2 of 2

প্রহসনের মতো – সাইয়িদ আতীকুল্লাহ

প্রহসনের মতো – সাইয়িদ আতীকুল্লাহ

গুজবে কান দেবো না।

হয় উদাসীন থাকবো, নয়তো বাধা দেবো। এমন কথা বলা যায় মনের জোর থাকলে। সংসারে অনেকরই তেমন সরেস মন আছে, শুনতে পাই। তাদের সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় নেই-থাকলে এ সংকটে আমার খুব কাজে লাগতো।

বলতে দ্বিধা নেই আমার মনটা বেশ দুর্বল। নানাজনের কথায় আমি সহজেই বিচলিত হয়ে পড়ি। বিশেষত বন্ধুদের কথায়। তার একটা কারণ হচ্ছে: আমার বিশ্বাস বন্ধু বলে যাঁদের জানি তারা দায়িত্বশীল ব্যক্তি, তাঁদের পরিমণ্ডলে জট খোলে। সন্দেহের এবং অনুভবের। তারা যে কখনো অনাবশ্যক গল্প ফেঁদে অশ্লীল জটিলতা সৃষ্টি করতে পারেন, একথা ভাবতে আমার মন সায় দেয় না। বরং ভাবি, দায়িত্ব পালনের পরিচ্ছন্ন তাগিদ উপেক্ষা করা যায় না বলেই তারা আমাকে নেহাত উপযাচক হয়ে মাঝেমাঝে অপ্রিয় কথা শোনান। রাস্তার লোককে ওসব কথা বলা হয় না, এজন্যে যে তাদের সম্পর্কে বন্ধুত্বের দায়িত্ব নেই। অনেক কিছু বাদ দিলেও অন্তত এজন্যে আমি বন্ধুদের কাছে অষ্টপ্রহর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসছি। আমার বন্ধুবর্গ নিশ্চয়ই তা খেয়াল করে থাকবেন।

কিন্তু দিন দিন আমি আরো অসুখি হয়ে উঠছি। ঘুম ভাঙবার পর সকালে মনে হয় প্রাণটা গলার কাছাকাছি এসে আটকে আছে। দুপুর হবার আগেই দিশেহারা লাগে। বিকেলে এমন অসুস্থ ও অপারগ ঠেকে সে শরীরের বাঁধন আলগা হয়ে আসে। ব্যক্তিগত দুর্দশার রূপটা যতো ভয়াবহই হোক না কেন তার জন্যে বন্ধুদের দায়ি করার কথা কখনো ভাবি নি। অপরিসীম দায়িত্ববোধের তাড়নায় তারা আমাকে যেসব খবরাখবর শুনিয়েছেন তাকে গুজব মনে করবার কোনো কারণ খুঁজে পাই নি। অবশ্য একথা ঠিক যে অন্য দশটা পাঁচটা ব্যাপারে বিচারবুদ্ধিকে যেরূপ স্বাধীন ও নিরাসক্তভাবে প্রয়োগ করা হয়, বন্ধুদের খবরখবরগুলোকে সেভাবে কখনো ধরা হয় নি। কাণ্ডজ্ঞানহীন গুজবরটনাকারী বন্ধুদের সম্পর্কে এসব ভাবা চলে তখনি যখন মনে সাহস থাকে, আর সাহস থাকলে অনেক কিছুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যায়। কেন যে আমার মনে তেমন জোর নেই। সাহস নেই। থাকলে এই অসুবিধেয় পড়তে হতো না। না শরীরের দিক থেকে, না মনের দিক থেকে। হয়তো সরাসরি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো যেতো। তাহলে কোথাও আর গোলমেলে কিছু থাকতো না।

গুজব ছড়ানোর জন্য দায়ি বন্ধুদের ঘৃণা করতে পারতাম, বিড়ম্বনার বোঝ হালকা করার জন্যে এসব বন্ধুদের বলা যেতো, এসব কাজ ভদ্রলোকের সাজে না, বুঝলে? আর তোমরা তো আমার বন্ধুজন।

গত তিন বছরের ভেতর এ ধরনের কোনো কাজ একবারের জন্যও পেরে উঠি নি। বন্ধুরা এসেছে, যেমনি তারা আসতো, দেখতে, কথা বলতে। তারা দেখেছে, আমি ভেতর থেকে নোনাধরা ইমারতের মতো ধ্বসে যাচ্ছি, এমনি বাইরের চুন, পলেস্তারাও আর আগের মতো নেই। খসে পড়ছে। লক্ষ করেছি, আমাকে নিয়ে তাদের যে উৎসাহ তা কিন্তু কমে নি।

একেক সময়, বিশেষ করে দুপুরের দিকে যখন আমার দিশেহারা লাগে, ভেবেছি, রাবেয়াকে ডেকে নিয়ে সব কথা খুলে বলি। সরাসরি জিজ্ঞাসা করি। এভাবে যে আর চলে না, আমি আর পারছিনে।

কিন্তু ওই পর্যন্তই।

রাবেয়াকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় না। নিজের এই অদ্ভুত দ্বন্দ্বের কথা মাথার ভেতর পাক খেতে থাকে যতক্ষণ না আমি একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার সব উদ্যোগকে সম্ভাবনাহীন দেখায়। আমি লজ্জিতবোধ না করে পারিনে। এমন ভাবনার পর কিছু সময় পর্যন্ত রাবেয়ার কথা মনে পড়লেও আমি কেমন সংকুচিত হয়ে পড়ি। ভয় হয়, চোখমুখ দেখে রাবেয়া আমার মনোভাব বুঝে ফেলবে।

রাবেয়া বুদ্ধিমতী, তার চেয়েও বড় কথা সে আমার স্ত্রী। কারণে অকারণে বিচিত্রবর্ণ আলো আমার মনের মধ্যে কখন হাট বসায় রাবেয়া তা জানে। যে সব ছায়ার গরে জীবনের সব অমঙ্গল লুকিয়ে থাকে তাদের সাথে তার পরিচয় আরও নিবিড় বলে আশ্চর্য নিপুণতার সাথে সে তাদের শত্রু হিসেবে চিরদিনের জন্যে চিহ্নিত করে রেখেছে। তার সতর্ক চোখকে ফাঁকি দিয়ে অশুভ কোনো কিছু আমার ত্রিসীমানায় ঢুকে পড়বে এ আশংকা রাবেয়া করে না। এমন যার আত্মবিশ্বাস শেষকালে পা হড়কালো তার? কিন্তু চোখের সামনে এ কার ছায়া!

চাপরাশি সুবিদালী। ইতস্তত করছে। বিরক্ত হয়ে বল্লাম, কী চাও?

বেগম সাহেবা বলেছিলেন এয়ার ফ্রেসনার নিয়ে যেতে।

কেনা হয়েছে?

না।

কেন?

আমেরিকান ফ্রেসনার এখন বাজারে নেই। জার্মানির তৈরি ওটা নেয়া কি ঠিক হবে?

হ্যাঁ হবে।

সুবিদালী নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

এই মুহূর্তে রাবেয়ার ওপর ভয়ানক রাগ হয়। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটে বেজে দশ মিনিট।

যদি সে আর আমাকে ভালো না বাসে তবে সে কথা জানালেই পারে। আমার জন্যে তা যতোই মর্মান্তিক হোক না কেন, নতুন পরিস্থিতিতে আমার পৌরুষ যতই হেয় তোক না কেন, রাবেয়ার উচিত সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে খোলাখুলি আমাকে জানো যা তার জীবনসঙ্গী হিসেবে আমি বাতিল হয়ে গেছি। এবং সে আমার চেয়ে যোগ্যর একজনকে খুঁজে পেয়েছে।

কিন্তু রাবেয়া মুখ ফুটে আজ অবধি কিছু বলে নি। আমার পক্ষেও জিজ্ঞাসা করা হয়ে উঠলো না।

রাবেয়া এবং আমার ভেত্র ব্যবধান বাড়ছে। অবশ্য এতে তার কোনো হাত আছে। বলে মনে হয় না। এ অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনের মতো। আমার একার কাজ। যেমনি ছিলো তেমনি আছে সে। তার ব্যবহারে কোথাও কোনো জড়তা নেই, দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই।

কখনো কখনো আমার ব্যবহারে অদ্ভুত কোনো কিছু ধরা পড়লে, রাবেয়া অনায়াসে আমার খুব কাছাকাছি চলে আসে। হাসিখুশি মুখে পলকের জন্যে ছায়া পড়ে। কিন্তু আমার মতো আতংকে সে ব্যব্যিস্ত হয় না। কিছু একটা যে ভাববার চেষ্টা করে না তা নয়। তবে সে কয়েক মুহূর্তের জন্যে—মনে হয় অবলম্বনহীন হয়ে ওর ভাবনা দাঁড়াতে পারে না। একটু ছটফট করে, একটু চঞ্চল হয়, তারপর সে নিজের স্বভাবে এবং উচ্ছলতায় মুক্তি পায়।

সেই হাসিখুশি মুখ।

অনর্গল কথার ঠাস বুনুনি।

সবচেয়ে উঁচু আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে সে আমার মুখোমুখি দাঁড়ায়, স্বচ্ছ, সুন্দর এবং জীবন্ত।

আমার মন যে কুটিল সন্দেহে বেঁকেচুরে কদাকার হয়ে আছে, সারাক্ষণ ধরে বিষিয়ে আছে, রাবেয়া সে কথা বুঝতে পারে না। মরিয়া হয়ে ভাবি, হয়তোবা না বোঝার ভান করে।

আর তো দেরি করা যায় না। ইতিমধ্যে টেলিফোন তিনবার বেজেছে। রিসিভার তুলে নিই, হ্যালো।

ওধারে স্টানলি মুরার। শুরু করেছিলো গিল্ট সিকিউরিটি দিয়ে। আসল কথা অবশ্য তা নয়। ডিবেচারের প্রস্তাবনা নিয়ে সে হিমশিম খাচ্ছে। এ ব্যাপারে মুরার বিশেষজ্ঞ। তার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না কোনোদিন।

বল্লাম, তোমার বিশ্লেষণ যথার্থ অর্থে তোমারি মতো। কোনোকিছু বাদ পড়ে নি। যা হয় একটা করে ফেলো না কেন? না হয় কালকে একটা মিটিং ডাকো। আলোচনা করে নাও বুড়োর সাথে।

বুড়ো মানে এ আপিসের বড় সায়েব। ক্রিস্টোফার হেনিংস, বেলজিয়ান। আমার এ প্রস্তাব মুরারের মনঃপূত হয়েছে। ধন্যবাদ জানিয়ে সে টেলিফোন ছেড়ে দিলো।

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় রাবেয়া জিজ্ঞাসা করেছিলো, আপিস থেকে আজকে একটু সকালে আসতে পারবে?

কেন জানিনে একথা শুনে হঠাৎ বুকের ভেতর ধরাস করে উঠেছিলো, বুঝিবা এক ঝলক রক্ত মুখে ভিড় জমিয়ে থাকবে। চায়ে চুমুক দিয়ে কোনোরকমে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে করতে বল্লাম, কেন বলোতো?

রাবেয়া বল্লো, তোমার সাথে গুটিকতক জরুরি কথা আছে।

আমি একটু বিরক্ত বোধ করি, তার জন্যে আপিস থেকে আগে চলে আসার দরকার কী? আমার জবাব দেবার ধরনটা তেমন ভালো ছিলো না, কথায় ঝাঁঝ ছিলো, বক্রতা ছিলো। রাবেয়া মনে করতে পারতো এ আচরণ অন্যায়, অপ্রত্যাশিত এবং নিষ্ঠুর। কেন যে সে চটে গেলো না তা অবশ্য এখন অবধিও আমার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কী আমার আচরণ যতোই অসমতল হোক না কেন, লক্ষ করেছি, রাবেয়া তাতে কখনো বিরক্ত বোধ করে না।

স্বাভাবিক স্বরে রাবেয়া বল্লো, বিকেলে, পাঁচটার দিকে, আমার স্কুল কমিটির একটা মিটিং রয়েছে। ওখানে যাবার আগে তোমার পরামর্শ নেবার ইচ্ছে। জানোইতো তোমার সাথে আলোচনা না করলে আমি কিছুই ঠিকমতো করে উঠতে পারিনে। সেজন্যে বলছিলাম যদি একটু আগে আসতে পারতে।

প্রায় দপ করে জলে উঠেছিলাম। সামলে নিলাম। এখন এই কথার সূত্র ধরে অনায়াসে রাবেয়াকে জব্দ করা যায়। একবার মনে হয়েছিলো এ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আবার ভাবি, মেজাজ করলে রাবেয়া ধরে নেবে এ আমার অক্লান্তির বিকার। বুঝবে না আমার মনে একটা পুরনো আক্রোশ আছে। ধারালো, শানানো কিছু কথা, কিছু চিৎকার জিবের ডগায় চলে এসেছিলো। গণ্ডগোল বাঁধালো বুড়ো বাবুর্চি, প্যাসেজে দাঁড়িয়ে রাবেয়াকে ডাকলো, চিংড়ি দিয়ে কী করবো মা?

ক্ষিপ্র পায়ে বেরিয়ে যাবার সময় রাবেয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, এক সেকেন্ড। বাবুর্চিকে বুঝিয়ে দিয়ে আসি।

বাবুর্চির সাথে রাবেয়া রান্নাঘরে ঢোকে। শুনতে পাই, বাবুর্চি মাঝে মাঝে হুঁ হুঁ। করছে। এভাবেই সে তার করণীয় কাজ রাবেয়ার কাছ থেকে বুঝে নেয়। বাবুর্চির গলাটা অদ্ভুত, স্বর জোরালো, খুব গভীর কোনো জায়গা থেকে উঠলে অন্যের কানে খুব খারাপ শোনায়। এটা কি তার কথা বলার বিশেষ ধরনের জন্যে, না অন্য কোনো কারণে তা নিয়ে মনে মনে বিস্তর গবেষণা করেছি। সদুত্তর পাওয়া যায় নি। রাবেয়ার ধারণা স্বরে আঁটসাট বাঁধুনি জিভের কাছে এসে হাসি ছেড়ে দেওয়ার ফলে বাবুর্চির কথা শ্রুতিমধুর ঠেকে না।

হচ্ছে কী!

এক সেকেন্ড, ওটা আসলে কথা বলার ভঙ্গি। রাবেয়া ফিরে এসে নিজের কাপে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞাসা করেছিলো আমি আরও একটু চা নেব কিনা। উত্তর দেবার সময় পাওয়া যায় নি। সে ধরে নিয়েছিলো আমার দিক থেকে আরেক কাপ বাড়তি চায়ের ব্যাপারে আপত্তি থাকবে না। রাবেয়া হেসে ওঠে।

বাবুর্চি আজকাল বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে। এখন ওকে আগের চেয়ে অনেক বেশি বোঝাতে হয় বোধহয় বুড়িয়ে যাচ্ছে।

ছাড়িয়ে দাও না হয়! বাবুর্চিকেও যদি রান্নাবান্নার বুদ্ধি ধার দিতে হয় তোমার তাহলে বিশ্ব সংসারের জন্যে কী রাখছো?

কথায় হয়তো প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ ছিলো। রাবেয়া আমার মুখের দিকে সোজাসুজি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে, এ বাবুর্চি থাকবে। যতদিন তার খুশি।

পোর্টিকো পর্যন্ত এগিয়ে দেয় রাবেয়া। গাড়িতে ওঠার সময় আমাকে চমকে দিয়ে বলেছিলো, একটু আগে সময় করে চলে এসো। হ্যাঁ?

আচ্ছা।

আপিসের দিকে যেতে যেতে ভাবছিলাম। রাবেয়ার ইচ্ছাই জয়ী হলো।

.

আপিসে বসেও নিজেকে কেমন প্রতারিত মনে হতে থাকে। সারাদিন ধরে ভেতরে ভেতরে তীব্র তুখোড় বাদানুবাদ চলছে। আর এই অস্থিরতার সাথে পাল্লা দিতে হয় বলে আপিসের কাজকর্ম দিন দিন আরও যেন বেশি করে ভালো লাগছে।

।আবার টেলিফোন!

এবারে ক্রিস্টোফার হেনিংস। স্বভাবসুলভ মিষ্টি গলায় বুড়ো বলেন, তোমার সাথে একটু কথা ছিলো তারেক। কামরায় আসবে একটু?

এক্ষুণি পৌঁছে যাব।

হেনিংস-এর ঘর একতলা নিচে।

বেরুবার সময় স্টেনোগ্রাফার গোমেজকে বলে গেলাম ব্যাগ গাড়িতে তুলে দেয়ার জন্য।

রাবেয়াকে কথা দিয়েছি। বুড়োর ওখান হয়ে সোজা বাড়ি চলে যাবো।

সিঁড়ির দিকে এগুবার সময় মাঝবয়েসি গোমেজের করুণ মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বেশ কিছুদিন থেকে কাজে কর্মে সে আর তেমন উৎসাহ বোধ করে না। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে বলে আজকাল খুব মনমরা হয়ে থাকে। আমাকে সে প্রাণভরে ভালোবাসে। সমীহ করে সেও মোটামুটি বলতে গেলে প্রাণের মনে। হয়তো একারণেই সে বোঝে আমি দীর্ঘদিন ধরে বিপদাপন্ন হয়ে রয়েছি। আপিসের কাজ নিয়ে আতিশয্য গোমেজের চোখ এড়ায়নি।

বুড়ো হেনিংস-এর অভ্যর্থনার ধরনটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও আন্তরিক। কেবলমাত্র ভালোভাবে রপ্ত করা কায়দা কেতা নয়। ফলে তার সঙ্গ ভালো লাগে।

বুড়ো তার একমাত্র ছেলের কথা দিয়ে শুরু করেন। আজকে সকালের ডাকে একটি চিঠি পেয়েছেন। আর্নেস্ট যোহানেস হেনিস কঙ্গোতে চলে যায় মাত্র বাইশ বছর বয়সে। পুরোহিতের জোব্বা গায়ে চড়িয়ে। সাপ খোপ, হিংস্র জানোয়ার, দুঃসহ গরম বা সভ্যতার নিচুস্তরে লোকদের বর্বর আচার আচরণ কোনোকিছুই তাকে দমাতে পারে নি। ওদেশের পাহাড়ে জঙ্গলে বা অনাব্য নদীর তীরে সুদীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে যিশুরও তার ইয়ত্তা মঙ্গলময় ঈশ্বরের বাণী প্রচার করছে। তার একান্ত চেষ্টার ফলে মানুষখেকোরা পর্যন্ত ঈশ্বর-অনুসারী ও যিশু-ভক্ত হয়ে উঠছে। কঙ্গোর নানা জায়গায় ঈশ্বরের নামে তারা সঙঘবদ্ধ হচ্ছে।

ছেলের কথা বলতে বলতে বুড়ো আজকে কেমন যেন উদাস হয়ে পড়েন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওকে একবার এদেশটা দেখে যাবার জন্যে নেমন্তন্ন পাঠান না কেন? না হয় আপনার হয়ে আমরাই পাঠাই।

কিছু লাভ নেই। তার যে অনেক কাজ। হ্যাঁ, যে জন্যে তোমাকে ডেকেছিলাম।

বুড়ো হেনিংস থামেন। একটা সরু বেলজিয়ান চুরুটের মুখে আগুন লাগিয়ে নিবিষ্ট মনে চুরুটটা পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হবার পর বল্লেন, বোর্ড অব ডাইরেক্টরসকে আমি লিখেছিলাম। বোর্ড তোমাকে চার মাসের ছুটি দিতে রাজি হয়েছে। তোমার সৌভাগ্যে আমি কিন্তু রীতিমতে ঈর্ষাবোধ করছি।

বুড়ো উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়েন। বোর্ডের চিঠিটা আমার সামনে এগিয়ে দিলেন, বিলেতে অথবা ইউরোপের যে-কোনা জায়গায় ছুটিটা কাটাতে পারো।

ছুটি নেয়ার ব্যাপারে ওজর আপত্তি বা বাগবিস্তারেব অবকাশ আর নেই। তবে যেভাবে ছুটি জুটলো সে সম্পর্কে কিছু জানা দরকার। বল্লো, আমিতো ছুটি চাই নি।

তোমার হয়ে আমি চেয়েছিলাম। তোমাকে জানানো উচিত ছিলো সে কথা মানি। জানানো হয় নি সে জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।

সাগরপারের বোর্ড যে কাজ ইতিমধ্যে অনুমোন করে পাঠিয়েছে, তাকে প্রত্যাখ্যান করলে একটা হুলুস্থুল পড়ে যাবে। বিব্রত হবে বুড়ো। হৈ হুল্লোড়ে আমার উৎসাহ নেই। তবে যেভাবে ছুটি আমার ঘাড়ে চাপলো তাকে অভিনন্দন যোগ্য কোনোকিছু বলে মনে হচ্ছিলো না। বুড়োকে বল্লাম, আপাতত এই শহর ছেড়ে কোথাও যাবার পরিকল্পনা আমার ছিলো না। কাজেই ছুটি নেবার কথা মনে হয় নি।

বুড়ো হাত তুলে থামিয়ে দেয় আমাকে। ভাবখানা এই যে এ নিয়ে কথা বাড়াবার সুযোগ নেই।

এ ছুটি তোমার খুব দরকার তারেক। একটু ভেবে দেখলে তুমি আমার সাথে একমত না হয়ে পারবে না। কাজের জন্য ভাবতে হবে না তোমার। সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কুয়ালালামপুর থেকে তোমরা রিপ্লেসমেন্ট এসে যাবে দুয়েকদিন ভেতর। না আসা পর্যন্ত আমিতো আছিই।

বল্লাম, আপনার কাজে খুঁত থাকে না। সে আমি জানি। একটা কথার সরাসরি জবাব দেবেন? বুড়ো বনে, একশোবার।

কোম্পানির কাজ ঠিকমতো করছিনে বলে কি আপনাদের মনে কোনো সন্দেহ দেখা দিয়েছে?

বুড়ো হেসে ফেলেন, কাজ বেশি করছে। সেখানে আমার আপত্তি আছে। তাছাড়া তুমি খুব ক্লান্ত—আমি অনেকদিন ধরে লক্ষ করেছি। এতো কাজ করারও মানে হয় না, এতো ক্লান্তি নিয়ে কাজ করা তার চেয়েও অর্থহীন।

বুড়োর কথায় সস্নেহ কর্তামির সুর, কিছু অভিযোগ, কিছু তিরস্কার, কিছু কৌতূহল। হয়তোবা তারও অজান্তে, অলক্ষ্যে এসে ভিড় জমিয়েছে। বিপরীত কিছু বল্লে বুড়ো মনে ব্যথা পাবেন। তাছাড়া প্রতিবাদ করার মতো কোনো কথা তো সায়েব বলেন নি।

হেনিংসের কথা মেনে নিলাম। এর ফলে নিমেষে মনের গুমোট বেশ খানিকটে কেটে যায়। পরিস্থিতির অভিনবত্বে অভিভূত হয়ে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ি। হেনিংস মনে মনে খুব খুশি হয়েছে। তার সারা মুখে অপার্থিব আনন্দ। আরেকটু দাঁড়ালে আমি যে তার একটু বেসামাল অবস্থা দেখে যেতে পারতাম সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।

বুড়ো সায়েরে ওখানেই এতো দেরি হয়ে গেলো যে রাবেয়ার কথা রাখতে পারি নি। এজন্যে আমি যে দুঃখিত বোধ করছি তা নয়।

বাড়িতে ফিরে রাবেয়াকে দেখতে পাবো আশা করি নি। ভেবেছিলাম সে নিশ্চয়ই মিটিং করতে চলে গেছে।

আশ্চর্য। রাবেয়া সময় মতো না ফেরা নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করলো না। বরং যেন কিছুই হয় নি এমনিভাবে বল্লো, তুমি ভারী অবুঝ। বুঝলে?

হুঁ।

সত্যি কথা বলতে কী রাবেয়ার সামনে মুহূরে জন্যে নিজেকে একটু অপরাধী লাগছিলো। সেই কখন থেকে আমি একলা বসে আছি। কিছুতেই সময় কাটলো না। না পেরে কী করলাম, জানো?

নাতো!

বড়বু’কে টেলিফোন করলাম। ঝাড়া আধঘন্টা। মিশেল বেশ কিছু কবিতা শিখে ফেলেছে। কী ঝরঝরে কথা, বুক জুড়িয়ে যায়।

বড়বু, মানে আমার বিধবা বড় বোন। মিশেল আমাদের একমাত্র ছেলে, তিন বছরের। জন্মের পর থেকে বড় জোর করে নিয়ে যান। কোনোকালে ফেরত পাওয়া যাবে কিনা সে সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ আছে। বড়বু’র ধারণা, তার কাছে থাকলে মিশেল মানুষ হবে।

এ ব্যবস্থা আমাদের, বিশেষত রাবেয়ার মনঃপূত নয়। কিন্তু বসুর দুঃখময় দিকটা ভেবে সেও খুব বেশি আপত্তি করতে পারে নি। মিশেলকে নিয়ে তিনি মোটামুটি ভালোই আছে। রাবেয়া রোজই একবার মিশেলকে দেখে আসে।

আমার মনে হলো ন্যাকামি। মিশেলের কথা আনা হয়েছে। খুব সুপরিকল্পিতভাবে। রাবেয়ার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আমি শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। সেও এলো পেছনে পেছনে।

এমন একলা লাগছিলো!

অর্থাৎ বিলম্বে আমি এসে পড়াতে সেই দুঃসহ অভাববোধটা এখন আর নেই। একথাই কি রাবেয়া আমাকে বোঝাতে চায়?

মনে হচ্ছিলো ঘাড়ে পিঠে চাবুক পড়ছে নির্দয়, বিরতিহীন ঘুরে দাঁড়িয়ে রাবেয়ার চোখে চোখ রাখি। ক্লান্ত স্বরে বলি, তাই নাকি?

আমাকে চা দিয়ে রাবেয়া বেরিয়ে গেলো। স্কুল কমিটির মিটিংয়ে।

.

আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো সংঘর্ষ বাঁধে নি, তার কারণ হয়তো এই যে রাবেয়া যেভাবে সমস্ত ব্যাপারটাকে দেখছে, আমার দেখার ধরনটা তা থেকে একেবারে আলাদা। অথবা আমরা দু’জনেই সংঘর্ষ এড়াবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছি।

রাবেয়ার কথা রাবেয়া জানে।

আমিতো সারাক্ষণ ভয়ঙ্কর একটা কিছু করার জন্যে ছটফট করছি। পারছিনে বলে নিজেকে কাপুরুষ ভীরু কত কিছু বলে অহরহ ধিক্কার দিই। একেক সময় ভাবতে অবাক লাগে। এত যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবার মতো ধৈর্য আমি পেলাম কোথা?

রাবেয়া কিন্তু সত্যিই অদ্ভুত।

কখনো সে আমার মতো ছটফট করে না। পরিস্থিতি যতোই জটিল হোক না কেন রাবেয়ার তাতে ভয় ধরে না। মুহূর্তের ভেতর সব কিছুকে সে কেমন সহজ করে রেখে যায় রাত্রিবেলা ঘুমোবার আগে রাবেয়া কতো কী যে বশ্লো। অনেক হাসালো। স্কুলটা অল্পদিনের ভেত্র দাঁড়িয়ে যাবে বলে সে বিশ্বাস করে। শেষ মুহূর্তে নতুন কোনো উপদ্রব দেখা না দিলে, সে মনে করে, তার বন্ধু সুফিয়া এখন অনায়াসে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করতে পারবে। এতে কিছু শোনার পর তার ভবিষ্যৎ

পরিকল্পনা সম্পর্কে আমার মনে একটা ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

স্কুলের কাজ হয়ে গেলে সে একদিন উঠে যাবে তার নতুন প্রেমিকের কাছে। ইতিমধ্যে ঘর বাঁধবার ব্যবস্থা পাকা করে নিচ্ছে।

রাতে আমার ঘুম হলো না।

.

রাবেয়ার সকাল চলছিলো যথানিয়মে। তার চোখ এড়াবার জন্যে বেড-টি না খেয়ে ঢুকে পড়ি বাথরুমে। ভেবেছিলাম ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসি। তাহলে দুঃসহ রাত জাগার ক্লান্তি রাবেয়ার চোখে ধরা পড়বে না।

একেক সময় অবাক লাগে, প্রাণপণ চেষ্টায় এসব যন্ত্রণা রাবেয়ার কাছ থেকে আমি আড়াল করে বেড়াচ্ছি কেন। খুব অনিশ্চিত হলেও মনে মনে বোধহয় ক্ষীণ আশা আছে যে রাবেয়া শেষ পর্যন্ত নিজের ভুল বুঝবে এবং অনুতপ্ত হয়ে থাকবে আমার কাছেই।

সকালের চায়ের টেবিল আমাকে দীর্ঘদিন থেকে আর কোনো প্রেরণা দেয় না, ওখানে বসা এখন একটি অভ্যাস মাত্র। প্রয়োজন মেটানোর একটি নির্দিষ্ট স্থান, একঘেয়ে।

কাপড় চোপড় পরে চা ব্রেকফাস্টের জন্য টেবিলের এককোণায় বসে পড়ি। রাবেয়া চোখ তুলে তাকালো একবার। সম্ভবত একটি অসঙ্গরি প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা তার উদ্দেশ্য— আমি সাধারণত টেবিলের এ জায়গায় বসিনে।

রাবেয়া গুনগুন করছিলো একমনে। এর অর্থ আমার কাছে বেশ স্পষ্ট। রাবেয়া জেনে ফেলেছে সারারাত আমি ঘুমুই নি। সেজন্যে তার মন খারাপ। গুনগুনিয়ে আসলে সে তার দুঃখ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে নানাদিক থেকে সন্ধানী আলো ফেলে বুঝবার চেষ্টা করছে তার দুঃখের গভীরতা।

আতঙ্কিত হয়ে উঠি। তবে কি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কখনো কিছু বলেছিলাম যা শুনে রাবেয়া অসুখি হয়েছে? সে জেনেছে আমার মনের ওপর কী নোংরামি বাসা বেঁধেছে। আমার মন এখন সন্দেহে ভরা এবং বিদ্বেষপূর্ণ?

মনে হচ্ছিলো ধরা পড়ে গেছি। আর রাবেয়া অপেক্ষা করছে এমন একটি মুহূর্তের জন্য যখন সে প্রমাণ করে ছাড়বে যে আসলে আমার মনটা অতি নিচু, অতি জঘন্য। ওর বাইরে আর কোনো সত্য নেই।

বুকের ভেতর তোলপাড় করছিলো। ভয় হচ্ছিলো সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে এখনি আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে এবং আমার—আমি, রাবেয়া, মিশেল, বড়, বাবা মা, বন্ধুবান্ধব, ঘরবাড়ি, ইচ্ছা অনিচ্ছা, নিক্ষিপ্ত হবো অনুজ্জ্বল কোনো এক প্রেতলোকে। তারপর বাকি জীবন জুড়ে বসবে ভূত-প্রেতের রাজত্ব।

স্থির ঠাণ্ডা চোখে রাবেয়া একবার তাকালো। সে দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম না। অনিশ্চিতভাবে বল্লাম, আমাকে এক কাপ কফি দাও বরং।

.

কথায় জড়তা ছিলো। রাবেয়া বোধহয় ঠিকমতো বুঝতে পারে নি। সে বল্লো উঃ?

কফি দাও। চা খেতে আর ভালো লাগছে না। কেমন একঘেয়ে লাগে। আমার এসব মন্তব্যের সাথে রাবেয়া নিজেকে কোথাও জড়ালো না।

আচ্ছা!

প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে উঠেছি। বুকের গভীরে যে শোরগোল চলছিলো তা কিন্তু এখনো শেষ হয় নি।

রাবেয়াকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

যারা হরদম কথা বলে, কোনো কারণে যদি আর তাদের কথা শোনা না যায় তাহলে বিপদাপন্ন মনে হয়। তারা কেমন দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে।

এই অস্বস্তিকর ভাবটা কাটাবার জন্যে বল্লাম, রাবেয়া, আজকে ছুটির দরখাস্ত করবো?

রাবেয়া উচ্চবাক্য করে না, চোখে চোখ রাখে। যেন সে আমার প্রস্তাবটার সারাংশ গ্রহণ করতে চেষ্টা করছে। এই সঙ্গে হয়তো আমাকে গম্ভীরভাবে নিরীক্ষণ করার কথা মনে হয়েছে ওর।

এতে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। মনের ভেতর গর্জে ওঠে অভিশাপের ভাষা। ভাবতে ভালো লাগে, রাবেয়া বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু তার কি কোনো লাভ হবে?

আজ বাদে কাল।

না হয় পরশু।

সহজ ভাষায় আমাকে জানাতে হবে তার নতুন প্রেমের কথা। সকালবেলায় এই ভাবনাকে আশ্রয় করে অপ্রধান হবার অপমান থেকে নিষ্কৃতি পেলাম।

.

আপিসে বুড়ো হেনিংসের সাথে দেখা করে দরখাস্তটা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। রাবেয়া স্কুলে যায় নি। এসে দেখি সে খুব মন লাগিয়ে ঘরবাড়ি গুছোচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলা, স্কুলে যাও নি?

না।

কেন?

এমনি, ভালো লাগছিলো না।

রাবেয়া?

বলো!

আমি আজ দুপুরের ট্রেনে বাড়ি যাবো।

হঠাৎ একটু আতিশয্য দেখা দেয় রাবেয়ার চোখে মুখে। সে খুব যেন খুশি হয়েছে এমনিভাবে বল্লো, গ্রামের বাড়িতে?

হ্যাঁ।

কী ভেবে রাবেয়া নিজেকে সংযত করে নেয়।

বেশতো, কবে ফিরবে?

রাবেয়া জানে না একথার সঠিক জবাব সে আমার কাছ থেকে পাবে না। আমি তাকে হাতে নাতে ধরতে চাই। ভদ্রতার আড়ালে সে শক্তিময়ী। ভদ্রতার ভেতরে থেকে তাকে ধরা যাবে না। কিছুদিন থেকে ভাবছিলাম। এখন আমি প্রায় নিশ্চিত যে অনুপস্থিতির সুযোগে রাবেয়া তার কাজ সেরে ফেলবার চেষ্টা করবে। এই মুহূর্তে সব কিছু যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তাই রাবেয়ার কাছে মিথ্যা কথা বলতে একটুও বাঁধলো না। বল্লাম, ভাবছি সপ্তাহ দুয়েক থাকব।

আমারও ভালো লাগে গ্রামে থাকতে।

একথার যোগ্য সাড়া দিতে গেলে বলতে হয়, বেশতো তুমিও চলো। আমি তার ধারে কাছেও গেলাম না। মনে হচ্ছিলো, রাবেয়া আমাকে গ্রামের বাড়িতে অন্ততপক্ষে সপ্তাহ দুয়েক কাটিয়ে আসার জন্যে উৎসাহিত করছে।

.

গ্রাম শহরের দ্বৈত প্রেরণা রাবেয়ার ভেতরে অনায়াসে জায়গা পেয়েছে। সে আমি জানি। কিন্তু সে কি এবারে সত্যি সত্যি আসতে চেয়েছিলো? আমার তা মনে হয় না। চাইলেই আমি তাকে নিয়ে আসতাম না।

গ্রামের বাড়িতে তিনদিন কাটতে না কাটতে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। একেতো গ্রামে আমার ভালো লাগে না। বিশেষত সন্ধ্যা হতে না হতেই যেভাবে অন্ধকার জেঁকে বসে তাতে আমি রীতিমতো অসুস্থ বোধ করি। চতুর্থ দিনে বুড়ো ফুফুর শত আপত্তি সত্ত্বেও আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম।

পরিকল্পনা নিখুঁত। অত্যন্ত ভেবেচিন্তে আমি সন্ধ্যার ট্রেনে চেপে বসেছি। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছে যাবো। আরো আধঘন্টা পরে বাড়ি।

বড়ো সড়কের ওপর ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিই। এখন আর মাত্র আধ মিনিটের মাথায় বাড়ি। সড়কের ওপর থেকেই দেখেছি, শোবার ঘরে আলো জ্বলছে।

রাস্তায় থাকতেই কান পেতে রাখি।

পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। মনে হলো, শোবার ঘরে কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার আর শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না। যন্ত্রচালিত্রে মতো এগুচ্ছিলাম, শোবার ঘরের দিকে। দরোজার ওপর কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, জানিনে। সামনে গাঢ় বুজ রংয়ের ভারী সিষ্কের পর্দা। মনে হয়েছিলো সমস্ত অস্তিত্ব তখন শ্রবণেন্দ্রিয় নির্ভর।

কান্নার পালা শেষ হয়েছে রাবেয়ার। এখন সে কথা বলছে, সংশয়ের আরতো কোনো অবকাশ নেই। হঠাৎ বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমি অভিভূত হয় পড়ি। তাদের মহত্ত্বের তুলনা হয় না।

আমার আরো আগে তৎপর হওয়া উচিত ছিলো। তাহলে দীর্ঘদিন ধরে নরকযন্ত্রণায় ভুগতে হতো না।

আশ্চর্য! আমরা বিয়ে করেছিলাম ভালোবেসে। রাবেয়াকে জানতাম সেই কোন ছোটবেলা থেকে। ভাবি নি কোনোদিন সে অধঃপাতের পথ বেয়ে এতোখানি নিচে নেমে যাবে। দেখেছি, চিরকাল সে মিশুকে প্রকৃতির। কোথাও আটকায় না। চলাফেরায় ফুর্তি থাকার ফলে। স্বাচ্ছন্দ্য তার নিত্যসঙ্গী।

রাবেয়া রূপসীও।

ভদ্রতায় সে নিখুঁত।

মনটা মার্জিত।

এ বই রাবেয়ার স্বপক্ষে ছিলো।

অগণিত ভক্তের ভেতর থেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকে কেন যে সে বেছেনিয়েছিলো তার অর্থ আমার কাছে অস্পষ্ট ছিলো না। এখন মনে হচ্ছে রহস্যাবৃত হয়ে আমি চিরদিনের জন্যে তলিয়ে গেলাম।

গ্রামে যাবার আগে ঠিক করেছিলাম এনিয়ে দুঃখের বোঝা আর বাড়াবো না। ব্যাগ থেকে আস্তে গুলিভরা পিস্তলটা তুলে নিই। আগ্নেয়াস্ত্রের স্পর্শ প্রত্যয় আনে মনে। শরীর দৃঢ় হয়, কোথায় যেন একটু জ্বালা ধরেছে।

ঘরের ভেতর থেকে রাবেয়ার কান্নাভেজা টুকরো কথা ভেসে আসছে।

তোমার কাছে এসে আমি বাঁচবো, কতবার বলেছি। আবার বলছি। আবার।

রাবেয়ার কথা, গলার স্বর ভৌতিক মনে হয় আমার কাছে।

রাবেয়া নিশ্চয়ই তার নতুন প্রেমিকের বুকে মুখ গুঁজে গাঢ় স্বরে কথা বলছে আর স্বপ্ন দেখছে। আমি যে খুব ঈর্ষা বোধ করছি তা নয়।

সব জানা হয়ে গেছে আমার। মনটাও তৈরি।

অকম্পিত হাতে দরোজার ভারী পর্দা সরাই। কোথায় যে সেই মিহি মসৃণ জ্বালা! এই মুহূর্তে আমার শরীরে মনে সুধাবর্ষণ করে চলেছে।

রাবেয়া খেয়াল করে নি। বল্লাম, রাবেয়া। আমাদের লুকোচুরি খেলার এই শেষ। তুমি তৈরি হয়ে নাও।

রাবেয়া চোখ তুলে একবার তাকালো না পর্যন্ত। আমার মানুষ সমান উঁচু ছবিটার সামনে সে দাঁড়িয়েছিলো। অলৌকিক বিষাদের ধ্যানী মূর্তির মতো চোখের কোল বেয়ে পানি গড়াচ্ছিলো অবিরল ধারায়।

ছবিটার ওপর চোখ পড়তে পিস্তলটা কোথায় লুকোবো ভেবে পাইনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *