৭.১ স্বাধীন নারী

স্বাধীন নারী
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৭ –মুক্তির অভিমুখে। পরিচ্ছেদ ১

ফরাশি আইন অনুসারে, আনুগত্য আর স্ত্রীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, এবং প্রতিটি নারী নাগরিকের আছে ভোটাধিকার; কিন্তু এসব নাগরিক অধিকার রয়ে যায় তাত্ত্বিক, যত দিন না এগুলোর সাথে যুক্ত হয় আর্থনীতিক স্বাধীনতা। পুরুষ ভরণপোষণ করে যে-নারীর স্ত্রী বা বারবনিতা ভোটাধিকার পেয়েছে বলেই সে পুরুষের অধীনতা থেকে মুক্ত, এমন নয়; সামাজিক রীতিনীতি আগের থেকে এখন কম বাধা সৃষ্টি করলেও নেতিবাচক স্বাধীনতা নারীর পরিস্থিতিকে গভীরভাবে পরিবর্তিত করে নি; সে এখনো বাঁধা পড়ে আছে তার দাসত্বের অবস্থায়। নারী-পুরুষকে পৃথক করে রেখেছে যে-দূরত্ব, অর্থকর চাকুরির মাধ্যমেই–নারী সে-দূরত্বের অধিকাংশ পেরিয়ে এসেছে; এবং বাস্তবে এ ছাড়া আর কিছুই নারীর মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। যখন সে আর পরজীবী নয়, তখন ভেঙে পড়ে তার পরনির্ভরতা ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সংশ্রয়; তার ও বিশ্বের মাঝে আর কোনো পুরুষ মধ্যস্থতাকারীর দরকার পড়ে না।

দাসী হিশেবে তার ওপর চেপে আছে যে-অভিশাপ, আমরা দেখেছি, তার কারণ হচ্ছে তাকে কিছু করতে দেয়া হয় না; তাই সে আত্মরতি, প্রেম, বা ধর্মের মাধ্যমে নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকে তার জীবনকে সার্থক করার ব্যর্থ প্রয়াসে। যখন সে হয় উৎপাদনশীল, সক্রিয়, তখন সে পুনরুদ্ধার করে তার সীমাতিক্ৰমণতা; তার কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে সে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করে কর্তা হিশেবে তার মর্যাদা; সে যে-সব লক্ষ্যে কাজ করে, সে অধিকারী হয় যে-অর্থ ও অধিকারের, তা দিয়ে সে তার দায়িত্বরের পরীক্ষানিরীক্ষা করে ও গুরুত্ব বোঝে। বহু নারী এসব সুবিধা সম্পর্কে। সচেতন, এমনকি খুবই সামান্য অবস্থানে আছে যারা, তারাও বোঝে। এক হোটেলের পাথুরে মেঝে মাজতে মাজতে এক ঠিকা-ঝিকে আমি বলতে শুনেছি : ‘আমি কখনো কারো কাছে কিছু চাই নি; আমি নিজেই নিজের সব কিছু করেছি’। একজন রকফেলারের মতোই সে গর্বিত ছিলো নিজের স্বাবলম্বিতা সম্পর্কে। তবে এটা মনে করা ঠিক হবে না যে ভোটাধিকার ও একটি চাকুরিই হচ্ছে সম্পূর্ণ মুক্তি : কাজ করা, আজ, মুক্তি নয়। নারীর অবস্থার বদলের ফলে সামাজিক সংগঠনের বিশেষ পরিবর্তন ঘটে নি; এ-বিশ্ব সব সময়ই ছিলো পুরুষের অধিকারে, পুরুষ একে যে-রূপ দিয়েছে এটি এখনো আছে সে-রূপেই।

যে-সব ব্যাপার নারীর শ্রমের বিষয়টিকে জটিল করে তোলে, সেগুলোর কথা ভুলে গেলে চলবে না। একজন গুরুত্বপূর্ণ ও সুবিবেচক নারী রেনল কারখানাগুলোর নারীদের সম্পর্কে সম্প্রতি একটি পর্যেষণা সম্পন্ন করেছেন; তিনি বিবৃত করেছেন যে কারখানায় কাজের থেকে বাড়িতে থাকতেই তারা বেশি পছন্দ করতো। সন্দেহ নেই যে তারা আর্থনীতিক স্বাধীনতা লাভ করে শুধু একটি শ্রেণীর সদস্য হিশেবে, যেটি আর্থনীতিকভাবে নির্যাতিত; এবং, অন্য দিকে, কারখানায় তাদের কাজ গৃহস্থালির ভার থেকে তাদের মুক্তি দেয় না। অধিকাংশ নারীই মুক্তি পায় না প্রথাগত নারীর জগত থেকে; বস্তুগতভাবে পুরুষের সমান হওয়ার জন্যে তাদের যে-সহায়তা পাওয়া দরকার, তা তারা সমাজের কাছে থেকেও পায় না তাদের স্বামীদের কাছে থেকেও পায় না। শুধু সে-সব নারী, যাদের আছে রাজনীতিক বিশ্বাস, যারা সংঘে জঙ্গি কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে, যাদের বিশ্বাস আছে তাদের ভবিষ্যতের ওপর, তারাই শুধু সে-প্রাত্যহিক শ্রমকে দিতে পারে একটা নৈতিক অর্থ, যে-শ্রমে ধন্যবাদও মেলে না। কিন্তু অবকাশহীন, একটা প্রথাগত বশবর্তিতার উত্তরাধিকারী হয়ে, নারীরা সবেমাত্র একটা রাজনীতিক ও সামাজিক বোধের বিকাশ ঘটাতে শুরু করেছে। এবং তাদের কাজের বিনিময়ে তাদের যে-নৈতিক ও সামাজিক সুবিধা ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রাপ্য, তা না পেয়ে তারা নিরুৎসাহে নতি স্বীকার করছে এর চাপের কাছে।

এও বেশ বোধগম্য যে নারীবস্ত্রপ্রস্তুতকারীর শিক্ষানবিশটি, দোকানের কর্মচারী মেয়েটি, সহকারিণীটি পুরুষের ভরণপোষণের সুবিধা ছাড়তে চাইবে না। ইতিমধ্যেই আমি উল্লেখ করেছি যে একটি সুবিধাভোগী গোত্রের অস্তিত্ব থাকা তরুণীর কাছে একটি প্রায়-অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন, কেননা শুধু নিজের দেহ সমর্পণ করেই সে যোগ দিতে পারে ওই গোত্রে, তার নিয়তিই হচ্ছে ‘বীরপুরুষ’-এর কাছে নিজেকে দান করা, এজন্যে যে তার মজুরি ন্যূনতম, আর সেখানে সমাজ তার কাছে জীবনযাপনের যেমান প্রত্যাশা করে, তা খুবই উচ্চ। যদি সে নিজের মজুরি দিয়েই চালাতে চায়, তাহলে সে হয়ে ওঠে একটা অস্পৃশ্য মানুষ : খারাপ বাসা, খারাপ পোশাক, সে বঞ্চিত হবে সমস্ত আমোদপ্রমোদ, এবং এমনকি প্রেম, থেকে। ধার্মিকেরা তাকে দেয় কৃচ্ছতের উপদেশ, এবং আসলেই তার খাবারদাবার অধিকাংশ সময়ই কার্মেলীয় তপস্বিনীর খাবারের মতোই বিশু। দুর্ভাগ্যবশত, বিধাতাকে সবাই প্রেমিক হিশেবে নিতে পারে না : নারী হিশেবে সে যদি জীবনে সফল হতে চায়, তাহলে তাকে সুখী করতে হবে একটি পুরুষকে। তাই সে সাহায্য নেবে, এবং তাকে অনাহারে থাকার মতো মজুরি দেয়ার সময় এর ওপরই সিনিকের মতো নির্ভর করে তার নিয়োগদাতা। এ-সাহায্য কখনো কখনো তার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে এবং প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে সহায়তা করে; তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে, সে ছেড়ে দেবে তার কাজ এবং হয়ে উঠবে একটি রক্ষিতা নারী। সে প্রায়ই রক্ষা করে আয়ের উভয় উৎসকেই এবং এর প্রতিটি কম-বেশি কাজ করে অন্যটির থেকে মুক্তির উপায়রূপে; তবে প্রকৃতপক্ষে সে থাকে দ্বিগুণ দাসত্বে : কাজের কাছে ও রক্ষকের কাছে। বিবাহিত নারীর কাছে তার মজুরিকে মনে হয় টুকিটাকি জিনিশ কেনার টাকা; যে-মেয়েটি ‘পাশ থেকে একটু আয় করে’, তার কাছে পুরুষের দানের টাকাকেই মনে হয়অতিরিক্ত; তবে নিজের চেষ্টায় তাদের কেউই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে না।

তবে আছে প্রচুর সংখ্যক বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত নারী, যারা আর্থনীতিক ও সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের একটি উপায় লাভ করে তাদের পেশার মধ্যে। নারীর সম্ভাবনা ও তার ভবিষ্যৎ বিবেচনা করতে গেলে এগুলোর কথা মনে আসে। যদিও এখনো তারা নিতান্তই সংখ্যালঘু, তবু এ-কারণেই তাদের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক; নারীবাদী ও নারীবাদবিরোধীদের মধ্যে তারা একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে আছে। পরের দলটি দাবি করে যে আজকের মুক্তিপ্রাপ্ত নারীরা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই করে উঠতে পারে নি এবং নিজেদের আন্তর ভারসাম্য অর্জন করাও তাদের পক্ষে কঠিন। আগের দলটি অতিরঞ্জিত করে পেশাজীবী নারীদের সাফল্যকে এবং দেখতে পায় না তাদের আতর কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। প্রকৃতপক্ষে, তারা ভুল পথে আছে বলার বিশেষ কারণ নেই; এবং ত এটা নিশ্চিত যে তারা তাদের এলাকায় প্রশান্তভাবে স্থিত হয় নি : এখন পর্যন্ত ওই দিকে তারা আধাপথ এগিয়েছে। যে-নারী আর্থনীতিকভাবে মুক্তি পেয়েছে পুরুষের থেকে, সে পুরুষের সাথে অভিন্ন নৈতিক, সামাজিক, ও মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতিতে অবস্থান করে না। যেভাবে সে কাজ করে তার পেশায় এবং পেশার প্রতি দেয় যে-মনোযোগ, তা নির্ভর করে তার সমগ্র জীবনপদ্ধতি তাকে দিয়েছে যে-পরিস্থিতি, তার ওপর। কেননা সে যখন তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবন শুরু করে, তখন তার পেছনে থাকে না একই অতীত, যা থাকে একটি ছেলের পেছনে; সমাজ তাকে একইভাবে দেখে না; বিশ্ব তার সামনে উপস্থিত প্রেক্ষিতে। নারী হওয়া আজ একটি স্বাধীন ব্যক্তিমানুষের সামনে উপস্থিত করে বিশেষ ধরনের সমস্যা।

পুরুষ ভোগ করে যে-সুবিধা, যা সে বোধ করে শৈশব থেকেই, সেটা হচ্ছে মানুষ হিশেবে তার বৃত্তি কিছুতেই পুরুষ হিশেবে তার নিয়তির বিপক্ষে যায় না। শিশ্ন ও সীমাতিক্ৰমণতার সমীকরণের মাধমে এটা এমন রূপ নেয় যে তার সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সাফল্য তাকে ভূষিত করে এক পৌরুষেয় মর্যাদায়। সে খণ্ডিত নয়। আর সেখানে নারীর নারীত্বকে বাস্তবায়িত করার জন্যে নিজেকে তার আবশ্যিকভাবে করে তুলতে হয় বস্তু ও শিকার, এর অর্থ হচ্ছে তাকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে সার্বভৌম কর্তা হিশেবে তার দাবি। এ-বিরোধই বিশেষভাবে লক্ষণীয় করেতোলে মুক্তিপ্রাপ্ত নারীর পরিস্থিতিকে। সে অস্বীকার করে নারী হিশেবে তার ভূমিকায় নিজেকে আবদ্ধ রাখতে, কেননা সে বিকলাঙ্গতাকে মেনে নেবে না; তবে তার লিঙ্গকে অস্বীকার করাও হবে একটি বিকলাঙ্গতা। পুরুষ একটি কামসম্পন্ন মানুষ; নারীও তখনই হয়ে ওঠে পুরুষের সমান একটি পরিপূর্ণ ব্যক্তি, শুধু যখন সে হয় একটি কামসম্পন্ন মানুষ। তার নারীত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে তার মনুষ্যত্বের একটি অংশকে অস্বীকার করা। ‘নিজেদের অবহেলা’ করার জন্যে নারীবিদ্বেষীরা প্রায়ই ভসনা করেছে বুদ্ধিজীবী নারীদের; তবে তারা নারীদের কাছে প্রচার করেছে এ-মতবাদ : যদিতোমরা সমান হতে চাও আমাদের, তাহলে প্রসাধন আর চারিমিনা ছাড়ো।

এ-উপদেশ একটা বাজেকথা। নারীত্বের ধারণাটি যেহেতু কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়েছে প্রথা ও ফ্যাশন দিয়ে, তাই এটা বাইর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় প্রতিটি নারীর ওপর; তাকে ধীরেধীরে রূপান্তরিত করা সম্ভব যাতে তার শোভনতা-শালীনতাবোধের বিধিবিধান হয়ে ওঠে পুরুষের গৃহীত বিধিবিধানের মতো: সমুদ্রসৈকতে এবং প্রায়ই অন্যত্র–ট্রাউজার হয়ে উঠেছে নারীসুলভ। এটা বিষয়টির কোনো মৌল পরিবর্তন ঘটায় না : ব্যক্তিটি এখনো ইচ্ছেমতো তার নারীত্বের ধারণাকে রূপায়িত করার মতো স্বাধীন নয়। যে-নারী খাপ খায় না, সে লৈঙ্গিকভাবে করে নিজের অবমূল্যায়ন, সুতরাং অবমূল্যায়ন করে সামাজিকভাবে, কেননা লৈঙ্গিক মূল্যবোধ সমাজের একটি অচ্ছেদ্য অংশ। নারীর গুণাবলি প্রত্যাখ্যান করলেই কেউ পৌরুষেয় গুণাবলির অধিকারী হয়; এমনকি পুরুষেরপোশাক পরে যে-নারী, সেও নিজেকে পুরুষ করে তুলতে পারে–সে পুরুষের ব্যঙ্গরূপ। আমরা যেমন দেখেছি, সমকাম হচ্ছে একটি বিশেষ মনোভাব : নিরপেক্ষতা অসম্ভব। এমন কোনোনেতিবাচক মনোভাব নেই, যা নির্দেশ করে না একটি ইতিবাচক প্রতিরূপকে। কিশোরী মেয়ে প্রায়ই মনে করে যে প্রথাকে সে অবজ্ঞা করে যেতে পারে; তবে সেখানেও সে বিজড়িত প্ৰকাশ্য বিক্ষোভে; সে একটি নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যার পরিণতির দায় অবশ্যই তাকে নিতে হয়। যখন কেউ একটা গৃহীত বিধানের সঙ্গে সেঁটে থাকতে ব্যর্থ হয়, তখন সে হয়ে ওঠে একটি বিদ্রোহী।অদ্ভুত ধরনের বেশবাস করে যে-নারী, সে যখন সরল ভঙ্গিতে দৃঢ়তার সাথে বলে যে তাকে যে-পোশাকে মানায়, সে তা-ই পরে, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়, তখন সে মিথ্যে কথা বলে। সে খুব ভালোভাবেই জানে যে মানানোর জন্যে তাকে হতে হবে অদ্ভুত।

এর বিপরীতে, যে-নারী নিজেকে বাতিকগ্রস্তরূপে দেখাতে চায় না, সে খাপ খাওয়াবে প্রচলিত রীতির সাথে। যদি ইতিবাচকভাবে কার্যকর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত না থাকে, তাহলে একটা উদ্ধত মনোভাব গ্রহণ করা অবিবেচনাপ্রসূত : এটা যতোটা সময় ও শক্তি বাঁচার, তার চেয়ে অনেক বেশি অপচয় করে। যে-নারীর আহত করার বা নিজেকে সামাজিকভাবে হেয় করার কোনো সাধ নেই, সে তার নারীধর্মী পরিস্থিতিতে নারীধর্মী রীতিতেই জীবন যাপন করবে; এবং অধিকাংশ সময় এজন্যে যে তার পেশাগত সাফল্য এটা দাবি করে। তবে পুরুষের জন্যে খাপখাওয়ানো যেখানে খুবই স্বাভাবিক প্রথা যেহেতু একজন স্বাধীন ও সক্রিয় ব্যক্তি হিশেবে তারই প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আর সেখানে যে-নারীও যখন কর্তা, সক্রিয়, তখনও তার দরকার পড়বে নিজেকে ধীরে ধীরে সুকৌশলে সে-বিশ্বে প্রবেশ করানো, যা তাকে দণ্ডিত করেছে অক্রিয়তায়। এটাকে করে তোলা হয় আরো বেশি দুর্বহ, কেননা নারীর এলাকায় আটকে থাকা নারীরা এর গুরুত্ব ভীষণভাবে বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে : তারা বেশবাস ও গৃহস্থালির কাজকে পরিণত করেছে দুরূহ কলায়। পুরুষকে তার পোশাকের কথা ভাবতেই হয় না, কেননা তার পোশাক সুবিধাজনক, তার সক্রিয় জীবনের উপযোগী, ওগুলো অপরিহার্যরূপে মার্জিত নয়; ওগুলো তার ব্যক্তিত্বের কোনো অংশই নয়। এছাড়া, কেউ আশা করে না যে সে নিজে যত্ন নেবে তার পোশাকের : কোনো একটি সহৃদয় ইচ্ছুক বা ভাড়া করা নারী তাকে রেহাই দেয় এ-জ্বালাতন থেকে।

নারী, এর বিপরীতে, জানে যে যখন কেউ তাকায় তার দিকে, তখন সে তাকে তার আকৃতির থেকে ভিন্ন করে দেখে না : তাকে বিচার, শ্রদ্ধা, কামনা করা হয় তার প্রসাধন দিয়ে ও প্রসাধনের মাধ্যমে। তার পোশাকের মূল উদ্দেশ্য ছিলো তাকে ক্লীব করে তোলা, এবং সেগুলো রয়ে গেছে ব্যবহারের অনুপযোগী : লম্বা মোজা ফেঁসে যায়, নিচু হয়ে যায় জুতোর খুড়ের দিকটা, ময়লা হয়ে যায় হাল্কা রঙের ব্লাউজ ও ফ্রক, কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যায়। তবে সারাইয়ের অধিকাংশ কাজ করতে হয় তার নিজেকেই; অন্য নারীরা দয়াপরবশ হয়ে তাকে সাহায্য করতে আসবে না এবং যেকাজ সে নিজে করতে পারে, তার জন্যে সে টাকা ব্যয় করতে চাইবে না : দীর্ঘস্থায়ীগুলোতে, কেশবিন্যাসে, প্রসাধনসামগ্রিতে, নতুন পোশাকে এরমাঝেই অনেক খরচ হয়ে গেছে। সারাদিনের কাজের পর যখন ঘরে ফেরে ছাত্রী ও সহকারিণীরা, তখন তারা সব সময়ই পায় একটা লম্বা মোজা, যেটা ছিড়ে গেছে বলে রিপু করতে হবে, একটা ব্লাউজ, যা ধুতে হবে, একটা স্কার্ট, যা ইস্ত্রি করতে হবে। যে-নারী ভালো আয় করে, সে নিজেকে মুক্তি দেবে এসব নীরস একঘেয়ে খাটুনি থেকে, তবে তাকে রক্ষা করতে হবে আরো জটিল আভিজাত্য; তার সময় নষ্ট হবে কেনাকাটায়, পোশাক মানানসই করায়, ও আরো বহু কিছুতে। প্রথা আরো চায় এমনকি একলা নারীকেও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে তার বাসস্থানের প্রতি। নতুন কোনো নগরে দায়িত্ব পেয়েছে, এমন কোনো কর্মকর্তা সহজেই একটি হোটেলে আবাসন পাবে; কিন্তু একই পদের একটি নারী চাইবে থাকার জন্যে তার নিজের একটি জায়গা। তাকে এটা রাখতে হবে নিখুঁতভাবে পরিচ্ছন্ন, কেননা লোকজন নারীর বেলা অবহেলা ক্ষমা করবে, যা তারা স্বাভাবিক বলেই মনে করবে পুরুষের বেলা।

যে-নারী তার শক্তি ব্যয় করে, যার আছে দায়িত্ব, যে জানে বিশ্বের বিরোধিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম কতো কঠোর, পুরুষের মতোই–শুধু বাস্তব কামনা পরিতৃপ্ত করলেই তার চলে না, তার আরো দরকার পড়ে প্রীতিকর যৌন রোমাঞ্চের মধ্য দিয়ে বিনোদন ও আমোদপ্রমোদ উপভোগ। এখন, আজো আছে বহু সামাজিক বৃত্ত, যেখানে এব্যাপারে তার স্বাধীনতা স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়নি; সে এটা প্রয়োগ করলে তার ঝুঁকি থাকে মানসম্মান, চাকুরি হারানোর; কমপক্ষে তাকে করতে হয় একটা ক্লেশকর ভণ্ডামমা। সমাজে যতো বেশি দৃঢ়ভাবে সে প্রতিষ্ঠা করে তার অবস্থান,লোকজন ততো বেশি প্রস্তুত থাকে চোখ বুজে থাকতে; কিন্তু বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলগুলোতে সচরাচর তার ওপর চোখ রাখা হয় চরম কঠোরভাবে। এমনকি সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশে–যেখানে জনমতের ভীতি সামান্য। সেখানেও এ-ব্যাপারে তার পরিস্থিতি পুরুষের সমতুল্য নয়। এ-পার্থক্য নির্ভর করে প্রথাগত মনোভাব ও নারীর কামের বিশেষ প্রকৃতি উভয়েরই ওপর।

নারীর জন্যে একটি সম্ভবপর সমাধান হচ্ছে রাস্তা থেকে এক রাত বা এক ঘণ্টার জন্যে একটি সঙ্গী নিয়ে আসা–মনে করা যাক নারীটি যেহেতু সংরাগপূর্ণ ধাতের এবং সে কাটিয়ে উঠেছে তার সব সংকোচ, তাই সে ঘেন্না না করে এটা মনস্থ করতে পারে–তবে এ-সমাধান পুরুষের জন্যে যতোটা বিপজ্জনক নারীর জন্যে তার থেকে অনেক বেশি। তার যৌনব্যাধির ঝুঁকি গুরুতর, কেননা পুরুষটিরই দায়িত্ব সংক্রমণের বিরুদ্ধে সাবধানতা অবলম্বনের; এবং যতোই সাবধান হোক-না-কেনো নারীটি কখনোই গর্ভধারণের বিপদ থেকে সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত নয়। কিন্তু অপরিচিতদের মধ্যে এমন সম্পর্কে–যে-সম্পর্ক স্থাপিত একটা বর্বরতার স্তরে–যা সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে তাদের শারীরিক শক্তির পার্থক্য। পুরুষ যে-নারীটিকে বাসায় আনে, তার থেকে পুরুষটির ভয় পাওয়ার বিশেষ কিছু নেই; তাকে নিতান্তই যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রস্তুত থাকতে হয় আত্মরক্ষার জন্যে। যে-নারী বাসায় পুরুষ আনে, তার জন্যে এটা একই ব্যাপার নয়। আমাকে দুটি নারীর কথা বলা হয়েছিলো, যারা সদ্য এসেছিলো প্যারিসে এবং আগ্রহ বোধ করেছিলো ‘জীবন দেখা’র জন্যে; তারা রাতে একটু ঘোরাঘুরির পর দুটি আকর্ষণীয় মৎমাৎ চরিত্রকে নিমন্ত্রণ করে রাতের ভোজে। ভোরবেলা তারা দেখে ডাকাতি হচ্ছে বাসায়, তাদের প্রহার করা হচ্ছে, এবং গোপন কথা ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে। আরো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে চল্লিশ বছর বয়স্ক, বিচ্ছেদপ্রাপ্ত, এক নারীর ক্ষেত্রে, যে সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করতে তিনটি সন্তান ও বুড়ো পিতামাতাকে পালনের জন্যে। তখনো সে আকর্ষণীয়, কিন্তু সামাজিক জীবনের জন্যে বা ছেনালিপনার জন্যে এবং একটা প্রেমের সম্পর্ক তৈরির জন্যে প্রথানুসারী কার্যকলাপের জন্যে তার একটুও সময় ছিলো না। তবে তার ছিলো তীব্র অনুভূতি, এবং সে বিশ্বাস করতো যে তার অধিকার আছে ওগুলো পরিতৃপ্ত করার। তাই সে মাঝেমাঝে রাতে বেরোতো রাস্তায় এবং একটা পুরুষ ধরতো। তবে এক রাতে, বোই দ্য বলনের ঝোপঝাড়ে দু এক-ঘণ্টা কাটানোর পর, তার ক্ষণিকের প্রেমিক তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়না; একসাথে বাসের ব্যবস্থা করার জন্যে সে চায় নারীটির নাম ও ঠিকানা, আবার দেখা করতে চায় তার সাথে। নারীটি রাজি না হওয়ায় পুরুষটি তাকে প্রচণ্ড মারধোর করে এবং শেষে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে প্রায় মৃত্যুর আতঙ্কে ফেলে রেখে চলে যায়।

পুরুষ যেমন প্রায়ই রক্ষিতা রাখে, সেভাবে একটি স্থায়ী প্রেমিক রাখা, এবং তার ভরণপোষণ করা বা আর্থিকভাবে তাকে সাহায্য করা সম্ভব শুধু ধনাঢ্য নারীদের পক্ষে। অনেকে আছে, যারা এ-ব্যবস্থাকে প্রীতিকর মনে করে; টাকা দিয়ে তারা পুরুষটিকে পরিণত করে নিতান্তই একটি হাতিয়ারে এবং তাকে ব্যবহার করতে পারে ঘৃণ্য অসংযমের সাথে। তবে সাধারণত, কাম ও আবেগকে এতোটা স্থূলভাবে বিচ্ছিন্ন। করার জন্যে ওই নারীদের হতে হয় বুড়ো। অনেক পুরুষ আছে, যারা কখনো দেহ ও চৈতন্যকে পৃথক করা মেনে নেয় না; এবং আরো অধিক কারণবশত অধিকাংশ নারীই এটা গ্রহণ করতে সম্মত হবে না। তাছাড়াও, এতে আছে প্রতারণা, যার প্রতি তারা পুরুষের থেকেও বেশি সংবেদনশীল; কেননা টাকা ব্যয় করে যে-খরিদ্দার, সে নিজেও হয়ে ওঠে একটি হাতিয়ার, কেননা তার সঙ্গী তাকে ব্যবহার করে জীবিকার উপায় হিশেবে। উপায় থাকলেও একটি পুরুষ ক্রয় করাকে নারী কখনোই একটি সন্তোষজনক সমাধানরূপে মেনে নেবে না।

আছে একটি নারীধর্মী কাজ, যা সম্পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে সম্পন্ন করা বাস্তবিকভাবে প্রায়-অসম্ভব। এটা মাতৃত্ব। ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় এবং অন্য কিছু দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কল্যাণে কোনো নারী নিজের ইচ্ছে অনুসারে অন্তত গর্ভধারণে রাজি নাও হতে পারে। ফ্রান্সে তাকে প্রায়ই ঠেলে দেয়া হয় যন্ত্রণাদায়ক ও ব্যয়বহুল গর্ভপাতের দিকে; নইলে তাকে বহন করতে হয় একটি অবাঞ্ছিত সন্তানের দায়, যা ধ্বংস করে দিতে পারে তার পেশাগত জীবন। এটা যে একটি ভারি দায়ভার, তার কারণ হচ্ছে। প্রথা নারীকে তার যখন ইচ্ছে তখন সন্তান জন্ম দিতে দেয় না। অবিবাহিত মা সমাজের একটি কেলেঙ্কারি; এবং অবৈধ জন্ম শিশুটির জন্যে একটি কলঙ্ক; বিয়ের শেকল না পরে বা গোত্রচ্যুত না হয়ে মা হওয়া খুব কম সময়ই সম্ভব। কৃত্রিম পরিনিষেকর ধারণাটি যে বহু নারীকেই আকৃষ্ট করে, তার কারণ এ নয় যে তারা পুরুষের সাথে সঙ্গম এড়াতে চায়; এর কারণ হচ্ছে তারা আশা করে অবশেষে সমাজ স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে মাতৃত্বের স্বাধীনতাকে। এ-সাথে বলা দরকার যে সুবিধাজনক দিবা শিশুপালনকেন্দ্র ও কিন্ডারগার্টেন থাকা সত্ত্বেও একটি শিশু থাকা নারীর কর্মকাণ্ডকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করার জন্যে যথেষ্ট; সে শুধু তখনই কাজে যেতে পারে যদি সে একে রেখে যেতে পারে আত্মীয়দের, বন্ধুদের, বা ভৃত্যদের কাছে। সে বেছে নিতে বাধ্য হয় বন্ধ্যাত্ব, যা প্রায়ই অনুভূত হয় একটি যন্ত্রণাদায়ক হতাশা, এমন বোঝারূপে, যা কর্মজীবনের সাথে আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এভাবেই আজকের স্বাধীন নারী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার পেশাগত আগ্রহ ও তার কামজীবনের সমস্যার মধ্যে; এ-দুয়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য স্থাপন করা তার পক্ষে কঠিন; যদি সে পারে, তাহলে এটা করতে হয় অধিকার ছাড় ও ত্যাগস্বীকারের মূল্যে, যার ফলে তাকে থাকতে হয় এক স্থায়ী স্নায়বিক চাপের মধ্যে। শারীরবৃত্তিক তথ্যে নয়, এখানেই খুঁজতে হবে সে-স্নায়ুদৌর্বল্য ও ভঙ্গুরতার কারণ, যা প্রায়ই দেখা যায় তার মধ্যে। নারীর শারীরিক গঠন তার জন্যে কতোটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তা নির্ণয় করা কঠিন। মাঝেমাঝেই অনুসন্ধান চালানো হয়, উদাহরণস্বরূপ, ঋতুস্রাব কতোটা বাধা সৃষ্টি করে সম্পর্কে। যে-নারীরা প্রকাশনা বা অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁরা এর ওপর খুবই কম গুরুত্ব দিয়ে থাকেন বলে মনে হয়। এর কারণ কি, প্রকৃতপক্ষে, তারা তাদের সাফল্যের জন্যে ঋণী তাদের আপেক্ষিকভাবে কিঞ্চিৎ মাসিক অসুস্থতার কাছে? প্রশ্ন করা যায় এটা কি এ-কারণে নয় যে, এর বিপরীতে, তাদের সক্রিয় ও উচ্চাভিলাষী জীবনই আছে এ-সুবিধার মূলে; নারী তার ব্যাধির প্রতি বোধ করে যে-আগ্রহ, তাই বাড়িয়ে তোলে ব্যাধির প্রকোপ। যে-নারীরা খেলাধুলো ও অন্যান্য সক্রিয় কর্মকাণ্ডে জড়িত, তারা অন্যদের থেকে ব্যাধিতে কম ভোগে, কেননা তারা এর দিকে বিশেষ খেয়ালই করে না। জৈবিক কারণও রয়েছে নিশ্চিতভাবেই, এবং অতি-উদ্যমী নারীদেরও আমি মাসে একবার চব্বিশ ঘণ্টা ধরে বিছানায় কাটাতে দেখেছি, তখন তারা নির্মম পীড়নের এক শিকার; কিন্তু এ-বিপদ তাদের কর্মকাণ্ডে সাফল্য লাভকে ব্যাহত করতে পারে নি।

যখন আমরা নারীর পেশাগত সাফল্য বিচার করি, এবং তার ভিত্তিতে নারীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুর্দান্তভাবে অনুমান করি, তখন এসব ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না। সে কর্মজীবন শুরু করে মানসিকভাবে উৎপীড়িত অবস্থার মধ্যে এবং যখন সে আছে প্রথাগতভাবে নারীত্ব ব্যক্তিগতভাবে তার ওপর যে-বোঝা চাপিয়ে দেয়, তার ভারের নিচে। বাস্তব পরিস্থিতিগুলোও তার অনুকূল নয়। এমন একটি সমাজ, যা বৈরী, বা কমপক্ষে সন্দিগ্ধ, তার ভেতর দিয়ে একটি নতুন পথ তৈরির চেষ্টা নবাগতের জন্যে সব সময়ই কঠিন। ব্ল্যাক বয়-এ রিচার্ড রাইট দেখিয়েছেন শুরু থেকেই কীভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে একটি মার্কিন নিগ্রো তরুণের উচ্চাভিলাষ এবং যে-স্তরে শাদাদের সমস্যা শুরু হয়, সে-স্তরে উঠতেই তাকে কী লড়াই করতে হয়েছে। আফ্রিকা থেকে ফ্রান্সে আগত নিগ্রোরাও মুখখামুখি হয় এমন বাধার তাদের নিজেদের সাথে ও চারপাশের সঙ্গে–যেগুলো, নারীরা যে-সব বাধার মুখোমুখি হয়, সেগুলোর মতো।

তার শিক্ষানবিশির পর্বে নারী নিজেকে দেখতে পায় এক হীনতার অবস্থানে, তরুণীর প্রসঙ্গে যে-বিষয়টি ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে, তবে তা এখন আরো যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। তার পড়াশুনোর কালে ও তার কর্মজীবনের প্রথম নিশ্চায়ক বছরগুলোতে, খুব কম সময়ই নারী তার সুযোগগুলো সরাসরি ব্যবহার করে এবং তাই প্রায়ই খারাপভাবে শুরু করে পরে সে হয় প্রতিবন্ধকতাগ্রস্ত। যে-সব। সংঘাতের কথা আমি বলেছি, সেগুলো, প্রকৃতপক্ষে, সর্বাধিক তীব্রতায় পৌছে আঠারো থেকে তিরিশ বছর বয়সের মধ্যে, ঠিক সে-সময়ে, যখন পেশাগত ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে। নারীটি তার পরিবারের সঙ্গেই থাকুক বা বিবাহিতই হোক তার পরিবার পুরুষের কাজের প্রতি যে-শ্রদ্ধা দেখায়, তার কাজের প্রতি কদাচিৎ দেখায় সমান শ্রদ্ধা; তারা তার ওপর চাপিয়েদেয় নানা দায়িত্ব ও কাজ এবং খর্ব করে তার স্বাধীনতা। সে নিজেই গভীরভাবে প্রভাবিত থাকে তার লালনপালন দিয়ে, বড়োরা যে-সব মূল্যবোধ দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছে, সেগুলোর প্রতি সে থাকে শ্রদ্ধাশীল, থাকে তার শৈশব ও বয়ঃসন্ধির স্বপ্ন দিয়ে গ্রস্ত; তার অতীতে উত্তরাধিকার ও তার ভবিষ্যতের আগ্রহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে সে পড়ে বিপদে। অনেক সময় সে প্রকাশ্যে শপথ নেয় তার নারীত্ব পরিহারের, সে দ্বিধাণ্বিত থাকে সতীত্ব, সমকামিতা, ও একটা আক্রমণাত্মক রণচণ্ডী মনোভাবের মধ্যে; সে বাজে বেশবাস করে বা পুরুষের পোশাক পরে; এবং এ-ক্ষেত্রে সে প্রচুর সময় নষ্ট করে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে, ভাব দেখিয়ে, রাগে ফুঁসে উঠে। অধিকাংশ সময়ই সে জোর দিতে চায় তার নারীসুলভ গুণাবলির ওপর : সে হয় ছেনালধর্মী, সে ধাইরে যায়, সে ফষ্টিনষ্টি করে, সে প্রেমে পড়ে, দুলতে থাকে মর্ষকাম ও আক্রমণাত্মকতার মধ্যে। সে প্রশ্ন করে, বিক্ষুব্ধ হয়, দিকে দিকে সে বিক্ষিপ্ত করে নিজেকে। এসব বাহ্যিক কর্মকাণ্ডই তাকে তার কর্মোদ্যোগে পুরোপুরি নিবিষ্ট হওয়ায় বাধা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট; সে এ দিয়ে যতো কম উপকৃত হয়, সে ততো বেশি প্ররোচিত বোধ করে এটা ছেড়ে দিতে।

যে-নারীর লক্ষ্য স্বাবলম্বী হওয়া, তার জন্যে যা চরমভাবে মনোবল ভেঙে দেয়ার মতো ব্যাপার, তা হচ্ছে তার একই মর্যাদার অন্যান্য নারীদের অস্তিত্ব, শুরুর দিকে যাদের ছিলো একই পরিস্থিতি ও একই সুযোগসুবিধা, যারা আছে পরগাছার মতো। পুরুষ ক্ষোভ বোধ করতে পারে বিশেষ সুবিধাভোগী পুরুষের প্রতি, তবে সে সংহতি বোধ করে তার শ্রেণীর সাথে; সাধারণত যারা একই সুযোগসুবিধা নিয়ে শুরু করে জীবনে, তারা একই সাফল্য অর্জন করে। আর সেখানে একই পরিস্থিতির নারীরা পুরুষের মধ্যস্থতায় অর্জন করতে পারে খুবই ভিন্ন ধরনের সৌভাগ্য। যে-নারী নিজে সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করছে, তার পথে একটা প্রলোভন হয়ে দেখা দেয়। আরামদায়কভাবে বিবাহিত বা পুরুষের ভরণপোষণপ্রাপ্ত কোনো একটি বান্ধবী; সে বোধ করে যে অত্যন্ত কঠোর পথে যাত্রা করে সে নিজেকে অযৌক্তিকভাবে নষ্ট করছে; প্রতিটি বাধার মুখে সে ভাবে ভিন্ন পথ নেয়াই হয়তো ভালো ছিলো। ‘যখন আমি ভাবি যে আমার নিজের মগজ দিয়েই আমাকে পেতে হবে সব কিছু!’ যেনো ওই চিন্তা তাকে বিমূঢ় করে ফেলেছে, এমনভাবে একটি দারিদ্রগ্রস্ত ছাত্রী আমাকে একথা বলেছিলো। পুরুষ মেনে চলে এক অত্যাবশ্যক জরুরি প্রয়োজনকে; নারীকে অবিরত দৃঢ়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করতে হয় তার অভিপ্রায়। সে একটি লক্ষ্যের ওপর স্থিরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সামনের দিকে এগোয় না, বরং তার চারদিকের প্রতিটি অভিমুখে ঘুরতে থাকে তার দৃষ্টি এবং তার চলার ভঙ্গিও ভীরু ও অনিশ্চিত। যতোই সে নিজের পথে এগোতে থাকে বলে মনে হয় ততই তার অন্য সুযোগগুলো লোপ পেতে থাকে; একটি নীলমুজো হয়ে, মস্তিষ্কশীল নারী হয়ে, সে সাধারণত পুরুষের কাছে নিজেকে করে তুলবে আকর্ষণহীন, বা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে সে অবমানিত করবে তার স্বামী বা প্রেমিককে। তাই সে আরো বেশি করে আভিজাত্য ও চটুলতাই শুধু দেখাতে থাকবে না, সে নিয়ন্ত্রণ করবে তার উচ্চাকাঙ্খা। নিজের দায়িত্ব নিজে নেয়া থেকে একদিন সে মুক্তি পাবে, এ-আশা এবং যদি কখনো তা পায়, তাহলে তা হারিয়ে ফেলার ভয় একত্র হয়ে তাকে বাধা দেয় নিঃশেষে নিজেকে তার পড়াশুনোয় ও তার কর্মজীবনে নিয়োজিত করতে।

নারী যতোটা নারী হতে চায়, তার স্বাধীন মর্যাদা ততোটা সৃষ্টি করে হীনম্মন্যতা ঘূঢ়ৈষা : অন্য দিকে, তার নারীত্ব তাকে সন্দেহী করে তোলে তার পেশাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। এটা এক অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা দেখেছি যে চোদ্দো বছরের মেয়েরা একজন অনুসন্ধানকারীর কছে ঘোষণা করেছে : ‘ছেলেরা মেয়েদের থেকে শ্ৰেষ্ঠ; তারা অধিকতর ভালো কর্মী’। তরুণী মেয়েনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে তার সামর্থ সীমিত। পিতামাতারাও শিক্ষকেরা যেহেতু স্বীকার করে যে মেয়েদের মেধার স্তর ছেলেদের থেকে নিম্ন, ছাত্রছাত্রীরাও তা অবিলম্বে স্বীকার করে নেয়; এবং বাস্তবিকপক্ষে, সমান পাঠক্রম সত্ত্বেও, ফ্রান্সের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের শিক্ষাগত সাফল্য অনেক নিচে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, দর্শনে মেয়েদের শ্রেণীর সব সদস্য, উদাহরণস্বরূপ, সুস্পষ্টভাবেই ছেলেদের শ্রেণীর নিচে। ছাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশ আর পড়াশুনো চালাতে চায় না, এবং খাটে অগভীরভাবে; আর অন্যদের অভাব রয়েছে সমকক্ষ হওয়ার সাধনা করার উদ্দীপকের। খুব সহজ পরীক্ষায় তাদের অযোগ্যতা অতিশয় স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে না, তবে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ছাত্রীটি সচেতন হয়ে উঠবে তার দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে। সে এজন্যে তার প্রশিক্ষণের মাঝারিত্বকে দায়ী করবে না, দায়ী করবে তার নারীত্বের অন্যায় অভিশাপকে; নিজেকে এ-অসাম্যের কাছে সমর্পণ করে সে বাড়িয়ে তোলে এটি; তাকে প্ররোচিত করা হয় যে তার সাফল্যের সুযোগ আসতে পারে শুধু তার ধৈর্য ও প্রয়োগের মধ্যে; সে গ্রহণ করে তার সময় ও শক্তির ব্যাপারে যথাসম্ভব মিতব্যয়ী হওয়ার দৃঢ়সংকল্পনিশ্চিতভাবেই একটা খারাপ পরিকল্পনা।

এ-পরাজয়বাদের পরিণতিরূপে নারী সহজেই মেনে নেয় পরিমিত সাফল্য; সে অতিশয় উচ্চ লক্ষ্য পোষণের সাহস করে না। অগভীর প্রস্তুতি নিয়ে তার পেশায় ঢুকে নারী অবিলম্বে নির্ধারণ করে তার অভিলাষের সীমা। নিজের জীবিকা নিজে উপার্জন করতে পারলেই নিজেকে তার যথেষ্ট মেধাবী মনে হয়; আরো অনেকের মতো সে একটি পুরুষের কাছে সমর্পণ করতে পারতো তার ভাগ্য। তার স্বাধীনতা লাভের। বাসনা পোষণ করে যাওয়ার জন্যে দরকার পড়ে একটা প্রচেষ্টা, এতে সে গর্ববোধ করে, কিন্তু এটা তাকে শেষ করে ফেলে। তার মনে হয় সে কিছু করতে মনস্থ করেই যথেষ্ট করে ফেলেছে। ‘এটাই একটি নারীর জন্যে বিশেষ মন্দ নয়’, সে ভাবে। এক নারী, যে কাজ করছিলো একটা অপ্রথাগত পেশায়, একবার বলেছিলো : যদি আমি পুরুষ হতাম, তাহলে আমি শীর্ষে পৌছোনোর কথা ভাবতাম; তবে এমন একটি পদে অধিষ্ঠিত ফ্রান্সে আমিই একমাত্র নারী : এ-ই আমার জন্যে যথেষ্ট। এপরিমিতিবোধের মধ্যে দূরদর্শিতা রয়েছে। নারী ভয় পায় বেশি দূরে যাওয়ার চেষ্টা করে সে তার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলবে।

বলা আবশ্যক যে স্বাধীন নারী ন্যায্যভাবেই বিচলিত বোধ করে একথা ভেবে যে তার ওপর লোকজনের আস্থা নেই। সাধারণভাবে, উচ্চবর্ণ বিরূপ থাকে নিম্নবর্ণ থেকে আসা নবাগতের প্রতি : শাদা মানুষেরা কোনো নিগ্রো চিকিৎসক দেখাবে না, পুরুষেরা দেখাবে না কোনো নারী ডাক্তার; কিন্তু নিম্নবর্ণের লোকেরা, তাদের বিশেষ নিকৃষ্টতা সম্পর্কে ধারণাবশত এবং তাদের বর্ণের যে-লোকটি তার প্রথাগত ভাগ্যের ওপরে উঠেছে, তার প্রতি তীব্র বিরাগবশত, তারাও পছন্দ করবে প্রভুদের কাছে যেতে। অধিকাংশ নারী পুরুষের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভক্তির ফলে ব্যথভাবে পুরুষ খোঁজে ডাক্তারের মধ্যে, আইনজীবীর মধ্যে, অফিসের ব্যবস্থাপক প্রভৃতির মধ্যে। একজন নারীর অধীনে পুরুষও থাকতে চায় না নারীও থাকতে চায় না। তার উতনেরা তার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করলেও সব সময়ই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থেকে কিছুটা প্রসন্নতা দেখাবে তার প্রতি; নারী হওয়া একটা ক্রটি না হলেও অন্তত একটা অদ্ভুতত্ব। নারীকে অবিরাম অর্জন করতে হয়আস্থা, যা প্রথম তার প্রতি পোষণ করা হয় না : শুরুতে সে হয় সন্দেহের পাত্র, তাকে প্রমাণ করতে হয় তার যোগ্যতা। যোগ্যতা থাকলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তারা এরকম বলে। তবে যোগ্যতা কোনো পূৰ্বদত্ত সারবস্তু নয়; এটা একটি সফল বিকাশের পরিণতি। কোনো একজনের বিরুদ্ধে একটা প্রতিকূল পূর্বসংস্কারের ভার বোধ করা খুব কম সময়ই তাকে তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। প্রারম্ভিক হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষা সাধারণত তাকে চালিত করে প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়ার দিকে, যা ধারণ করে একটি অতিরঞ্জিত কর্তৃত্বের কৃত্রিম আচরণের রূপ।

অধিকাংশ নারী চিকিৎসক, উদাহরণস্বরূপ, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত বা অতিশয় কম কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ করেন। যদি তারা স্বাভাবিক আচরণ করেন, তাঁরা ব্যর্থ হন নিয়ন্ত্রণে, কেননা সামগ্রিকভাবে জীবন তাদের প্রস্তুত করে প্রলুব্ধ করার জন্যে, কর্তৃত্ব করার জন্যে নয়; যে-রোগী শাসিত হতে চায়, সে হতাশ হবে সরলভাবে দেয়া পরামর্শে। এ-ব্যাপারে সচেতন হয়ে নারী চিকিৎসকেরা কথা বলেন গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে, চরম কর্তৃত্বপূর্ণ কঠে; তবে এতে তিনি হারিয়ে ফেলেন সে-রুক্ষ কিন্তু সরল ও স্পষ্টবাদী স্বভাব, যা নিজের সম্বন্ধে নিশ্চিত চিকিৎসকের আকর্ষণীয়তা।

পুরুষ নিজের অধিকার দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে অভ্যস্ত; তার খরিদ্দাররা বিশ্বাস করে তার যোগ্যতায়; সে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে : সে অভ্রান্তভাবে প্রভাব। বিস্তার করে। নারী একই রকম নিরাপত্তার বোধ জাগায় না; সে অহঙ্কারী আচরণের ভাব করে, তা ছেড়ে দেয়, সে এটা অতিরঞ্জিত করে। ব্যবসায়, প্রশাসনিক কাজে, সে যথাযথ, বুৎপুঁতে, সে সহজেই দেখায় আগ্রাসিতা। যেমন তার পড়াশুনোয়, তার অভাব স্বাচ্ছন্দ্য, তেজস্বিতা, দুঃসাহসের। সাফল্য অর্জনের প্রয়াসে সে হয়ে ওঠে উত্তেজিত। তার কর্মকাণ্ড হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতার ও আত্মঘোষণার পরম্পরা। এটাই সে-সাংঘাতিক ক্রটি, যা উদ্ভূত হয় আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে : কর্তা ভুলতে পারে নিজেকে। সে অকুতোভয়ে কোনো লক্ষ্যের দিকে নিবিষ্ট থাকে না : নির্ধারিত পথেই সে বরং উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়। সাহসের সাথে লক্ষ্যের দিকে এগোনোর মধ্যে মানুষ খুঁকি নেয় আশাভঙ্গের, তবে সে অভাবিত ফলও লাভ করে; সাবধানতা দণ্ডিত করে মাঝারিত্বে।

খুব কম সময়ই স্বাধীন নারীর মধ্যে আমরা দেখতে পাই দুঃসাহসিক অভিযাত্রা এবং অভিজ্ঞতার জন্যে অভিজ্ঞতা অর্জনের রুচি, বা কোনো নিরাসক্ত ঔৎসুক্য; সে অর্জনের চেষ্টা করে একটি কর্মজীবন যেমন অন্য নারীরা গড়ে তোলে সুখের নীড়; সে নিয়ন্ত্রিত, পরিবৃত থাকে পুরুষের জগত দিয়ে। তার দুঃসাহস নেই এর ছাদ। ভেঙেচুরে বেরিয়ে যাওয়ার, সে সংরক্তভাবে নিজেকে তার কর্মপরিকল্পনায় নিয়োগ করে না। এখনও সে তার জীবনকে গণ্য করে একটা সীমাবদ্ধ কর্মোদ্যোগরূপে : কোনো বস্তুগত লক্ষ্য অর্জন তার উদ্দেশ্য নয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে লক্ষ্যবস্তুর মাধ্যমে তার মন্ময় সাফল্য অর্জন করা। এ মনোভাব, উদাহরণস্বরূপ, খুবই দেখা যায় মার্কিন নারীদের মধ্যে; তারা এটা প্রকাশ করতে খুবই পছন্দ করে যে তারা একটি চাকুরি করতে এবং এটা খুবই ভালোভাবে সমাধা করতে সমর্থ; তবে তারা তাদের কাজের। আধের প্রতি সংরক্তভাবে আকর্ষণ বোধ করে না। একই রকমে নারীর প্রবণতা আছে যে সে অতিশয় গুরুত্ব দেয় ছোটোখাটো বাধাবিপত্তি ও সামান্য সাফল্যের ওপর; সে পদে পদে নিরুৎসিত হয় বা অহমিকায় স্ফীত হয়ে ওঠে। যখন কোনো সাফল্যের প্রত্যাশা দেখা দেয়, তখন মানুষ তা ধীরভাবে গ্রহণ করে; কিন্তু যখন এটা লাভ সম্পর্কে সে ছিলো সন্দেহপরায়ণ, তখন এটা হয় এক মাদকতাপূর্ণ বিজয়োল্লাস। এটাই সে-অজুহাত, যখন নারীরা তালগোল পাকিয়ে ফেলে প্রতিপত্তিতে এবং আঁকালো গৌরব বোধ করে তাদের তুচ্ছ সাফল্যে। তারা কতো দূর এসেছে, তা দেখার জন্যে তারা সব সময়ই পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকে, এবং ব্যাহত করে তাদের অগ্রগতি। এ-পদ্ধতিতে তারা সম্মানজনক সাফল্য অর্জন করতে পারে কর্মজীবনে, কিন্তু অসাধারণ কিছু অর্জন করতে পারে না। এটাও বলা করা দরকার যে বহু পুরুষও কর্মজীবনে মাঝারি সাফল্যের বেশি কিছু অর্জন করতে পারে না। শুধু পুরুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠদের সঙ্গে তুলনায়ই–অতিশয় দুর্লভ ব্যতিক্রমগুলো বাদে–নারী পেছনে পড়ে আছে বলে আমাদের মনে হয়। আমি যে-কারণগুলো দেখিয়েছি, সেগুলোই এটা ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করে, এবং কোনোক্রমেই সেগুলো বন্ধক দেয় না ভবিষ্যৎকে। অসামান্য কোনো কাজ করার জন্যে নারী আজ মূলত যার অভাব বোধ করে, তা হচ্ছে তার আত্মবিস্মৃতি; কিন্তু নিজেকে ভুলে যাওয়ার জন্যে প্রথমে যা দরকার, তা হচ্ছে এটা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া যে এখন এবং ভবিষ্যতের জন্যে সে লাভ করেছে নিজেকে। পুরুষের বিশ্বে ভিন্নভাবে এসে, তাদের দ্বারা স্বাভাবিক দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে দীনহীন কাজে নিযুক্ত হয়ে, নারী আজো আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত।

এক শ্রেণীর নারী আছে, যাদের ক্ষেত্রে এসব মন্তব্য প্রযোজ্য নয়, কেননা তাদের কর্মজীবন তাদের নারীত্বকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং দৃঢ়তর করে। তারা সে-নারী, যারা শৈল্পিক প্রকাশের মাধ্যমে পেরিয়ে যেতে চায় তাদের বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো; তারা অভিনেত্রী, নর্তকী, ও গায়িকা। তিন শতাব্দী ধরে তারাই শুধু সে-নারী, যারা সমাজে রক্ষা করে এসেছে মূর্ত স্বাধীনতা, এবং বর্তমানেও তারা সমাজে বজায় রাখছে একটা বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত স্থান। গির্জার কাছে আগে অভিনেত্রীরা ছিলো এক অভিশপ্ত বস্তু, এবং ওই কঠোরতার আতিশয্য সব সময়ই তাদের দিয়েছে আচরণের বিরাট স্বাধীনতা। তারা প্রায়ই প্রান্তবর্তী হয় নাগরালির এলাকার এবং বারবনিতাদের মতো, তারা তাদের অধিকাংশ সময় কাটায় পুরুষের সংস্পর্শে; তবে নিজেদের জীবিকা অর্জন করে ও তাদের কর্মের মধ্যে তাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে, তারা মুক্ত থাকে পুরুষের জোয়াল থেকে। তাদের বড়ো সুবিধা হচ্ছে যে তাদের পেশাগত সাফল্যপুরুষদের সাফল্যের মতোই বাড়িয়ে তোলে তাদের লৈঙ্গিক মূল্য; তাদের আত্মসিদ্ধির মধ্যে, মানুষ হিশেবে নিজেদের বৈধতাপ্রতিপাদনের মধ্যে, নারী হিসেবে তারা লাভ করে আত্মচরিতার্থতা : তারা পরস্পরবিরোধী আকাথায় ছিন্নভিন্ন হয় না। বরং তাদের কাজের মধ্যে তারা লাভ করে তাদের আত্মরতির যাথার্থ প্রতিপাদন; পোশাক, রূপচর্চা, মোহনীয়তা তাদের পেশাগত দায়িত্বের অংশ। নিজের ভাবমূর্তির প্রেমমুগ্ধ নারীর কাছে এটা এক বড়ো সন্তোষের ব্যাপার হচ্ছে সে যা, শুধু তা প্রদর্শন করাই একটা কিছু করা, এবং একটা কাজের বিকল্প রূপে মনে হওয়ার জন্যে, যেমন বলেছেন জর্জেৎ লেব্লা, এ-প্রদর্শনীর জন্যে দরকার পড়েযথেষ্ট পর্যেষণা ও দক্ষতা। একজন বড়ো অভিনেত্রীর লক্ষ্য আরো উচ্চ : তিনি বিদ্যমানকে প্রকাশ করতে গিয়ে বিদ্যমানকে অতিক্রম করে যাবেন; তিনি হবেন প্রকৃতই একজন শিল্পী, একজন স্রষ্টা, যিনি বিশ্বকে অর্থপূর্ণ করে অর্থপূর্ণ করেন নিজের জীবনকে।

তবে এসব অসাধারণ সুবিধা ফাঁদগুলো লুকিয়ে রাখে : তার আত্মরতিপরায়ণ আত্ম-প্রশ্রয় ও লৈঙ্গিক স্বাধীনতাকে তার শৈল্পিক জীবনের সঙ্গে সংহতিবিধানের বদলে অভিনেত্রী প্রায়ই ডুবে যায় আত্মপুজোয় বা নাগরালিতে; আমি ইতিমধ্যেই সে-সব ছদ্মশিল্পীদের কথা বলেছি, যারা চলচ্চিত্রে বা রঙ্গমঞ্চে নিজেদের জন্যে একটা নাম। করতে চায়, যা হয়ে ওঠে পুরুষের বাহুর ভেতরেশোষণের একটি পুঁজি। কর্মজীবনের ঝুঁকি ও সব ধরনের প্রকৃত কাজের নিয়মানুবর্তিতার তুলনায় অনেক বেশি প্রলোভন জাগায় পুরুষের পৃষ্ঠপোষকতার সুবিধা। নারীধর্মী নিয়তির বাসনা–স্বামী, গৃহ, সন্তান এবং প্রেমের মোহিনীশক্তির সঙ্গে সাফল্য লাভের ইচ্ছের সঙ্গতিবিধান সহজ নয়। তবে, সর্বোপরি, তার অহমিকার প্রতি তার মুগ্ধতাবোধ বহু ক্ষেত্রে সীমিত করে অভিনেত্রীর সাফল্যকে; তার সশরীরে উপস্থিতির মূল্য সম্পর্কে সে এতো বেশি মোহাচ্ছন্ন থাকে যে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাজকে মনে হয় নিরর্থক। সব কিছুর ওপরে সে ব্যস্ত থাকে জনগণের চোখের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে এবং রঙ্গমঞ্চীয় হাতুড়েপনার কাছে সে বলি দেয় সে-চরিত্রটিকে, যেটিকে সে ব্যাখ্যা করছে। তার অভাব আছে নিজেকে ভুলে থাকার সহৃদয়তার; সত্যিই দুর্লভ রাশেলরা, দুশেরা, যাঁরা এড়িয়ে যান এসব শৈলশিরা এবং শিল্পকলার মধ্যে তাঁদের অহমিকার একটি সেবককে দেখার বদলে তারা তাদের দেহকে করে তোলেন শিল্পকলার হাতিয়ার। উপরন্তু, একটি নিকৃষ্ট অভিনেত্রী তার ব্যক্তিগত জীবনে অতিশায়িত করে তুলবে তার সমস্ত আত্মরতিপরায়ণ ত্রুটিগুলো : সে নিজেকে প্রদর্শন করবে অসার, বিরক্তিকর, নাটকীয়ভাবে; সে সমগ্র বিশ্বকে গণ্য করবে একটি রঙ্গমঞ্চ।

আজকাল অভিনয়কলাই শুধু উন্মুক্ত নয় নারীর সামনে; অনেকেই চালাচ্ছে বিচিত্র ধরনের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের প্রচেষ্টা। নারীর পরিস্থিতি নারীকে প্রবৃত্ত করে সাহিত্য ও শিল্পকলায় নিজের পরিত্রাণ খুঁজতে। পুরুষের জগতের প্রান্তিক অবস্থানে বাস করে সে একে এর বিশ্বজনীন রূপে দেখতে পায় না, দেখে তার বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে। তার কাছে এটা হাতিয়ার ও ধারণার একত্রীভবন নয়, বরং এটা ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও আবেগের এক উৎস; বিভিন্ন বস্তুর গুণাবলির প্রতি সে আকৃষ্ট হয় ওই সব বস্তুর ভিত্তিহীন ও গুপ্ত উপাদান দ্বারা। একটা নেতিবাচক ও অস্বীকারের মনোভাব গ্রহণ করে সে আসল বস্তুতে নিবিষ্ট হয় না : সে প্রতিবাদ করে এর বিরুদ্ধে, শব্দ দিয়ে। প্রকৃতির ভেতর দিয়ে সে খোঁজে তার আত্মার প্রতিমা, সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে স্বল্পপ্রয়াণে, সে অর্জন করতে চায়তার সত্তা–কিন্তু সে হয় হতাশাগ্রস্ত; সে এটা ফিরে পেতে পারে শুধু কল্পনার রাজ্যে। একটি আন্তর জীবন, যার কোনো ব্যবহার্য লক্ষ্য নেই, সেটিকে শূন্যতায় ডুবে যাওয়া থেকে নিবৃত করতে, দুর্দমনীয়ভাবে সে সহ্য করে যে-বিদ্যমান। অবস্থা, তার বিরুদ্ধে নিজেকে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করার জন্যে, যে-বিশ্বে তার সত্তা সে চরিতার্থ করতে পারে না, তার থেকে ভিন্ন একটি বিশ্ব সৃষ্টি করতে গিয়ে, তাকে আশ্রয় নিতে হয় আত্ম-প্রকাশের। তারপরও, সকলেই জানে যে সে এক অনর্থক বকবককারী ও হিজিবিজিলেখক; কথোপকথনে, চিঠিপত্রে, অন্তরঙ্গ দিনপঞ্জিতে সে খুলে ধরে নিজের বক্ষ। একটু উচ্চাভিলাষ থাকলে সে শুরু করবে স্মৃতিকথা লেখা, তার জীবনীকে পরিণত করবে উপন্যাসে, কবিতায় সে প্রকাশ করবে তার অনুভূতি। যেবিপুল অবকাশ সে উপভোগ করে, তা এসব কর্মকাণ্ডের অনুকূল।

তবে যে-পরিস্থিতিগুলো নারীকে সৃষ্টিশীল কাজে প্রবৃত্ত করে, সেগুলোই হয়ে ওঠে এমন বাধা, যা কাটিয়ে উঠতে নারী প্রায়ই অসমর্থ হয়। যখন সে শুধু তার কর্মহীন দিনগুলোকে ভরেতোলার জন্যে ছবি আঁকার বা লেখার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ছবি আঁকা বা লেখাকে গণ্য করা হবে শখের কাজ বলে; সে ওগুলোর প্রতি বিশেষ সময় ও যত্ন নিয়োগ করবে না, এবং ওগুলো হবে একই মূল্যের। প্রায়ই ঋতুবিরতির সময় তার অস্তিত্বের ক্রটির ক্ষতিপূরণ করার জন্যে নারী স্থির করে হাতে তুলি বা কলম। তুলে নেয়া; তবে তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে, এবং সনিষ্ঠ প্রশিক্ষণের অভাবে সে কখনোই একটি আনাড়ির বেশি কিছু হবে না। এমনকি সে যখন বেশ আগেই শুরু করে, তখনও কদাচিৎ সে শিল্পকলাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে কল্পনা করে; আলস্যে অভ্যস্ত হয়ে, তার জীবনের ধরনের মধ্যে কখনো কঠোর নিয়মানুবর্তিতার আবশ্যকতা বোধ না করে, সে কখনোই অব্যাহত ও অটল উদ্যোগ গ্রহণে সমর্থ হবে, সে কখনো একটি সুষম কৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হবে না। সে বীতস্পৃহ হয়ে ওঠে সে-কাজের প্রতি, যাতে নিরর্থকভাবে, নিঃসঙ্গ অন্ধের মতো হাতড়ে ফিরতে হয়, যে-কাজ কখনো দিনের আলো দেখতে পায় না, যা অবশ্যই নষ্ট করতে হবে এবং শত বার সম্পন্ন করতে হবে; অন্যদের খুশি করার জন্যে শৈশব থেকে যেমন তাকে শেখানো হয়েছে ছলচাতুরি করতে, তেমনি সে উতরে যেতে চায় কিছু কৌশল প্রয়োগ করে। মারি বাশকিসেভ স্বীকার করেন ঠিক এটাই : হ্যা, আমি কখনো ছবি আঁকার কষ্ট স্বীকার করি না। আমি আজ নিজেকে দেখেছি। আমি ঠকাই। নারী কাজ কাজ খেলতে খুবই প্রত, কিন্তু সে কাজ করে না; অক্রিয়তার যাদুকরী গুণাবলিতে বিশ্বাসী হয়ে সে তালগোল পাকিয়ে ফেলে মন্ত্রোচ্চারণ ও কর্মের মধ্যে, প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি ও কার্যকর আচরণের মধ্যে। সে চারুকলার ছাত্র হওয়ার ভান করে, সে নিজেকে সজ্জিত করে তুলির সাজসরঞ্জামে; কিন্তু যেই সে বসে ইজেলের সামনে, তার চোখ নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়ায় শাদা কাপড় থেকে তার আয়না পর্যন্ত; তবে ফুলের গুচ্ছটি বা আপেলের ডালাটি নিজেদের ইচ্ছেয় গিয়ে দেখা দেবে না চিত্রপটে। তার ডেস্কের সামনে বসে, তার অস্পষ্ট গল্পগুলোকে মনে মনে আন্দোলন করে, নারী উপভোগ করে এ-সহজ ভানটা যে সে লেখক: কিন্তু তাকে বাস্তবিকভাবে শাদা। কাগজের ওপর কাটতে হবে কালো দাগ, তাকে ওগুলোকে অন্যদের চোখের কাছে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হবে। তখনই ধরা পড়ে প্রতারণাটি। খুশি করার জন্যে মরীচিকা সৃষ্টি করাই যথেষ্ট; তবে শিল্পকলা কোনো মরীচিকা নয়, এটা এক কঠিন বস্তু; এটা রূপায়িত করার জন্যে জানতেকুর রীতিনীতি।

শুধু তার প্রতিভা ও মেজাজের কারণেই কলেৎ একজন মহৎ লেখক হয়ে ওঠেন নি; তাঁর কলম প্রায়ই হয়ে উঠেছে তার অবলম্বনের উপায়, এবং দক্ষ কারিগর যেমন তার হাতিয়ারের কাছে প্রত্যাশা করে ভালো কাজ, তিনিও এর কাছে চেয়েছেন একই রকম ভালো কাজ। ক্লদিন থেকে নেসাঁস দ্য জুর-এর মধ্যে শৌখিন লেখকটি হয়ে ওঠেন পেশাদার, এবং এ-ক্রান্তিকাল একটা কঠোর প্রশিক্ষণ পর্বের উপকারগুলো দীপ্তভাবে প্রদর্শন করে। তাদের যোগাযোগের বাসনা যে-সব সমস্যা উপস্থিত করে, অধিকাংশ নারী, অবশ্য, সেগুলো বুঝতে পারে না; এবং এর মূলে বেশির ভাগই আছে তাদের আলস্য। সব সময়ই তারা নিজেদের দত্ত বলে গণ্য করে; তারা মনে করে যে তাদের যোগ্যতা উৎসারিত হয় কোনো অন্তর্নিহিত বর থেকে এবং ভাবে না যে যোগ্যতাকে জয় করা যায়। প্রলুব্ধ করার জন্যে তারা জানে শুধু নিজেদের প্রদর্শনের রীতি; এতে তাদের মোহনীয়তা কাজ করে বা করে না, এর সাফল্য বা ব্যর্থতায় তাদের সত্যিকার কোনো হাত নেই। সদৃশ রীতিতে তারা অনুমান করে যে একজন কী, তা দেখানোই প্রকাশের জন্যে, যোগাযোগের জন্যে যথেষ্ট; ভাবনাচিন্তার সাহায্যে তাদের লেখাকে বিশদ করার বদলে তারা নির্ভর করে স্বতস্ফূর্ততার ওপর। লেখা ও মৃদুহাসি তাদের কাছে একই জিনিশ; তারা তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখে, সাফল্য আসবে বা আসবে না। যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয় যে বইটি বা চিত্রটি কোনোপ্রয়াস ছাড়াই সাফল্যমণ্ডিত হবে; যদি ভীরু হয়, তাদের সমালোচনায় তারা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। তারা জানে না যে একটা ভুল উন্মোচিত করে দিতে পারে অগ্রগতির পথ, ভুলকে তারা বিকলাঙ্গতার মতো অসংশোধনীয় মহাবিপর্যয় বলে গণ্য করে। এজন্যে তারা প্রায়ই দেখিয়ে থাকে একটা বিপর্যয়কর যুক্তিহীন অস্থিরতা : তারা তাদের ভুলগুলো থেকে লাভজনক শিক্ষা নেয়ার বদলে ভুলগুলোকে গ্রহণ করে বিরক্তি ও নিরুৎসাহের সঙ্গে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বতস্ফূর্ততা আয়ত্ত করা যতোটা সহজ বলে মনে হয় ততোটা সহজ নয় : গতানুগতিকের কূটাভাস হচ্ছে যে–যেমন ফ্ল্যর দ্য তারবেতে পলহা। ব্যাখ্যা করেছেন–মন্ময় বোধের সরাসরি উপস্থাপনের সঙ্গে একে প্রায়ই তালগোল পাকিয়ে তোলা হয়। তাই একজন হবু-লেখিকা, অন্যদের গোণার মধ্যে না ধরে, যেমুহূর্তে মনে করে যে তার নিজের মনে যে-ছবিটি গড়েউঠেছে, সেটি সে উপস্থাপন করেছে অতিশয় মৌলিকভাবে, তখন সে আসলে একটা মামুলি অতিব্যবহৃত বুলি পুনরুদ্ভাবনের বেশি কিছু করে না। কেউ তাকে একথা বললে সে বিস্মিত হয়; সে। অস্থির হয়ে ওঠে ও তার কলম ছুঁড়ে ফেলে দেয়; সে এটা বোঝে না যে জনগণ পড়ে চোখ ও ভাবনাকে অন্তর্মুখি করে এবং সামগ্রিকভাবে কম টাটকা একটা প্রকাশভঙ্গি মনে জাগিয়ে তুলতে পারে নানা প্রিয় স্মৃতি। নিজের মনের ভেতরে ছিপ ফেলে কিছু পাওয়া ও সেগুলোকে প্রাণবন্ত প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে ভাষার বাইরের স্তরে নিয়ে আসতে পারা সত্যিই এক বহুমূল্য সহজাত ক্ষমতা। আমরা শ্রদ্ধা করি কলেতের স্বতস্ফূর্ততাকে, যা কোনো পুরুষ লেখকের মধ্যে দেখা যায় না; তবে তার মধ্যে আমরা পাই এক সুচিন্তিত স্বতস্ফূর্ততা–যদিও এ-দুটি শব্দকে পরস্পরবিরোধী মনে হয়। তিনি তার বিষয়ের কিছু রাখেন এবং বাকি সবসময়ই জেনে-শুনে বাদ দেন। আনাড়ি লেখিকা শব্দকে আন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগের, অন্যদের অনুভূতিতে নাড়া দেয়ার একটি উপায় বলে গণ্য না করে তার নিজের অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশ বলে গণ্য করে; বাছাই করা, মুছে ফেলাকে তার কাছে তার নিজের একটি অংশকে ত্যাজ্য করা বলে মনে হয়; সে তার শব্দরাশির কোনোটিকেই ত্যাগ করতে চায়না, এটা যুগপৎ এজন্যে যে সে যা, তা নিয়েই সে সন্তষ্ট এবং এ-কারণে যে অন্য কিছু হওয়ার কোনো আশা তার নেই। তার বন্ধ্যা অহমিকা উদ্ভূত হয় এ-ঘটনা থেকে যে সে অত্যন্ত ভালোবাসে নিজেকে, নিজেকে বিশ্লেষণের সাহস না করে।

সুতরাং, যে-নারীবাহিনী শিল্পসাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করে, তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই অধ্যবসায়ী হয়; এবং এমনকি যারা পেরিয়ে যান এ-প্রথম বাধা, তারাও প্রায়ই ছিন্নভিন্ন হন তাঁদের আত্মরতি ও হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষার মধ্যে। নিজেদের ভুলে। যাওয়ার অসামর্থ্য এমন এক ক্রটি, যা অন্যান্য পেশার নারীদের ওপর যতোটা চেপে থাকে, তাদের ওপর চেপে থাকে অনেক বেশি; যদি সত্তার বিমূর্ত সুনিশ্চিত ঘোষণা, সাফল্যের আনুষ্ঠানিক সন্তোষ হয় তাদের মূল লক্ষ্য, তাহলে তারা বিশ্ব সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনায় নিজেদের নিয়োজিত করবেন না : তারা একে পুনসৃষ্টি করতে অসমর্থ হবেন শিল্পকলায়। মারি বাশকির্তসেভ ছবি আঁকবেন বলে ঠিক করেন, কেননা তিনি বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন; তার খ্যাতির আবেশ এসে দাঁড়ায় তার ও বাস্তবতার মাঝখানে। তিনি আসলে ছবি আঁকা পছন্দ করেন না : শিল্পকলা একটা উপায় মাত্র; তাঁর উচ্চাভিলাষী ও শূন্যগর্ভ স্বপ্নগুলো একটি রঙের বা মুখের তাৎপর্য প্রকাশ করবে তাঁর কাছে। নারী যে-কাজের ভার নেয়, তাতে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার বদলে প্রায়ই সে একে মনে করে তার জীবনের নিতান্ত একটা অলঙ্করণ, বই বা চিত্র হচ্ছে জনগণের কাছে সে-অপরিহার্য সত্য প্রদর্শনের পরিহার্য উপায় : তার নিজের সত্তা। উপরন্তু, তার নিজের সত্তাই তার আগ্রহের প্রধান–অনেক সময় অনন্য–বিষয় : মাদাম ভিগি-ব্ৰুে কখনোই তার মৃদুহাস্যরত মাতৃত্বকে তাঁর চিত্রপটে উপস্থাপনে ক্লান্ত হন নি। কোনোলেখিকা যখন সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা বলেন, তখনও তিনি নিজের। সম্পর্কেই কথা বলেন : লেখিকার দেহগঠন ও অত্যধিক মাংসলতা, তার চুলের রঙ, এবং তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে না জেনে কারো পক্ষে কোনো কোনো নাটকীয় মন্তব্য পড়া সম্ভব নয়।

একথা সত্য, অহং সব সময়ই কদর্য নয়। কিছু স্বীকারোক্তির থেকে বেশি চাঞ্চল্যকর বই কমই আছে, তবে ওগুলোকে সৎ হতে হবে, এবং স্বীকারোক্তির মতো কিছু থাকতে হবে লেখকের। নারীর আত্মরতি তাকে সমৃদ্ধ করার বদলে দীনতর করে তোলে; কিছু না করে শুধু নিজের ধ্যান করে নারী নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে; এমনকি তার আত্মপ্রেমও ছকবাঁধা : তার লেখায়সে অকৃত্রিম অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে না, বরং প্রকাশ করে গতানুগতিক বুলিতে তৈরি এক কাল্পনিক মূর্তি। কনস্ট্যান্ট বা তেঁদাল যেভাবে করেছেন, সেচাবে সে যদি নিজেকে প্রক্ষেপ করে তার উপন্যাসে, তাহলে কেউ তাকে তিরস্কার করতে পারে না; কিন্তু বিপদ এখানে যে সে নিজেও প্রায়ই তার ইতিহাসকে দেখে একটা নির্বোধ রূপকথারূপে। কল্পনার সহায়তায় অল্পবয়স্ক মেয়ে নিজের কাছে গোপন করে রাখে সে-বাস্তবতা, যার স্থূলতায় সে সন্ত্রস্ত বোধ করে, তবে এটা শোচনীয় যে যখন সে নারী হয়ে ওঠে তখনও সে বিশ্বকে, তার চরিত্রগুলোকে এবং নিজেকে নিমজ্জিত করে কাব্যিক কুয়াশায়। যখন এ-ছদ্মবেশের ভেতর থেকে সত্য প্রকাশ পায়, তখন কখনো কখনো অর্জিত হয় আনন্দদায়ক ফল: তবে তখনও একটি ডাস্টি অ্যান্ডার ও একটি কনস্ট্যান্ট নিম্ফ-এর জায়গায় পাওয়া যায় কতোশতো নিষ্প্রভ ও নিষ্প্রাণ পলায়নের উপন্যাস।

নারীর জন্যে খুবই স্বাভাবিক যে সে পালানোর উদ্যোগ নেবে এ-বিশ্ব থেকে, যেখানে সে প্রায়ই বোধ করে যে তাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে ও ভুল বোঝা হচ্ছে; তবে আক্ষেপের কথা হচ্ছে সে একজন জেরার দ্য নেভাল, একজন এডগার অ্যালান পোর মতো দুঃসাহসী পলায়নের ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ নেয় না। তার ভীরুতার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। খুশি করাই হচ্ছে তার প্রথম কাজ; এবং প্রায়ই সে ভয় পায় যে সে লেখে, শুধু এ-কারণেই নারী হিশেবে সে বিরক্তিকর হয়ে উঠবে; নীলমুজো অভিধাটি, যদিও নিরর্থক হয়ে উঠেছে, তবু এটা এক অপ্রীতিকর দ্যোতনা জ্ঞাপন করে চলছে; এছাড়া, লেখক হিশেবে বিরক্তিকর হওয়ার সাহস তার নেই। মৌলিকত্বসম্পন্ন লেখক, যদি মৃত না হয়, সব সময়ই অতি জঘন্য, কলঙ্ককর; অভিনবত্ব বিঘ্ন সৃষ্টি করে ও বীতস্পৃহা জাগায়। চিন্তার জগতে, শিল্পকলার জগতে–একটি পুরুষের জগতে প্রবেশ করে নারী আজো বিস্ময় ও শ্লাঘা বোধ করে। সে সুশীলতম আচরণ করে; সে ভয় পস বিশৃঙ্খলা ঘটাতে, অনুসন্ধান করতে, ফেটে পড়তে; সে মনে করে তার সাহিত্যিক অভিমানের জন্যে সে মার্জনা চেয়ে নেবে তার বিনয় ও সুরুচির সাহায্যে। সে ভরসা করে প্রথাগত রীতি অনুসরণের নিশ্চিত মূল্যের ওপর; সাহিত্যকে সে ঠিকঠাকভাবে দান করে সে-সব ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, যা তার কাছে প্রত্যাশা করা হয়, যা আমাদের মনে পড়িয়ে দেবে যে সে নারী, যার আছে সুচয়িত কিছু সৌষ্ঠব, মেকি আচরণ, ও কৃত্রিমতা। এসবই তাকে সাহায্য করে বেস্ট-সেলার উৎপাদনে অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে; কিন্তু আমরা তার কাছে বিস্ময়কর পথে দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় বেরিয়ে পড়ার আশা করবো না।

এমন নয় যে এ-স্বাধীন নারীদের আচরণ বা অনুভূতির মধ্যে মৌলিকত্বের অভাব আছে; বরং, তাদের অনেকে এতো অসাধারণ যে তাদের তালাবদ্ধ করে রাখা উচিত; সব মিলিয়ে, তাদের মধ্যে আছে বহু, যারা অনেক বেশি খামখেয়ালপূর্ণ, অনেক বেশি বাতিকগ্রস্ত পুরুষদের থেকে, যাদের শৃঙ্খলা তারা প্রত্যাখ্যান করে। তবে তাদের জীবনপদ্ধতিতে, কথোপকথনে, ও চিঠিপত্রে তারা তাদের প্রতিকাকে প্রয়োগ করে অস্বাভাবিকতার কাজে; যদি তারা লিখতে শুরু করে, তাহলে তারা অভিভূত হয়ে পড়ে সংস্কৃতির বিশ্ব দিয়ে, কেননা এটা পুরুষের বিশ্ব, সুতরাং তারা পারে শুধুতোতলাতে। অন্য দিকে, নিজেকে প্রকাশের জন্যে যে-নারী পুরুষের কলাকৌশল অনুযায়ী বেছে নিতে চায় যুক্তি, সে শ্বাসরোধ করে তুলবে সে-সে-মৌলিকত্বের, যাকে অবিশ্বাস করার তার কারণ আছে; ছাত্রীর মতো, তার আছে পড়ুয়া ও পণ্ডিতসুলভ হওয়ার প্রবণতা; সে অনুকরণ করবে পুরুষের কঠোরতা ও বলিষ্ঠতার। সে হয়ে উঠতে পারে একজন চমৎকার তাত্ত্বিক, আয়ত্ত করতে পাতে প্রকৃত যোগ্যতা; তবে সে বাধ্য হবে তার মধ্যে ভিন্ন যা-কিছু আছে, তা অস্বীকার করতে। বহু নারী আছে, যারা পাগল এবং যুক্তিনির্ভর ধরনের নারী আছে বহু; এমন কেউ নেই, যার ধরনের মধ্যে আছে সেই পাগলামো, যাকে আমরা বলি প্রতিভা।

সর্বোপরি, এ-যুক্তিযুক্ত পরিমিতিবোধই এ-পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে নারীপ্রতিভার সীমা। বহু নারী এড়িয়ে গেছে এবং এখন উত্তরোত্তর এড়িয়ে যাচ্ছে–আত্মরতি ও ভ্রান্ত যাদুর ফাঁদ; কিন্তু বিদ্যমান বিশ্বের বাইরে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টায় কেউই কখনো সমস্ত বিমৃষ্যকারিতাকে পায়ে মাড়িয়ে যায় নি। প্রথমে, অবশ্যই আছে অনেকে, যারা সমাজ যেমন আছে তেমনভাবেই মেনে নেয়; তাদের মধ্যে বুর্জোয়াধারার মহিলা কবিরা সর্বপ্রধান, কেননা এ-হুমকিগ্রস্ত সমাজের সবচেয়ে রক্ষণশীল উপাদানের তারা প্রতিনিধিত্ব করেন। সুনির্বাচিত বিশেষণের সাহায্যে তাঁরা মনে জাগিয়ে তোলেন এমন এক সমাজের পরিশীলনের কথা, যাকে নির্দেশ করা হয় ‘উৎকর্ষ’-এর সভ্যতা বলে; তাঁরা মহিমান্বিত করেন কল্যাণের মধ্যবিত্তসুলভ আদর্শকে এবং কাব্যিক রঙ চড়িয়ে তারা ঢেকে রাখেন তাদের শ্রেণীর স্বার্থকে; তারা সংযোগ করেন সে-মহারহস্যীকরণের সুর, যার লক্ষ্য নারীকে ‘নারীধর্মী থাকতে’ প্ররোচিত করা। প্রাচীন গৃহ, ভেড়ার খোয়াড় ও শক্তি বাগান, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বুড়োরা, পাজি শিশুরা, ধােয়া, সংরক্ষণ, পারিবারিক উৎসব, প্রসাধন, বসার ঘর, বলনাচ, অসুখী তবে আদর্শ স্ত্রীরা, ভক্তি ও ত্যাগের সৌন্দর্য, দাম্পত্য প্রেমের ছোটোখাটো দুঃখ ও বিরাট সুখ, যৌবনের স্বপ্ন, বার্ধক্যের দাবিত্যাগ–ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার নারী ঔপন্যাসিকেরা এসব বিষয় ব্যবহার করেছেন তলানি পর্যন্ত; এভাবে তারা খ্যাতি ও অর্থ লাভ করেছেন, তবে নিশ্চিতভাবেই আমাদের বিশ্বদৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করেন নি।

অনেক বেশি আকর্ষণীয় সে-সব বিদ্রোহী নারীরা, যারা দ্বন্দ্বে আহ্বান করেছেন এঅসৎ সমাজকে; প্রতিবাদের সাহিত্য জন্ম দিতে পারে আন্তরিক ও শক্তিশালী গ্রন্থ; তার বিদ্রোহের উৎস থেকে জর্জ এলিয়ট এঁকেছেন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের রূপ, যা একই সঙ্গে অনুপুঙ্খ ও নাটকীয়; তবে, ভার্জিনিয়া উ যেমন দেখিয়েছেন আমাদের, জেইন অস্টিনকে, ব্রোন্টি বোেনদের, জর্জ এলিয়টকে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্যে নেতিবাচকভাবে এতোটা শক্তি ব্যয় করতে হয় যে তাঁদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে সে-স্তরে পৌছোতে, যেখানে থেকে মহাপরিসরসম্পন্ন পুরুষ লেখকেরা শুরু করেন যাত্রা; তাঁদের বিজয়ে লাভবান হওয়ার এবং যে-সব রজু তাঁদের বেঁধে রেখেছে, সেগুলো ঘেঁড়ার মতো যথেষ্ট শক্তি আর তাদের অবশিষ্ট থাকে না। তাঁদের মধ্যে আমরা পাই না, উদাহরণস্বরূপ, একজন স্তেদালের বক্রাঘাত, সাবলীলতা, তার প্রশান্ত আন্তরিকতাও পাই না। তাঁদের ছিলো না একজন দস্তোয়েভস্কির, একজন তলস্তয়ের অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধিও : এটাই ব্যাখ্যা করে চমৎকার মিডলমার্চ কেনো ওয়ার অ্যান্ড পিস-এর সমতুল্য নয়; তার মহিমা সত্ত্বেও কেনো উদারিং হাইটস-এ নেই দি ব্রাদার্স কারামাজোভ-এর নিরন্তর অব্যাহত প্রবাহ।

সে-পুরুষদেরই আমরা মহৎ বলি, যারা–একভাবে বা অন্যভাবে নিজেদের কাঁধে নিয়েছে বিশ্বের ভার; তারা উৎকৃষ্টতর কাজ করেছেন বা নিকৃষ্ট কাজ করেছেন; তাঁরা একে পুনসৃষ্টি করতে সফুল হয়েছেন বা ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু প্রথমে তারা ধারণ করেছেন ওই বিপুল ভার। এটাই সে-কাজ, যা কোনো নারী কখনো করে নি, যা তারা কেউ করতে পারে নি। বিশ্বকে নিজের বলে গণ্য করা, এর ত্রুটিগুলোর জন্যে নিজেকে দোষী করা এবং এর অগ্রগতির জন্যে নিজে গৌরব বোধ করার জন্যে তাকে অন্তর্ভুক্ত হতে হয় সুবিধাপ্রাপ্ত বর্ণের; বিশ্বকে বদলে দিয়ে, এর সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে, একে উঘাটিতে করে এর যাথার্থ প্রতিপাদন শুধু তাদেরই দায়িত্ব, যারা আছে কর্তৃত্বে; শুধু তারাই নিজেদের চিনতে পারে এর ভেতরে এবং প্রয়াস চালাতে পারে এখানে বিখ্যাত হওয়ার। এ পর্যন্ত মানুষের পক্ষে নিজেকে মূর্ত করা সম্ভব হয়েছে পুরুষের মধ্যে, নারীর মধ্যে নয়। কেননা যে-ব্যক্তিদের আমাদের অসাধারণ মনে হয়, যদের প্রতিভা নামে সম্মান করা হয়, তারা হচ্ছেন সে-সব পুরুষ, যারা চেয়েছেন সমগ্র মানবমণ্ডলির ভাগ্য নিজেদের ব্যক্তিগত অস্তিত্বের মধ্যে রূপায়িত করতে, এবং কোনো নারীই বিশ্বাস করে নি যে এটা করার অধিকার তার আছে।

কী করে ভ্যান গগ জন্ম নিতে পারতেন নারীরূপে? কোনো নারীকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হতো না বোরিনাজে বেলজিয়ামের কয়লা খনিতে, তাই সে কখনোই খনিশ্রমিকদের দুর্দশাকেবোধ করতো না নিজের অপরাধ বলে, সে চাই তো না পরিত্রাণ; সুতরাং সে কখনো আঁকতো না ভ্যান গগের সূর্যমুখি। উল্লেখ করার দরকার নেই যে ওই চিত্রকরের জীবনপদ্ধতি–আর্লেতে তাঁর নিঃসঙ্গতা, কাফেতে ও বেশ্যালয়ে তার ঘন ঘন যাতায়াত, যা কিছু ভ্যান গগের সংবেদনশীলতাকে পুষ্ট করে পুষ্ট করেছে তার চিত্রকলাকে–নিষিদ্ধ হতো তার জন্যে। কোনো নারী কখনোই হতেপারতো না কাফকা : তার সন্দেহ ও তার উদ্বেগের মধ্যে সে কখনোই বুঝতে পারতো স্বর্গচুত মানুষের নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা। সেইন্ট তেরেসা ছাড়া কদাচিৎ আছে এমন নারী, যে সম্পূর্ণ পরিত্যাগের মধ্যে পেরিয়ে গেছে মানুষের পরিস্থিতি : আমরা দেখেছি কেনো। পার্থিব স্তরক্ৰমের বাইরে তার অবস্থান গ্রহণ করে, ক্রুশের সেইন্ট জনের মততা, তিনি নিজের মাথার ওপর কোনোআশ্বাসদায়ক চালের উপস্থিতি অনুভব করেন নি। উভয়ের জন্যেই ছিলো একই অন্ধকার, একই আলোর ঝলকানি, সত্তায়। একই শূন্যতা, বিধাতায় একই প্রাচুর্য। যখন অবশেষে প্রতিটি মানুষের পক্ষে, স্বাধীন অস্তিত্বের শ্রমসাধ্য মহিমায়, সম্ভব হবে তার গর্বকে লৈঙ্গিক বৈষম্যের বাইরে স্থাপন। করতে, তখনই শুধু নারী সমর্থ হবে তার ব্যক্তিগত ইতিহাসকে, তার সমস্যাগুলোকে, তার সন্দেহগুলোকে সমগ্র মানবমণ্ডলির ইতিহাস, সমস্যা, সন্দেহের সঙ্গে অভিন্ন করে বুঝতে; তখনই শুধু সে সমর্থ হবে তার জীবন ও কর্মের মধ্যে শুধু তার ব্যক্তিগত সত্তাকে নয়, সমগ্র বাস্তবতাকে প্রকাশ করতে। যতো কাল তাকে মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে সংগ্রাম করতে হবে, ততো কাল সে স্রষ্টা হয়ে উঠতে পারবে না।

আর একবার, নারীর সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যার জন্যে আবাহন করতে হবে নারীর পরিস্থিতিকে, কোনো রহস্যময় সারসত্তাকে নয়; তাই ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই উনুক্ত। এ-বিষয়ের লেখকেরা পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অটলভাবে মত পোষণ করেন যে নারীদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা নেই; এ-তত্ত্বই সমর্থন করেছেন মাদাম মার্থে বোরেলি, এক কুখ্যাত নারীবাদবিরোধী; তবে বলা যায় তার বইগুলো এতো স্ববিরোধী যে তিনি ওগুলোকে করে তুলতে চেয়েছেন নারীসুলভ অযৌক্তিকতা ও নির্বুদ্ধিতার জীবন্ত প্রমাণ। এছাড়াও, ‘নারী চিরন্তনী’ ধারণাটির মতোই, সত্যিকার অস্তিত্বশীল বস্তুর পুরোনো তালিকা থেকে, বর্জন করতে হবে সৃষ্টিশীল সহজাত প্রবৃত্তির ধারণাটি। কিছু কিছু নারীবিদ্বেষী জোরের সঙ্গে, কিছুটা বেশি সুনির্দিষ্টভাবে, ঘোষণা করেন নারী, যেহেতু স্নায়ুবৈকল্যগ্রস্ত, মূল্যবান কিছু সৃষ্টি করতে পারে না; তবে প্রায়ই ওই একই লোকেরা প্রতিভাকে এক ধরনের স্নায়ুবৈকল্য বলে ঘোষণা করেন। তা যা-ই হোক, প্রস্তের উদাহরণ স্পষ্টভাবে দেখায় যে মনোশারীরিক ভারসাম্যহীনতা ক্ষমতার। অভাবও দ্যোতনা করে না, মাঝারিত্বও দ্যোতনা করে না।

ইতিহাস থেকে নেয়া যুক্তিটির কথা বলতে গেলে, ওইটি সম্পর্কে কী মনে করবো আমরা ঠিক তা-ই বিবেচনা করছিলাম; ঐতিহাসিক সত্য কোনো চিরন্তন সত্য প্রতিষ্ঠা করে না; এটা নির্দেশ করতে পারে শুধু একটা পরিস্থিতি, যা ঐতিহাসিক প্রকৃতির, বিশেষ করে এ-কারণে যে এটা এখন বদলে যাচ্ছে। কী করে কখনো থাকতে পারতো নারীর প্রতিভা, যখন তাদের কোনোপ্রতিভাজাত শিল্পকর্ম বা শুধুই একটি শিল্পকর্ম–সম্পন্ন করার সমস্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে? প্রাচীন ইউরোপ আগেকার দিনে ঘৃণা ঢেলে দিতে মার্কিন বর্বরদের ওপর, গর্ব করার মতোযাদের কোনো চিত্রকরও ছিলো না লেখকও ছিলো না। আমাদের অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রমাণ করার আগে আমাদের অস্তিত্বশীল হতে দাও, জেফারসন উত্তর দিয়েছেন, সত্যিকার অর্থে। কখনোএকজন হুইটম্যান বা একজন মেলভিল জন্ম দেয় নি বলে নিগ্রোদের তিরস্কার করে যে-জাতিশ্রেষ্ঠতাবাদীরা, নিগ্রোরা তাদের দেয় একই উত্তর। ফরাশি সর্বহারারাও উপস্থিত করতে পারে না রাসিন বা মালার্মের সঙ্গে তুলনীয় কোনো নাম।

মুক্ত নারী সবে মাত্র জন্ম নিচ্ছে; যখন সে জয় করবে নিজের মালিকানা তখনই হয়তো ফলবে ব্র্যাবোর ভবিষ্যদ্বাণী : ‘কবিরা থাকবে! যখন নারীর অমিত দাসত্ব ভাঙবে, যখন সে নিজের জন্যে ও নিজের মাধ্যমে বাঁচবে, পুরুষ–এ-পর্যন্ত ঘৃণ্যতাকে মুক্তি দেবে, তখন সেও হবে কবি! নারী জানতে পাবে অজানাকে! তার ভাবনাগত বিশ্বগুলো কি ভিন্ন হবে আমাদেরগুলো থেকে? সে মুখোমুখি হবে অদ্ভুত, অতল, অনাকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক জিনিশের; আমরা তাদের গ্রহণ করবো, আমরা তাদের উপলব্ধি করবো’। এটা নিশ্চিত নয় যে তার ‘ভাবনাগত বিশ্বগুলো’ ভিন্ন হবে পুরুষেরগুলো থেকে, কেননা পুরুষের মতো একই পরিস্থিতি লাভ করার মাধ্যমেই সে পাবে মুক্তি; কতোটা মাত্রায় সে ভিন্ন থাকবে, এ-ভিন্নতাগুলো কতটা মাত্রায় রক্ষা করবে তাদের গুরুত্ব, সে-কথা বলা–এটা দুঃসাহসিক ভবিষদ্বাণীর ঝুঁকি নেয়া হবে বটে। যা নিশ্চিত, তা হচ্ছে এ-পর্যন্ত নারীর সম্ভাবনাগুলো নিরুদ্ধ করা হয়েছে এবং হারিয়ে গেছে মানবমণ্ডলির থেকে, এবং তার নিজের স্বার্থে এবং সকলের স্বার্থে তাকে তার সুযোগগুলো গ্রহণের অনুমতি দেয়ার এখখুনি সময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *