০৯.রায়-নন্দিনী – নবম পরিচ্ছেদঃ কাননাবাসে

নবম পরিচ্ছেদঃ কাননাবাসে

প্রধান সেনাপতি মাহতাব খাঁ যশোর হইতে প্রস্থানের কিঞ্চিৎ পরেই প্রতাপাদিত্য তাঁহাকে ধরিয়া আনিবার জন্য কালিদাস ঢালীকে আদেশ করিলেন। ঢালী মহাশয় অনুসন্ধান করিয়া কোথাও খাঁ সাহেবকে পাইলেন না। পরে নদীতটে যাইয়া শুনিলেন যে, খাঁ সাহেব নৌকা করিয়া বামনী নদী উজাইয়া গিয়াছেন। কালিদাস যাইয়া রাজাকে সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। ঘটনা শুনিয়া প্রতাপাদিত্যের রোষানল শীতল হইয়া গেল। মনে একটু অনুশোচনার উদ্রেক হইল। মাহতাব খাঁই প্রতাপের দক্ষিণ হস্ত। মাহতাবের বাহুবল এবং রণ-কৌশলেই প্রতাপের যা কিছু প্রভাব ও দম্ভ। মগ ও পর্তুগীজেরা কতবার মাহতাব খাঁর দুর্দম বিক্রমে রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়াছে। প্রতাপ ভাবিলেন, মাহতাব খাঁ শক্রপক্ষে যোগদান করিয়া তাঁহার ঘোরতর অনিষ্ঠ সাধন করিতে পারেন। তিনি যদি কেদার রায় বা রামচন্দ্র রায়ের অথবা ভুলুয়ার ফজল গাজীর সেনাপতিত্ব গ্রহণ করেন, তাহা হইলে প্রতাপের পক্ষে বিষম সঙ্কট। এক্ষণে হয় তাঁহাকে ফিরাইয়া আনা, না হয় নিহত করাই মঙ্গলজনক বলিয়া বোধ হইল। প্রতাপ তখনি কালিদাসকে এক শত বন্দুকধারী সৈন্য সহ একখানি দ্রুতগামী তরী লইয়া মাহতাব খাঁকে ধরিয়া আনিবার জন্য আদেশ করিলেন। কালিদাস কালবিলম্ব না করিয়া শত সৈন্য সমভিব্যবহারে শীঘ্র তরণীতে আরোহণ করিলেন। পঞ্চাশ দাঁড়ে প্রকাণ্ড ছিপের আকৃতি নৌকা কল্‌ কল্‌ করিয়া বামনীর ঊর্মিলাস্রোত বিদারণ করতঃ মাহতাব খাঁর উদ্দেশ্যে ছুটিয়া চলিল।

মাহতাব খাঁর নৌকা ছয় দাঁড়ের হইলেও ক্ষুদ্র বলিয়া বেশ ছুটিয়া চলিয়াছিলেন। তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে, সারারাত্রি নৌকা বাহিতে পারিলে, প্রাতঃকালে কিঞ্চিৎ বেলা উদয়েই প্রতাপাদিত্যের এলাকা ছাড়াইতে পারিবেন। প্রতাপাদিত্যের এলাকা ছাড়াইতে পারিলেই তিনি নিরাপদ। মাল্লারা দাঁড় ফেলিতে যাহাতে শৈথিল্য না করে, সেজন্য তিনি অর্ধরাত্রি পর্যন্ত জাগিয়া রহিলেন। মাল্লারা প্রাণপণে নৌকা বাহিতে লাগিল। মাঝি খাঁ সাহেবকে জাগিয়া থাকিতে দেখিয়া তাঁহাকে শয়ন করিবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতে লাগিল এবং নৌকা যে প্রভাতেই সলিমাবাদের সীমা অতিক্রম করিয়া ঈসা খাঁর এলাকায় পৌঁছাইতে পারিবে, এ বিষয়ে খুব বড় মুখে বড়াই করিতে লাগিল।

মাহতাব খাঁ মাঝির ব্যগ্রতা এবং মাল্লাদিগের প্রতি দ্রুত নিক্ষেপ পুনঃ পুনঃ সাবধানতা দর্শনে নিশ্চিন্ত হইয়া শয্যায় দেহ পাতিলেন এবং অল্পক্ষণে। নিদ্রাভিভূত হইয়া পড়িলেন। মাহতাব খাঁ নিদ্রিত হইয়া পড়িলে মাঝি ও মাল্লারা একস্থানে নৌকা লাগাইয়া সকলেই পলায়ন করিল। তাহাদের পলায়ন করিবার কারণ যে প্রতাপাদিত্যের কঠোর দণ্ডভীতি, তাহা বোধ হয় পাঠক বুঝিতে পারিতেছেন। খাঁ সাহেব যখন যশোরে নৌকায় আরোহন করেন, তিনি যে যশোর হইতে পলায়ন করিতেছেন তখন মাঝিরা তাহা বুঝিতে পারে নাই। তিনি সলিমাবাদের বিশেষ কোন গোপনীয় রাজকার্যে যাইতেছেন বলিয়াই তাহারা বুঝিয়াছিল; কিন্তু মনোহরপুর হইতে নৌকা ছাড়িলে অরুণাবতী যখন পলায়নমান-বেশে নৌকায় উঠিল তখন তাহারা বুঝিল যে, সেনাপতি প্রতাপাদিত্যের কন্যাকে কুলের বাহির লইয়া পলায়ন করিতেছেন। তাহারা নিজেদের পরিণাম ভাবিয়া উদ্বিগ্ন হইল; তাহারই মাহতাব খাঁর পলায়নে করিয়াছে, প্রতাপ ইহা সহজেই জানিতে পারিবেন। জানিতে পারিলে তাহাদিগকে যে জান, বাচ্চা বুনিয়াদসহ জ্বলন্ত আগুনে পুড়াইয়া মারিবেন, ইহা স্মরণ করিয়া শিহরিয়া উঠিল। তাহাদের গায়ে ঘর্ম ছুটিল। অন্যদিকে সেনাপতির ভয়ে নৌকা বাহনেও অস্বীকৃত হইবার সাহস ছিল না। ঘটনা যতদূর গড়াইয়াছে তাহাতেই তাহাদের প্রাণরক্ষা হইবে কি না সন্দেহের বিষয়। তবে নিজেদের অজ্ঞতা জানাইয়া সেনাপতির রাজকন্যা হরণের সংবাদ রাজাকে অর্পণপূর্বক আপনার নির্দোষত্ব জ্ঞাপন করিতে পারিলে হয়ত প্রতাপাদিত্য তাহাদিগকে ক্ষমা করিতে পারেন, এই বিশ্বাসে তাহারা পলায়ন করিল। সেনাপতি সাহেব নিজের ব্যস্ততা এবং নিজের বিপচ্ছিন্তার মধ্যে মাঝিদের বিপদের কথা একবারও ভাবিবার অবসর পান নাই। তিনি যেরূপ উদার ও মহদন্তঃকরণের লোক ছিলেন, তাহাতে মাঝিরা নিজেদের বিপদের কথা খুলিয়া বলিলে, তাহাদিগকে নিজের সহস্র বিপদের মধ্যেও বিদায় করিয়া দিতেন।

যাহা হউক, মাঝিরা পলায়ন করিবার প্রায় একপ্রহর পরে মাহতাব খাঁর নিদ্রা ভাঙ্গিল। তিনি দাঁড়ের শব্দ না শুনিয়া নৌকার ভিতর হইতে বাহির হইলেন। বাহির হইয়া দেখিলেন, মাঝি-মাল্লার কোন নিদর্শন নাই। নৌকা একগাছি রজ্জু দ্বারা একটি গাছের মূলে বাঁধা রহিয়াছে। প্রকৃত রহস্য বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হইল না। তৎক্ষণাৎ তিনি অরুণাবতীকে জাগাইয়া সমস্ত বৃত্তান্ত বুঝাইয়া বলিলেন। মাঝিদের পলায়নে প্রতাপ-দুহিতা নিতান্ত উদ্বিগ্ন ও অধীর হইয়া পড়িল। পাছে বা পশ্চাদ্ধবিত রাজ-অনুচরদের হস্তে ধৃত হওয়ায় উচ্ছ্বসিত জীবনের উদ্দাম সুখ ও প্রেমের কল্পনা মরীচিকায় পরিণত হয়। তাহার হৃদয়-তরণীর ধ্রুবনত্র, তাহার তৃষ্ণার্ত জীবনের সুশীতল অমৃত-প্রশ্রবণ, তাহার জীবনাকাশের চিত্তবিনোদন লোচনরঞ্জন অপূর্ব জলধনু পরে বা বিপদগ্রস্থ হয়, এবম্বিধ চিন্তায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িল। মাহতাব খাঁ মুহুর্তে চিত্ত স্থির করিয়া অরুণাবতীকে করুণাময় আল্লাহতালার উপর নির্ভর করিতে বলিয়া শেষে বলিলেন, “প্রিয়তমে! এ বিপদে তুমি যদি কোনরূপে নৌকার হালটি ধরে রাখতে পার, তা হলে আমি একাই দাঁড় ফেলে নিয়ে যেতে পারি। এছাড়া আর কোন উপায় নাই। তুমি যখন হতভাগের জীবন-সঙ্গিনী হয়েছে, তখন দুঃখ ভোগ করা ছাড়া উপায় কি?”

মাহতাব খাঁ এমন গভীর অনুরাগ এবং শুভ্র সহানুভূতির সহিত কথাটি বলিলেন যে, প্রতাপ-বালার কর্ণে তাহা অমৃতবর্ষণ করিল। নৌকায় আরোহণ করা পর্যন্ত মাঝিদের জন্য লজ্জায় পরস্পর কোন কথাবার্তা বলিতে পারে নাই। এক্ষণে লোক-সঙ্কোচ দূর হওয়ায় এবং বিপদ সমাগমে উভযের হৃদয়, চক্ষু ও জিহবা মুক্তাবস্থায় সুরভিত প্রেমের অমিয় দৃষ্টি ও মধুর ভাষা উদগীর্ণ করিতে লাগিল। হাতুড়ির আঘাত যেমন দুইখণ্ড উত্তপ্ত ধাতুকে পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্মিলিত করিয়া দেয়, বিপদও তেমনি অনুরাগোষ্ণ হৃদয়কে একেবারেই মিলাইয়া দেয়। অগ্ন্যুত্তাপে অল্পপরিমিত দুগ্ধ যেমন বৃহৎ পাত্রকে পূর্ণ করিয়া ফুলিয়া উঠে, বিপদের আঁচেও তেমনি হৃদয়ের কোণে যে প্রেম, যে সহানুভূতি নীরবে আলস্যশয্যায় পড়িয়া ঘুমাইতেছে তাহাও জোরেশোরে দশগুণ উচ্ছ্বসিত হইয়া হৃদয়ের কুল ভাসাইয়া অপর হৃদয়কে ভাসাইয়া ফেলে। তখন দুই মিশিয়া এক হয়।

অরুণাবতী বাল্যকাল হইতেই নৌকা-ক্রীড়ারত ছিল বলিয়া হাল ধরিতে অভ্যস্তা ছিল। এক্ষণে বিপদকালে প্রতাপ-কুমারী হাল ধরিয়া বসিল, আর খাঁ সাহেব বীর-বাহুর বিপুল বলে দুই হস্তে দাঁড় ফেলিতে লাগিলেন। নৌকা নদীর খর-প্রবাহ কাটিয়া কল্‌ কল্‌ করিয়া ছুটিয়া চলিল। ছয় দাঁড়ে নৌকা যেরূপ দ্রুত চলিয়াছিল, মাহতাব খাঁর দুই দাঁড়েও নৌকা প্রায় সেইরূপ ছুটিল। মাহতাব খাঁ তালে তালে দাঁড় ফেলিতেছেন, আর সুন্দরী অরুণাবতী সাবধান-হস্তে পরস্পরের হাসিতে উভয়ের হৃদয়ে যে কোটি নক্ষত্রের স্নিদ্ধ আলোক মরকত-দ্যুতির ন্যায় জ্বলিতেছে-ঐ নীলাকাশের তারাগুলি যদি যে প্রেমামৃতমাখা দিব্য দীপ্তি দর্শন করিত, তাহা নক্ষত্রখচিত জলদ-বিমুক্ত অনন্ত নভোমণ্ডল, নিন্মে শ্যামলা ধরণী বক্ষে রজত-প্রবাহ বামনী নদী কোটি তারকার প্রতিবিম্ব হৃদয়ে ধারণ করতঃ উদ্দাম গতিতে কল্‌ কল্‌ ছল্‌ ছল্‌ করিয়া ফুটন্ত যৌবনা প্রেমোন্মাদিনী রসবতী যুবতীর ন্যায় সাগরসঙ্গমে ছুটিয়াছে; আর তাহার বক্ষে নবীন প্রেমিক-প্রেমিকা দাঁড় ফেলিয়া হাল ধরিয়া অনন্ত আনন্দ ও অপার আশায় হৃদয় পূর্ণ করিয়া নৌকা বাহিয়া চলিয়াছে। মরি! মরি!! কি ভুবনমোহন চিত্তবিনোদন লোচনরঞ্জন দৃশ্য! যে বিপদ এমন অবস্থায় সংঘটন করে, তাহা সম্পদ অপেক্ষাও প্রার্থনীয় নহে কি?

নৌকা ছুটিয়াছে। আকাশে তারকা দলও ছুটিয়া চলিয়াছে। বামনী ছুটিতেছে, বাতাস ছুটিতেছে। এ জগতে ছুটিতেছে না কে? জগৎ পর্যন্ত, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত ছুটিয়া চলিয়াছে। অনন্তকাল হইতে ছুটিতেছে, অনন্তকাল ছুটিবে। এ ছোটার কিছু শেষ নাই, সীমা নাই। রজনী পূর্ব গোলার্ধ ত্যাগ করিয়া পশ্চিম গোলার্ধে ছুটিল-ঊষার শুভ্র আলোক-রেখা ছুটিয়া আসিয়া অম্বর-অঙ্গ-বিলম্বিত শ্বেত পতাকার ন্যায় ফুটিয়া উঠিল। নদীব ঈষৎ আলোকিত হইল। শীতল-সলিল-শীকর-সিক্ত-মৃদু-সমীরণ নায়ক-নায়িকার বাবরী দোলাইয়া কুন্তল উড়াইয়া প্রতি মুণ্ডর্তে ছুটিয়া চলিল। মাহতাব খাঁর ঈষৎ স্বর্ণতা-মণ্ডিত শুভ্র-রজত-ফলকবৎ ললাটদেশে গুরুশ্রমে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম ফুটিয়াছে। মাহতাব খাঁ দাঁড় তুলিয়া সম্মুখের দিকে স্থির ও দূরগার্মিনী দৃষ্টিতে চাহিলেন-দেখিলেন, দূরে-অতিদূরে একখানি প্রকাণ্ড নৌকায় কয়েকটি বাতি জ্বলিতেছে! হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল-আবার দেখিলেন,-পকেট হইতে দূরবীণ বাহির করিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন, তাহাতে বুঝিলেন বিপদ আসন্ন। অরুণাবতীও দেখিল, কেবল আলোক ছুটিয়া আসিতে দেখা যাইতেছে। অরুণাবতী ব্যাঘ্রসন্দর্শনভীতা মৃগীর ন্যায় কাঁপিয়া উঠিল!

মাহতাব খাঁ প্রকৃত বুদ্ধিমান বীরপুরুষের মত মুহুর্ত মধ্যে চিত্ত ও কর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিলেন। অরুণাকে বলিলেন, “অরুণে! ব্যাকুল হইও না, আল্লাহ আছেন। আমাদের নৌকায় বাতি নাই, সুতরাং ওরা আমাদিগকে দেখতে পায় নাই। চল, নদীর তীরবর্তী জঙ্গলে আশ্রয় লওয়া যাক। নৌকা বেয়ে ওদের হস্ত অতিক্রম করা অসম্ভব। মুসলমান কখনও শত্রু দেখে আত্মগোপন করে না, কিন্তু আজ আত্মগোপন না করলে অমূল্য কোহিনূর তোমাকে রক্ষা করতে পারব না। নৃপকিরীট-শীর্ষ-শোভী কোহিনূর কক্ষনও কুক্কুরের গলায় অর্পণ করব না। অরুণা! তুমি আর বিলম্ব করো না, সমস্ত দ্রব্য গুছিয়ে পেটিকা-বদ্ধ কর। আমি এখন নৌকা তীরে লাগাচ্ছি।

অতি অল্প সময়েই মধ্যেই নৌকা তীরে লাগিল। মাহতাব খাঁ দ্রুত নামিয়া রজ্জু দ্বারা একটি বৃক্ষমূলে নৌকা বাঁধিলেন। তৎপর দুইজনে সমস্ত জিনিসপত্র নামাইয়া জঙ্গলের মধ্যে জমা করিলেন। সমস্ত দ্রব্য কথায় পুঞ্জীকৃত করিয়া নৌকার ছই ও পাটাতনের তক্তা-সকল গভীর জঙ্গলে রাখিয়া নৌকা ডুবাইয়া দিলেন। বামনীর উভয় পার্শ্বে সেই স্থানে বহুদূরব্যাপী অরণ্য। নিকটে কোথাও লোকালয় নাই। জঙ্গলে নানা জাতীয় বৃক্ষ। জঙ্গল এমন নিবিড় এবং বিশাল ছিল যে, তখন এখানে দলে দলে মৃগ বিচরণ এবং ব্যাঘ্র গর্জন করিত। পূর্বে শিকার উপলক্ষে দুই তিনবার মাহতাব খাঁ এ-জঙ্গলে পদার্পণ করিয়াছিলেন, তাই তিনি এ কাননের বিষয় অবগত ছিলেন। খাঁ সাহেব জিনিসপত্র একস্থানে রাখিয়া একস্থানে একটু দূরে বৃক্ষের নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করিয়া অরুণাকে লইয়া বসিলেন। হিংস্র শ্বাপদভীতির জন্য তিনি তাহার ‘খুনরেজ’ (রক্তপিপাসু) নামক তরবারি কোমর হইতে মুক্ত করিয়া হস্তে ধারণ করিলেন। জঙ্গলের ফাঁকের ভিতর দিয়া দূরবীণ ধরিয়া মাহতাব খাঁ শত্রুতরী পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। ক্রমে ঊষার আলোক আরও স্ফুটতর হইয়া উঠিল। অর্ধ ঘন্টার মধ্যে প্রতাপাদিত্যের প্রকাণ্ড নৌকা দাঁড়ের আঘাতে নদী বক্ষে ঊর্মি তুলিয়া এবং শব্দে উভয় তটের কানন-হৃদয়ে প্রতিধ্বনি জাগাইয়া মাহতাব খাঁ ও অরুণাবতীর আশ্রয়দাত্রী বনভূমি পশ্চাতে ফেলিয়া সলিমাবাদের দিকে ছুটিয়া চলিল। মাহতাব খাঁ অজু করিয়া ভক্তিপ্লুতচিত্তে বামনীর তটস্থ শ্যাম দুর্বাদলের কৃতজ্ঞতার অশ্রুবারি বর্ষণ করিলেন। অনন্তর মঙ্গলময় আল্লাহতালার পদারবিন্দে তরুণ অরুণিমা-জালে আকাশ-মেদিনী বামনীর চঞ্চল হৃদয় এবং কাননের বর্ষাবারি-বিধ্যেত সরস-শ্যামল-মসৃণ তরুবল্লীর পত্রে স্বর্ণ-চূর্ণজাল ছড়াইয়া অপূর্ব শোভা ফুটাইলে মাহতাব খাঁ অরুণাবতীর কর ধারণ করতঃ আশ্রয়ের উপযুক্ত স্থান অনুসন্ধানে কিঞ্চিৎ ভিতরে প্রবেশ করিলেন। অরণ্য-শাল, তমাল, সুন্দরী, ঝাউ, অশ্বত্থ, কদম্ব, বেত, কেতকী, হরীতকী, আমলকী, আম্র, খর্ৎুর, পনস প্রভৃতি জাতীয় অসংখ্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বৃক্ষে পরিপূর্ণ। কোথায়ও নানাজাতীয় গুল্ম ও তৃণ বাড়িয়া ভূমি আচ্ছন্ন এবং অসম্য করিয়া ফেলিয়াছে। কোথায়ও বা মনুষ্য-হস্তকৃত সযত্ন-রচিত উদ্যান অপেক্ষাও বনভূমি মনোহর। রাশি রাশি কেতকী ও কদম্ব ফুল ফুটিয়া প্রভাত সমীরে গন্ধ ঢালিয়া সমস্ত বনভূমি আমোদিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘুঘু, ফিঙ্গা, দোয়েল, শ্যামা, বন্য, কুক্কুট, বুলবুল, টিয়া প্রভূতি অসংখ্য বিহঙ্গ বিবিধ স্বরে মধুর কুজনে প্রভাত-কানন চঞ্চল ও মুখরিত করিয়া তুলিয়াছে। বন-প্রকৃতির সরস শ্যামল নির্মল নগ্ন শোভা দেখিয়া অরুণার নব প্রেমাকুল চিত্ত যেন প্রেমের আভায় আনন্দে ফুটিয়া উঠিল।

উভয়ে কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়া এক নির্মল-সলিলা সরসী দেখিতে পাইলেন। ক্ষুদ্র সরসীর চারিপার্শ্বে মখমল-বিনিন্দিত কোমল ও শ্যামল শম্পরাজি। তাহার মধ্যে বর্ষাঋতুজ নানাবিধ বিচিত্র বর্ণের তৃণৎজাতীয় পুস্প ফুটিয়া শ্যামল ভূমি অপূর্ব সুষমায় সাজাইয়াছে। সরোবরের জলে অসংখ্য মৎস্য ক্রীড়া কুর্দন করিতেছে। মাঝে মাঝে শাপলা ও কুমুদ ফুটিয়া মৃদু হিল্লোলে দুলিয়া দুলিয়া নাচিতেছে। জল এত পরিস্কার যে, নীচের প্রত্যেকটি বালুকা কণা দেখা যাইতেছে। রক্ত-রেখা-অঙ্কিত সমুজ্জ্বল শফরীর ঝাঁক রূপের ছাঁয় সরসীগর্ভ আলোকিত করিয়া ভ্রমণ করিতেছে। আকাশের নানাবর্ণ রঞ্জিত অম্বুদমালা আকাশসহ সরসীর তলে শোভা পাইতেছে। কি বিচিত্র দৃশ্য! কি মনোমোহিনী শোভা! দেখিয়া দেখিয়া প্রতাপ-তনয়া একেবারে মুগ্ধ-লুব্ধ এবং বিস্মিত হইয়া পড়িল। অরুণা অরণ্যভূমির উজ্জ্বল শ্যামল-বিনোদ কোমল শোভা আর কখনও দর্শন করে নাই। সুতরাং তাহার প্রেমাকুল তরুণ চিত্ত যে বনভূমির শান্তি সম্পদে, বিচিত্র সৌন্দর্যে এবং নির্জন প্রেমের সরস পুলকে মাতিয়া উঠিবে, তাহা ত অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাহার এত আনন্দ হইল যে, ইচ্ছা হইতেছিল সে একবার পুস্পখচিত গালিচা-বিনিন্দী কোমল ঘাসের উপর চঞ্চলা হরিণী বা প্রেমোন্মাদিনী শিখিনীর ন্যায় নৃত্য করে। মাহতাব খাঁও অরণ্য প্রকৃতির স্নিগ্ধ শোভা এবং মোহন দৃশ্যে মুগ্ধ হইয়া গেলেন। ক্ষণেকের জন্য তাঁহার চিত্তা নগরের বণ্ড লোক সহবাস পূর্ণ অশান্তি ও কোলাহলময় জীবনের প্রতি ধিক্কার দিল। অলক্ষিতে তাঁহার প্রেমমদিরাকুল চিত্তের মর্ম হইতে প্রভাত-কানন মুখরিত করিয়া মধুর কণ্ঠে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত ধ্বনিত উঠিলঃ

“দর ফসলে বাহার আগার তনে হুর শিরস্তী
পুর ময়ে কদাহ্‌ বমন দেহদ বরলবে কীসত,
গরচে বর্‌হর্‌ কসে সখুন্‌ বাশদ জীশ্‌ত।
সগ্‌ বে বমন্‌ আরজাঁকে বরম্‌ নামে বেহেশত”

মাহতাব খাঁ সুললিত স্বরে সেই নির্জন কাননে সুধাকণ্ঠ বিহঙ্গাবলীর মধুর কুজনে মধু বর্ষণ করিয়া কয়েকবার ‘রুবাইয়াত’টি গাহিলেন। অরুণাবতী ফার্সী জানিত না, কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তে মাহতাব খাঁকে জিজ্ঞাসা করিল,-“কি গাইছেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

মাহতাবঃ কি গাইব! তোমারই গান গাইছি।

অরুণাঃ আমার গান কেমন? গজলটা ভেঙ্গেই বলুন না!

“আচ্ছা তবে শোন,” এই বলিয়া-প্রস্ফুটিত শুভ্র রজনীগন্ধা মারুত হিল্লোলে যেমন করিয়া ফুটন্ত যৌবনা গোলাপ-সুন্দরীর রক্তব স্পর্শ করে, মাহতাব খাঁও তেমনিভাবে প্রণয়-সোহাগে চম্পক অঙ্গুলে অরুণাবতীর গোলাপী কপোল টিপিয়া বলিলেন, “কবি বলিতেছেন যে, আনন্দময় বসন্তকাল পুস্পিত নিকুঞ্জ কাননে যদি কোন অস্পরীবৎ সুন্দরী অর্থাৎ অরুণাবতী কোমল করপল্লবে এক পাত্র মদিরা আমার অধরে ধারণ করে, তাহা হইলে কুকুর আমা অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ, যদি আর কখনও বেহেশত কামনা করি।”

অরুণা রুবাইয়াতের ব্যাখ্যা শুনিয়া ঈষৎ সলজ্জ কটাক্ষ হানিয়া স্মিত হাসিয়া বলিল, “বটে! কবি ত খুব রসিক।”

মাহতাবঃ আর আমি বুঝি অরসিক?

অরুণাঃ কে বলল?

মাহতাবঃ ভাবে!

অরুণাঃ কি প্রকারে?

মাহতাবঃ তবে মদিরাপাত্র কোথায়?

অরুণাঃ সে যে বসন্তকালে।

মাহতাবঃ এ বর্ষাকাল হলেও এ কাননে এখনও বসন্ত বিরাজমান।

অরুণাঃ আচ্ছা, বসন্তই যেন হ’লে; কিন্ত এখানে মদিরা কোথায়? আর তুমি মুসলমান, মদ্য যে তোমার জন্য হারাম।

মাহতাবঃ কবি যে মদ্যের কথা বলেছেন, তা’ হারাম নহে।

অরুণাঃ সে আবার কোন মদ্য?

“সে এই মদ্য” এই বলিয়া মাহতাব খাঁ যুবতীকে ভুজপাশে জড়াইয়া অধরে অধর স্থাপন করিলেন। অধল-রসামৃত পানে উভযের পুলকিত শিহরিত এবং বিমোহিত হইলেন। অরুণাবতী দেখিল সমস্ত পৃথিবী যেন সুধারসে বিপ্লাবিত। সহসা একটা বুলবুল উড়িয়া আসিয়া অরুণাবতী সেই বিহঙ্গের দৃষ্টিতে লজ্জিত হইয়া আনত চুতে চুম্বনাকৃষ্ট মুখ সরাইয়া লইল। যুবতী-হৃদয় যৌবনতরঙ্গে যেমন প্রেমাকুল, লজ্জায় তেমনি সদা অবগুণ্ঠিত।

মাহতাব খাঁ সরোবরের অদূরে গোলাকারে ঘণ সন্নিবিষ্ট তালবৃ পূর্ণ এশটি উচ্চস্থান দেখিতে পাইলেন। তাল গাছগুলির ফাঁকে বেতের লতা এমন ঘন ভাবে জন্মিয়াছে যে, বাহির হইতে মধ্যস্থানের নির্মল তৃণাচ্ছাদিত স্থানটুকু সহসা দেখা যায় না। অরুণাবতীও সেইস্থানে কানন-বাসের কুটীর নির্মাণের জন্য পছন্দ করিল। একদিকের কিঞ্চিৎ বেত কাটিয়া দ্বার প্রস্তুত করা হইল। অতঃপর ছোট ছোট দেবদারু ও সুন্দরী গাছ কাটিয়া মঞ্চ প্রস্তুতপূর্বক নৌকার ছই এবং গোলপাতার সাহায্যে দুইটি রমণীয় কুটীর প্রস্তুত করা হইল। কাঁচা বেত চিবিয়া তদ্বারা বন্ধনীর কার্য শেষ করা হইল।

প্রতাপাদিত্যের নৌকা বামনী নদী হইতে ফিরিয়া না গেলে অরুণাকে লইয়া সেই ভীষণ জঙ্গল অতিক্রম করতঃ অন্যত্র যাওয়া মাহতাব খাঁর পক্ষে নিতান্ত অসুবিধা ছিল। কয়েক ক্রোশ পশ্চিমে আর একটি নদী আছে। সেখানে সহসা নৌকা পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। এদিকে নৌকা ব্যতীত কোন নিরাপদ স্থানে যাইবার সুবিধা নাই। কারণ তখন সুন্দরবনের এই অঞ্চল অসংখ্য নদী-প্রবাহে বিভক্ত ও বিধৌত ছিল। হেমন্তকাল হইতে বৈশাকের শেষ পর্যন্ত এই সমস্ত অরণ্যে লোকের খুব চলাচল হইত। নল, বেত এবং নানাজাতীয় কাষ্ঠ আহরণের জন্য বহু লোকের সমাগম হইত। কিন্তু বৃষ্টিপাত আরম্ভ ও বর্ষা সূচনা হইলেই এই সমস্ত অরণ্য জনমানব-শূন্য হইয়া পড়িত। মাহতাব খাঁ একাকী হইলে, এই বনভূমি অতিক্রম করিয়া প্রতাপের রাজ্যের বাহিরে চলিয়া যাইতেন, কিন্তু অরুণাবতীর বিপদ ও ক্লেশ ভাবিয়া সেই কাননেই আবাস কুটীর রচনা করিলেন। বিশেষতঃ অরুণাবতী এবং মাহতাব খাঁর প্রেম-উচ্ছ্বসিত হৃদয়, কিছুদিন এই রমণীয় কাননাবাসে বাস করিবার জন্যও ব্যাকুল হইয়াছিল। নৌকায় রন্ধন করিবার পাতাদি সমস্তই ছিল। প্রায় দুই মণ অত্যুৎকৃষ্ট চাউল, কিছু ডাল, ঘৃত, লবণ ও অন্যান্য মশলা যাহা ছিল, তাহাতে দুইজনের দুই মাস চলিবার উপায় ছিল। বনে হরিণ, নানাজাতীয় খাদ্য পক্ষী এবং সরোবরে মৎস্যের অভাব ছিল না। মাহতাব খাঁ প্রথম দিবসেই এক হরিণ শিকার করিয়া তাহার গোশত কাবাব করিয়া অরুণাবতী সহ পরমানন্দে উদরপূর্তি করিলেন।

অরুণাবতী মাহতাব খাঁর নিকট ইসলামের পবিত্র কলেমা পড়িয়া মুসলমান ধর্মে দীতি হইল। অপাততঃ আত্মরক্ষার জন্য উভয়েই সেই নিবিড় বনে বাস করিতে লাগিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *