2 of 2

আশ্রয় – নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

আশ্রয় – নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

সাততলা বিল্ডিং-এর জানলা দিয়ে ডালহৌসি এলাকার স্কাইলাইন দেখছিল মনোজ। দিনটা মেঘলা। ঘোলা জলের মতো আকাশের রঙ। এত উঁচু থেকে রাস্তাঘাট, চলন্ত যানবাহন, হেঁটে যাওয়া মানুষজন সব মনে হচ্ছে কবিতার প্রতীক।…অস্পষ্ট…।

আজ সকাল থেকে মননজের মাথাটাও ভার মনে হচ্ছে। যন্ত্রণা নেই। তবে মাথা নীচের দিকে ঝোকালে কেমন ভারী লাগছে। আর যেন তাই অফিসে এসে কাজ করতেও ভাল লাগছে না। কয়েকটা ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করেই আবার সরিয়ে রাখল। হয়তো মাথা ধরার ফল গতকাল বেশ রাত অব্দি আড্ডা আর গুরুপাক খাওয়াদাওয়া। স্টেটস থেকে মাসখানেকের ছুটি নিয়ে কয়েকদিন আগে কলকাতায় ল্যাণ্ড করেছে অরণি। আর এসেই মনোজের অফিসে ফোন। প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিল মনোজ। গলাটা চিনতে পারেনি। বছর পাঁচ হ’ল অরণি কাছাকাছি নেই। প্রথম দিকে ঘনঘন চিঠিপত্রের আদান-প্রদান থাকলেও ক্রমশঃ দূরত্ব সম্পর্কের গিটকে আলগা করে দিয়েছে। মধ্যিখানে,—তাও প্রায় বছর দুই আগে, অরণি কয়েকদিনের জন্যে এখানে এসেছিল বিয়ে করতে। মনোজের অফিসে নিমন্ত্রণও করতে এসেছিল। কিন্তু মনোজের সঙ্গে দেখা হয়নি। সে তখন অফিরে কাজে দিল্লী। ফিরে এসে টেবিলে কার্ড দেখে ব্যাপারটা বুঝেছিল।

গতকাল অপ্রত্যাশিতভাবেই ফোনটা পাবার পর মনোজ বুঝতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ছিল। কে কথা বলেছেন জিজ্ঞেস করতেও হয়েছিল তাকে।

—আরে আমি রে আমি। অরণি! ইট সিমস ইউ হ্যাভ ম্যানেজড টু ফরগেট মি—।

—অরণি? আরে কি আশ্চর্য! কোথা থেকে?

–ডোভার লেন থেকে।

–মানে?

–মাসখানেকের ছুটি নিয়ে তোরা কে কেমন আছিস দেখতে এলাম। আজ সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে আয়। মণিকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমার বউ রে! শালা চিঠি দিলে তো উত্তর দিস না।

–চিঠি আমাকে?

–আবার কাকে? তোর বউকে?

বুকের মধ্যে আচমকাই একটা ধাক্কা খেল মনোজ।….

সামলে নিয়ে বলল—একটা চিঠিও পাইনি। মাইরি বলছি। এখানকার পোস্টাল সার্ভিস ভেরি পুওর। এ দেশটা তো আর তোর স্টেটস নয়–।

–যাই হোক। আজ চলে আয়। সাতটা নাগাদ। আই উইল এক্সপেক্ট ইউ ও. কে?

–ও. কে.। যাব।

গিয়েছিল মনোজ। অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরী হলেও ঠিক সময়মতোই পৌঁছে গেল। ডোভার লেনে অরণিদের বাড়িতে শেষ এসেছিল ঐ বছর পাঁচ আগেই। এতদিন পর হলেও বাড়িটা চিনতে অসুবিধে হ’ল না। গোলাপী রঙ। দোতলা বাড়ি। জানলার কাচ নীল। কলিং বেল টিপতেই যিনি দরজা খুলে দিলেন তিনি অরণির বাবা।

—আরে-এসো-এসো। অরণি সেই কখন থেকে তোমার জন্যে বসে আছে। সিঁড়ির চাতালের কাছে পৌঁছে অনিশ্চিত ভাবে দাঁড়াতেই বললেন—যাও। দোতলায় আছে। মনোজ লক্ষ্য করল পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলেও সময়ের থাবা তেমনভাবে ভদ্রলোকের চেহারায় পড়েনি। সেই আগের মতোই দীর্ঘ, টানটান, সুন্দর চেহারা। শুধু মাথার চুলগুলো সব পেকে গেছে।

—কেমন আছেন মেশোমশাই? সিঁড়িতে উঠতে উঠতে মনোজ জিজ্ঞেস করে।

—ঐ আছি আর কি! রিটায়ার্ড ম্যান! আমাদের আর থাকা।

—মাসিমা?

—ঐ একরকম। ওনার তো আবার আথ্রাইটিসের কষ্ট!

-তাই নাকি? বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে অরণির মাকে দেখতে পেল। কথাবার্তা শুনে মনোজের গলার আওয়াজ বোধহয় চিনতে পেরেই দালানের শেষে একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলন। মনোজকে দেখে, ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন যে চিনতে পেরেছেন। দোতলায় উঠেই সামনের ঘরে সোফায় কাত হয়ে অরণি বসেছিল। দেখেই লাফিয়ে উঠল—আয় আয়। মণিকা দেখো কে এসেছে। আজ দুপুরে যাকে ফোন করেছিলাম।

বেশ ভালই দেখতে অরণির বৌকে। লম্বা উজ্জ্বল ফর্শা। তীক্ষ্ণ নাক। স্বপ্নালু চোখ। মাথার চুল, সচরাচর হয় না, অদ্ভুত কোঁকড়ানো। বয়কাট। সব মিলিয়ে একটা আধা-দেশী, আধা বিদেশী ছাপ। মনোজকে দেখে বেশ আন্তরিকভাবে হাসল।

–বসুন। আপনার গল্প প্রায়ই শুনি ওর কাছে। একা এলেন? মিসেসকে আনলেন না।

বুকের মধ্যে আচমকা আবার ধাক্কা খায় মনোজ। চকিতে সামলে নিয়ে, প্রশ্নটা এড়িয়ে অল্প হেসে নাটকীয়ভাবে সে নিজেকে বলতে শোনে—কিরে অরণি? বউটাকে দেখছি ভালই বাগিয়েছিস। ইউ আর এ লাকি চ্যাপ। স্পষ্টতই খুশীতে আরও উজ্জ্বল হয়ে মণিকা হেসে ওঠে। অরণিও হাসে। তারপর বলে শালা—অন্যের বউ তোর কাছে তো বরাবরই সুন্দরী রে! তোকে আর আমি চিনি না? কিন্তু নিজের বউটাকে ঘরের মধ্যে চাবি দিয়ে এলি কেন? সঙ্গে আনতে পারলি না? বেশ একসঙ্গে চারজনে আড্ডা দেওয়া যেত। তুই তো বিয়ে করলি আমি স্টেটসে যাওয়ার পর। আমি তবু একটা ইনভিটেশন কার্ড তোর অফিসের টেবিলে রেখে আসতে পেরেছিলাম। তুই তো তাও পাঠাসনি! বিয়ে করে, হনিমুন-টুন করে, বউটাকে বাসি করে তারপর একটা চিঠি পাঠালি যে তুই বিয়ে করেছিস। বল—এটা কি বন্ধুর মতো কাজ হ’ল?

মণিকা একটু চাপা গলায় বলল—আঃ অরণি। কি আজেবাজে ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করছ?

মনোজ তাড়াতাড়ি হেসে বলল—ঠিক আছে। ঠিক আছে। অরণিটা বরাবরই কিন্তু এরকম। কাকে কি বলতে হয় জানে না। দেখছি এতকাল স্টেটসে থেকেও কথা

বলতে শেখেনি। সেইসব সাত-পাঁচ ভেবেই তো বউকে আনিনি। কি উল্টোপাল্টা বলে দেবে! রসিকতাটা ধরতে পেরে ওরা দুজনেই গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল। খানিক বাদেই বিদেশী সিগারেট অফার করল অরণি। তারপর মণিকার দিকে তাকিয়ে বলল—যাও। টী-এর অ্যারেঞ্জমেন্ট করো। আমরা ইন দি মিনটাইম দুজনে সুখ-দুঃখের গল্প করে নি।

—নিশ্চয়ই। মণিকা চলে গেল।

গল্প-সল্প বেশ অনেকক্ষণই—চলল। ফস করে অরণি একবার জিজ্ঞেস করে বসল—আমাদের বয়স-টয়স কতো হলে রে মনোজ? ঠিক খেয়ালও থাকে না।

–কম হল না রে!

–কতো?

—তুই আমার থেকে এক বছরের ছোট। আমার আটত্রিশ চলছে। তুই নিশ্চয়ই সাঁইত্রিশ। আমাদের দুজনেরই বেশ লেট ম্যারেজ।

–সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছরকে তুই বেশী বয়স বলছিস? দূর! এখন আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করা যায়।

-সত্যি? মনোজ খানিক্ষণ চুপ করে সিগারেট টানল। অরণির এই কথার মধ্যে সে যেন এক গভীর অর্থ খুঁজে পেয়েছে। অরণি এবার বলল-স্টেটসে একবার চলে আয় মনোজ। দেখে যা কতো আরামে আছি! বডোসড়ো চাকরি তো অনেকদিন করছিস। মাইনেও মনে হয় খারাপ পাস না। দু-সপ্তার ছুটি নিয়ে চলে আয়। শুধু প্লেনভাড়া তোর। ওখানকার থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য জায়গায় বেড়ানো খরচ আমার। কিরে যাবি?

-আচ্ছা তুই তো এখনও বেশ কয়েকদিন আছিস। ভেবে দেখবখন। মণিকা বেশ কিছুক্ষণ চা আর স্যাণ্ডউইচ রেখে গেছে। একটা স্যাণ্ডউইচ ভেঙে মুখে দেয় মনোজ। অরণি চা-এর কাপে চুমুক দিয়ে বলে—চলে আয়। কলকাতায় কি করে যে তোরা ডে-টু-ডে লাইফ চালাস! এই কবছরে রাস্তাঘাটের যা হাল দেখছি। সেদিন দমদম এয়ারপোর্টে নেমে জানিস তো একঘন্টার ওপর দুজনে দাঁড়িয়ে আছি। একটা ট্যাক্সি পাই না! সবাই বলে—এখন রাস্তা জ্যাম। সাউথের দিকে যাব না। শেষ অব্দি একজন রাজী হ’ল। তাও আবার তাকে এক্সট্রা কুড়ি টাকা দিতে হ’ল! ক্যান ইউ ইমাজিন? একজন ট্রাফিক পুলিশকে বললাম। গ্রাহ্যই করল না?

চায়ের কাপে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে মনোজ অল্প হেসে বলল—আমার কাছে। এসব নতুন কিছু নয়। যা—ওসব সাহেব-মার্কা কথাবার্তা ছাড়তো। কলকাতা যে এরকম সে ত’ বিশ্বশুদ্ধ সবাই জানে। তুই যখন এখানে রোজ থাকতি—তখনও কি খুব ভাল ছিল?

প্রায় ঘন্টা-তিনেক গল্প করা আর ঘন ঘন সিগারেট টানার পর উঠতে যাবে। মণিকা এসে বলল—খেয়ে যেতে হবে। অরণির মা বাবাও নাকি তাই বলছেন। অগত্যা আরও খানিকটা সময় গেল। খাওয়া-দাওয়া সেরে রাস্তায় নেমে যখন ট্যাক্সি নিল মনোজ তখন রাত সাড়ে-দশটা বেজে গেছে। মণিকা দোতলার ব্যালকনি থেকে বলল—এবার এলে-মিসেসকে নিয়ে আসবেন।…

জানলার ধার থেকে সরে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল মনোজ। কিছু ফাইল আগে থেকেই ছিল। আবার সকাল থেকে কিছু ফাইল এসে জমেছে। ময়লা, ছেঁড়া, স্মৃতির মতো ধূসর ফাইল সব। খুললেই পড়তে হবে প্রতারক ভাষা। নিজেকে লিখতেও হবে প্রতারক ভাষা। এভাবেই কতদিন? …অনেকদিন…। গতকালই তো অরণির সঙ্গে বয়স হিসেব হচ্ছিল। আটত্রিশ চলছে তার। কম করে এখনও বছর কুড়ি এই চাকরি করে যেতে হবে তাকে। কোনো পরিত্রাণ নেই। অবশ্য এই চাকরিটা আছে বলেই সমাজে তার যাকে বলে একটা পজিশন আছে। এই চাকরিই তাকে দিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়ায় একটা ছিমছাম ফ্লাট। গাড়ি। কিন্তু এসব পেয়েও কি সে সুখী? শাস্তি এলো কি জীবনে? কোনদিন আসবে? দিনের শেষে বাইরের কাজের পর ক্লান্ত মানুষেরা তাড়াহুড়ো করে তোড়জোড় চালায় বাড়ি ফেরার। প্রত্যেকেরই বাড়ি আছে। সংসার আছে। সন্তানের উষ্ণ সান্নিধ্য আছে। কিন্তু তার কি আছে! বিয়ে করেও, সংসার শুরু করেও বিবাগী সে। কার জন্য বাড়ি ফিরবে? গতকাল প্রসঙ্গটা অনেকবার উঠেছে অরণির কথাবার্তায়। আর বরাবরই অস্বস্তি হয়েছে তার। ব্যক্তিগত সমস্যার কথা কাউকে বলে লাভ কি? চেম্বারের দরজা খুলে পিয়ন এসে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে তাকাল মনোজ।

–কিছু বলবে?

—একজন ভিজিটর এসেছেন স্যার–।

—আজ আর কারুর সঙ্গে দেখাটেখা করা যাবে না। ভীষণ ব্যস্ত আমি। এখনই বেরিয়ে যাব। সত্যিসত্যিই অ্যাটাচিটা নিয়ে প্রস্তুত হয় মনোজ।

—আচ্ছা স্যার।

লিফটে নেমে এসে এদিক ওদিক তাকায়। সামনেই আছে গাড়িটা। এখন বিকেল চারটে। গাড়িতে উঠে বসে সে। ড্রাইভার ঠিক বুঝতে পারে না কোথায় যেতে হবে। তাই জিজ্ঞেস করে।

-পার্কস্ট্রীটের মোড়ে নামিয়ে দাও।

–ভীষণ জ্যাম স্যার। কি একটা মিছিল বেরিয়েছে। সত্যিই ভীষণ জ্যাম। সারি সারি গাড়ি সামনে। আবহাওয়া সত্যিই বিশ্রী আজ। সারা দিন আকাশের মুখ ঝুলে আছে। রোদের লেশমাত্র নেই। বিকেল বেলাতেও শহরের কোথাও কোন ঔজ্জ্বল্য নেই। পথচারীদের মুখেও যেন বিষণ্ণতা লেগে আছে। সবাই যেন রিমোট কন্ট্রোলে চালিত হয়ে যন্ত্রের মতো হাঁটছে, হাত-মুখ নাড়ছে, ফিসফাস কথা বলছে সবাই। কারুরই যেন কোন প্রাণ নেই, সজীবতা নেই। কি যেন বলছিল অরণি! আমেরিকায় যেতে? ওখানে জীবনকে জীবনের মতো উপভোগ করা যায়। মেদিনী কাপিয়ে বেঁচে থাকা যায়। তাই যাবে কি? সঞ্চয়ের টাকা যা আছে প্লেনভাড়া কোন ব্যাপার নয়। এখন সে একেবারে প্রায় মুক্ত, স্বাধীন। পিছুটান নেই। তিনশো বছরের এই প্রাচীন শহরে আহত ইঁদুরের মতো মুখে রক্ত তুলে বেঁচে থেকে কি হবে? যদি এখনই চাকরি থেকে ইচ্ছাকৃত অবসর নেয় তাহলে সরকারী তহবিল থেকে প্রায় লাখ দেড়েক টাকা। তারপর যদি ভিসা ম্যানেজ করা যায় তাহলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা আমেরিকা যে। কোন জায়গাতেই যেতে অসুবিধা কোথায়। চাকরি নাকি বিদেশে পেতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু সত্যিই কি সে যেতে পারবে? সত্যিই কি তার কোন পিছুটান নেই? এই কয়েক মাসের নিঃসঙ্গতায় সে কি একবারও মনে মনে চায়নি বনশ্রী ফিরে আসুক…।

সমস্যাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে মনোজ। যখন প্রচণ্ড অশান্তির মধ্যে দিয়ে, মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কাটছে, বিনিদ্র রাতগুলো কাটছে তখন প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত সে নিজের জীবনের বিশ্রী অভিজ্ঞতাগুলো চিরে চিরে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে। এরকমও তো হতে পারে যে সে তার মতো করে সমস্ত কিছু দেখছে। ফলে নিজের দোষ-ত্রুটিগুলো হয়তো তার নিজের কাছে ধরা পড়ছে না। এবং কিছুটা সেকারণেই সে অনেক ভেবেছে। নিজেকে দর্শকের আসনে বসিয়ে, নিরপেক্ষভাবে সবকিছু বিচার করতে চেয়েছে। কিন্তু না; বারবার তার মনে হয়েছে বনশ্রীর সঙ্গে এই যে তার মতের অমিল,দৈনন্দিন জীবনের খুব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েও তর্কাতর্কি; এসব্বে কারণ বনশ্রীর অদ্ভুত, অপরিণত মানসিকতা। ব্যাপারটা সে প্রথম উপলব্ধি করে বিয়ের মাস ছয় পরে—পুজোর সময়। বোনাসের টাকাটা হাতে পেয়ে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সে। অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেই বৌকে প্রস্তাব দিল চলো আজ মার্কেটিংএ বেরোব। একটা খুব দামী শাড়ি কিনে দেব তোমাকে।

–সত্যি? উত্যু বনশ্রী বলল।

—হ্যাঁ। চলো।

—তাহলে মাকে একটা ফোন করে দি?

–মাকে? কেন?

—মা সঙ্গে থাকলে খুব সুবিধে হবে। ওনার মতো শাড়ি পছন্দ করতে আমি পারব না। আর তাছাড়া আমার শাড়ি এ যাবতকাল সবই পছন্দ করে এসেছে মা। আমার নিজের পছন্দে কোনদিন কিছু কিনতেই পারি না!

গম্ভীর হয়ে যায় মনোজ। একটু আগেকার আবেগ, উচ্ছাস-সব যেন লোডশেডিং হওয়ার মতো নিভে যায় দপ করে! নিজেকে সামলে নেবার জন্যে একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বলে বিয়ের আগে না-হয় তোমার মা সব পছন্দ করে দিতেন। কিন্তু বিয়ের পরে তো আর সেরকম হওয়া উচিত নয়। এবার থেকে আমিই না-হয় পছন্দ করে দেব তোমায় সবকিছু।

–ধ্যাৎ। ছেলেরা আবার শাড়ি কিনতে পারে নাকি? আমার বাবা বলেন এরকম। চেষ্টা যে ছেলে করবে সে বোকা। এরকম কথার পর আর সেদিন মার্কেটিং করা হয়নি মনোজের। অফিসের কি একটা জরুরী কাজ মনে পড়ে গিয়েছিল তার। বনশ্রীকে সে পুজোর বাজারের টাকা ধরে দেয় পরে।

বনশ্রীর এই অদ্ভুত মাতৃ-নির্ভরতা ক্রমশঃ তার কাছে বিশেষভাবে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতিদিনই দুপুরবেলা বনশ্রী নিজের বাড়িতে মা-এর কাছে চলে যেত। মনোজ অফিস বেরিয়ে যাবার পর তার নাকি খুবই ফাঁকা ফাঁকা, একা লাগে। বাপের বাড়ি তো আর বেশী দূর নয়। পার্ক সার্কাস। অনেক বোঝাতে চেয়েছে সে। হোক না দূরত্ব কম, তবুও বিয়ের পর নিজের ঘরবাড়ি ফাঁকা রেখে কেন প্রায়ই প্রতিদিনই মায়ের কাছে যেতে হবে তাকে? তার থেকে দুপুরে কিছু পড়াশোনা করো। হাতের কাজ করো। কিংবা নতুন নতুন রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করো। আর যদি কোন স্কুলে চাকরি করতে চাও—তাও করতে পারো। চেষ্টা করো সে ব্যাপারে। কিন্তু কোন পরামর্শই মনঃপূত হয় না বনশ্রীর। তার পড়তে ভাল লাগে না। হাতের কাজ করতে ভাল লাগে না। একা একা কিছুই ভাল লাগে না। সুতরাং নিঃসঙ্গ দুপুর ও বিকেলগুলো সে মায়ের কাছে কাটিয়ে আসে। যদি সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকত ব্যাপারটা তাও না হয় হ’ত। কিন্তু এর থেকেও বাড়াবাড়ি শুরু হল। প্রায় দিনই অফিস থেকে সন্ধ্যের পর কোয়ার্টারে ফিরে মনোজকে দেখতে হয় দরজায় তালা ঝুলছে। তখনও ফেরেনি বনশ্রী। ডুপ্লিকেটে চাবির ব্যবস্থা করতেই হয় মনোজকে। এবং একদিন ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেল। নিজেই দরজা খুলে, প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সে নিজেই এক কাপ কফি করার কথা ভাবছে,—ঠিক তখনই ফোন।

—তুমি বলছ? ওধার থেকে বনশ্রীর বেশ উচ্ছ্বসিত গলা।

—হ্যাঁ।

—খুব রাগ করেছে মনে হচ্ছে। প্লীজ রাগ কোরো না। শোনো, সেই আমাদের ফুলদিকে মনে আছে?

—কে?

ফুলদি গোয় আমাদের বিয়ের দিন রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে তোমার সঙ্গে খুব ইয়ার্কি মারছিল। আমার মাসিমার মেয়ে। ফুলদি আর ওর হাজব্যান্ড আজ বিকেলেই পুনে থেকে কলকাতায় এসেছে। আমাদের বাড়ি উঠেছে। তো আজ সবাই মিলে ডিনার সারব। তুমিও চলে এসো। ওয়েট করছে সবাই।

—আমার শরীর খারাপ লাগছে। যেতে পারব না।

—যাঃ। সকালে তো সেরকম কিছু মনে হ’ল না। প্লীজ এসো, না এলে কি ভাববে বলো তো সবাই?

—তুমি যেতে পার। আমি যাব না।

-আচ্ছা। মা তোমার সঙ্গে কথা বলবে। বিরক্তির সঙ্গে ফোনটা ধরে থাকতে হয় তাকে।

—কে? মনোজ বলছ?

–হ্যাঁ। উত্তরটা দিয়েই প্রশ্নটা অবাস্তর মনে হয় তার।

–বনু কি বলছে তোমার শরীর খারাপ? আসতে পারবে না!

–না।

-ঠিক আছে। শরীর খারাপ থাকলে এসো না। কিন্তু বনু আজ একটু আমাদের সঙ্গে বেরোবে। বুঝেছো? আজ রাতে আর ফিরতে পারবে না। আগামীকাল ফিরবে। আর কথা বাড়ায়নি মনোজ। রিসিভার নামিয়ে রেখেছিল। রাগটা তার বনশ্রী আজ ফিরবে না বলে নয়। অনেকদিন পর আত্মীয়দের দেখা পেয়েছে। আজ একটু বাই মিলে থাকতেই পারে। কিন্তু সে তার শরীর খারাপ বলা সত্ত্বেও বনশ্রী তেমন কোন কৌতূহল বা উদ্বেগ প্রকাশ করল না ব্যাপারটাতে। অবিশ্বাসই করল। এতটা ঠিক নয়। মনোজের হঠাৎ মনে হল স্বাধীনতার সুযোগ যেন খুব বেশীই নিচ্ছে বনশ্রী। যৌথ জীবনের ন্যূনতম এটিকেটগুলোও মানছে না!

পরের দিন বনশ্রী ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই মনোজ প্রসঙ্গটা তুলতে চাইল।

—শোন, একটা কথা তোমায় অনেকদিন ধরে বলব ভাবছিলাম।

—কি কথা? ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বনশ্রীর জিজ্ঞাসা।

—অফিস থেকে খেটেখুটে বাড়ি ফেরার পর কোন হাজব্যান্ডেরই কিন্তু তালা খুলে বাড়ি ঢুকতে ভাল লাগে না।

—ওরকম বেঁকিয়ে বলছ কেন? মাঝে মাঝে একটু অসুবিধে তো হতেই পারে।

–না। প্রায়ই দুপুরে তোমার বেরিয়ে যাওয়া চলবে না। একা লাগলেও থাকা অভ্যাস করতে হবে। অনেককেই ওরকম থাকতে হয়। তা বলে তুমি রোজ রোজ বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকবে এটা আমার একেবারে মনঃপূত নয়।

তোমার মন রেখে যে সবসময়ে চলতে হবে এরকম কোন মানে নেই। আমার যখন যেখানে খুশী যাবো। তুমি আমার ওপরে কোন ফরমান জারি করতে পার না।

-আমি সব পারি। আমি তোমার হাজব্যান্ড…।

–তাই নাকি? হাজব্যান্ড হলেই বুঝি যা ইচ্ছে শাসন করা যায়? আসলে তুমি ভীষণ গোঁড়া। প্রেজুডিসড! বাইরে যতই আধুনিকতা দেখাও…।

—আমি গোঁড়া? …প্রেজুডিসড? আর তুমি কি? বিয়ে করার পরও মায়ের কথায় ওঠো বসো? কচি খুকী নাকি? শাড়ি চয়েস করতেও এখনও তোমার মাকে দরকার হয়! কেন তোমার নিজের কোন ব্যক্তিত্ব নেই? তাহলে বিয়ে করেছিলে। কেন? মায়ের কোলে দুধের বোতল নিয়ে শুয়ে থাকতে পারতে।

–ইনসালটিং কথাবার্তা বলবে না।

—শেষ কথা আমি বলে দিলাম। কাল থেকে দুপুরে বেরোনো বন্ধ।

—আচ্ছা দেখা যাবে। বলে মেজেয় দুমদাম শব্দ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বনশ্রী। শুধু তাই নয়। সেদিন রাতে কিছু খেল না। এবং এক বিছানায় না শুয়ে পাশের ঘরে শুল। খাটটাকে সেদিন বিশাল এক প্রান্ত মনে হয়েছিল মনোজের। বনশ্রীর ব্যবহারে সে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সারারাত তারও ঘুম এলো না। পরের দিন। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে চান সেরেই মনোজ অফিসের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটা রেস্তোরাঁতে চা খেতে খেতে তার মনে হ’ল সকাল থেকে বনশ্রী এক কাপ চা করে দেওয়া দূরে থাক একটা কথা অব্দি বলেনি। সন্ধেবেলা মনের মধ্যে একটা চাপা টেনশন নিয়ে বাড়ি ফিরে সে দেখল দরজায় তালা। তার মানে বনশ্রী তার নিষেধকে কোন পাত্তাই দিল না। উপরন্তু তার দিকে ছুঁড়ে দিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কোন খবর নেবার চেষ্টা করেনি সে বনশ্রীর। নিজের গোঁ নিয়ে সে বসে থাকল বাপের বাড়ী। একদিন বিকেলে মনোজের অফিসে ফোন বেজে উঠল…।

-হ্যালো?

—আমি বলছি। আজ আমাকে নিতে আসবে একটু? ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ ভেবে নিল মনোজ। তারপর গম্ভীর গলায় বলল

—কেন? হঠাৎ! খুব একটা খারাপ আছ নাকি?

—নিতে আসবে একটু? প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি।

—সময় নেই। দরকার মনে করলে তুমি নিজেই আসবে। ডুপ্লিকেট চাবি তো তোমার ব্যাগেই থাকে। ফোনটা রেখে দিয়েছিল। চুম্বক-টানেই যেন মনোজ সেদিন বাড়ি ফিরল বেশ তাড়াতাড়ি। দরজার দিকে তাকিয়েই তার বুকটা ধড়াস করে উঠল। তালা খোলা। ভেতর থেকে বন্ধ দরজা। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিল বনশ্রী। একটু যেন লাজুক ভঙ্গীতে তাকালোও। খানিক পরেই নিয়ে এল চা। প্লেটে ভাল বিস্কুট। সেই বিয়ের পর প্রথম কয়েকটা দিনের মতো। চায়ের কাপ টেবিলে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মনোজ এক হ্যাচকা টানে বনশ্রীকে টেনে নিল নিজের দিকে। তারপর চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে লাগল তার ঘাড়, গলা, বুক…। পরপর কয়েকদিন খারাপ কাটল না। একদিন ছুটি নিয়ে মনোজ বউকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখল। তারপর ফেরার মুখে খানদানী হোটেলে ডিনার। যেন পল বেয়ে গড়িয়ে নামছিল স্রোত। গল গল করে কথা বলছিল দুজনে। যেন অতীতের তেতো, বিস্বাদ দিনগুলোকে ভুলে আবার ওরা দুজনে দুজনকে ঘিরে বাঁচতে চাইছে। একদিন রাতে ঘনিষ্ঠ হবার মুহূর্তে মনোজ বনশ্রীকে জানাল তার ইচ্ছার কথা। আর অপেক্ষা করা ঠিক নয়। বয়স বেড়ে যাচ্ছে দুজনেরই। এবার মনোজ বাবা হতে চায়। তার নিবিড় আলিঙ্গন থেকে যেন চাবুকের মতো ছিটকে বেরিয়ে এল বনশ্রী। না এত তাড়াতাড়ি নয়। বিবাহিত জীবনের স্বাদ আরও কিছুদিন নির্ভেজাল, নির্ঝঞ্ঝাট উপভোগ করতে চায় সে। এটা মনোজকে মেনে নিতেই হবে। এত তাড়াতাড়ি ঐসব ঝক্কি? অসম্ভব…।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনোজ জিজ্ঞেস করে—এটা কি বলছো তুমি? সন্তান মানে ঝামেলা? বহুক্ষণ যুক্তি দিয়ে বোঝালেও বনশ্রী বুঝতে চায় না। শেষকালে ফস্ করে বলে বসে—ঠিক আছে। আমাকে একটু মায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে দাও। কথাটা শুনেই মনোজের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সন্তান তারা আনবে কি আনবে না এ ব্যাপারে তাদের যৌথ সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে আবার অন্য কারোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এরকম অদ্ভুত কথা কে কবে শুনেছে! এসব কি বলছে বনশ্রী? সত্যিই বুঝতে পারে না মনোজ। চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলে—তোমার মা যদি এখনও তোমার অভিভাবক থাকেন তাহলে আমার সঙ্গে থাকার কোন প্রয়োজন আমি দেখি না। কাল ভোরবেলাই তুমি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। তোমার মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে। আর কোনদিন এ-মুখো হবে না।

-কি? আমাকে এভাবে অপমান করলে? নিজের স্ত্রীকে এখনও সম্মান দিতে শেখোনি? রাষ্টিক! ব্রুট কোথাকার! এবার সত্যি সত্যিই মেজাজ হারিয়ে ফেলে। মনোজ। যেনবা প্রকৃত ব্রুটের মতোই সে বনশ্রীর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কোমল গালে পরপর দুটো চড় কষায় সাপটে! ফর্সা গাল রক্তিম আকার নেয়। যেন নিজের অজাইে ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলে মনোজ। বনশ্রী বোধহয় এতটা কল্পনাও করতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার দুগাল বেয়ে নিঃশব্দে জল বিছে মতো এঁকেবেঁকে গড়ায়।

—তুমি…তুমি আমাকে মারলে? অস্ফুটে বলে বনশ্রী।

—এতোবড়ো সাহস তোমার আমাকে রাষ্টিক বলো? আমার স্ট্যাটাস জানো?

—এই মুহূর্তে আমি বেরিয়ে যাব বাড়ি থেকে। আমি থাকব না তোমার সঙ্গে। একটা অসভ্য, ইতর লোকের সঙ্গে কিছুতেই থাকব না!

কাঁদতে কাঁদতে পাশের ঘরে গিয়ে সুটকেশ গোছাতে থাকে সে। আলমারী এবং আলনা থেকে শাড়ি, জামা, অন্যান্য টুকিটাকি তীব্র রাগে এলোমেলো ছুঁড়ে ফেলতে। থাকে। মনোজ বুঝতে পারে তাদের এই এতোল-বেতোল সম্পর্কের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তারা। খাদের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু পরেই সুটকেশ হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বনশ্রী। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা। মনোজ কোন রকম বাধা দেবার চেষ্টা করে না। বিছানায় চোখ বুজিয়ে শুয়ে শুয়েই সে নিশ্চিত হয় যে, একটা ট্যাক্সি বনশ্রী ঠিক পেয়ে যাবে। এবং কোনরকম রিস্ক ছাড়াই বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠবে…।

নির্দেশমতোই ড্রাইভার অনেকক্ষণ মনোজকে নামিয়ে দিয়ে গেছে পার্কস্ট্রীটের মোড়ে। আনমনা মনোজ নিজেকে একটা বুক-স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে দেখল। কোথায় যেন সে পড়েছিল আবহাওয়ার সঙ্গে মেজাজের একটা অদৃশ্য যোগাযোগ আছে। সারাদিন আকাশ গুম হয়ে থাকায় তার মনও যেন ভার হয়ে আছে। অতীতের তিক্ত স্মৃতিসব বুড়বুড়ি কাটছে। ভীষণ একা আর অসহায় লাগছে। একটা সাজানো জীবন সে চেয়েছিল। পরিবর্তে পেয়েছে একটা ফাটা, ভাঙা, বিশৃঙ্খল জীবন। এই মুহূর্তে সে কি করবে জানে না। অরণির বাড়ি যাবে? কাটিয়ে আসবে কিছুক্ষণ? কিন্তু মনে পড়ে গেল। আজ থাকবে না অরণিরা। কোথায় যেন বেরোবে। আবহাওয়ার মালিন্য থাকলেও পার্কস্ট্রীট কিন্তু প্রতিদিনকার মতো নিজস্ব বিভায় উজ্জ্বল। দোকানপাট, অভিজাত রেস্তোরাঁ ও বারগুলি ঝলমল করছে আলোয়। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সামনের এক বারের দরজা সামান্য খুলে গেল। বাইরে বেরিয়ে এলো মার্কিনী উপন্যাসের চরিত্রের মতো এক উজ্জ্বল যুবক আর যুবতী। সপ্রতিভ ভঙ্গীতে ফুটপাতের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠে গেল। বারের ভেতরকার ঠাণ্ডা হাওয়া এক ঝলক ছুঁয়ে গেল মনোজকে। হঠাৎই মদ্যপান করার করার ইচ্ছে জাগল তার। লম্বা পা ফেলে সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। তার দীপ্ত হাঁটার ভঙ্গীতে উর্দি পরা বেয়ারা সচমকে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল। ভেতর চাপা গুঞ্জন, তবে এখন মজলিশ তেমনভাবে জমে ওঠেনি। অধিকাংশ টেবিলই ফাঁকা। সিগারেটের ধোঁয়া কুয়াশার মতো জমে আছে আলোগুলোর নীচে। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় অলৌকিক লাগছে অভ্যর। মননজের মনে হয়, হঠাই যেন সে সমুদ্রের ভাসমান কোন জাহাজের কেবিনে ঢুকে পড়েছে কোণের দিকে একটা ফাঁকা টেবিল দেখে সে বসে পড়ে। খানিক পরেই সুবেশ অ্যাটেনড্যান্ট নোটবুক নিয়ে এগিয়ে আসে অর্ডার নেবার জন্য। কিছু খাবার আর হুইস্কির অর্ডার দেয় সে। বেয়ারা এসে দিয়ে গেলে কয়েকটা কাজু তুলে নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে মনোজ চারপাশে তাকায়। কিছু কিছু টেবিলে নারী-পুরুষেরা একসঙ্গেই বসে মদ্যপান আর গল্প করছে। নিজেদের নিয়েই মশগুল তারা। কারুর দিকে তাকাচ্ছে না। শুধু,ভাল করে তাকায় সে। বিপরীত দিতে একটা টেবিলে একজন বসে আছে একা। মহিলা। কারুর কি অপেক্ষায় এরকম পরিবেশে একা একজন মেয়ে। একটু অবাকই লাগে তার। বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকায় মনোজ। মেয়েটিও তাকায়। সেই তাকানোর মধ্যে যেন কিসের ইঙ্গিত। সাজটা বেশ উগ্র। স্লিভলেস ব্লাউজে কাধ আর হারে অনাবৃত অংশ চকচক করছে। একটা আলগা চটকও যেন ছড়িয়ে আছে মেয়েটির মুখে। যেন মনোজের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনেই মেয়েটি অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসল। গুছিয়ে নিতে চাইল শাড়ির আঁচল। আর সেই মুহূর্তে পাশ থেকে ওর নিটোল স্তনের ঘনত্ব বুঝে নিতে অসুবিধে হ’লনা মনোজের। হুইস্কির ধীর প্রভাব কি কাজ করতে শুরু করেছে? মাথা যেন আরও ভারী হয়ে আসছে। দৃষ্টিও ঝাঁপসা! শরীরের মধ্যে যেন কিসের টান অনুভব করে সে। হঠাৎই মনে পড়ে, বনশ্রীর চলে যাওয়ার পর থেকে আজ চার মাস তার। শরীর উপবাসে আছে। একটা নারীশরীর নিজের মতো করে নাড়াচাড়া করার ইচ্ছেটা। যেন হঠাই চাড়া দিয়ে ওঠে তার ভেতর। বিল মিটিয়ে দিয়ে সে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কথা বলছে না মেয়েটি। কিন্তু ওর ঠোঁটের কোণে প্রচ্ছন্ন হাসি। আর কথা বলছে চোখদুটি!

–ইয়েস? চাপা গলায় বলে মনোজ।—উড ইউ লাইক টু গো? অদ্ভুত ভঙ্গী করে হাসে মেয়েটি। তারপর শরীরে ঢেউ তুলে নির্বাক উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে মনোজের পেছন পেছন বেরিয়ে আসে।

—কোনদিকে যাওয়া যায়?

—যেদিকে নিয়ে যাবেন। গাঢ় লিপষ্টিক ঠোঁটে। মনে হ’ল রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে আছে। কোথায় তোলা যায় একে? ফাঁকা বাড়িতে? কিন্তু পাড়ার কেউ যদি দেখে ফেলে? গলির মোড়ে যে ক্লাবটা আছে সেখানকার বোম্বেটে-মার্কা ছোঁকরাগুলো কিন্তু তাকে দেখেই সিগারেট লুকোয়। সম্মান দেয় তাকে। অসম্ভব…।

–কোন পার্কে-টার্কে গিয়ে বসা যাক! অনিশ্চিতভাবে প্রস্তাব দেয় সে।

–যা করার তাড়াতাড়ি করুন। গঙ্গার ঘাটে চলুন না।… নৌকোয়…। চাপা হাই তোলে মেয়েটি। মনোজ তার মুখের গহ্বর স্পষ্ট দেখতে পায়। দাঁতগুলোর ভেত্রদিক কি নোংরা! কালো ছোপ! তীব্র বিতৃষ্ণায় কুঁকড়ে যায় মনোজ।

–ট্যাক্সি-ফ্যাক্সি যাহয় একটা ডাকুন না। কথাটা বলেই তার অপেক্ষা না করে মেয়েটি নিজেই হাত তুলে একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে দাঁড় করায়। উঠে বসে। সুতরাং মনোজকেও উঠতে হয়। ট্যাক্সি-ড্রাইভারের জিজ্ঞাসায় মনোজ নিজেকে অস্পষ্টভাবে বলতে শোনে—আউটরাম ঘাট। সন্ধ্যে পুরোপুরি নেমে এসেছে। রাস্তার এবং দোকানের আলোর সারি চোখের সামনে দিয়ে সরে যাচ্ছে দ্রুত। কুয়াশা আর ধোঁয়ায় বিধুর হয়ে আছে চারদিক। কিছুই স্পষ্ট করে চোখে পড়ে না। ট্যাক্সির অন্ধকারে মেয়েটি ঘন হয়ে সরে আসে তার দিকে। একটা হাত হঠাৎ তুলে দেয় মনোজের উরুর ওপরে। চমকে ওঠে মনোজ। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হাতটাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। বুঝতে পারে মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মনোজ হঠাৎই অনুভব করে বার-এ মেয়েটিকে দেখে সেই উত্তেজনা যেন আর নেই। ব্রং সে যেন এই মুহূর্তে পালিয়ে যেতে চাইছে ওর কাছ থেকে। আবার মেয়েটির হাত এঁকেবেঁকে উঠে আসছে তার বুকে! ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে তার নাভির দিকে! মননজের মনে হয়। একটা সাপ কিলবিল করছে তার শরীরে! গঙ্গার কাছাকাছি ট্যাক্সি প্রায় পৌঁছে গেছে। এক ঝটকায় মনোজ হাতটা সরিয়ে দেয়। তারপর ট্যাক্সি থামিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে। ট্যাক্সি-ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে—কত দিতে হবে? স্পষ্টতই এবার অবাক হয় মেয়েটি।–নৌকায় যাবেন না?

–কত দিতে হবে? কঠিন গলায় আবার জিজ্ঞাসা মনোজের।

–কুড়িই দিন তাহলে। হতাশ গলায় বলে মেয়েটি। পার্সটা হাতে ধরাই ছিল। একটা কুড়ি টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়….

শরীরটা হঠাৎই যেন খারাপ লাগছে। একটু বমি হয়ে গেলে ভাল হ’ত কি? ফুটপাত ধরে এলোমেলো পা চালায় সে। রেলিং-এর ওপারে একটু এগোলেই বিশাল, ঘোলা জলরাশির বিস্তার। জাহাজের আলোগুলোকে তার কোনও নগরীর আলো মনে হয়। ঠাণ্ডা, মৃদু হাওয়া। সেই হাওয়ায় শরীরটা একটু যেন হাল্কা লাগে। ফুটপাতে একটা বেলুনওলাকে ঘিরে অনেক বাচ্চা আর মায়েদের ভীড়। বেলুনের কুমড়ো পটাশ বিক্রি করছে লোকটা। এক একটা কুমড়ো পটাশ শূন্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ঘুরপাক খেতে খেতে তা আবার নেমে আসছে নীচে। মনোজ কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে। বেলুনগুলোকে ঘিরে বাচ্চাদের এই চাঞ্চল্য, উল্লাস তার দেখতে ভাল লাগে।

—মাম্মি, আমাকে একটা কিনে দাও। দেবদূতের মতো একটা বাচ্চা তার মায়ের কাছে আবদার ধরে।

রোজই তো কিনে দিই। পেলেই তো এখুনি ফাটিয়ে ফেলবে। আজ থাক।

–না—আজও একটা কিনব। বায়না করতে থাকে বাচ্চাটা। মনোজ এগিয়ে যায়। পকেট থেকে খুচরো পয়সা বের করে একটা বেলুন কিনে বাচ্চাটার দিকে। বাড়িয়ে ধরে। একবার বেলুনটার দিকে আর একবার মনোজের মুখের দিকে তাকায় বাচ্চাটা। তারপর মায়ের দিকে তাকায়। মিষ্টি চেহারার একজন যুবতী। বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে ভদ্রমহিলা। মনোজের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বাচ্চাটাকে বলে—আচ্ছা, উনি যখন দিচ্ছেন, নাও। থ্যাঙ্ক ইউ বলো।

–থ্যাঙ্ক ইউ। বেলুনটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বাচ্চাটা বলে। মনোজ হাঁটতে থাকে। হাঁটতেই থাকে। হঠাৎ আবার খুব হালকা লাগছে। মাথার ভারবোধও কম মনে হচ্ছে। সে ভাবে…। অরণি বলছিল স্টেটসে চলে যেতে। না,সে কোথাও যাবে না। সে এখানেই পড়ে থাকবে। তার এই অতি চেনা শহরে। হঠাৎ তার উপলব্ধি হয় যে একটা সুখী, উপদ্রবহীন সংসারের জন্য সে ভেতরে ভেতরে তৃষাতুর হয়ে আছে। সংসার ছাড়া তার পরিত্রাণ নেই। সংসারে ধরাবাঁধা ঘেরাটোপই তার একমাত্র আশ্রয়। হাঁটতে হাঁটতে মনোজ ঠিক করে ফেলে সে বনশ্রীর কাছে ফিরে যাবে। একবার চেষ্টা করে দেখবে। তার সামনে নতজানু হয়ে বলবে—যা হবার হয়েছে। এসো, আমরা সবকিছু ভুলে যাই। …এসো, আমরা আবার নতুন করে শুরু করি…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *