1 of 2

জারিনার প্রেম – তারাপদ রায়

জারিনার প্রেম – তারাপদ রায়

পাঠিকা ঠাকুরানি নিজগুণে ক্ষমা করবেন। মাতালের গল্প ছাড়া আমার গতি নেই।

মাতাল যেমন বারবার তার ঠেকে ফিরে যায়, তেমনি আমি ঠেকে গেলেই মাতালের গল্পে ফিরে আসি।

এক মদ্যপ মধ্যরাতে রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন, তার কপাল কেটে যায়। বাড়িতে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের কাটা জায়গায় স্টিচিং প্ল্যাস্টার লাগিয়ে সে শুতে যায়। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে তার কপালে কোথাও স্টিচিং প্ল্যাস্টার লাগানো নেই, বিছানাতেও পড়ে নেই। পরে দাড়ি কামাতে গিয়ে সে দেখে ছোট স্টিচিং প্লাস্টার আয়নার সঙ্গে লেগে আছে। তার মানে তার কপালের কাটা জায়গায় প্ল্যাস্টারটা না লাগিয়ে সে সেটা আয়নায় তার ছায়ার কপালে লাগিয়ে দিয়েছিল।

জগৎ সংসারে মাতালের মত রহস্যময় জীব আর নেই। সে একাধারে সরল ও জটিল, বলংবদ ও মারকুটে, কৃপণ ও উদার, সনাতন ও আধুনিক। প্রকৃত মদ্যপের কথাকার হতে পারেন চেকভ কিংবা শরৎচন্দ্র।

আমার দৌড় ঐ আয়না পর্যন্ত। ছায়ার কপালে স্টিকিং প্ল্যাস্টার লাগান। রক্ত মাংসের মানুষটাকে আমি মোটেই কায়দা করতে পারি না, আয়নার মধ্যের ছায়াই আমার ভরসা।

আরম্ভ

এ গল্প উত্তম বা প্রথম পুরুষে আমি লিখবো না। এর মধ্যে আমি কোথাও নেই। আমি এই কাহিনীর তথাকথিত কোনো চরিত্র নই। কিন্তু গল্পলেখক হিসেবে কিঞ্চিৎ ভূমিকা করার প্রয়োজন আছে।

নির্মদ পাঠক এবং নির্মদিনী পাঠিকাদের কাহিনীর সুবিধার্থে, দুয়েকটি মোটা তথ্য নিবেদন করি। মাতাল নিয়ে গল্প, তাই মদের ব্যাপারটা অল্প বলে নিচ্ছি। কেউ যেন ভাববেন না, প্রচুর মদ্যশক্তির জন্যে এসব জিনিস আমি ধরে ধরে জেনেছি। তা নয়, প্রথম যৌবনে অধুনালুপ্ত রাজস্ব পর্ষদের বিলীয়মান আবগারি শাখায় কয়েক বছর কাজ করে কিঞ্চিৎ জেনেছিলাম।

ছোট গল্পের পরিসরে বিস্তারিত বলা যাবে না। আমাদের এই আখ্যানের কুশীলবেরা বাংলা খান। বাংলা মানে দিশিমদ, এ যাতা দিশি মদের কথা বলছি।

দিশি মদ, বাংলা মদ নামেই সমধিক প্রচলিত। বাংলাদেশেও শুনেছি, পশ্চিমবঙ্গেও তাই সরকারি দিশি মদের পরিচয় বাংলা বলে। অবশ্য এর বাইরে বে-আইনি, বেসরকারি চোলাই দিশি মদ আছে, যাকে গ্রাহকেরা ভালোবেসে চুন্নু বলে।

সরকারি দিশি মদকে যে বাংলা মদ বলা হয় এ বিষয়ে আমার মনে একটা খটকা আছে। দিশি মদ এই বাংলাতেই বাংলা মদ, বিহারে কিন্তু বিহার মদ নয়। মাদ্রাজে মাদ্রাজ বা তামিল মদ নয়।

আরেকটা কথা উল্লেখ করে রাখি, আমাদের দেশে যে সব বিলিতি মদ তৈরি হয় সরকারি পরিভাষায় সেও দিশি মদ, কানট্রি মেড ফরেন লিকার, সংক্ষেপে (সি এম এফ এল) আর বাংলা মদ হলো কানট্রি লিকার, দিশি মদ।

বাংলা মদের দোকানের আরেকটা বিশেষত্ব হলো এ সব দোকানের কোনো নাম থাকে না। সাইনবোর্ড পর্যন্ত থাকে না। কোথাও কদাচিৎ সাইনবোর্ড থাকলে তাতে দোকানের কোনো নাম দেয়া থাকে না। সেখানে লেখা থাকে, মদের দোকান, ভেণ্ডার রামচন্দ্র সাউ কিংবা শ্যামনাথ সাধুখাঁ।

মূল কাহিনী

আপাতত যথেষ্ট হয়েছে। পাঠক-পাঠিকাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক গল্পের সুযোগে নিষিদ্ধ বিষয়ে এর চেয়ে বেশ জ্ঞানদান করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

এবার আমরা মূল গল্পে প্রবেশ করি। প্রথমেই ভ্রম সংশোধন। বাংলা মদের দোকানের নাম যে থাকে তা নয়। বাংলা মদের নামহীন দোকান সব, যেগুলোকে তার গ্রাহক অনুগ্রাহকেরা ভালোবেসে ঠেক বলে থাকে, কখনো কখনো গ্রাহকদের দ্বারস্থ গৌরবার্থে নামাঙ্কিত হয়। যেমন খালাসিটোলা, বারদুয়ারি, হাবিলদার বাড়ি, মায়ের ইচ্ছা ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সব ঠেকে দু-চারজন যে বিক্ষিপ্তভাবে যায় না তা নয় কিন্তু অধিকাংশই দলবদ্ধভাবে যায়। বন্ধু বান্ধবদের একেকটা দলে চার-পাঁচ জন থেকে পনেরো-বিশজন পর্যন্ত থাকে।

***

পূর্ব কলকাতার হাবিলদার বাড়ি একটি সুপ্রাচীন বিখ্যাত ঠেক। কেন এই মদের দোকানটির নাম হাবিলদার বাড়ি সেটা কেউ জানে না। শোনা যায়, কোনোকালে কোনো হাবিলদার সাহেব বেনামে এই মদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কালক্রমে কৃতজ্ঞ গ্রাহকবৃন্দ বেনামকে স্বনামে এনে দাঁড় করিয়েছে।

এই হাবিলদারবাড়ি ঠেকের নিয়মিত খদ্দেরদের মধ্যে কয়েকটি দল আছে, তার একটি হলো বুড়ো শিবতলার নাচগানের একটি সমিতি। অবশ্য যাঁরা সন্ধ্যাবেলা এই দলের সঙ্গে বসে এই ঠেকে নেশা করেন তারা সবাই এই ধার্মিক সংঘের লোক নয়। সমিতিটির পোষাকি নাম নামব্রত সঙঘ।

মদের দোকানটির উত্তর সীমান্তে ডানদিক ঘেঁষে মুখোমুখি দুটো লম্বা বেঞ্চে সঙেঘর রাজত্ব। মধ্যে কোনো টেবিল নেই। বেঞ্চের নিচে বোতল, জল ইত্যাদি এবং সুরাপাত্র সামনের বেঞ্চের লোকটির পাশেই রাখা নিয়ম। এ-তো আর বিলিতি মদের বার নয়, সাহেবি ক্লাসও নয়। তবে অসুবিধা হয় শনিবার সন্ধ্যাবেলা, রবিবার দুপুরে। ভিড় উপচিয়ে পড়ে। হাবিলদার বাড়ি মাতালের ভিড়ে গিজগিজ করে। হৈ হট্টগোলে গমগম করে, মদ-চাট-ঘামের গন্ধে থই থই করে।

এই ঠেকে বুড়ো শিবতলা নামচক্র সঙেঘর নিয়মিত সদস্যের সংখ্যা পাঁচ-ছয় জন। কিন্তু শনিরবিবারে পনেরো বিশজনে পৌঁছে যায়। হই হই কাণ্ড হয়।

‘নামচক্র সঙঘ’ এই নাম শুনে যদি কারো মনে ধারণা হয় যে সমিতিটি সাম্প্রদায়িক তা হলে তিনি ভুল করবেন। সাম্প্রদায়িক কেন, সঙঘটি ধার্মিকও বোধহয় নয়।

সঙেঘর প্রাণপুরুষ হলো মিষ্টর ডেভিড পাল, সাতপুরুষ কিংবা ততোধিক পুরুষ ধরে তালতলাবাসী এবং এ্যাংলো। তবে ডেভিডের জীবনের আরো একটা দিক আছে। ডেভিড তার সংক্ষেপিত নাম। তার আসল নাম দেবীদয়াল, দেবীদয়াল থেকে ডেভিড হয়েছে।

দেবীদয়াল নামটা তার ঠাকুমা রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন ঘোর বোষ্টমী। কাটোয়ার ছোট লাইনে রেলগাড়ির গার্ডসায়েব ছিলেন ডেভিডের পিতামহ। ওখান থেকেই ডেভিডের ঠাকুমাকে তিনি বিয়ে করে নিয়ে আসেন। খ্রীস্টান সংসারেও মহিলা তার বোষ্টমী সত্ত্বা রক্ষা করেছিলেন। কপালে চন্দনের রসকলি এক স্বামীর সঙ্গে গির্জায় যেনে, পালা পার্বণে, রবিবার। ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ’ করে খাটিয়ায় তুলে মৃত্যুর পরে তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল।

ডেভিড বেশ লম্বা, গায়ের রঙ ফর্সা। ইংরেজি বলতে কইতে পারে। নিউ মার্কেটে একটা বড় সুতোর দোকানে কাজ করে হেড সেলসম্যান। শীতের দিনে কোট-প্যান্ট, টাই পরে, বড়দিনে ইস্টরে সপরিবারে গির্জায় যায়। তবে তার প্রধান দুর্বলতা সে পেয়েছে তার ঠাকুমার কাছ থেকে, সে একজন কীর্তনিয়া নামগান সঙেঘর মূল স্তম্ভ।

কিন্তু এই মূল স্তম্ভটি মাঝেমধ্যেই হেলেদুলে যায়। তার কারণ ঐ কারণবারি বা মদ।

ডেভিড একেক সময় মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, হাবিলদার বাড়িতে তাকে আর দেখা যায় না, বেশ কয়েক দিন, এমন কি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বেপাত্তা হয়ে যায়। নামগান সঙেঘর সহশিল্পীরা তার আর খোঁজ পায় না।

অবশ্য এ জন্যে ডেভিডকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। মদ্যপানে তার উৎসাহের কোনো অভাব কখনোই হয় না। সে ইচ্ছে করে হাবিলদার বাড়িতে আসে

তা নয়, তার আসা হয় না। তার আসার উপায় থাকে না তার ধর্মপত্নী জারিনার জন্যে।

জারিনার কথা কম করে বা বেশি করে, বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলা যাবে না। তার কোনো প্রয়োজন নেই। খুব বেশি বলার দরকারও নেই।

আশেপাশের বাড়ি ঘরে, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে জারিনাকে বাই অল্পবিস্তর দেখেছে,তাকে ধ্বই হাড়ে হাড়ে চেনেন।

জারিনার প্রতাপে জগৎ সংসার তটস্থ, স্বামী বেচারা ডেভিড তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ। এমনকি হাবিলদার বাড়ি নামক প্রবল পরাক্রান্ত দিশি মদের ঠেকের দুঃসাহসী মদ্যপদের পা ঠকঠক করে কাঁপে জারিনার নাম শুনলে।

বলা বাহুল্য, মিঃ ডেভিড পালকে উদ্ধারকল্পে মিসেস জারিনা পাল বারই হানা দিয়েছে হাবিলদার বাড়ির নৈশ ঠেকে এবং সেই ব রাতে সেখানে একই সঙ্গে রামরাবণের যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্র এবং দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে। কিংবা পূর্বাপর বিবেচনা করে বাল যেতে পারে দনুজদলিনীর মহিষাসুর বধ পালা মঞ্চস্থ হয়েছে।

মদের ওপর, জারিনা বিবির একটা জাতক্রোধ আছে, (অজাতক্রোধও বলা যায়), কারণ তার বাবা জুয়েল মণ্ডল খিদিরপুরে ‘ওভারসিজ বেকারিজ অ্যান্ড প্রভিসন্স’ কারখানার সহকারী প্রধান পাউরুটি তৈরির কারিগর ছিলেন। জমিসাহেব নামে তার এক মদ্যপ সহকারি বন্ধুর সঙ্গে এক শীতার্ত বড়দিনের প্রভাতে বহু রুটি এবং বহুর কেক তৈরি করতে করতে জুয়েলকারিগর উক্ত বন্ধুর প্ররোচনায় কেক ও রুটি তৈরির স্টিক বা শর্করার গাদ দুই গামলা পান করেন। তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়নি, ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল। পুরোটা পেয় ছিল না, র্ব না হলেও অনেকাংশ চোষ্য এবং লেহ্য ছিল, চুষে এবং চেটে খেতে হয়েছে।

পরিণাম ভালো হয়নি। জুয়েল মণ্ডল ঐ সপ্তাহেই নববর্ষের দিন সকালে দেহত্যাগ করেন। জারিনা তখন মাতৃগর্ভে। জারিনা জন্ম ইস্তক রিষড়ায় তার মাতুতালয়ে মানুষ হয়েছে এবং আজন্ম মদ্যপ পিতার কীর্তিকলাপের খোটা শুনে এসেছে। সুতরাং স্বামীর ওপরে সে পরবর্তীকালে প্রতিশোধ নেবে, বিশেষত মদ্যপানের ব্যাপারে, এটা স্বতঃসিদ্ধ।

তবে জারিনাবিবির লাজ-লজ্জা, সমবোধ আছে। নিতান্ত অপারগ না হলে বিবি হাবিলদার বাড়িতে হানা দিতো না।

ডেভিডের নামচক্র সঙেঘর সাঙারো, অনাদি, অনন্ত, অনিল, অক্ষয়—এরা সবাই জানে আসল দোষী ডেভিড ওরফে দেবীদয়াল ওরফে অমর।

এখানে বলে রাখা ভালো নামচক্রের সকলেরই নতুন নাম। শুধু নামগানের সময় নয় হাবিলদার বাড়ির ঠেকেও সেই নামই চালু। ডেভিড যেমন অমর, গদা মিস্ত্রি হলো অনাদি, ছিমন্ত হলো অনন্ত এবং শেষমেশ বাদলচন্দ্র হলো অক্ষয়।

নামচক্রে বাদলচন্দ্ৰই সবচেয়ে ধর্মপ্রাণ, তার পূর্ব ইতিহাসও খুব সেকুলার। এগারো বারো বছর বয়েসে ভারত বাংলাদেশ একাকার হয়ে যাওয়া এক বন্যায় সে পদ্মা বেরিয়ে রাজশাহী থেকে মুর্শিদাবাদে ভেসে গিয়েছিলো। সেটা সেই পাতাল রেলের কলকাতার ময়দান খোঁড়ার যুগ। আজিমগঞ্জের পাশে ভাগীরথী পারের গ্রামের রহমতুল্লা ছিলেন পাতাল রেলের লেবার কনট্রাক্টর। বন্যায় ভাসমান এই কিশোরকে তিনি উদ্ধার করেন, এবং তাকে পাতাল রেলের গর্ত খোঁড়ার কাজে কলকাতায় নিয়ে আসেন।

এ গল্পে বাদলচন্দ্রের কাহিনীর স্থান নেই। আমরা এখন ডেভিড এবং জারিনা বিবির কেচ্ছায় ফিরে যাচ্ছি। এবার নয়, যথাসময়ে বাদলচন্দ্র ওরফে অক্ষয়ের সঙ্গে দেখা হবে।

ডেভিড ঠিক সংসারী টাইপের লোক নয়। তার হয়তো বিয়ে করাই উচিত হয়নি। সে অবশ্য বলে যে, আমি তো বিয়ে করিনি। জারিনা আমাকে বিয়ে করেছে।

ডেভিডের প্রধান দোষ ছিল সে মাইনে পাওয়ার পর তিনচারদিন বেপাত্তা হয়ে যেতো। তারপর সব টাকা উড়িয়ে বাড়ি ফিরতো। কোনো সংসারই এ জিনিস বরদাস্ত করতে পারে না।

জারিনা বিবির কল্যাণে ডেভিডের এই দোষটি কিঞ্চিৎ সংশোধিত হয়েছে। হাবিলদার বাড়ির ঠেকে অতর্কিতে আবির্ভূত হয়ে জারিনা ডেভিডের টুটি চেপে বাড়ি নিয়ে যেতো, সেই সঙ্গে ইয়ার বন্ধুদের যার কাছে যা মালকড়ি আছে সেটাও হস্তগত করতো।

সে সময় ঝামেলার ভয়ে ডেভিড মাসের প্রথম দিকে নামচক্রের আড্ডায় আসতো না। জারিনা বিবিও এসে তাকে খুঁজে পেতো না। জারিনা তখন বুদ্ধি করে ডেভিডের কর্মস্থলে মাসমাইনের দিনে সকাল সকাল গিয়ে উপস্থিত হতো। এ ছাড়াও জারিনা দোকানের প্রবীণ মালিককে অনুরোধ করে যেন সে না এলে কিংবা কখনো আগের দিন মাইনে দেওয়া হলে সেটা যেন ডেভিডকে না দেয়া হয়। প্রাজ্ঞ দোকানদার সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।

অবশ্য এই ঘটনার ফলে ডেভিডের যথেষ্ট সম্মানহানি হয়েছিল। দোকানের এবং আশেপাশের দোকারে অন্য কর্মচারীদের কাছে মুখ দেখানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। মনের দুঃখে সে মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়।

মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়া খুব সোজা নয়। সব মাতালই কখনো না কখনো মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, আবার ধরে। আবার ছাড়ে, আবার ধরে। আরো জোর দিয়ে ধরে।

একই নিয়মে কয়েকদিন মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পরে হঠাৎ করে ডেভিড আবার নামচক্রে চলে আসে। অধিকতর উদ্যমের সঙ্গে মদ্যপান, হৈচৈ শুরু করে। হাবিলদার বাড়ির ঠেক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও সে বাড়ি যেতে চায় না। আরো খাবে, আরো আরো খাবে।

এইরকম সময়ে বন্ধুরা অনেকেই তাকে বুঝে কিংবা না বুঝে তাল দেয় কিন্তু তারা সবাই ডেভিডের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারে না। রাস্তায় বেরিয়ে করতালি সহযোগে নামগানের সঙ্গে ডেভিড যখন ‘হেলিয়া দুলিয়া’ নাচে, তারা তাল রাখতে গিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

রাত বাড়ে। দায় বাড়ে নামচক্র সঙেঘর ঠাণ্ডামাথা সদস্যদের। তারা এভাবে ডেভিডকে রাস্তায় ফেলে যেতে পারে না।

***

এককালে কলকাতার ট্রাফিক পুলিশে মাতাল স্কোয়ার্ড ছিল। এক অ্যাংলো সার্জেন্ট সাহেব লাল মোটর সাইকেলে রাত সাড়ে দশটার পর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। কোথায় কোন্ মাতাল বাড়ি ফেরেনি, তাকে বাড়ি পাঠানোই তাঁর ডিউটি। সেই সার্জেন্ট সাহেব কলকাতার পানশালার একটি অনবদ্য গল্প অমর হয়ে আছে।

(গল্পটা অন্যেরাও লিখেছেন বা বলেছেন। আমার কাণ্ডজ্ঞানেও সম্ভবত রয়েছে। তবু কাহিনীর খাতিরে আরেকবার উল্লেখ করা যেতে পারে।)

মোদো কলকাতার মধ্য নিশা। চৌরাস্তার মোড়ে দুই মাতাল পরস্পরকে জাপটিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বহুদূর থেকে এই দৃশ্য দেখে সার্জেন্ট সাহেব তার সেই লাল মোটর সাইকেল যুগ্মমদ্যপের পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন, বাবুরা বাড়ি যাও। Go Home–এর পরে বিবিরা পেটাবে।

সবাই চলে গেছে। শুধু ঐ দু’জন দাঁড়িয়ে রইলেন, চুরচুর অবস্থায় দু’জনায় দু’জনকে পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাস্তায় মধ্যখানে সম্পূর্ণ নিশ্চল। সার্জেন্ট সাহেব তার মোটর সাইকেল নিয়ে তাদের পাস ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জোর করতে লাগলেন বাড়ি যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তাদের তো বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই, তাদের বক্তব্য, ‘United we stand, divided we fall’ অর্থাৎ একত্রে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকলেই তারা আছে, ছাড়াছাড়ি হলেই পড়ে যাবেন। বাড়ি যাওয়ার উপায় কি?

মিস্টার ডেভিড ওরফে শ্ৰীযুক্ত দেবীদয়াল ওরফে অমরের সমস্যা অনেক জটিল। অধিক মদ্যপান করলে ডেভিডের কদাচিৎ পদস্খলন হয়, সে তখন উদ্বাহু নৃত্য করে।

আর সে বাড়ি যাবেই বা কেন? সেখানে জারিনা বিবির উদ্যত ঝটা অপেক্ষা করছে।

বেচাল অবস্থায় রাত দুপুরে পাড়ার কুকুরদের বিচলিত না করে নিজের ঘরেও নিঃশব্দ প্রবেশ খুব সহজ নয়। সুতরাং যত রাতই হোক জারিনা জেগে উঠবেই এবং তারপর ওরকম অভ্যর্থনা, ঝাটা পেটা এবং অনাহার ডেভিড়ের মোটেই পছন্দ নয়। সুতরাং সে নানা কারণেই বাড়ি ফিরতে চায় না।

নামব্রত সঙেঘর বন্ধুরা উদ্যোগ নিয়ে আগে দুয়েকবার ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছে। দিতে গেছে। কিন্তু তার পরিণতি সুখের হয়নি। অনাদি, অনরা সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনো বহন করে চলেছে।

একবার বাদলচন্দ্র জারিনার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ডেভিডকে ঘরের মধ্যে বুকে একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। জারিনা ঘরের মধ্যে অন্ধকারে, নিঃশব্দে ওঁৎ পেতে ছিল। সে মাতল ও অসতর্ক কেরামরে কোমরে আচমকা একটা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে চোর-চোর বলে চেঁচাতে থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘনবসতি ঘিঞ্জি ও হাফন্তি অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে পিল পিল করে লোক লাঠিবল্পম-ভোজালি-চাবুক-হাতদাবটিদা ইত্যাদি নিয়ে রে রে করে বেরিয়ে আসে। পূর্বপুরুষের বহু পুণ্যে সে যাত্রায় বাদলচন্দ্র মত্ত অবস্থাতেও আত্মপরিচয় দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। বলা বাহুল্য, নামব্রত সঙেঘর সহযোগী যারা সেদিন তার সঙ্গে ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছাতে গিয়েছিল, দুর্যোগের আভাস পাওয়া মাত্রই তারা দৌড়ে পালিয়েছিল।

এখনো শীতে বর্ষায় বাদলচন্দ্রের কোমরের গাঁটটা টনটন করে।

অবশ্য এর পরেও উপায়ান্তর না থাকায়, বন্ধুরা কখনো কখনো মধ্যরাতে কিংবা তারো পরে ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছাতে গেছে। কোনোবারই অভিজ্ঞতা মনোরম হয়নি। জারিনার কেমন যেন বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায় ডেভিডের পদস্খলনের জন্যে। এরাই দায়ী। হিংস ভাষায় এবং হিংস্রর ভঙ্গিতে সে এই বন্ধুবৎসল এবং পরোপকারী বন্ধুদের তাড়া করে যেতো। একবার ‘ডাকাত ডাকাত’ করে চেঁচিয়ে একরাত্রি তালতলা। থানায় এদের হাজহ্বাসের ব্যবস্থাও করেছিল।

সে যা হোক, এখন নামব্রত সঙের সম্মুখে বিশাল সমস্যা। প্রত্যেকবার জন্মাষ্টমীর সময় তার ঢোল করতালি কাসি সহযোগে নামগান করে পথ প্রদক্ষিণ করে। বলতে গেলে এটাই নামগান সঙের বাৎসরিক প্রধান উৎ।

এই উৎব ডেভিডকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। সবচেয়ে বড় খোলটা নিপুণ হাতে ডেভিড বাজায়। তার গানের গলাও খুবই সুরেলা। তাছাড়া দীর্ঘকায়, সুদর্শন, গৌরবর্ণ ডেভিড ওরফে দেবীদয়ালই নায়কেরই মত ওই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেয়। তখন তার চন্দনচতি ললাট, গলায় জুইফুলের মালা, সাদা অঙ্গবস্ত্র ইত্যাদি দেখে কে বলবে যে এই লোকটিই জুতোর দোকানের টাইপরা সেলসম্যান।

তা সেই ডেভিডেরই দেখা নেই এবং এবার ব্রিতি খুব দীর্ঘদিনের। দেড় দুই মাস তো হবেই। হাবিলদার বাড়ির ঠেকে এত দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ডেভিড কখনো হয়নি। কখনো কখনো বড়জোর তিন সপ্তাহ হয়েছে। কিন্তু এবার বিশেষ করে এই জন্মাষ্টমীর আগে ডেভিডের এত দীর্ঘকাল দেখা নেই, ভাবা যায় না।

শেষ যেদিন ডেভিড এসেছিল, সেদিন অবশ্য বেশ গোলমাল হয়েছিল। ডেভিডকে বাড়িতে পৌঁছা’তে যেতে হয়েছিল, সেটাও রাত দেড়টা নাগাদ প্রায় চ্যাংদোলা করে। সেদিনও অভ্যর্থনা মোটেই সুখের হয়নি। ঘরে ঢোকা মাত্র ডেভিডকে এক ঝাঁপটায় মেঝেতে চিৎ করে ফেলে জারিনা বিবি জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে পর পর চিনেমাটির পেয়ালা ছোড়ে। অব্যর্থ লক্ষ্য তার, প্রথম দুটি অনন্ত এবং অমরের কপালে লাগে, অবস্থা বুঝে বাকি দু’জন দৌড় দেয়। কিন্তু রক্ষা পায় না। অনাদির ঘাড়ে এবং অসীমের পিঠে লাগে। সবাই অল্পবিস্তর আহত হয়, অমরের কপাল কেটে যায়, নীলরতনে গিয়ে দুটো সেলাই দিতে হয়েছিল।

***

নামব্রত সঙেঘর ঠেকে বসে সবাই খুব চিন্তান্বিত। ক্যালেন্ডার দেখে হিসেব কষে বেরোলো আজ পঞ্চাশদিন ডেভিডের দেখা নেই।

এদিকে বার্ষিক উৎসবের সময় সমাগত। আর দেরি করা যায় না।

মদ্যপানে মানুষের মনে এক ধরনের অলীক সাহস সঞ্চয় হয়। রাত দশটার সময় হাবিলদার বাড়ির দোকান বন্ধ হলে রাস্তায় বেরিয়ে কিছুক্ষণ জটলা করে সবাই সঙঘবদ্ধ হয়ে ঠিক করল, ঐ দজ্জাল জারিনা বিবিকে ভয় পেলে চলবে না, আমাদের বৌয়েরাই বা ওর চেয়ে কম কিসে, ডেভিডের বাড়িতে আজ যেতেই হবে, ডেভিডকে ছাড়া তো আর নগর সঙ্কীর্তন হবে না।

কিন্তু ডেভিড কোথায়? এক মাস আগে ডেভিড মারা গেছে।

ঐ রকম লম্বাচওড়া, যুবক মানুষ। সকালবেলা বাজারে গিয়ে বাজার থেকে ফিরে থলে নামিয়ে বৌয়ের কাছে এক গেলাস জল চাইলো। জল আর খাওয়া হয়নি। সামনে বিছানার ওপরে লুটিয়ে পড়ে। আঘঘণ্টা পরে হাসপাতাল বলে হার্ট ফেল।

এ খবর তো আর অনাদি-অনন্তদের কাছে পৌঁছায়নি। মাতালদের আড্ডায় এরকম হয়। একেক জন একেক প্রান্ত থেকে আসে। তার মধ্যে কেউ একদিন হঠাৎ বরবাদ হয়ে গেলে সে খবর আড্ডায় অন্যদের কাছে এসে পৌঁছায় না।

আজ বলতে গেলে একটু সকাল-সকালই এসেছ এরা। রাত এগারোটা। পাড়ার অনেক বাড়িতেই আলো জ্বলছে। লোকজন দাওয়ায়, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় চারমূর্তি গলির মধ্যে প্রবেশ করল।

এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক সামনের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে নৈশাহার শেষে রাস্তার কুকুরদের রুটি দিচ্ছিলেন। তিনি এদের দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? কাকে চান?

অনাদি বলল, আমরা ডেভিডের বন্ধু।

অনন্ত বলল, আমরা ঐ সামনের বাড়ির ডেভিডের কাছে এসেছি।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, আপনারা কিরকম বন্ধু? জানেন না একমাস হল ডেভিড মারা গেছে।

এই সংবাদে হতভম্ব হয়ে অনাদি-অনপ্পো পিছু হটছিল। তাদের মনের মধ্যে দুটো জিনিস কাজ করছিল। একটা হল বন্ধুর মৃত্যুর জন্য শোক এবং অন্যটা হল জারিনা বিবির আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার থেকে নিষ্কৃতি জনিত স্বস্তি।

কিন্তু ইতিমধ্যে নিজের ঘরের জানালা দিয়ে এদের দেখে স্বয়ং জারিনা বিবি রাস্তায় নেমে এসেছে। এরা জারিনাকে দেখে দৌড় দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো এদের পর্যবেক্ষণে রেখেছিল এবং দৌড় দিলেই তাড়া করবে। বুঝতে পেরে, দ্রুত পা চালিয়ে পালাতে গেল।

এদের ভাবগতিক দেখে জারিনা দ্রুতপদে এগিয়ে এলো, যাবেন না। আপনারা যাবেন না। আপনাদের কাছে আমার দরকার আছে।

কিছুই বুঝতে না পেরে অনাদি-অনন্তরা দাঁড়িয়ে গেল। তবে খুব ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। জারিনা বিবির চোখেমুখে চেহারায় রাগের ভাব দেখা যাচ্ছে না।

জারিনা এদের ডেকে নিয়ে তার ঘরে বসাল। একপাশে একটা বড় খাট, তার ওপরে এক পাশে দুই পিতৃহীন নাবালক ঘুমোচ্ছে। এ পাশটায় জারিনা শোয়। সেখানে দু’জনে বসল। আর দু’জন দুটো চেয়ারে বসল, চেয়ার দুটো এবং খাটের মাঝখানে একটা ছোট গোল টেবিল।

জারিনা বলল, আপনারা একটু বসুন। আমি কতদিন ধরে আপনাদের কথা ভাবছি। এই বলে সে টেবিলের দেরাজ থেকে একটা চাবি বার করে ঘরের এক পাশের সাবেকি দিনের বড় কাঠের আলমারিটা খুলল।

অনাদি ফিসফিস করে অনন্তকে বলল, পিস্তল-টিস্তল বার করছে বোধহয়। অন্য দু’জনও মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।

কিন্তু পিস্তল-টিস্তল নয়। জারিনার হাতে একটা বোতল দুনম্বর বাংলা মদ। মৃত্যুর দিন বাজার করার পথে কিনে এনেছিল ডেভিড। যখন ঠেকে যেতো না, বাজার থেকে আসার সময় একেক দিন এইরকম কিনে আনতো।

বোতলটা অটুট রয়ে গেছে। জারিনা এসে বোতলটা টেবিলের ওপর রাখল। তারপরে পাশের রান্নাঘরে গিয়ে গোটা দুয়েক গেলাস আর তিনটে কাপ নিয়ে এল।

চারজনের জন্যে পাঁচটা পাত্র। অনাদি ধরে নিল জারিনাও খাবে। বোতলের ছিপিটা খুলতে খুলতে অনাদি মনে মনে বলল, সাবাস জারিনা।

বোতলটা ভোলা হয়ে যেতেই জারিনা সেটা নিজের হাতে নিয়ে চারটে পাত্রে সমান করে ভাগ করে দিল। আর পঞ্চম পাত্রে খুব কম ঢালল।

ভদ্রতা করে অনন্ত বলল, আপনি নিজে এত কম নিলেন?

জারিনা বলল, এটা আমার নয় ডেভিডের।

চারপাত্র নিঃশেষ করে চার বন্ধু উঠে পড়ল। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ডেভিডের পাত্রের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে জারিনা তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখে জল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *