1 of 2

ধূসর কণ্ঠস্বর – শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

ধূসর কণ্ঠস্বর – শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

শশীকান্ত প্রথমে উবু হয়ে পরে হাঁটু মুড়ে প্রায় শোবার ভঙ্গি করে রেকর্ডটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। সেই এক গোঁ গোঁ শব্দ রেকর্ডের খাঁজ থেকে বেরিয়ে আসছে। ঠিক কান্না নয়, কেমন একধরনের গোঙানির মত। আজ তিন দিনের মাথায় এইটুকু হয়েছে।

প্রথম দিন অনেক ঘষামাজার পর রেকর্ডটা গ্রামোফোনের প্লেটে চড়াতেই আচমকা কেমন এক ধরনের আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছিল রেকর্ডের প্লেট থেকে। ক্রমে সেটা বাড়তে বাড়তে ঘরের আবহাওয়া ভারি হয়ে ওঠে। মেখু মামা তখন তড়িঘড়ি রেকর্ড থেকে পিনটা তুলে মেশিন বন্ধ করে বলেছিলেন, ভেবেছিলুম তাৰ্পিন তেলে এটা পরিষ্কার হবে। এখন দেখছি এর ওষুধ অন্য।

পরদিনই তিনি গৌরবাবুর হারমোনিয়াম সারাইর দোকানে গিয়ে জেনে এসেছিলেন, তারপিন তেলে না হলে স্পিরিটে প্লেটটা সাফ করে নিতে হবে। তুলো দিয়ে নয়, পুরনো ফর্সা ধুতির টুকরো দিয়ে যত্ন করে ঘষতে ঘষতে দেখবে যেন রেকর্ডের ভেতরকার লাইনের খাঁজে খাঁজে সেটা ঢুকে বসে যায়। বারকয়েক ঘষলেই দেখবে সরুসুতোর মত কিছু একটা বেরিয়ে আসছে।

কিন্তু তাতেও কিছু হয়নি। আর্তনাদ ছাড়া কোন কথা বলেনি রেকর্ড। শশীর মাথায় তখন খুন চেপে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, থাক মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা, আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে রেকর্ডটাকে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে শান্ত করে নিয়েছি। শত হলেও মা। তার যখন তিন সাড়ে তিন বছর বয়স, তখনি সে তার মাকে হারায়, সেই থেকে শশী মামাবাড়িতে বড় হয়েছে।

বাবা ফের বিয়ে করে নতুন সংসার পেতে তাকে নিতে এসেছিলেন। দিদিমা ছাড়েননি। বলেছিলেন, সার কাছে তার নাতি মানুষ তোক এটা তিনি চান না। লোকে যতই বলুক, অনেক সৎ-মা’ও ভাল হয়, তিনি তা বিশ্বাস করেন না। যদ্দিন না নিজের সন্তান হয়, তদ্দিন পর্যন্তই ঐ আদিখ্যেতা। হলেই কুকুর বেড়ালের মত ব্যবহার।

বলে, নিজের পেটের মেয়েকে অভিশাপ দিতে দিতে দিদিমা নিঃশব্দে কাঁদতেন। কাঁদতেন, আবার প্রশংসা করতেন। ভারি মিষ্টি গলা ছিল চরির। চরি অর্থে চারুবালা। মিষ্টি করে কথা বলত বলে ওর বাপ ঐ নাম রেখেছিল। ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বর তাকে ঐ গুণটি দিয়েছিলেন। রেকর্ডের নাম সুহাসিনী। সুহাসিনীবালা। তখন ওটাই রেওয়াজ ছিল। নামটা দিয়েছিল কাশী। ওর গানের মাষ্টার। ছোটবেলায় যখন তিনি ‘যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যবেলায়’ গুণগুণ করে গাইতেন, চরি তখন তাঁর সঙ্গে গলা মেলাতো। কার গান তিনি জানেন না, রেডিও থেকে শোনা। কিন্তু মেয়ের গলায় যেন ভারি ভাল লাগত। সেই থেকে চরির গান শেখা। কিন্তু সেটা আর বেশিদিন হয়ে ওঠেনি তের পেরিয়ে চোদ্দয় পা দিতেই ভাল পাত্র পেয়ে ওর বাবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন।

এসব কথা শশীর বড় হয়ে শোনা। যখন এগারো বারো বছর বয়স। তখন মাকে দেখবার ইচ্ছা বা রেকর্ডে কণ্ঠস্বর শুনবার বাসনা, কোন কিছুই অনুভব করার মত তেমন করে মন তৈরি হয়নি তার।

তারপর থেকে কোথায়, কোন্ অতলে তলিয়ে গিয়েছিল মায়ের স্মৃতি। বড় হয়ে যে বাপকে সে কাছে পেয়েছিল, তিনি তখন প্রায় বদ্ধ পাগল। দিদিমা তখন নেই। দাদা তার আগেই মারা গেছেন। তাকে তার মনেও পড়ে না। সেই সময় মেঘু মামা তাকে একদিন বাপ চেনাতে রিষড়ায় নিয়ে গিয়েছিল। প্রথমটা দেখে মনেই হয়নি বদ্ধ পাগল। গেরুয়া বসন, গলায় মোটা রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে মোটা বালা, কপালে ধ্যাবড়ানো রক্ততিলক। মেঘুমামা কাছে গিয়ে নিশিবাবু, এই আপনার ছেলে শশী, শশীকান্ত বলে তাকে এগিয়ে দিতেই তিনি লাল টকটকে চোখ তুলে সস্নেহে হেসে বলেছিলেন, ওমা, তাই নাকি! আমার ছেলে? বাঃ, বেশ ডাগরটি হয়েছে তো? বাপকে দেখতে এসেছ? বেশ বেশ।

তারপরই প্রচণ্ড হুংকার, কুলটার ছেলে। আমার সুখের সংসারে আগুন লাগাতে এসেছিস? বেরো বেরো। ওরে কে আছিস, কুলটার ছোঁড়াটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে গেটের বাইরে বের করে দিয়ে গোবরজল ছিটিয়ে দে।

তারপরও শশী বারকয়েক তাকে দেখতে গিয়েছিল। শত হলেও জন্মদাতা বাপ তো বটে। সেইসঙ্গে একটা কৌতূহলও ছিল। মানুষটার এই অবস্থা হোল কি করে।

যতবার গিয়েছে, সম্মা আদর করে তাকে কাছে টেনে নিয়েছেন, গায়ে মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, যত্ন করে ভাল-মন্দ খাইয়েছেন। এপক্ষের ছেলে মেয়েদের ডেকে বলেছেন, প্রণাম কর তোদের বড়দা হয়।

তারও পরে একদিন মুখ ফুটে কারণটা বলেছেন। তুমি এখন বড় হয়েছ, তাই বলা যায়। তোমার বাবা এই বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। সন্দেহ থেকে ভয়। ভয়, তোমার মা ফিরে এলে আমরা দু’জনে মিলে ওকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবো। তোমার বাবা বলতেন, কুলটাকে আমার একদম বিশ্বাস নেই। সে সব করতে পারে। যে নিজের পেটের সন্তানকে বুকের দুধ না দিয়ে……না, থাক। সে সব কথা তোমার ভাল লাগবে না। তবে এটুকু বিশ্বাস কর, আমি তা বিশ্বাস করিনি। তোমার মা তোমার বাবার অনুমতি না নিয়ে গ্রামোফোন রেকর্ডে গান গেয়েছিল বলে তোমার বাবাই তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। বাকিটা তোমার মামার কাছ থেকে জেনে নিও।

সে কাহিনী অবশ্য মেঘুমামা তখন বলেননি। বলেছিলেন অনেক পরে। ছাদের চিলেকোঠা পরিষ্কার করতে গিয়ে চোঙওলা পুরনো গ্রামোফোনটা আবিষ্কারের সময়। তার মধ্যে একটা রেকর্ডও ছিল। সেটা তার মা’র গানের। বলেছিলেন, এটা তোর মা’কে সেকালের এক বড় ওস্তাদ গান শুনে খুশি হয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে তার ট্রেনিঙে গাওয়া সেকালের কয়েকজন মেয়ে শিল্পীর গানের কিছু রেকর্ড। সঙ্গে তোর মা’র রেকর্ড। ঐ একটা রেকর্ডই বেরিয়েছিল টুইন কোম্পানি থেকে। তাই থেকে আত্মীয়-স্বজনরা তারে কুলটা বলেছিল।

এতকথার পরেও মেঘুমামা মা। পরবর্তী জীবনের কথা খুলে বলেননি। শুধু বলেছিলেন, এই গ্রামোফোনটা তোর বাবাই এবাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন দ্বিতীয়বার সংসার করার পর। এটায় নাকি পরিবারের শুচি নষ্ট করবে, গেরস্তের অকল্যাণ করবে। বাড়িতে পাপ ঢুকবে।

শুনে বাপের ওপর ঘৃণা হয়েছিল শশীর। খুন চড়ে গিয়েছিল মাথায়। মেঘু মামাই তখন তাকে শান্ত করেছিল। বলেছিলেন, এসব তখন ভাল চোখে দেখত না মানুষে। ঘরের মেয়ে বাইরে গান গাইলে, থিয়েটার-টিয়েটার করে সমাজে ইজ্জত নষ্ট হোত। মেয়েকে বিয়ে দিতে কষ্ট হোত। এটা রেডিও চালু হবার পরও অনেকদিন ছিল। অথচ মানুষ তাদের গান শুনে, থিয়েটার দেখে প্রশংসাও করত। তবে নিজের বাড়ির মেয়েকে বাদ দিয়ে। একটু শিক্ষিত, রুচিশীল, যাদের ঘরে গ্রামোফোন, রেডিও ঢুকেছে, তারা অবশ্য অতটা বলত না। তবে সে আর ক’জন। ঐ শিক্ষিত, পয়সাওলা, জমিদার-টমিদারদের বাড়িতেই ঐসব শোভা পেত। আমাদের ছোটবেলায় পরের বাড়ির জানালার খড়খড়ি তুলে গোপনে রেডিও রেকর্ডের গান, নাটক শুনতুম। গ্রামোফোন রেডিও দেখে চক্ষু সার্থক করতুম। সে যে কি থ্রিল! বোঝানো যাবে না।

শুনে কিছুক্ষণ শশী চুপ করে রইল। তারপর এক সময় গলা নামিয়ে বলল, যারা গাইতে তারা বাই সত্যি সত্যি কুলটা ছিল?

মেঘুমামা সঙ্গে সঙ্গে সে কথার উত্তর দিলেন না। পরে বললেন, কুলটা হতে যাবে কেন? ঐ লোকের ধারণা। মেয়েদের গানবাজনা তো তখন বাইরের জন্যে ছিল না। শখ করে কিংবা বিয়ে-পার করানোর জন্যে বাড়ির লোকেরা মাষ্টার রেখে মেয়েদের দুচারটে শ্যামাসঙ্গীত ধরনের ভক্তিগীতি শেখাতো। বিয়ে হয়ে গেলে সব শিকেয় উঠত।

: মার তো তা হয়নি?

: না। ঐ কাশী মাষ্টার এসে খোঁচাতো। চরি, তোর ভারি মিষ্টিগলা। সংসার করছিস বলে গান ছাড়িসনি। বলিস ভো ওস্তাদজিকে ডেকে আনি। সেই শুরু। একদিন অফিস ফেরতা তোর বাবা দেখে বিরাট পাগড়িওলা একটা লোক বাইরের ঘরে বসে। সামনে ডুগি বলা, হারমোনিয়াম,ভোর মা ও কাশী মাষ্টার। ওস্তাদের মুখে গান, হাতে পানের ডিবে। রেকাবিতে পিরিচ পেয়ালা। পান মশলা।

অশাস্তির সেই শুরু। একদিন কাশী মাষ্টারকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া। হোল। তার ডুগিলা ফাঁসিয়ে, হারমোনিয়ামটাকে আছাড় মেরে কাশী মাষ্টারের পেছন পেছন্ন রাস্তায় ফেলে দেয়া হোল। সেগুলি তারই ছিল। তোর বাপ বলে, গেরস্ত বাড়িকে বাঈজি বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে।

সেই থেকে তোর মা’র যেন জিদ চেপে গেল। তখন তোর বয়স দেড় কি দুই। সে নিজেকে গুটিয়ে নিল সংসার থেকে। দুমুঠো ভাত রাঁধা, গান আর তুই। মা বললে, এ আমাদের জন্যে নয়। সংসার কর। নইলে সংসারটা ভেসে যাবে। বাবারও তাই মত। এই সময় চরি তোকে মাঝে মাঝেই এখানে রেখে যেতে লাগল। তাই নিয়ে দু’বাড়িতে অশান্তি। একদিন কে খর দিলে, তোর মাকে চিৎপুরের গরানহাটায় দেখা গেছে। সেখানে তখন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুম ছিল। খারাপ পাড়ার মেয়েদের যাতায়াত খুব। ততদিনে তোর মাও একরকম বেপরোয়াই। তার কিছুদিন পরেই তাকে তোর বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।

মেঘু মামা একটানা অতগুলি কথা বলে থামলেন। অনেক পরে গলা নিচু করে ফের বললেন, সেই সময়টা চরির খুব খারাপ গেছে। পরের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হয়েছে। লোক লজ্জা আর সমাজের ভয়ে তোর দাদুও মেয়েকে আশ্রয় দিতে সাহস পায়নি। মেয়েও তেমনি জেদি। দ্বিতীয়বার আর সে বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায়নি। অনেকদিন পরে শুনেছিলুম চরি তার কোন্ গাইয়ে বান্ধবীর সঙ্গে নবদ্বীপে গিয়েছিল। সেখান থেকে কাশী। তার পরেরটুকু জানা নেই। তোর দিদিমার কথায় আমি নবদ্বীপ পর্যন্ত গিয়েছিলুম। তবে কাশীতে খোঁজ করতে যাওয়া হয়নি।

শশী বলল, কত বছর আগে তুমি নবদ্বীপ গিয়েছিলে?

: বছর কুড়ি হবে। মেঘুমামা বললেন। তখনও বিধবা থেকে নানা জাতের। অসহায়, পরিত্যক্ত মেয়েদের ওখানে আশ্রয় নেয়া চলছিল। তাদের জন্য নানা আশ্রমও ছিল। শুনেছিলুম তোর মা দু’বেলা বড় রাধেশ্যাম ছোট রাধেশ্যামের মন্দিরে কেত্তন করে দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতো।

: তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

মেঘুমামা সে কথার উত্তর দিলেন না।

: কোনো কথা? কি কথা!

এবারও কথা বললেন না তিনি।

.

সেরাতে ঘুমতে পারেনি শশী। সর্বাঙ্গে তার জ্বালা। তিন সাড়ে তিন বছরের চোখ দিয়ে মা’কে মনে করার চেষ্টা তাকে সারা রাত তাড়িয়ে বেড়াল। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না। রেকর্ডের লেবেল, তার ভেতরে গানের কথার মতই। সবটা অস্পষ্ট, ধূসর হয়ে রইল।

দিদিমা মারা যাবার পর এবাড়িতে আর কোন আলতা-সিঁদুর পরা মেয়ে-মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়েনি। কুলটার ছেলেকে কেউ মেয়ে দেবে না ভেবে সেও বিয়ে করেনি। নিঃসন্তান মাসী মারা যেতে মেঘুমামা হঠাৎ বিবাগী হয়েছিলেন। ইদানীং শশীর সঙ্গী হয়েছে। দু’জনে মিলে দাদুর রাবার স্টাম্পের ব্যবসাটা দেখে। এখন, সেই ব্যবসা তামাদি হবার মুখে। ও আর চলে না। তাই থেকেই কোনক্রমে দু’জনের দুমুঠো হয়ে যায়। নিজেরাই হাত পুড়িয়ে খায়।

সকালে উঠে শশীকান্ত মামাকে বলল, মা’র কোন ছবি আছে কোথাও?

মেঘুমামা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, তখন কি এখনকার মত এত ছবি তোলা সহজ ছিল না রেওয়াজ ছিল? খুব ছোটবেলায় আমাদের সবাইকে নিয়ে অবশ্য একটা গ্রুপ ফটো তোলা হয়েছিল কি কারণে। তাতে শ’খানেক মুখ। তোর মা তখন কোলের শিশু। শুনেছিলুম বিয়ের পরে শখ করে তোর বাবা স্টুডিওতে গিয়ে জোড়ে ছবি তুলেছিল। তোর মা’কে তাড়িয়ে দেবার পর বৌর সেই হাসি হাসি মুখের। ছবিটা আচড়ে ভেঙে ফেলে দিয়েছে। তবে কয়েকবার নাকি রেকর্ডের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে খবরের কাগজে তোর মা’র ছবি বেরিয়েছিল। শোনা কথা, আমি দেখিনি। তখন রেকর্ড কোম্পানির শিল্পীর ছবি ছাপার রেওয়াজ ছিল।

: তুমি কি মার রেকর্ডের গান দুটো আগে শুনেছিলে?

: অনেকদিন আগে। এখন আর মনে নেই।
: একটা দুটো কথা?

মেঘুমামা চুপ করে একটু আনমনা হলেন। পরে বললেন, ঐ যুথিকা রায়ের ‘চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয় আমার সমাধি পরে’ গোছের হবে। আর উল্টো পিঠের গানটা…..ঐতো, মিস লাইট না তারকবালার গাওয়া ‘শেফালি তোমার আঁচলখানি’র মত। ঠিক মনে সেই। এইগান বাজানো নিয়ে দিদির মুখে একটা ঘটনা শুনেছি। ওস্তাদ যেদিন গ্রামোফোন যন্তরটা তোর মাকে খুশি হয়ে উপহার দেয়, সেদিন তোর মা’র গানের রেকর্ডটা ওস্তাদ সেখানে বাজিয়ে খুব বাহবা দিয়েছিল তোর মাকে। তাই শুনে পরদিনই তোর বাবা চণ্ডালের মত আর সব রেকর্ডগুলি আছড়ে ভেঙে ফেলেছিল। শুধু তোর মারটা পারেনি। সেটা সে আগেই সরিয়ে ফেলেছিল। সেটা গ্রামোফোন যন্তরটার সঙ্গে পাওয়া গেছে।

 : মাকে সবাই কুলটা বলত কেন। গান গাইলেই কি তাকে সমাজে অপাংক্তেয় করে কুলটা বলতে হবে? গানের সঙ্গে স্বভাব-চরিত্রের কি সম্পর্ক। ঘরে থাকলেই কি সে সতী হোত?

: তখনকার সমাজব্যবস্থাই সেরকম ছিল। অথচ চার দেয়ালের মধ্যেও তো চোরা অসতী কম ছিল না। আসলে এসবই ইর্ষা থেকে, পরশ্রীকাতরতা তার ওপর মেয়েছেলেদের পায়ে শেকল বেঁধে রাখার চেষ্টা। সেকালের অমন সব মেয়ের কপালেই যেটা জুটেছে। কেউ উতরে গেছে, কেউ তলিয়ে গেছে। এক শ্রেণীর পুরুষও বাদ যায়নি তা থেকে। তাদেরও সমাজে চিহ্নিত হতে হয়েছে। তবে মেয়েদের মত নয়। আর পাঁচজনের থেকে আলাদা হতে গিয়ে তাকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছিল। সমাজের নিচু স্তরে মেয়েদের তুল্য হতে হয়েছে।

.

সে রাত্রে শশীকান্ত একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল।

প্রথমে মনে হোল গোঙানি নয়, কোথা থেকে যেন চাপা নারীকণ্ঠের অস্ফুট কান্না ভেসে আসছে অতি করুণ, অনেকটা বিলাপের মত। কিন্তু এ বাড়িতে তো কোনো মহিলা নেই? কান্নাটা যখন ক্রমশ তার কাছাকাছি হোল তখন গায়ে কাঁটা দিল। মনে হোল, কান্না নয়, ওপাশের টেবিলের ওপর দেয়াল ঘেঁষে রাখা গ্রামোফোনের ঢাকনার ভেতর থেকে করুণ সুরের গান ভেসে আসছে কাঁপা কাঁপা স্বরে। তার নিঃশ্বাস পর্যন্ত স্পষ্ট। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত মায়ের গলার গানটা অমন কঁকিয়ে ছিল?

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল শশী। সর্বাঙ্গ ঘামে জবজব করছে, কণ্ঠতালু শুকিয়ে এক ধরনের বোবা আওয়াজ বেরুচ্ছে তা থেকে। কান্নার মত কাঁপা কাঁপা সেই গান যেন মুহূর্তে ময়াল সাপের মত তাকে জড়িয়ে ধরবে। সে চিৎকার করে উঠল।

তারপর আর কিছু মনে নেই।

যখন জ্ঞান ফিরল, দেখল পাশে মেঘুমামা।

: কোন ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলিস? নইলে অমন চিৎকার করে উঠলি কেন।

প্রথমটা শশী কোন কথা বলতে পারল না। পরে একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, স্পষ্ট শুনলুম গ্রামোফোনটার ডালা খুলে গিয়ে তার ভেতর থেকে কান্নার মত একটা গান ভেসে আসছে।

: ও তোর মনের ভুল। মেঘুমামা বললে। গ্রামোফোনের ডালাটা তো বন্ধই আছে। তুই স্বপ্ন দেখছিলি। ওটা ঘরে রাখাই কাল হয়েছে। সকালেই ওটাকে ফের চিলেকোঠায় তুলে দেবো। সেখান থেকে নিশ্চয়ই তোর মা রেকর্ড থেকে বেরিয়ে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসবে না।

সেই কথা শুনে শশী হতবাক হয়ে মেঘুমামার দিকে অপলক চেয়ে রইল।

সেই করুণ চাহনি দেখে কি হোল, মেঘুমামা ফের বললেন, তার আগে না হয় আর একবার চেষ্টা করে দেখা যাবে। কালকেই আমি বৌবাজারের চোরামার্কেটে যাবো। এখনও হয়তো সেখানে কিছু পুরনো রেকর্ডের দোকান আছে। তারা রেকর্ডের পেট থেকে গান বের করার কায়দা জানলেও জানতে পারে।

শশীর সেদিনের সকালটা ঘোরের মধ্যেই কাটল। ব্যবসার ঝপ কদিন থেকেই বন্ধ। মেঘুমামা একটু বেলা চড়তেই বেরিয়ে গেছেন।

প্রায় বারোটা নাগাদ ফিরে এসে বললেন, সব শুনেটুনে এক দোকানদার বললে, অদ্দিনের রেকর্ড, বাজাবো বললেই বাজানো যায়? গান-টান ধুয়ে মুছে কবে পালিয়ে গ্যাছে। ওকে এখন গামছায় বেঁধে জলে ডুবিয়ে রাখুন। তারপর যখন তোর বাসনার কথাটা শুনলে, তখন বসলে, একজনই মাত্র লোক আছে, যে চেষ্টা করলে রেকর্ডের পেট থেকে গান বাজনা সব টেনে বের করতে পারবে। কিন্তু তার বয়স হয়েছে। বাড়ি থেকে প্রায় বেরুতেই পারে না। থাকে বেলঘরিয়ায়। সেখানেই যেতে হবে। তবে আগে জানিয়ে। চোরামার্কেটে গানের ব্যবসা করে করে সেও এখন এক ধরনের উন্মাদ।

পরদিন মেঘুমামা বললেন, লোকটার ঠিকানা নিয়ে এসেছি। আমি বরং তার পাত্তাটা জেনে আসি। ভোর যখন এ্যাত মন পোড়ানী মা’র গান শোনার জন্যে।

দুপুর নাগাদ যখন তিনি ফিরলেন, সঙ্গে সিঁড়িঙ্গে মার্কা চেহারার একটি লোক। মালকোচা মারা ধুতির ওপর দুমড়নো শার্ট। একটু কুঁজো, প্রায় ধনুভঙ্গ চেহারা। গালে কদম রোঁয়ার মত দাড়ি। চোখে সুতলি বাঁধা নিকেল ফ্রেমের চশমা। পায়ে হাউই চটি।

মামা হেসে বললেন, কাকে ধরে এনেছি জানিস? সাক্ষাৎ জহুরি। আসতে কি চায়?

লোকটি হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললে, বাস বাস। আগে মালটা দেখি। তার আগে এককাপ চা খাবো। সঙ্গে দু’টো বিস্কুট। খালি পেটে চা খাওয়া ডাক্তারের বারণ। আমার আবার পেটে গ্যাসের রোগ আছে। এক সময় মাল-টাল চলত তো। ব্যবসাও গ্যাচে, তার সঙ্গে নেশাটাও গ্যাচে। কিন্তু রোগটা শালা পেটে থেকে গ্যাচে।

চা খাওয়ার পর আর এক বায়নাক্কা, এক প্যাকেট বিড়ি আর দেশলাই। সঙ্গে কটা সিগ্রেট। ওঝার কাজ তো। ঝাড়ফুঁক করতে ওসব লাগবে।

চা বিস্কুট এলো, সঙ্গে বিড়ি-দেশলাই এবং সিগারেট। সব আয়োজন দেখে বেশ প্রসন্ন লোকটা। বললে, ঠিক আছে। চার্জটা একটু কমিয়েই নেয়া যাবে। ঐ গাড়ি ভাড়া শুদ্ধ পঞ্চাশ টাকা। এখন কি আর টাকার কোন মূল্য আছে? ছিল তখন। চোর বাজারে ব্যবসা হলে কি হবে, বাঘা বাঘা সব লোক ধরে নিয়ে যেত। কৈ, গ্রামোফোন আর রেকর্ডটা নিয়ে এসো।

শশী আর মেঘুমামা ধরাধরি করে গ্রামোফোনটা কাছে নিয়ে আসতে লোকটা বললে, কুকুর মার্কা যন্ত্র। তাই বল। নইলে অ্যাতো দিন ট্যাকে?

তারপর উবু হয়ে বসার ভঙ্গি করে গ্রামোফোনের চারদিক দেখলে। পরে মুখ তুলে ভুরু কুচকে বললে, ডোনের মাল? কিন্তু কে দিলে তার নাম লেখা নেই তো?

মেঘুমামা বললে, শুনেছি আমার বোনঝিকে তার গান শুনে খুশি হয়ে এক ওস্তাদ এটা দিয়েছে। নাম জানি না।

: সুহাসিনীবালা তোমাদের কে হয়?
: আমার ছোRদি। এর মা।

লোকটা এবার টান-টান হোল। একবার শশীর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললে, চ্যায়রার তো কোনো মিল দেখছি না?

কথাটা শুনে শশীর মাথায় রক্ত ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। শশব্যন্তে তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি তাকে দেখেছেন?

 : একবার সে আমার শ্যালদার চোর বাজারে দোকানে এয়েছিল তার রেকর্ডটার খোঁজে। সঙ্গী কালো চশমা চোখে একটা লোক। গানের মাষ্টার-টাষ্টার হবে। এক কপিই ছিল। চড়া দামে ঝেড়ে দিয়েছি। কত বছরের পুরনো মাল। বাজারে পাওয়া গেলে তো।

শশীর মনে মনে ইচ্ছে হয়েছিল, জিজ্ঞেস করে তার মাকে কেমন দেখতে ছিল। তাহলেও একটা কল্পনা করে নেওয়া যায়। কিন্তু লোকটা ততক্ষণে মেঝেতে বসে পড়ে গ্রামোফোন যন্ত্রটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগা পাস্তালা সেটাকে উল্টে পাল্টে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, স্থান বিশেষে কান পেতে কি সব পরীক্ষা করে এক সময় নিজের মনেই বললে মনে হচ্ছে, লিবার-টিবার, যন্ত্রপাতি ব ঠিকই আছে। এখন বরং মালটাকে দেখা যাক।

এই সময় কোচড় থেকে একটা থলে বের করে তা থেকে স্পিরিটের শিশি, জুট তুলল, কিছু যন্ত্রপাতি মেঝেতে নামিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে গ্রামোফোনের প্লেট থেকে রেকর্ডটা নামিয়ে নিয়ে সেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিল। পরে নিজের সঙ্গেই যেন কথা বলছে সেইভাবে বললে, আঃ, কদ্দিনের মাল। তখন কি র‍্যালা মেয়েটার। একখানা রেকর্ডেই হিরোইন। তাই দেখে ছোট বড়ালবাবু একদিন বললে, বুঝলি সতে, তোকে আর এই মেয়েটাকে নিয়ে দু’নম্বরি করতে হবে না। সুখী গৃহকোণে’ ফাটাবে। অন্য মেয়ে গাইয়েদের পেটে নাথি পড়ল বলে। …তা, কই আর হোলো। ফুটুর ডুম। কোথায় ছিটকে গেল।

বলতে বলতে লোকটা মেঘুমামার দিকে চোখ তুলল। ভুরু নাচিয়ে রেকর্ডটা তার দিকে তুলে ধরে ফের বললে, ওজনটা দেকেচ? ব্ল্যাক লেবেল। সলিড। তঁত নয়, শিরিস নয়, খাঁটি জার্মান বেকা কোম্পানির মাল। কথাটা শেষ করেই লোকটা এবার রেকর্ডটাকে নিয়ে পড়ল। মাঝে শুধু একবার বলল, রেকর্ডটাতে ক্যামন য্যান একটা আতর আতর গন্ধ লুকিয়ে আছে বলে মনে হচ্চো তাতো হবেই। শত হলেও বাইজি বাড়ির গান তো বটে। তার মেজাজই আলাদা।

তারপরই সে হঠাৎ কেমন চুপ মেরে গেল। রেকর্ডটাকে নিয়ে পড়ল। শশী দেখল রেকর্ডের লেবেলটা কেমন আস্তে আস্তে তার পুরনো চেহারা ফিরে পাচ্ছে। তবে একটু বিবর্ণ। বুকটা ধুক ধুক করতে লাগল তার। সত্যিই যদি এবার রেকর্ডটা কথা বলে ওঠে, গান হয়ে মায়ের গলা ভেসে ওঠে? নোকটার হাতের শিরিস কাগজ আর ফোঁটা ফোঁটা স্পিরিটের আলতো চাপের ঘষায় রেকর্ডের ঘূর্ণায়মান খাঁজগুলি ক্রমশ যেন চকচকে, সজীব হয়ে উঠছে। আর তাই দেখতে দেখতে তার গোটা দেহ থিরথির করে কাঁপছে, চোখের দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসছে।

নিস্তব্ধ ঘরে একটা হিসহিস শব্দ। যেন একটা তেজি সাপ কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে সারা ঘরময়। তার চারপাশে অন্ধকার ঘাপটি মেরে স্থির হয়ে আছে।

বিশ্ব চরাচরে ঝলমলে রোদ। সেই ঘোর শশীর কতক্ষণ ছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আওয়াজে তার বুকের স্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। মনে হোল, কানের কাছে কে যেন গোঁ গোঁ করে, ‘আমার’ ‘আমার’ শব্দে উন্মাদের মত চিৎকার করতে শুরু করে দিয়েছে। সঙ্গে মেঘুমামার আর্তনাদ থামান থামান, বন্ধু করে দিন মেশিনটা।

তারও পরে, জ্ঞান ফিরতে, চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ হতে যতটা সময়, শশী দেখল লোকটার হাতে সাপের ফণা ধরার মত সাউন্ড বক্সটা, চোখ দুটো বিস্ফারিত, যেন সাপ খেলা দেখাতে দেখাতে একাট বেদে থমকে, ক্রুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি স্থির। বললে, মেয়েটার বড্ড তেজ। কিছুতেই কথা কইবে না। সত্যিকারের মা হলে এ্যামনটা কেউ করে? কুলটা, নষ্ট মেয়েছেলে কাহাকা। বেইমান। দিলে খদ্দেরটা হাতছাড়া করে।

বলতে বলতে হাতের যন্ত্রটা ঘূর্ণায়মাণ রেকর্ডের ওপর আছড়ে ফেলল সে।

এবার আর আর্তনাদ নয়, শশীর মনে হোল ‘আমার আমার’ বলে তার মা যেন করুণ সুরে কি বলতে চাইছিল। যেটা অব্যক্ত হয়েই রইল শেষপর্যন্ত।

মুহূর্তে শশী দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *