১৮.রায়-নন্দিনী – অষ্টাদশ পরিচ্ছেদঃ কুলগুর যশোদানন্দের ইসলামে দীক্ষা

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদঃ কুলগুর যশোদানন্দের ইসলামে দীক্ষা

শাহ সোলতান সুফী মহীউদ্দীন কাশ্মীরী শ্রীপুরে উপস্থিত হইবার অল্পকাল পরেই তাঁহার যশঃ-সৌরভে শ্রীপুর পূর্ণ হইয়া গেল। সহস্র সহস্র লোকের দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁহার পবিত্র কর-স্পর্শে বিলুপ্ত হইতে লাগিল। চতুর্দিক হইতে ধনী-দরিদ্র বহু মুসলমান আসিয়া তাঁহার উপদেশ-রসামৃত পান করিয়া পিপাসিত প্রাণ শীতল করিল। অনেক হিন্দুও তাঁহার অমৃতনিস্যন্দিনী বক্তৃতা এবং কোরানের ব্যাখ্যা শ্রবণে ইসলামের পবিত্র কলেমা পাঠ করিয়া আপনাদের জীবন পবিত্র করির। ফলতঃ, শ্রীপুরের রাজবাটীতে দুর্গোৎসব এবং শ্রীপুরের ঘাটে সূফী সাহেবের নিকট লোক-সমাগম ও দীক্ষার উৎসবে শ্রীপুর অহোরাত্র জন-কোলাহলে মুখরিত হইতে লাগিল। হিন্দু-ধর্মত্যাগী নব মুসলমানদের জন্য হিন্দু সমাজে বিষম আন্দোলন উপস্থিত হইল।

পূজার উৎসব শেষ হইলে অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সম্মিলিত হইয়া হিন্দু ধর্ম রক্ষা করিবার জন্য এক বিরাট সভার আয়োজন করিলেন। শ্রীপুরেশ্বরের কুলগুরু মহাপণ্ডিত সার্বভৌম যশোদানন্দ ঠাকুরকে মুখপাত্র করিয়া সেই সভাস্থলে সুফী সাহেবকে আহবান করা হইল। সুফী সাহেবও বহু আলেম, ফাজেল এবং সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবেষ্টিত হইয়া সভাস্থলে গমন করিলেন। এই মহাসভার বিচার, বিতর্ক ও মীমাংসা শ্রবণ করিবার জন্য চতুর্দিক হইতে বিপুল জনতা আসিয়া সভাক্ষেত্র সমবেত হইল। দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয়ে সহস্রাধিক যোদ্ধা মুক্ত তরবারি করে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা কার্যে ব্যাপৃত হইল। যথাসময়ে রাজা কেদার রায়ের আদেশে সার্বভৌম যশোদানন্দ ঠাকুর বেদের প্রশংসা কীর্তন করিয়া ইসলাম ধর্ম এবং সুফী সাহেবের অযথা কুৎসা কীর্তন করিতে লাগিলেন। তিনি হিন্দু ধর্মের আক্রোশপূর্ণ কুৎসা কীর্তন করায় সমবেত হিন্দু-মুসলমান ভদ্রমণ্ডলী সকলেই দুঃখিত হইলেন। মুসলমানগণ ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন নামাজের সময় উপস্থিত হইলে পণ্ডিত যশোদানন্দ ঠাকুর বিদ্বেষ-হলাহল উদ্গীরন হইতে নিবৃত হইলেন এবং সুফী সাহেবও সমবেত মুসলমানগণকে লইয়া উপাসনায় প্রবৃত্ত হইলেন।

উপাসনা শেষ হইলে সুফী সাহেব উচ্চৈস্বরে “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ” এই কলেমা সমস্ত মুসলমানকে লইয়া প্রমত্ত অবস্থায় পাঠ করিতে লাগিলেন। কলেমার ধ্বনিতে চতুর্দিক প্রতিধ্বনিত হইল। কলেমা পাঠ করিতে করিতে সুফী সাহেব উন্মত্ত হইয়া পড়িলেন। যেন প্রদীপ্ত এবং কম্পিত হইয়া উঠিল! তৎপর তিনি সভা মধ্যে সহসা দণ্ডায়মান হইয়া পণ্ডিত যশোদানন্দের দিকে তর্জনী তুলিয়া তিনবার গুরুগম্ভীর মেঘমন্ত্রে বলিলেন, “হে যশোদানন্দ! তুমি সত্য গ্রহণ কর।”

শাহ সাহেব এইরূপ বলিবার পরে যে অদ্‌ভুদ ব্যাপার সাধিত হইল, তাহাতে সকলেই বিস্মিত এবং স্তুম্ভিত হইয়া পড়িলেন। ঠাকুর যশোদানন্দ বেগে সভামধ্যে উত্থিত হইয়া গম্ভীর রবে “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ” এই কলেমা অনবরত পাঠ করিতে লাগিলেন এবং যঞ্জসূত্র আকর্ষণ করতঃ ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। অতঃপর পণ্ডিতবর যশোদানন্দ ক্রন্দন করিতে করিতে শাহ সুফী মহীউদ্দীন সাহেবের চরণতলে লুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন। মুসলমানগণ আনন্দে “আল্লাহু আকবর” রবে আকাশ-পাতাল কাঁপাইয়া জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন।

যশোদানন্দ কাতর কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “হযরত, আমাকে পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করুন। ধর্মের আগুন আমার প্রাণের ভিতরে জ্বলে উঠেছে; আমার পাপ অন্তঃকরণ দগ্ধ হচ্ছে। আমি আর কাঠ-পাথরের পূজা করব না।” এই বলিয়া ঠাকুর দীক্ষিত হইবার জন্য বিষম ব্যগ্রতা প্রকাশ ও আরও গভীরভাবে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন।

সুফী সাহেব তখন তাহাকে ক্ষৌর কার্য ও স্নান সম্পন্ন করিতে আদেশ দিলেন। অল্পক্ষণ মধ্যেই পণ্ডিত যশোদানন্দ মস্তকের টিকি কাটিয়া নখ ও কেশাদি সংস্কারপূর্বক স্নান করিয়া, সভ্যজনোচিত আচকান পায়জামা ও টুপী পরিয়া দিব্যমূর্তিতে সুফী সাহেবের চরণপ্রান্তে স্থান গ্রহণ করিলেন। সুফী সাহেব তাঁহার হস্ত ধারণ করিয়া বিশ্বাসের মন্ত্রে তাঁহাকে দীক্ষিত করিলেন এবং তাঁহারা নাম জহিরুল হক রাখিলেন। মুসলমানগণ পুনরায় আনন্দোচ্ছ্বাসে আকাশ-পাতাল কাঁপাইয়া “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি করিয়া উঠিলেন। রাজকুলগুরু সর্বজনমান্য মহাপণ্ডিত যশোদানন্দ ঠাকুরের ইসলাম গ্রহণে হিন্দুগণ হাহাকার করিতে লাগিল! রাজা কেদার রায় দুঃখে এবং লজ্জায় সভাস্থল পরিত্যাগ করিয়া ক্ষুন্নমনে প্রাসাদে ফিরিলেন।

পণ্ডিত যশোদানন্দ ইসলাম গ্রহণ করিবার কয়েকদিন পরে, একদিন রাজা কেদার রায় তাঁহাকে পূর্ববৎ সমাদরে রাজ-দরবারে আহবান করিলেন। নবীন মুসলমান জহিরুল হক দুই চারিজন মুসলমান বন্ধুসহ রাজ-দরবারে আগমন করিলেন। রাজা সম্মানের সহিত তাঁহাকে গ্রহণ করিয়া কৃতঘ্নতাপূর্বক সহসা বন্দী করতঃ দুর্গাভ্যন্তরস্থ কারাগারে নিক্ষেপ করিলেন। রাজকীয় প্রহরী এবং অন্যান্য কর্মচারীগণ জহিরুল হকের প্রতি বিষম অত্যাচার করিয়া মনের ক্ষোভ মিটাইতে লাগিল। তাঁহার সমস্ত ভূসম্পত্তি রাজসরকারে বাজেয়াফত হইল।

জহিরুল হকের নিদারুণ লাঞ্জনা এবং নির্যাতনে কারাগৃহের পাষাণ-প্রাচীন এবং কতল অশ্রুজলে বিধৌত এবং আর্তনাদে শব্দায়মান হইতে লাগিল! দুর্গের অভ্যন্তরস্থ অতি নিভৃত কারাগারের সংবাদ বাহিরে কেহ অবগত না হইলেও, দুর্গের অভ্যন্তরস্থ ব্যক্তিদিগের কাহারও জানিতে বাকী থাকিল না। যশোধানন্দের নির্যাতন এবং লাঞ্জনায় সকলেই আনন্দিত হইল। অনেকের নিকট তাহা বৈঠকী গল্প, হাসি-ঠাট্রা এবং বিদ্রূপের বিষয়ে পরিণত হইল। কেবল করুণাময়ী স্বর্ণময়ীর কোমল প্রাণ যশোদানন্দের দুঃখে ব্যথিত হইল। স্বর্ণময়ী ভিতর দিয়া যশোদানন্দকে দেখিয়া আসিত। উদ্যানে কোন ফল পাইলে তাহাও প্রহরীকে বলিয়া গোপনে কুলগুরুকে দিয়া আসিত। যশোদানন্দ কারাগারের অসীম দুঃখ এবং নির্যাতনের মধ্যে করুণাময় পরাৎপর পরম পিতা পরমেশ্বরের ধ্যান-ধারণা এবং অর্চনা-আরাধনায় মনোনিবেশ করিয়া হৃদয়কে স্থির ধীর করিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহার নিষ্ঠা এবং গভীর ধর্মভাব দেখিয়া প্রহরীদিগের মধ্যে কয়েকজন তাঁহার প্রতি অতিশয় শ্রদ্ধাবান হইয়া উঠিল। হিন্দু থাকিতে যশোদানন্দকে তাহারা যেরূপ শ্রদ্ধা করিত, এণে তাহা অপেক্ষাও বেশী শ্রদ্ধা করিতে লাগিল। ক্রমে তাহারা যশোদানন্দের উপদেশে ইসলাম ধর্মের প্রতিও গভীর অনুরাগ প্রকাশ করিতে লাগিল। অতঃপর স্বর্ণ তাহাদের সহানুভূতি এবং সাহায্যে জহিরুল হকের খাদ্যের অসুবিধা দূর করিল। নানা প্রকার উৎকৃষ্ট ভোজ্যজাত সরবরাহ করিতে লাগিল। স্বর্ণময়ী জহিরুল হকের উদ্ধারের জন্য মস্তিস্ক বিলোড়ন করিতে লাগিল বটে, কিন্তু সহসা কোন নিরাপদ পস্থা উদ্‌ভাবন করিতে পারিল না। স্বর্ণ নিজের জীবনকে বিপদাপন্ন করিয়াও জহিরুল হককে মুক্ত করিবার জন্য প্রহরীকে অর্থলোভে বশীভূত করিতে চেষ্টা করিল। কিন্ত জহিরুল হক কিছুতেই সেরূপভাবে অন্যের জীবনকে বিপদাপন্ন করিয়া কারাগার হইতে পলায়ন করিতে রাজি হইলেন না।

অতঃপর স্বর্ণ সহসা একদিবস শিরঃপীড়ার ভাণ করিয়া আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিল। কোনও রূপেই সে শিরোবেদনার লাঘব হইল না, শিরঃপীড়ার সহিত নানা উপসর্গ আবিভূর্ত হইয়া স্বর্ণকে যারপর-নাই ব্যথিত করিয়া তুলিল। কবিরাজ এবং হাকিমগণ স্বর্ণের এই আকস্মিক ব্যধির কোন প্রতিকার করিতে পারিলেন না। অবশেষে স্বর্ণ একদিন শেষ রাত্রিতে গভীর চীৎকার করিয়া নিদ্রা হইতে শয্যায় উঠিয়া বসিল। স্বর্ণের জননী এবং পিতা সে-চীৎকারে ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া কারল জিজ্ঞাসু হইলে, স্বর্ণ বলিল, “উপাস্য কালিকাদেবী এসে রোষ-কষায়িতনেত্র গম্ভীরভাবে আমাকে বললেন যে, ‘তুই যদি বাঁচতে চাস, তা’ হ’লে তোর পিতাকে বলে কুলগুরুকে শীঘ্র মুক্ত করে যে নতুবা এই অগ্নিময় মুখে তোকে গ্রাস করব।’ এই মুখব্যাদান করলেন, অমনি তাঁর মুখ হতে ভীষণ অগ্নিশিখা বহির্গত হতে লাগল। ভয়ে আমি চীৎকার করে উঠলাম।”

স্বর্ণময়ীর স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনিয়া কেদার রায় তাহা যথার্থ বলিয়া বিশ্বাস করিলেন এবং কন্যার মঙ্গলাকাঙ্খায় পরদিন প্রত্যুষেই জহিরুল হককে কারামুক্ত করে দিলেন। জহিরুল হক স্বর্ণের উপস্থিত-বুদ্ধি এবং অসাধারণ সহানুভূতির পরিচয় পেয়ে পরমেশ্বরের সমীপে তাঁহার অজস্র মঙ্গল কামনা করিলেন। বলাবাহুল্য, সেইদিন দ্বিপ্রহর হইতে স্বর্ণময়ীর শিরঃপীড়া আরোগ্য হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *