৩.২ পাঁচজন লেখকে নারীকিংবদন্তি

পাঁচজন লেখকে নারীকিংবদন্তি
প্রথম খণ্ড । ভাগ ৩ – কিংবদন্তি। পরিচ্ছেদ ২

সাধারণ দৃষ্টিতে নারীকিংবদন্তি যে-রূপ নিয়েছে, তার এ-বিশ্লেষণকে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করার জন্যে আমরা এখন বিচার করব কয়েকজন লেখকের লেখায় এটা যে-বিশেষ ও বিচিত্রভাবে সম্মিলিত রূপ নিয়েছে, সে-রূপগুলো। নারীর প্রতি সঁতেরল, ডি এইচ লরেন্স, ক্লদেল, ব্রেতো, এবং তেঁদালের মনোভাবকে আমার কাছে মনে হয়েছে বৈশিষ্ট্যসূচক।

এক
মঁতেরলঁ বা ঘৃণার রুটি

মঁতেরলঁ অন্তর্ভুক্ত পুরুষের সে দীর্ঘ ধারায়, যারা আপন বলে গ্রহণ করেছেন পিথাগোরাসের গর্বিত ম্যানিকীয়বাদ। নিটশের অনুসরণে তিনি মনে করেন যে শুধু দুর্বলতায় বিশিষ্ট পর্বগুলোই উচ্চপ্রশংসা করেছে শাশ্বতী নারীর এবং তাই নায়ককে বিদ্রোহ করতে হবে মহামাতার বিরুদ্ধে। বীরত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনি, দায়িত্ব নিয়েছেন নারীকে সিংহাসনচ্যুত করার। নারী–সে হচ্ছে রাত্রি, বিশৃঙ্খলা, সীমাবদ্ধতা। তার মতে আজকের পুরুষের নির্বুদ্ধিতা ও হীনতার জন্যেই নারীর উনতাগুলোকে দেয়া হচ্ছে সদর্থক মূল্য : আমরা শুনতে পাই নারীর সহজাত প্রবৃত্তি, তাদের বোধি, তাদের ভবিষ্যকথনের কথা, যখন নিন্দা করা উচিত তাদের যুক্তিশীলতার অভাবের, একগুঁয়ে মূর্খতার, তাদের বাস্তবতাবোধের অক্ষমতার। আসলে তারা পর্যবেক্ষকও নয় মনোবিজ্ঞানীও নয়; তারা বস্তুরাশিকে দেখতে পায় না, জীবন্ত বস্তুদের বুঝতেও পারে না; তাদের রহস্য এক ফাঁদ এবং এক প্রতারণা, তাদের অতল সম্পদের আছে শূন্যতার গভীরতা; পুরুষকে তাদের দেয়ার কিছুই নেই এবং তারা শুধু ক্ষতি করতে পারে পুরুষের। মতেরলর কাছে সবার আগে মা-ই হচ্ছে মহাশত্র; তারুণ্যপূর্ণ একটি প্রকাশনায়, ‘ল’একজিল-এ, তিনি আমাদের এমন এক মাকে দেখান, যে তার পুত্রকে বিয়ের চুক্তি করতে বাধা দেয়; লে অলেপিক-এ এক কিশোর, যে খেলায় নিজেকে নিয়োগ করতে চায়, সে ‘নিষিদ্ধ’ হয় মায়ের ভীরু আত্মপ্রচারের ফলে; লে সেলিবাতেরে-এ যেমন তেমনি লে জোনে ফিইতেও তেমনি মাকে দেয়া হয় ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্য। তার অপরাধ সে চিরকাল তার পুত্রকে নিজের দেহের অন্ধকারে রুদ্ধ করে রাখতে চায়; সে পুত্রকে বিকলাঙ্গ করে দেয়, যাতে সে পুত্রকে শুধু একা তারই কাছে রাখতে পারে এবং ভরে তুলতে পারে তার সত্তার বন্ধ্যা শূন্যতাকে; সে হচ্ছে সবচেয়ে শোচনীয় শিক্ষক; সে শিশুর ডানা কেটে দেয়, পুত্র যে-উচ্চ শিখরে উঠতে চায়, তার থেকে অনেক পেছনে সে টেনে রাখে পুত্রকে; সে পুত্রকে করে তোলে নির্বোধ এবং অধঃপাতিত।

এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। তবে যে-তীব্র ভৎসনা চাপিয়ে দেন তিনি নারী মার ওপর, তাতে এটা স্পষ্টভাবে দেখা যায় তিনি মার মধ্যে যা ঘেন্না করেন, তা হচ্ছে তার নিজের জন্মের ঘটনা। তিনি বিশ্বাস করেন তিনিই বিধাতা, তিনি বিধাতা হতে চান; কেননা তিনি পুরুষ, কেননা তিনি একজন ‘উৎকৃষ্টতর মানুষ’, কেননা তিনি মতেরল। দেবতা কোনো জননিত সত্তা নয়; তার যদি দেহ থাকে, তাহলে তাঁর দেহ হচ্ছে দৃঢ় ও সুশৃঙ্খল পেশির ছাঁচে ঢালাই করা এক ইচ্ছে, সেটা স্থূলভাবে জীবন ও মৃত্যুর অধীন কোনো মাংসপিণ্ড নয়; তিনি মাকে দায়ী করেন এ-বিনাশী মাংসের জন্যে, যা অনিশ্চিত, অরক্ষিত, এবং তাঁর নিজের দ্বারা ত্যাজ্য। ‘তার শরীরের শুধু সে-স্থানেই ভেদ্য ছিলো একিলিস, যেখানে তাকে ধরে রেখেছিল তার মা,’ সির লে ফেম-এ বলেন মতেরল। মানুষ হওয়ার মধ্যে নিদের্শিত হয়ে আছে যে-অবস্থা, তা তিনি মেনে নিতে কখনোই ইচ্ছক ছিলেন না। নিজের উদ্ভবের উর্ধ্বে না উঠে তিনি একে অস্বীকার করেন প্রবলভাবে।

মতেরলর কাছে রক্ষিতাও মায়ের মতোই অশুভ সংকেতবহ; সে বাধা দেয় পুরুষকে তার ভেতরের দেবতাকে পুনর্জীবিত করতে। তিনি ঘোষণা করেন যে নারীর নিয়তি হচ্ছে সদ্যস্কতার জীবন্ত সে বেঁচে থাকে ইন্দ্রিয়ানুভূতির ওপর, তার আছে বাঁচার দুর্বার ক্রোধ—এবং পুরুষকে সে আবদ্ধ করতে চায় এ-হীনবস্থায়। নারী পুরুষের সীমাতিক্ৰমণতার উত্তাল অনুভব করে না, তার নেই কোনো মহিমাবোধ; সে তার প্রেমিককে ভালোবাসে তার দুর্বলতার মধ্যে, তার শক্তির মধ্যে নয়, তার দুর্দশার মধ্যে এবং তার আনন্দের মধ্যে নয়; সে তাকে চায় নিরস্ত্র। প্রেমিক তাকে অতিক্রম করে যায় এবং মুক্তি পায় তার থেকে; কিন্তু সে জানে কীভাবে প্রেমিককে ক্ষীণ করে তার ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে হয়। কেননা প্রেমিককে তার দরকার, সে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, সে একটা পরগাছা। ল্য সঁজ-এ দমিনিকের চোখ দিয়ে মতেরল দেখান যে। রেনেলার পদচারণারত নারীরা ‘তাদের প্রেমিকদের বাহু থেকে ঝুলে আছে ছদ্মবেশী বিশাল শামুকসদৃশ অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মতো’। তার মতে শুধু নারী ক্রীড়াবিদেরা ছাড়া নারীরা অসম্পূর্ণ জীব, যারা নির্ধারিত দাসীত্বের জন্যে; কোমল এবং পেশিহীন হওয়ার জন্যে বিশ্বের ওপর তাদের কোনো আয়ত্তি নেই; তাই তারা কঠোর পরিশ্রম। করে একটা প্রেমিক, বা আরো ভালো হয় একটি স্বামী, সংযোজনের জন্যে। মতেরল আরাধনারত ম্যান্টিসের উপকথা ব্যবহার না করতে পারেন, কিন্তু তিনি প্রকাশ করেন এর বিষয় : প্রেম হচ্ছে, নারীর কাছে, গিলে খাওয়া; দেয়ার ভান করে সে নেয়। তিনি তুলে ধরেন মাদমোয়াজেল তলস্তয়ের চিৎকার : ‘আমি তার মধ্যে বাচি, তার জন্যে বাঁচি; আমি চাই আমার জন্যে সে তা-ই করুক’, এবং তিনি চিত্রিত করেন এমন প্রেমোত্তেজনার বিপদ; এবং এক্লিজিয়াস্টেস্-এর বচনে পান এক ভয়ঙ্কর সত্য : ‘যেপুরুষ তোমার অশুভ কামনা করে সেও ভালো সে-নারীর থেকে, যে তোমার শুভ কামনা করে’।

মতেরল যদি সত্যিই শাশ্বতী নারীর কিংবদন্তি চূর্ণ করে থাকেন, তাহলে এসাফল্যের জন্যে তাকে অভিনন্দন জানাতে হবে : শাশ্বতী নারীকে অস্বীকার করেই শুধু মানুষের মর্যাদা লাভে আমরা সাহায্য করতে পারি নারীকে। কিন্তু তিনি মূর্তিটি। চুরমার করেন না, তিনি একে করে তোলেন এক দানবী। তিনিও বিশ্বাস করেন সেঅস্পষ্ট ও মৌল সারবস্তুতে, নারীত্বে; আরিস্ততল ও সেইন্ট টমাসের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন নারীকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে নঞর্থকভাবে; নারী পৌরুষের অভাবেই নারী; এটা সংশোধন করতে সমর্থ না হয়ে এর কাছে আত্মসমর্পণ করাই প্রতিটি নারীর নিয়তি। যে-কেউ এর থেকে মুক্তির কথা ভাবে, সে-ই নিজেকে পতিত করে মানুষের মানদণ্ডের তলদেশে; সে পুরুষ হতে ব্যর্থ হয়, সে নারী হওয়াকে পরিত্যাগ করে; সে হয়ে ওঠে এক হাস্যকর প্রাণী, একটা ভান।

মতেরল প্রাচ্য মনোভাব অনুমোদন করেন : সম্ভোগের বস্তু হিশেবে দুর্বল লিঙ্গটির একটা জায়গা আছে জগতে, সন্দেহ নেই জায়গাটা খুবই হীন, তবে বেশ; পুরুষ এর থেকে যে-প্রমোদ আহরণ করে, তার জন্যেই সে থাকতে পারে এবং থাকতে পারে শুধু প্রমোদের জন্যেই। আদর্শ নারী নিখুঁতভাবে নির্বোধ ও নিখুঁতভাবে অনুগত; সে সব সময়ই পুরুষকে গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত এবং পুরুষের কাছে সে কিছু দাবি করে না। এমন একজন হচ্ছে রিদিদিয়া, ছোট্ট আরব প্রেমের শান্তশিষ্ট পশু, বশমানারূপে যে গ্রহণ করে কাম ও অর্থ।

তবুও কোনক্রমেই মতেরল কোনো প্রাচ্য সুলতান নন; প্রথমত, তার রয়েছে কামবোধের অভাব। ‘নারী পশুদের মধ্যে কিছু আপত্তি ছাড়া তিনি কখনোই সুখ পান না: তারা অসুস্থ, অস্বাস্থ্যকর, কখনোপরিচ্ছন্ন নয়। কোস্তাল গোপনে আমাদের বলে যে বালকের চুলের গন্ধ নারীর চুলের থেকে অনেক বেশি সুগন্ধি ও তীব্র; অনেক সময় সে বিরক্তি বোধ করে সলজের, ‘সেই মিঠে, প্রায় অসুস্থকর গন্ধ ও সেই পেশিহীন, শাদা স্লাগের মতো স্নায়ুহীন দেহ’-এর উপস্থিতিতে। প্রাচ্যদেশীয়রা নারীতে পায় প্রবল ইন্দ্রিয়সুখাবহ আনন্দ এবং এভাবে প্রেমিকপ্রেমিকার মধ্যে স্থাপন করে এক দৈহিক পারস্পরিকতা : এটা প্রকাশ পেয়েছে পরমগীতের আকুল আবাহনে, আরব্যরজনীর কাহিনীগুলোতে, এবং দয়িতার স্তবমুখর অসংখ্য আরব কবিতায়। সেখানে সঁতেরর নায়ক সব সময়ই থাকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে : ‘পরাভূত না হয়েপরাজিত করা, শ্রেষ্ঠ পুরুষ ও নারীর মধ্যে এটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য সূত্র’।

অক্স ফঁতেনে দি দেজির-এ মতেরল ঘোষণা করেন, ‘কামনার থেকে ঘৃণা মহত্তর’; এবং ল্য মেতর দ্য সান্তিয়াগোতে আলভারো চিৎকার করে ওঠে : ‘ঘৃণা আমার কাছে রুটি’। তিনি গরিব মেয়েদের টাকা অথবা রত্ন দিয়ে প্রলুব্ধ করতে মজা পান : তারা তার অমঙ্গলকামী উপহার গ্রহণ করলে তিনি উল্লাস বোধ করেন। মজা করার জন্যে তিনি আঁদ্রির সাথে খেলেন এক ধর্ষকামী খেলা, তাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে নয়, বরং সে নিজেকে কীভাবে হীন করে তুলছে, তা দেখার জন্যে।

নারীর প্রতি মতেরলর মনোভাবের বৈধতা বিচার করার জন্যে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা তার নীতিবোধ। তার মনোভাবের নেই কোনো সদর্থক প্রতি-রূপ, যা একে ব্যাখ্যার কাজ করতে পারতো; এটা প্রকাশ করে শুধু তার অস্তিত্বগত পছন্দ। প্রকৃতপক্ষে, এ-নায়ক বেছে নিয়েছে ভয়। তার নায়ক সব সময় একলা মুখোমুখি দাঁড়ায় পশুদের, শিশুদের, নারীদের, ভূদৃশ্যের; সে শিকার তার নিজের কামনার।

দুই
ডি এইচ লরেন্স বা শিশ্নের গর্ব

লরেন্স ও একজন মতেরল দু-মেরুর মতো সুদূর। পুরুষের ও নারীর বিশেষ সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করা তার কাজ নয়, বরং তাদের উভয়কে জীবনের সত্যের কাছে ফিরিয়ে আনা তার কাজ। এ-সত্য প্রদর্শনের মধ্যেও নেই, ইচ্ছের মধ্যেও নেই : এটা জড়িত পাশবিকতায়, যার ভেতরে ছড়ানো মানুষের শেকড়। লরেন্স সংরক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেন লিঙ্গ-মস্তিষ্কের বৈপরীত্য; তার আছে এক মহাজাগতিক আশাবাদ, যা আমূলভাবে বিপরীত শপেনহায়ারের হতাশাবাদের; শিশ্নের মধ্যে প্রকাশিত বেঁচেথাকার-ইচ্ছে হচ্ছে আনন্দ।

লেডি চ্যাটার্লি ও মেলর্স উন্নীত হয়েছে একই মহাজাগতিক আনন্দে : একে অন্যের সাথে মিশে গিয়ে, তার মিশে গেছে গাছপালা, আলো, বৃষ্টির সাথে। লরেন্স এ-মতবাদটি সাধারণভাবে ব্যাখা করেছেন দি ডিফেন্স অফ লেডি চ্যাটার্লিতে : ‘বিয়ে এক প্রতিভাস যদি তা স্থায়ীভাবে ও আমূলভাবে শৈকি না হয়, যদি তা জড়িত না থাকে সূর্য ও পৃথিবীর সাথে, চাঁদের, গ্রহনক্ষত্রের সাথে, ঋতুর, বর্ষের, লাস্ট্রার, শতাব্দীর ছন্দস্পন্দনের সাথে। বিয়ে কিছুই নয় যদি না তা স্থাপিত হয় রক্তের প্রতিসাম্যের ভিত্তির ওপর। কেননা রক্ত হচ্ছে আত্মার সারবস্তু’। ‘পুরুষের রক্ত আর নারীর রক্ত হচ্ছে দুটি অনন্তকালীন পৃথক স্রোতধারা, যা মিশ্রিত হতে পারে না’। একারণেই এ-স্রোতধারা দুটি তাদের সর্পিল পথেই আলিঙ্গন করে জীবনের সমগ্রতাকে। ‘শিশ্ন হচ্ছে কিছু পরিমাণ রক্ত, যা পরিপূর্ণ করে নারীর ভেতরের রক্তের উপত্যকাকে। পুরুষের রক্তের তীব্র ধারা চরম গভীরতম তলে নিমজ্জিত করে নারীর রক্তের মহাধারাকে… তবে কোনোটিই বাঁধ ভেঙে ছোটে না। এটা হচ্ছে মিলনের বিশুদ্ধতম রূপ… এবং এটা মহারহস্যগুলোর অন্যতম’। জীবনের এক অলৌকিক সমৃদ্ধিসাধন এ-মিলন; তবে এটা চায় লোপ করতে হবে ‘ব্যক্তিত্ব’-এর দাবি। যখন বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদের অস্বীকার না করে পৌছোতে চায় পরস্পরের ভেতরে, যা সব সময়ই ঘটে আধুনিক সভ্যতায়, তখন তাদের উদ্যোগ পরিণত হয় হতাশায়। এমন ক্ষেত্রে থাকে এক কাম, যা ‘ব্যক্তিগত, শূন্য, শীতল, বিচলিত, কাব্যিক’, তা বিধ্বস্ত করতে চায় প্রত্যেকের প্রাণস্রোত। তখন প্রেমিকপ্রেমিকারা পরস্পরকে ব্যবহার করে উপকরণের মতো, যা জাগায় ঘৃণা : এটা ঘটে লেডি চ্যাটার্জি ও মাইকেলিসের ক্ষেত্রে; তারা রুদ্ধ থাকে নিজেদের ব্যক্তিতার মধ্যে; তারা ভোগ করতে পারে এমন জ্বর, যা দেয় অ্যালকোহল বা আফিম : তারা প্রত্যেকে ব্যর্থ হয় বাস্তবতা আবিষ্কারে; তারা কোথাও প্রবেশাধিকার পায় না।

লরেন্স সংরক্তভাবেই বিশ্বাস করেন পুরুষের আধিপত্যে। ‘শৈশ্নিক বিয়ে’ পদটিতে, তিনি ‘কামগত’ ও ‘শৈশ্নিক’-এর মধ্যে স্থাপন করেন যে-প্রতিসাম্য, তাতেই এটা প্রমাণ হয়। যে-দুটি রক্তধারা রহস্যময়ভাবে বিবাহিত হয়, তাদের মধ্যে শৈশ্নিক ধারাটিই লাভ করে আনুকূল্য। ‘শিশ্ন কাজ করে দুটি নদীর মিলনের উপায়রূপে; এট একই স্রোতে সংযুক্ত করে দুটি ভিন্ন ছন্দকে।‘ তাই পুরুষটি শুধু যুগলের মধ্যে একটি উপাদানই নয়, বরং তাদের সংযোগের কারণ; সে যোগায় তাদের সীমাতিক্ৰমণতা : ‘ভবিষ্যতের সাথে সেতু হচ্ছে শিশ্ন’। মাতা মহাদেবীর তন্ত্রের বিকল্পে লরেন্স প্রতিষ্ঠা করতে চান শিশ্নতন্ত্র; তিনি যখন মহাজগতের কামধর্মীতাকে উদ্ভাসিত করতে চান, তখন তিনি নারীর উদরের বদলে মনে পড়িয়ে দেন পৌরুষকে। তিনি কখনোই দেখান না যে নারী আলোড়িত করছে পুরুষকে; কিন্তু বারবার দেখান যেগোপনে নারী উত্তেজিত হচ্ছে পুরুষের তীব্র, সূক্ষ্ম, ও ধীরে-কৌশলে-প্রবেশকারী আবেদনে। তার নায়িকারা রূপসী ও স্বাস্থ্যবতী, কিন্তু হঠকারী নয়; আর সেখানে তার নায়কেরা উদ্বিগ্নকর ফন। পুরুষ প্রাণীরাই ধারণ করে জীবনের আলোড়ন ও শক্তিশালী রহস্য; নারী বোধ করে শুধু সম্মােহন : এটি অভিভূত হয় একটা শেয়াল দিয়ে, ওটি অনুরক্ত হয়ে ওঠে একটি অশ্বের, গাড্রুন অতি উত্তেজিত হয়ে রুখে দাঁড়ায়একপাল তরুণ ষাড়ের সামনে; সে অভিভূত হয় একটি খড়গোশের বিদ্রোহী বলিষ্ঠতায়।

পুরুষের একটি সামাজিক সুবিধাকে জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয় এসব মহাজাগতিক সুবিধার সাথে। সন্দেহ নেই এ শৈশ্নিক ধারা যেহেতু মহাবেগশালী, আক্রমণাত্মক, যেহেতু ছড়িয়ে পড়ে ভবিষ্যতের ভেতরে লরেন্স নিজেকে ব্যাখ্যা করেন, তবে অশুদ্ধভাবে পুরুষকেই ;সামনের দিকে বইতে হয় জীবনের ধ্বজা’; পুরুষ উদ্দেশ্য ও পরিণতির প্রতি একাগ্রচিত, পুরুষ ধারণ করে সীমাতিক্ৰমণতা; নারী জড়িত থাকে তার ভাবাবেগের মধ্যে, সে ইচ্ছে সম্পূর্ণ অন্তর্মুখিতা; সে উৎসর্গিত সীমাবদ্ধতার কাছে। পুরুষ শুধু যৌনজীবনে সক্রিয় ভূমিকাই পালন করে না, সে একে অতিক্রম করার ব্যাপারেও সক্রিয়; তার মূল রয়েছে কামের বিশ্বে, কিন্তু সে এর থেকে মুক্তি অর্জন করে; নারী বন্দী হয়ে থাকে এর ভেতরেই। চিন্তা ও কর্মের মূল রয়েছে শিশ্নে; শিশ্নের অভাবে এটিতেও নারীর অধিকার নেই ওটিতেও নেই : সে পুরুষের ভূমিকায় অভিনয়করতে পারে, এবং চমক্কারভাবেই পারতে পারে, কিন্তু এটা খেলা মাত্র, এতে নেই গভীর সত্যতা। নারীর ‘গভীরতম চেতনা আছে পাছায় ও পেটে’। যদি একে বিকৃত করা হয় এবং তার শক্তিপ্রবাহ ধাবিত করা হয়উধ্বমুখে, বক্ষে ও মাথায়, নারী হয়তো পুরুষের বিশ্বে বুদ্ধিমান, মহৎ, দক্ষ, মেধাবী, যোগ্য হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু, লরেন্সের মতে, তখন সব কিছু ধসে পড়ে, এবং সে ফিরে যায় কামের কাছে, ‘বর্তমান মুহূর্তেযা তার করণীয়’। কর্মের এলাকায় পুরুষকেই হতে হবে প্রবর্তক, সদর্থক; নারী সদর্থক শুধু আবেগের স্তরে।

এভাবে লরেন্স আবার আবিষ্কার করেন বোনালদ, অগাস্ত কোঁৎ, ক্লেমে ভতেলের প্রথাগত বুর্জোয়া ধারণা। নারীকে তার অস্তিত্বকে করতে হবে পুরুষের অধীন। ‘নারীকে বিশ্বাস করতে হবে তোমাকে এবং তুমি বোঝাও যে-গভীর লক্ষ্য, তাকে’। তাহলে পুরুষ তাকে দেবে অনন্ত প্রীতি ও কৃতজ্ঞতা। ‘আহা, কী চমকার বাড়িতে তোমার স্ত্রীর কাছে ফিরে আসা, যখন সে বিশ্বাস করে তোমাকে এবং অনুগত হয় তোমার লক্ষ্যের, যা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে… যে-নারী তোমাকে ভালোবাসে, তার প্রতি তুমি অনুভব করো অতল কৃতজ্ঞতা’।

লরেন্স যার উচ্চপ্রশংসা করেন–প্রধো ও রুশোর ধরনে–তা হচ্ছে একপতিপত্নীক বিয়ে, যাতে স্বামীর কাছে থেকে স্ত্রী আহরণ করে তার অস্তিত্বের যথার্থতা। সঁতেরলর মতোই তীব্র ঘৃণার সাথে লরেন্স সে-স্ত্রীর বিরুদ্ধে লেখেন, যে পাল্টে দিতে চায় ভূমিকা। লরেন্স মাতৃত্বকে আদৌ ঘৃণা করেন না : বরং এর উল্টো। মাংস হতে পেরে তিনি খুশি, তিনি স্বেচ্ছায় মেনে নেন তার জন্মকে, তিনি তার মাকে ভালোবাসেন; তাঁর লেখায় মা দেখা দেয় খাঁটি নারীত্বের জমকালো উদাহরণরূপে; তারা বিশুদ্ধ। আত্ম-অস্বীকৃতি, পরম মহত্ত্ব, তাদের সমস্ত জীবন্ত উত্তাপ সন্তানের সেবায় নিয়োজিত : তাদের পুত্ররা পুরুষ হয়ে উঠছে এটা তারা সানন্দে মেনে নেয়, তারা এতে গর্বিত। কিন্তু ভয় পেতে হবে অহমিকাপরায়ণ অমৎকে, যে পুরুষকে ফিরিয়ে নেয় তার বাল্যকালে; সে ব্যাহত করে এল, পুরুষের উড়াল। ‘চাঁদ, নারীদের গ্রহ, আমাদের দুলিয়ে দেয়পেছনের দিকে’। নারী অনিঃশেষ কথা বলে প্রেম সম্বন্ধে; কিন্তু তার কাছে প্রেম হচ্ছে নেয়া, তার ভেতরে সে যে-শুন্যতা বোধ করে, এটা তা ভরিয়ে তোলার জন্যে; এমন প্রেম ঘৃণার মতোই।

তিন
ক্লদেল এবং প্রভুর দাসী

ক্লদেলের ক্যাথলিকবাদের মৌলিকত্ব এমন এক অনমনীয় আশাবাদের মধ্যে যে এতে অশুভকে পরিণত করা হয় শুভতে।

অশুভ নিজেই
জড়ানো তার শুভে যা আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।

ক্লদেল সৃষ্টির সব কিছুকেই অনুমোদন করেন, তিনি গ্রহণ করেন এমন দৃষ্টিভঙ্গি, যা স্রষ্টার ছাড়া আর কারো নয়। কেননা পরেরজনকে মনে করা হয় সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, এবং দয়ালু। নরক ও পাপ ছাড়াস্বাধীন ইচ্ছেও থাকতো না পাপমুক্তিও। থাকতো না; তিনি যখন শূন্যতা থেকে সৃষ্টি করেন এ-জগত, তখন আগে থেকেই তিনি দেখতে পান পতন ও পরিত্রাণ। ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মী উভয়েরই চোখে হাওয়ারঅবাধ্যতা তার কন্যাদের ফেলে দেয় মহাঅসুবিধায়; সবাই জানে গির্জার পিতারা কী প্রচণ্ড ভৎসনা করেছেন নারীদের। কিন্তু উল্টোভাবে আমরা দেখতে পাবো যে সে ঠিক কাজই করেছে, যদি আমরা স্বীকার করি যে সে কাজ করেছে স্বর্গীয় লক্ষ্যকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে। ‘নারী! সে-উপকার একদা স্বর্গোদ্যানে, যা সে করেছে বিধাতাকে তার অবাধ্যতা দিয়ে; সে-গভীর সমমর্মিতা তার ও তার মাঝে; সে-মাংস, যা সে পতনের মধ্য দিয়ে দান করেছে পরিত্রাণের কাছে!’ এবং নিশ্চিতভাবেই সে পাপের উৎস, এবং তার কারণেই পুরুষ হারিয়েছে স্বর্গ। তবে ক্ষমা করা হয়েছে মানুষের পাপ, এবং এবিশ্ব নতুনভাবে আশীর্বাদপ্রাপ্ত। ‘বিধাতা আদিতে আমাদের যেখানে স্থান দিয়েছিলেন আমরা কোনোক্রমেই ছেড়ে আসি নি সে-সুখকর স্বর্গলোক!’ ‘সমগ্র পৃথিবীই প্রতিশ্রুত দেশ’।

যা কিছু বিধাতার হাত থেকে এসেছে, যা কিছু তিনি দিয়েছেন, তা নিজে খারাপ হতে পারে না : ‘যা কিছু তিনি তৈরি করেছেন, তার কিছুই নিষ্ফল নয়’। মহাজগতের সঙ্গতির মধ্যে তাই আছে নারীর স্থান।

অতি নিশ্চিতভাবেই নারী হয়ে উঠতে পারে ধ্বংসকারী : ক্লদেল লিসির মধ্যে মূর্তি দিয়েছেন খারাপ নারীকে, যে পুরুষকে নিয়ে যায় সমূহ সর্বনাশের দিকে; পাৰ্তাজ দ্য মিদিতে ওয়াইসি সর্বনাশ করে সে-পুরুষদের জীবন, যারা তার ফাঁদে পড়ে। কিন্তু যদি থাকতো এ-সর্বনাশের বিপদ, তাহলে আর পাপমোচনও থাকতো না। নারী হচ্ছে ‘বিপদের সে-উপাদান, যা তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তার বিশাল নির্মাণে’। মাংসের প্রলোভন জানা পুরুষের জন্যে শুভ। ‘এটা আমাদের ভেতরের সেশক্ত, যে আমাদের জীবনকে দেয় তার নাটকীয় উপাদান, এ-মর্মভেদী লবণ। আত্মা এভাবে যদি নৃশংসভাবে আক্রান্ত না হতো, তাহলে তা ঘুমিয়ে থাকতো, এবং দ্যাখো, তা লাফিয়ে উঠছে… জয়ের পথ যুদ্ধের ভেতর দিয়েই’। ‘এবং নারী ছাড়া পুরুষের সাথে কথা বলায় কোন মাংস বেশি শক্তিশালী?’ তবে অধিকাংশ সময়ই নারী হচ্ছে প্রতিভাসের এক প্রতারক বহনকারী। ‘আমি সে-প্রতিশ্রুতি, যা রক্ষা করা যাবে না এবং তার মধ্যেই আছে আমার আবেদন। যা নেই, তার জন্যে অনুতাপের সাথে, যা আছে, আমি তার মধুরতা’। তবে প্রতিভাসেরও আছে উপকারিতা; অভিভাবক দেবদূত এটাই বলে দোনা প্রোহেৎকে :

এমনকি পাপ! পাপও করে উপকার!

তাই ভালো ছিলো এ যে সে ভালোবাসতো আমাকে?

এ ছিলো ভালো যে তুমি কামনা শিখিয়েছিলে তাকে।

প্রতিভাসের জন্যে কামনা? এক ছায়ার জন্যে যে সব সময় পালায় তার থেকে?

যা আছে তার জন্যে কামনা, যা নেই তার প্রতিভাস। প্রতিতাসের

ভেতর দিয়ে কামনা

যা আছে তার জন্যে, যা নেই তার ভেতর দিয়ে।

বিধাতার ইচ্ছেয় রদরিগের কাছে প্রোহেৎ হচ্ছে : ‘তার হৃৎপিণ্ডের ভেতর দিয়ে একটি তরবারি’।

তবে বিধাতার হাতে নারী শুধু এ-ক্ষুরই নয়; এ-বিশ্বের ভালো জিনিশগুলোকেও সব সময় অস্বীকার করা ঠিক নয় : তারাও পুষ্টি; পুরুষকে নিতে হবে তাদেরও এবং করে নিতে হবে নিজের।

নারী প্রকৃতির সর্বস্ব : গোলাপ ও পদ্ম, নক্ষত্র, ফল, কুঁড়ি, বায়ু, চাঁদ, সূর্য, ফোয়ারা, ‘দুপুরের সূর্যের নিচে এক মহা সমুদ্রবন্দরের শান্ত উত্তেজনা’।

তবে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা পুরাপুরি সমরূপ নয়। সামাজিক স্তরে পুরুষের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। ক্লদেল স্তরক্ৰমে বিশ্বাস করেন, অন্য সবখানের মতো পরিবারেও : স্বামীই প্রধান। শুধু পুরুষ হওয়ার মধ্যেই পাওয়া যায় একটি সুবিধা। সিনে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কে, এক অভাগা মেয়ে, যে নিজেকে তুলনা করবো আমার জাতির পুরুষের সাথে?’ পুরুষই জমি চাষ করে, ক্যাথিড্রাল তৈরি করে, তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করে, বিশ্ব উদ্ঘাটন করে, দেশ জয় করে যারা কাজ করে, উদ্যোগ নেয়। পৃথিবীতে পুরুষের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয় বিধাতার পরিকল্পনা। নারী এক সহায়ক বস্তু মাত্র। সে থাকে বিশেষ স্থানে, অপেক্ষা করে, এবং সে গুছিয়ে রাখে জিনিশপত্র : ‘আমি সে, যে পড়ে থাকে, এবং সর্বদা সেখানে,’ বলে সিনে।

চার
ব্রেতোঁ বা কবিতা

ক্লদেলের ধর্মীয় জগতের সাথে ব্রেতের কাব্যিক বিশ্বের মেরুর ব্যবধান থাকলেও তাঁরা নারীকে যে-ভূমিকা দেন, তার মধ্যে রয়েছে সাদৃশ্য : নারী এক বিঘ্নকর জিনিশ; সে পুরুষকে ছিন্ন করে নেয়সীমাবদ্ধতার নিদ্রা থেকে মুখগহ্বর, চাবি, দরোজা, সেতু, দান্তেকে সে পথনির্দেশ করে নিয়ে যায় দূরান্তরে। কিন্তু ব্রেতোঁর কাছে ওই দূরান্তর সুদূর স্বর্গ নয় : এটা আসলে এখানে, এটা সরিয়ে দিতে পারে দৈনন্দিনতার মামুলিত্ব; কাম দূর করতে পারে মিথ্যা জ্ঞানের সম্মোহন। নারী এক হেঁয়ালি এবং সে জ্ঞাপন করে হেঁয়ালি; তার বহু বৈশিষ্ট্য একত্রে তৈরি করে ‘সে-অনন্য সত্তা, অনুগ্রহ করে যার মধ্যে আমাদের দেখতে দেয়া হয়েছে ফিংক্সের শেষ প্রতিমূর্তি’; এবং এ-কারণেই সে হচ্ছে প্রত্যাদেশ। এক নামাতে তিনি ভালোবাসেন, তাকে ব্রেতো বলেন, ‘তুমি হচ্ছো গূঢ়র একান্ত প্রতিরূপ’।

এটা বলার অর্থ নারী হচ্ছে কবিতা। এবং জেরার দ্য নেভালেও সে একই ভূমিকা পালন করে; কিন্তু তার সিলভি ও অরেলিতে নারীর আছে স্মৃতি বা প্রেতচ্ছায়ার গুণ, কেননা স্বপ্ন, সত্যিকারটির থেকে অনেক সত্য, এর সাথে ঠিকমতো খাপ খায় না। ব্রেতের কাছে মিল হচ্ছে উকৃষ্ট : বিশ্ব আছে মাত্র একটি; কবিতা জিনিশের মাঝে উপস্থিত বস্তুগতভাবে, আর নারী হচ্ছে অদ্ব্যর্থভাবে এক মাংস ও রক্তের সত্তা। একজন কেউ তার মুখোমুখি হয়, অর্ধ-স্বপ্নে নয়, পুরো জাগ্রত অবস্থায়, যে-কোনো একটা। সাদামাটা দিনে, দিনপঞ্জিতে অন্যান্য দিনের মতো তার তারিখ আছে–১২ এপ্রিল, ৪ অক্টোবর, বা যা-ই হোক–একটা সাদামাটা পরিবেশে : একটা কাফেতে, কোনো রাস্তার প্রান্তে। তবে সব সময়ই সে কোনো অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের জন্যে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। নাদিয়া ‘হেঁটে গেলো তার মাথা উঁচু করে, অন্য পথচারীদের থেকে একেবারে ভিন্ন… অদ্ভুত প্রসাধনে… এমন চোখ আমি কখনো দেখি নি’।

নারী প্রেমে লাভ করে পরিপূর্ণতা এবং প্রকৃত সিদ্ধি; বিশেষ, একটি বিশেষ নিয়তি মেনে নিয়ে এবং মহাজগত ভরে শেকড়হীন ভেসে বেড়িয়ে নয়–সে ধারণ করে সব কিছু। যে-মুহূর্তে তার সৌন্দর্য প্রকাশ পায় শ্রেষ্ঠরূপে, সেটা রাত্রির সে-সময়ে যখন ‘সে হচ্ছে বিশুদ্ধ দর্পণ, যাতে আছে যা কিছু ছিলো, যা কিছুকে হওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, এবার যা হতে যাচ্ছে, তার ভেতরে মনোমোহনরূপে স্নাত হয়ে’।

অবিনাশী প্রেম অনন্য না হয়ে পারে না। ব্ৰেতোর মনোভাবের এটাই অসঙ্গতি যে তার বইগুলোতে, ভাজে কমিনিকাৎ থেকে আরকান ১৭ পর্যন্ত, তিনি দুর্দমনীয়ভাবে অঙ্গীকার করেছেন বিভিন্ন নারীর জন্যে এক অনন্য ও শাশ্বত প্রেম। কিন্তু তিনি ব্যাখ্যা করেন যে এমন সামাজিক অবস্থা আছে, যা পুরুষকে স্বাধীনভাবে পছন্দ করতে দেয় না, তাই পুরুষকে ভুলভাবে পছন্দ করতে হয়; এছাড়াও, এসব ভুলের ভেতর দিয়ে। আসলে সে খোঁজে একটি নারীকেই। এবং তিনি যদি সে-প্রিয়াদের মুখ স্মরণ করেন, তাহলে তিনি ‘সব নারীর মুখের মধ্যে উপলব্ধি করবেন একটি মুখ : শেষ যে-মুখটি তিনি ভালোবেসেছেন’।

পাঁচ
স্তেঁদাল বা বাস্তবের রোম্যান্টিক

বর্তমান কাল ছেড়ে যদি আমি ফিরে যাই স্তেদালের কাছে, তা এজন্যে যে কার্নিভালের এ-জলবায়ুতে, যেখানে নারী আছে প্রতিশোধের দেবী, বনদেবী, শুকতারা, সাইরেন প্রভৃতির ছদ্মবেশে, সেখান থেকে বেরিয়ে এমন একজন পুরুষের কাছে যেতে আমি স্বস্তি বোধ করি, যিনি বাস করে রক্তমাংসের নারীদের মধ্যে।

স্তেদাল বাল্যকাল থেকেই কামনাতুরভাবেই ভালোবাসতেন নারীদের; তিনি তাদের ওপর প্রক্ষেপ করেছিলেন তাঁর কৈশোরিক অভিলাষগুলো : কল্পনা করতে তিনি ভালোবাসতেন যে তিনি উদ্ধার করছেন কোনো অচেনা রূপসীকে এবং পাচ্ছেন তার প্রেম। প্যারিসে এসে তিনি যা অতিশয় ব্যাকুলভাবে চান, তা হচ্ছে ‘এক রূপসী নারী; আমরা পরস্পরকে ভালোবাসবো গভীরভাবে, সে জানবে আমার আত্মাকে’। বৃদ্ধকালে, তিনি ধুলোয় নাম লেখেন সে-নারীদের, যাদের তিনি ভালোবেসেছিলেন সবেচেয়ে বেশি। নারীরা অনুপ্রাণিত করেছিলো তাঁর বইগুলো, ওগুলো ভরে আছে নারীমূর্তিতে; এবং সত্য হচ্ছে বেশির ভাগ তিনি লিখেছেন তাদেরই জন্যে।

নারীর সকাতর এ-বন্ধু নারীরহস্যে বিশ্বাস করেন না, এ-কারণে যে তারা প্রকৃতই যেমন সে-রূপেই তিনি ভালোবাসেন তাদের; কোনো সারসত্তা চিরকালের জন্যে সংজ্ঞায়িত করে না নারীকে; ‘চিরন্তনী নারী’র ধারণাটি তার কাছে মনে হয় পণ্ডিতসুলভ ও হাস্যকর। ‘দু-হাজার বছর ধরে পণ্ডিতেরা এ-ধারণা বারবার ব্যক্ত করে এসেছেন যে নারীদের আছে এক অধিকতর প্রাণবন্ত আত্মা, পুরুষের আছে অধিকতর কাঠিন্য; নারীদের আছে ভাবনার কমনীয়তা পুরুষদের আছে মনোযোগ আকর্ষণের অধিকতর শক্তি। প্যারিসের এক কুঁড়ে যে একবার ভার্সাইয়ের উদ্যানে বেড়াতে গিয়েছিলো, সব কিছু দেখে সে সিদ্ধান্তেপৌঁচেছিলো গাছপালা পরিপাটি ছাটাকাটারূপেই জন্মে’। পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে-পার্থক্যগুলো দেখা যায়, সেগুলো প্রতিফলিত করে তাদের পরিস্থিতির পার্থক্য। কেননা নারীরা, উদাহরণস্বরূপ, হবে না তাদের প্রেমিকদের থেকে বেশি রোম্যান্টিক? ‘সূচিকর্মরত নারী, যে রত এক নীরস কাজে, যাতে ব্যবহৃত হয় শুধু তার হাত, সে স্বপ্ন দেখে তার প্রেমিকের; যখন প্রেমিক, তার স্কোয়াড্রনের সাথে অশ্বারোহণে চলে মুক্ত প্রান্তরে, ভুল পথে এগোলেই যার বন্দী হওয়ার সম্ভাবনা’। একইরূপে নারীদের বিচারবুদ্ধির অভাব আছে বলে অভিযুক্ত করা হয়। ‘নারী যুক্তির থেকে আবেগ বেশি পছন্দ করে, এবং এটা খুবই সহজ সরল ব্যাপার : আমাদের নির্বোধ প্রথানুসারে তারা যেহেতু কোনো পারিবারিক দায়িত্ব পায় না, তাই যুক্তি তাদের কাছে কখনোই উপকারী নয়… আপনার স্ত্রীকে চাষীদের সাথে আপনার দু-খণ্ড জমি দেখাশোনা করতে দিন, এবং আমি বাজি ধরতে পারি যে হিশেবনিকেশ আপনি রাখলে যা হতো রাখা হবে তার থেকে অনেক ভালোভাবে’। ইতিহাসে যদি পাওয়া যায় খুবই কম নারীপ্রতিভা, তার কারণ হচ্ছে সমাজ তাদের আত্মপ্রকাশের সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখে। ‘সব প্রতিভা যারা জন্ম নিয়েছেন নারীরূপে, তারা হারিয়ে গেছেন জনকল্যাণে; ভাগ্য যদি একবার সুযোগ দেয় তাদের নিজেদেকৃত করাতে, তাহলে দেখতে পাবেন তারা অর্জন করেছে দুরূহতম সাফল্য’।

তাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হতবুদ্ধিকর শিক্ষা; উৎপীড়নকারী সব সময়ই উৎপীড়িতকে পরিণত করতে চায় বামনে; পুরুষ ইচ্ছাকৃতভাবে নারীদের বঞ্চিত করতে চায় সুযোগসুবিধা থেকে। ‘আমরা নারীদের মধ্যে নিষ্ক্রিয় করে রাখি অসাধারণ মেধাপূর্ণ গুণরাশি, যা তাদের ও আমাদের জন্যে হতে পারতো অসামান্য উপকারী’। দশ বছর বয়সে বালিকা তার ভাইয়ের থেকে দ্রুতগামী ও অনেক বেশি চালাক; বিশ বছর বয়সের তরুণ এক বুদ্ধিমান পুরুষ আর তরুণীটি ‘একটি আস্ত বোকালাজুক এবং ভয় পায় মাকড়সাকে’; দোষ দিতে হবে তার শিক্ষাকে। নারীদের শিক্ষা দিতে হবে পুরুষদের সমান। নারীবিরোধীরা অভিযোগ তোলে যে সুসংস্কৃত ও বুদ্ধিমান নারীরা দানবী; কিন্তু গোলমালটি এখানে যে তারা আজো ভিন্ন; যদি তারা সবাই পুরুষের মতোই পেতো সংস্কৃতি, তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই এ দিয়ে উপকৃত হতো। তাদের এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার পর, তাদের করা হয়েছে অস্বাভাবিক বিধানের অধীন : তাদের অনুভূতির বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে তাদের কাছে আশা করা হয় যে তারা হবে বিশ্বস্ত, এবং যদি বিবাহবিচ্ছেদ হয়, তাহলে সেটাকে গণ্য করা হয় অসদাচরণের মতো একটা ভৎসনার ব্যাপার বলে। কাজ ছাড়া তাদের জীবনে আর কোনো সুখ নেই বলে অসংখ্য নারী নষ্ট হয় আলস্যে। এসব ব্যাপার তেঁদালকে ক্রুদ্ধ করেছে, এবং তিনি এর মাঝেই দেখেছেন সমস্ত দোষ, যার জন্যে তিরস্কার করা হয় নারীদের। তারা দেবদূতী নয়, দানবী নয়, স্ফিংক্সও নয়; তারা নিতান্তই মানুষ, সমাজের জড়বুদ্ধি রীতিনীতি যাদের নামিয়ে দিয়েছে আধা-দাসীত্বের স্তরে।

তারা উৎপীড়িত হয় বলেই তাদের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে থাকে না সে-সব দোষ, যা বিকৃত করে তাদের উৎপীড়নকারীদের; তারা নিজেরা পুরুষের থেকে নিকৃষ্টও নয় উৎকৃষ্টও নয়; কিন্তু এক দুর্বোধ্য বিপর্যাসের ফলে তাদের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা তাদের অনুগ্রহই করে। একাগ্ৰমনস্কতাকে কতোটা ঘেন্না করতেন তেঁদাল, তা সুবিদিত : অর্থ, গৌরব, পদমর্যাদা, ক্ষমতা তার কাছে মনে হতো সবচেয়ে করুণ ব্যাপার বলে;অধিকাংশ পুরুষই লাভের কাছে বিক্রি করে দেয় নিজেদের; পণ্ডিত, গণ্যমান্য ব্যক্তি, বুর্জোয়া, স্বামী–সবাই তাদের ভেতরের জীবন ও সত্যের প্রতিটি স্ফুলিঙ্গকে নিভিয়ে ফেলে ছাই চাপা দিয়ে; গতানুগতিক চিন্তাভাবনা ও হাতের কাছে পাওয়া আবেগ দিয়ে এবং সামাজিক বিধিবিধানের সাথে খাপ খাইয়ে, তাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই থাকে না; এসব আত্মবর্জিত প্রাণীদের আবাস যে-বিশ্ব, তা এক নির্বেদের মরুভূমি। দুর্ভাগ্যবশত আছে বহু নারী, যারা গড়ায় একই ধরনের দুঃখদায়ক নর্দমায়; এগুলো হচ্ছে ‘সংকীর্ণ ও প্যারিসি ভাবভাবনার’ পুতুল, বা ভণ্ড ভক্ত। তেঁদাল আমরণ ঘৃণা বোধ করেন ‘সম্রান্ত নারীদের ও তাদের অপরিহার্য ভণ্ডামোর’ প্রতি; তারা তাদের তুচ্ছ কাজকে করে তোলে একই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ, যা তাদের স্বামীদের করে কৃত্রিমতায় অনমনীয়; কুশিক্ষার ফলে নির্বোধ, ঈর্ষাকাতর, শূন্যগর্ভ, পরচর্চাকারী, আলস্যে অপদার্থ, শীতল, শুষ্ক, ভানপূর্ণ, বিদ্বেষপরায়ণ, তারা ভরে রেখেছে প্যারিস ও মফস্বলগুলো; আমরা তাদের দেখতে পাই একজন মাদাম দ্য রিনাল, একজন মাদাম দ্য শস্তেলেকে ঘিরে। স্তেদাল চরম অমঙ্গলকামী যত্নের সাথে যে-একজনকে চিত্রিত করেছেন, তিনি নিঃসন্দেহে মাদাম গ্রদে, যার মাঝে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন মাদাম রোলা, মেতিলদের সম্পূর্ণ বিপরীতকে।

ছয়
সারসংক্ষেপ

এসব উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে প্রত্যেক লেখক প্রতিফলিত করেন যৌথ মহকিংবদন্তি : আমাকে নারীকে দেখেছি মাংস হিশেবে; পুরুষের দেহ উৎপাদিত হয়। মায়ের দেহের ভেত্তরে এবং পুনরায় সৃষ্ট হয় প্রেমিকা নারীর আলিঙ্গনে। তাই নারী প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত, সে একে করে প্রতিমূর্তিত : রক্তের উপত্যকা, প্রস্ফুটিত গোলাপ, সাইরেন, পাহাড়ের বক্রতা, সে পুরুষের কাছে উর্বর মাটি, রস, বস্তুর। সৌন্দর্য এবং বিশ্বের আত্মা। কবিতার চাবি সে ধরে রাখতে পারে তার হাতে; সে হতে পারে তার এ-বিশ্ব ও বাইরের মধ্যে মধ্যস্থতাকারিণী: সে সৌন্দর্যের দেবী বা দৈববাণীর যাজিকা, নক্ষত্র বা অভিচারিণী, সে দরোজাখোলে অতিপ্রাকৃতের, পরাবাস্তবের। সে সীমাবদ্ধতায় নষ্ট হওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট; এবং তার অক্রিয়তার মধ্য দিয়ে সে বিতরণ করে শান্তি ও সঙ্গতি–কিন্তু যদি সে প্রত্যাখ্যান করে এ-ভূমিকা, তাকে দেখা হয়আরাধনাকারী ম্যান্টিসরূপে, রাক্ষসীরূপে। যা-ই ঘটুক, সে দেখা দেয় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অপরুরূপে, যার মাধ্যমে কর্তা লাভ করে চরিতার্থতা : পুরুষের এক মানদণ্ড, তার ভারসাম্য রক্ষাকারী, তার পরিত্রাণ, তার অভিযাত্রা, তার সুখ।

কিন্তু এসব কিংবদন্তি বিভিন্নরূপে বিন্যস্ত হয়েছে আমাদের লেখকদের হাতে। মতেরর কাছে সীমাতিক্ৰমণতা হচ্ছে পরিস্থিতি : তিনি সীমাতিক্রমণকারী, তিনি ওড়েন বীরদের গগনে; নারীরা তার পায়ের নিচে গুটিসুটি মেরে হাঁটে মাটির ওপর; তাঁর ও নারীর মাঝে যে-দূরত্ব, সেটা মেপে তিনি মজা পান; কখনো কখনো তিনি নারীকে নিজের কাছে তুলে নেন, তাকে গ্রহণ করেন, তারপর তাকে ছুঁড়ে ফেলেন; কখনোই তিনি নিজেকে নামান না নারীর কর্দমাক্ত ছায়ার জগতের কাছে। লরেন্স সীমাতিক্ৰমণতা স্থাপন করেন শিশ্নে; শুধু নারীর দয়ায়ই শিশ্ন হচ্ছে জীবন ও শক্তি; সীমাবদ্ধতা তাই শুভ ও প্রয়োজনীয়; যে-মিথ্যা নায়ক ভান করে যে তার পা মাটিতে পাড়া দেয়ার জন্যে নয়, নরদেবতা হওয়া দূরে থাক সে পুরুষের অবস্থাও অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ক্লদেল দাবি করেন একই গভীর অনুরক্তি; তাঁর কাছে নারীর কাজ হচ্ছে জীবন লালন, যখন পুরুষ কর্মের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে যায় এর সীমা; তবে ক্যাথলিকের কাছে সমস্ত পার্থিব কর্মকাণ্ড নিমজ্জিত অসার সীমাবদ্ধতায়: একমাত্র সীমাতিক্রমণকারী হচ্ছেন বিধাতা; বিধাতার চোখে কর্মী পুরুষ এবং যে-নারী সেবা করে সে-পুরুষের, তারা পুরোপুরি সমান; প্রত্যেকের কাজ হচ্ছে তার পার্থিব অবস্থাকে পেরিয়ে যাওয়া : সব ক্ষেত্রেই পাপপরিত্রাণ এক স্বায়ত্তশাসিত কর্মোদ্যোগ। ব্রেতো নারীকে ভক্তি করেন, কেননা সে শান্তি আনয়ন করে।

তাদের প্রত্যেকের কাছে সে-ই আদর্শ নারী, যে সবচেয়ে যথাযথভাবে মূর্ত করে অপরকে, যে প্রকাশ করতে সমর্থ পুরুষের নিজের কাছে নিজেকে। মতেরল, সৌর চৈতন্য, নারীর ভেতরে খোঁজেন বিশুদ্ধ পশুত্ব; লরেন্স, শিশ্নবাদী, নারীকে অনুরোধ করেন সাধারণ নারী-লিঙ্গকে সংক্ষিপ্তরূপে ধারণ করতে; ক্লদেল নারীকে সংজ্ঞায়িত করেন আত্মার বোনরূপে; ব্রেতো হৃদয়ে লালন করেন মেলুজিনেকে, যার শেকড়ছড়ানো প্রকৃতির ভেতরে, তিনি গভীর আস্থা পোষণ করেন নারী-শিশুর সহায়তার ওপর; স্তেদাল চান তাঁর দয়িতা হবে বুদ্ধিমান, সুসংস্কৃত, চেতনা ও আচরণে স্বাধীন : সমান একজন। কিন্তু সমান একজনের, নারী-শিশুর, আত্মার বোনের, নারী-লিঙ্গের, নারী-পশুর জন্যে যে-একমাত্র পার্থিব নিয়তিটি নির্ধারিত হয়ে আছে, তা সব সময়ই হচ্ছে পুরুষ। যে-কোনো অহংই নারীর ভেতরে নিজেকে খুঁজুক না কেননা, সে নিজেকে পেতে পারে শুধু তখনই, যদি নারী রাজি হয় তার মহাপরীক্ষারূপে কাজ করতে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নিজেকে ভুলে যেতে হবে নারীকে এবং ভালোবাসতে হবে। মতেরল সে-নারীকে করুণা করতে রাজি, যে তাকে পরিমাপ করতে দেয় তার পৌরুষ; লরেন্স সে-নারীর উদ্দেশে নিবেদন করেন জ্বলন্ত স্তোত্র, যে লরেন্সের জন্যে বিসর্জন দেয় নিজের সত্তা; ক্লদে উন্নীত করেন সে-দাসীকে, নারী-ভত্যকে, ভক্তকে, যে পুরুষের অনুগত হয়ে অনুগত হয় বিধাতার; ব্রেতো নারীর থেকে আশা করেন। মানুষের পাপমোচন, কেননা নারী তার সন্তান ও তার প্রেমিককে সামগ্রিকভাবে। ভালোবাসতে সমর্থ; এবং এমনকি তেঁদালেও নায়িকারা অনেক বেশি মর্মস্পর্শী তার পৌরুষসম্পন্ন নায়কদের থেকে, কেননা নারীরা তাদের সংরাগের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে অধিকতর বিহ্বল প্রচণ্ডতার সাথে; তারা পুরুষকে তার নিয়তি চরিতার্থ করতে সাহায্য করে, যেমন প্রোহেৎ সহায়তা করে রদরিগের পাপমোচনে; স্তেদালের উপন্যাসে প্রায়ই ঘটে যে নারীরা তাদের প্রেমিকদের রক্ষা করে ধ্বংস, কারাগার, বা মৃত্যু থেকে। মঁতেরলঁ  ও লরেন্স নারীর ভক্তিকে তার দায়িত্ব হিশেবে দাবি করেন। ক্লদেল, ব্রেতোঁ, ও তেঁদাল একে একটা স্বাধীন পছন্দের কাজ হিশেবে দেখেন মুগ্ধচোখে; এটা তারা প্রাপ্য বলে দাবি করেন না, তবে কামনা করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *