৫.৬ নারীর পরিস্থিতি ও চরিত্র

নারীর পরিস্থিতি ও চরিত্র
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৫ –পরিস্থিতি। 
পরিচ্ছেদ ৬

এখন আমরা বুঝতে পারছি গ্রিকদের থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত নারীর বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কেনো আছে এতো বেশি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বাহ্যিক কিছু পরিবর্তন সত্ত্বেও নারীর অবস্থা রয়ে গেছে একই, আর এ-অবস্থাই নির্ধারণ করে তা, যাকে বলা হয় নারীর চরিত্র; সে ‘সীমাবদ্ধতায় আনন্দ পায়’, সে বিপরীত। সে সতর্ক ও ক্ষুদ্র, তার কোনো তথ্যবোধ বা যথাযথতাবাধ নেই, তার। আছে নৈতিকতার অভাব, সে ঘুণ্য উপযোগিতাবাদী, সে মিথ্যে, নাটকীয়, স্বার্থান্বেষী ইত্যাদি। এর সব কিছুতেই আছে কিছুটা সত্যতা। তবে অবশ্যই আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে বিচিত্র যে-সব আচরণের বিবরণ পাওয়া গেছে, সেগুলো তার হরমোন কর্তৃক নারীর ওপর আরোপিত হয় নি বা নারীর মস্তিষ্কসংগঠনে সেগুলো পূর্বনির্ধারিত নয় : তার পরিস্থিতিই সেগুলোকে রূপ দিয়েছে ছাঁচে ঢালাই করার মতো করে। এপ্রেক্ষিতেই আমরা চেষ্টা করবো নারীর পরিস্থিতির ওপর একটি সমন্বিত জরিপের। এতে ঘটবে কিছুটা পুনরাবৃত্তি, তবে তার সামগ্রিক অর্থনীতিক, সামাজিক, ও। ঐতিহাসিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চিরন্তনী নারীকে বুঝতে এটা আমাদের সাহায্য করবে।

‘নারীর জগত’কে কখনো কখনো প্রতিতুলনা করা হয় পুরুষের বিশ্বের সাথে, তবে আমাদের আবার এর ওপর জোর দিতে হবে যে নারীরা কখনোই একটি বদ্ধ ও স্বাধীন সমাজ গঠন করে নি; তারা একটি অচ্ছেদ্য অংশ সে-গোষ্ঠির, যা শাসিত হয় পুরুষদের দ্বারা এবং যাতে তাদের আছে একটি অধস্তন স্থান। নিতান্ত সাদৃশ্যবশতই তারা মিলিত একটা যান্ত্রিক সংহতিতে, কিন্তু তাদের অভাব সে-জৈব সংহতির, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে প্রতিটি সংহত জনগোষ্ঠি; তাদের সব সময়ই দলবদ্ধ হতে বাধ্য করা হয়–যেমন করা হতো এলিউসিসের রহস্যের কালে তেমনি আজো ক্লাবে, সালয়, সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে একটা প্রতিপক্ষীয় সেবা গড়ে তোলার জন্যে, তবে তারা সব সময়ই এটা স্থাপন করে পুরুষের বিশ্বের কাঠামোর মধ্যেই। এজন্যেই ঘটে তাদের পরিস্থিতির স্ববিরোধ : তারা অচ্ছেদ্যভাবে ও একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত পুরুষের বিশ্বের এবং এমন এক এলাকার, যেখান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয় পুরুষের বিশ্বের বিপক্ষে; তাদের নিজেদের জগতে বন্দী হয়ে থেকে, অন্য জগত দিয়ে পরিবেষ্টিত থেকে, তারা কোথাও শান্তিতে স্থির হয়ে বসতে পারে না। তাদের। বশ্যতাকে সব সময়অবশ্যই খাপ খাওয়াতে হয় প্রত্যাখ্যান করার সাথে, তাদের প্রত্যাখ্যান করাকে খাপ খাওয়াতে হয় গ্রহণ করার সাথে, এ-ব্যাপারে তাদের মনোভাব অনেকটা তরুণী মেয়ের মনোভাবের মতো, তবে এটা রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন, কেননা প্রাপ্তবয়স্ক নারীর কাছে এটা নিতান্তই প্রতীকের মাধ্যমে জীবনের স্বপ্ন দেখার ব্যাপার নয়, বরং এটা বাস্তবিকভাবে যাপনের ব্যাপার।

নারী নিজেই মেনে নেয় যে সার্বিকভাবে বিশ্বটি পুরুষেরই; যারা এটিকে রূপায়িত করেছে, শাসন করেছে, এবং আজো এটির ওপর আধিপত্য করছে, তারা পুরুষ। তার দিক থেকে, সে নিজেকে এর জন্যে দায়ী মনে করে না; এটা সত্য যে সে নিকৃষ্ট ও পরনির্ভর; সে হিংস্রতার পাঠ নেয় নি, সে কখনো গোষ্ঠির অন্য সদস্যদের কাছে নিজেকে কর্তা হিশেবে দাঁড় করায় নি। তার মাংসে, তার গৃহে বন্দী থেকে মানুষের মুখাবয়বসম্পন্ন সে-দেবতাদের সামনে, যারা নির্দেশ করে লক্ষ্য ও প্রতিষ্ঠা করে মূল্যবোধ, সে নিজেকে দেখে অক্ৰিয়রূপে। এ-অর্থে সত্যতা আছে সে-প্রবাদের, যা। তাকে নির্দেশ করে ‘চিরশিশু’ বলে। শ্রমিকদের, কালো ক্রীতদাসদের, উপনিবেশের অধিবাসীদেরও–যতো দিন তারা ভীতিকর ছিলো না। বলা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক শিশু; এটা বোঝাতে যে অন্য মানুষদের প্রণীত শাশ্বত সত্য ও বিধিবিধান তাদের মেনে নিতে হবে বিনাপ্রতিবাদে। নারীর ভাগ্য হচ্ছে একটা সম্মানজনক আনুগত্য। এমনকি চিন্তাভাবনায়ও তার চারদিকের বাস্তবতার ওপর তার কোনো অধিকার নেই। তার চোখে এটা অনচ্ছ।

এবং একথা সত্য যে তার নেই প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, যা দিয়ে সে কর্তৃত্ব করতে পারতো পদার্থের ওপর। তার দিক থেকে সে পদার্থ দিয়ে অধিকার করে না, করে জীবন দিয়ে; এবং হাতিয়ার দিয়ে জীবনকে আয়ত্ত করা যায় না : মানুষ পারে শুধু এর গুপ্ত নিয়মের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে। নারীর কাছে বিশ্বকে তার ইচ্ছে ও তার লক্ষ্যের মাঝামাঝি ‘একটি হাতিয়ারের সন্নিবেশ’, যেমন একে সংজ্ঞায়িত করেছেন হাইডেগার, বলে মনে হয়না; এর বিপরীতে এটা এমন জিনিশ, যা একগুয়েভাবে প্রতিরোধক, অজেয়; এর ওপর আধিপত্য করে চরম বিপর্যয় ও এটি রহস্যময় চাপল্যে পরিপূর্ণ। একটি রক্তাপ্লুত স্ট্রোবেরির এ-রহস্য, যা মায়ের ভেতরে রূপান্তরিত হয় একটি মানুষে, এটা এমন এক রহস্য, যা কোনো গণিত সমীকরণরূপে প্রকাশ করতে পারে না, কোনো যন্ত্র একে ত্বরান্বিত বা বিলম্বিত করতে পারে না; নারী বোধ করে ধারাবাহিকতার এমন শক্তি, যা সবচেয়েউদ্ভাবনকুশল যন্ত্রপাতিও ভাগ বা গুণ করতে অসমর্থ; চান্দ্ৰস্পন্দনের দ্বারা আন্দোলিত হয়ে সে একে অনুভব করে নিজের দেহের ভেতরে; প্রথমে পেকে, তারপর পচে, বছরের পর বছর ধরে। প্রতিদিন রান্নাঘরটিও তাকে শেখায় ধৈর্য ও অক্রিয়তা; এখানে আছে রসায়ন; মেনে চলতে হয় আগুনকে, জলকে, অপেক্ষা করতে হয় চিনি গলার জন্যে, দলা ময়দার তাল ফুলে। ওঠার জন্যে। ঘরকন্নার কাজগুলো অনেকটা প্রযুক্তিগত কর্মপদ্ধতির কাছাকাছি, তবে নারীর কাছে যান্ত্রিক কার্যকারণ প্রমাণ করার জন্যে ওগুলো খুবই প্রারম্ভিক, অতি একঘেয়ে। এছাড়াও, এখানেও জিনিশপত্র চাপল্যপূর্ণ কিছু জিনিশ ধোলাই সহ্য করে কিছু সহ্য করে না, কিছু দাগ ওঠানোযায় কিছু লেগেই থাকে, কিছু জিনিশ নিজে থেকেই ভেঙে যায়, ধুলো গজিয়ে ওঠে উদ্ভিদের মতো।

নারীর মানসিকতা চিরস্থায়ী করে রাখে কৃষিসভ্যতার মানসিকতা, যে-সভ্যতাগুলো পুজো করতো ভূমির যাদুশক্তির : নারী বিশ্বাস করে যাদুতে। তার অক্রিয় কাম তার কামনাকে এমন রূপ দেয় যে তাতে কামকে তার কাছে ইচ্ছে ও আক্রমণ বলে মনে হয় না, বরং মনে হয় এক আকর্ষণ, যা সগোত্র সে-প্রক্রিয়ার, যার ফলে নিমজ্জিত হয় গণকের দণ্ড; তার মাংসের সামান্য উপস্থিতিতেই স্ফীত ও দৃঢ় হয়ে ওঠে পুরুষের লিঙ্গ; তাই গুপ্ত জলধারা কেনো কাপাবে না হেজেলের দণ্ডকে? সে অনুভব করে যে সে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে ঢেউ, বিকিরণ, অতীন্দ্রিয় তরল পদার্থ দিয়ে; সে বিশ্বাস করে টেলিপ্যাথিতে, জ্যোতিষশাস্ত্রে, রেডিওথেরাপিতে, সম্মােহনে, থিয়সফিতে, টেবিল-কাত করাতে, অলোকদৃষ্টিতে, বিশ্বাসের-জোরে-নিরাময়কারীতে; তার ধর্ম আদিম কুসংস্কারে পরিপূর্ণ : মোমবাতি, উত্তরদত্ত প্রার্থনা; সে বিশ্বাস করে সন্তরা হচ্ছে প্রকৃতির প্রাচীন চেতনারাশির মূর্তরূপ : এটি রক্ষা করে ভ্রমণকারীদের, এটি রক্ষা করে প্রসূতিকে, অন্য একটি ফিরিয়ে দেয় হারানো জিনিশ, এবং কোনো মহাশ্চর্য বস্তুই তাকে বিস্মিত করতে পারে না। তার মনোভাব যাদু ও প্রার্থনার; বিশেষ ফল লাভের জন্যে সে পালন করে বিশেষ ধরনের পরীক্ষিত ব্ৰতানুষ্ঠান।

কেননা নারীরা শক্তভাবে লেগে থাকে নিত্যনৈমিত্তিকতায়, তা বোঝা বেশ সহজ; তার কাছে সময়ের মধ্যে বিশেষ অভিনবত্বের ব্যাপার নেই, এটা সৃষ্টিশীল প্রবাহ নয়; সে যেহেতু পুনরাবৃত্তিতে দণ্ডিত, ভবিষ্যতের মধ্যে সে দেখতে পায় শুধু অতীতের প্রতিলিপিকরণ। যদি জানা যায় শব্দ ও সূত্র, তাহলে কালের ব্যাপ্তি সম্পর্কিত হয় উর্বরতার শক্তির সাথে–তবে এটা নিজেই নিয়ন্ত্রিত হয় মাস ও ঋতুর ছন্দোস্পন্দ দিয়ে; গর্ভধারণের, ফুল ফোটার প্রতিটি চক্র যথাযথভাবে পুনরাবৃত্তি করে পূর্ববর্তী চক্রটির। চক্রবর্তনশীল প্রপঞ্চের এ-খেলায় সময়ের একান্ত কাজ হচ্ছে ধীরভাবে বিনাশ করা; এটা যেমন নষ্ট করে আসবাবপত্র ও পোশাকপরিচ্ছদ, তেমনি এটা নষ্ট করে মুখমণ্ডল; বছরের পর বছর কাটার সঙ্গে ধীরেধীরে ধ্বংস হয় প্রজননের শক্তি। তাই নারী এই নিরন্তর ধ্বংসের শক্তির ওপর কোনো আস্থা রাখে না।

প্রকৃত কর্ম কী এবং কীভাবে বদলানো যায় বিশ্বের মুখমণ্ডল, সে-সম্পর্কে সে শুধু অজ্ঞই নয়, সে এমনভাবে লীন হয়ে আছে বিশ্বের মাঝে যেনো সে আছে এক বিপুল, অস্পষ্ট নীহারিকার মর্মলোকে। পুরুষের যুক্তি প্রয়োগের সাথে সে পরিচিত নয়। পুরুষের বিশ্বে তার চিন্তাভাবনা কোনো কর্মোদ্যোগের দিকে এগোয় না, কেননা সে কিছুই করে না, তাই তার চিন্তাভাবনাকে দিবাস্বপ্নের থেকে পৃথক করা যায় না। কার্যকারিতার অভাবে বাস্তব সত্য সম্পর্কে তার ধারণা নেই; শব্দ ও মানসচিত্র ছাড়া আর কিছু দিয়ে সে অনুধাবন করে না, এজন্যেই অতিশয় বিপরীতধর্মী দাবিগুলোও তাকে কোনো অস্বস্তি দেয় না; যা সব দিক দিয়েই তার শক্তির সীমার বাইরে, তেমন এলাকার রহস্য ব্যাখ্যা করার জন্যে সে সামান্যও চেষ্টা করে না। তার অভীষ্টের জন্যে চূড়ান্ত অস্বচ্ছ ধারণা নিয়েই সে তৃপ্ত, সে গুলিয়ে ফেলে দল, মতামত, স্থান, ব্যক্তি, ঘটনা; তার মাথা ভরাট অদ্ভুত তালগোল পাকানো বস্তুতে।

তবে, সব সত্ত্বেও, সুস্পষ্টভাবে কিছু দেখা তো তার কাজ নয়, কেননা তাকে শেখানো হয়েছে পুরুষের কর্তৃত্ব মেনে নিতে। তাই সে ছেড়ে দেয় নিজে সমালোচনা করা, অনুসন্ধান করা, বিচার করা, এবং এসব ছেড়েদেয় উৎকৃষ্টতর বর্ণের ওপর। তাই পুরুষের বিশ্বকে তার কাছে মনে হয় এক সীমাতিক্রান্ত সত্য, এক ধ্রুব বস্তু। ‘পুরুষ দেবতা তৈরি করে,’ ফ্রেজার বলেন, ‘তাদের পুজো করে নারীরা’। পুরুষ যেসব মূর্তি তৈরি করেছে, সেগুলোর সামনে তারা পূর্ণ বিশ্বাসে নতজানু হতে পারে না; কিন্তু নারীরা যখন রাস্তায় মুখোমুখি হয় এসব শক্তিশালী মূর্তির, তারা মনে করে এগুলো হাত দিয়ে তৈরি করা হয় নি, এবং বাধ্যতার সাথে নত করে মাথা। বিশেষ করে নেতার মধ্যে তারা মূর্ত দেখতে চায় শৃঙ্খলা ও অধিকার। প্রত্যেক অলিম্পাসেই আছে একটি পরম দেবতা; পুরুষের ঐন্দ্রজালিক সারসত্তা সংহত হতে হবে একটি আদিরূপের মধ্যে, যার নিতান্ত অস্বচ্ছ প্রতিফলন হচ্ছে পিতা, স্বামী, প্রেমিকেরা। তাদের এ-মহাটোটেম পুজো যৌন প্রকৃতির, একথা বলা হবে বিদ্রুপাত্মক; তবে একথা সত্য যে এ-পুজোর মধ্যে তারা সম্পূর্ণরূপে তৃপ্ত করে তাদের শৈশবের বিনাপ্রতিবাদে নতজানু হওয়ার স্বপ্ন। ফ্রান্সে বলজে, পেতা, ও দ্য গলের মতো সেনাপতিরা সর্বদাই পেয়েছে নারীদের সমর্থন; মনে পড়ে সাম্যবাদী পত্রিকা লইয়মানিক্সে নারী সাংবাদিকেরা কিছুকাল আগে কী রকম ধড়ফড়ে কলমে স্তব লিখতেন টিটো ও তার জমকালো উর্দির। তীক্ষ্ণ-চক্ষু, চারকোণা-চোয়ালের সেনাপতি, একনায়ক হচ্ছে সব গভীর সদচিন্তাশীলদের প্রার্থিত দিব্য পিতা, সব মূল্যবোধের পরম নিশ্চয়তাবিধায়ক। বীরদের ও পুরুষের বিশ্বের বিধিবিধানের প্রতি নারীরা যে শ্রদ্ধাশীল হয়, তার কারণ তাদের অকার্যকারিতা ও অজ্ঞতা; তারা এগুলোকে সুষ্ঠু চিন্তার মাধ্যমে গ্রহণ করে না, গ্রহণ করে বিশ্বাস দিয়ে। আর বিশ্বাস তার উগ্র যুক্তিহীন গোঁড়ামির শক্তি পায় এঘটনা থেকে যে এটা কোনোজ্ঞান নয়; এটা অন্ধ, আবেগাতুর, একগুঁয়ে, নির্বোধ; এটা যা ঘোষণা করে, ঘোষণা করে নিঃশর্তভাবে, যুক্তিশীলতার বিরুদ্ধে, ইতিহাসের বিরুদ্ধে, সমস্ত অস্বীকারের বিরুদ্ধে।

এ-একগুঁয়ে ভক্তি পরিস্থিতি অনুসারে নিতে পারে দুটি রূপের মধ্যে একটি রূপ : হতে পারে যে নারী সংরক্তভাবেই অনুগত বিধানটির আধেয়র বা সে অনুগত নিতান্তই তার শূন্যগর্ভ রূপের। যদি সে অন্তর্ভুক্ত হয়সুবিধাভোগী অভিজাতশ্রেণীর, যারা লাভবান হয় প্রচলিত সমাজব্যবস্থায়, তাহলে সে চায় ব্যবস্থাটি থাকবে অটল এবং এবাসনায় সে থাকবে লক্ষণীয়ভাবে অনমনীয়। পুরুষ জানে যে সে বিকাশ ঘটাতে পারে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, আরেক জীবনবিধানের, নতুন আইনগত বিধির; যা আছে তা অতিক্রম করে যাওয়ার নিজের সামর্থ সম্পর্কে সে সচেতন, তাই সে ইতিহাসকে গণ্য করে এক ধরনের হয়ে-ওঠা বলে। সবচেয়ে রক্ষণশীল পুরুষও জানে কোনো-নাকোনো ধরনের বিবর্তন অনিবার্য এবং বুঝতে পারে তাকে ওই বিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে তার কর্মকে ও তার চিন্তাকে; কিন্তু নারী ইতিহাসে অংশ নেয় না বলে সে এর প্রয়োজনীয়তাগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয়; ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সে সন্দেহজনকভাবে। সন্দিগ্ধ এবং রোধ করতে চায় সময়ের প্রবাহ। যদি তার পিতার, তার ভ্রাতাদের, তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করা হয়, তাহলে স্বৰ্গকে আবার অধ্যুষিত করার কোনোপথ সে দেখতে পায় না; প্রচণ্ড তীব্রভাবে সে ছোটে পুরোনো দেবতাদের রক্ষা করার জন্যে।

মার্কিন বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধের সময় দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখার জন্যে কোনো দক্ষিণীই নারীদের থেকে প্রবলতরভাবে আবেগগাদ্দীপ্ত ছিলো না। বুয়োর যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে, কম্যিউনের সময় ফ্রান্সে, নারীরাই প্রজ্বলিত হয়েছিলো সবচেয়ে যুদ্ধংদেহিভাবে। তারা তাদের নিষ্ক্রিয়তার ক্ষতিপূরণ করতে চেয়েছিলো তাদের প্রদর্শিত আবেগের তীব্রতা দিয়ে। যখন জয় হয়, তখন তারা হায়েনার মতো ছুটে গিয়ে পড়ে পরাভূত শক্রর ওপর; পরাজয়ে, তারা তিক্ততার সাথে প্রত্যাখ্যান করে মীমাংসার যে-কোনো প্রচেষ্টা। তাদের ভাবনাচিন্তাগুলো যেহেতু নিতান্ত মনোভাব মাত্র, তাই তারা নির্বিকারভাবে। সমর্থন করে অতিশয় বাতিল ব্যাপারগুলো; ১৯১৪তে তারা হতে পারে বৈধতাবাদী, ১৯৫৩তে জারবাদী। পুরুষেরা অনেক সময় সহাস্যে তাদের উৎসাহিত করতে পারে, কেননা তাদের সংযত ভাষায় প্রকাশিত ভাবনাচিন্তা নারীদের মধ্যে কী উগ্ররূপ ধারণ করতে পারে, তা দেখে তারা কৌতুকবোধ করে; তবে তাদের ভাবনাচিন্তা এমন। নির্বোধ, একগুঁয়ে রূপ ধারণ করেছে দেখে তারা বিরক্তও বোধ করতে পারে।

নারী এ-অদম্য মনোভাব পোষণ করে শুধু শক্তভাবে সংহত সভ্যতায় ও সামাজিক শ্ৰেণীতে। আরো সাধারণভাবে, সে আইনকে শ্রদ্ধা করে কেননা তা আইন, যেহেতু তার বিশ্বাস অন্ধ; আইন বদলে গেলেও এটা টিকিয়ে রাখে তার যাদুমন্ত্র। নারীর চোখে জোরই অধিকার, কেননা পুরুষের যে-অধিকারগুলো সে স্বীকার করে, সেগুলো তাদের শক্তির ওপর নির্ভরশীল। তাই যখন ভেঙে পড়ে কোনো সমাজ, তখন নারীরাই প্রথম নিজেদের ছুঁড়ে দেয় বিজয়ীর পদতলে। সার্বিকভাবে, যা আছে, তা তারা মেনে নেয়। তাদের অন্যতম স্বাতন্ত্র্যনির্দেশক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেয়া। পম্পেইর ধ্বংসস্তৃপ যখন খোঁড়া হয়, তখন দেখা যায় যে স্বৰ্গকে অমান্য করে বা পালানোর চেষ্টায় পুরুষদের ভস্মীভূত দেহগুলো স্থির হয়ে আছে বিদ্রোহের ভঙ্গিতে, সেখানে নারীদের দেহগুলো, দু ভাঁজ হয়ে, মাথা নত করে মুখ ঠেকিয়ে আছে মাটিতে। নারীরা বোধ করে যে তারা বিভিন্ন বস্তু : অগ্নিগিরি, পুলিশ, পৃষ্ঠপোষক, পুরুষের বিরুদ্ধে শক্তিহীন। ‘নারী জন্মেছে দুঃখভোগের জন্যে,’ তারা বলে; ‘এ-ই জীবন–এর আর কিছু করা যাবে না’।

এ-বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেয়ার ফলে দেখা দেয় নারীর বহুলপ্রশংসিত ধৈর্যশীলতা। তারা পুরুষের থেকে অনেক বেশি দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে; পরিস্থিতির প্রয়োজনে তারা ধারণ করতে পারে স্টোয়িকধর্মী সাহস; পুরুষের আক্রমণাত্মক ঔদ্ধত্য তাদের নেই বলে বহু নারী তাদের অক্রিয় প্রতিরোধের মধ্যে দেখিয়ে থাকে প্রশান্ত ধৈর্যশীলতা। স্বামীদের থেকে অনেক বেশি উদ্যমের সাথে তারা সহ্য করতে পারে সংকট, দারিদ্র্য, দুর্ভোগ। কোনো কর্মোদ্যোগে যখন তারা নিয়োগ করে তাদের নিঃশব্দ অটলতা, তখন তারা কখনো কখনো অর্জন করে চমকপ্রদ সাফল্য। ‘নারীর শক্তিকে কখনো কমিয়ে দেখো না’। দয়াবতী নারীর মধ্যে বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেয়ার ব্যাপারটি রূপ নেয় তিতিক্ষার; সে সব কিছু সহ্য করে, কারো দোষ দেয় না, কেননা সে মনে করে কোনো মানুষ বা জিনিশ যেমন আছে, তেমন ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। গর্বিত কোনো নারী তার বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেয়ার ব্যাপারটিকে মহৎ গুণে পরিণত করতে পারে, যেমন করেছিলেন মাদাম দ্য শারিয়ের। তবে এটা এক ধরনের বন্ধ্যা পরিণামদর্শিতারও জন্ম দেয়; নারীরা ধ্বংস করা ও নতুন করে তৈরি করার বদলে সব সময়ই চেষ্টা করে সংরক্ষণ করার, খাপ খাওয়ানোর, বিন্যাস করার বিপ্লবের থেকে তারা বেশি পছন্দ করে আপোষমীমাংসা ও খাপ খাওয়ানো।

উনিশশতকে শ্রমিকদের মুক্তির প্রচেষ্টার পথে নারীরা ছিলো অন্যতম বৃহৎ বাধা; একজন ফ্লোরা ত্রিস্তান, একজন লুইস মিশেলের বিপরীতে কতো অজস্র নারী ঝুঁকি না নেয়ার জন্যে অনুনয় করেছে তাদের স্বামীদের কাছে। তারা শুধু ধর্মঘট, বেকারত্ব, ও দারিদ্রকেই ভয় করতো না : তারা ভয় করতো যে বিদ্রোহটাই হয়তো একটা ভুল।

নারীর নিয়তি পচনশীল বস্তুর নিয়তির সাথে বাধা; ওগুলো হারিয়ে তারা সব কিছু হারিয়ে ফেলে। শুধু একজন স্বাধীন কর্তা, যে নিজেকে দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করে বস্তুরাশির স্থায়িত্বকালের থেকে উর্ধ্বে ও অনেক সুদূরে, সে-ই শুধু রোধ করতে পারে সমস্ত পচন; নারী বঞ্চিত হয়েছে এ-পরম আশ্রয় থেকে। কেননা সে মুক্তিতে বিশ্বাস করে না, তার প্রকৃত কারণ হচ্ছে সে কখনো মুক্তির শক্তিগুলো পরখ করে নি; তার কাছে মনে হয় বিশ্ব যেনোশাসিত হয় একটা অবোধ্য নিয়তির দ্বারা, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ধৃষ্টতা। যে-সব বিপজ্জনক পথে তাকে চলতে বলা হয়, সেগুলো সে নিজে বেছে নেয় নি, তাই ওই পথে উদ্দীপনার সঙ্গে না ঝাপিয়ে পড়াই তার পক্ষে স্বাভাবিক। তার সামনে ভবিষ্যৎকে খুলে দাও, তখন সে আর মরিয়া হয়ে অতীত আঁকড়ে থাকবে না। যখন বাস্তব কাজের জন্যে ডাকা হয় নারীদের, যখন তারা নির্ধারিত লক্ষ্যের মধ্যে দেখতে পায় নিজেদের স্বার্থ, তখন তারা পুরুষের মতোই সাহসী ও নির্ভীক।

বহু ক্রটি–মাঝারিত্ব, আলস্য, লঘুচিত্ততা, দাস্যভাব–যে-সবের জন্যে নিন্দা করা হয় নারীদের, সেগুলো শুধু এ-সত্য প্রকাশ করে যে তাদের দিগন্ত রুদ্ধ। বলা হয়ে। থাকে নারী কামাতুর, সে গড়াগড়ি খায় সীমাবদ্ধতায়; কিন্তু প্রথমে তাকে তো আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে এরই মধ্যে। হারেমের দাসী কোনো অসুস্থ সংরাগ পোষণ করে না সংরক্ষিত গোলাপ ও সুবাসিত স্নানের জন্যে; তাকে সময় কাটাতে হবে। যখন নারীর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে কোনো নিরানন্দ গাইনিকিউমে–বেশ্যালয়ে বা মধ্যবিত্ত গৃহেসে তখন বাধ্য হয় আরামআয়েশ ও সুখসমৃদ্ধির আশ্রয় নিতে; তাছাড়াও, যদি সে কামসুখলাভের জন্যে ব্যাকুলও হয়, তার কারণ হচ্ছে প্রায়ই সে বঞ্চিত থাকে কামসুখ থেকে। কামে অপরিতৃপ্ত, পুরুষের স্থূলতায় দণ্ডপ্রাপ্ত, ‘পুরুষের কদর্যতায় দণ্ডিত’, সে সান্ত্বনা খোঁজে তেলতেলে চাটনিতে, উৎকট মদে, মখমলে, জলের, রোদের, নারী। বন্ধুর, তরুণ প্রেমিকের স্পর্শাদরের মধ্যে। যদি তাকে এতোই ‘দৈহিক’ প্রাণী বলে মনে হয় পুরুষের, তার কারণ হচ্ছে তার পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে তার পাশবিক প্রকৃতির ওপর চরম গুরুত্ব দিতে। মাংসের ডাকের শব্দ তার মধ্যে পুরুষের থেকে। উচ্চ নয়, তবে সে এর ক্ষীণতম গুঞ্জরণকেও ধরে ফেলে এবং বাড়িয়ে তোলে সেগুলোর ধ্বনি। কামসুখ, বিদীর্ণকর যন্ত্রণার মতো, নির্দেশ করে অব্যবহিতের অপূর্বসুন্দর বিজয়োল্লাস; তাৎক্ষণিকের হিংস্রতার মধ্যে প্রত্যাখ্যান করা হয়ভবিষ্যৎকে ও মহাবিশ্বকে; দেহাগ্নিশিখার বাইরে যা কিছু আছে তা কিছু নয়; মোক্ষলাভের এক্ষণিক মুহূর্তে নারী আর বিকলাঙ্গ ও হতাশাগ্রস্ত থাকে না। তবে সীমাবদ্ধতার এসব বিজয়োল্লাসকে সে মূল্যবান মনে করে শুধু এ-কারণে যে সীমাবদ্ধতাই তার ভাগ্য।

যে-কারণে ঘটে তার ‘শোচনীয় বস্তুবাদ’, সে-একই কারণে ঘটে তার লঘুচিত্ততা; মহৎ জিনিশে তার প্রবেশাধিকার নেই বলে ক্ষুদ্র জিনিশকেই সে মনে করে গুরুত্বপূর্ণ, এবং যে-অন্তঃসারশূন্যতা ভরে রাখে তার দিনগুলোকে সাধারণত সেগুলোই হয় তার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব ব্যাপার। তার মোহনীয়তা ও সুযোগসুবিধার জন্যে সে ঋণী তার পোশাক ও রূপের কাছে। প্রায়ই তাকে মনে হয় অলস, নিরুদ্যম; তবে তার জন্যে আছে যে-সব কাজকর্ম, সেগুলো বিশুদ্ধ কালপ্রবাহের মতোই শূন্য। সে যে অনর্থক বকবক করে, লেখে হিজিবিজি করে, সে তা করে তার অলস সময় কাটানোর জন্যে : অসম্ভব কাজের বদলে সে ব্যবহার করে শব্দপুঞ্জ। সত্য কথা হচ্ছে কোনো নারী যখন মানুষের উপযুক্ত কোনো কাজে নিযুক্ত হয়, তখন সে হয়ে উঠতে পারে পুরুষের মতোই সক্রিয়, দক্ষ, মিতবাক ও কৃচ্ছব্রতী।

তাকে অভিযুক্ত করা হয় দাস্যস্বভাবসম্পন্ন বলে; বলা হয়ে থাকে যে প্রভুর পায়ে পড়ার জন্যে ও যে-হাত তাকে আঘাত করে, তাকে চুমো খাওয়ার জন্যে সে সব সময়ই প্রস্তুত, এবং এটা সত্য যে তার অভাব আছে প্রকৃত গর্ববোধের। ‘প্রেমাতুরদের প্রতি উপদেশ’, প্রবঞ্চিত স্ত্রী ও পরিত্যক্ত প্রেমিকাদের প্রতি হিতোপদেশ দেয়া হয় যেস্তম্ভগুলোতে, সেগুলো ভরা থাকে শোচনীয় বশ্যতাস্বীকারের চেতনায়। নারী নিজেকে শ্রান্ত করে তোলে উদ্ধত ভাবাবেগপূর্ণ দৃশ্য ঘটিয়ে, কিন্তু শেষে কুড়িয়ে নেয় তার দিকে অবহেলায় পুরুষের ছুঁড়ে দেয়া ক্ষুদকুঁড়ো। কিন্ত পুরুষের সাহায্য ছাড়া নারী কী করতে পারে, যার কাছে পুরুষ হচ্ছে জীবনধারণের একমাত্র উপায় ও কারণ? সে প্রতিটি অবমাননা ভোগ করতে বাধ্য; ক্রীতদাসের থাকতে পারে না মানুষের মর্যাদাবোধ; নিজের চামড়া বাঁচাতে পারাই দাসের জন্যে যথেষ্ট।

এবং পরিশেষে, নারী যদি হয়েই থাকে পার্থিব প্রবৃত্তিসম্পন্ন, বৈশিষ্ট্যহীন, স্কুল উপযোগিতাবাদী, তার কারণ হচ্ছে তাকে বাধ্য করা হয়েছে রান্নাবান্না ও ডাইয়াপার ধােয়ার কাজে তার সমগ্র অস্তিত্ব নিয়োগ করতে–এটা মহিমান্বিত বোধ করার পথ নয়। তার দায়িত্ব হচ্ছে জীবনের সমস্ত মূঢ়োচিত কাজগুলো নিয়ে জীবনের একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি নিশ্চিত করা। নারীর পক্ষে পুনরাবৃত্তি করা, উদ্ভাবন না করে আবার শুরু করা স্বাভাবিক, তার কারণ সময়কে তার মনে হয় শুধু আবর্তন ও আবর্তন, যা কখনো কোনো অভিমুখে অগ্রসর হয় না। সে কখনো কিছু না করেই ব্যস্ত থাকে, এবং তাই তার যা আছে তার সাথেই সে অভিন্ন করে তোলে নিজেকে। বস্তুর ওপর এনির্ভরশীলতা, যা পুরুষ তাকে যে-পরনির্ভরতায় রাখে তারই পরিণতি, ব্যাখ্যা করে তার মিতব্যয়িতার, তার ধনসম্পত্তির লালসার কারণ। তার জীবন কখনোই কোনো লক্ষ্যের অভিমুখি নয় : সে নিবিষ্ট বস্তু উৎপাদনে ও সেবাযত্নে, যেমন খাবার, পোশাকপরিচ্ছদ, ও আশ্রয়, যেগুলো উপায়ের থেকে বেশি কিছু নয়। এসব বস্তু হচ্ছে পাশবিক জীবন ও স্বাধীন অস্তিত্বের মাঝে অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগের মাধ্যম। অপ্রয়োজনীয় উপায়গুলোর সাথে যুক্ত হয় যে-একটি মাত্র মূল্য, তা হচ্ছে উপযোগিতা; গৃহিণী বেঁচে থাকে উপযোগিতার স্তরেই, আর সে একথা ভেবে শ্লাঘা বোধ করে না যে সে তার জাতির কাছে একটি উপকারী লোকের থেকে বেশি কিছু।

কিন্তু কোনো অস্তিত্বশীলই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না একটি অপ্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে, কেননা তা অবিলম্বে উপায়কেই করে তোলে লক্ষ্য–যা দেখা যায়, উদাহরণ হিশেবে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে এবং উপায়ের মূল্যকেই ধ্রুব মূল্য বলে মনে হতে থাকে। তাই সত্য, সৌন্দর্য, স্বাধীনতার উর্ধ্বে গৃহিণীর স্বর্গে রাজত্ব করে উপযযাগিতা; এবং এ-পরিপ্রেক্ষিতেই সে মনে মনে আঁকে সমগ্র বিশ্বের ছবি। এজন্যেই সে গ্রহণ করে সোনালি মধ্যপন্থার আরিস্ততলীয় নৈতিকতা–অর্থাৎ মাঝারিত্বের নৈতিকতা। তাহলে কী করে তার কাছে প্রত্যাশা করা যায় যে সে দেখাবে স্পর্ধা, উৎসাহ, নিরাসক্তি, মহিমা? এসব গুণ তখনই দেখা দেয় যখন কোনো মুক্ত মানুষ অগ্রসর হয় মুক্ত ভবিষ্যতের ভেতর দিয়ে, অনেক পেছনে ফেলে রেখে যায় বিদ্যমান বাস্তবতা। নারীকে আটকে রাখা হয়েছে রান্নাঘরে বা নারীদের খাসমহলে, এবং তারপরও বিস্ময় প্রকাশ করা হয় যে তার দিগন্ত সীমাবদ্ধ। তার ডানা হেঁটে দেয়া হয়েছে, তারপরও মনস্তাপ করা হয় যে সে উড়তে পারে না। তার সামনে খুলে দেয়া যোক ভবিষ্যৎ, তখন সে আর বাধ্য হবে না বর্তমানের মধ্যে কালবিলম্ব করতে।

তার অহমিকার বা গৃহের সীমানার মধ্যে তাকে বন্দী করে রেখে যখন তাকে নিন্দা করা হয় তার আত্মরতি, তার আত্মপ্রচার, ও এগুলোর সব সহবৈশিষ্ট্য : আত্মশ্লাঘা, অভিমান, বিদ্বেষ প্রভৃতির জন্যে, তখন প্রদর্শন করা হয় একই অসামঞ্জস্য। তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে অন্যদের সাথে যোগাযোগের সমস্ত বাস্তব সম্ভাবনা থেকে; তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই সংহতির আবেদন বা লাভ সম্পর্কে, কেননা তাকে, এককভাবে বিচ্ছিন্ন রেখে, সম্পূর্ণরূপে উত্সর্গ করা হয়েছে তার পরিবারের কাছে। তাই আদৌ তার কাছে প্রত্যাশা করা যায় না যে সে নিজেকে পেরিয়ে এগোবে সর্বসাধারণের কল্যাণের দিকে। সে একগুয়েভাবে অবস্থান করে সে-এলাকায়, যা তার কাছে পরিচিত, যেখানে সে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং যার মাঝে অবস্থান করে সে উপভোগ করে এক ধরনের আশঙ্কাজনক সার্বভৌমত্ব।

সে দরোজায় তালা লাগায় এবং ঝাপ বন্ধ করে দেয়, তবুও নারী তার গৃহে পুরোপুরি নিরাপত্তা করে না। এটা পরিবৃত হয়ে আছে পুরুষের সে-বিশ্ব দিয়ে, যার ভেতরে ঢোকার স্পর্ধা না করে যাকে সে দূর থেকে শ্রদ্ধা করে। এবং যেহেতু সে কৌশলগত দক্ষতা, সুষ্ঠু যুক্তি, এবং সুস্পষ্ট জ্ঞানের সাহায্যে এটিকে বুঝতে পারে না, তাই সে, শিশু ও অসভ্যের মততা, মনে করে যে সে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে বিপজ্জনক রহস্য দিয়ে। বাস্তবতা সম্পর্কে তার ঐন্দ্রজালিক ধারণাগুলো সে প্রক্ষেপ করে পুংবিশ্বের ওপর; তার কাছে ঘটনাক্রমগুলোকে মনে হয় অনিবার্য এবং তারপরও ঘটতে পারে যা-কিছু; সে স্পষ্টভাবে সম্ভব ও অসম্ভবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না এবং প্রস্তুত থাকে সব কিছু বিশ্বাস করার জন্যে, তা যা-ই হোক-না-কেনো। সে। গুজবে কান দেয় এবং গুজব ছড়ায় এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এমনকি যখন সব কিছু শান্ত, তখনও সে উদ্বিগ্ন বোধ করে; রাতে আধােঘুমের মধ্যে পড়ে থেকে তার বিশ্রাম বিঘ্নিত হয় দুঃস্বপ্নের যে-সব রূপ নিয়ে দেখা দেয় বাস্তবতা, সেগুলো দিয়ে; এবং এভাবে অক্রিয়তায় দণ্ডিত নারীর দুয়ে ভবিষ্যতের ভেতরে হানা দিতে থাকে যুদ্ধ, বিপ্লব, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য; কোনোকাজ করতে না পেরে সে থাকে দুশ্চিন্তায়। তার। স্বামী, তার পুত্র, যখন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে বা মুখখামুখি হয় কোনো জরুরি অবস্থার, তখন তারা নিজেরা ঝুঁকি নেয়; তারা নেয় যে-সব পরিকল্পনা, বিধিবিধান, সেগুলোনির্দেশ করে দুর্বোধ্যতার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত পথ। কিন্তু নারী নাকানিচোবানি খেতে থাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় ও অন্ধকারে; সে এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, কেননা সে কিছুই করে না; তার কল্পনায় সব সম্ভাবনাই সমান বাস্তব : রেলগাড়ি রেলচ্যুত হতে পারে, ভুল হতে পারে অস্ত্রোপচারে, ব্যবসায় ক্ষতি হতে পারে। তার আঁধার রোমন্থনের মধ্যে সে যা প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা চালায়, তা তার নিজের শক্তিহীনতার প্রেতচ্ছায়া।

তার দুশ্চিন্তা বিদ্যমান বিশ্বের ওপর তার সন্দেহের প্রকাশ; একে যে তার কাছে মনে হয় আশঙ্কাজনক, ধ্বংসোনথ, তার কারণ সে এর মাঝে অসুখী। অধিকাংশ সময়ই সে বিনা প্রতিবাদে সব কিছু সয়ে যাওয়া সহ্য করে না; সে খুব ভালোভাবেই জানে যে সে কষ্ট পাচ্ছে, কেননা সে কাজ করে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে; সে নারী, কিন্তু এ-ব্যাপারে তার সাথে আলাপ করা হয় নি। সে বিদ্রোহ করার সাহস পায় না; সে। অনিচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে; তার মনোভাব নিরন্তর ভর্তসনার। যাদের কাছে নারীরা তাদের গোপন কথা বলে–চিকিৎসক, পুরোহিত, সমাজকর্মী-তারা সবাই জানে যে নারীদের নিত্যদিনের স্বর হচ্ছে অভিযোগের স্বর। বন্ধুদের মধ্যে নারী তার নিজের সমস্যা নিয়ে কাতর আর্তনাদ করে, এবং তারা সবাই সমস্বরে অভিযোগ জানাতে থাকে ভাগ্যের, বিশ্বের, এবং সাধারণভাবে পুরুষের বিচার সম্বন্ধে।

একটি স্বাধীন মানুষ তার ব্যর্থতার জন্যে দায়ী করে শুধু নিজেকে, সে নেয় এগুলোর দায়দায়িত্ব; কিন্তু নারীর সব কিছুই ঘটে অন্যদের মাধ্যমে, সুতরাং এঅন্যরা দায়ী তার দুঃখকষ্টের জন্যে। তার উন্মত্ত হতাশা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করে সব প্রতিবিধান; যে-নারী অভিযোগপরায়ণ, তার কাছে প্রতিবিধানের প্রস্তাব করে কোনো ফল হয় না : সে কোনো প্রতিবিধানকেই গ্রহণযোগ্য মনে করে না। সে জেদের সাথে জীবনযাপন করতে চায় যে-পরিস্থিতিতে সে আছে, তাতেই–অর্থাৎ একটা ক্লীব ক্রোধের অবস্থার মধ্যে। কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হলে সে আতঙ্কে দু-হাত ওপরে তোলে : ‘ওটিই শেষ খড়কুটো!’ সে জানে তার তোলা অজুহাতগুলো যে-সমস্যার ইঙ্গিত করে, তার সমস্যাগুলো তার থেকে আরো অনেক গভীর, এবং সে জানে এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে কৌশলের থেকেও বেশি কিছু দরকার। সে সমগ্র বিশ্বকে দায়ী মনে করে, কেননা এটি তৈরি করা হয়েছে তাকে ছাড়া, ও তার বিরুদ্ধে; বয়ঃসন্ধি থেকেই, এমনকি শৈশব থেকেই সে অভিযোগ করে আসছে তার অবস্থার বিরুদ্ধে। তাকে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তাকে। আশ্বাস দেয়া হয়েছে যদি সে তার সৌভাগ্য অর্পণ করে পুরুষের হাতে, তাহলে তা শতগুণে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং সে অনুভব করে তার সাথে জোচ্চুরি করা হয়েছে। সে অভিযুক্ত করে সমগ্র পুংবিশ্বকে। অসন্তুষ্টি হচ্ছে পরনির্ভরতার উল্টো পিঠ : যখন কেউ সব দান করে, প্রতিদানে সে যথেষ্ট পায় না।

নারী, অবশ্য, পুরুষের বিশ্বকে কিছুটা ভক্তির সঙ্গে মেনে নিতে বাধ্য; যদি সে পুরোপুরি বিরুদ্ধে থাকতো, তাহলে তার মাথার ওপরে একটা চালের অভাবে সে বিপদ বোধ করতো; সুতরাং সে নেয় একটা ম্যানিকীয়বাদী অবস্থান–শুভ ও অশুভর একটা সুস্পষ্ট পৃথককরণ–গৃহিণী হিশেবে তার অভিজ্ঞতাও এটাই নির্দেশ করে। যেব্যক্তি কাজ করে, সে অন্যদের মতো নিজেকেও দায়ী করে শুভ ও অশুভ উভয়েরই জন্যে, সে জানে তাকেই স্থির করতে হবে লক্ষ্য, তাকেই সফল করতে হবে সেগুলো; কর্মের মাধ্যমে সে সচেতন হয় সব প্রতিবিধানের দ্ব্যর্থবোধকতা সম্পর্কে; ন্যায় ও অন্যায়, লাভ ও ক্ষতি অচ্ছেদ্যভাবে মিশ্রিত। কিন্তু যে অক্রিয়, সে থাকে খেলার বাইরে এবং চিন্তার মধ্যেও নৈতিক প্রশ্নগুলো তুলতে অস্বীকার করে : শুভকে বাস্তবায়িত হতেই হবে, যদি তা না হয়, তাহলে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ করা হয়েছে, তার জন্যে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। শিশুর মতোই নারী শুভ ও অশুভকে দেখে সরল মূর্তিতে, সহাবস্থানরত, পৃথক সত্তারূপে; তার এ-ম্যানিকীয়বাদ কঠিন সিদ্ধান্তগ্রহণের উদ্বেগ দূর করে তার মনকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে তোলে। কোনটি অশুভ ও কোনটি কম অশুভ, বর্তমানের শুভ ও ভবিষ্যতের বৃহত্তর শুভর মধ্যে কোনটি কাম্য, পরাজয় কী ও বিজয় কী, তা নিজে স্থির করা–এসবের মধ্যে আছে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি। ম্যানিকীয়বাদীর কাছে ভালো গম সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন আগাছার থেকে, তাই আগাছাগুলো তুলে ফেলে দিলেই হলো; ধুলো সুনিন্দিত এবং পরিচ্ছন্নতা হচ্ছে ধুলোর সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি; গৃহ পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে ময়লা ও আবর্জনা তাড়ানো।

তাই নারী মনে করে ‘সব দোষই ইহুদিদের’, অথবা ফ্রিম্যাসনদের অথবা বলশেভিকদের, বা সরকারের; সে সব সময়ই থাকে কারো বা কোনো কিছুর বিরুদ্ধে। তারা সব সময় জানে না কোথায় নিহিত থাকতে পারে অশুভ নীতিটি, তবে একটি ‘ভালো সরকার’-এর কাছে তারা চায় যে সরকার অশুভকে ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করে ফেলবে যেমন তারা বাড়ি থেকে ঝেটিয়ে দূর করে ধুলোময়লা।

তবে সব সময়ই এসব হচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশা; এ-অবসরে অশুভ ক্ষয় করতে থাকে শুভকে; এবং সে যেহেতু ইহুদি, ফ্রিম্যাসন, বলশেভিকদের ওপর তার হাত তুলতে পারে না, তাই নারী এর জন্যে দোষী বলে খোঁজে এমন একজনকে, যার বিরুদ্ধে সে তার রোষ প্রকাশ করতে পারে মূর্তভাবে। তার স্বামীটি এ-পছন্দসই বলি। স্বামীটি পুরুষের বিশ্বের প্রতিমূর্তি, যার মাধ্যমে পুরুষের সমাজ গ্রহণ করেছে তার দায়িত্ব ও তার সাথে জোচ্চুরি করেছে। স্বামীটি ধারণ করে বিশ্বের ভর, এবং কিছু। বিগড়ে গেলে সেটা তার দোষ। স্বামীটি যখন রাতে বাড়ি ফেরে, সে তার কাছে অভিযোগ করে সন্তানদের, দোকানদানদের সম্বন্ধে, জীবনযাপনের ব্যয়, তার বাতের ব্যথা, আবহাওয়া সম্পর্কে–এবং চায় যে এর জন্যে স্বামীটি দোষী বোধ করুক। সে মাঝেমাঝেই স্বামীকে মনে করে দুঃখদুর্দশার বিশেষ কারণ বলে; তবে তার প্রথম অপরাধ হচ্ছে সে পুরুষ। স্বামীটির নিজেরই থাকতে পারে অসুস্থতা ও উদ্বেগ—’সেটা ভিন্ন’–তবে স্বামীটির আছে এমন এক বিশেষাধিকার, যা তার কাছে নিরন্তর একটা অবিচার বলে মনে হয়। এটা লক্ষণীয় জিনিশ যে স্বামী বা প্রেমিকের প্রতি সে যেবৈরিতা বোধ করে, সেটা তাকে স্বামী বা প্রেমিকের থেকে বিচ্ছিন্ন করার বদলে। তাদের প্রতি অনুরক্ত করে। যে-পুরুষ তার পত্নী বা উপপত্নীকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শুরু করেছে, সে চেষ্টা করে তাদের থেকে দূরে সরে যেতে; কিন্তু নারী যে-পুরুষকে ঘৃণা করে, তাকে সে হাতের কাছাকাছি চায়, যাতে তাকে সে ব্যয় বহন করতে বাধ্য করতে পারে। প্রত্যভিযোগ তার দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তির নয়, বরং তাতে গড়াগড়ি দেয়ার উপায়; স্ত্রীর পরম সান্ত্বনা নিজেকে শহিদ হিশেবে দাবি করা। জীবন, পুরুষ, তাকে পরাজিত করেছে : পরাজয়কেই সে পরিণত করবে বিজয়ে। এটাই ব্যাখ্যা করে কেননা সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজেকে সমর্পণ করে অশ্রুপাত ও দৃশ্যসৃষ্টির কাছে, যেমন সে করতো তার শৈশবে।

নারীর অবলীলায় অশ্রুপাতের অর্জিত ক্ষমতা, নিঃসন্দেহে, অনেকাংশে আসে এঘটনা থেকে যে তার জীবন স্থাপিত একটা বন্ধ্যা বিদ্রোহের ভিত্তির ওপর; এটাও শারীরবৃত্তিকভাবে পুরুষের থেকে তার স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ কম। এবং তার শিক্ষা তাকে শিখিয়েছে অবলীলাক্রমে ভেঙে পড়তে। শিক্ষা, বা প্রথার এপ্রভাব খুবই স্পষ্ট, কেননা অতীতে, উদাহরণস্বরূপ, বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্ট ও দিদরোর মতো পুরুষেরাও অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিতেন, এবং তারপর পুরুষেরা কাদাকাটি করা থামিয়ে দেয়, যখন এটা আর পুরুষসম্মত থাকে না। তবে, সর্বোপরি, সত্য কথা হচ্ছে বিশ্বের প্রতি একটা নৈরাশ্যপূর্ণ মনোভাব পোষণ করার জন্যে নারী সব সময়ই তৈরি, কেননা সে কখনো একে অকপটে মেনে নেয় নি। কোনো পুরুষ বিশ্বকে মেনে নেয় না; এমনকি দুর্ভাগ্যও তার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাতে পারে সে এর মুখোমুখি দাঁড়ায়, সে ছেড়ে দেয় না; আর সেখানে অল্পতেই নারীর মনে পড়েযায় তার বিরুদ্ধে বিশ্বের বৈরিতা এবং তার প্রতি ভাগ্যের অবিচারের কথা। তখন সে দ্রুত অবসর নেয় তার সবচেয়ে সুনিশ্চিত আশ্রয়স্থলে; নিজের ভেতরে। তার এ-গাল লাল হয়ে ওঠা, এ-রক্তাভ চোখ, এগুলো তার তীব্র শোকাহত আত্মার দৃষ্টিগ্রাহ্য বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কী? তার ত্বকের কাছে স্নিগ্ধশীতল, বড়ো জোর জিভে একটু নোনতা লাগে, একটু তিক্ত হলেও অশ্রু এক রকম মৃদু আদর; এ-দয়ালু ধারার নিচে দগ্ধ হয় তার মুখমণ্ডল। অশ্রু একই সঙ্গে অভিযোগ ও সান্ত্বনা, জ্বর ও শান্তিদায়ক প্রশমন। অশ্রু নারীর পরমতম অজুহাত; ঝোড়ো বাতাসের মতো আকস্মিক, থেকে থেকে দেখা দিয়ে, তুফানের মতো এপ্রিলের বর্ষণের মতো, অশ্রু নারীকে করেতোলে একটি বিলাপাতুর ফোয়ারা, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ আকাশ। তার দু-চোখ অন্ধ, কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসে; দৃষ্টিহীন, চোখ বিগলিত হয় বৃষ্টিধারায়; অন্ধ, সে ফিরে আসে প্রাকৃতিক বস্তুর অক্রিয়তায়। কেউ তাকে জয় করতে চায়, কিন্তু সে নিমজ্জিত হয়ে থাকে তার পরাজয়ের মধ্যে; সে পাথরের মতো নিমজ্জিত হয়, ডুবে মৃত্যুবরণ করে, যে-পুরুষ তার ধ্যান করে তাকে সে এড়িয়ে চলে, যেনো সে কোনো জলপ্রপাতের মুখোমুখি অসহায়। পুরুষটি একে মনে করে অন্যায় কাজ; কিন্তু নারী শুরু থেকেই এ-সংগ্রামকে অন্যায় মনে করে, কেননা তার হাতে আর কোনো কার্যকর অস্ত্র তুলে দেয় হয় নি। সে আরেকবার নিয়েছে যাদুর আশ্রয়। এবং তার ফুপিয়ে কান্না যে পুরুষকে রাগিয়ে তোলে, তাও তার ফুঁপিয়ে কান্নার আরেক কারণ।

যখন অশ্রু তার বিদ্রোহের প্রকাশের জন্যে অপ্রতুল হয়ে ওঠে, তখন সে এমন সব অসম্বন্ধ হিংস্রতার দৃশ্য ঘটায়, যা পুরুষকে আরো বিব্রত করে তোলে। কোনো কোনো সামাজিক বৃত্তে স্বামী তার স্ত্রীকে সত্যিই ঘুষি মারতে পারে; অন্যান্য বৃত্তে সে হিংস্রতার আশ্রয় নেয়া থেকে বিরত থাকে শুধু এ-কারণে যে সে অধিকতর শক্তিশালী এবং তার মুষ্টি একটা কার্যকর অস্ত্র। কিন্তু নারী, শিশুর মতো, ফেটে পড়ে প্রতীকী বিস্ফোরণে : সে আক্রমণ করতে পারে পুরুষটিকে, তাকে মারতে পারে খামচাতে পারে, তবে এটা একটা ইঙ্গিত মাত্র। তবে স্নায়বিক সংকটের নির্বাক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সে প্রকাশ করতে চেয়েছে সে-অবাধ্যতা, যা সে বাস্তবে পালন করতে পারে না। তার ভয়ানক বিক্ষুব্ধ আলোড়নের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর প্রবণতার শারীরবৃত্তিক কারণ ছাড়াও আছে অন্যান্য কারণ : ভয়ানক বিক্ষুব্ধ আলোড়ন হচ্ছে শক্তির অভ্যন্তরণীকরণ, যা বাইরের দিকে চালিত করার পর সেখানে কোনো বস্তুর ওপর ক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয়; এটা হচ্ছে পরিস্থিতিজাত সমস্ত নঞর্থক শক্তির লক্ষ্যহীন বর্ষণ। ছোটো সন্তানদের সাথে মায়ের স্নায়বিক সংকট ঘটেই না, কেননা সে তাদের শাস্তি দিতে পারে, মারতে পারে; বরং তার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে, তার স্বামী, বা তার প্রেমিক, যাদের ওপর তার কোনো সত্যিকার ক্ষমতা নেই, তাদের সঙ্গেই নারীর ঘটে উন্মত্ত। বদমেজাজের ঘোর। মাদাম তলস্তয়ের স্নায়ুবিকারগ্রস্ত আবেগের বিস্ফোরণ ঘটানোর দৃশ্যগুলো তাৎপর্যপূর্ণ; সন্দেহ নেই কখনোই তার স্বামীকে বোঝার চেষ্টা না করে তিনি খুব ভুল করেছিলেন, এবং তার দিনপঞ্জির আলোকে তাকে মনে হয় অনুদার, সংবেদনাহীন, এবং আন্তরিকতাহীন, তাকে কিছুতেই আকর্ষণীয় মানুষ মনে হয় না। তবে তিনি ঠিক ছিলেন না ভুল করেছিলেন, তা যা-ই হোক, তাতে তার পরিস্থিতির বিভীষিকার বদল ঘটে না। সারাজীবন ভরে তিনি কিছু করেন নি, নিরন্তর নিন্দার মধ্যে, বৈবাহিক বিধির মধ্যে, তাঁকে শুধু সহ্য করতে হয়েছে মাতৃত্ব, নৈঃসঙ্গ, এবং তার ওপর তার স্বামীর চাপিয়ে দেয়া জীবনের ধরন। তলস্তয়ের নতুন কোনো হুকুম যখন বিরোধকে তীব্রতর করে তুলতো, তলস্তয়ের নির্মম ইচ্ছের সামনে তিনি অসহায় হয়ে পড়তেন, তিনি তখন তাঁর অক্ষম শক্তি দিয়ে তার বিরোধিতা করতেন; তিনি ফেটে পড়তেন অস্বীকার করার নাটকীয়তায়–ভান করতেন আত্মহননের, ভান করতেন পালানোর, ভান করতেন অসুস্থতার, এবং আরো এমন বহু কিছুর–এসব তার চারপাশের লোকজনের কাছে মনে হতো উল্কট এবং তার নিজের জন্যে ছিলো ক্ষতিকর। তার পক্ষে এ-ছাড়া অন্য কিছু করা সম্ভব ছিলো, এটা মনে করা খুবই কঠিন, কেননা তার বিদ্রোহের অনুভূতিগুলো গোপন করে রাখার মতো কোনো সদর্থক কারণ তার ছিলো না, এবং সেগুলোকে কার্যকররূপে প্রকাশের কোনো উপায়ও তার ছিলো না।

যে-নারী পৌছে গেছে তার প্রতিরোধের সীমান্তে, তার সামনে খোলা আছে মুক্তির একটি পথ–সেটা আত্মহত্যা। তবে মনে হয় যেনো পুরুষের থেকে নারী এর আশ্রয় নেয় কম। এখানে পরিসংখ্যান খুবই দ্ব্যর্থবোধক। সফল আত্মহত্যার ঘটনা নারীর থেকে পুরুষের ক্ষেত্রে ঘটে অনেক বেশি, তবে নিজেদের জীবন শেষ করে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ নারীদের ক্ষেত্রে ঘটে অনেক বেশি। এটা হয়তো এ-কারণে যে নারীরা ভাব দেখিয়েই বেশ তৃপ্তিবোধ করে : প্রকৃতপক্ষে তারা যতোটা চায় তার চেয়ে অনেক বেশি ভান করে আত্মবিনাশের। এটা আংশিকভাবে এ-কারণেও যে প্রচলিত নৃশংস পদ্ধতিগুলো বিকর্ষণীয় : নারীরা প্রায় কখনোই ছুরিকা ও তরবারি বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না। তারা, ওফেলিয়ার মতো, সাধারণত জলে ডুবে মরে, একথা প্রমাণ করে যে জলের সাথে নারীর আছে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, যেখানে, নিথর অন্ধকারে, জীবনের অক্রিয় অবসান ঘটবে বলে মনে হয়। সাধারণভাবে এখানে আমরা আবার দেখতে পাই সে-দ্ব্যর্থবোধকতা, যার প্রতি আমি আগেই ইঙ্গিত করেছি : নারী যা তীব্রভাবে ঘৃণা করে, নারী তা সততার সঙ্গে প্রত্যাখ্যানের চেষ্টা করে না। সে সম্পর্কচ্ছেদের ভাব করে, কিন্তু পরিশেষে থাকে সে-পুরুষটির সাথেই, যে তার সমস্ত দুঃখকষ্টের কারণ; যে-জীবন তাকে কষ্ট দেয়, সেটি সে ত্যাগ করার ভান করে, কিন্তু তার পক্ষে নিজেকে হত্যা করার সাফল্য লাভ তুলনামূলকভাবে দুর্লভ। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার বিশেষ রুচি নেই। পুরুষের বিরুদ্ধে, জীবনের বিরুদ্ধে, তার পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করে, কিন্তু সে তার উদ্দেশ্য সাধন করে না।

নারীর আচরণের বহু দিক আছে, যেগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে প্রতিবাদের নানা রূপ হিশেবে। আমরা দেখেছি নারী প্রায়ই তার স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করে প্রকাশ্যে অবাধ্যতা দেখিয়ে এবং তা আনন্দের জন্যে নয়; এবং সে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অসাবধান ও অপব্যয়ী হতে পারে, কেননা তার স্বামী সুশৃঙ্খল ও মিতব্যয়ী। যেনারীবিদ্বেষীরা অভিযোগ করে যে নারীরা সব সময়ই দেরি করে তারা মনে করে নারীর সময়ানুবর্তিতার বোধ নেই; তবে আমরা দেখেছি সত্য হচ্ছে যে নারী সময়ের দাবির সঙ্গে নিজেকে ভালোভাবেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। যখন সে দেরি করে, তখন উদ্দেশ্যমূলক পরিকল্পনা থেকেই দেরি করে। কিছু ছেনাল নারী মনে করে এভাবে তারা উদ্দীপ্ত করে পুরুষের কামনা এবং তাদের উপস্থিতিকে করে তোলে অতিশয় আকর্ষণীয়; কিন্তু একটি পুরুষকে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে বাধ্য করে নারী সর্বোপরি প্রতিবাদ জানায় সে-দীর্ঘ প্রতীক্ষার বিরুদ্ধে; তার জীবনের বিরুদ্ধে।

এক অর্থে তার সমগ্র অস্তিত্বই হচ্ছে প্রতীক্ষা, কেননা সে আটকে আছে সীমাবদ্ধতা ও অনিশ্চিত সম্ভাবনার অবহেলিত অবস্থার মধ্যে; এবং যেহেতু তার যাথার্থ প্রতিপাদন সব সময়ই অন্যদের হাতে। সে প্রতীক্ষা করে পুরুষের শ্রদ্ধাঞ্জলির, অনুমোদনের, সে প্রতীক্ষা করে প্রেমের, সে প্রতীক্ষা করে তার স্বামী বা তার প্রেমিকের কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসার। সে তার জীবিকার প্রতীক্ষা করে, যা আসে পুরুষের কাছে থেকে; সে নিজে চেক-বই রাখুক বা স্বামীর কাছে থেকে নিতান্তই সাপ্তাহিক বা মাসিক ভাতা পাক, নারীটিকে দোকানদারের পাওনা শোধের জন্যে বা নিজের জন্যে একটি নতুন পোশাক কেনার জন্যে পুরুষটির দরকার হয় বেতন তোলা। নিজের মুখ দেখানোর জন্যে সে পুরুষের প্রতীক্ষা করে, কেননা তার আর্থিক পরনির্ভরতা তাকে পুরুষের নিয়ন্ত্রণের অধীনে রাখে; পুরুষের জীবনের সে একটি উপাদান মাত্র, আর পুরুষ তার সমগ্র অস্তিত্ব। ঘরের বাইরে স্বামীটির আছে নিজের পেশা, এবং স্ত্রীটিকে দিনভর সহ্য করতে হয় তার অনুপস্থিতি; আর প্রেমিক–যদিও সে সংরক্ত–তবু সে-ই নিজের সুবিধা অনুসারে ঠিক করে কখন তাদের দেখা হবে ও বিচ্ছেদ ঘটবে। বিছানায়, সে প্রতীক্ষায় থাকে পুরুষের কামনার, সে কামনা করে অনেক সময় উদ্বেগভরে–তার আপন সুখের।

মোট সে যা করতে পারে, তা হচ্ছে তার প্রেমিক অভিসারের জন্যে যে-স্থান ঠিক করেছে, সেখানে দেরি করে উপস্থিত হতে পারে, তার স্বামী যে-সময়ে তাকে তৈরি হতে বলেছে, সে-সময়ে সে তৈরি না হতে পারে; ওই উপায়ে সে জ্ঞাপন করে তার নিজের বৃত্তির গুরুত্ব, সে জোর দিয়ে জ্ঞাপন করে তার স্বাধীনতা; এবং ওই মুহূর্তে সে হয়ে ওঠে অপরিহার্য কর্তা, যার ইচ্ছের কাছে অন্যজন অক্রিয়ভাবে আনুগত্য স্বীকার করে। কিন্তু এসব হচ্ছে প্রতিশোধ নেয়ার ভীরু উদ্যোগ; পুরুষদের প্রতীক্ষায় রাখার জন্যে সে নাছোড়বান্দার মতো যতোই অটল থাকুক না কেননা, সে কিছুতেই সেঅন্তহীন ঘন্টাগুলোর ক্ষতিপূরণ করতে পারবে না, যা সে ব্যয় করেছে পুরুষের শুভ ইচ্ছের প্রতীক্ষায় তাকিয়ে থেকে ও আশায় আশায়।

পুরুষের বিশ্বকে নারী উপলব্ধি করতে পারে না, কেননা তাদের অভিজ্ঞতা তাদের যুক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করতে শেখায় না; এর বিপরীতে, পুরুষের যন্ত্রপাতি নারীর রাজ্যের সীমান্তে এসে তার শক্তি হারিয়ে ফেলে। মানব-অভিজ্ঞতার আছে একটি সমগ্র এলাকা, পুরুষ ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করতে চায়, কেননা সে তা ভাবতে পারে না: যে-অভিজ্ঞতা যাপন করে নারী। যে-প্রকৌশলী তার রেখাচিত্র তৈরির সময় খুবই যথাযথ, বাড়িতে সে আচরণ করে একটা গৌণ দেবতার মতো একটা শব্দ, আর দ্যাখো, তার খাবার দেয়া হয়ে গেছে, তার জামা ইস্ত্রি হয়ে গেছে, তার সন্তানেরা চুপ হয়ে গেছে; জন্মদান মুসার যাদুদণ্ড দোলানোর মতোই এক দ্রুতগতিশীল কর্ম; সে। এসব অলৌকিক কাণ্ডের মধ্যে স্তম্ভিত হওয়ার মতো কিছু দেখতে পায় না। অলৌকিক কারে ধারণা ইন্দ্রজালের বোধ থেকে ভিন্ন; যৌক্তিক কার্যকারণের মধ্যে এটা। উপস্থিত করে কারণহীন ঘটনার এক আমূল ধারাবাহিকতাহীনতা, যার মুখখামুখি ভেঙেচুরে পড়ে চিন্তাভাবনার অস্ত্রগুলো; আর সেখানে ঐন্দ্রজালিক প্রপঞ্চগুলো সমন্বিত হয় গুপ্ত শক্তিরাশির দ্বারা, যার ধারাবাহিকতা–না বুঝেও–গ্রাহ্য হতে পারে সহজ-বশ-মানা একটি মনের কাছে। নবজাতক শিশু পিতৃসুলভ গৌণ দেবতাটির কাছে এক অলৌকিক ব্যাপার, আর সে-মায়ের কাছে এটা এক ঐন্দ্রজালিক ঘটনা, যে তার পেটের ভেতরে এর সঙ্গে আপোষমীমাংসায় পৌছোনোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। পুরুষটির অভিজ্ঞতা বোধগম্য, তবে বিঘ্নিত হয় নানা ফাঁক দিয়ে; নারীর অভিজ্ঞতা, এর সীমার মধ্যে, রহস্যময় ও অবোধ্য, তবে পূর্ণাঙ্গ। এ-অবোধ্য তাকে করে তোলে গুরুভার; নারীর সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্যে পুরুষটিকে মনে হয় লঘু : পুরুষটির লঘুত্ব হচ্ছে একনায়কদের, সেনাপতিদের, বিচারকদের, আমলাদের, আইনের বিধানের, ও বিমূর্ত নীতিমালার লঘুত্ব। যখন এক গৃহিণী তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছে, ‘পুরুষ, তারা চিন্তা করে না!’, তখন সে নিঃসন্দেহে এটাই বুঝিয়েছে। নারী আরো বলে :’পুরুষ, তারা জানে না, তারা জীবনকে জানে না’। আরাধনারত ম্যান্টিসের কিংবদন্তির বিপরীতে নারী তুলে ধরে চপল ও অনধিকারচর্চাপ্রবণ পুং মৌমাছির প্রতীক।

পুরুষ তার কর্তৃত্বের পক্ষে সানন্দে মেনে নেয় হেগেলের ধারণা যে কোনো নাগরিক নিজেকে অতিক্রম করে বিশ্বজনীনের দিকে প্রসারিত হওয়ার মধ্যেই লাভ করে তার নৈতিক মর্যাদা, তবে ব্যক্তিমানুষ হিশেবে তার অধিকার আছে কামনা পোষণের ও আনন্দ লাভের। তাই নারীর সাথে তার সম্পর্ক অবস্থিত একটি ঘটনাচক্ৰজাত এলাকায়, যেখানে নৈতিকতা আর কাজ করে না, যেখানে আচরণ এক অনীহার ব্যাপার। অন্যান্য পুরুষের সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে আছে মূল্যবোধ; সে একজন স্বাধীন সংঘটক, যে সকলের কাছে সম্পূর্ণ স্বীকৃত বিধান অনুসারে সম্মুখিন হয় আরেক স্বাধীন সংঘটকের; কিন্তু নারীর সাথে সম্পর্কের মধ্যেনারীকে উদ্ভাবন করা হয়েছিলো এ-উদ্দেশ্যেই–সে বর্জন করে অস্তিত্বের দায়িত্ব, সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে তার আঁ-সোর কাছে, বা স্থির, হীনতর প্রকৃতির কাছে, সে নিজেকে স্থাপন করে অসত্যতার স্তরে। সে দেখা দেয়স্বৈরাচারী, ধর্ষকামী, হিংস্র, বা বালসুলভ, মর্ষকামী, কলহপ্রিয় রূপে; সে তপ্ত করার চেষ্টা করে তার আবিষ্টতা ও খেয়াল; সামাজিক জীবনে তার অর্জিত অধিকারগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় সে ‘আরামে থাকে’, সে ‘অবসর যাপন করে’।

তার স্ত্রী প্রায়ই অবাক হয় স্বামীর প্রকাশ্যে উচ্চারিত চমৎকার কণ্ঠস্বর ও আচরণ, এবং ‘অন্ধকারের ভেতরে তার অধ্যবসায়ী উদ্ভাবন’-এর বৈপরীত্য দেখে। সে উচ্চ জন্মহারের পক্ষে প্রচার চালায়, কিন্তু নিজের জন্যে যতোটা সুবিধাজনক তার থেকে বেশি সন্তান জন্মদানের ব্যাপারে সে থাকে সুকৌশলী। সে গুণকীর্তন করে সতী ও বিশ্বাসিনী স্ত্রীর, কিন্তু সে তার প্রতিবেশীর স্ত্রীকে ডাকে ব্যভিচারের জন্যে। আমরা দেখেছি পুরুষ কতোটা ভণ্ডামোর সাথে গর্ভপাতকে একটি অপরাধমূলক কাজ বলে হুকুম জারি করে, আর সেখানে ফ্রান্সে প্রতিবছর পুরুষেরা এক মিলিয়ন নারীকে ফেলে গর্ভপাতের অবস্থানে; স্বামী বা প্রেমিক প্রায়ই চায় এ-সমাধান; এছাড়াও প্রায়ই তারা মৌনভাবে ধরে নেয় যে দরকার হলে এটাই করতে হবে। তারা খোলাখুলিভাবে নির্ভর করে এর ওপর, যাতে নারী স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে নিজেকে করে তোলে অপরাধী : পুরুষের শ্রদ্ধেয় নৈতিক সমাজের সঙ্গতিবিধানের জন্যে নারীর ‘অনৈতিকতা’ দরকার।

এ-কপটতার সবচেয়ে জাজ্বল্যমান উদাহরণ হচ্ছে বেশ্যাবৃত্তির প্রতি পুরুষের। মনোভাব, কেননা তার প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয় এ-সরবরাহ। আমি উল্লেখ করেছি কী রকম ঘৃণ্য সন্দিগ্ধচিত্ততার সাথে বেশ্যারা দেখে থাকে সম্মানিত ভদ্রলোকদের, যারা সাধারণত এ-পাপের নিন্দা করে, কিন্তু নিজেদের ব্যক্তিগত খেয়াল চরিতার্থ করে ইন্দ্রিয়পরায়ণতার সাথে; তবুও যে-সব মেয়ে নিজেদের দেহ ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের তারা গণ্য করে বিকৃত ও ভ্রষ্টা বলে, কিন্তু যে-পুরুষেরা তাদের ব্যবহার করে, তাদের নয়। একটি সত্য কাহিনী চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দেয় এমানসিকতা। এ-শতকের শুরুতে বারো ও তেরো বছরের দুটি ছোটো মেয়েকে পুলিশ পায়একটি বেশ্যালয়ে; বিচারে সাক্ষী দেয়ার সময় মেয়ে দুটি তাদের খদ্দেরদের কথা বলে, যারা ছিলো গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তি, এবং একটি মেয়ে তাদের একজনের নামও বলতে যায়। বিচারক তখনই তাকে থামিয়ে দেয় : ‘তুমি একজন সম্রান্ত পুরুষের নামকে কালিমালিপ্ত করতে পারো না’। লেজিআঁ দ’অনর উপাধিভূষিত দ্রলোক একটি ছোটো মেয়ের সতীত্বমোচনের সময়ও থাকেন সম্রান্ত পুরুষ; তার একটু দুর্বলতা থাকতে পারে, তা কার নেই? আর সেখানে ওই ছোটো মেয়েটি, যার কোনো উচ্চাকাঙ্খ নেই বিশ্বজনীন নৈতিকতার জগতের দিকে এগোনোর–যে ম্যাজিস্ট্রেট নয়, বা জেনারেল। নয়, বা একজন মহান ফরাশি নয়, একটা ছোট্ট মেয়ে ছাড়া যে আর কিছু নয়। তারই নৈতিকতা বিপন্ন হয় কামের অনিশ্চিত এলাকায় : সে বিকৃত, দূষিত, পাপিষ্ঠ, সে মানসিক ও নৈতিক সংশোধন গারদে বন্দী থাকার যোগ্য।

নারী পালন করে সে-সব গুপ্তচরের ভূমিকা, ধরা পড়লে যাদের তুলে দেয়া হয়। গুলিবর্ষী সেনাদলের সামনে, এবং সফল হলে বোঝাই করা হয় পুরস্কারে; পুরুষের সমস্ত অনৈতিকতা কাঁধে তুলে নেয়া তার দায়িত্ব : শুধু বেশ্যারাই নয়, সব নারীই পয়ঃপ্রণালির কাজ করে সে-ঝলমলে, স্বাস্থ্যকর সৌধের, যাতে বসবাস করেন সম্রান্ত দ্রজনেরা। তারপর যখন এ-নারীদের কাছে কেউ বলে মর্যাদা, সম্মান, আনুগত্য, পুরুষের সমস্ত অত্যুচ্চ গুণাবলির কথা, তখন এতে বিস্ময়ের কিছু থাকে না যদি তারা এক মত না হয়। তারা পরিহাসের হাসি হাসে বিশেষ করে যখন পুণ্যবান পুরুষেরা তাদের তিরষ্কার করেন নিরাসক্ত না হওয়ার জন্যে, ছল-অভিনয়ের জন্যে, মিথ্যাচারের জন্যে। তারা ভালোভাবেই জানে যে তাদের সামনে মুক্তির আর কোনো পথ খোলা নেই। পুরুষও টাকা ও সাফল্যের ব্যাপারে ‘নিরাসক্ত’ নয়, তবে তার কাজের মধ্যে এগুলো অর্জনের উপায় তার আছে। নারীর জন্যে নির্ধারণ করা হয়েছে পরজীবীর ভূমিকা–এবং প্রতিটি পরজীবীই শোষক। নারীর পুরুষ দরকার মানবিক মর্যাদার জন্যে, খাওয়ার জন্যে, জীবন উপভোগের জন্যে, জন্মদানের জন্যে, সে এসব উপকার পেয়ে থাকে লিঙ্গের সেবাদানের মাধ্যমে; সে যেহেতু এসব ভূমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাই সে পুরোপুরিভাবে শোষণের এক নিমিত্তত্ব।

পুরুষের প্রতি নারীর অনুভূতির এ-দ্ব্যর্থবোধকতার পরিচয় আবারো পাওয়া যায় নিজের ও বিশ্বের প্রতি তার সাধারণ মনোভাবের মধ্যে। যে-এলাকায় সে বন্দী হয়ে আছে, সেটিকে বেষ্টন করে আছে পুরুষের জগত, কিন্তু সে-জগতে হানা দেয় এমন সব দুর্বোধ্য শক্তি, যেগুলোর কাছে পুরুষেরা নিজেরাই ক্রীড়নক; নারী এসব যাদুকরী শক্তির সাথে মৈত্রির সম্পর্ক পাতায়, কারণ যখন তার পালা আসবে তখন সে ক্ষমতাশীল হবে। সমাজ দাসত্বে বন্দী করে প্রকৃতিকে; কিন্তু প্রকৃতি প্রাধান্য করে তার ওপর। চেতনা দাউদাউ করে জ্বলে উঠে জীবনকে অতিক্রম করে যায়, কিন্তু জীবন যখন আর তাকে সমর্থন করে না, তখন তা আর জ্বলে না। নারীর সত্যতা প্রতিপন্ন হয় এ-দ্ব্যর্থকতা দিয়ে যে নারী অনেক বেশি সত্যতা দেখতে পায় একটি নগরের থেকে একটি বাগানে, একটি ভাবনার থেকে একটি ব্যাধিতে, একটি বিপ্লবের থেকে একটি জন্মের মধ্যে; সে আবার প্রয়োজনীয় হয়েওঠার জন্যে অপ্রয়োজনীয়র বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সে প্রয়াস চালায় পৃথিবীর, মহামাতার, রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার, যার স্বপ্ন দেখেছিলেন বাখোফেন। পুরুষ বাস করে একটি সমঞ্জস বিশ্বে, যা এমন এক বাস্তবতা ভাবনাচিন্তা দিয়েযা উপলব্ধি করা যায়। নারী সম্পর্কিত এক যাদুবাস্তবতার সাথে, যা অমান্য করে চিন্তাভাবনাকে, এবং সে এটি থেকে মুক্তি পায় এমন চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে, যার কোনো সত্যিকারের আধেয় নেই। নিজের অস্তিত্বকেএগিয়ে নেয়ার বদলে সে অলীক ধ্যান করে তার নিয়তির বিশুদ্ধ ভাব সম্পর্কে; কাজ। করার বদলে সে কল্পলোকে স্থাপন করে নিজের মূর্তি : অর্থাৎ যুক্তিপ্রয়োগের বদলে সে স্বপ্ন দেখে। এ থেকেই এটা ঘটে যে ‘প্রাকৃতিক’ হয়েও সে আবার কৃত্রিমও, এবং পার্থিব হয়েও সে নিজেকে করে তোলে বায়বীয়। তার জীবন কেটে যায় হাড়িপাতিল ধুয়ে, এবং এটা এক ঝলমলে উপন্যাস; সে পুরুষের অনুগত দাস, তবু সে মনে করে যে সে পুরুষের আরাধ্য মূর্তি; দৈহিকভাবে সে অবমানিত, কিন্তু সে তীব্রভাবে প্রেমের পক্ষে। সে যেহেতু শুধু জীবনের বাস্তব ঘটনাচক্রে জড়িয়ে থাকার জন্যেই দণ্ডিত, তাই সে নিজেকে করে তোলে পরম আদর্শের যাজিকা।

নারী যেভাবে দেখে তার দেহকে, তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ-পরস্পরবিপরীত মূল্য। এটি একটি বোঝা : প্রজাতির সেবায় জীর্ণ হয়ে, প্রতিমাসে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে, অক্রিয়ভাবে বেড়ে উঠে, এটা তার কাছে বিশ্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের বিশুদ্ধ হাতিয়ার নয়, বরং এটা এক জড় শারীরিক রূপ; এটা আনন্দের সুনিশ্চিত উৎস নয় এবং এটা সৃষ্টি করে ক্ষতের যন্ত্রণা; এটা ধারণ করে বিপদ : নারী তার ‘অভ্যন্তর’ দিয়ে বিপন্ন বোধ করে। অন্তর ক্ষরণক্রিয়ার সঙ্গে স্নায়বিক ও সহানুভূতিশীল সংশ্রয়গুলো, যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে পেশি ও অন্ত্রতন্ত্র, সেগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে এটা এক ‘স্নায়ুবিকারগ্রস্ত’ দেহ। তার দেহ প্রদর্শন করে এমন প্রতিক্রিয়া, যার দায় নিতে নারী অস্বীকার করে; ফুঁপিয়ে কান্নায়, বমনে, শরীরের ভয়ানক আলোড়নে, এটা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, এটা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে; এটা তার অন্তরঙ্গতম সত্য, কিন্তু এটা এক লজ্জাজনক সত্য, যাকে সে গোপন রাখে। এবং তবু এটি তার মহিমান্বিত ডবল; আয়নায় একে দেখে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়; এটা প্রতিশ্রুত সুখ, শিল্পকর্ম, জীবন্ত ভাস্কর্য; সে এটিকে রুপায়িত করে, অলঙ্কৃত করে, প্রদর্শন করে। সে যখন আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে, তখন সে ভুলে যায় তার রক্তমাংসের আকস্মিকতাকে; প্রেমের আলিঙ্গনে, মাতৃত্বে তার মূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু প্রায়ই, যখন সে তন্ময় হয়ে ভাবে নিজের সম্পর্কে, সে বিস্মিত হয় যে একই সময়ে সে সেই নায়িকা ও সেই মাংস।

রান্নাঘর সরবরাহ করে ও অতীন্দ্রিয় অপ্রতিরোধ্য ভাবোচ্ছ্বাস ঘটিয়ে একইভাবে প্রকৃতি তার সামনে উপস্থিত করে ঐকটি দ্বৈত মুখ। যখন সে গৃহিণী ও মা হয়, তখন সে ছেড়ে দেয় বনেবাদাড়ে স্বাধীনভাবে বিচরণ, তখন সে বেশি পছন্দ করে নীরবে শজির বাগান চাষ করা, সে ফুলদানিতে ফুল সাজায় : তবুও সে অভিভূত হয় চন্দ্রালোক ও সূর্যাস্ত দিয়ে। পার্থিব প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে সব কিছুর আগে সে দেখে খাদ্য ও অলঙ্কার; কিন্তু তাদের ভেতরে সঞ্চালিত হয় একটি রস, যা হচ্ছে মহত্ত্ব ও ইন্দ্রজাল। জীবন শুধু সীমাবদ্ধতা ও পুনরাবৃত্তি নয় : এর আলোতে চোখ-ধাঁধানো একটি মুখও আছে; পুষ্পিত উদ্যানে এটা দেখা দেয় সৌন্দর্যরূপে। তার জরায়ুর উর্বরতা দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে এক সুরে বাঁধা পড়ে নারী ভেসে যায় এর প্রাণসঞ্চারক মৃদুমন্দ বায়ুতেও, যা হচ্ছে চৈতন্য। এবং যতোটা সে থাকে অতৃপ্ত এবং, তরুণীর মতো, যতোটা সে বোধ করে অচরিতার্থ ও অসীম, তার আত্মাও ততোটাই হারিয়ে যাবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে অসীম দিগন্তের দিকে প্রসারিত পথের দৃশ্য দেখে। তার স্বামী, তার সন্তান, তার গৃহের কাছে দাসীত্বে বন্দী থেকে নিজেকে একাকী, সার্বভৌমরূপে পাহাড়ের ধারে দেখতে পাওয়া হচ্ছে পরমানন্দ; সে তখন আর মা, স্ত্রী, গৃহিণী নয়, সে একটি মানুষ; সে অক্রিয় বিশ্বকে নিবিষ্টভাবে অবলোকন করে, এবং তার মনে পড়ে যে সে একটি পূর্ণাঙ্গ সচেতন সত্তা, একটি অপর্যবসেয় স্বাধীন ব্যক্তি। জলের রহস্য ও পর্বতশিখরের গগনমুখিতার সামনে পুরুষের আধিপত্য মিলিয়ে যায়। যখন সে হাঁটে চিরহরিৎ গুল্মের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, তার হাত ডুবোয় স্রোতধারায়, তখন সে অন্যের জন্য বাঁচে না, বাঁচে নিজের জন্যে। যে-নারী তার সমস্ত দাসীত্বের মধ্যেও বজায় রেখেছে তার স্বাধীনতা, সে প্রকৃতির মধ্যে তার স্বাধীনতাকে ভালোবাসবে অতিশয় আকুল হয়ে। অন্যরা সেখানে অজুহাত পাবে শুধু মার্জিত তুরীয় আনন্দের; এবংগোধূলিবেলায় তারা দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে ঠাণ্ডা লাগার বিপদ ও আত্মার পরমোল্লাসের মধ্যে।

স্বাধীনতার বিকাশ ঘটানো–এমনকি নারীর জন্যেও–আধুনিক সভ্যতার একটি দায়িত্ব; এ-সভ্যতায় ধর্ম যতোটা বাধ্যকরণের হাতিয়ার তার চেয়ে অনেক বেশি ধোকা দেয়ার হাতিয়ার। বিধাতার নামে নিজেকে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট বলে মেনে নেয়ার জন্যে নারীকে ততোটা আর আদেশ দেয়া হয় না, বরং, বিধাতাকে ধন্যবাদ, তাকে বিশ্বাস করতে বলা হয় যে সে প্রভুসুলভ পুরুষের সমান; এমনকি বিদ্রোহ করার প্রলোভনকেও দমন করা হয় এ-দাবি করে যে অবিচার যা হয়েছিলো, তা দূরীভূত হয়েছে। নারীকে আর সীমাতিক্রমণ থেকে বঞ্চিত করা হয় না, কেননা নারীকে তার সীমাবদ্ধতা উৎসর্গ করতে হবে বিধাতার কাছে; আত্মার বিশেষ মূল্য পরিমাপ করা হবে শুধু স্বর্গে, পৃথিবীতে তাদের সিদ্ধি অনুসারে নয়। যেমন বলেছেন দস্তয়েভস্কি, এনিম্নলোকে এটা নানা ধরনের কাজের ব্যাপার মাত্র; জুতো পালিশ করার বা একটা সেতু নির্মাণের, সবই একই রকমের অসার দম্ভ; সামাজিক বৈষম্যের থেকে উধ্বস্তরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে দু-লিঙ্গের সাম্য। এ-কারণেই ছোটো মেয়ে ও কিশোরী তাদের ভাইদের থেকে অনেক বেশি ঐকান্ত্রিকভাবে ধর্মের ভক্ত; বিধাতার চোখ, যা বালকের সীমাতিক্ৰমণতাকে অতিক্রম করে যায়, বালকটিকে লজ্জিত করে : এ-মহাশক্তির। অভিভাবকত্বের নিচে সে চিরকাল থাকবে শিশু; তার পিতার অস্তিত্ব নপুংসকীকরণের যে-ভয় দেখিয়েছিলো তাকে। এটা তার থেকেও বেশি আমূলবাদী নপুংসকীকরণ। তবে ‘চিরশিশু’টি যদি হয় স্ত্রীলিঙ্গ, তাহলে সে এ-চোখের কাছে পাপ থেকে পরিত্রাণ লাভ করে, যা তাকে রূপান্তরিত করে দেবদূতদের বোনে। এটা রহিত করে শিশ্নের সুবিধা। হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষা এড়োনোয় ছোটো বালিকার জন্যে আন্তরিক ধর্মবিশ্বাস একটা বিশাল উপকার : সে পুরুষও নয় নারীও নয়, সে বিধাতার জীব।

সত্য হচ্ছে নারীরা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের বাসনা পরিতৃপ্ত করার একটি ছুতো হিশেবে। সে কি কামশীতল, মর্ষকামী, ধর্ষকামী? মাংসকে অস্বীকার করে, শহিদের অভিনয় করে, তার চারদিকের সমস্ত জীবন্ত প্রণোদনাকে ধ্বংস করে সে। লাভ করে সাধুতা। নিজেকে বিকলাঙ্গ করে, সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে সে কয়েক ডিগ্রি ওপরে ওঠে মনোনীতদের স্তরক্ৰমে; যখন সমস্ত পার্থিব সুখ থেকে বঞ্চিত করে সে শহিদ করে তার স্বামী ও সন্তানদের, তখন সে স্বর্গে তাদের জন্যে তৈরি করতে থাকে একটি শ্রেষ্ঠ স্থান। তার ধার্মিক জীবনীকারের বর্ণনানুসারে ‘নিজের পাপের জন্যে নিজেকে শাস্তি দেয়ার জন্যে’ কর্তোনার মার্গারেত নির্দয় আচরণ করতেন তার অবৈধ সন্তানের সাথে; সমস্ত ভবঘুরে ভিখিরিদের ধাওয়ানোর পরই শুধু তিনি ছেলেটিকে খেতে দিতেন। আমরা দেখেছি, অবাঞ্ছিত সন্তানের প্রতি ঘৃণা এক সাধারণ ঘটনা : এটা দৈববর–আক্ষরিকার্থেই–তাই এর প্রতি ন্যায়নিষ্ঠ ক্রোধ দেখানো যায়। তার দিকে থেকে, সহজ সতী নারীরা সহজেই বিধাতার সাথে সব কিছু ঠিকঠাক করে নেয়; আগামীকাল সে ঘোষণা পাবে তার পাপমুক্তির, এ-আত্মপ্রত্যয় ধার্মিক নারীকে প্রায়ই সাহায্য করে তার আজকের বিবেকের অস্বস্তি জয় করতে।

তাই ‘চিরন্তন’ পুরুষ বলা যেমন বাজেকথা, তেমনি ‘নারী’ সম্পর্কে সাধারণভাবে কোনো কিছু বলাও বাজেকথা। আমরা বুঝতে পারি কেনো সমস্ত তুলনা নিরর্থক, যেগুলো দেখাতে চায় নারী পুরুষের থেকে শ্রেষ্ঠ, নিকৃষ্ট, বা সমান, কেননা তাদের পরিস্থিতি গভীরভাবে ভিন্ন। আমরা যদি পরিস্থিতির অন্তর্গত মানুষদের মধ্যে তুলনা না করে এ-পরিস্থিতিগুলোর তুলনা করি, আমরা স্পষ্টভাবেই দেখতে পাই যে পুরুষ। অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য; এর অর্থ হচ্ছে বিশ্বে তার স্বাধীনতা প্রয়োগের জন্যে পুরুষের সুযোগ অনেক বেশি। এর অনিবার্য ফল হচ্ছে পুরুষের সিদ্ধি নারীর সিদ্ধির থেকে অনেক বেশি শ্রেষ্ঠ, কেননা বাস্তবিক কোনো কিছু করা নারীদের জন্যে নিষিদ্ধ। তাছাড়া, তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে নারী ও পুরুষ তাদের মুক্তিকে কীভাবে কাজে লাগায়, তার তুলনা করা কারণকার্যগতভাবে একটা নিরর্থক প্রচেষ্টা, কেননা তারা যা করে, তা হচ্ছে মুক্তিকে তারা স্বাধীনভাবে কাজে লাগায়। তবে নারীর স্বাধীনতা এখনো বিমূর্ত ও শূন্যগর্ভ বলে সে এটা প্রয়োগ করতে পারে শুধু বিদ্রোহে, যাদের গঠনমূলক কিছু করার কোনো সুযোগ নেই তাদের সামনে খোলা এটাই একমাত্র পথ। বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেয়া নিতান্তই অধিকারত্যাগ ও পলায়ন, নিজের মুক্তির জন্যে কাজ করা ছাড়া নারীর আর কোনো পথ নেই।

এ-মুক্তি অবশ্যই হতে হবে যৌথ এবং এর জন্যে সবার আগে সম্পন্ন করতে হবে নারীর অবস্থার আর্থনীতিক বিবর্তন। আগেও অনেকে করেছে, এবং এখনো অনেক নারী একক উদ্যোগে চেষ্টা করছে ব্যক্তিগত পরিত্রাণের। তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে তারা চেষ্টা করছে নিজেদের অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রতিপাদনের–অর্থাৎ বাস্তবায়িত করতে চাচ্ছে সীমাবদ্ধতার মধ্যে সীমাতিক্রমণ। এটা কখনো কখনো হাস্যকর, প্রায়ই করুণ, তবে এটা হচ্ছে তার কারাগারকে গৌরবের স্বর্গে, তার দাসত্বকে সার্বভৌম মুক্তিতে রূপান্তরিত করার জন্যে কারারুদ্ধ নারীর চূড়ান্ত প্রচেষ্টা, যা আমরা দেখতে পাবো আত্মরতিবতীতে, প্রণয়িনী নারীতে, অতীন্দ্রিয়বাদীতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *