাশয় তাকে দণ্ডিত করে চিরকাল নতজানু অবস্থায়বেঁচে থাকায়। পুরুষধর্মী আক্রমণাত্মকতাকে একটা প্রভুসুলভ সুবিধা বলে মনে হয় শুধু সে-সংয়ে, যেটি সার্বিক চক্রান্ত চালায় পুরুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে; এবং যৌনকর্মে নারী নিজেকে গভীরভাবে অক্রিয় বোধ করে শুধু এ-কারণে যে সে আগে থেকেই নিজেকে এমন মনে করে। বহু আধুনিক নারী, যারা মর্যাদা বোধ করে মানুষ হিশেবে, তারা এখনো তাদের কামজীবনকে দেখে দাসপ্রথার দৃষ্টিকোণ থেকে : একটি পুরুষের নিচে শোয়া, তার দ্বারা বিদ্ধ হওয়া তাদের কাছে অবমাননাকর মনে হয় বলে তারা হয়ে ওঠে কামশীতল। কিন্তু বাস্তবতাটি যদি ভিন্ন হতো, তাহলে কামের ভঙ্গি ও আসনের দ্যোতিত প্রতীকী অর্থও হতো ভিন্ন; উদাহরণস্বরূপ, যে-নারী টাকা দেয় তার প্রেমিককে ও আধিপত্য করে তার ওপর, সে গর্ববোেধ করে তার চমৎকার আলস্যে এবং মনে করে সে ক্রীতদাস করে তুলেছে পুরুষটিকে, যে খাটিয়ে চলছে নিজেকে। এবং এখনই আছে বহু ভারসাম্যপূর্ণ যুগল, জয় ও পরাজয় সম্পর্কে যাদের ধারণার স্থানে দেখা দিচ্ছে বিনিময়ের ধারণা।

বাস্তবিকপক্ষে, পুরুষ, নারীর মতোই, মাংস, সুতরাং অক্রিয়, তার হরমোন ও প্রজাতির ক্রীড়নক, তার কামনার অস্থির শিকার। এবং নারী, পুরুষের মতোই, রক্তমাংসের জুরের মধ্যে, একটি সম্মতিদাত্রী, একটি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত দান, একটি কর্ম; তাদের বিচিত্র রীতিতে তারা যাপন করে অস্তিত্বের এ-অদ্ভুত দ্ব্যর্থতা, যা রূপ নিয়েছে শরীরের। ওই সমস্ত দ্বৈরথে, যাতে তারা পরস্পরের মুখখামুখি হয় বলে মনে করে, তাতে আসলে তারা প্রত্যেকে সংগ্রাম করে নিজের বিরুদ্ধে, তাদের নিজের যেঅংশটিকে তারা নিজের বলে অস্বীকার করে, সেটিকে তারা প্রক্ষেপ করে সঙ্গীটির ওপর; তাদের পরিস্থিতির দ্বৈততাগুলো যাপন করার বদলে, তারা একে অন্যকে বাধ্য। করে হীনতা বইতে এবং চেষ্টা করে সম্মানটুকু নিজের জন্যে রাখতে। তবে উভয়েই যদি এ-দ্ব্যর্থতার ভার নিতো বিচক্ষণ সংযমের সাথে, একটি সত্যিকার গর্বের সাথে, যা পরস্পরসম্পর্কযুক্ত, তাহলে পরস্পরকে দেখতে সমান হিশেবে এবং তাদের কামের নাটক যাপন করতো বন্ধুতাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে। আমরা যে মানুষ এটা নিরতিশয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ যে-সব বিশিষ্টতার থেকে, যা মানুষকে পরস্পরের থেকে পৃথক করে রাখে; বিদ্যমানতা কখনোই শ্রেষ্ঠত্বসমূহ দান করে না; ‘সদগুণ’, প্রাচীনেরা একে যেমন নাম দিতেন, সংজ্ঞায়িত হয় ‘যা আমাদের ওপর নির্ভরশীল’, তার স্তরে। উভয়লিঙ্গের মধ্যেই অভিনীত হচ্ছে মাংস ও চেতনার, সসীমতা ও সীমাতিক্ৰমণতার একই নাটক; উভয়ই ক্ষয় হচ্ছে সময় দিয়ে এবং অপেক্ষা করছে মৃত্যুর, তাদের উভয়েরই আছে পরস্পরের জন্যে একই অপরিহার্য আবশ্যকতা; এবং তাদের স্বাধীনতা থেকে তারা লাভ করতে পারে একই গৌরব। যদি তারা এর স্বাদ নিতে চাইতো, তাহলে তারা আর বিভ্রান্তিকর বিশেষাধিকার নিয়ে বিতর্কে প্ররোচিত হতো না, এবং তাদের মধ্যে দেখা দিতো ভ্রাতৃত্ব্যবোধ।

আমাকে বলা হবে এসবই ইউটোপীয় অলীক কল্পনা, কেননা নারী রূপান্তরিত হতে পারে না যদি না সমাজ প্রথমে নারীকে প্রকৃতভাবে পুরুষের সমান করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে রক্ষণশীলেরা কখনো সে-দুষ্টচক্রের শরণ নিতে ভুল করে নি; ইতিহাস, অবশ্য, চক্রাকারে ঘোরে না। একটি জাতকে যদি হীনতার অবস্থায় রাখা হয়, সন্দেহ নেই সেটি থাকে হীনতার অবস্থায়ই; তবে স্বাধীনতা ওই চক্রটি ভাঙতে পারে। নিগ্রোদের ভোটাধিকার দাও, তাহলে তারা ভোটাধিকারের উপযুক্ত হয়ে উঠবে; নারীকে দায়িত্বভার দেয়া হোক এবং সেও পালন করতে পারবে। সেগুলো। সত্য হচ্ছে যে উৎপীড়নকারীদের কাছে বিনামূল্যে মহত্ত্ব প্রত্যাশা করা যায়; তবে এক সময় উৎপীড়িতদের বিদ্রোহ, আরেক সময় বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত জাতটির নিজের বিবর্তন, নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে; তাই পুরুষেরা নিজের স্বার্থে নবীদের আংশিক মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে : নারীদের দায়িত্ব ওই সমুথান চালিয়ে যাওয়া, এবং তারা যে-সাফল্য অর্জন করছে এটা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে তা-ই তাদের জন্যে একটি উৎসাহ। এটা প্রায় নিশ্চিত যে আজই হোক বা কালই হোক তারা পুরোপুরি আর্থনীতিক ও সামাজিক সাম্যেপৌছোবে, যা ঘটাবে একটা আন্তর রূপান্তর।

তবে তা যা-ই হোক, কেউ কেউ যুক্তি দেখাবে যে এমন একটি বিশ্ব সম্ভবপর হলেও কাম্য হতে পারে না। যদি নারী ‘একই সমান’ হয় তার পুরুষের, তাহলে জীবন হারিয়ে ফেলবে তার স্বাদ ও গন্ধ। এ-যুক্তিও তার অভিনবত্ব হারিয়ে ফেলেছে : যারা বর্তমান অবস্থা চিরস্থায়ী করে রাখতে আগ্রহী, তারা সব সময়ই নবভবিষ্যৎকে হাসিমুখে গ্রহণের বদলে অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে বিলীয়মান বিস্ময়কর অতীতের জন্যে। এটা খুবই সত্য যে দাসব্যবসা বাতিল হওয়ার অর্থ ছিলো আজেলিয়া ও। ক্যামেলিয়ায় সমৃদ্ধ জমকালো বিশাল চা, তুললা, আখ, তামাকের বাগানগুলোর মৃত্যু, এর অর্থ ছিলো সংস্কৃত দক্ষিণি সভ্যতার সম্পূর্ণ ধ্বংস। সময়ের চিলেকোঠায় সিস্টান কাস্ৰাতির নির্মল শুদ্ধ কণ্ঠের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দুর্লভ পুরোনো কারুকার্যময় ফিতে, এবং আছে এক রকম ‘নারীর মোহনীয়তা’, তাও যাত্রা করেছে একই রকম ধুলোপূর্ণ গুদামের পথে। আমি একমত যে সে ছিলো সত্যিই বর্বর, যে মুগ্ধ হতো না অপরূপ পুষ্প, দুর্লভ ফিতে, খোজাদের স্ফটিকস্বচ্ছ স্বর, ও নারীর মোহনীয়তায়।

যখন তার সমস্ত চমৎকারিত্ব নিয়ে দেখা দেয় ‘মোহিনী নারী’, সে তখন অনেক বেশি পরমানন্দদায়ক বস্তু ওইসব ‘নির্বোধ চিত্রকলা, তোরণ, দৃশ্য, বিনোেদনকারীর চটকালো সংকেত, জনপ্রিয় অবিকল নকল চিত্র’-এর থেকে, যা উত্তেজিত করেছে। রাববাকে; অতিশয়আধুনিক দক্ষতায় ভূষিত হয়ে নতুনতম কৌশলে প্রসাধিত হয়ে, সে আসে সুদূর যুগযুগান্ত থেকে, থিবি থেকে, ক্রিট থেকে, শিশেন-ইটজা থেকে; এবং সে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত টোটেমও; সে হেলিকপ্টার এবং সে পাখি; এবং এখানে আছে সব বিস্ময়ের শ্রেষ্ঠ বিস্ময় : তার ছোপলাগানো কেশরাজির নিচে আরণ্যক গুঞ্জন হয়ে ওঠে চিন্তা, এবং তার স্তনযুগল থেকে উৎসারিত হয় শব্দমালা। পুরুষেরা লোলুপ হাত বাড়ায় এ-বিস্ময়ের দিকে, কিন্তু যখন তারা এটি আঁকড়ে ধরে, তখনই এটি বিলীন হয়ে যায়; স্ত্রী, দয়িতা অন্য সকলের মতোই কথা বলে তাদের মুখ দিয়ে : তাদের কথার মূল্য তা-ই, যা ওগুলোর মূল্য; তাদের স্তনযুগলেরও। এমন একটি পলাতক অলৌকিকত্ব এবং যা এতোই দুর্লভ–তা কি ন্যায়সঙ্গতভাবে আমাদের দিয়ে চিরস্থায়ী করাতে পারে এমন একটি পরিস্থিতি, যা উভয় লিঙ্গের জন্যেই অশুভ? আমরা উপভোগ করতে পারি পুষ্পের সৌন্দর্য, নারীর মোহনীয়তা, এবং তাদের প্রকৃত গুণের জন্যে দিতে পারি প্রভূত মূল্য; যদি এসব সম্পদ রক্তপাত বা দুর্দশা ঘটায়, তাহলে ওগুলোকে বলি দিতেই হবে।

প্রথম স্থানে, পুরুষ ও নারীর মধ্যে সব সময়ই থাকবে বিশেষ কিছু পার্থক্য; নারীর কামের, তাই তার কামের জগতের, থাকবে একটি বিশেষ নিজস্ব রূপ এবং তাই এটা এক বিশেষ প্রকৃতির ইন্দ্রিয়পরায়ণতার, সংবেদনশীলতার কারণ না হয়ে পারে না। এর অর্থ হচ্ছে তার নিজের শরীরের সাথে, পুরুষটির সাথে, শিশুটির সাথে তার সম্পর্ক কখনোই অভিন্ন হবে না তার সাথে, পুরুষটি যা বোধ করে তার শরীরের সাথে, নারীটির সাথে, এবং শিশুটির সাথে যারা ভিন্নতার মধ্যে সাম্যকে বড়ো করে তোলে তারা স্বেচ্ছায় আমার কাছে সাম্যের মধ্যে ভিন্নতা থাকার সম্ভবপরতা স্বীকার না করে পারে নি। তারপর আবার, প্রতিষ্ঠানগুলোই সৃষ্টি করে অসাম্য। হারেমের ক্রীতদাসীরা, যুবতী ও রূপসী, সুলতানের আলিঙ্গনের ভেতরে তারা সবাই অভিন্ন; খ্রিস্টধর্ম যখন একটি নারীকে অধিকারী করেছে একটি আত্মার, তখন কামকে দিয়েছে পাপের ও কিংবদন্তির স্বাদগন্ধ; সমাজ নারীকে তার সার্বভৌম ব্যক্তিতা ফিরিয়ে দিলে ধ্বংস হবে না হৃদয়কে আলোড়িত করার জন্যে প্রেমের আলিঙ্গনের শক্তি।

পুরুষ ও নারী বাস্তব ব্যাপারগুলোতে সমান হলে সম্ভব হবে না হৈচৈ করে আনন্দোপতভাগ, পাপ, পরমমাল্লাসমত্ততা, সংরাগ, একথা বলা আহাম্মকি; চৈতন্যের বিপরীতে দেহ, মহাকালের বিপরীতে মুহুর্ত, সীমাতিক্ৰমণতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিপরীতে সীমাবদ্ধতার মূর্ছা, বিস্মৃতির শূন্যতার বিপরীতে পরমানন্দের বিরোধের কখনো। মীমাংসা হবে না; কামের মধ্যে চিরকালই থাকবে স্নায়বিক চাপ, তীব্র মানসিক যন্ত্রণা, আনন্দ, হতাশা, ও অস্তিত্বের বিজয়োল্লাস। নারীকে মুক্ত করা হচ্ছে পুরুষের সাথে সে বহন করে যে-সব সম্পর্ক, সেগুলোতে আটকে থাকাকে অস্বীকার করা, তার সাথে ওই সম্পর্কগুলোকে অস্বীকার করা নয়; তাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে দাও, তাহলে সে বেঁচে থাকবে পুরুষের জন্যেও : পরস্পরকে কর্তারূপে মেনে নিয়ে তারা প্রত্যেকে অপরের জন্যে হয়ে থাকবে অপর। তাদের সম্পর্কের পারস্পরিকতা নষ্ট করবে না ওই অলৌকিকতাগুলোকে কামনা, অধিকার, প্রেম, স্বপ্ন, রোমাঞ্চকে, যেগুলো তৈরি করা হয়েছিলো মানুষকে দুটি ভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে; এবং যে-সব শব্দ আলোড়িত করে আমাদের দান, জয়, মিলন–হারাবে না তাদের অর্থ। বরং এর বিপরীতে, যখন আমরালোপ করবো মানবমণ্ডলির অর্ধেকের দাসত্ব, এবং তার সাথে লোপ করবো তার অন্তর্নিহিত ভণ্ডামো, তখনই মানবমন্ডলির ‘বিভাজন’ প্রকাশ করবে তার শুদ্ধ তাৎপর্য এবং মানব-যুগল পাবে তার সত্যিকার রূপ। ‘মানবপ্রাণীর প্রত্যক্ষ, স্বাভাবিক, আবশ্যিক সম্পর্ক হচ্ছে নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ক’, বলেছেন মার্ক্স। ‘এ-সম্পর্কের প্রকৃতিই স্থির করে কতো দূর পর্যন্ত পুরুষ নিজে গণ্য হবে একটি গোষ্ঠিগত সত্তা হিশেবে, মানবরূপে, নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে স্বাভাবিক সম্পর্ক। এটা দিয়েই, সুতরাং, প্রদর্শিত হয়। পুরুষের স্বাভাবিক আচরণ হয়ে উঠেছে কতো দূর মানবিক বা কতো দূর পর্যন্ত মানবিক সত্তা হয়ে উঠেছে তার স্বাভাবিক সত্তা, কতো দূর পর্যন্ত মানবিক স্বভাব হয়ে উঠেছে তার স্বভাব’।

বিষয়টি এর থেকে আর ভালোভাবে বিবৃত করা সম্ভব নয়। পুরুষকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিদ্যমান বিশ্বের মাঝে মুক্তির রাজত্ব। পরম বিজয় লাভের জন্যে, এক দিকে, এটা দরকার যে পুরুষ ও নারীরা তাদের প্রাকৃতিক পার্থক্যকরণের সাহায্যে ও মাধ্যমে দৃঢ়তার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করবে তাদের ভ্রাতৃত্ববোধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *