2 of 2

বন্ধন – ভাগ্যধর হাজারী

বন্ধন – ভাগ্যধর হাজারী

পাড়ায় মুখুজ্জে গিন্নির দুর্নাম বড় একটা কম ছিল না। তবুও পাড়ার লোকে কখনও কখনও সজ্ঞানে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো কারণ মুখজ্জে গিন্নির কৃপায় পাড়াতে কাকচিলের উৎপাত ছিল না বললেই চলে। তাঁর গালিবর্ষণের লাভাস্রোতের ঠ্যালায় ঘরজ্বালানি পক্ষীকূলও মুখুজ্জে বাড়ী ও অসংলগ্ন অঞ্চল সভয়ে এড়িয়ে চলত।

মুখুজ্জে গিন্নির বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। মা বাবা বড় সাধ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন সুভাষিনী। তা তাদের দেওয়া নাম সার্থক হয়েছে বটে; সুভাষিনী দেবী কদাপি সেই নামের আংশিক অমর্যাদাও করেননি এ যাবৎ কাল। কারণে অকারণে যে কোন জায়গায় তিনি অপদস্থ হলেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করে স্বামীকে তীব্র বাক্যবাণে জর্জরিত করতে তিনি ভয় পেতেন না। ঘরের বাইরে তিনি যত অন্তর্মুখী, স্বামীসান্নিধ্যে তিনিই আবার রণরঙ্গিণী চামুণ্ডাসদৃশা।

পক্ষান্তরে, মুখুজ্জেমশাই নিতান্তই গোবেচারা ধরনের জীব। সমাজে একপ্রকার নোক থাকে যারা ভেবে থাকেন বিবাহের পরমক্ষণ থেকেই স্বামীগণ স্ত্রীর নিকট বলিপ্রদত্ত। আমাদের মুখুজ্জেমশাইও সেই ধরনের। তাই কাদায়পড়া গরুর মত গাড়োয়ানের পাঁচনের শত আঘাত সহ্য করেও কোনদিন তিনি কাঁধ ঝাঁকালেন না অথবা পুচ্ছ তাড়না করে স্ত্রীর রোষবহ্নিতে ইন্ধন জোগালেন না। দিকচক্রবালকে স্পর্শ করার আশায় যতই এখোন যাক না কেন তা যেমন অধরাই থেকে যায়, মুখুজ্জেমশাইও দাম্পত্যসুখের স্পর্শানুভূতি লাভের চেষ্টা করে সেরকমই পুনঃপুনঃ ব্যর্থ হন।

মুখুজ্জেদম্পতি নিঃসন্তান। মুখুজ্জেমশাই সরকারের উচ্চপদে চাকুরী করনে একসময়। এখন মাসে মাসে পেনশন হিসেবে যা পান তাতে বুড়োবুড়ির ভালভাবেই চলে যায়। তাছাড়া বসতবাড়ির কয়েকটা ঘর ভাড়া দিয়েও বেশ কিছু টাকা ঘরে আসে। সংসারে আর্থিক অনটন বলতে যা বোঝায় তা তাদের ছিল না। তবু অভাব ছিল—ভাবের অভাব।

যৌনবয়সে মুখুজ্জেমশাই স্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু বিধি বাম থাকার জন্য আর তাঁর সর্বদা ডানপন্থা অবলম্বন করার কারণে তিনি বামাজাতির মনোহরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ইয়ার বন্ধুরা এই ব্যাপারে কটাক্ষ করলে তিনি হাসিমুখে বলতেননাঃ ভাই, মনোচোরা হয়ে ফাঁসি যেতে পারব না। এই বেশ আছি। হজম না করতে পারি, বদহজমের জ্বালা থেকে তো বেঁচেছি।

তিনি স্ত্রীর হাত থেকে সত্যিই বেঁচেছিলেন না কি বেঁচে মরার স্বাদ পাচ্ছিলেন তা তর্কের বিষয়। সত্য এই, স্ত্রীর প্রতি তার ভালবাসা বিন্দুমাত্রও কমেনি; লাঞ্ছনাগঞ্জনা, কটুক্তি বই তার ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিলেন।

প্রতিবেশিরা এসবের সব খোঁজই রাখতে। তাই সকালসন্ধ্যা কলহপ্রিয়া স্ত্রীর অমধুর লাভাস্রাবী বাক্যস্ফুরণে শব্দদূষণের মাত্রা তীব্রতর হলেও তারা প্রায়শই নীরব থাকতেন। কখনও তাদের বিরক্তির কথা কেউ যদি প্রকাশ করে ফেলত সুভাষিণী দেবী ঘরের ভেতরে গোবধের পালা মাঝপথে থামিয়ে সম্মার্জনী হস্তে বার হয়ে প্রতিবাদীর ঝুলিঝাড়নের কাজে প্রবৃত্ত হতেন। আমরা সচরাচর সে বাড়ির ছায়া মাড়াতাম না।

সেদিন কি একটা কারণে মুখুজ্জেবাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। বাড়ির পরিবেশ আজ যেন কিছুটা আলাদা। ঝগড়াঝাটি, গালিবর্ষণ, আক্ষেপোক্তি এসবই আজ অনুপস্থিত। কিন্তু বাড়ির ভেতরে প্রতিবেশিদের জটলা দেখে কেমন যেন কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। ঘরের বাইরে প্রতিবেশিদের বিষণ্ণ কথাবার্তা আর ঘরের ভেতরে মুখুজ্জেগিন্নির করুণ বিলাপধ্বনি শুনে বাড়িতে না ঢুকে আর পারলাম না। এ আবার মুখুজ্জে গিন্নির কি নতুন রঙ্গ। যা তোক বাড়িতে ঢুকলাম।

দাদা বুঝি এইমাত্র খবরটা পেলেন? আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্য একজন দুঃসংবাদটা শোনাল আমায়। জানেন দাদা, গত রাতে হার্টফেল করে মুখুজ্জেমশাই মারা গেছেন।

একথা শুনে মনটা বাস্তবিকই খারাপ হয়ে গেল। সান্ত্বনা বলতে একটা কথাই বারবার মনে হতে লাগলো যে এবার যেন মরার পর মুখুজ্জেমশাই একটু শান্তি পান। চিন্তার স্রোত আমার থেমে গেল হঠাৎ। কানে এলো মুখুজ্জে গিন্নির করুণ বিলাপধ্বনি—ঘাটের মড়া, হাড় হাভাতে। বজ্জাত মিনসে—তুই তো মরে বাঁচলি। আমাকে কোন যম দুয়োরে রেখে গেলি?

স্বামীর প্রতি মুখুজ্জে জায়ার সশ্রদ্ধ প্রেম ও প্রণয়ের ঘটা দেখে চমকে উঠলাম আমি। মুশুজ্জে মশাই সত্যিই মরে বেঁচেছেন।

শ্রদ্ধশান্তি চুকে গেল নির্ধারিত সময়ে। বৃক্ষের পতনে লতার যে দশা হয় স্বামীর মৃত্যুর পর সুভাষিনী দেবীরও তদনুরূপ দশা হলো। প্রতিপক্ষের অভাবে কেমন যেন বিমর্ষ আপাতগম্ভীর ভাব ধারণ করলেন তিনি। নিন্দুক প্রতিবেশিজন বলতে লাগলোবুড়ো কুচুটে বুড়ির হাত ও মুখ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে। আর আমরা মুক্তি পেয়েছি বুড়ির বাক্যযন্ত্রণা থেকে। যারা বয়সে নবীনা সেই লাস্যময়ীর দল বুড়িকে দেখে বিদ্রূপ করতো—দেখ, দেখ বুড়ি বুড়োকে জ্বালাতে না পেরে কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। আহা রে! বুড়ির কষ্ট দেখে আর বাঁচি না। বুড়ো নিজে মরে বুড়ির আজ এ কি দশা করলো।

তা পরনিন্দা করা যাদের স্বভাব তারা তো করবেই। তবে প্রকৃত তথ্য ছিল এই যে বুড়ি সত্যিই প্রাণের চেয়ে বুড়োকে ভালবাসত। বুড়োর প্রতি বুড়ির প্রেম ও অনুরাগ যে কত গভীর ছিল তা আমরা টের পেলাম কয়েকমাস বাদে। নারকেলের। বহিরঙ্গের ছোবড়া দেখে ভেতরের শাঁসের খবর মেলে না। ঠিক তেমনি মুখুজ্জে গিন্নির উপরের দুর্ব্যবহারের ঘটা দেখে স্বামীর প্রতি তার আবেগ-প্রণয়ের হ্রাসের কথা বিবেচনা করা মূখতার নামান্তর হলো।

মুখুজ্জে গিন্নি অকস্মাৎ একদিন তার ভবলীলা সাঙ্গ করলেন স্বামীবিরহ সহ্য করতে না পেরে। বুড়ির জন্য শোক করার কেউ ছিল না—প্রকৃত সত্যানুসন্ধান না। করার ফলে কেউ দু-ফোঁটা চোখের জলও ফেলল না। নিতান্ত আমাদের অবহেলায় সেই উপেক্ষিতার শেষকৃত্য সমাধা হলো। জগৎসংসার যেমন চলছিল তেমনই চলতে লাগলো। কেবল তার বাক্য বর্ষণের অভাবে পাড়ায় পুনরায় কাক চিল শকুনের উৎপাত বৃদ্ধি পেতে লাগলো। পাড়ায় স্ত্রীলোকেরা কেবল কাক চিলের জ্বালা থেকে মুক্তিপাবার জন্য মুখুজ্জেগিন্নির কথা—তার অনর্গল গালিস্রোতের কথা সংসারে তার প্রয়োজনের কথা স্মরণ করে গোপনে অশুবর্ষণ করতে থাকলো।

***

মৃত্যুর পর বিধবা মুখুজ্জেগিন্নি প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়ে সধবা পেত্নীরূপ পরিগ্রহ করলেন। ইহলোকে এতকাল যিনি আপন সংসারের সর্বময় কীরূপে সংসার পরিচালনার চাবি নিজের অধিকারে রেখে দিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর স্বর্গের চাবির হদিশ করতে পারলেন না তিনি। নরলোকের কর্মফলতঃ তাকে পেত্নীরূপধারণ করতে বাধ্য হতে হলো। এতদিন দোর্দণ্ডপ্রতাপশালিনী হয়ে গোবেচারা স্বামীর উপর নির্মমভাবে ছড়িচালনা করে তিনি এতই প্রীতি ছিলেন যে আজ একাকিনী শ্যাওড়াগাছ নিবাসিনী হয়ে নিরন্তর অন্তর যন্ত্রণা হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগলেন। হাড়ছাড়া দেহের আর কীই বা অবশিষ্ট আছে এখন! কঙ্কালদেহ ধারিনী হয়ে বিগতজন্মের সুখস্মৃতি স্মরণ করে অতিশয় কার হয়ে পড়তে লাগলেন মুখুজ্জে পেত্নী।

ইহলোক সুন্দরী ছিলেন তার মনে যথেষ্ট আত্মশ্লাঘা ছিল। কঙ্কালসার হলেও পূর্বজন্মের ন্যায় রূপাভিমান প্রেতলোকেও তাঁর বড় কম ছিল না। বরং রাতে রাতে তাঁর দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগলো এইভাবে যে নবজন্মের এই দুরন্ত রূপযৌবন কোন প্রেতপুরুষের পায়ে অর্পণ করবেন। দিনের বেলায় প্রেতলোকের অস্তিত্ব থাকে না। তাই রাতে রাতে নব প্রেতযোনি প্রাপ্তা সুন্দরী পুরুষ বিরহে ক্রমশ ক্ষীণতনু আর কৃশ হতে শুরু করলেন। তিনি যতই কৃশ হতে থাকেন ততই তার রূপের জেল্লা বাড়তে থাকে। নিশীথ রাত্রির অভিসারে একাকিনী কান্তারে বসে এজন্মের ভাবী কান্তারের জন্য অন তার অন্তর বারংবার উদ্বেলিত হতে থাকে।

পেত্মীরূপ ধারণ করার জন্য লোকলজ্জার কোন ভয় নেই তার। এখানে তো ইহলোকের মত নিন্দুক লোকই নেই—তো লোকলজ্জা! তার ইহকাল গেছে; কিন্তু পূর্বজন্মের মুখরা স্বভাবের ন্যায় এজন্মেও সেই দোষের কারণে পরকালেরও প্রায় যায় যায় অবস্থা।

মুখুজ্জে পেত্নী যৌবনের তাড়নায় অস্থির। কত রাত না জানি কত কাল ধরে অনন্ত যৌবনমদরসে মত্ত নবীন ভূবাবাজীদের কাছ হতে একটু প্রেম সদ্ভাষণ শানবার জন্য মুখুজ্জে পেত্নীর অন্তরের জ্বালা বেড়েই চলল। কিন্তু ইহলোকে যুবার দল যা করে প্রেতলোকে নবীন ভূরে দল তা করে না। পেত্নী সুন্দরী মনে মনে আক্ষেপ করেন—আমরণ, ছেঁড়াগুলোর ভেতরে সম্ভোগ বাসনা বলে কিছুই নেই। নাকি। আমার মতন যুবতীকে দেখে মর্তের মাসেরা চোখের পলক ফেলত না—আর এখানে ড্যাকরার দল আমাকে দেখেই যেন পালাতে পারলে বাঁচে।

অবশেষে এক অমাবস্যার রাতে চারদিক যখন শুনশান তখন মুখুজ্জে পেত্নী, স্বামীর অভাব তথা পুরুষলালসায় স্বয়ংবরা হবার জন্য ঝোঁপ-জঙ্গল, জলায়-বিলে, পোড়োবাড়িতে হানা দিলেন। চারদিকে অথৈ আঁধারের বন্যা। অন্তরে তার রূপের বন্যা হৃদয়ে পতিবিরহের জ্বালা। মুখুজ্জে পেত্নী রাজজাগা নিশাচর পাখির কর্কশ সুরের টানে বেভুল হয়ে জোনাকির টিপিটিপি আলো জ্বলার মৃদুমন্দ তালে তালে ঝিঝির করুণ রাগিনীতে আপন বেদনা মিশিয়ে দিয়ে ব্যাকুলা-বিহুলা হয়ে পথ চলতে লাগলেন। তাঁর পাগলিনী আলুথালু রূপ দেখে ছানাপোনা কচিকাচা ভূতের দল তার সংস্পর্শ এড়াতে সবেগে স্থান ত্যাগ করতে লাগলো। কেবল এক বৃদ্ধ খঞ্জবধির মেছোভূত জলায় মাছধরার কাজে এত মনোযোগী ছিল যে কামবিধুরা পতিলোভী পেত্নীর আগমনের কোন শব্দ শুনতে পেল না।

মুখুজ্জে পেত্নী অগ্রপশ্চাৎ ভুলে খঞ্জ বধির মেছোভূতকে এইজন্মের পতি হবার জন্য প্রস্তাব নিবেদন করলেন। কানে কিছু না ঢোকার কারণে মেছোভূত নীরব থাকলো পেত্নীসুন্দরীর প্রস্তাবে। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে পেত্নী সুন্দরী শীর্ণবাহুযুগল দিয়ে মেছোভূতের কণ্ঠলগ্না হবার চেষ্টা করামাত্র সে পেত্মীর মুখে ছুঁড়ে মারলো পচা মাছের গলা দেহ।

ঘরে আমার রূপসী শাঁকচুন্নী বউ থাকতে আমাকে ফুসলোনর মতলব আঁটছিস হতচ্ছাড়ি? তোর সাথে আমাকে শাকচুন্নী যদি একবার দেখে তবে তুই মরবি—আমি তো মরবই। যা-যা পালা, রসবতী হয়েছিস, রসিক নাগর চিনতে পারছিস না?

রসবতী আর নাগর কথাগুলো মনের আগুন বাড়িয়ে দিলো পেত্নীর। কিন্তু পচামাছের আঘাতের যন্ত্রণা তাতে কমল না। এতকাল এইভাবে তিনি অপরকে শাসন করে এসেছেন একতরফা ভাবে। আজ ভাগ্যের পরিহাসে একটা ল্যাংড়া ভূতের কাছে তার প্রেম নিবেদন ব্যর্থ হলো। অপমান বোধ তাকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। কিন্তু, এত সহজে হাল তিনি ছাড়বেন না। তিনি জানেন প্রেমের পথে হাজারো বাধা। এত অল্পে হাল ছেড়ে দিলে তার পতিলাভের আশায় যে ছাই পড়বে।

কিছু রাত বাদে প্রথম প্রেমের ব্যর্থতার জ্বালা কিছুটা প্রশমিত হবার পর তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে পতিশিকারে ব্রতী হলেন। একরাতে ঘুরতে ঘুরতে অসংবৃতা হয়ে এক। পরমসুন্দর যৌবনোচ্ছল ব্রহ্মদৈত্যর সাক্ষাৎ পেলেন। ব্রহ্মদৈত্যর অনিন্দকান্তি দর্শন করে মুখুজ্জে পেত্নীর অন্তরের বিরহজ্বালা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। ‘প্রেম দাও, প্রেম দাও’ আকুতিতে তার অন্তঃকরণ প্রেমরসসিক্ত হতে আরম্ভ করলো। স্থান কাল ভুলে মোহিত হয়ে তিনি ব্রহ্মদৈত্যিকে প্রেম নিবেদন করে বসলেন।

আর যায় কোথা, প্রথমবারে পচামাচ্ছে মৃদু আঘাতে প্রেমের লীলা সাঙ্গ হয়েছিল। কিন্তু এবারের আঘাত আরও নির্মম, আরও নিদারুণ। পেত্নীর স্বয়ং হবার আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে ব্রহ্মদৈত্য সহসা তার পায়ের একপাটি খড়ম ধই করে ছুঁড়ে মারলো পেত্নীর মুখের উপর। খড়মটা ঠকাং করে পেত্নীর অন্তঃপাতী নাকে এসে আঘাত করলো। কিছুক্ষণের জন্য মুখুজ্জে পেত্নীর চিন্তাশক্তি লোপ পেল। বোধকরি তিনি জ্ঞান হারালেন।

তিন সংখ্যাটা নরলোকে যত অশুভই হোক না কেন প্রেতলোকে তিনের বড়ই কদর। তিনবার চেষ্টা করলে নাকি সফলতা আসবেই আসবে। মুখুজ্জে পেত্নীর এখন। আশাভরসা বলতে সেই তিন। আজ তৃতীয় পর্বে স্বামী ধরতে বেরিয়েছেন তিনি। বহু্যত্নে ঘেঁটুফুলের মালা গেঁথেছেন। সেই মালা হাতে দুলিয়ে দুলিয়ে পথ চলছে তিনি। আজ তার মনে আশা ও প্রতিজ্ঞার যুগল মিলন। একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বেন আজ। ফুলমালা হাতে নিয়ে পথ চলতে দেখে কেউ তাকে বিদ্রূপ করলো, কেউ কেউ ভয়ে ছুটে পালিয়ে বাঁচলো, তামাশা দেখার আশায় গেছো ভূত, মেছোভূত, কন্ধকাটার দল নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অনুগমন করতে লাগলো। কি জানি কি কারণে সহসা পেত্নীর হৃদয় চঞ্চল হলো। তীব্র খুশিতে ভরে গেল তার মন। তার অন্তর বলছে যাকে তিনি এজন্মে খুঁজে ফিরছেন সে এলো বলে। স্বপ্নসুখের মদিরা পান করতে করতে কম্পিত বক্ষে শঙ্কিত চরণে তিনি ইতিউতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে লাগলেন। চলতে চলতে কত সময় পার হয়ে গেছে খেয়াল নেই তার। তিনি সংবিত ফিরে পেলেন দীন ভিখারি এক ভূতের গানের করুণ সুরে। তেঁতুল গাছের মোটা ডালে বসে তন্ময় হয়ে ভূতবাবাজী গাইছিলো—

বড় সুখে দাদা           হয়েছিনু গাধা
ঘরে ছিল রায়বাঘিনী।
তাকে দিয়ে মালা           বেড়েছিল জ্বালা
সাক্ষাৎ তিনি ডাকিনী।
হাতে হাতকড়া           নাকে দিয়ে দড়া
পিছে পিছে অনুগামিনী।
কাঁচাখেকো দেবী           ভয়ে তাকে সেবি
নির্ঘাত প্রাণঘাতিনী।
রাতভোর হতে           গালি খেতে খেতে
দিন শেষে আসে যামিনী
কানে দেন সুধা           ভুলি সব ক্ষুধা
সারারাত মধুভাষিণী!
সংসারে থেকে          সং রঙ মেখে
হাসিমুখে দুখ চাপিয়া
সেঁতো হাসি হেসে           ভজি অবশেষে
পেত্নীর গুন গাহিয়া।

গান শেষ করে ঝপাং করে ভূতবাবাজী লাফিয়ে পড়ল পেত্নীসুন্দরীর সামনে। হতচকিত হয়ে কিছুটা দুরে সরে গেল পেত্নীসুন্দরী।

ওগো, তুমি কি পথ হারিয়েছ, নাকি কিছু খুঁজছো?

ভূতের কণ্ঠে মধুর জিজ্ঞাসা শুনে মুখুজ্জে পেত্নী বিগলিত হলেন। কত কাল তিনি এরূপ মধুশ্রাবী কথা শোনেননি। কেউ তাকে সামান্যতম প্রণয় নিবেদনও করেনি। তাই আজ যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। কে তুমি? আমার মনের গোপন কথা, গোপন ব্যথা জানলে কি করে? সত্যিই আমি পথ হারিয়েছি গো। একা থাকার জ্বালা সইতে না পেরে স্বামী খুঁজতে বার হয়েছি।

তাই নাকি, তাই নাকি? ওঃ, কি মধুর যোগাযোগ। গতজন্মে পত্নীসুখ জোটেনি আমার। তাই এজন্মে স্ত্রীভাগ্যশালী হবার বাসনায় পথে নেমেছি।

শুভকাল উপস্থিত বিবেচনা করে মুখুজ্জে পেত্নী আনন্দবিহ্বল হয়ে পড়লেন। পাছে দেরী হলে নানা বাধা এসে হাজির হয় সেজন্য তড়িঘড়ি ঘেঁটুফুলের মালা পরিয়ে দিলেন সেই গাইয়ে ভূতের গলায়। গাইয়ে ভূত আবার সেই মালা প্রেমাস্পদের কণ্ঠে পরিয়ে দিল। চারচোখের মিলন হতেই কনের চক্ষুস্থির।

সহসা তারা পরস্পরকে চিনতে পারলেন। আরে, তারা যে ইহলোকের মুখুজ্জে দম্পতি। কিন্তু মালাবদল যে হয়ে গেছে, তাই দুজনের কারও কিছুই করার রইল না। শুধু একটা সত্য তারা উপলব্ধি করতে পারলেন—স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন হলো জন্মজন্মান্তরের চিরবন্ধন—কোন কালেই তা ছিন্ন হবার নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *