১৬.রায়-নন্দিনী – ষোড়শ পরিচ্ছেদঃ শাহ্‌ মহীউদ্দীন কাশ্মীরী

ষোড়শ পরিচ্ছেদঃ শাহ্‌ মহীউদ্দীন কাশ্মীরী

শরতের সুপ্রভাত। নির্মণ নীলাম্বরে বিশ্বলোচন সবিতা অরুণিমাজাল বিস্তার করিয়া ধরণী বক্ষেনবজীবনের আনন্দ-কোলাহল জাগাইয়া দিয়াছে। শ্যামল তরূপত্রে বালার্কের স্বর্ণকিরণ সম্পাতে এক চিত্ত-বিনোদন দৃশ্যের আবির্ভাব হইয়াছে। ইচ্ছামতীর কাচ-স্বচ্ছ সলিলে বাল-সূর্যের হৈমকিরণ পড়িয়া সহস্র হীরক-দীপ্তি ভাঙ্গিতেছে, মৃদু সমীরণ ফুলের গন্ধ হরণ করিয়া পুস্প-চয়নরতা কামিনীর অব্জল উড়াইয়া, অলক দোলাইয়া, নদীবক্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীচি তুলিয়া এবং পত্র-পল্লব আন্দোলিত করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। তাহার প্রত্যেক হিল্লোল মানবরে প্রাণে স্বাস্থ্য-শক্তি ঢালিয়া দিতেছে। প্রকৃতির চির-গায়ক সুকণ্ঠ বিহগকুল নানা তান-লয়ে সুধাবর্ষী স্বরে মুক্ত প্রাণের মুক্ত আনন্দ কীর্তন করিতেছে। প্রেমিকা রমণীর চক্ষুর ন্যায় মনোহর নীলাকাশের প্রান্তে নানা বর্ণের মেঘমালা বণ্ডরূপীয় ন্যায় মুহুর্মুহুঃ শরীর ও বর্ণ পরিবর্তন করিতেছে। প্রকৃতি যেন আজি নির্মল আনন্দপূর্ণ ও হাস্যময়ী।

আজ আশ্বিনের পঁচিশ তারিখ। দুর্গা পূজার ষষ্ঠী। বাঙ্গালার পাখী-ডাকা ছায়া-ঢাকা পল্লীর শান্ত শীতল বক্ষে আনন্দের স্রোত শতধারায় প্রবাহিত! বালক-বালিকারা নানা প্রকার রঙ্গীন বস্ত্রে বিভূষিত হইয়া আনন্দে নৃত্য করিয়া বেড়াইতেছে। কেহ কেহ বা উদ্যানে মালঞ্চে, গৃহস্থের বাটীর প্রাঙ্গণে ফুলের সাজি লইয়া ফুল তুলিতেছে। গ্রামে গ্রামে জোড়-কাঠিতে ঢাক বাজিতেছে। প্রবল প্রতাপ রাজা কেদার রায়ের বাসস্থান শ্রীপুরে আজ আড়ম্বরের সীমা নাই। আজ কেদার রায়ের বাড়ীতে মহাসমারোহ। বাড়ীর উদ্যান সংলগ্ন প্রকাণ্ড মণ্ডপদালানে দুর্গা প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। ত্রিশটি প্রকাণ্ড স্তম্ভের উপর মন্দির সংস্থাপিত। কেদার রায়, বিজয়নগরনিবাসী একজন ইরানী মুসলমান ইঞ্জিনিয়ারের দ্বারা এই মন্দির গঠন করিয়াছেন। ইহা প্রাচীন ধরনের ভিতরে অন্ধকারপূর্ণ ক্ষুদ্র দ্বারবিশিষ্ট মন্দিরের ন্যায় নহে। মসজিদের নিদর্শনে ইহা অনেকটা উন্নত আদর্শে প্রস্তুত। থামগুলি বেশ উচ্চ এবং দ্বার ও জানালা প্রশস্ত। এই মন্দিরেই শ্রী শ্রীমতি দুর্গাদেবীর সিংহ-বাহিনী দশভুজা প্রকাণ্ড মূর্তি, গণেশ, লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতী ও অসুরের সহিত প্রতিষ্ঠিত।

মন্দিরের সম্মুখে প্রশস্ত নাট-মন্দির। নাট-মন্দির বিবিধ সজ্জায সজ্জিত। উহাতে ঝাড়, ফানুস, লন্ঠনের সঙ্গে সুপক্ক কলার কাঁদী ও রঙ্গীন কাগজের ফুলের ঝাড়ও ঝুলিতেছে। দিল্লীর চিত্রকরদের অঙ্কিত কয়েকখানি সুন্দর পটও সোনা-রূপার কাঠাম বা ফ্রেমে শোভা পাইতেছে। দলে দলে লোক পূজা-বাড়ীতে আসিতেছে ও যাইতেছে। নানা স্থান হইতে ভারে ভারে ফলমূল তরিতরকারি অনবরত আসিতেছে। মন্দির দক্ষিণ-দ্বারী। মন্দিরের পূর্ণ-পার্শ্বে একটি প্রকাণ্ড ফল-ফুলের বাগান। সেই বাগানের পূর্বে একটি ইষ্টক-মণ্ডিত পথ। যে পথের নীচেই স্বচ্ছ-সলিলা ইচ্ছামতী কল কল করিয়া দিবারাত্রি আপন মনে প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে।

নদীর ঘাট অনেক দূর পর্যন্ত সুন্দররূপে বাঁধান। নৌকাযোগে নানা স্থান হইতে নানা দ্রব্য আসিয়া ঘাটে পৌঁছিতেছে। আর ভারীরা তাহা ক্রমাগত ভুঁইয়া বাড়ীতে বহন করিয়া হইতেছে। ঘাটে কয়েকখানি পিনীস, বজরা ও ডিঙ্গি বাঁধা রহিয়াছে। ঘাটে রাজবাড়ী ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য বাটীর বহু স্ত্রীলোক স্নান করিতেছে। এলায়িত-কেশা, সিক্ত-বস্ত্রা পদ্মমুখী শ্রীমতীদের মুখে বাল তপন তাহার কিরণ মাখাইয়া সৌন্দর্যের লহরী ফুটাইয়া তুলিয়াছে। কোন রমণী গ্রীবা হেলাইয়া দীর্ঘ কুন্তলরাশি সাজিমাটী ও খৈল-সংযোগে পরিস্কার করিতেছে। কোন নারী কাপড় ধুইতেছে। বালিকার দল পা নাচাইয়া জল ছিটাইয়া সাঁতার কাটিতেছে। যুবতীরা ঈষৎ ঘোমটা দিয়া আব জলে নামিয়া শরীর মর্দন করিতেছে এবং মাঝে মাঝে আড়চক্ষে সম্মুখ দিয়া নৌকায় কাহারা যাইতেছে, তাহা দেখিয়া লইতেছে। প্রবীণরা ঘাটে বসিয়া কেহ কেহ সূর্যপূজার মন্ত্র আওড়াইতেছে। কেহ কেহ পিতলের ঘটি ও কলসী মাজিয়া এমন ঝকঝকে করিতেছে যে, উহাতে সূর্যের ছবি প্রতিবিম্বিত হইয়া ঝলমল করিয়া সোনার ন্যায় জ্বলিতেছে। হায়! মানুষ নিজের মনটি যদি এমন করিয়া মাজিত, তাহা হইলে উহাতে বিশ্ব-সূর্য পরমেশ্বরের জ্যোতিঃপাতে কি অপূর্ব শোভাই না ধারণ করিত! মানুষ নিজের ঘটি-বাটী, এমনকি জুতা জোড়াটি যেমন পরিস্কারর রাখে, মনকে তেমন রাখে না। অথচ মানুষই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান।

কোন যুবতী স্নানান্তে কলসী কক্ষে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতেছে। ঘাটের দক্ষিণ-পার্শ্বে কতিপয় পুরুষও স্নান করিতেছিল। একটি প্রফুল্ল মূর্তি ব্রাহ্মণ পৈতা হাতে জড়াইয়া মন্ত্র জপ করিতেছে। তাহার পার্শ্বে ফুটন্ত গোলাপের মত একটি শিশু স্নানান্তে উলঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়া আঙ্গুল চুষিতেছে এবং এক দৃষ্টে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের জপ, মন্ত্র-ভঙ্গী এবং জল ছিটান দেখিতেছে। বোধ হয়, তাহার কাছে এ-সমস্তই অর্থশূন্য অথচ কৌতুকাবহ মনে হইতেছে। সে এক এক বার মনে মনে ভাবিতেছে যে, তাহার ঠাকুরদাদা জল লইয়া এক রকম খেলা করিতেছে! কিন্তু পরক্ষণেই তাহার মুখের গাম্ভীর্য বালকের ধারণা নষ্ট করিয়া দিতেছে। এ-সংসারে গাম্ভীর্যের প্রভাবেই অনেক হালকা জিনিস গুরু এবং গুরু জিনিসও গাম্ভীর্যের অভাবেই হালকা হইয়া পড়ে।

শ্রীপুরের ঘাটে দুর্গোৎসবের ষষ্ঠীর দিনে প্রাতঃকালে যখন এই প্রকার রমণীদিগেন স্নানের হাট বসিয়াছে, সেই সময়ে একখানি সবুজবর্ণ অতি সুন্দর প্রকাণ্ড বজরা, একখানি পিনীস ও একখানি বৃহদারের ডিঙ্গিসহ আসিয়া ঘাটে ভিড়িল।

বজরায় খুব বড় একটি ডঙ্কা ছিল। বজরা কুলে লাগিবা মাত্রই একজন লোক সেই ডঙ্কা পিটিতে লাগিল। ডঙ্কার আওয়াজে সমস্ত গ্রামখানি যেন প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। অনেক বাড়ীতেই তখন পূজার ঢাক বাজিতেছিল। ডঙ্কার আওয়াজে ঢাকের শব্দ তলাইয়া গেল। ডঙ্কার তুমুল ধ্বনি শুনিয়া ছেলের দল এবং অনেক কৌতুহলী ব্যক্তি বজরার দিকে ছুটিল।

বজরার মধ্যে একটি প্রশস্ত কক্ষে একখানি ব্যাঘ্রর্মাসনে এক তেজঃপুঞ্জ মূর্তি দিব্যকান্তি দরবেশ বসিয়া তসবী জপিতেছিলেন। তাঁহার মুখমণ্ডল জ্যোতির্ময়, গম্ভীর অথচ ঈষৎ হাস্যময় এবং প্রশান্ত। তাঁহার চেহারার লাবণ্য, দীপ্তি এবং প্রশান্ততা দেখিলেই তিনি যে একজন প্রতিভাশালী পিরহান, তাহার উপরে একটি সদরিয়া এবং মাথায় শ্বেতবর্ণ পাগড়ী। পরিধানে পা’জামা। এই সামান্য বস্ত্রেই তাঁহাকে বেশ মানাইয়াছে। তাপসের বয়স পঞ্চাশের উপর নহে। তাঁহার সর্বাঙ্গের গঠন সুন্দর, দোহারা। মুখে অর্ধহস্ত পরিমিত দীর্ঘ মসৃণ কৃষ্ণশ্মাশ্রু শোভা পাইতেছে। গ্রীবাদেশের চতুস্পার্শে বাবরীগুলি ঝুলিয়া পড়িয়াছে। দুই পার্শ্বের জোলফ প্রভাত বায়ুতে ঈষৎ আন্দোলিত হইতেছে। যেন দুইটি কালো সর্প দুই পার্শ্বে ঝুলিয়া পড়িয়া দোল খাইতেছে। যে আসিতেছে, সেই তাঁহারা সম্মুখে আসিয়া মস্তক নত করিতেছে। তাঁহাকে দেখিয়া কেহ অগ্রসর হইতেও পারিতেছে না, পিছাইতেও পারিতেছে না। চঞ্চলমতি কলহপ্রিয় ছেলে মেয়েরা যাহারা মুহূর্ত পূর্বে ভীষণ কোলাহলে প্রভাত আকাশ মুখরিত করিয়া তুলিয়াছিল, তাহারাও দরবেশের দিকে মুখ তুলিয়া কেহ তাকাইতেও পারিতেছে না। জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁহার পরিচয় জানিবার জন্য বজরা সংলগ্ন ডিঙ্গীতে যাইয়া একজন লোককে জিজ্ঞাসা করিল। তাহার মুখে ব্রাহ্মণ জানিতে পারিল যে, দরবেশের নাম শাহ সোলতান সুফী মহীউদ্দীন কাশ্মীরী। তিনি কাশ্মীরের কোনও রাজপুত্র। রাজসিংহাসন ত্যাগ করিয়া দীর্ঘকাল শাস্ত্রালোচনা ও তপস্যা দ্বারা সিদ্ধি লাভ করতঃ ধর্ম-প্রচার উপলক্ষে কিয়র্দ্দিন হইল নিন্ম-বঙ্গে আগমন করিয়াছেন।

ইতিমধ্যে দরবেশের জপ শেষ হইলে তিনি বালকদিগকে অতি মধুর স্বরে বজরার নিকটে আহবান করিয়া হাস্যমুখে নিতান্ত স্নেহের সহিত সকলের নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। বালক-বালিকারা তাঁহার মধুর আহবানে একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেল। নৌকায় যথেষ্ঠ পরিমাণে বর্তমান-কলা ও মিঠাই ছিল। তিনি প্রত্যেক বালককে পাঁচটি করিয়া কলা ও পাঁচটি করিয়া সন্দেশ পরম স্নেহের সহিত দিতে লাগিলেন। বালকদের মধ্যে সন্দেশ লইতে প্রথমে অনেকেই ইতস্ততঃ করিলেও পরে আগ্রহের সহিত তাহা গ্রহণ করিল। বালকেরা সকলেই হিন্দু। তন্মধ্যে ১৪/১৫ জন গোঁড়া ব্রাহ্মণ-সন্তান। শাহ সাহেব কদলী ও মিঠাই বণ্টন করিয়া কলা সকলকেই খাইতে বলিলেন। তাহারা মন্ত্র-মুগ্ধবৎ সেই বজরার দুই পার্শ্বে বসিয়া স্বচ্ছন্দে কলা ও সন্দেশ খাইতে লাগিল। সেই সময় অনেক হিন্দু পুরুষ ও রমণী দণ্ডায়মান হইয়া ভিড় করিয়া তামাসা দেখিতেছিল। সকলেই যেন পুত্তলিকাবৎ নীরব ও নিস্পন্দভাবে দাঁড়াইয়া সেই মহাপুরুষের দেব-বাঞ্জিত-মূর্তি ও বালকদের প্রতি জননী-সুলভ মমতা দর্শন করিতে লাগিল।

বালকদের মধ্যে একটি ছেলেকে রোগা দেখিয়া শাহ সাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার জ্বর হয় কি?” সে মাথা নাড়িয়া মৃদুস্বরে বলিল, “হু”। দরবেশ সাহেব মনে মনে কি পড়িয়া ফুঁ দিলেন এবং তাহাকে বলিলেন, “তোমার জ্বর হবে না।” বালক বলিল, “বিকালে আমার জ্বর আসবে। এ জ্বরে কোনও চিকিৎসায় ফল করে নাই।” দরবেশ বলিলেন, “আচ্ছ বাবা! বিকালে একবার এসো, তোমার জ্বর আসে কি-না দেখা যাবে। তোমাদের বাড়ী কত দূরে, “ঐ যে, আমাদের বাড়ীর তালগাছ দেখা যাচ্ছে।” একটি বালককে জ্বরের জন্য ফুৎকার দিতে দেখিয়া আর একটি বালক বলিল, “আমার একটি ছোট ভাই ক’মাস থেকে পেটের অসুখে ভুগছে।” দরবেশ বলিলেন, “বাড়ী হ’তে মাটির একটি নূতন পাত্র নিয়ে এস, আমি পানি পড়ে দিব। তোমার ছোট ভাই-এর অসুখ ভাল হয়ে যাবে।” নীলাম্বরী-পরিহিতা প্রফুল্লমুখী একটি বালিকা অনেকক্ষণ দরবেশের নিকট বসিয়া তাহার মুখের দিকে এতক্ষণ পর্যন্ত আগ্রহ ও প্রীতিমাখা দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল। কখন দরবেশ মুখ ফিরাইবেন তাহার প্রতীক্ষা করিতেছিল। এইবার দরবেশ মুখ ফিরাইলে সে তাহার দক্ষিণ হস্তের তর্জনী বাম হস্তের দুইটি অঙ্গুলীর দ্বারা চাপিয়া ধরিয়া আধ আধ স্বরে বেশ একটু ভঙ্গিমার সহিত মুখ নাড়িয়া বলিল, “আমার আঙ্গুলটা কে’টে গে’ছে, ব্যথা করছে।” দরবেশ সস্নেহে তাহার চিবুক ধরিয়া বলিলেন, “কেমন ক’রে হাত কেটেছে?”

বালিকাঃ আমার পুতুলের ছেলের বিয়ের তরকারি কুটতে কেটে গেছে।

দরবেশঃ তোমার পুতুলের ছেলে আছে? তার বিয়ে হ’য়েছে?

বালিকাঃ হ্যাঁ, আপনি দেখবেন?

দরবেশ সাহেব বালিকার মতলব বুঝিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, বিকালে নিয়ে এস, দেখব-এই বলিয়া তিনি বালিকার আঙ্গুলে ফুৎকার দিয়া বলিলেন, “তোমার বেদনা সে’রে গেছে!” বালিকা কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া আশ্চর্যের সহিত বলিল “কৈ! আর ত বেদনা করে না! বা! আপনার ফুঁতে বেদনা সে’রে গেল।”

তখন স্বর্ণপ্রসবিনী ভারতবর্ষের রম্যোদ্যান বঙ্গভূমি, আজকালকার মত রেলের কল্যাণে নদনদীর স্রোত বন্ধ হইয়া ম্যালেরিয়া প্রিয় নিকেতনে পরিণত হইয়াছিল না; তাই সেই বহু সংখ্যক বালক-বালিকার মধ্যে একটি মাত্র রুগ্ন বালক ছিল। বালক-বালিকারা সুফী সাহেবের নিকট হইতে ক্রমে ক্রমে বিদায় লইল। যে সমস্ত বয়স্ক লোক দাঁড়াইয়াছিল, দরবেশ সাহেব তাহাদিগকে স্থানীয় নানা তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিলেন। লোক-সংখ্যা কত, মুসলমান কত, কেদার রায় কেমন লোক, স্থানীয় আবহাওয়া কেমন, জিনিসপত্র কেমন পাওয়া যায়, লোকের চরিত্র, শিক্ষা ও ধর্মানুরাগ কেমন, কত সম্প্রদায়, কত জাতি, কি কি পূজা-পদ্ধতি চলিত আছে ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি উপস্থিত জনসাধারণকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। তাহারাও যথাযথ উত্তর দিতে লাগিল। কেবল কেদার রায় কেমন লোক, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই থতমত খাইয়া পরে বলিল, “ভাল লোক। অনেক লোক-লস্কর আছে; বাঙ্গালার নবাবের খাজনা দুই বৎসর হ’ল বন্ধ করেছে।”

দরবেশ সাহেব প্রশ্নোত্তর হইতে বুঝিতে পারিলেন, স্থানটি বেশ স্বাস্থ্যকর। মৎস্য ও তরিতরকারি অপর্যাপ্ত। অধিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু। সাধারণতঃ লোক সকল অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কেদার রায় ও তাঁহার ভ্রাতা চাঁদ রায় সামান্য একটু বাঙ্গালা ও ফারসী জানেন। কেদার রায় অপেক্ষা চাঁদ রায় কম নিষ্ঠুর ও উদার প্রকৃতি। কেদার রায় গণ্ডমূর্খ, হঠকারী এবং কুপমণ্ডুকবৎ সংকীর্ণ-জ্ঞান বলিয়া নিজেকে সত্য সত্যই প্রতাপশালী, বিশেষ পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজা বলিয়াই মনে করেন। বাঙ্গালার নবাব দায়ুদ খাঁর পতনে রাজ্যের বিশৃঙ্খলা ঘটায় তিনি খাজনা বন্ধ করিয়া তাঁহার প্রজামণ্ডলীর মধ্যে নিজেকে স্বাধীন নরপতি বলিয়া প্রচার করিতে কুণ্ঠিত হন নাই, তবে রাজছত্র ধারণ ও মুদ্রাঙ্কনে এখনও সাহসী হন নাই।

কেদার রায় ঈসা খাঁকে সম্মুখে ভক্তিশ্রৈদ্ধা প্রদর্শন ও হাত-জোড় করিয়া বাধ্যতা স্বীকার করিলেও তাঁহাকে স্বীয় আধিপত্য বৃদ্ধির পথের কণ্টক স্বরূপ বিবেচনা করেন। ঈসা খাঁ ও তাঁহার স্বর্গীয় পিতা উপকার ব্যতীত কেদার রায়ের কখনও অপকার করেন নাই। বলিতে গেলে ঈসা খাঁর বন্ধুভাবই তাঁহার রাজ্যরক্ষার অবলম্বন-স্বরূপ হইয়াছে। ঈসা খাঁ কেদার রায়ের হিতৈষী না হইলে, ভুলুয়ার প্রবল প্রতাপান্বিত ফজল গাজীর তরবারি ও কামানের মুখে কোন দিন শ্রীপুর শ্রীশূন্য হইয়া যাইত। ঈসা খাঁর আনুকূল্যেই কেদার রায় অন্যান্য জমিদারের বহু এলাকা হস্তগত করিতে সমর্থ হইয়াছেন।

দ্বি-প্রহরের প্রারম্ভে সমস্ত লোক চলিয়া গেলে, হযরত মহীউদ্দীন সাহেবের ভৃত্য, খাদেম ও শিষ্যগণ আহারের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইল। শাহ সাহেবের সঙ্গে তাঁহার অনুচর আটজন, বাবুর্চি একজন, খাদেম পাঁচজন এবং মাঝি-মাল্লা কুড়িজন, মোট চৌত্রিশ জন লোক ছিল। তিনি নিজের সম্পত্তি হইতে এই সমস্ত লোকের ব্যয়ভার বহন করিতেন। কাহারও নিকট হইতে অর্থাদি কিছু লইতেন না। তবে খাদ্যদ্রব্য উপহার স্বরূপ প্রদান করিলে, তিনি গ্রহণ করিতেন। তিনি প্রায় বারমাসই রোজা রাখিতেন। রাত্রিতে সামান্য কিছু দুগ্ধ, রুটি ও ফল-মূল ভক্ষণ করিতেন। মৎস্য, মাংস স্পর্শও করিতেন না। সমস্ত রাত্রি উপাসনা ও ধ্যান-ধারণায় রত থাকিতেন। ফজরের নামাজের পরে কোরআন শরীফের এক তৃতীয়াংশ আবৃত্তি করিতেন। তৎপর মধ্যাহৃ পর্যন্ত সমাগত লোকদিগকে উপদেশ ও রোগীদিগকে পানি পড়িয়া দিতেন। তাঁহার পানি পড়ায় সহস্র সহস্র ব্যক্তি রোগ-মুক্ত হইতেছিল। তিনি যেখানে যাইতেন সেইখানেই কবিরাজ ও হাকিমগণের অন্ন মারা যাইত। তাঁহার পানি পড়ার অদ্‌ভুত শক্তি দর্শনে লোক আর কবিরাজ বা হাকিমের কাছে ঘেঁষিত না। দুই দিনের রাস্তা হইতে লোক আসিয়া পাড়ি পড়াইয়া লইয়া যাইত, তিনি মধ্যাহ্নে জোহরের নামাজ পড়িয়া আসরের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত তিন ঘন্টা মাত্র ঘুমাইতেন। তাঁহার নিদ্রার এই এক আশ্চর্যত্ব ছিল যে, আসরের ওয়াকত হওয়া মাত্রই তিনি জাগ্রত হইতেন। বার বৎসরের মধ্যে তাঁহার এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয় নাই। আসরের নামাজ অন্তে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত কোন কোন দিন তিনি আধ্যাত্মিক-সঙ্গীত ও গজলের চর্চা করিতেন। কোন কোন দিন গ্রন্থ রচনা করিতেন। তৎপর সন্ধ্যার প্রাক্কালে খোলা মাঠে বা নদীর ধারে ভ্রমণ করিতেন এবং সান্ধ্যোপাসনা মুক্ত আকাশের নীচেই প্রায় সম্পন্ন করিতেন। মগরের বাদ কিঞ্চিৎ বিশ্রাম ও সমাগত লোকজনদিগকে উপদেশ দিতেন। তাঁহার স্বর অতীব মিষ্ট, সুস্পষ্ট এবং গম্ভীর ছিল। উপদেশ-স্রোতৃবর্গ তন্ময়চিত্ত হইয়া পড়িত। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত লোকজনের ভিড় কমিত না। মসলা-মসায়েল, ফতোয়া-ফারাজ এবং অধ্যাত্মা-নীতি সম্বন্ধে তাঁহাকে শত শত লোকের প্রশ্নোত্তর দিতে হইত। তাহাতে তিনি বিরক্তির পরিবর্তে আনন্দ প্রকাশ করিতেন। মওলানা, মুনশী, খোন্দকার ও মুফতিগণ তাঁহার নিকট নানা বিষয়ের মীমাংসার জন্য উপস্থিত হইতেন। সকাল হইতে রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত লোকারণ্যের হলহলায় দিঙ্মণ্ডল নিনাদিত হইত। তিনি যেস্থানে অবস্থান করিতেন, সেখানে দস্তুরমত হাট-বাজার ও থাকিবার চটী বসিয়া যাইত। রাত্রি দ্বিপ্রহরে লোকজন বিদায় হইলে তিনি নৈশ-উপাসনা সমাপ্ত করিয়া ধ্যানস্থ হইতেন। ফজরের সময় এই ধ্যান ভঙ্গ হইত। ধ্যানের সময় তাঁহার সর্বাঙ্গ হইতে এক প্রকার স্নিগ্ধ জ্যোতিঃ নির্গত হইত।

ফলতঃ শাহ্‌ মহীউদ্দীন একজন অসাধারণ জ্ঞানী এবং তপঃপ্রভাবসম্পন্ন বিশ্ব-প্রেমিক দরবেশ ছিলেন। আরবী, ফারসী, তুর্কী ও সংস্কৃত এই চারিটি ভাষায় তাঁহার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। সমগ্র কোরআন, হাদিস, মসনবী ও হাফেজ তাঁহার মুখস্থ ছিল। ইহা ছাড়া সংস্কৃত উপনিষদ, ষড়দর্শন ও গীতা তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাঁহার সংস্কৃত জ্ঞানের অগাধ পরিচয় পাইয়া চমৎকৃত হইয়া যাইতেন। ইতিহাস, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র এবং কাব্য এই চাবি বিষয়ে তাঁহারা অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও সূক্ষ্মদর্শিতা অভিব্যক্ত হইত। তাঁহার বজরাখানি আড়াই হাজারেরও উপর গ্রন্থে পরিপূর্ণ ছিল। বাল্যকাল হইতেই বিশ্বশোষিকা-জ্ঞানপিপাসা তাঁহাকে আকুল করিয়া তুলিয়াছিল। জ্ঞান-চর্চার ব্যাঘাত হইবে বলিয়াই তিনি দারপরিগ্রহ করেন নাই এবং নিজে যৌবরাজ্য অভিষিক্ত হইয়াও রাজ-সিংহাসন কনিষ্ঠকে সমর্পন করিয়াছিলেন। তিনি আদর্শ মুসলমানের ন্যায় জ্ঞানপিপাসু, উদারপ্রকৃতি, ধর্মনিষ্ঠ ও বিশ্বহিতৈষী পুরুষ ছিলেন।

নয় মাস কাল তিনি বাঙ্গালায় আসিয়াছেন। ইহার মধ্যে তিনি ৩৫ হাজার হিন্দুকে নানাপ্রকারের ভূত-প্রেত দৈত্য-দানবের কম্পিত বিশ্বাসের মসীমলিন অন্ধকার হইতে একমাত্র সচ্চিদানন্দ আল্লাহতালার উপাসনা অর্চনায় দীক্ষা দিয়া মুসলমান সমাজভুক্ত করিয়াছেন! তাহাদের টিকি কাটাইয়া, তিলক মুছাইয়া, গলার রসি খোলাইয়া, সভ্য-পরিচ্ছদে বিভূষিত করিয়াছেন। প্রাচীন হিন্দুরা যে মুসলমান ছিলেন, ইহা তিনি বেদ ও উপনিষদ হইতে প্রমাণ করিয়া হিন্দু পণ্ডিতদিগকে চমৎকৃত করিয়া দিতেন। প্রাচীন আর্যজাতি যে সর্বাংশে মুসলমানদিগেরই ন্যায় একেশ্বরবাদী ও একজাতিভুক্ত ছিলেন, তাঁহারা যে সাকার ও জড়োপাসনার বিরোধী, এমনকি তাঁহারা যে মুসলমানদিগেরই ন্যায় পরম উপাদেয় জ্ঞানে গোমাংস ভক্ষণ করিতেন’ এবং মৃতদেহগুলিকে নিষ্ঠুর ও পেশাচিকভাবে চিতায় দগ্ধ না করিয়া পরম যত্নে গোর দিতেন, তাহা তিনি বেদ, উপনিষদ ও পুরাণ হইতে তন্ন তন্ন করিয়া দেখাইয়া দিতেন। বিধবা-বিবাহের বহু ঘটনা ও শাস্ত্রীয় বাক্য প্রদর্শনপূর্বক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে পরাস্ত করিয়া দিতেন। আধুনিক হিন্দুগণ যে আদিম অসভ্য অনার্যজাতির সংশ্রবে মৃৎ-প্রস্তর উপাসক এবং ব্যবস্থাদাতা ব্রাহ্মণদিগের স্বার্থমূলক কূট ষড়যন্ত্রে পতিত হইয়া শতধাবিচ্ছিন্ন, কুসংস্কার-সম্পন্ন এবং ধর্মভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়াছে, তাহা তিনি এমনভাবে চক্ষে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক দেখাইয়া দিতেন যে, স্বার্থাদ্ধ ব্রাহ্মণেরাও অশ্রুপাত করিত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ ইত্যাদি দেব-দেবী যে আকাশ-কুসুমের ন্যায় কবি-কল্পিত তাহা ব্রাহ্মণগণও শেষে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেন। তাঁহার জ্ঞানগর্ভ অমৃত-নিস্যন্দিনী বক্তৃতা শ্রবণে পাঁচ হাজার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় লাভ করিয়া মানবজন্মের সার্থকতা সম্পাদন করেন। মহাতপা শাহ মহীউদ্দী পাঁচ লক্ষ মুসলমানকে শিষ্যত্ব দীতি করেন। শেরেক, বেদাত প্রভৃতি কুসংস্কার যাহা হিন্দু সংস্পর্শে মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, তিনি তাহা সমূলে উৎপাটিত করেন।

তিনি দেশের নানা স্থানে বহু ইন্দারা ও দীঘিকা খনন করেন। শুধু তাহাই নহে, গ্রাম্য রাস্তা নির্মাণ, মসজিদ, মাদ্রাসা স্থাপন ইত্যাদি বহু জনহিতকর সৎকার্যে তিনি প্রভূত অর্থ ব্যয় ও পরিশ্রম করিতেন। তিনি প্রত্যেক সভায় সমাগত হিন্দু-মুসলমানকে প্রাগুক্ত সংকার্যসমূহের জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করিতে বলিতেন। শ্রোতৃমণ্ডলী তাঁহার কথায় আনন্দের সহিত অর্থ দান করিত। এইরূপে নয় মাসে তিনি প্রায় লক্ষ টাকা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই টাকা সমস্তই পূর্বোক্ত সদনুষ্ঠানসমূহে ব্যয় করিয়াছিলেন। মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় স্বহস্তে তিনি ভিত্তি-প্রস্তর প্রতিষ্ঠিত করিতেন। ইদারা ও পুস্করিণী খননে দশ কোদাল করিয়া মাটি অগ্রে নিজে উঠাইতেন। রাস্তা নির্মাণেও সর্বাগ্রে নিজে মাটি কাটিয়া দিতেন। তাঁহারা এই প্রকার প্রবল লোকহিতৈষণার সকলেই মুগ্ধ হইয়া যাইত। হিন্দুরা তাঁহাকে দেবতা বলিয়া পূজা করিত।

তিনি প্রত্যহ অপর্যাপ্ত পরিমাণে যে সমস্ত ফল, মূল, চা’ল ডা’ল, তরিতরকারি, মৎস্য, খাসী, মোরগ, দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মাখন ও বস্ত্র উপহার পাইতেন, তাহা দীন-দুঃখী অনাথদিগকে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে বিতরণ করিতেন এবং কোন স্থান হইতে যাইবার পূর্বদিন মহাসমারোহপূর্বক সকলকে ভোজ দিতেন। ফলত, গঙ্গা যেমন হিমালয় হইতে নির্গত হইয়া বঙ্গের সমতলভূমিতে সহস্র শাখা বিস্তারপূর্বক সহস্র জল-প্রবাহে জমী উর্বরা করিয়া, মাঠে মাঠে সোনা ফলাইয়া, তৃষ্ণার জ্বারা দূরীভূত করিয়া, দেশের জঞ্জালজাল ভাসাইয়া লইয়া, পূণ্য-পূর্ণ তরণী বহিয়া, বায়ুকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ করিয়া, সমস্ত দেশে স্বাস্থ্য-শান্তি ও আনন্দ ছড়াইয়া কল কল নাদে আপন মনে বহিয়া যাইতেছে, মহাত্মা শাহ মহীউদ্দীন সাহেবও তেমনি প্রেম-পুণ্য-সত্যের আলোক-উজ্জ্বল উদার হৃদয় ও বিশ্বহিত-কামনায় সৌরভ-পূর্ণ মন লইয়া কাশ্মীর হইতে বাঙ্গালায় আসিয়া তরুচ্ছায়া-শীতল গ্রাম ও নগরে নবজীবন, নবআনন্দ ও নবপুলকের স্রোত গৃহে গৃহে প্রবাহিত করিতেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *