২০.রায়-নন্দিনী – বিংশ পরিচ্ছেদঃ আত্মদান

বিংশ পরিচ্ছেদঃ আত্মদান

অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমাংশ বিগতপ্রায়। স্বর্ণময়ীর বিবাহের আর দশ দিন মাত্র অবশিষ্ট। শ্রীপুরের রাজবাটীতে বিবাহের জন্য বিশেষ সমারোহ ব্যাপার। স্বর্ণের উদ্বেগ ও অশান্তি চরমে উঠিয়াছে। তাহার পরিণাম যে কি ভয়াবহ হইবে, ভাবিয়া তাহার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিতেছে। স্বর্ণের তপ্ত স্বর্ণের ন্যায় বর্ণ বিবর্ণ হইয়াছে। তাহার মুখ শুঙ্ক, বদনমণ্ডল মলিন! জহিরুল হকও বিশেষ চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন। তবে তাঁহার মহাজ্ঞানী মহীউদ্দীন সাহেবের বাক্যের উপরে নির্ভর করিয়াই কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত রহিয়াছেন।

ইতিমধ্যে অগ্রহায়ন মাসের ১৫ই তারিখ বৃহস্পতিবার প্রাতে সূফী মহীউদ্দীন সাহেব জহিরুল হককে ডাকিয়া বলিলেন, “এখনি তুমি রায়-নন্দিনীকে লয়ে বিজয়নগরে যাত্রা কর। তথায় গেলেই তোমাদের সিদ্ধ হবে।”

জহিরুল হক সূফী সাহেবের আদেশে আনন্দে উৎফুল্ল হইলেন। বিজয়নগর গমন কষ্টসাধ্য হইলেও, তথায় গমন করিলে সোনামণির অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে এই আশায় তাঁহার হৃদয়ে উৎসাহের সঞ্চার হইল। তাঁহার পরশ স্নেহপাত্রী, দুর্দিনের পরম বন্ধ সোনার মঙ্গল চিন্তায় জহিরুল হক ডুবিয়া গিয়াছিলেন; কাজেই তাহার সুখের জন্য যে কষ্ট স্বীকার, তাহা তাঁহার কাছে নূতন সুখের নিদান বলিয়াই বোধ হইল।

পরদিন নিশাশেষে ঊষার শুভ্র হাস্যরেখা প্রকাশিত হইবার পূর্বেই জহিরুল হক স্বর্ণময়ীকে লইয়া ছদ্মবেশে অশ্বারোহণে শ্রীপুর ত্যাগ করিলেন। জহিরুল হক দুইজন বিশ্বস্ত ভৃত্যকেও সঙ্গে লইলেন। স্বর্ণময়ী অশ্বারোহণে অনভ্যস্তা হইলেও কিছু দিনের মধ্যে অল্পে অল্পে কিঞ্চিৎ পটুতা লাভ করিল। জহিরুল হক সকল বিষয়েই পিতার ন্যায় স্বর্ণময়ীর যত্ন লইতে লাগিলেন। স্বর্ণময়ী নানাদেশ ও জনপদ, অসংখ্য নদী ও মাঠ, নগর ও পল্লী অতিক্রম করিয়া ঊনত্রিশ দিনে বিজয়নগরে উপস্থিত হইলেন।

ঈসা খাঁ তখন ঘোরতর পীড়িত। সেই বিষদিগ্ধ শল্যের আঘাতে তাঁহার বাণ্হুর বিয়দংশ পচিয়া গিয়াছে। জ্বরের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। শরীর শীর্ণ, কান্তি-শ্রী মলিল। সোলতান নিজাম শাহের খাস চিকিৎসক ‘জোবদাতল হোকামা’ আহমদুল্লাহ্‌ খান সাহেব বিশেষ যত্নে তখন চিকিৎসা করিতেছিলেন। ক্ষতস্থানের পচনক্রিয়া কিছুতেই বন্ধ হইতেছে না। ক্ষত শুঙ্ক না হওয়ার জন্য জ্বরও বন্ধ হইতেছে না। ঈসা খাঁ নিজের অনুচর ও ভৃত্যগণ এবং সোলতানের নিয়োজিত ব্যক্তিগণ প্রাণপণে তাঁহার সেবা-শুশ্রুষা করিতেছেন। স্বয়ং সোলতান নিজাম শাহ প্রতি শুক্রবারে তাঁহাকে দেখিতে আসেন।

ঈসা খাঁয় যখন এই অবস্থা, ঠিক সেই সময়ে স্বর্ণময়ী ও জহিরুল হক বিজয়নগরে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা প্রাণপণে শুশ্রূষায় যোগদান করিলেন। ঈসা খাঁর শোচনীয় অবস্থা বিলোকনে স্বর্ণ, অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। ঈসা খাঁ তাঁহার রোগশয্যা-পার্শ্বে হৃদয়-প্রতিমা স্বর্ণকে অপ্রত্যাশিত এবং অচিন্তনীয়রূপে উপস্থিত দেখিয়া প্রেমাশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন। স্বর্ণের মুখ দেখিয়া ঈসা খাঁ প্রথমতঃ প্রফুল্ল, তৎপর তাহার ভবিষ্যৎ ভাবিয়া বড়ই বিমর্ষ হইলেন।

স্বর্ণ উপস্থিত হইবার তিন দিবস পরেই আয়েশা খানম ও অনুচর, সৈন্য ও ভৃত্যসহ পুত্রকে দেখিবার জন্য উপস্থিত হইলেন। বিজয়নগরের জলবায়ু অতীব স্বাস্থ্যপ্রদ ছিল বলিয়া চিকিৎসকগণ ঈসা খাঁকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে মত দিলেন না। বিশেষতঃ সুদূর পথ অতিক্রমের নানা অসুবিধায় তাঁহার শরীর আরও দুর্বল হইতে এবং পীড়ার উপসর্গ আরও বৃদ্ধি পাইতে পারে। দাক্ষিণাত্যের সোলতান চতুষ্টয় নিজ নিজ প্রধান চিকিৎসকদিগের দ্বারা পরম আগ্রহে ঈসা খাঁর চিকিৎসা করাইতে লাগিলেন। রাজচিকিৎসকগণ বহু চেষ্টায় জ্বর বন্ধ করিতে সক্ষম হইলেন বটে, কিন্তু ক্ষত আরোগ্য হইল না। বরং জ্বর বন্ধ হইবার পরে ক্ষত কিছু বাড়িতে লাগিল। তাহাতে ঈসা খাঁ জীবন সম্বন্ধে নিরাশ হইয়া পড়িলেন। তাঁহার বাহু হইতে ছয় অঙ্গুলি দীর্ঘ এবং তিন অঙ্গুলি চওড়া স্থানের ক্ষত কাটিয়া ফেলিয়া সেই স্থলে যদি কোন সুস্থ এবং নির্দোষ-রক্ত যুবাব্যক্তির বাহুর সেই অংশ কাটিয়া বসাইয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে এই ক্ষত আরোগ্য হইতে পারে।

‘জোবদাতল হোকামা’ আহমদুল্লাহ্‌ খানের এ মত, অন্যান্য হাকিমগণের দ্বারা সমর্থিত হইলে, সোলতান নিজাম শাহ্‌ প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত আসামীগণের মধ্য হইতে একজন সুস্থকায় যুবকের বাহুর মাংসচ্ছেদ করিয়া ঈসা খাঁর ক্ষতস্থানে বসাইবার প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু ঈসা খাঁ তাহাতে ঘোরতর আপত্তি প্রকাশ করিলেন। তাঁহার জন্য আর এক ব্যক্তির প্রাণসংশয় ব্যাপার এবং ভীষণ ক্লেশ উপস্থিত হইবে, তাহা তিনি সহ্য করিতে পারিবেন না। তাঁহাকে অনেক বুঝান হইল, কিন্তু তিনি কিছুতেই সম্মত হইলেন না। বরং উত্তরোত্তর বিরক্ত এবং উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার জন্য কোন ব্যক্তির মাংসচ্ছেদ করিলে তিনি নিজের গলায় ছুরি লইবেন, ইহাও দৃঢ়তার সহিত জানাইলেন। স্বর্ণ নিজ বাহু হইতে মাংস দিবার জন্য বিষম আকুলতা প্রকাশ করিতে লাগিল, কিন্তু ঈসা খাঁ তাহাতেও হইলেন না। স্বর্ণ অনেক বুঝাইল, অনেক কাঁদিল, অবশেষে ঈসা খাঁর পদতলে লুটাইয়া পড়িয়া অনেক কাকুতি-মিনতি করিল, কিন্তু ঈসা খাঁকে কিছুতেই সম্মত করিতে পারিল না।

স্বর্ণ বলিলঃ আপনার প্রাণই যদি রক্ষা না হয়, তা’ হ’লে আমার প্রাণের জন্য কিছুই মমতা নাই। আপনার জীবনেই আমার জীবন। আমি প্রাণ দিয়েও আপনাকে রক্ষা করব। আপনি না বাঁচলে, আমিও বাঁচব না। আমি প্রাণ দিয়ে আপনার জীবন রক্ষা করতে পারলেও সুখী হব। মাংস ছেদনে যে কষ্ট হবে, তা’ আমার সুখ এবং শান্তির কারণ হবে। আমাকে বেহুঁস করেও কাটতে হবে না। আমি নিজ হস্তে মাংস ছেদন করে দিব।

কিন্তু ঈসা খাঁ কিছুতেই সম্মত হইলেন না। অগত্যা স্বর্ণ নিরূপায় হইয়া আরও উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িল। ঈসা খাঁর প্রাণ রক্ষার জন্য স্বর্ণের ব্যাকুলতা এবং কাতরতা দর্শনে সকলেই বিস্মিত হইলেন। ঈসা খাঁর প্রতি স্বর্ণের প্রেম এবং অপার্থিব অনুরাগ সন্দর্শনে সকলেই তাহার প্রতি শ্রদ্ধাবান হইয়া পড়িলেন। তাহার স্নিগ্ধ এবং সুন্দর মুখমণ্ডলের পুণ্যশ্রী এবং উদার ও কাতরদৃষ্টিতে সকলেই তাহার দেব-হৃদয়ের পরিচয় পাইয়া পরম পুলকিত হইলেন। আয়েশা খানম পর্যন্ত পরম যত্ন ও আদর করিতে লাগিলেন। স্বর্ণের গুণে এবং অনুরাগে আয়েশা খানম এইরূপ মুগ্ধ এবং লুব্ধ হইয়া পড়িলেন যে, স্বর্ণকে তিনি পুত্রবধূরূপে পাইবার জন্য মনে মনে কল্পনা করিতে লাগিলেন।

পরদিবস প্রত্যুষে হাকিম আহমদুল্লাহ খান যখন ঈসা খাঁর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া তাঁহাকে অন্যের মাংসচ্ছেদ মত দিবার জন্য বুঝাইতেছিলেন, স্বর্ণ সেই সময় হাকিম সাহেবকে ইঙ্গিতে দৃঢ়তার সহিত বলিল, “আপনি বীরবর খাঁ সাহেবের তস্থান কেটে পরিস্কার করুন, আমি আপনাকে মাংস দিচ্ছি।”‘জোবদাতল হোকামা’ স্বর্ণময়ীর দৃঢ়তা ও ব্যাকুলতা দেখিয়া ইঙ্গিতে অন্যান্য সহকারীদিগকে সত্বর অস্ত্র-চিকিৎসার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করিতে বলিলেন। আয়োজন সম্পন্ন হইবার পরে সকলে বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে স্তম্ভিতভাবে দেখিলেন যে, একখানি শাণিত ছুরিকা দক্ষিণ হস্তে ধারণপূর্বক স্বর্ণময়ী অবিকম্পিত হস্তে শান্তভাবে অথচ ক্ষিপ্রতার সহিত তাহার বাম বাহুর উপরিভাগের অংশে গভীরভাবে বসাইয়া দিয়া মাংস কাটিতে লাগিল। ‘জোবদাতল হোকামার’ ইঙ্গিতে চকিতে স্বর্ণময়ীর বাহু হইতে মাংস লইয়া ঈসা খাঁর তস্থানে বসাইয়া দিলেন। ইত্যবসরে আর একজন অতি সত্বর একটি হরিণের জানুদদেশের উপরিভাগের মাংসচ্ছেদ-পূর্বক স্বর্ণের বাহুতে বসাইয়া এক প্রকার পূক্ষ্ম চূর্ণের প্রলেপ দিয়া তাঁহার উপরে বরফ চাপিয়া ধরিলেন।

এত ক্ষিপ্রতার সহিত এবং নীরবে এই গুরুতর অস্ত্র-চিকিৎসার কার্য সম্পন্ন হইল যে, ঈসা খাঁ স্বর্ণময়ীকে বাধা দিবার অবসর পর্যন্ত পাইলেন না। একবার তিনি “ওকি”! মাত্র বলিয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু সে শব্দ উচ্চারণের পূর্বেই স্বর্ণ তাহার বাহু হইতে মাংস বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল। ছয় অঙ্গুলি দীর্ঘ, তিন অঙ্গুলি প্রশস্ত এবং এক অঙ্গুলি পরিমিত গভীর ক্ষতের জন্য স্বর্ণময়ীর মুখে কেহ যন্ত্রণার বিন্দুমাত্র চিহৃও দেখিতে পাইল না। সকলেই স্বর্ণের ভূয়োভূয়ঃ প্রশংসা করিতে লাগিল। আয়েশা খানম স্বর্ণকে জড়াইয়া ধরিয়া আনন্দাশ্রু বর্ষণ সোলতান নিজাম শাহ স্বর্ণের এই অতুলনীয় সংসাহস এবং স্বার্থত্যাগ দর্শনে যার-পর-নাই প্রীত এবং মুগ্ধ হইলেন। প্রেমের স্বর্গীয় দৃশ্য দর্শনে সমগ্র বিজয়নগরবাসী নরনারী,-কি হিন্দু, কি মুসলমান সকলেই ধন্য ধন্য করিতে লাগিল! স্বর্ণময়ীর পুণ্য-কথা যত্রযত্র আলোচিত হইতে লাগিল। রাজ-কবিগণ স্বর্ণময়ীর এই পুণ্য প্রেমাসক্তি স্বার্থত্যাগের কবিতা রচনা করিয়া শাহী-দরবারে এবং সভা-সমিতি ও সম্মিলনীতে পাঠ করিতে লাগিলেন।

স্বর্ণকে দেখিবার জন্য বেগম ও শাহজাদী হইতে আরম্ভ করিয়া স্বর্ণকে গৃহে নানাশ্রেণীর অসংখ্য রমণীর সমাগম হইতে লাগিল। সোলতান ও বেগমগণ স্বর্ণময়ীকে ধর্মকন্যা বলিয়া সমাদর ও সম্বর্ধনা করিতে লাগিলেন। স্বর্ণের সুচিকিৎসা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের জন্য সর্বপ্রকারের শাহী বন্দোবস্ত করা হইল। ইশ্বরেচ্ছায় অল্পদিগের মধ্যেই ঈসা খাঁ এবং স্বর্ণময়ী আরোগ্য লাভ করিলেন।

ঈসা খাঁর রুগ্ন ও জীর্ণ দেহে আবার নবযৌবনের কান্তি-শ্রী ফিরিয়া আসিয়া লাগিল। হিমানী-পীড়িত শ্রীহীন-উদ্যান যেমন বসন্ত-সমাগমে নব-পত্র-পল্লব এবং ফল-ফুল মঞ্জুরীতে হিভূষিত হইয়া পিকবধূর আনন্দ বিধান করে, ঈসা খাঁর স্বাস্থ্য-শ্রীও তেমনি স্বর্ণময়ীর প্রাণে অতুল আনন্দ দান করিতে লাগিল। জীবনের স্বার্থকতার পূর্ণ পরিতৃপ্তি বোধে, জীবনানুভূতি স্বর্ণের নিকটে নিতান্তই সুবিধাময় বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। নিজের দুঃখ-কষ্ট বা অসুবিধার বিষয় স্থান পাইতে পারে, এমন একটু স্থানও হৃদয়ে রহিল না। তাহার হৃদয়-মন্দিরের প্রেমদেবতা, অন্তর-আকাশের পূর্ণচন্দ্রমা, মন-উদ্যানের মন্দাকিনীধারা জীবনকুঞ্জের শোভন গোলাপ-ঈসা খাঁকে যে মৃত্যুর কবল হইতে নব-জীবনে ফিরাইতে আনিতে পারিয়াছে, তাঁহার জন্য যে নিজ বাণ্ডর মাংসচ্ছেদ করিয়া দিবার সুযোগ পাইয়াছে, সেই মধুর ঘটনা ও উল্লাসে স্বর্ণময়ীর হৃদয়ের কুঞ্জে অপার্থিব প্রেমের সুধা রাগিণীর যে বিনোদ ঝঙ্কার বাজিয়া উঠিয়াছে, তাহাতে তাহার হৃদয় ভরপুর হইয়াছে। প্রেমাস্পদের জন্য স্বার্থত্যাগ এবং আত্মত্যাগে যে আনন্দ, তাহা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্যের পক্ষে ধারণা করা অসম্ভব। স্বর্গে সে আনন্দ নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *